সকালেই বারান্দার গ্রিলে রোদ পড়ে। চৌকো খোপ খোপ, খোপের দুকোণে বাঁকানো লতা। রূপোলী রং। রোদ যত বাড়ে, বাঁকানো লতা, চৌখুপি ঘর তত তেতে ওঠে। হাত ছোঁয়ানো যায় না এক সময়। তারপর রোদ সরে যায়, গ্রিলের তাত কমে যেতে থাকে। গ্রিলের ওপরে নাক নিলে রোদের গন্ধ ওঠে। রুফাস নাক দিয়ে আওয়াজ করে বারান্দার মেঝে শোঁকে, গ্রিল, তারপরে বাতাস। চোখ পিট পিট করে। বাদামী চোখের পাতা, লোম। জিভ বের করে হাঁপায়। তারপর সামনের পা টান করে, বারান্দার মেঝেতে পেট পেতে শোয়, মুখ নামিয়ে আনে থাবার ওপর। থাবা চাটে। তারপর চোখ বোজে। ঝিমোতে থাকে। স্বপ্না বারান্দায় এলে গা ঝাড়া দেয়। স্বপ্নার পায়ে পায়ে ঘোরে।
রোদ সহ্য হয় না স্বপ্নার। আবার এই বাড়িটা এমনই হয়েছে যে রোদে রোদে ভরে থাকে। জানলায় কাচ বসানো। সামান্য কিছু আঁকা তাতে-এমনিতে চোখে পড়ে না-সকালের প্রথম রোদটা সাতটার মধ্যেই হুড়মুড়িয়ে ঢুকতে থাকে আর তখনই বোঝা যায় নকশাটা-তিনটে নকশা সামান্য ব্যাঁকা হয়ে পড়ে মেঝেতে তারপর সোজা হয়ে দেওয়ালে-দশ মিনিট বড়জোর। তারপর মিলিয়ে যায়। মিলিয়ে যে যায় তা নয়, আসলে তখন ঘরভরা রোদ থই থই করে-হাল্কা রোদের নকশা হারিয়ে যায় রোদে রোদেই। জানলা দিয়ে রোদ ঢুকতেই থাকে -আলোর গতিপথে অজস্র ধুলোর কণা উড়তে দেখা যায় আর ঠিক এই সময় থেকে স্বপ্নার মাথা ধরে। প্রথমে ঘাড় তারপর ব্যথাটা মাথার পেছনে ছড়ায়। ও চুল গুটিয়ে খোঁপা করে নেয়-ব্যথা তখন চুল বেয়ে বেয়ে কপালে নামে।তারপর সারাদিন সঙ্গে থাকে। ঘন ঘনই মাথা ধরছে ইদানিং। স্কুলে যাওয়ার সময় রোদ অ্যাভয়েড করে-কালো চশমা ছাতা এই সব। বিকেলে রোদ একদম মরে গেলে স্কুল থেকে বাড়ি। আজ রবিবার, বাড়িতেই ছিল স্বপ্না। ভারি পর্দা টেনে। রোদ কমতে বারান্দায় এল। চৌখুপি গ্রিলে হাত রাখল। যেন রোদের তাত মেপে নিচ্ছে। বারান্দার ওপরে হাল্কা ফাইবারের শেড। সামনেটা ঢেউ খেলানো। সেই ফাঁক দিয়ে পাহাড় দেখল স্বপ্না। ছোটো পাহাড় তৈরি হচ্ছিল প্রথমে, তারপরে বড় পাহাড়। ভেঙে গিয়ে হাতি হচ্ছিল, বুড়ো মানুষ, উট। দশ বছর ধরে এখানকার আকাশ দেখছে - এই মেঘে বৃষ্টি হয় না। বাগানে জল দেবার পাইপটা তুলে নিল স্বপ্না, প্যাঁচ খুলে সোজা করল। ট্যাপ খুলতেই আলতো ফোয়ারা হয়ে জল গাঁদায় পড়ল, সেখান থেকে লংকা গাছে। আমচারাকে ভিজিয়ে তুলসী পাতাদের ভেজাচ্ছিল স্বপ্না। তুলসী পাতার ওপর জল