আমাদের দেশে -- ভারত, বাংলাদেশ ইত্যাদি জায়গায় -- শিক্ষা হলো প্রধানতঃ চাকরিবাকরি, কাজকর্ম পাওয়ার একটা রাস্তা। এবং মালিকদের ও শাসকদের নির্ধারিত পথ অন্ধভাবে অনুসরণ করার যোগ্যতা অর্জন করা।
কিন্তু এ শিক্ষা কোনো শিক্ষাই নয়।
শিক্ষার প্রধান উদ্দেশ্য হলো যোগ্যতা অর্জন করা, যাতে প্রশ্ন করার, গবেষণা করার, চ্যালেঞ্জ করার ক্ষমতা জন্মায়। ক্রিটিকাল থিঙ্কিং অর্থাৎ গভীরভাবে বিশ্লেষণ করার ক্ষমতা অর্জন করা যায়। কেউ যদি বলে, মহাভারতের সময়েই ইন্টারনেট ছিল, কিংবা গরুর কুঁজে সোনা থাকে, তাহলে মাথা গরম না করে ঠাণ্ডা মাথায় যুক্তি দিয়ে যেন বুঝিয়ে দেওয়া যায় এসব হলো খাঁটি গো-চোনা, যাকে ইংরিজি ভাষায় বলে বুলশিট।
কিন্তু সেটা করতে গেলে মিথ্যার সঙ্গে সত্যের পার্থক্য খুঁজে বের করার মতো শিক্ষাগত যোগ্যতা থাকতে হবে।
প্রশ্ন করলে, চ্যালেঞ্জ করলে শাস্তি হবেনা কখনো। পরীক্ষায় নম্বর কেটে নেবেনা কেউ। ক্লাসে টিচার সবার সামনে দাঁড় করিয়ে চড় খাওয়াবেনা অন্যদের দিয়ে।
আমেরিকা, ইংল্যাণ্ড বা ইউরোপ-প্রভাবিত ভারতে মুক্তচিন্তার একটা অবকাশ এতদিন ছিল। ভারতে এখন আর নেই। ফ্যাসিস্টরা দরজায় কড়া নাড়ছে। হিটলারের অনুসারীরা ভারত ধ্বংসের রাজপথে খোলা তরোয়াল হাতে মারো মারো হাঁক দিচ্ছে রোজ।
আমেরিকায় প্রায় চল্লিশ বছর কাটিয়ে অনেক কিছু শিখেছি। এবং শিক্ষাব্যবস্থায় মুক্তচিন্তা এবং বাক-স্বাধীনতা থাকার কারণে এমনভাবে ভাবনাচিন্তা করতে শিখেছি, যা দেশে থাকতে কখনো সম্ভব হয়নি। ওখানে আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা হচ্ছে মূলতঃ, ওই যে বললাম, অন্ধভাবে ইন্সট্রাকশন ফলো করার শিক্ষা।
কিছু ব্যতিক্রমী শিক্ষক ও শিক্ষিকা অবশ্যই আমরা পেয়েছি। যাঁরা সিলেবাসের মধ্যে নিজেদের আবদ্ধ রাখেননি। ক্লাসরুমে এসে রবীন্দ্রনাথের গান নিয়ে গানের লড়াই খেলা খেলেছেন। সুকান্ত ভট্টাচার্য্যের কবিতা শিখিয়েছেন। কেমিস্ট্রি পড়াতে এসে টাইম মেশিনের গল্প বলে শুনিয়েছেন। মনের দরজা খুলে দিয়েছেন তাঁরা।
কিন্তু এডুকেশন সিস্টেমটাই ছিল সিলেবাস-কেন্দ্রিক। এবং শাস্তিকেন্দ্রিক। যাকে ইংরিজিতে বলে পিউনিটিভ। প্রকাশ্য এবং অপ্রকাশ্য রক্তচক্ষু চারদিকে ঘুরে বেড়াতো। বাড়ির মধ্যে, রাস্তায়, সমাজে, স্কুলে, কলেজে, ইউনিভার্সিটিতে। ছেলেদের জন্যে একরকম শাস্তি। মেয়েদের জন্যে আর একরকম।
পরীক্ষার ভীতির মধ্যে আমরা বড় হয়েছি। এবং অতি প্রাচীনপন্থী, বাজে সিলেবাস। যেখানে বাংলা টেক্সট বইতে পনেরোটা পীসের মধ্যে ছটা রবীন্দ্রনাথ, তারপর শিবনাথ শাস্ত্রী, রামেন্দ্রসুন্দর ত্রিবেদী, বিবেকানন্দ, বিদ্যাসাগর, ইত্যাদি। তাঁদের নমস্কার জানিয়েও বলছি, গুরুদেবরা, আপনারা বিলক্ষণ জ্ঞানী মানুষ। আমাদের সৌরজগতের জ্যোতিষ্ক। কিন্তু শিশু মনের, কিশোর কিশোরী, বালক বালিকার মনের ফান আপনারা কিছুই জানতেন না।
এবং আপনাদের অন্ধভাবে অনুসরণ করা ওই শিক্ষাব্যবস্থার কর্তারা। শিক্ষা যে পরীক্ষাভীতি নয়, আর কেবল জ্ঞানের বাণী নয়, তা আপনারা বোঝেন নি।
আমাদের বাংলা বইতে একটা শিবরাম, একটা টেনিদা, একটা লীলা মজুমদার, পরশুরাম, আর একটা সত্যজিৎ রায় অবশ্যই থাকা উচিৎ ছিল। থাকেনি।
মুসলমান লেখকদের, প্রান্তিক জাতির লেখক কবিদের রচনা অবশ্যই থাকা উচিৎ ছিল। কখনো থাকেনি। তাই আমরা তাঁদের কখনো সম্মান করতেও শিখিনি।
সত্যি কথা বলতে আমেরিকায় এসে প্রথমে বিজ্ঞান এবং তারপর হিউম্যানিটিজ নিয়ে পড়াশোনা করে, এবং বহু বছর পড়িয়ে রপ্ত করেছি শিক্ষার আসল উদ্দেশ্য।
আমার গুরু নোম চমস্কি, কলাম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিক্টর নাভাস্কি এবং জেমস ক্যারি, সাদার্ন ইলিনয় ইউনিভার্সিটির ল্যারি ম্যাটেন এবং বারবারা স্টটলার -- এঁদের কথা আজ খুব বেশি মনে পড়ে। শিক্ষক দিবস বলে যদি কিছু পালন করতেই হয়, সেই শিক্ষক শিক্ষিকাদের মনে করবো, যাঁরা শুধু উৎসাহিত করেছেন।
যাঁদের সঙ্গে ভুল ইংরিজিতে কথা বলতেও কখনো ভয় করেনি।
যাঁরা বলেছেন, এগিয়ে যাও। প্রশ্ন করো। চ্যালেঞ্জ করো। যাঁরা বলেছেন, আর যাই করো, আমার সঙ্গে কথা বলতে এসে পায়ে লুটিয়ে পোড়োনা। ওসব আমরা পছন্দ করিনা। এমন কি, আমাদের নাম ধরেও ডাকতে পারো।
জগদ্বিখ্যাত দার্শনিক নোম চমস্কি আমাকে বলেছেন, পার্থ, আমাকে প্রফেসর চমস্কি বলে ডেকোনা। ওসব কলোনিয়াল সেন্টিমেন্ট আমার ভালো লাগেনা।
তাঁকে গত দশ বছর ধরে নোম বলেই ডেকে এসেছি।
____________
পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।