এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • হরিদাস পাল  ব্লগ

  • #মারখা_মেমারিজ (পর্ব ৯)

    Biswajit Hazra লেখকের গ্রাহক হোন
    ব্লগ | ১৭ মার্চ ২০১৯ | ২২৮৪ বার পঠিত
  • কাং ইয়াৎজে বেসক্যাম্প (০৯.০৯.২০১৮)
    ___________________________

    স্টেন্সিলের ডাকাডাকিতে যথারীতি ঘুম ভেঙেছে সকাল ছটায়। টেন্টের জিপার খুলে হাত বাড়িয়ে গরম চায়ের গেলাস নিতে নিতে রিফ্লেক্সে সবাই একবার ঘাড় তুলে তাকিয়েছে আকাশের দিকে। ওয়েদার কেমন? ক্লিয়ার হয়েছে? নাকি আরও ডাউন? নাঃ ... আরও ডাউন হয়েছে কিনা সেটা বোঝা গেলো না। কিন্তু ভালো কিছুও হয়নি। মেঘ। কুয়াশা। কেমন যেন একটা থম মেরে আছে চারদিকটা।

    এই এক মুশকিল। দু’রাত্তির বেসক্যাম্পে বসে থেকে থেকে অলরেডি কেমন যেন ঝিম লাগতে শুরু করেছে। কখন ওয়েদার ভালো হবে, কখন ওপরে ওঠার গ্রীন সিগন্যাল মিলবে, তার জন্যে হাপিত্তেশ করে বসে থাকো! নাথিং টু ডু। কোনও কিছুই তোমার হাতে নেই। সবই মায়ের ইচ্ছে!

    চুপচাপ বসে থাকতে থাকতে কত কি হাবিজাবি চিন্তা যে মাথায় ভিড় করে। পাহাড়ে বেড়াতে আসা শুরু বাবা-মায়ের হাত ধরে। সেই কোন ছোটবেলায়। কাঠমান্ডু, পোখরা যাওয়া হয়েছিলো গরমের ছুটিতে। সেই প্রথম ‘ট্যুরিস্ট’ শব্দটার সাথে পরিচয়। মনে আছে, ইশকুল খোলার পর বন্ধুবান্ধবদের সাথে যখন দেখা হলো, তখন যারা বেড়াতে-টেড়াতে বিশেষ যায় না, মন দিয়ে পড়াশোনা করে, তাদের থেকে নিজেকে বেশ আলাদা মনে হয়েছিলো। ভাবখানা হলো ... ইশ্‌, তোরা বাড়ির বাইরে বেরোস না, খালি পড়াশোনাই করিস, জানিসই না ভূগোল বইয়ের বাইরে হিমালয় পাহাড়টা আসলে কেমন দেখতে! আমি ট্যুরিস্ট। আমি জানি, হিমালয় দেখতে কেমন! তাপ্পর আস্তে আস্তে ইশকুলের পাট চুকিয়ে কলেজে। পকেটে দেড়শটা টাকা আর কাঁধে একটা ঝোলা ব্যাগ নিয়ে উড়নচণ্ডী কিছু বন্ধুর সাথে বিনা-টিকিটের ট্রেনে চেপে আজ অযোধ্যা পাহাড়ে, তো কাল চক্রধরপুরের জঙ্গলে। হেসাডি। টেবো। জংলি হাতি দেখতে গিয়ে মশার কামড়ে ম্যালিগন্যান্ট-ম্যালেরিয়া বাধিয়ে হাসপাতালে দু’মাস। ‘ট্র্যাভেলার’ শব্দটার মানে তখন একটু একটু করে বুঝতে শুরু করেছি। ঘোরার নেশা মাথায় বেশ জেঁকে বসছে। মনে হলো, নাঃ, ‘ট্যুরিস্ট’-দের রুটিনে বাঁধা সৌখিন ট্যুরের চেয়ে ‘ট্র্যাভেলার’-দের আন্‌-প্ল্যান্ড, অগোছালো ঘুরে বেড়ানোটাতেই তো বেশী কম্ফর্টেবল্‌ লাগছে! তেমনটাই চলছিলো। বেশ কয়েক বছর। কোনও একটা ম্যাগাজিনে গোমুখ-তপোবনের ছবিটা চোখে না পড়লে বোধহয় তেমনটাই চলতো। ‘ট্রেকিং’ ব্যাপারটার সঙ্গে সেই প্রথম মোলাকাত। গঙ্গোত্রী থেকে গোমুখ, সেখান থেকে তপোবনের রাস্তায় হাঁটতে হাঁটতে বুঝলুম, যদ্দুর গাড়ি চলে, মোটোরেবল্‌ রাস্তা আছে, তদ্দুর হিমালয়টা একরকম। তারপর পুরো অন্যরকম। এই লুক্‌টা দেখতে হলে না-হেঁটে উপায় নেই। পায়ে-চলা রাস্তায় যদ্দুর দমে কোলায়, হাঁটো। রাতে টেন্ট লাগাও। পরদিন আবার হাঁটো। ধীরে ধীরে এন্ট্রি মিলবে ভরপুর এক রূপকথার রাজ্যে। যেখানে পাহাড়চূড়োগুলো দিনরাত খুনসুটি করে মেঘের সাথে। মেঘও তেমনি। মোমের মতো গলে গিয়ে বরফ কুচি হয়ে ঢেকে দেয় চূড়োগুলোকে। কি প্রেম! কি প্রেম! সেই বরফ জমতে জমতে কখন যেন তৈরি হয়ে যায় আস্ত একটা হিমবাহ। যে হিমবাহের বুকে স্বপ্নের মতো একদিন জন্ম নেবে নীল টুকটুকে একটা নদী। আহা! ট্রেকিং-এর ভূত মাথায় না চাপলে থোড়ি এ’সব দেখতে পেতুম! তা মিথ্যে কথা বলে লাভ নেই, ট্রেকার হিসেবে মাঝে মধ্যে খানিক আত্মশ্লাঘাও বোধ হতো। আমি যা দেখি, তা যে অন্য কেউ দেখে না, সেটা কি খুব কম কথা! হুঁ হুঁ বাওয়া। বললে হবে! কিন্তু তখনও ‘ক্লাইম্বার’ প্রজাতির সঙ্গে আমার সাক্ষাৎ এনকাউন্টার হয়নি। যা এই রুটে এসে হলো!