পড়লে ভেজামাটির গন্ধর সঙ্গে হালকা তুলসীর গন্ধ মিশে যাচ্ছিল। নাক টানছিল স্বপ্না। এই সময় মেঘের পিছন থেকে সূর্য বেরোলে স্বপ্না জলের ধারা আলোর গতিপথে উঠিয়ে আনে - দেখে নীল, দেখে সবুজ, কমলা। রঙেরা ঈষৎ কাঁপে, মিলেমিশে যেতে থাকে, একসময় রোদ আর জল আলাদা হয়ে যায় ফের। এই পাহাড়তলির ছোটো শহরে বৃষ্টি হয় কেমন খাপছাড়া। হয়ত সন্ধ্যায় একপশলা, রাতে তুমুল, সকালে আবার ঝকঝকে আকাশ। এমন হল রাতে বৃষ্টি হয়েছিল আর সকালে স্বপ্না রুফাসকে নিয়ে হাঁটতে বেরিয়েছে। বাড়ির সামনে রাস্তা, গর্ত, জমা জল। সূর্য উঠলে রাস্তা থেকে বাষ্প ওঠে -রুফাসের ল্যাজ খাড়া হয়ে যায়। পিঠ টান টান। আর তখনই জমা জলে রামধনু দেখতে পায় স্বপ্না। ওর সেই দরজার কথা মনে হয় খুব - একটা পেল্লায় কাঠের দরজা - ঐরকম কাঠ, ঐরকম পালিশ পরে আর দেখে নি স্বপ্না - দরজার ওপরের দিকটায় রামধনু কাচ বসানো - এইরকম একটা দরজা ছোটোবেলায় দেখেছিল ও। রোজই দেখত। সেই দরজার বাড়ি থেকে ছোটোবেলায় স্বপ্নাকে বেড়াতে নিয়ে যেতে হাতি আসত বিকেলে। হাতির পিঠে হাওদা থাকত, মাহুত। স্বপ্নাদের বাড়ির দরজায় পা মুড়ে বসত হাতি। ঘন্টার শব্দ করত। ঝালর দেওয়া ফ্রক পরে স্বপ্না হাতীর পিঠে বসত। কাজল পরত, টিপ। একটা বড় বাগানে বেড়াতে যেত স্বপ্না, কখনও নদীর ধারে। এই সব হাতির গল্প, হাওদা, মাহুত আর নদীর গল্প সে নিশ্চিত বলে জানত তার ফুলশয্যা পর্যন্ত। আসলে হাওয়ার রাত ছিল সেদিন। ফুলশয্যার খাটে ঘন নীল মশারি ফুলে ফুলে উঠছিল। তখন নীলকমলকে হাতির গল্পটা বলেছিল স্বপ্না। নীলকমল হাসিমুখ করে শুনছিল তারপর বলেছিল - ধ্যাত, সরু গলিতে হাতি ঢুকবেই না। হাতি বিষয়ে নীলকমল সবই জানে - এরকমই মনে হয়েছিল তার নতুন বৌয়ের। তখন স্বপ্না অন্য গল্প বলবে ভাবছিল - বিরাট উঠোনে জ্যোৎস্নায় লক্ষ্মীপ্যাঁচা নামত, সেই গল্প। নীলকমল ততক্ষণে সুকুমারের গল্প শুরু করেছিল। চাঁদ আর জ্যোৎস্না দিয়েই শুরু করেছিল নীলকমল। বলেছিল সুকুমারের আশ্চর্য বাড়ির কথা। বলেছিল, চাঁদ উঠলে সুকুমারের বাড়ির সামনের রাস্তায় আইসক্রীম ট্রাক আসে। লাল নীল আলো জ্বলে, ঘন্টা বাজায়। নীলকমল বলেছিল সুকুমার আইসক্রীম ভালোবাসে। স্বপ্নারও একটা গল্প ছিল আইসক্রীমের। প্রাচীন এক আইসক্রীমের রেসিপির - যা ও এক মেমসাহেবের থেকে পেয়েছিল কুচবিহারে-ওর বাপের বাড়ির পাড়ায়। জীর্ণ এক বাড়িতে থাকত সেই মেম