এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • হরিদাস পাল  ব্লগ

  • আমার সোহিনী আর বাবার বউ

    Ajit Roy লেখকের গ্রাহক হোন
    ব্লগ | ২৭ জুন ২০১৭ | ১৭২২ বার পঠিত
  • সবচেয়ে ভোরে উঠে একটা মোক্ষম জিনিশ টের পাই। শালা, য-ফলাতেই মেয়েদের কাঁখতল দেখি আমার নির্ঘাৎ ঘোর অসুখ করেছে। এবং, রোগটা অস্বস্তির। এ যৌনব্যাধির একটা স্পেসিফিক নাম নিশ্চয়ই আছে, কিন্তু তজ্জন্যে মাকুন্দ ডাক্তারের মদত নেব না। কেননা রোগটা আমারই। অন্য কারো এতে ক্ষতি হচ্ছে না। না সমাজের। কোন সন্দেহ কিম্বা দ্বন্দ্ব ছাড়াই, কারো ওপর চোপা নেই, রোষও করছি না; আজ এতদিনে সহজ ও সরসর করে সুবোধ খরিসের মতো ফণা তুলে দাঁড়াল আবিষ্কারটা।
    না, যৌন না। যৌন জড়িত অপর কোনো ব্যাধি। মানসিক। এরপর যত বড় হচ্ছে ফণা, ভয়-পাওয়া কুকুরের মতো দরজায় দরজায় শিনা-মমতা-মেঘা-সোহিনী, ত্রস্ত বেশ্যার মতো মুখগুলো খোঁদলে ঢুকিয়ে নিচ্ছে ওরা। ছোটবেলায়, সে বছর আমি সেভেনের ঢিপি ডিঙোচ্ছি, সুশান্তদা মারা যাবার পর, ভোরবেলা, বাবার সঙ্গে গয়ায় বেড়াতে গেছি। বেড়াতে যে নয়, গলায় গামছা জড়ানো তেল-সিঁদুরের বাবাকে দেখেই বুঝেছি।
    বাবা বলল, 'কারুক্কে বলিসনি। তোর মায়ের পিন্ডি দিয়ে এলুম।'
    মা তখনও বেঁচে। পালটে গেছে তারা, দৃষ্টির ভাষা। হরদম আগুন জ্বলছে। দাউদাউ হব্যাশ। চোখ বড় বড় ও আগুনের ফিনকি। ডাকিনী যেনবা এবার সংহার মূর্তি ধরবে।
    সোহিনীর বেলা সেরম হলে আমি আত্মহত্যার ছুরি শানাতে বাধ্য হবো। নিছক পিন্ডিদানে তুষ্টি আমার সইবে না। চাই বদলা। গুমখুন। খুনী হামলা। চোরা প্রতিশোধ।
    আমি না পুরুষ! জানোয়ার।
    নার্সিং হোম ঘিরে ঝিমঝিমে অন্ধকার। বুনো লতার স্মেল। ছোট ছোট টর্চ জ্বলছে জোনাকির প্রায়। যেহেতু এখন লোডশেডিং, মড়াকান্নার রোলটাও চুপ মেরে আছে। আলো ফিরলে শুনতে পাবো তো? সৎকার সমিতির ভ্যান?
    "বাবা, দেয়ালের ফাটলটা তারপর থেকে আর খুঁজে পেয়েছো?"
    তাই তো! ক্যালেন্ডার সরিয়ে আমি চোখ ধরলুম। ফাটলটা খুঁজলুম। বহুক্ষণ খুঁজলুম। চোখ ধরাই থাকল। ধরাই। কতক্ষণ? একসময় চোখ ধরে এলো। চোখ ধরে বাঁকা আর সরু হয়ে এলো। তবু ধরা। অক্ষিতারা বুজিয়ে রেটিনা ঝুলে এলো। চোখ দুটো খুলে আমি তানিয়ার হাতে দিলুম।
    "আর হুঁকোর গন্ধ?" তানিয়া বলল, "বাবা, তুমি যে বলতে!"
