মুখ্যমন্ত্রীর নন্দীগ্রাম বিষয়ক বিস্ফোরক মন্তব্যের পর ভোটবাজারে রাজনৈতিক তরজা স্বভাবতই চরমে উঠেছে। সেদিন নন্দীগ্রামে পুলিশ ঢুকেছিল শিশির শুভেন্দুর অনুমতিসাপেক্ষে এবং ওই "চটি পরা পুলিশেরা" আদতে শুভেন্দুর লোক, এই দুটি বক্তব্যেরই রাজনৈতিক তাৎপর্য বিরাট। কারণ নন্দীগ্রামে পুলিশের গুলিচালনা এবং নির্বিচার হত্যার সেই ঘটনা বাংলায় ৩৪ বছরের বাম শাসনের অবসানে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অনুঘটক হিসাবে কাজ করেছিল, এ আমরা জানি। যে যে পক্ষেই থাকি না কেন, সেদিন আমরা যারা কম বেশী রাজনৈতিক ছিলাম, এটা কারোই অজানা নয়। অতএব আজ যদি সেই যুগান্তকারী ঘটনার বেসিক এলিমেন্টগুলো প্রশ্নচিহ্নের মুখে পড়ে, তাতে আলোড়ন উঠবেই।
লিবারাল বন্ধুরা অনেকেই বলছেন, সিপিএমের এই নিয়ে আলোচনা করা, হইচই করা নাকি আত্মঘাতী সিদ্ধান্ত। কেন আত্মঘাতী? নন্দীগ্রামে বামফ্রন্টের বিরুদ্ধে অভিযোগগুলি কি কি ছিল? প্রথমতঃ, জোর করে জমি অধিগ্রহন। বুদ্ধবাবু স্পষ্টই জানিয়ে দিয়েছিলেন, নন্দীগ্রামের মানুষ চাইছেন না, তাই কেমিকাল হাবের প্রকল্প বাতিল করা হল। তারপরেও প্রচার চলতে থাকে যে লক্ষণ শেঠ জোর করে জমি অধিগ্রহণ করছেন। দ্বিতীয় এবং সবচেয়ে মারাত্মক অভিযোগ, নন্দীগ্রামে গ্রামবাসীর প্রতিরোধ ভাঙতে বুদ্ধবাবুর নির্দেশে পুলিশ ঢুকে গুলি চালিয়ে মহিলা এবং শিশুদের ওপরেও নির্বিচারে গুলি চালায়, যার ফলে সরকারী তথ্যানুযায়ী ই অন্তত ১৪ জন মানুষ (বেসরকারি মতে অনেক বেশী) মারা যান। এবং তারপরে "চটি পরা পুলিশের" সাজে এবং বিনা সাজে "সিপিএম এর হার্মাদ বাহিনী" নন্দীগ্রামের ঘর থেকে নারী পুরুষ নির্বিশেষে টেনে বার করে হত্যাকাণ্ড এবং ধর্ষণ চালায়। হলদি নদীর কুমির টুমিরের কথা এখন না হয় থাক। গোটা বাংলা প্রতিবাদে সামিল হয়। আমরা বামকর্মীরা মিনমিন করে ডিফেন্ড করতে থাকলেও আমাদের লোকে হ্যাট হ্যাট করে ভাগাত। শেষে তো আমরা অনেকে "অনুতপ্ত" হয়ে সিপিএম কে চাট্টে গালিও দিয়ে ফেললাম।
এখন বিদ্বজ্জনদের বক্তব্য, ভোটের মুখে পাবলিককে এসব কথা মনে করিয়ে দেওয়া নাকি আত্মহত্যার সামিল। নন্দীগ্রাম নিয়ে সিপিএমের মুখ খোলাই নাকি উচিৎ নয়। হবেও বা, এত বুঝলে কি আর আমরা ৭% হয়ে যেতাম। কিন্তু হয়ে যখন গেছিই, তখন মরার আবার আত্মঘাত কিসের? সিপিএম মরিয়া প্রমাণ করিবে তারা মরে নাই? সেও তো হয়ে গেছে। এখন একটু খোলাখুলি আলোচনা হলে আমাদের নতুন করে হারানোর কী বা থাকবে? বিধানসভায় শুন্য আসন? হলে হবে - তাও একটু আলোচনাই হোক বরং। আপনাদের শুভাকাঙখা, আত্মহত্যার হাত থেকে সিপিএম কে বাঁচানোর এই চেষ্টা আমরা মনে রাখব কমরেড। নরক থেকে দুহাত তুলে আশীর্বাদ করব।