আর তার অন্ধ কুকুর। স্বপ্না অবশ্য সে গল্প বলে নি তখন। সুকুমারের গল্প শুনেছিল চুপ করে। এক বছর শুনেছিল সুকুমারের গল্প। তারপর বছর ঘুরতেই কুচবিহার গিয়ে রুফাসকে নিয়ে এসেছিল। বলেছিল বাপের বাড়ির কুকুর। বলেছিল ছোটোবেলায় ও ইংরিজি শিখেছিল এক মেমের কাছে। ইংরিজি শিখত আর রান্না। রুফাস আর রান্নার বই এনেছিল কুচবিহার থেকে। বলেছিল মেম দিয়েছে। নীলকমল রান্নার বই উল্টে দেখেছিল। সমস্ত উপকরণ, মাপামাপির হিসেব অচেনা ঠেকেছিল নীলকমলের। বলেছিল - এসব এদিকের বাজারে পাওয়া যায় না। বলেছিল - সুকুমারকে বলে দেব, দেশে এলে নিয়ে আসবে। স্বপ্না সে বই তুলে রেখেছিল। রুফাস তখন ছোটো। স্বপ্না বলেছিল মেমের অন্ধ কুকুরের নাতি রুফাস। মেমই নাম রেখেছে।পরে একদিন তুমুল ঝড় জলে শিয়ালদায় স্বপ্নার পিসতুতো দাদার সঙ্গে নীলকমলের দেখা হয়েছিল। দার্জিলিং মেল ধরার কথা দুজনেরই। ট্রেন লেট ছিল সেদিন। অনেকক্ষণ গল্প করেছিল ওরা। মেমের কথা কিছু জানে না স্বপ্নার পিসতুতো দাদা, বরং, সেদিন সে রুপুর কথা বলেছিল আচমকা। বলেছিল, রুপু স্বপ্নার প্রেমিক ছিল কুচবিহারে। বাড়ি ফিরে স্বপ্নাকে সে সব কিছু বলে নি নীলকমল। প্রথম ইন্টার্ভিউ দিতে গিয়ে সুকুমারের ট্রেন আটকে পড়েছিল পাটনায়-সে গল্প বলেছিল।
আজ জানলা দিয়ে মেঘ দেখছিল নীলকমল। মেঘ ভেঙে ভেঙে যথারীতি উট, বুড়ো, পাহাড়। রোদ বেরোতেই জানলা থেকে চোখ সরালো নীলকমল। টিভির রিমোট নিল। তারপর এহাত ওহাত করে রেখে দিল সেন্টার টেবিলে। কাঠের ওপর রোদ সরে যাচ্ছিল তখন। নীলকমলের হাতের ওপর রোদ পড়ছিল। রোদের হালকা উত্তাপ টের পাচ্ছিল নীলকমল হাতের ওপর। চামড়ার ছোটো ছোটো চৌখুপি ঘর, প্রতি ঘরে রোমকূপ, চার পাঁচটা সবজে শিরা - নখের পাশ দিয়ে চামড়া উঠেছে। কড়ে আঙুলের নখটা সামান্য ভাঙা, ক্ষয়ে যাওয়া। সুকুমার হাত অন্যরকম ছিল। সুকুমারের হাতের কথা নীলকমল জানে। সুকুমারের কড়ে আঙুলের তলায় ছোটো গোল দাগ ছিল-নাইট্রিক পড়েছিল বি এস সির প্র্যাক্টিকালে। সুকুমার সে জায়্গায় তেল মাখত - অলিভ অয়েল, ক্রীম, লোশন। সুকুমার ঐ রকমই - খুঁত সহ্য হয় না। নীলকমলের সঙ্গে কুল কিনত সুকুমার স্কুলের সামনে। হাত বুলোতো কুলে, দাগহীন খুঁতহীন কুল দু আঙুলে তুলে উঁচু করে দেখত।