দিন যায়।
কেবলী মোটেই ভালো নেই। কেমিস্ট্রী পড়তে তার ইচ্ছেই করে না। থিওরি তবুও চালানো যায়, প্র্যাকটিকাল বড়ই বিরক্তিকর ও নীরস। ইস, কেন যে ইংলিশ নিল না! এইসব যন্ত্রণার ওপর জুটেছে ঐ গোবুচন্দ্র-আজকাল হামেশা তাকে নিজের কলেজ ছেড়ে কেবলীর ক্লাশে পেছনের বেঞ্চিতে দেখা যায়। সে আবার নানারকম গলা করে প্রক্সি দিতে পারে - এই গুণটি আবিষ্কার করে ক্লাশের ছেলেরা তাকে মাথায় করে রেখেচে। এমনকি মাঝে মাঝে সে প্রফেসারদের প্রশ্নের উত্তর দেবার জন্য হাত তুলে থাকে, একদিন নাকি তাকে ক্লাশের সময় বারান্দায় দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে পিকেজি কষে ধমক দিয়েছেন। রক্ষে এই যে ক্লাশে কেবলীর চেয়ে বহুগুণে সুন্দরী ও স্মার্ট মেয়েরা থাকাতে ব্যাপারটা কেউ আঁচ করতে পারে নি। যাই হোক, গোবুর পক্ষে যে এ যাত্রা ডাক্তার কেন কম্পাউন্ডারও হওয়া সম্ভব নয় - এ বিষয়ে কেবলীর মনে সামান্যতম সন্দেহও ছিল না। সৌমিত্র মাঝে মাঝে গোবুচন্দ্রের গুণগান শোনায় - নাকি খুব ব্রিলিয়ান্ট ছাত্র(হুঁঃ) ওর বাবাও আর্মিতে ডাক্তার, কেমিস্ট্রী ভালোবাসে, তাই মাঝে মাঝে এখানে ক্লাশ করতে আসে (বাবাগো, এমন জীবও আছে দুনিয়ায়!!)। কেবলী ঠাকুরকে ডাকে - গোবু যা ইচ্ছে করুক, শুধু ওর আমার কলেজে ঘুরঘুর বন্ধ হোক, উটকো ঝামেলা কেবলীকে যথেষ্ট বিরক্ত ও বিব্রত করছিল।
সময় বয়ে যায় যথানিয়মে! পার্ট ওয়ানের রেজাল্ট বেরিয়ে গেল, কেবলী সকালের ট্রামে কলেজে চলেচে মার্কশিট না কী একটা নিতে।
কলেজের একটা স্টপ আগে ভীড় ঠেলে গোবুচন্দ্র উদিত হলেন আর চোখ দিয়ে কেবলীকে বল্লেন “নেমে পড়ো”। দেখাই যাক, ভেবে কেবলী নামলো। সেই স্টেথো-কাণ্ডের পর এই দৃশ্যে যা ভাবের আদানপ্রদান হল তা এইরকম -
গোবু - শুনলাম ফেল হয়েচ।
কেবলী - আমি তো আর ক্লাশের সময় অন্য কলেজে গিয়ে আড্ডা দিই না যে ফেল করব।
গোবু - যাক, পাশ করেচ তালে। একটা কথা বলার জন্যে —
ও ও ওরে বাবারে, মারে গেছি, গেছি রে-এ-এ-এ, মরে গেলাম রে-এ!!
আড়চোখে ব্যাপারটা দেখে কেবলী অত্যন্ত খুশী হল। আসলে, অভ্যেসমত ট্রাম থেকে নেবেই কেবলী ফুটপাথের দিকে যাচ্ছিল, সঙ্গে সঙ্গে গোবুও, আর ঠিক সেখানেই, যেন গোবুকে ফেলে দেবার জন্যই অতি চমৎকার ভাবে সাজানো ছিল একতাল গোবর, অন্যমনষ্ক ভাবে যাতে পা পড়া মাত্রই গোবু একেবারে পারফেক্টলি প্যারাবোলিক কক্ষপথে ভীষণ জোরে ধপ্পাস হয়ে গেছে আর এখন মাটিতে পড়ে চ্যাঁচাচ্ছে। লোকজন জড়ো হচ্ছে, “জল দিন, আহা আগে তুলুন্না, দাদার জামাকাপড় যে গোবরে মাখামাখি, এট্টু দেইখ্যা হাঁটাচলা করেন্না ক্যান” এইসব শুনতে শুনতে হৃষ্টচিত্তে কেবলী আস্তে আস্তে সরে পড়ল।
কলেজের কাজ সেরেটেরে, একটু আড্ডা মেরে কেবলী ও আরো কয়েকজন বেরোচ্চে, এমন সময় দেখা গেল সৌমিত্র হন হন করে আসচে (ততদিনে জানা গেছিল, গোবু আবার সৌমিত্রর কীরকম দাদা হত) -
“হ্যাঁরে তুই নাকি গোবুদাকে ঠেলে গোবরে ফেলে দিয়েছিস?”