    বেসক্যাম্পে দশদিন ধরে ঘাঁটি গেড়ে থাকা একটা বিদেশী টিমকে দেখে বুঝলুম, ‘ক্লাইম্বার’ হতে গেলে শুধু পাহাড়কে ভালবাসলেই হয় না। ফিজিক্যাল ফিটনেস থাকলেও হয় না। বোধহয় একটা কিলিং-ইন্সটিংটও লাগে। ওয়েদার খারাপ হোক। হোয়াইট আউট হোক। বরফ পড়ুক। বেসক্যাম্পে আমি মাটি কামড়ে পড়ে থাকবো। আমি নয়, বরং ওয়েদারই খারাপ হতে হতে একদিন বোর হয়ে যাবে। তারপর কোনও একটা রাতে যেদিন মেঘ কাটবে, তারা দেখা যাবে আকাশে, ওমনি জুতোয় ক্র্যাম্পন লাগিয়ে কোমরে দড়ি বেঁধে আইস-অ্যাক্স হাতে বেরিয়ে পড়বো ফাইনাল অ্যাসল্টে! ক্লাইম্বাররা হলো ভিভিয়ান রিচার্ডসের জাত। তুমি বুক সমান বাউন্সার দাও। আমি চ্যুইং গাম চিবোতে চিবোতে ডিফেন্স করবো। ব্যাট বেয়ে বল নামবে পায়ের কাছে। তুমি অফ-স্ট্যাম্পের বাইরে বিষাক্ত আউট স্যুইং দাও। আমি চ্যুইং গাম চিবোতে চিবোতে ডাক্‌ করবো। একটা না একটা লুজ বল তুমি দেবেই। চ্যুইং গাম চিবোতে চিবোতে ঠিক সেই বলটাই আমি মাঠের বাইরে পাঠাবো। তোমার মাথার ওপর দিয়ে। উরি বাবা! সে ভারি কঠিন কাজ। অতো এলেম আমার নেই!