    ফাটলটা খুঁজি তন্নতন্ন। দেয়ালে কান পাতি। হাত পাতি। মাথা পাতি। কোথাও নেই। আজ আর কেউ লাথিও ছুঁড়ল না। না চপেটা। না আছে নিঃশ্বাসের হুপহাপ্। খুবই শান্ত, নিস্তব্ধ। শুনশান। পদশব্দ, হুঁকো, হুপহাপ্। সবগুলোর সঙ্গে যে একটা সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল, যা এমনকি এতদিন খানিক নিবিড়ও হয়ে এসেছিল ----- আর খুঁজে পাচ্ছি না। আজ প্ৰমাণ চাইলে দেব কেমন করে? কিন্তু, গলায় ফাঁস গলিয়ে বসে আছে যে, আত্ম-হননমুখী সেই উজবুক, সে কি তবে মিথ্যে বলল?
    বাহাত্তর ঘন্টা পেরিয়ে গ্যাছে। এখনো কারো ফোন আসেনি।
    তৃপ্তায়ন বেঁচে আছে কিনা জানি না।
    তবে, সোহিনী মারা গেছে। আমি নিশ্চিত।
    কারণ, হাজার ডেকেও সাড়া পাইনি। কারণ, সে নড়েনি পর্যন্ত। কারণ তার ডানায়, চোখে, গন্নাকাটা ঠোঁটে তীব্র ঘুম জড়ানো। কারণ সে রাতপাখি নয়, বায়সারাতি বা বাদুড় নয়। সে মানুষ নয়। এ পৃথিবীর এখন সে কেউ নয়। আমি দূর থেকে বিছানায় দেখলুম, একটি অবশিষ্ট শয়ন। চিতা। সহমরণ। মানুষের সমাগম থেকে বহু দূরে, নীল শূন্যতায়।
    আচ্ছা, বেশ্যা মরলে বেশ্যা আর বেশ্যার দালালরা ভিড় করে। বাবুরা কি উঁকিও মেরে দ্যাখে?
    তা হলে, শেষ দৃশ্যটা অন্যরকম হতো। তাই না?
    টেনে ঘুমো। টেনে ঘুমো মানে? টেনেই না-হয় ঘুমোলুম। কেননা, তৃপ্তায়ন আমার বউয়ের বাছুর-বয়সের প্রেমিক, ও মরলে আমার একটা গেরো ঘুচবে। কিন্তু সব ঠিক আগের মতো হয়ে যাবে কি? আবারও কি আমূল উদোম খাওয়া যাবে? কাশীর আদি সংকটার গা থেকে, দেবীকে বিবস্ত্রা করে, ঘচঘচ করে ফুল-বেলপাতা চিবিয়ে খেতে দেখেছিলুম এক সাহিওয়াল ষাঁড়কে, ----- তেমন ভাবে? য্যাহঃ!
    যেসব দাম্পত্যে কোন 'কালো ঝাণ্ডা' নেই, এবং ঐ বেলুন, যা ফটাস শব্দে প্ৰমাণ নথি করতে চাইল যে, যাঁরা ভেবে থাকেন সংযমের সঙ্গে, গ্যাপ দিয়ে-দিয়ে, তথাকথিত ডিসিপ্লিনের সঙ্গে নর ও নারীর কামধান্দার আদৌ কোনো লংজিবিলিটি আছে, ইশ, তাদেরই দলে বিশু। তা, বিশু কদ্দিন বাঁট চোষেনি? বছর-১৫ তো হবেই। অথচ, ও নিজে যেভাবে কয়, এই পনেরো বছর ধরে ও আর ওর বউ কী, না, হ্যাপি কনজুগাল লাইফ 'লীড' করছে। এটুকু ইংরিজির বাংলায় একটা জবরদস্ত জবাব হয়। কিন্তু সে বড় রকের ভাষা। আপাতত, তাই, তামাম ক্ষোভ ও উষ্মা গিরমি রেখে বিশুর বিরুদ্ধে আমার একটাই শর্টপিচ ডেলিভারি : "চোপ শালা!"