কুল বেছে নিয়ে পকেট থেকে রুমাল বের করে আঙুল মুছত সুকুমার। এখন অবশ্য আর কুল কেনে না সুকুমার - চেরি কেনে, স্ট্রবেরি, রকমেলন; টমেটো লাগিয়েছে বাগানের টবে। নিটোল টমেটো হয়। বাগানে কুমড়ো চাইছে সুকুমার অনেকদিন হ'ল-কুমড়োর বীচি পুঁতেছে বহুবার। চারা বেরোয়, দু একটা পাতা।তারপর শুকিয়ে যায়। নীলকমলকে লিখেছিল সেকথা। লিখেছিল, কুমড়ো হচ্ছে না। মাটি পরীক্ষা করাবে - লিখেছিল। পরীক্ষা হয়ে গেলে, নীলকমলের বাগান থেকে বীচি নিয়ে যাবে সুকুমার। কুমড়োর আর লংকার। আর কিছু লেখে নি তার পরে বহুদিন। অথচ নীলকমলের সবই জানা ছিল। জানা ছিল, সবুজ রোঁয়া ওলা বৃন্ত বাদামী হলে দুহাতে ফলন তুলে দেখবে সুকুমার। দেখবে সুগোল কমলার ওপর কালচে সবুজ ডোরা সমদূরত্বে আছে কি না। তারপর হাত বুলিয়ে মসৃণতা পরখ করবে। প্রথমে একটা কুমড়ো, তারপর দুটো, তিনটে চারটে, পাঁচটা ছটা। এইরকমই ছেলেমানুষি করবে সুকুমার - নীলকমলের জানা ছিল। নীলকমল সবুজ শিরায় হাত বোলালো, তারপর আরও একটু ঝুঁকে দাঁড়িয়েই রইল হাতের ওপর এক ফালি রোদ নিয়ে। হাত সরিয়ে নিলে রোদ হারিয়ে যাবে।
এই সময় বাগান থেকে ঘরে ঢুকছিল স্বপ্না। রুফাস চার পা ওপরে তুলে শুয়ে পড়ছিল স্বপ্নার সামনে। ল্যাজ নাড়ছিল। যে রোদটুকু ঘরে ঢুকছিল, তাতে অজস্র বাদামী সাদা রোঁয়া ঘরময় দেখা যাচ্ছিল,স্বপ্না পুরোনো তোয়ালে দিয়ে রুফাসের পা মুছে দিচ্ছিল, বাগানের ঘাস, মাটি ই মূলতঃ। রুফাসের আরাম লাগছিল। আরও আদর চাইছিল রুফাস। রুফাসের গলা, বুক, পেটে হাত বুলিয়ে দিচ্ছিল স্বপ্না। ঘন বাদামী লোমে আঙুল বসে যাচ্ছিল ওর। নখের ডগা আলতো ছোঁয়াচ্ছিল। ওর হাত ঘুরছিল বৃত্তাকারে। রুফাস এপাশ ওপাশ করছিল। ল্যাজ নাড়ছিল। আলতো দাঁত বসাচ্ছিল স্বপ্নার আঙুলে।
প্রথম প্রথম, স্বপ্না যখন আদর করত রুফাসকে, অস্বস্তি শুরু হত নীলকমলের। অস্বস্তি হত, চোখ সরিয়ে নিত নীলকমল। তারপর শরীর জাগত। স্বপ্না জানত। রুফাসকে বারান্দায় রেখে দরজা বন্ধ করত নিজেই। জ্যোৎস্নার দিনগুলোতে এসব বেশি হত। হয়তো রুফাসকে নিয়ে উঠোনে মোড়া পেতে বসেছে দুজনে, কিম্বা বারান্দায় চেয়ারে। হয়ত পাহাড়তলির আকাশ পরিষ্কার সেদিন-হয়ত সকালে বৃষ্টি হয়েছিল-আকাশ তারাময়-চাঁদ ঘিরে জলীয় বাষ্পের রঙীন বৃত্ত - সাদা মেঘে মেঘে আশ্চর্য একটা পথ তৈরি হচ্ছে চাঁদের দিকে-স্বপ্না লক্ষ্মীপ্যাঁচার গল্প শুরু করলে নীলকমল আইসক্রীম ট্রাকের গল্পটা শুরু করত। রুফাস কান খাড়া করে তাকিয়ে থাকত দূরে-স্বপ্না তখন আদর করত রুফাসকে। তারপর রুফাসকে বাইরে রেখে