কেবলী হেন কেবলী মেয়ে কাউকে ঠেলে ফেলে দিতে পারে, সেও গোবরে, এটা এতই অবিশ্বাস্য খবর, যে যেখানে ছিল দৌড়ে ঘটনা শুনতে এলো, আর সৌমিত্র হাত পা নেড়ে সবাইকে বোঝাতে লাগলো - “গোবুদা বলল, তোদের ক্লাশের ঐ কেবলী মেয়েটাকে দেখি ট্রাম থেকে নামছে। সরল মনে একটু রেজাল্টের কথা জিজ্ঞেস করতে গেছি, আর বল্লে বিশ্বাস করবি না, কথা নেই, বার্ত্তা নেই, কুনুই দিয়ে ঠ্যালা মেরে এক্কেবারে গোবরের মধ্যে ফেলে দিল।”
বেশীর ভাগই বিশ্বাস করলো না, তবু সৌমিত্রর চ্যাঁচামেচিতে এক আধজন যেন একটু ভেবে দেখচে মনে হল। তাইতে মহারেগে কেবলী বলে ফেল্ল - “বেশ করেচি, আবার উল্টোপাল্টা বলতে এলে ট্রামের তলায় পাঠিয়ে দেব, বলে দিস।”
হাতে কাজ কম্ম নাই, মজার গন্ধে সবাই নেচে উঠল -
হ্যাঁরে, কী উল্টোপাল্টা বলছিল, প্রায়ই বলে নাকিরে, পেটে পেটে এত, এইজন্যই এসে এসে বসে থাকত,
“আয় তবে কেবলীনী, পুরো গল্পটা শুনি” - ফুর্তির চোটে তিন পাক নেচেও নিল কেউ কেউ।
মুখটুখ লাল করে প্রায় কেঁদে ফেলেচে কেবলী, কথা খুঁজে পাচ্চে না, সৌমিত্রই উদ্ধার করল। সবাইকে ঠেলেঠুলে কলেজ থেকে বের করে দিল, তারপর গুছিয়ে বসে বল্ল -
“শোন মন দিয়ে, দুটো কথা আছে -
এক হল - গোবুদা কাল দিল্লী চলে যাচ্চে, ওর বাবা বদলী হয়ে গেছেন। ও ওখানেই পড়বে (বাঁচা গেল, আজই কালীবাড়ীতে পুজো দিতে হবে)।
দুই - গোবুদা জিজ্ঞেস করল, গোবুদাকে দিয়ে কি তোর কোন দরকার আছে?”
সোজা প্রশ্নের সোজা উত্তর - কোন দরকার নাই, ছিল না কোনদিন, ভবিষ্যতেও হবে না।
আশাহত সৌমিত্র কলেজে দাঁইড়ে রইল - মহানন্দে কেবলী প্রায় নাচতে নাচতে ট্রামে চড়ল।
এই অকিঞ্চিৎকর কাহিনীটি এতক্ষণে শেষ হয়ে যাওয়া উচিত ছিল, কিন্তু হয়নি, সামান্য একটু বাকী আছে।
প্রায় চার বছর পর আবার এক ডিসেম্বরের সকালে আমরা কেবলীকে দেখতে পেলাম। সে এখন রিসার্চ করে, অনেকটা স্মার্ট হয়েছে, স্কলারশিপ পায়, নানা জায়গায় যায়, বেশ আত্মবিশ্বাসী।
কখনো কখনো কলেজের দিনগুলোর কথা স্বপ্নের মত মনে পড়ে, কী বোকাই ছিল, কী ভীতু।
দু একবার মনে হয়েছে অত জোরে পড়ে গেল, চোট পেল কিনা একবার জিজ্ঞেস করা উচিত ছিল।
সৌমিত্রর সঙ্গে বন্ধুত্ব আছে এখনো, ওরা চারপাঁচজন একটা এনজিওতে যুক্ত, মাসের দুটো রবিবার সকলে এক বৃদ্ধাশ্রমে যায়, যতটুকু পারে স্বেচ্ছাশ্রম দেয়।
ঠাণ্ডার দিন, তাই সৌমিত্র বলেছিল কফিহাউসে ওয়েট করিস, সকাল দশটা নাগাদ, আমরা ওখানেই মীট করে একসঙ্গে বৃদ্ধাশ্রমে যাব। কেবলীর সরল মন, ভাবতে পারেনি এই নিরীহ প্রস্তাবের পেছনে কোন ষড়যন্ত্র লুকিয়ে আছে।
কেবলী কফিহাউসে গিয়ে দেখল তখনো দলের কারো দেখা নেই। বিরক্ত হয়ে বসল একটা খালি টেবিলে, বহুদিন পর এদিকে আসা, কলেজদিনের কথা মনে পড়ছিল খুব, ক্লিপদুটো কোথায় পড়ল কে জানে, চুল বেজায় উড়ছিল, আর চাদ্দিকের সিগারেটের গন্ধেই হয়তো অল্প অল্প নাক সুড়সুড় করছিল।
রুমাল কোমরে গুঁজে রাখে, সেটি না পেয়ে কেবলী মাথা নীচু করে ব্যাগে অন্য রুমালটা খুঁজছে, হেনকালে কে বলল “এই যে -”
গোবু্চন্দ্র - যাকে শেষ দেখা গিয়েছিল গোবরে পড়ে থাকতে। আগের চেয়ে শরীরটা সেরেছে, আকাশনীল শার্ট, নাকে চশমা, গলা একটু ভারী, হাতে কেবলীর ক্লিপ, রুমাল।
“আমাকে দরকার নেই বলেছিলে,তা এইসব সারাজীবন কুড়িয়ে আনবে কে?”
এককথার মানুষ কেবলী উত্তর দিল - “হ্যাঁচ্চো-ও”।
__________________________________________________________________________________________________________
ছবি : সোনালী সেনগুপ্ত