    ----- "থালগাত দেখেছিস?" বিশু উল্টে নিজের ধন্বন্তরী চালালো, "ঢেঁকির গোড়ার নিচের গর্ত। ঐ থালগাতে ঢেঁকি পড়লে গর্ত উগরে দিতে পারবে? মরদ হয়ে মামুলি একটা মাগিকে হুল দিতে পারছিস না খালিপিলি ব্লেম দিয়ে মারছিস, শালা!"
    বিশুকে এ-কথা লগুড়-হাতেও বোঝাতে পারি না যে, দ্যাখ, ---- আধুনিক সমাজে মেয়েমরদের দাম্পত্য দেখে মহাপুরুষরাও বিরক্ত, ক্ষুব্ধ, পরেশান; কেউ কেউ তো মারমুখী। সামঞ্জস্য ও ভারসাম্যেই যে বহুত্বের স্থিতি সেটা পাপীতাপী ধর্মের ভোজবাজরাও টের পেয়ে গেছে। সেদিন একটা ধম্মপুস্তক পেলুম, কী লিখেছে জানিস? লিখেছে, ----- গণতন্ত্র, যুক্তিবোধ, বিজ্ঞান-মনস্কতা, মানবতা, সামাজিক ন্যায়, ধর্ম নিরপেক্ষতা, নারীমুক্তি, পরিবেশ চেতনা, সুস্থির যৌনজীবন আর বিশ্ববোধ ---- এই দশ দিশার একটাও তালা-মারা অবস্থায় পড়ে থাকলে মানুষের মুক্তি চৌপট। কী কবির মত কথাবার্তা দ্যাখ! এমনকি, প্রবচনের গোঁড়া লোকজনরাও বলাবলি করছে, ----- স্বেচ্ছা-অনুসৃত সুস্হ কামই জীবন। আস্থা চ্যানেলে দিনরাত হেদিয়ে মরে শুনিসনি? ----- নীতি-আবদ্ধ শক্তি-বাধ্য যৌনতাই বিকৃতি। নারীপুরুষের সম্পর্কের নান্দনিক ব্যাপারটাই যৌনতাকে বেস ক'রে। বাণিজ্যিক কারণে, বিকৃতির কারণে, ধর্মীয় অন্ধত্বের কারণে তা অসুস্থ চেতনায় পরিণত হয়েছে বলেই আজকের সমাজ বিপন্ন। সুস্হ যৌনজীবন বলে এ সমাজে কিছু হতে পারে না। তারজন্য দরকার গোঁড়া নীতি-শাসন থেকে মুক্তি। বাণিজ্যিক যৌনতা থেকে মুক্তি। সুস্থ যৌন জীবনের জন্য দরকার ভারসাম্য আর পোস্টমডার্ন কেলিকা। এসব গেলাসে ঘুলে কে খাইয়ে দেবে বিশু, তোকে? বিয়ের ১৫তম বর্ষপূর্তিতে কুঁথেপেদে তুই নতুন কী হাসিল করবি?
    বিশু বলল, "কিন্তু মার্ক্স? গান্ধী?"
