প্রকৃতিমগ্নতা ছিল তাঁর গল্পের একটি বড় অংশ। বনের রাজা বা সমুদ্র – প্রকৃতির দুই রূপ দেখেছেন লেখক। বনের রাজা গল্পে সারদা নাতিকে বলছেন, গাছ তাঁর সঙ্গে কথা বলে। ডাল-পাতা-ফুল-কুঁড়ি-ফল সব তাঁর সঙ্গে কথা বলে। দাদু সারদা তাঁর নাতি মতিকে নিয়ে বনের ভিতরে, প্রকৃতির ভিতরে চলতে চলতে, প্রকৃতিলগ্ন হয়ে পড়েন। সারদা ছিলেন ইঞ্জিনীয়র। সমস্ত জীবন শহরে কাটিয়ে, কল-কারাখানা লোহা লক্কড়ের ভিতর কাটিয়ে শেষ জীবনে গাঁয়ে ফিরে পুকুর বাগান, গাছগাছালি, পাখপাখালির ভিতরে থেকে টের পেলেন প্রকৃতির রূপ-রস-গন্ধ-স্পর্শ। শহর থেকে আসা নাতি বালক মতি দেখে দাদু সারদা আর প্রকৃতির ভিতরে বেঁচে থাকা আর সব প্রাণের কোনো তফাৎ নেই বুঝিবা। বনের ভিতরে যারা বাঁচে, সারদাও তাদের মত করে বাঁচেন। হয়ত মতিকে বুঝিয়ে দেওয়া মানুষ এই প্রকৃতি ছেড়ে শহরে কোন নির্বাসনে গেছে। সারদার মত মতিও খুলে ফেলে প্যান্টটি। গাছগাছালি, ফড়িং, পাখি, সবের ভিতরে তাঁরা যেন মিলেমিশে যান। এ এক আশ্চর্য গল্প। তিনি যেমন ভাবে প্রকৃতির সঙ্গে মানুষকে জড়িয়ে দিয়েছেন বনের রাজা গল্পে তার সৌন্দর্য অসীম। আর সমুদ্র তো আলাদা ভাবে অনুভব করা সমুদ্রকে। তার ভয়ঙ্করতাকে দেখে নেওয়া।
শুনেছি জীবনে একবারই সমুদ্রে গিয়েছিলেন লেখক। সমুদ্রকে কীভাবে দেখেছিলেন তিনি? বালুকাবেলায় ঝিনুক কুড়ানো দেখতে পাননি। অনেকদিনের পুরনো দম্পতি, দাম্পত্য, যৌনতা সব কিছু ওই বিপুলতার কাছে তুচ্ছ হয়ে যায়। সারারাত লোকটি গর্জন শোনে সমুদ্রের। তার সঙ্গে সমুদ্রতীরে একটি লোকের পরিচয় হয়, লোকটি ২৪ ঘন্টার ছুটি নিয়ে সমুদ্র দেখতে এসেছিল, আর ফিরে যায়নি, ২৪ ঘন্টা হয়ে গেছে কুড়ি বছর। তাকে সবাই বলে মামা। তার ভাগ্নের একটি হোটেল আছে এখানে। সেখানে থাকে খায়। লোকটি গল্প কথক ব্যক্তিটিকে বলে, আপনার রক্তের মধ্যে ওই শব্দ চলে যাবে – মগজের ভিতর ছবিটা আটকা পড়বে আজ না, ক’দিন তাকিয়ে থাকুন – তখন আর কোনো কাজকর্ম ভাল লাগবে না, চোখের ঘুম উধাও হবে, ক্ষুধা কমে যাবে-,
সমুদ্রের কথাই বলছিল লোকটা। গর্জমান ভয়ঙ্কর সুন্দরের কাছে লোকটা আটকা পড়ে গেছে। সমুদ্রের ভিতর সে ভয়ানক এক প্রাণকে খুঁজে পেয়েছে যেন। তার কাছে সমুদ্র হল সাঙ্ঘাতিক জীবন্ত একজন কেউ। যখন সে সমুদ্রতীরে, বালুকাবেলায় বেড়াতে আসে, পকেটে থাকে কিছু মাছভাজা, কেক-পাঁউরুটি ইত্যাদি। লোকে যে ফুল বেলপাতা দেয়, সমুদ্র সব ফেরত দেয়, তার নিবেদন গ্রহণ করে। শোনা যায়, জীবন্ত কুকুর বেড়ালও নিবেদন করেছে মামা। সমুদ্র তা নিয়েছে। সমুদ্র এক ক্ষুধার্ত দানব।