    সারাটা দিন ডাউন ওয়েদারেই কাটলো। সবাই কম-বেশী রেস্টলেস। কতক্ষন আর এভাবে হাত-পা গুটিয়ে বসে থাকা যায়! ঠিক হলো, আজ রাতে একটা হেস্ত-নেস্ত করা হবে। ওয়েদার যদি ৭৫%-ও সাথ দেয়, সেক্ষেত্রে ওপরে ওঠার চেষ্টা করা হবে। সবাই নয়। যারা যারা ফিট এবং কনফিডেন্ট ফিল করবে, কেবল তারাই সামিট অ্যাটেম্পট করবে। বাকীরা সেক্ষেত্রে ওয়েট করবে বেসক্যাম্পে। কিরণের কথা অনুযায়ী সন্ধ্যে সাড়ে সাতটার মধ্যে ডিনার করে নেওয়া হলো। রোপ, হার্নেস, আইস-অ্যাক্স, স্পাইক সব রেডি-টু-মুভ কন্ডিশনে রেখে মোবাইলে অ্যালার্ম দিয়ে সেঁধিয়ে যাওয়া হলো স্লিপিং ব্যাগে। ঠিক রাত এগারোটায় ফাইনাল ডিসিশন নেওয়া হবে।

    অস্বস্তিকর কয়েকটা ঘণ্টা খালি এ’পাশ আর ও’পাশ। এগারোটা বাজতে তখন আর অল্পই বাকি। ফ্যাঁস্‌ ফ্যাঁসে একটা শব্দ শুরু হলো। প্রথমে আস্তে। তারপর বেশ স্পষ্ট। একটানা এই একঘেঁয়ে শব্দটা আমাদের চেনা। খুব চেনা। টেন্টের ছাদে বরফ পড়ছে! ঘোর কলি! মেঘ, কুয়াশা, বৃষ্টির সাথে তাহলে আল্টিমেটলি তুষারপাতটাও যোগ হলো! এই পরিস্থিতিতে আর পাঁচটা ক্লাইম্বিং গাইড যা সাজেস্ট করবে, কিরণও তাই করলো। ডিসকারেজ করলো বেরোতে। আর যাই হোক, অ্যাক্সিডেন্টের ঝুঁকি নেওয়াটা কোনও কাজের কথা নয়। তার সাজেশন, রাতটা কাটিয়ে সকালে দেখা যাক আকাশ কেমন থাকে। যদি ওয়েদার ক্লিয়ার হতে শুরু করে, তাহলে আর একটা দিন দেখা যেতে পারে। আর যদি একই রকম ডাউন থাকে, তাহলে নীচে নেমে যাওয়া ছাড়া উপায় নেই। ঠিকই বলেছে। এছাড়া আর কী-ই বা আমরা করতে পারি!

    অ্যালার্ম অফ্‌ করে আবার ঢুকে যাওয়া হলে স্লিপিং ব্যাগে। বেসক্যাম্পে এটা আমাদের থার্ড নাইট। বাইরে বরফ পড়ার শব্দ বেড়েই চলেছে। নাঃ! আল্টিমেটলি সিগন্যাল রেড বলেই মনে হচ্ছে। তবু, দেখা যাক কাল সকালে উঠে। যদি কোনও মিরাকেল ঘটে!

    (সঙ্গের ছবিটা বেসক্যাম্পের। দুপুর-বিকেলের দিকে তোলা। ওয়েদার ক্লিয়ার ছিলো না ঠিকই, তবে এটাও বোজা যায়নি যে রাতে স্নো-ফল্‌ শুরু হবে।)


    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।
  • ব্লগ | ১৭ মার্চ ২০১৯ | ২২৮৪ বার পঠিত
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • | ***:*** | ১৭ মার্চ ২০১৯ ০৮:২০49562
  • ইশশ তারপর?
    এত্ত দেরী করেন কেন মশাই?
  • বিপ্লব রহমান | ***:*** | ১৮ মার্চ ২০১৯ ০৪:৪৪49563
  • উফফ! তারপর?
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : guruchandali@gmail.com ।


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। আলোচনা করতে প্রতিক্রিয়া দিন