
“কেউ যায় না/ শুধু জায়গা বদলে বদলে/ সব কিছুই/ জায়গা বদলে বদলে/ সকলেই/ থাকে।“
আমাদের পুবদিকের জানলা দিয়ে নিচের দিকে তাকালে যে টালিছাদ বাড়িটা দেখা যায়, তার ইটের দেয়ালে গতকাল সকাল থেকে নীল রঙের প্রলেপ লাগতে শুরু করেছে। নতুন নীল রং। যেন আশ্বিনের আকাশ। ওই বাড়িটার মানুষজনের সাথে আমার ব্যাক্তিগত চেনাশোনা নেই। কেবল সকালে-রাতে একগুচ্ছ সম্পর্ক লক্ষ্য করি। সবুজ হাওয়াই চটি, বেতের চুপড়ি, ছেঁড়া টেডি বিয়ার, কালো চশমা, হাতল ভাঙা চেয়ার, বেগুনি কামিজ – এসবের দৈনন্দিনতায় আঁচ করে নিতে চাই টালিছাদের নিচে বসবাসকারী নারীপুরুষদের, যেমনটা চিনতে চেয়েছিলাম সেই ইমরান নামের কিশোরকে, যার জন্য দিদি জাসমিন ক্যামকর্ডারে গুছিয়ে রাখছিল সুখ-দুঃখ, যেমনটা বুঝে নিচ্ছিলাম ওই দেশপান্ডে আন্টিকে, যে যত্নে লালন করে নিঃসঙ্গ ইলার ভালো থাকা-খারাপ থাকা।
লাঞ্চবক্স দেখে এলাম। দু’বছর আগে, সম্পর্ক নিয়ে তৈরী হওয়া আরেকটা ছবির কথা খুব মনে পড়ছে। ধোবিঘাট।
বাতাসে কীসের ডাক শোনো
__________________
আমেরিকান ব্যাঙ্কের চাকরি ছেড়ে শাই এসে পড়েছিল মুম্বইতে, ছবি তোলার নেশায়। শেখও সৌদি আরব থেকে মুম্বই শহরে আসে, একটা চাকরি জোটায় সরকারি দফতরে, চায় মেহেরুন্নিসার সাথে ঘর বাঁধতে। শাইয়ের সাথে অরুণের রাত্রিযাপন একটা বিচ্ছিন্ন ঘটনা, অন্তত অরুণ তাই মনে করেছিল। কিন্তু শহর খুঁড়তে খুঁড়তে শাইয়ের দেখা হয়ে যায় মুন্নার সঙ্গে। তরুণ ধোপা মুন্না, অভিনেতা হতে চাওয়া মুন্না। গড়ে ওঠে একটা প্রত্যাশাহীন, দায়বদ্ধতাহীন বন্ধুত্ব।
ক্রমাগত উপেক্ষা করেও ফার্নান্ডেজ শেষমেশ একদিন বাপ-মা মরা ছেলেটাকে ব্যালান্স শিটের হিসেবগুলো কষে ফেলতে বলে। হোটেলে কাজ করা শেখের স্বভাবতই ভুল হয়। ফার্নান্ডেজ সে ভুলের দায় নিজের ঘাড়ে নেয়। শেখের প্রমোশন আটকে যায়। তবুও নিকাহর দিন পাত্রপক্ষ হিসেবে শেখের ডানদিকে দেখা যায় একা ফার্নান্ডেজকে।
সে রাতে শাই মুন্নাকে খুঁজে পেয়েছিল ঘুটঘুটে গলির ভেতর, আর না চাইতেই দেখে ফেলেছিল রাতের অন্ধকারে মুন্নার ইঁদুর মেরে বেঁচে থাকার লড়াই। দাদা সেলিমের খুনের ঘটনার পর ক্রমাগত তাই পালিয়ে বেড়াচ্ছিল মুন্না, শাইয়ের থেকে। অথবা নিজের থেকে। আর ইলাকে দেখা করার প্রতিশ্রুতি দিয়ে আত্মগোপন করে থাকাও তো ফার্নান্ডেজের একপ্রকার পালিয়ে যাওয়াই! যুবতী ইলা। আর ধূসরকেশ ফার্নান্ডেজ। সংসারী ইলা। আর আয়নায় ঠাকুরদাদার প্রতিবিম্ব দেখে ফেলা ফার্নান্ডেজ।
মল্লার যেখানে নামে
_____________
দেশপান্ডে আন্টি প্রত্যহ তার কোমায় আক্রান্ত স্বামীর ডাইপার বদলায়। ফার্নান্ডেজ অফিস থেকে বাড়ি ফিরে টেনে বার করে মৃতা স্ত্রীর সংগ্রহে রাখা দূরদর্শনের কিছু মজার পুরনো ধারাবাহিক। প্রতিদিন লাঞ্চ-আওয়ারে গুটিকয় ফলমূল নিয়ে শেখ বসে পড়ে ফার্নান্ডেজের সামনের চেয়ারে। ওয়াশিং মেশিনের সামনে এসে ইলা তার বরের জামায় হারিয়ে ফেলা সম্পর্কের গন্ধ হাতড়ায়। সম্পর্ককে বাঁচিয়ে রাখার চেষ্টা। সম্পর্ককে ঝালিয়ে নেয়ার অভ্যেস। সেই অভ্যেসবশতই গৃহকর্ত্রীর আবেদনে মুন্না শোবার ঘরে ঢুকত। অভ্যেসবশত পাশের ফ্ল্যাটের স্থবির বৃদ্ধাকে যাতায়াতের পথে দেখে নিত অরুণ। অভ্যেসেই ফার্নান্ডেজ বারান্দায় দাঁড়িয়ে দেখতে পায় সামনের বাড়িতে বাস করা পরিবারটির উচ্ছ্বল যৌথতা। আর ইলার মা নিয়মিত পরিস্কার করে শয্যাশায়ী স্বামীর মলমূত্র, সেই অভ্যেসেই।
তারপর হঠাৎই একদিন ইলার বাবার মৃত্যুতে ইলার মা বলে ওঠে- মনে হত উনি চলে গেলে কী করে বাঁচব, অথচ আজ সকাল থেকে আমার খুব পরোটা খেতে ইচ্ছে করছে! তারপর হঠাৎই একদিন ভোরবেলা দেশপান্ডে আন্টি দুম করে পরিষ্কার করে ফেলে আঙ্কেলের প্রিয়, চলন্ত ওরিয়েন্ট ফ্যান! ঠিক যেভাবে শাইয়ের গাড়ি থামিয়ে ‘ধোবি’ মুন্না পকেট থেকে বার করে এনেছিল অরুণের বদলে যাওয়া ঠিকানা!