    জবর সওয়াল। ..... এদিন বিশুকে আটক না করে পারি না, ---- ব্যাপারটা খুব সিরিয়াস, বেশি লাইক পাবো না জানি, তবু মন দিয়ে শোন নচেৎ ফাঁকাবি। ব্যাপারটা কী জানিস, এক্কেবারে উল্টো। আসলে, দর্শনের ওপর বিজ্ঞানের মানবঘাতী বিজয়ের অন্যতম উৎস ছিল মার্ক্সবাদ, যেটা বিশ্বজুড়ে এই বুজরুকি বিতরণ করেছিল যে মানুষের ভাবনাচিন্তা, সংকল্প, আদর্শ এসব সবকিছু ভৌত অবস্থানের ওপর আলম্বিত। কী করবি বল, এসব রকের ভাষায় লুব্রিকেট করে বোঝানো সম্ভব নয় বলেই তোর একটু টাইট লাগছে। নাহয় একটু দম নিয়ে নে, তারপর শোন। ..... মার্ক্সবাদ, তোদের এই মজুরপুলার মতবাদ একধরনের সুখভ্রান্তি ছড়িয়েছিল যে ইতিহাসের তামাম কায়দাকানুন 'জানা' হয়ে গেছে এবং দুশ্চিন্তার কোন কারণ নেই। কেননা আমরা চাই বা না-চাই, মানুষ সর্বোতোমুখী (বিশু মুখ কোঁচকাস না) মুক্তির পথে এগিয়ে চলেছে। ইতিহাসের একটাই গোল (গণ্ডগোল ভাবিস না) ---- শ্রেণীহীন সমাজ তথা পুঁজিতন্ত্র আর সাম্রাজ্যবাদ নিছক ক্ষয়িষ্ণু শক্তি মাত্র। এই মতবাদটা গিলে পৃথিবী জুড়ে তোর মত বেওকুফের তো কমতি নেই, তারা নিজেদের ফিউচার সম্পর্কে নিশ্চিত হয়ে মরীচিকার ঢেউয়ে গোঁত্তা খেতে লাগল। ষাট দশকেই এতখানি মনে হয়েছিল বিশ্বজুড়ে এই বুঝি সাম্যবাদের বিগুল বেজে উঠল। কিন্তু মানবতার এই ধামগুজারি যজ্ঞ খুব ছোটা-সা-ব্রেকের পরেই বিষাক্ত ধোঁয়া ওগরাতে শুরু করলে দেখা গেল কমিউনিস্ট দেশগুলোতেও সাম্রাজ্যবাদী এলিমেন্টগুলো আরও পোক্ত হয়ে গেছে। এর মানে এই নয় যে পুঁজিবাদ আর সাম্রাজ্যবাদই শেষ কথা; কিন্তু এতে একটা ট্রুথ ধরা পড়ে গেল যে এ-দুটোকে যতখানি রোগা আর দুর্বল মনে করা হয়েছিল আদপেই ততখানি নয়।
    এবার গান্ধী। ভাল জুড়েছিস বটে! কোথায় মার্ক্স আর ফ্রয়েডকে জুড়বি, মানে, রেভলিউশন আর কপুলেশনকে, ---- তার জায়গায় জুড়ে ফেললি কোটহ্যাট আর হেঁটোধুতি! বেশ বেশ। যুবরাজ সিদ্ধার্থ এক-হারেম ডবকা মেয়েমানুষের ভামিনীগিরির আতংকে মাঝরাতে উধাও হয়ে,শেষাবধি বুদ্ধ। গান্ধীর কেসটা উল্টো। ১৯০১ সালে যখন সবরকমের যৌনাচার থেকে সন্নেস নেবেন ভাবলেন, ততদিনে কস্তুরবার সঙ্গে লাখদফা শোয়া আর প্রক্রিয়েশনের বেসিক ব্যাপারটা সারা হয়ে গেছে। একজন গ্যাড়া আর গোঁড়ার পক্ষে যা স্বাভাবিক, ঐ যৌনাচার থেকে মুক্তি পেতে কী-না করলেন! শেষ পরীক্ষা দিলেন মানু গান্ধী, ড. সুশীলা নায়ার, জয়প্রকাশের বিবি প্রভাবতী নারানের সঙ্গে উদোম ন্যাংটো শুয়ে। গুরুর, পরে যিনি রাষ্ট্রপিতা হবেন, তাঁর ভীমরতি দেখে চ্যালাকুলের তো পোঁদের গু অব্দি সিঁটিয়ে গেল। আসলে, কেসটা বোঝ, ----- সেক্সউয়ালিটিকে গান্ধী হিংসা আর আগ্রাসনের সমার্থক ভেবেই ওসব করে ফেলেছিলেন। শরীরের সুখশান্তির জন্য গোয়াগোয়ি চালালে নাকি মানুষ জানোয়ার ব'নে যায়, ভাবতেন; স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে যেটা হবে বলে ভাবতেন, ---- যৌনতাহীন ফক্কা আলুবেগুনের ঘ্যাট, অর্থাৎ নিষ্কলুষ প্রেম নিয়ে শূন্যে মাতনবাজি। তাইলেই নাকি ঈশ্বরের ডাইরেক্ট টাচে থাকা যাবে। বউয়ের কারিয়া ছুঁয়েছো যেই, আনশাটকা ঈশ্বর গায়েব। শালা, মে-মানুষের গায়ে ইন্সুলেটার ফিট করা আছে নাকি বে?