তাহলে এবার প্রথম অভিযোগের প্রেক্ষিতে আলোচনা হোক। আমাদের মধ্যে যারা পূর্ব মেদিনীপুর কিছুটা হলেও চিনি (আমি খুবই কম চিনি) তাদের মোটামুটি ধারণা আছে যে তমলুক আর কন্টাইয়ে দুই দোর্দন্ডপ্রতাপ রাজা ছিলেন - লক্ষণ শেঠ আর শিশির অধিকারী। এখন লক্ষণ শেঠের সেই দিন আর নাই, তিনি কোন পার্টি করেন তা সেই সংশ্লিষ্ট দলও জানে কি না সন্দেহ। কিন্তু পরাজিত হবার আগে, সপ্তম বামফ্রন্ট সরকারের আমলে তিনি অমিত পরাক্রমী ছিলেন তাতে সন্দেহ নেই। কিন্তু তা সত্ত্বেও, নন্দীগ্রাম তেমনভাবে তাঁর এলাকা ছিল না, সে ছিল অধিকারী বংশের রাজত্ব। মমতা নিজমুখেই স্বীকার করেছেন, সেই বাম আমলের ৩২ তম বছরেও অধিকারীদের অনুমতি ছাড়া নন্দীগ্রামে পুলিশ বা গুন্ডা, কারোই ঢোকার উপায় ছিল না। বুদ্ধদেব সরকারের চরম ব্যর্থতারই নিদর্শন এটা, সন্দেহ নেই। কিন্তু সেই সঙ্গে এটাও মনে করার যে, সেই নন্দীগ্রামে "লক্ষণ শেঠের জমি দখল এর ফতোয়া" যতটা বলা হচ্ছে, ততটা অমোঘ ভেবে নেবার কোন কারণ নেই। পোস্ট ট্রুথের নির্মাণের অনেক ধাপ থাকে।
এবারে দ্বিতীয় অভিযোগের প্রেক্ষিতে মমতা ব্যানার্জীর বক্তব্যকে দেখব। তিনি স্পষ্ট বলেছেন, "বাপ-বেটার" নির্দেশ ছাড়া শুধু পুলিশ ঢুকতে পারত না ই নয়, ওই "চটি পরা পুলিশ", যাদের আমরা এতদিন সিপিএম এর হার্মাদ বাহিনী বলেই জেনে এসেছি, তারাও নাকি আদতে ওই বাপ বেটারই লোক। বাহ উস্তাদ বাহ! আপনাকে একটু মনে করিয়ে দিই, ওই বাপ ব্যাটা সেদিন কিন্তু বিজেপির নয়, তৃণমূলেরই "মুক্তিসূর্য" ছিল। যারা মারা গেলেন, তাঁদের পরিবারের কাছে আজ নতজানু হয়ে ক্ষমা চাইবেন মমতা বন্দোপাধ্যায়, যখন নিজমুখে স্বীকার করে নিলেন যে ওই হার্মাদ বাহিনী আসলে আপনারই জহ্লাদ বাহিনী?
নন্দীগ্রামে কী হয়েছিল, সবাই জানি। কেন হয়েছিল, সেটা আমার কাছে আজও পরিষ্কার নয়। অধিকারীদের খাস তালুকে সিপিএমের হার্মাদ বাহিনী এতবড় তাণ্ডব চালিয়েছিল কোন মোটিভে? জমি দখল? অথচ তার আগেই সরকারী ঘোষণা হয়ে গেছে যে নন্দীগ্রামে কেমিকাল হাব হচ্ছে না, সেজ হচ্ছে না? লক্ষণ- শিশিরের যুদ্ধ? ওইরকম সময়ে, যখন গোটা বাংলা সিঙ্গুর-নন্দীগ্রামের দিকে তাকিয়ে টানটান বসে আছে? আমার অঙ্ক মিলছে না। এটা রাজনৈতিক হারাকিরি, সেটা বোঝার জন্য থিঙ্ক ট্যাঙ্ক লাগার কথা নয়। কিছুই পাবার ছিল না, হারাবার ছিল অনেক (যদি সবটা তখনো না বোঝাও গিয়ে থাকে) - তবুও এই কাণ্ড? এই স্কেলে?