এই লোকটি, মামার সঙ্গে মিশতে মিশতে দুদিনের ভিতরেই তার মগজের ভিতর সমুদ্র প্রবেশ করে যায়। সমুদ্রের রূপের কাছে সব কিছুই তুচ্ছ হয়ে যায়। নিজের যুবতী বউ হেনার রূপও তার অসহ্য লাগতে থাকে। বউ আলুথালু হয়ে শুয়ে থাকে হোটেলের ঘরে, লোকটি সারারাত ধরে সমুদ্রের গর্জন শোনে। বালুকাবেলায় শাড়ির আধখানা ভিজিয়ে বালি মাখানো পা দুটো টেনে টেনে হেনা যখন তার সামনে এসে দাঁড়ায়, তার ঘেন্না লেগে যায়। লোকটার রক্তের ভিতরে সেই মামা সমুদ্র গর্জন ঢুকিয়ে দিয়েছিল। সমুদ্রকে এভাবে দেখা ভারতীয় সাহিত্যে কেন, বিশ্ব সাহিত্যেও বিরল। লোকটা শেষ পর্যন্ত কী করতে গিয়েছিল? হেনাকে সমুদ্রের কাছে নিবেদন করতে চেয়েছিল। সমুদ্রের ঘোর উন্মত্ততায় সে অমনই হয়ে গিয়েছিল।। মামা লোকটি তো সমুদ্রকে জীবন্ত প্রাণী পর্যন্ত উৎসর্গ করেছিল। হেনা টের পেয়ে যায় কী করতে যাচ্ছে তার স্বামী, লোকটার তখন সম্বিত ফেরে। একবার সমুদ্রে যাওয়া, তারপর কলকাতা ফিরে ওই গল্প।
তাঁর গল্পের প্রধান চরিত্ররা সকলেই অ্যান্টি হিরো। অসফল মানুষ, জীবনের সর্ব ক্ষেত্রে তারা ব্যর্থ মানুষ। সমুদ্র গল্পের লোকটিও তাই, মঙ্গল গ্রহ বা তারিণীর বাড়ি বদল গল্পের তারিণী, সামনে চামেলি গল্পের ক্রাচ বগলে লোকটিও তাই। কিন্তু প্রতিটি চরিত্রই হল গভীর অনুভূতিপ্রবণ। তাদের পঞ্চ ইন্দ্রিয় সব সময় সজাগ। এই সব ব্যর্থ মানুষের ভিতর আবার অন্য মানুষও আছে। তিনি ছিলেন জাত শিল্পী। শুধু মাত্র কাহিনি কথনের যখন রমরমা, দগদগে কাহিনি যখন বিক্রি হয়ে যায় হাজার হাজার, তখন প্রায় নিভৃতে তিনি শিল্পের সাধনা করে গেছেন। হ্যাঁ, একমাত্র জীবনানন্দকেই যেন মনে পড়ে যায় জ্যোতিরিন্দ্র নন্দীকে পড়তে পড়তে। আমি যখন জীবনানন্দের জলপাইহাটি উপন্যাসটি পড়ি, সেই ব্যর্থ অসফল মানুষটির কথা পড়ি, তখন মনে পড়ে যায় জ্যোতিরিন্দ্র নন্দীর কথা। ট্রাঙ্ক বন্দী সেই উপন্যাসের পাণ্ডুলিপি উদ্ধার হয়েছিল জ্যোতিরিন্দ্র নন্দীর মৃত্যুর বছর সাত আট বাদে তো নিশ্চয়। শিল্পের কথা যখন বলছি, ‘রাইচরণের বাবরি’ গল্পটির কথা বলি।
মাথার বাবরি চুল ছিল রাইচরণের গর্ব। হাতে এক কোষ তেল নিয়ে বাবরিকে রীতিমতো পরিচর্যা করত সে। পাড়ার লোক তাকে ‘বাবরি ঘোষ’ বলে ডাকত। শেষে ঘোষ উঠে গিয়ে শুধুই ‘বাবরি’। এত চুল একটি লোকের মাথায়! কোঁকড়া, লম্বা, চিকন, সাপের মত ঢেউ খেলানো। চুলের এই বাহারে তার বউ মানদা রীতিমতো ক্ষিপ্ত। কতখানি করে তেল যায় ওই চুলে, সংসার তো অভাবের। এহেন রাইচরণ হল দর্জি। শিয়ালদা আর বৌবাজারের মোড়ের মাথায় তার এক দরজার দোকান। তার বাবরি দেখতেই কত লোক তার দোকানে ঢোকে, দরজায় দাঁড়িয়ে একবার উঁকি দিয়ে চলে যায়। তার বাবরির জন্যই রাইচরণের দোকান ভাল চলছিল। সেই দোকানে এল এক থিয়েটারের ম্যানেজার। তার জহুরির চোখ। রাইচরণ তার বাবরি দিয়েই দেশ জোড়া নাম কিনতে পারে। মাস বেতন একশো টাকা দিয়ে সে রাইচরণকে তার থিয়েটারের দলে নিয়ে যেতে চায়। রাইচরণ প্রস্তাব শুনে খুব উৎসাহিত হয়নি, অ্যাক্টিং সে জানেনা। কেন