    আসল ভিলেন হলো গিয়ে আমাদের মধ্যে দুবকি মেরে বসে থাকা 'পুরুষতন্ত্র'। এই তন্ত্র এমন হারামি যে আমাকে তোকে কারুক্কেই নোংরা, রুক্ষ আর আগ্রাসী করে তুলতে বাদ রাখেনি। সোহিনীকে ভাল লাগত যখন, আর আজ লাগাতে পারছি না বলেই লাগাতে চাই ---- সবেতেই আগ্রাসন; ---- গান্ধী-মতে, জানোয়ারগিরি। সহজিয়া তো নয়ই। অবশ্য সহজিয়া ধর্মেও মিস্টিক পার্টনার হিশেবে পরকীয়া বা কল-গার্ল গ্রহণের ইঙ্গিত আছে। এদেশে 'অর্ধনারীশ্বর' বলে একটা ধারণাও আছে, ক্যালেন্ডারে দেখবি, ----- বিষ্ণুর পাশে কোন মেয়েমানুষ নেই। বিষ্ণু নাকি উভলিঙ্গ। মডার্ন সাইকো-দুনিয়া তো পুরুষের মধ্যে মেয়েদের অ্যানিমা আর মেয়েদের মধ্যে পুরুষের অ্যানিমাসও খুঁজে পেয়েছে। আজকের ইকোফেমিনিস্টরা একে বলছেন অ্যান্ডরোগনি; যেটা আসলে আমাদের সেই পুরনো অর্ধনারীশ্বর। গান্ধী চেয়েছিলেন এই অর্ধনারীশ্বর প্রেম, ----- শরীরী কামনাবর্জিত অহিংস যৌন অন্বেষণ। সেটা কী মাল টাকলু বেঁচে থাকলে নাহয় খোলসা হয়ে যেত। কিন্তু, এখন আর কিছু করার নেই। তাছাড়া, রিপিট করছি, বিয়ের ১৫তম বর্ষপূর্তিতে কুঁথেপেদে তুই কী আর নতুন হাসিল করবি? বিশু!
    কাল রাতেও পরপর দুটো স্বপ্ন দেখলুম, বুঝলি! ছোটবেলায়, মা বেঁচে থাকতে, বাবার সঙ্গে গয়া এসেছি মায়ের পিন্ডি দিতে। তারপর, রাতে, অপরূপ জ্যোৎস্নায় পথ ভুল করে আমি আর সোহিনী, শ্মশানে। ছড়াতে ছড়াতে ওখানেই থমকে গেছে জনালয়। লোকে মরলে ফলগুতে নিয়ে গিয়ে দাহ করার নানান হ্যাপা, অদ্দূর না গিয়ে, কাছেই, কাছাকাছি একটু এগিয়ে সরু পিচ-সড়কটা বোঁ করে ঘুরে গেছে ডাইনে। অতখানি হেঁটে হাঁপাতে হাঁপাতে শিশির ভেজা ঘাসের ওপর লুটিয়ে পড়েছিলুম দুজনে, ---- আমি আর সোহিনী। কতক্ষণ কে জানে। আনমনে ঘাস বা ঐ জাতীয় কিছু কুড়োবার চেষ্টায় আমি, আর তখুনি, শক্ত লোহা-মতো কী-একটা হাতে লাগতেই ধড়মড়িয়ে উঠে বসি। ----- শাড়ির ছ্যাওটা বা খুঁটে বাঁধা একটা চাবির গোছা। চাবি তো? হ্যাঁ, চাবি। তার গোছা। খুঁট অনুসরণ করে আমার চোখ মুহূর্ত-মধ্যে বিস্ফারিত। মাটির 'পড়ে লোটানো ওটা কী? ..... এরপর সোহিনীরও চোখ বিস্ফারিত। শিশির-ঘাসে চিৎ-শোয়ানো সম্পূর্ণ উলঙ্গ এক নারী শরীর। নারী তো? হ্যাঁ, এমনকি, অন্তত, আয়াতের চেয়ে বিশাল বেশি পুষ্ট স্তনদুটিকে দেখে সোহিনীর লাশ বলেও মনে হলো আমার; দূর থেকে আমি চিনতেও পারলুম।
    "স্বপ্নে সোহিনী, আবার সোহিনীর লাশও!" বিশু হাসল, "শালা, এত জায়গা থাকতে, বিছানা আর বাথরুম থাকতে, ওই জনশূন্য গোরস্থানে অমন বেহুদাভাবে লাশ হয়ে পড়ে থাকে কেউ? আর, সোহিনী, সে কেন ওখানে?"