অঙ্ক আরও জটিল হয়ে যায় যখন আপনারা পরামর্শ দেন এ নিয়ে হইচই না করতে। আমার বারবার মনে পড়ে যাচ্ছে ধনঞ্জয় চ্যাটার্জীর কথা, আফজল গুরুর কথা। দুজনেই যে অভিযোগে গ্রেপ্তার হয়েছিল, তদন্তের পর সেই মূল অভিযোগগুলো ভিত্তিহীন প্রমাণিত হয়েছে- একজনের ফাঁসির পরে, আরেকজনের ফাঁসির আগেই - কিন্তু তাতে কিছুই বদলায়নি। ফাঁসি হয়ে গেছে, দুজনেই সমাজের চোখে অপরাধী হয়েই রয়ে গেছে। এবং এখনো তাদের পরিজনকে হুমকি দেওয়া হয়, এসব নিয়ে কথা তুললে তার ফল ভাল না-ও হতে পারে। আজ আপনাদের সুপরামর্শ পেয়ে এই অপ্রাসঙ্গিক কথাগুলো কেন মনে পড়ে গেল জানিনা। কোন অঙ্কই মিলছে না রে তোপসে।
আপনার দেওয়া লিন্ক থেকেই তো বলছি। আপনিই তো রেকো করলেন যে এই প্রতিবেদন থেকে সব জানতে বুঝতে হবে। এখন নিজের দেওয়া লিন্কই আর পছন্দ হচ্ছেনা। কি মুশকিল।
আর যদি ধরে নিই যে বামেরাই সব করেছে, তাহলে দিদি কালকে মিথ্যা কথা বলেছেন, তাইতো?
পিসি-ভাইপো পার্টিকে নিয়ে আমি একটা কথাও বলিনি! মমতা মিথ্যাবাদী, কোনো সন্দেহ নেই! তাই বাকিরাও তাই!
এইটাই শুনতে চাইছিলাম। ঠিকাছে। রেকর্ড থাকলো। বামেদের ভোট পাওয়া না পাওয়াতেও আমার কোনও ইন্টারেস্ট নেই।
বামেরা তো এমনিতেই পাচ্ছে না ভোট। তার চেয়ে আলোচনাটাই হোক।
তাহলে এখন জানা গেল দিদি "আসলে" বলেছেন যে ওই চটি পুলিশ সিপিএম এরই ছিল, অধিকারীরা তাদের ঢুকতে দিয়েছিল - এই তো? এতে আপনাদের নিজেদেরও হাসি পাচ্ছে না - তাহলে আর আমরাই বা হেসে কী করব? নন্দীগ্রামে যাঁরা সেদিন কেঁদেছিলেন, তাঁরা শেষ অবধি হাসতে পারেন কিনা, সেই অপেক্ষাতেই থাকি।
আরেকটা জিনিষ বোঝা গেল - আপনাদের সবই মনে আছে। যা যা কাগজে পড়েছিলেন। যে যা বলেছিল। অসাধারণ নীতিনিষ্ঠ সাংবাদিকতা সেদিন পশ্চিমবঙ্গ তথা ভারতের ইতিহাস আপনাদের বুকে খোদাই করে দিয়ে গেছে। আমরা আপ্লুত
চিন্তা নেই, ভোটের ফল বেরোলে আরো আপ্লুত হবেন!
