এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • হরিদাস পাল  ব্লগ

  • ফুটবল, মেসি ও আমিঃ একটি ব্যক্তিগত কথোপকথন (পর্ব ১)

    Ranajay Banerjee লেখকের গ্রাহক হোন
    ব্লগ | ০৯ জুলাই ২০১৮ | ১৬৪০ বার পঠিত
  • সময়টা ছিল শরৎকাল, ছেঁড়া ছেঁড়া মেঘ আর উজ্জ্বল রোদের দিন, কিন্তু ক্লাস এইটের প্যাংলাপানা মোটা চশমা পরা ছেলেটা তার ক্লাসরুমে দাঁড়িয়ে সেসব কিছুই টের পাচ্ছিল না। টিফিন টাইম শেষ হয়ে আসছিল আর দরজার কাছে দাঁড়িয়ে সে ভাবছিল কোন পথে শেষ বেঞ্চে তার ব্যাগের দিকে গেলে, কোনো চাঁটি বা ঠ্যালা না খেয়ে পৌঁছনো যাবে। হেয়ার স্কুল থেকে এই হিন্দু স্কুলে আসার পর দু’বছর কেটে গেছে, অথচ তার ওপর চালিয়ে যাওয়া র‍্যাগিং থামেনি। সে ভাবতে পারে প্রচুর, কথা বলতে পারে কম আর মারতে পারে ঘোড়ার ডিম। প্রতিক্রিয়াহীন এই ক্রমাগত অত্যাচারে তার বন্ধু হয়ে ওঠেনি তেমন কেউ, শিক্ষকদের কাউকেই পছন্দ হয়নি তখনো, তাই তার একমাত্র উপায় ছিল শেষ বেঞ্চে বসে গল্পের বই নিয়ে নিজের কল্পনার দুনিয়ায় হারানো আর শেষ ঘণ্টি বাজলেই দৌড় দৌড়...দু’ কিলোমিটার দূরে তার প্রিয় আশ্রয়স্থান আর বাড়ি।

    শরতের সেই উজ্জ্বল দিনে ছেলেটি দ্বিধাজড়িত পা বাড়ালো শেষ বেঞ্চের দিকে আর যথারীতি একটি ছেলে এগিয়ে এলো, আচমকা পেছন থেকে জড়িয়ে ধরল তাকে, তুলে নিল হাওয়ায় আর আছড়ে ফেলল মাটিতে। কারণহীন। কারণ এটুকুই, ঐ ছেলেটি পারত আর এই ছেলেটি পারত না।

    এই ছেলেটির মোটা চশমা ছিটকে গেল, চোখ ভরে গেল নিষ্ফল আক্রোশের জলে আর সেই চশমাহীন, জলভরা আবছা দৃষ্টিতেই ধরা পড়ল সেই ছেলেটির হাসতে হাসতে ছুটে যাওয়া আর কি যে হয়ে গেল সে দিন...রাগ চোখ ছাড়িয়ে উঠে গেল আরও ওপরে, মস্তিষ্কে আর মস্তিষ্ক সারা শরীরে কি যেন বার্তা ছুঁড়ে দিল আর ঐ পড়ে থাকা অবস্থাতেই ছেলেটির পা চলল, সাইড ভলি যেন আর নিখুঁত ভাবে ছুঁয়ে গেল দৌড়ে যাওয়া ছেলেটির পায়ের গোছে আর বিস্মিত হয়ে পড়ে থাকা ছেলেটি দেখল তাকে হাওয়ায় সামান্য উঠে গিয়ে দুম করে মেঝেতে পড়তে, যন্ত্রণায় কোমরে হাত দিতে।

    উঠে দাঁড়াল সে, চশমা কুড়িয়ে নিল সে আর স্তম্ভিত সহপাঠীদের মধ্যে দিয়ে হেঁটে গেল শেষ বেঞ্চে। সেদিন ছিল বোঝার দিন, জানার দিন যে সেও মারতে পারে, প্রত্যাঘাত করতে পারে আর তাতে আক্রমণকারীর যন্ত্রণা হতে পারে। শুধু সে জানত না, এই ছিল তার হিংসার প্রতি আকর্ষণের জন্ম, খালি হাতে ডুয়েলের প্রতি তীব্র টানের জন্ম, নিজের শরীর থেকে অন্যের শরীরে কালশিটের স্থানান্তরের নেশার জন্ম। সে জানত না এক বছরের মধ্যেই সে হয়ে উঠবে মারপিটে দক্ষ, যার নাম স্কুলে ছড়াবে ‘মারকুটে রণজয়’ বলে, তার মোটা চশমা সত্ত্বেও।

    সেই রাগ স্তিমিত হতে লাগে আরও কয়েক বছর, যখন সে তার পাশের বাড়ির বন্ধুর সঙ্গে প্রায় নৃশংস লড়াইয়ের অভ্যাস শুরু করে এবং বাড়িতে লুকিয়ে এক কারাটে ক্লাবে ভর্তি হয়।