দরজা বন্ধ করত দুজনে। অনেক রাতে দরজা খুলে রুফাসকে দেখত নীলকমল। রাস্তার দিকে তাকিয়ে বসে রুফাস, পিঠ টান টান, কান খাড়া। নীলকমলের মনে হত রুফাসের কোথাও যাওয়ার আছে। কোথাও যেতে চায় রুফাস। স্বপ্নাকে এ কথা বলতে স্বপ্না বলেছিল - রুফাস কোথাও যাবে না। কোথাও শব্দের ওপর জোর দিয়েছিল স্বপ্না। আলতো হেসেছিল। তারপর নীলকমলের দিকে তাকিয়েছিল, বলেছিল - গেট বন্ধ রেখো সবসময়। রাস্তায় যা গাড়িঘোড়া।
আজ রুফাসকে আদর করতে করতে নীলকমলকে দেখছিল স্বপ্না। তারপর বলেছিল - ওর পিরিয়ড হচ্ছে না। বলেছিল পরদিন ডাক্তারের সঙ্গে অ্যাপয়েন্টমেন্ট। সকালে ডাক্তারের কাছে ঘুরে স্কুলে যাবে। পাড়ার দোকানে আজকাল প্রেগ্নেন্সি কিট রাখছে - নীলকমল একথা বলায় স্বপ্না খুব অবাক হয়ে তাকিয়েছিল। বলেছিল - সে বয়স এখনও আছে নাকি। তারপর গলা খাঁকরে বলেছিল, ডাক্তারের কাছেও কিট আছে, আর সেকন্ড ফ্লোরে আল্ট্রাসাউন্ড।
পরদিন অফিসে যায় নি নীলকমল। দাড়ি কামায় নি, স্নান করে নি। কাগজ কোলে শুয়ে ছিল বাইরের ঘরে। জানলা দিয়ে দুপুর দেখছিল। দুপুর, রোদ, গরম হাওয়া। রাস্তায় পিচ গলছিল বোধ হয়। হাওয়ার জোর বাড়ছিল। শুকনো পাতা উড়ে যাচ্ছিল বাগানে।জানলার কাচে রোদ ঠিকরোচ্ছিল, চোখে লাগছিল নীলকমলের।
স্বপ্না সকালেই ডাক্তারের কাছে গেছে। টেস্টগুলো হবে তারপর স্কুলে যাবে। রিপোর্ট নিয়ে ফিরতে বিকেল। রুফাস বারান্দায় ছিল। থাবার ওপর মাথা দিয়ে শুয়েছিল। হাওয়ার জোর বাড়তে উঠে বসল। রাস্তার দিকে মুখ করে কান খাড়া করল, পিঠ শক্ত করে বসল কান খাড়া রেখে। এক দৌড়ে বাগানে গেল। ঘর থেকে বাগানে তাকাল নীলকমল। বাগানের গেটে দাঁড়িয়ে রুফাস। ধনুকের ছিলার মত টানটান। মহরমের সময় তীর ধনুক কিনত নীলমল আর সুকুমার। বাঁশের বাখারিতে রঙীন কাগজ, রুপোলী রাংতার ধনুক। কাক মারত দুজনে। হয়তো নিমগাছের ডালে কাক আর সুকুমার কাকের দিকে ধনুক তুলছে, সুকুমারের চুল সামান্য বড় হয়ে ঘাড় ঢেকেছে, স্যান্ডো গেঞ্জির ওপরে ঘাড় আর পিঠের সন্ধিতে শক্ত গোল হাড় - এই সব মনে পড়ছিল নীলকমলের। বাগানে এসে রুফাসের পাশে দাঁড়াল নীলকমল গেটের কাছে - দেখল বাগান, বাগানের গেট, বড় রাস্তা। দেখল, টান দাঁড়িয়ে রুফাস, কান খাড়া, দেখল রুফাসের ঘন লোম, দেখল ঘাড় পিঠের পেশী, দেখল রুফাসের পিছনের পায়ে ভর বেশি, সামনের পায়ে কম। গরম হাওয়া বইছিল। পাতা উড়ে যাওয়ার শব্দ, ভারি ট্রাকের আওয়াজ আসছিল। বাগানের গেট খুলে দিল নীলকমল।