    না না, সোহিনী একা নয়। আমি বলি, বিশু, তুইও তো ছিলি। তুইই তো বললি, 'বুকে মাথা চেপে হার্ট চালু আছে কিনা দ্যাখ, তারপর নিয়ে চল চ্যাংদোলা করে কী আর করবি!'
    'নেমে নাচো গো ন্যাংটো নারী' ---- রামপ্রসাদী গাইতে গাইতে, যদ্দুর মনে পড়ে, তোর কথাতেই আমি সরাসরি বুকে মাথা পাততে এগিয়ে যাই। "আরে, ইয়ে, ---- করিস কী!" ----- পেছন থেকে তুই চেঁচিয়ে উঠলি, "ও কি আর মাল আছে? দাঁড়া, আমাকে টেস্ট করতে দে।"
    আমি বললুম, "বাবা, দেখছো! মার চোখদুটো কেমন হাঁ হয়ে আছে! বেঁচে থাকলে ওইভাবে তাকিয়ে থাকতে পারত?"
    গয়া থেকে ফেরার পথে বাবা যেন নিজের মনেই বলেছিল, "সত্যি,মেয়েরা মরলে আর মাল থাকে না। দেবী বনে যায়।"
    দেবী! হ্যাঁ, স্বপ্নে, সোহিনীর শুধু চোখ কেন, দাঁতের চাপে কেটে বিঘৎখানেক বেরিয়ে ঝুলে-পড়া জিবটা দেখে আমারও কেমন একটু ছ্যাঁৎছুঁৎ করেই ছিল; ---- কিন্তু, অল্প-আধটু দেবী-টেবীও দেখাচ্ছিল না কি? আ, মরা নারী-ই উলঙ্গ হলে দেবী লাগে। কই, জ্যান্ত সোহিনীকে কখনো লাগেনি তো! মৃত বলেই কি?
    শক্ত-নরম ফোলা মোমস্তনে মাথা পাতা আর মেয়ে-শরীরের রেমিংটন বু ---- সোহিনীর নারী ও বাবার দেবী ধন্দ ইকোলজি আমি ভুলব না; স্বপ্নে আমি যৌনপীড়িত ঘাসবন, কোটরের ডিম চুরিয়ে খাওয়া আলখরিস, স্বপ্নেও দাবি করছি উষ্ণফিট সদাচারী শীতসাথী রমণীর স্ববিশিষ্ট ভাপ, ----- সে কেমন তার বোধ ও অনুভূতি থেকে আলোকবর্ষ অচ্ছুৎ হয়ে আছি, জন্মাবধি। সবাই জোট বেঁধেছে আমার এই স্বপ্নের চারগায়ে, বেনো আঙুলগুলো সোহিনীর মোমে ঢুকে পড়তে চাইছে।
    বেশির ভাগ স্বপ্নে কামনার রঙ যেরম হয়, ----- অধরা; কোমরে ছোরা-বাঁধা নিশাবাদুড়ের হিংস্র আস্ফালন, ------ যৌনতা, এরপর দেখি শব্দ হচ্ছে না। না হুঁকোর গন্ধ। পুরো ফাঁকা। পথে লোকজন নেই। চাপরাশি চাবির সরঞ্জাম টেবিলে ফেলে বাইরে গিয়ে খৈনি ডলছে। টেবিলগুলো ফাঁকা, শুধু অদূরে বিধবা স্টাফটি ঠোঁটে লিপগ্লস বোলাচ্ছে। মাথা নোয়ানো, চুল উড়ছে মেয়েটার অনুস্বার ও এবংগুলো-সুদ্দু তাল দিচ্ছে দেখে, দেখতে দেখতে, পরপর তিনটে ফাঁকা টেবিল পেরিয়ে, বাঁ দিকে বাঁক নিয়ে আমি মাকুন্দ বোসের চেম্বারে ঢুকি। ডাক্তার প্যান্টের জীপারটা এক ঝটকায় ওপরের দিকে খিঁচে, আমি দেখলুম, গ্লেজারের ওপর থেকে ভারি আর মোটা ফোলিও ব্যাগটা তুলে নিয়ে অপ্রস্তুত হাসলেন। আমি দেখলুম ওঁর নিচের মাড়িতে আজ একটাও দাঁত নেই। আমি দেখলুম, কিছু কালো পিঁপড়ের আনাগোনা, শুধু।