যাবে? কিন্তু কথাটা তার বউ মানদার কানে যেতে প্রলয় বেধে গেল। কেন যাবে না রাইচরণ, মাস গেলে একশো টাকা কি কম হল, খালিফাগিরিতে অত আয় হয়! না গেলে মানদা রাইচরণের বাবরি পুড়িয়ে দেবে। বঁটি দিয়ে কেটে দেবে। শেষমেশ আরো পঁচিশ টাকা বেশীতে রাইচরণ রাজি হল। থিয়েটারে রাইচরণকে দেওয়া হল ডাকাতের পার্ট। রাইচরণের মনে এল দুর্ভাবনা। সে তো সত্যিকারের ডাকাত নয়। ডাকাতের সাজপোশাক, কথাবার্তা, লুঠতরাজ, মারপিট – সবই তো মিথ্যে। দর্শকও জানবে মিথ্যে। রাইচরণ না বলল। কেন না, সবই তো মিথ্যে বলে ধরে নেবে দর্শক, তাহলে কি তার বাবরিটিকে সত্য বলে মেনে নেবে? বাবরিটা লোকের চোখে পরচুলা হয়ে যাবে। সাধের বাবরির অসম্মান সে হতে দেবে না। একশো পঁচিশ টাকা মাস মাইনের চেয়ে বাবরির দাম তার কাছে বেশি। তার অমর্যাদা হতে দেবে না সে।
আমি গল্পের জ্যোতিরিন্দ্র নন্দীর কথাই বলে যাচ্ছি। তাঁর সূর্যমুখী, মীরার দুপুর, বারোঘর এক উঠোন, প্রেমের চেয়ে বড়, এই তার পুরস্কার – উপন্যাসগুলির অনুরাগী। সেই ষাট-বাষট্টি বছর আগের মীরার দুপুর পড়লে এখনো মনে হয় এই উপন্যাস গতকাল লেখা হতে পারত, আগামীকাল লেখা হতে পারে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ, মন্দা, দেশভাগ, দুর্ভিক্ষ পার হয়ে এসে মানুষের মেরুদন্ড ভেঙ্গে গিয়েছিল। সেইসব ব্যর্থ মানুষই তাঁর গল্প ও উপন্যাসের মূল চরিত্ররা। সূর্যমুখী উপন্যাসে বাবার বন্ধুর মেয়েকে নিয়ে যাওয়া হয় ক্ষমতাবানের কাছে, তাঁর অনুগ্রহ পাওয়ার শর্ত হিসেবে। এই বিষয়ই কুড়ি-বাইশ বছর বাদে আবার লেখা হয়। এ থেকে ধরা যায় জ্যোতিরিন্দ্র নন্দীর দেখার চোখটি ছিল কতখানি এগিয়ে। আমি তিরিশ-পঁয়ত্রিশ বছর আগে আগ্রহ ভরে যে গল্প পড়েছি বাংলা সাহিত্যের নামী আর দামী লেখকদের, এখন পড়তে গিয়ে অনেক গল্পকে মনে হয় বানানো, তেমন আহ্লাদ করার মত কিছু নয়, আবার অনেক গল্পের ভিতর পাই নতুন মাত্রা। নতুন কথা আবিষ্কার করে শিহরিত হয়। জ্যোতিরিন্দ্র নন্দীর যে গল্পই পড়ি এত বছর বাদে, মুগ্ধতা কমে না, বেড়ে যায়। এতটা বছর বাদেও শিখতে পারি। শিখি। তা গিরগিটি পড়ি বা তিন বুড়ি পড়ি, খালপোল ও টিনঘরের চিত্রকর পড়ি বা তাঁর সেই প্রথম নদী ও নারী পড়ি, মনে হয় এখনো লেখা হতে পারত এই সব গল্প। কিন্তু মনে হওয়া আর বাস্তবতা তো এক নয়। কে লিখবেন শিল্পের ওই সূক্ষতার কথা? জীবনের ওই আশ্চর্য সুধা ও গরলের কথা? খুব বড় লেখক কিন্তু কম পঠিত। সরল কাহিনী পাঠে অভ্যস্থ পাঠক সমাজ তাঁকে গ্রহন করেননি। পড়তে পড়তে বিরক্ত হয়েছেন ভয়ানক সত্যের মুখোমুখি হয়ে। কিন্তু যিনি লিখতে আসবেন আমাদের এই ভাষায়, তাঁকে তো পড়তে হবে জ্যোতিরিন্দ্র নন্দীকে। তাঁকে না পড়লে সাহিত্য পাঠ আর লিখতে শেখার পাঠ থাকবে অসম্পূর্ণ। শতবর্ষে তাঁকে প্রণাম।