    সে এক অন্য গল্প কিন্তু সেই প্রাথমিক লাথিটির দক্ষতা এসেছিল কোথা থেকে? উত্তর ফুটবল।

    আমার বয়স তখন পাঁচ কি ছয়। বহু বহু দিন কেটে যেত মামাবাড়িতে। বাঁশদ্রোণীতে মামাবাড়ির সামনে বিশাল মাঠ, বর্ষায় গাঢ় সবুজ ঘাস আর কাদাজলে ভরা, তিরিশ-পয়তিরিশ বছর আগে চারদিকে সামান্য কিছু পাকা বাড়ি। বিকেলে খেলতে আসত মূলত চারপাশের কলোনির ছেলেরা, মধ্যবিত্তের কাছে যারা ভূষিত ছিল বস্তির ছেলে বলেই। তারাই ছিল আমার বন্ধু। তাদের বল ছিল যে।

    মনে পড়ে তাদের সঙ্গে খেলে প্রচুর হাসি মুখে নিয়ে মামাবাড়ি ফেরা, সারা গায়ে কাদা মাখা, বাড়ির সামনে বাবা বসে শশা খাচ্ছে। আমাকে দেখে প্লেট এগিয়ে দিয়ে জিজ্ঞেস করল, “খাবি?” মাথায় আসেনি বাবা তো জানত আমি শশা পছন্দ করি না। তখন খেলার আনন্দ আর পাঁচদিন বাদে বাবাকে দেখার আনন্দ মিলেমিশে একাকার, তখন নাকে মাটির আর ঘাসের গন্ধের সঙ্গে মিশে আছে বাবার গায়ের গন্ধ যদিও নাক সর্দিতে বোজা, তখন আমি বৃথা খুঁজছি প্যান্টের কোন শুকনো জায়গা যেখানে চশমা থেকে একগাদা কাদা মুছে নেওয়া যাবে।

    আমি হাত বাড়ালাম শশার প্লেটের দিকে আর পিঠ জ্বলে গেল হঠাৎ। ছিটকে পিছিয়ে এলাম, আবিষ্কার করলাম বাবার হাতে লিকলিকে বাঁখারি। পালাতে পালাতে শুনতে পেলাম বাবার চিৎকার, “বস্তির ছেলেদের সঙ্গে খেলা!...বস্তির ছেলেদের মত জামা খুলে খালি গায়ে খেলা!...”

    সেই ছিল আমার ফুটবলের জন্য প্রথম মার খাওয়া। তারপর চলতেই লাগল। না ফুটবল দেবতা তাঁর নৈবেদ্য হিসেবে আমার চশমা নেওয়া থামালেন আর না আমি এক সপ্তাহে তিনবার চশমা ভেঙ্গেও, মার খেয়ে শরীরে কালশিটে নিয়েও, ফুটবল থেকে একদিনও দূরে থাকতে পারলাম। পড়ে গিয়েও সাইড ভলি মাঠে এত করেছি, করে এত গোল দিয়েছি যে ক্লাসে ওভাবে পা চালানো কোন বড় ব্যাপারই ছিল না। শুধু জানার অপেক্ষা ছিল যে ফুটবল মাঠের বাইরেও, শুধু বেঁচে থাকার জন্যও কাজে লাগতে পারে।

    ( ক্রমশ)
    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।
  • ব্লগ | ০৯ জুলাই ২০১৮ | ১৬৪০ বার পঠিত
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • Abhijit Majumder | ***:*** | ০৯ জুলাই ২০১৮ ০৬:১৭64840
  • পুরো চুমু
  • aranya | ***:*** | ০৯ জুলাই ২০১৮ ০৮:৩০64841
  • ভাল লাগছে। আরও লিখুন
  • | ***:*** | ০৯ জুলাই ২০১৮ ০৯:২৪64837
  • বাহ নিজস্ব অভিজ্ঞতার স্বাদই আলাদা। লিখুন লিখুন।
  • সিকি | ***:*** | ০৯ জুলাই ২০১৮ ১১:৪০64838
  • পড়চি।
  • শঙ্খ | ***:*** | ০৯ জুলাই ২০১৮ ১২:১৮64839
  • পড়ছি
  • + | ***:*** | ১০ জুলাই ২০১৮ ০১:২৫64844
  • তাপ্পর?
  • pi | ***:*** | ১০ জুলাই ২০১৮ ০১:৩৬64842
  • বাহ, পরের পর্বের অপেক্ষায় ।
  • Tim | ***:*** | ১০ জুলাই ২০১৮ ০২:৪২64843
  • বাহ, আরো হোক।
    সামান্য খটকাঃ বাখারির মার পিঠেই পড়েছিলো? বর্ণনায় তো মনে হচ্ছিলো শশার থালা যেদিকে সেদিক থেকেই মারটা আসার কথা।
  • ফুটকি | ***:*** | ১০ জুলাই ২০১৮ ০৭:৪০64845
  • জম্পেশ!!
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : guruchandali@gmail.com ।


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। সুচিন্তিত প্রতিক্রিয়া দিন