    আমি বললুম, আমি কিছু দেখিনি। এই এলুম।
    আমি দেখলুম, আমার ডান হাতটা তলপেটের দ্রড়িষ্ঠ ভাবটা লেহন করতে লেগেছে।
    বোধ আর অনুভূতির কোনো চেহারা আছে কি? যৌনতা আর ভালোবাসার? সোহিনী আর আমার বাবার বউয়ের?
    বহুদূরে, পৌনে ১১ কিমি দূরে দিগন্ত। প্রতিভাত। ঐ অবধি পাটকিল ফ্রকের ঘের, সে-অবধি নরম ছায়া। বাহিরে বেগতিক বাতাস, খ্যাপা, প্রডিগাল বাউলের মাফিক। ঘুরছে, নাচছে।। মধ্যেমধ্যে জারুল মধ্যেমধ্যে বাবলা গাছের আগায় মুখ ঘষছে। এরই মধ্যে দরজায় ছিটকিনি না তুলেই ঘুমিয়ে পড়েছিলুম।
    আসলে পালাতে চাইছি। ওর সঙ্গে দেখা না হয় তজ্জন্যেই যাবৎ বন্দোবস্তি।
    ওর মুখোমুখি হওয়া খুব বিপজ্জনক
    ও আজ সব হারিয়েছে
    ও আজ জেনেছে, আমি ওকে কখনো ভালোবাসিনি। -----
    ওর দেহ। এ বাদে।
    আমাকে ভালোবাসতে না পেরে কেউ মারা গেছে। কে সে? আমি সোহিনীর, আর বাবা ওর বউয়ের ভস্ম হাতড়াচ্ছি। না-পোড়া নাভি। পেরিয়ে পেরিয়ে, না জানি কোন প্রত্যয়ে। অজস্র কপিনরঙা চিৎকার আমার আর বাবার চতুরাশ জুড়ে, মাথার চাদ্ধারে। একটা অদ্ভুত সাইকেডেলিক ভিজ্যুয়াল তৈরি হচ্ছে চেতনার নিশ্চেত পরিধি ঘিরে। আমি সোহিনীর চোখ কচলে দিতে চাই। ওর নাড়ি ঢুঁড়ি। আঙ্গুল দিয়ে ছিঁড়ি চুল। দেখি সোহিনীর চোখ নেই। নাড়ি গায়েব। শরীরে আগুন নেই কোনো। যোনি লোপাট। শুধু লাভা-রঙের সেরিব্রাম ফেটে গদগদ গলে পড়ছে চেতনাহীনতার যাবৎ গরল ....
    নীল, নরম আকাশে একটা চিল উড়ছে।
    একা।
    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।
  • ব্লগ | ২৭ জুন ২০১৭ | ১৭২২ বার পঠিত
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • Abhishek | ***:*** | ২৭ জুন ২০১৭ ১০:৩৬60510
  • Ajit da swagoto !
  • pi | ***:*** | ২৮ জুন ২০১৭ ০২:৫৮60511
  • অন্যরকম। আরো লিখুন।
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : guruchandali@gmail.com ।


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। যা খুশি প্রতিক্রিয়া দিন