এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • হরিদাস পাল  ব্লগ

  • ফুটবল, মেসি ও আমিঃ একটি ব্যক্তিগত কথোপকথন (পর্ব ২)

    Ranajay Banerjee লেখকের গ্রাহক হোন
    ব্লগ | ১০ জুলাই ২০১৮ | ২১০৫ বার পঠিত
  • বছর তিন বাদে সুকিয়া স্ট্রিটের পাড়ায়, বাড়ির ঠিক সামনের মাঠে চুপচাপ বসে দেখতে হত বড়দের খেলা, নিজে খেলার উপায় ছিল কম। বিকল্প হিসেবে ফুটবলের জায়গা হিসেবে নেওয়া হল পাড়ার বন্ধু বাজুর বাড়ির সরু গলি, সাড়ে চার থেকে পাঁচ ফুট চওড়া, যেখানে আমি আর বাজুই শুধু দুটো দল, বল ছিল পয়সা থাকলে রাবার ডিউস ক্রিকেট বল আর না থাকলে সুতো বাঁধা প্লাস্টিকের ড্যালা।

    একে অন্যকে ঐ সরু জায়গার মধ্যে টপকে যাওয়ার মধ্যে দিয়ে শরীরের ভার পরিবর্তন, ভারসাম্য আর সব মিলিয়ে সামান্য জায়গায় ড্রিবলিং স্কিল তৈরির রান্নাঘর ছিল সেই গলি। বাজুর তৈরি হল পায়ের তেলো দিয়ে সূক্ষ্মভাবে চকিতে বল টেনে নেওয়ার ক্ষমতা, আমার এল নিমেষে এক পা থেকে অন্য পায়ে শরীরের ওজন নিয়ে যাওয়া আর দিক পরিবর্তনের নৈপুণ্য।

    সবদিক দিয়েই নিরীহ, গোবেচারা, মুখচোরা, কল্পনাবিলাসী, বই পড়ার উন্মাদ নেশা নিয়েও ছাত্র হিসেবে অতি সাধারণ ছেলেটির একমাত্র জেতার জায়গা হয়ে দাঁড়াল ফুটবল মাঠ।

    ক্লাস ফোরে স্কুল টুর্নামেন্টে প্রথমবার ক্লাস টিমে সুযোগ পেয়ে বাবার পায়ে ঝাঁপিয়ে, খেলার সরঞ্জামের দোকানে গিয়ে জীবনের প্রথম জার্সি কেনা হল, আদতে যেটা ছিল গোলকিপারের জার্সি। জানতাম না। কিন্তু ফুলহাতা ছিল তো। সে জার্সি নিয়ে মাঠে যাওয়া আর আবিষ্কার করা, আমি বাদ। আমার চশমা আছে বলে। বাড়ি ফেরা সারা রাস্তা কাঁদতে কাঁদতে আর বাবাকে বলতে বলতে, “ওদের সবার থেকে আমি বেশি ভালো খেলি তো, তাহলে নেবে না কেন?” বাবা বিষণ্ণ মুখ, নিরুত্তর। বাবাও তো সেবার আমার চশমার পরোয়া করেনি। স্কুল করেছিল।

    স্কুল করেছিল বারবার। স্কুল পালটে যাওয়ার পরেও। ক্লাস সিক্স কি সেভেন হবে। ইন্টার-স্কুল চার দশের (উচ্চতা চার ফুট দশ ইঞ্চির মধ্যে হতে হবে) টুর্নামেন্টে হিন্দু স্কুলের টিমে আমি রিজার্ভে। পাড়ার পাশেই হৃষীকেশ পার্কে খেলা। টিমের ক্যাপ্টেন ও সেরা মিডফিল্ডার বাজু আর টিমের সেরা ফরওয়ার্ড, ওপরের ক্লাসের বাবুয়া, যার পায়ে বল কথা বলত, দুজনেই ছিল আমার পাড়ার ছেলে। তাই বোধহয় আমাদের বোঝাপড়াও ছিল টেলিপ্যাথিক। আমাদের স্কুল তখন দু’ গোলে হারছে। আজো মনে আছে, দুজনেই বারবার আমাদের খেলার শিক্ষক নির্মলবাবুকে বলছে,” রণজয়কে নামান স্যার, এখনো জিতে যাব।“ নির্মলবাবু গোঁ ধরে আছেন, চশমা পরা ছেলেকে তিনি নামাবেন না। মাঠে বাজু পায়ে বল নিয়ে অসহায়ভাবে তাকিয়ে আছে দুজন মিলে গার্ড করা বাবুয়ার দিকে, প্রতিপক্ষ অনেক আগেই বুঝে নিয়েছিল এই একটিমাত্র ছেলে বল না পেলে বাকিরা কোন বিপদই তৈরি করতে পারবে না। সারাটা ম্যাচ, আমি মাঠের বাইরে দাঁড়িয়ে, অপেক্ষা ছেড়ে দেওয়া অপেক্ষায়। শুধু দেখতে থাকা, বাবুয়া কখনো বল পেলে অভ্যেসবশত কোথায় পাস দিয়ে যাচ্ছে, আর কেউ সেখানে নেই, যেখানে আমার অবধারিত থাকার কথা ছিল আর ধীরে ধীরে বাজু আর বাবুয়ার মেনে নেওয়া, সমস্ত প্রচেষ্টার অর্থহীনতার কথা। আমার মনে বুদবুদ কেটে যাওয়া চিন্তা, তাহলে কিসের জন্য দিনের পর দিন স্কুল টিমের সঙ্গে প্র্যাকটিস? কি অর্থ এই মাঠ থেকে দূরবর্তী অস্তিত্বের, যেখানে বাবুয়া ছাড়া আমার থেকে কেউ ভালো খেলে না? সে বছর আমাদের স্কুল শুধু হারেনি, দু’ বছরের জন্য ডিসকোয়ালিফায়েড হয়েছিল। কারণটা তৎকালীন খেলার শিক্ষকরা জানতেন।