রুফাস একবার তাকালো নীলকমলের দিকে। তারপর লাফ দিয়ে বেরোলো। নীলকমল দেখছিল রুফাসের পা মাটিতে পড়ছে না - যেন উড়ে যাচ্ছে রুফাস। একটা লাল ঘোড়ার কথা মনে হল নীলকমলের। গলি পেরিয়ে বড় রাস্তা। গলির মুখ অবধি দেখতে পাচ্ছিল নীলকমল। রুফাস টগবগিয়ে পেরিয়ে গেল গলি। তারপর বড় রাস্তার সামনে এসে সামনের দুপা দিয়ে মাটি আঁকড়াল, পিছনের পা সামান্য ছেতরে সোজা হল। পিচ গলছিল রাস্তায়। ধোঁয়া ধোঁয়া লাগছিল। বাগান থেকে এটুকুই স্পষ্ট করে দেখেছিল নীলকমল। তারপর মনে হল, খুব জোরে ব্রেক কষছে ট্রাক, হই হই করছে মানুষ। এরকমই তো হওয়ার কথা, ছুটে বেরিয়ে গেল নীলকমল। ঝাঁ ঝাঁ করছিল মাথা, নীলকমল পুড়ে যাচ্ছিল যেন। গলা ফাটিয়ে ডাকল - রুফাস রুফাস। গলির মুখে পৌঁছে দেখল ট্রাক যাচ্ছে, গাড়ি, ছাতা মাথায় দু একটি মানুষ। আর নীলকমল যেমনটি দেখেছিল বাগান থেকে, ঠিক তেমনই বসে আছে রুফাস - রাস্তার দিকে মুখ। নীলকমল বলল রুফাস বাড়ি চল। রুফাস নড়ল না। নিচু হয়ে রুফাসের গলায় বেড় দিয়ে নিজের দিকে রুফাসকে টানতে চাইল নীলকমল। রুফাস বেড় কাটিয়ে দৌড়তে লাগল - প্রথমটায় গলির দিকে দৌড়ে এল তারপর আবার বড় রাস্তার দিকে দৌড়োলো। নীলকমল দৌড়ে বাড়ি ঢুকল, বারান্দায় রুফাসের খাবার থালা বাটি। স্বপ্না নিজের হাতে ধুয়ে মেজে উল্টো করে রেখে গেছে সকালে। নীলকমল থালা বাটি তুলে রাস্তার দিকে দৌড়ল। হাত তুলে বাটি দেখাতে লাগল রুফাসকে - চেঁচিয়ে বলতে লাগল-রুফাস খাবি না? কে খাবে রুফাস? থালা আর বাটি বাজিয়ে শব্দ করতে লাগল নীলকমল-ফ্যাঁসফেসে গলায় অবিশ্রান্ত বলে চলল - কে খাবে? কে খাবে? রুফাস রুফাস কে খাবে? কে খাবে রুফাস? রুপু রুপু খাবি না? পথচলতি রোদে পোড়া মানুষজন অবাক হয়ে তাকাচ্ছিল - দেখছিল একটা লালচে বাদামী কুকুর চারদিকে দৌড়ে বেড়াচ্ছে আর একজন পাজামা গেঞ্জি পরা মানুষ বাটি হাতে চিৎকার করে কিছু বলছে - পাগল অথবা ভিখারি হয়তো।
রোদ সামান্য পড়তে বাড়ি এলো স্বপ্না। বাইরের ঘরে ব্যাগ আর রিপোর্টের খাম রেখে উঠোনে এল শুকনো জামা কাপড় তুলে নিতে। দেখল একটা মোড়া পেতে বসে আছে নীলকমল। পায়ের কাছে রুফাস ঘুমোচ্ছে। রুফাসের দিকে তাকিয়েছিল নীলকমল। স্বপ্নাকে দেখে মুখ তুলল এবারে। না কাটা দাড়িতে হাত বুলিয়ে অদ্ভুত হাসল - কি বলল ডাক্তার? পজিটিভ?