হে প্রেম, হে নৈঃশব্দ
_____________
শোহরের বিবাহবহির্ভূত সম্পর্ক জাসমিনকে বেঁচে থাকার প্রতি নিরাসক্ত করে। একদিন সে গলায় দড়ি দেয়। কিন্তু ততটা সাহসী ইলা ছিল না, যতটা ভয়হীন হলে সমস্ত গয়নাগাটি খুলে রেখে ছোট্ট মেয়েকে কোলে নিয়ে বাড়ির ছাদ থেকে লাফ দেয়া যায় অনায়াস। তাই ইলার পাঠানো লাঞ্চবক্স ভুল ঠিকানায় যাচ্ছে জেনেও সে রান্না করতে থাকে পরম তৃপ্ততায়। কারণ ভুল ট্রেনও কোনো কোনো সময় সঠিক গন্তব্যে পৌঁছে দেয়। সে চিঠি লেখে, এক পাতা, দু’পাতা, তিন পাতা। অরুণ শুনতে থাকে জাসমিনকে, পহেলি চিঠ্ঠি, দুসরি চিঠ্ঠি, তিসরি চিঠ্ঠি। অচেনা ইলার পনির পসিন্দায় কামড় দিয়ে যে অসামান্য অনুভব হয় ফার্নান্ডেজের, ঠিক সেইরকম অনুভূতি অরুণকেও আঁকড়ে ধরতে থাকে ক্রমশ, যখন সে ঘষে ঘষে সাফ করতে থাকে জাসমিনের রূপোর হারখানা, তারপর গলায় পরে ফেলে আচমকাই!
ইলা গয়না বেচে টাকা সংগ্রহ করে ভূটান যাবে বলে, যে ভূটানে মাপা হয় ‘গ্রস ন্যাশনাল হ্যাপিনেস’, যেমনটা সে লিখেছিল চিঠিতে, হ্যাঁ, এই ইন্টারনেটের সময়কালেও, চিঠিতেই, কেননা ইলাদের, ফার্নান্ডেজদের সেলফোন থাকে না, কেননা হাতের লেখায় তারা স্পর্শ করতে পারে প্রেম, আর ফার্নান্ডেজ নাসিক না পৌঁছে ফের ঢুকে পড়ে তার আস্তানায়, পঁয়ত্রিশ বছরের পুরনো জংধরা গেট পেরিয়ে, চেনা চেনা হাসিমুখ পেরিয়ে, আর আমরা জানতে পারিনা শাই অরুণকে খুঁজে পায় কিনা, জানা হয়না সাজন ফার্নান্ডেজের দেখা হল কিনা ইলার সাথে, শুধু আসমুদ্র ঘোর গ্রাস করে, যেমনটা ওই আকাশি নীল দেয়ালটার দিকে তাকালেই হয়, মনে হয় আসলে সমস্ত গল্পের প্রোটাগনিস্ট একই... ভালোবাসা।
ফরিদা | unkwn.***.*** | ০১ অক্টোবর ২০১৩ ০২:০৯77995
arindam | unkwn.***.*** | ০১ অক্টোবর ২০১৩ ০২:১০77996
শঙ্খ | unkwn.***.*** | ০১ অক্টোবর ২০১৩ ০২:৫৩77997
kk | unkwn.***.*** | ০১ অক্টোবর ২০১৩ ০৪:৩২77998
aranya | unkwn.***.*** | ০১ অক্টোবর ২০১৩ ০৪:৩৭77999
কল্লোল | unkwn.***.*** | ০২ অক্টোবর ২০১৩ ০৪:২৬78000
nina | unkwn.***.*** | ০৩ অক্টোবর ২০১৩ ০৩:১০78001
শিবাংশু | unkwn.***.*** | ০৪ অক্টোবর ২০১৩ ০৬:০৬78002
tapas | unkwn.***.*** | ০৪ অক্টোবর ২০১৩ ০৬:৪৮78003
কল্লোল | unkwn.***.*** | ০৪ অক্টোবর ২০১৩ ১০:৩৮78004
mainbulu | unkwn.***.*** | ০৮ অক্টোবর ২০১৩ ০৬:৫৮78005
hu | unkwn.***.*** | ০৮ অক্টোবর ২০১৩ ০৭:৩৫78006
Paramita Das | unkwn.***.*** | ০৮ অক্টোবর ২০১৩ ০৯:৪৮78007
Biplob Rahman | unkwn.***.*** | ০২ নভেম্বর ২০১৩ ০২:৫৫78008
meghbalika | unkwn.***.*** | ১৯ এপ্রিল ২০১৬ ০২:২০78009