    সেই রাগই বোধহয় বেরিয়ে এসেছিল পরের সপ্তাহে পাড়ার ম্যাচে। ঐ হৃষীকেশ পার্কেই। একদিকে মিলন সমিতি, যারা নার্সারি লিগ খেলে, নিয়মিত প্র্যাকটিস করে। অন্যদিকে আমাদের পাড়ার টিম - বাবুয়া, বরুন আর আমি। ততদিনে বাবুয়া আর আমার ড্রিবলিং আর বরুনের ফলস মুভ দেখার জন্য লোক দাঁড়িয়ে যায়, খেপ খেলতে যাওয়ার জন্য ভালো টাকার প্রস্তাব আসে আর ইস্টবেঙ্গল সাবজুনিয়র টিমের জন্য আমি স্পটেড হয়েছি (অসম্ভব তো ছিলই কারণ চশমা এবং হুমমম...ক্লাবটা মোহনবাগান নয় বলে)।

    সে খেলায় আমরা গুঁড়িয়ে দিয়েছিলাম মিলন সমিতিকে। প্রচণ্ড বৃষ্টির পর পা ডুবে যাওয়া কাদা মাঠ আমাদের কারোরই পছন্দ ছিল না। তবুও বাবুয়া বোধহয় খান চারেক গোল করে, আমি তিনটে। মনে আছে, আমি তিনজনকে কাটিয়ে গোলের কাছাকাছি, সামনে শুধু গোলকিপার। নিশ্চিত গোল। শেষ টাচ নিলাম, বল পুরো নিয়ন্ত্রণে, হঠাৎ পা ঢুকে গেল কাদায়, যতক্ষণে পা তুলতে পারলাম, ততক্ষণে গোলকিপার হেলতে দুলতে এসে বল হাতে তুলে নিয়েছে।

    হাফটাইম। প্রচুর প্রশংসা। মাঠের বাইরে দেখি এক দাদা দাঁড়িয়ে, বয়েসে বেশ খানিক বড়, পেশাদার ফুটবলার, পাড়ায় কদাচিৎ খেলে, তা দেখেই আমি তার বিশাল ভক্ত। আমি একগাল হেসে বললাম,” মাঠটা শুকনো থাকলে না...”। দাদার প্রথম কথা, “চশমা মুছে নিয়ে মাঠ দেখতে শেখ আগে।“ আমার সব হাসি মুছে গেল। “তোর পায়ে শট নেই, হেড করতে পারিস না চশমার জন্য, পাস দিতে শিখিসনি স্বার্থপর খেলোয়াড় বলে। না বুঝিস খেলার ছক, না আছে খেলার বেসিক চারটে স্কিলের মধ্যে দুটো।“ আমি তুতলে তুতলে বললাম,” না শট নেই কিন্তু আমি তো পাস দিতে পারি...আর রিসিভ ভালই পারি...আর ড্রিবলিং...” দাদা ঠাণ্ডা গলায় বলল, “যে আউটসাইড ডজ পারে না, সে পারে ড্রিবলিং! আর পাস দিতে গেলে আগে তো দেখতে হবে প্লেয়ার কোথায় আছে, কোথায় যাবে আর তার জন্য তো আগে বল থেকে মাথা তুলতে হবে। তুলিস তুই?” তখন কি আর মাথা তোলার অবস্থায় আছি?

    বলা বাহুল্য, সেদিন আর মাঠে নামিনি। ফুটবল শেখার সেই শুরু, খেলতে শুরু করার অন্তত সাত-আট বছর পর।

    (ক্রমশ)
    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।
  • ব্লগ | ১০ জুলাই ২০১৮ | ২১০৫ বার পঠিত
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • | ***:*** | ১১ জুলাই ২০১৮ ০৫:২৫65166
  • পরের পর্বের অপেক্ষায় ...
  • শঙ্খ | ***:*** | ১১ জুলাই ২০১৮ ১২:১৭65167
  • দারুণ দারুণ! এক নিঃশ্বাসে পড়ে ফেললুম
  • Ranajay Banerjee | ***:*** | ১৪ জুলাই ২০১৮ ১২:২৮65168
  • দ্বিতীয় পর্ব দেখে খুঁজে প্রথমটা বের করে পরপর দুটোই পড়ে ফেললাম...দারুন হচ্ছে লেখাটা !!
  • pi | ***:*** | ১৬ জুলাই ২০১৮ ০৩:৪৩65170
  • আপনি প্রথম পর্বের নিচে পরের পর্বগুলো আপেন্ডও করতে পারেন।

    আর বেশ ভাল লাগছে সিরিজটা, শেয়ারও করে ফেললাম ঃ)
  • | ***:*** | ১৭ জুলাই ২০১৮ ০৫:০২65171
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : guruchandali@gmail.com ।


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। যুদ্ধ চেয়ে প্রতিক্রিয়া দিন