নন্দীগ্রাম নিয়ে একটা ক্রোনোলজি প্রয়োজন। ২০১১ সালে দিদি মসনদে বসলেন। তারপর কবে তদন্ত থামানো হল। কবে বুদ্ধবাবুকে ক্লিন চীট দেওয়া হল। সিদ্দিকুল্লাই বা কোথায়। পুলিশ আর সচিব কবে তিনো জয়েন করলেন। কবে দিদির স্বীকারোক্তি। এসব একটু রেকর্ড করে রাখা প্রয়োজন।
হ্যাঁ, সনতারিখ দিয়ে সব পরপর রাখা থাকলে বুঝতে সুবিধে হয় অনেক। এটা দরকার।
ওসব হিসেব করে আর কি হবে ? লোকে পরিবর্তন চেয়েছে , হাতেনাতে পেয়েওছে। এখন যা ইচ্ছে হোকগে। আমরা পাঁচিলে বসে বাদামভাজা খেতে খেতে ফ্রি তে সার্কাস দেখবো। পবতে আর যাই খামতি থাক, অন্তত ভাড়ামির খামতি নেই গত দশ বছরে।
লোকে আরো পরিবর্তন চায়। দেখা যাক কী হয়। অনেকেই রামের কাঁধে উঠতে চায়, কিন্তু উঠে যদি দ্যাখে হনুমানের কাঁধে উঠেছে, তবেই চিত্তির আরকি।
বামছাগলের দল প্রমান করছে দিদিই বাংলার মানুষের একমাত্র আশা ভরসা।
ঘাস আর ছাগল, এই দুইয়েরও খুব মিল। :-)
পুরো বক্তব্যটা এটা।
https://www.facebook.com/watch/?v=558809755038084
সিপিএম এর লোকজন এখান থেকে কাট করা একটা ভারশন অর্ধেক কথা কাটা, দুটো মাত্র বাক্য তোলা একড়া ভিডিও চালিয়ে যাচ্ছে।
যাঁরা অন্য ভার্শনটা শুনে বলছেন, তাঁরা নাহয় একরকম না জেনে বা ভুল জেনে বলছেন কিন্তু যাঁরা পুরোটা দেখে করছেন, তাঁরা জেনেশুনে ফেক নিউজ ছড়াচ্ছেন, রামের আইটি সেলের বাপ এই রামবামরা!
এইসব লেখা পড়তে হাসিও পায়, বিরক্তি লাগে। পাঞ্জাব ও হরিয়ানায় কৃষকেরা শাসকের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করলে এঁরা সমর্থন জানান। কিন্তু ঘরের কাছে সিঙ্গুর-নন্দীগ্রামে চাষীরা জমি অধিগ্রহণের বিরোধিতা করলে এঁরা তার মধ্যে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ ও ঘোর ষড়যন্ত্র খুঁজে পান। নন্দীগ্রামে গণহত্যার সপক্ষে ইনিয়ে বিনিয়ে কথা বলতে থাকেন।
এখন নতুন তত্ত্ব এসেছে। পুলিশমন্ত্রী কিছু জানতেন না, এমনি এমনি গুলি চলেছে! তা এর পর তো আরো চার বছর ক্ষমতায় ছিলেন, দোষী দের শাস্তি দিলেন না কেন?
নির্লজ্জ স্তাবকের লজ্জাবোধ থাকেনা!
অবশ্য দলদাসদের কাছ থেকে এই লেখা অপ্রত্যাশিত নয়। নিজের বুদ্ধিকে বন্ধক দিয়ে পার্টির প্রতি প্রশ্নহীন আনুগত্য দেখাতে না পারলে তো পার্টিকর্মী হওয়া সম্ভব নয়!
স্বয়ং তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী শেষপর্যন্ত বলতে বাধ্য হয়েছিলেন, সিঙ্গুর-নন্দীগ্রামের ভুল থেকে শিক্ষা নিতে হবে! তা শিক্ষার ফল তো দেখতেই পাচ্ছি! সবাই চক্রান্ত করছে, আর সাধারণ মানুষ বিভ্রান্ত! জমিদারি নেই তো কি হয়েছে, জমিদারি মেজাজ আছে ষোলোআনা! আর এই মেজাজের ফল কি হবে, তা সহজেই অনুমেয়!
কোথাও কিচ্ছু হয়নি! সব বিরোধীদের চক্রান্ত!
অঙ্ক দেখছি খুবই কঠিন!