স্বপ্নাও হাসল। বলল - না, সিস্ট। একটু বড়। ওষুধ খেতে হবে। আরও কিছু টেস্ট।
মাথা নামিয়ে নিল নীলকমল। নিচু হয়ে রুফাসের গায়ে বিলি কাটতে লাগল। স্বপ্না দেখছিল বিকেলের রোদ পড়েছে নীলকমলের গালে - সাদা দেখাচ্ছে নীলকমলের না কাটা দাড়ি। বুড়ো মানুষ মনে হচ্ছিল নীলকমলকে। অসুস্থ বুড়ো মানুষ শীতকালে যেমন রোদে বসে থাকে মোড়া পেতে আর রোদ ফুরিয়ে এলে কুঁজো হয়ে ঘরে ঢোকে, চা দিতে বলে। নীলকমলকে তেমন লাগছিল। স্বপ্নার খুব ইচ্ছে হল নীলকমলের কপালে হাত রাখে। স্বপ্নার বাঁ হাত ভাঁজ করা, তাতে শাড়ি শায়া গেঞ্জি, অন্য হাতে কাপড় মেলার ক্লিপ। উঠোনে লম্বা ছায়া পড়েছে নীলকমলের। হাতের ক্লিপ দড়িতে গুঁজে দিল স্বপ্না। তখনই নীলকমল বলল, সুকুমার শীতে আসবে। বাগানে মাচা তুলব। বর্ষা আসছে। কুমড়োর বীচি পুঁতবো।
স্বপ্না শুকনো কাপড় তুলে নিয়ে ঘরে গেল। সঙ্গে রুফাস। এরপরে ও রুফাসকে খেতে দেবে, বেড়াতে নিয়ে যাবে, আদর করবে।
নীলকমল বাগানে এল। বাগানের শেষে গেট। গেট পেরোলে গলি, বড়রাস্তা। রাস্তার ওপারটা স্পষ্ট দেখছিল নীলকমল। দেখছিল রাস্তার ওপারে অন্য একটা বাগান, একটা বাড়ি। বাগানের সামনে অজস্র ফুল-লাল, কমলা হলুদ, বেগুণী, কোণের দিকে লেবু গাছ একটা, আর পেছনের দিকটায় ভেজিটেবল প্যাচ। টমেটো আর শসা চিনতে পারছিল নীলকমল। আর বোধ হয় ডিল, লেটুস, লেমনগ্রাস। তারপরেই কুমড়োর মাচা। সাপের মত ফণা ধরছে কুমড়োর ডগা - মাচায়। মাটিতে। ক্রমে ঢেকে ফেলছে ডিল, লেটুস, লেমনগ্রাস। অজস্র ফুল ধরেছে। হলুদ কুমড়োফুল। কমলা সবুজ ডোরার নিটোল কুমড়ো, সবুজ রোঁয়ায় ভরা বৃন্ত বাদামী হচ্ছে ক্রমশঃ।
সামনেই বর্ষা। বীচি পুঁততে হবে। মাচা তুলতে হবে। দু হাতে আগাছা ছিঁড়ছিল নীলকমল। মরা ঘাস উপড়ে ফেলছিল। শীতে সুকুমার আসবে।