আমাদের বর্তমান স্বাস্থ্যব্যবস্থার মধ্যে অস্তিত্বযাপন করে এর আলোকে বাইরের, অতীতের স্বাস্থ্যব্যবস্থার অস্তিত্বকে আমরা চোখের আলোতেই দেখার চেষ্টা করছি। শুরুতে বর্তমানের অবস্থা আরেকটু ভালো করে হৃদয়ঙ্গম করে নিই।
নিউ ইংল্যান্ড জার্নাল (NEJM)-এর সাম্প্রতিকতম সম্পাদকীয়তে (৮.১০.২০২০) বলা হল যে কোভিড-১৯ বিশ্ব জুড়ে সংকট তৈরি করেছে। এবং এ সংকট দেশের নেতৃত্বকে বুঝে নেবার একটা পরীক্ষা। আমেরিকাতে নেতৃত্ব এ পরীক্ষায় পূর্ণত বিফল হয়েছে। ২০০,০০০-র উপরে মানুষের জীবনহানি হয়েছে, লক্ষ লক্ষ কোটি টাকার ক্ষতি হয়েছে, অসংখ্য বেকার তৈরি হয়েছে। সম্পাদকীয়টির সিদ্ধান্ত – সম্পাদককীয়র শিরোনাম “Dying in a Leadership Vacuum – “নেতৃত্ব ছাড়া অন্য কেউ এরকম হঠকারীভাবে মানুষের জীবন নিয়ে ছিনিমিনি খেললে কিংবা টাকা তছনছ করলে বিচারের মুখোমুখি দাঁড়াতে হত। এরপরেও আমাদের নেতৃত্ব তাদের কৃতকর্মের জন্য আমাদের কাছে অব্যাহতি দাবী করেছে। কিন্তু এই নির্বাচন আমাদের হাতে বিচারের ক্ষমতা দিয়েছে। যৌক্তিক মানুষেরা আমাদের প্রার্থীদের বিভিন্ন রাজনৈতিক অবস্থান নিয়ে আপত্তি জানাবে নিশ্চয়ই। কিন্তু সত্য কখনো ‘লিবারাল’ বা ‘কনজারভেটিভ’ নয়। কিন্তু আমাদের জীবদ্দশার সবচেয়ে বড়ো জনস্বাস্থ্যের সংকটের প্রশ্ন যখন আসে তখন পরিস্থিতি দেখিয়ে দিয়েছে আমাদের রাজনৈতিক নেতারা বিপজ্জনকভাবে অকর্মণ্য। আমরা এদেরকে আর উৎসাহ কিংবা সামর্থ্য জোগাতে পারিনা যাতে তারা আবার নেতা হিসেবে ফিরে আসে এবং হাজার হাজার আমেরিকানের মৃত্যু ঘটে। আমরা এদের আর ফেরার অনুমতি দিতে পারিনা।”
পৃথিবীর সবচেয়ে মান্য মেডিক্যাল জার্নালে (ইম্প্যাক্ট ফ্যাক্টর ৭৪-এর বেশি) আমেরিকার নির্বাচনের প্রাক্কালে এরকম সম্পাদকীয় লেখা হচ্ছে। আমরা এখানে এ কাজটি করতে কবে পারবো? সময় উত্তর দেবে।
এ সম্পাদকীয় আমাদের কাছে দুটি ভাবনা পথ খুলে দিল – প্রথম, স্বাস্থ্য সংকটের সময়, যখন অসংখ্য মানুষের অসহায় মৃত্যু ঘটছে আমেরিকার মতো বিশ্বের কর্তা সবচেয়ে ধনী দেশে সেসময়ে, দেশের নেতৃত্বের চূড়ান্ত অপদার্থতা এবং দায়িত্বজ্ঞানহীনতা; দ্বিতীয়, নেতৃত্ব দেবার ক্ষেত্রে ভয়াবহ শূণ্যতা। আপামর মানুষের ক্ষেত্রে প্রায় সমধর্মী সংকটের মোকাবিলা হয়েছিল আজ থেকে ১০০ বছরেরও বেশি আগে পৃথিবীর একটি ভূখণ্ডে। কি সেই সময়? কি সেই ইতিহাস? সে ইতিহাসের এক রেখাচিত্র আমাদের আলোচনায় ধরার চেষ্টা থাকবে।
এই জার্নালেই আরেকটি প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়েছিল (৩০.০৯.২০২০) “Ruthless Health Law” শিরোনামে। আমেরিকায় সামাজিক ও অর্থনৈতিকভাবে দুর্বলতর অংশের জন্য যে Affordable Care Act (ACA) রয়েছে সে আইন ট্রাম্প প্রশাসন রদ করার চেষ্টা যেভাবে করছে তার বিরোধিতা করে। প্রবন্ধের বক্তব্য ছিল – “যখন আমেরিকায় ৭০,০০,০০০-র বেশি মানুষ করোনা-আক্রান্ত এবং ২০০,০০০-র বেশি মানুষ মারা গেছে, সেসময় মানুষকে স্বাস্থ্য নিরাপত্তা থেকে বঞ্চিত করা দেশের পক্ষে দুর্ভাগা এক সময়কে বোঝায়। এবং যে সময়ে সার্স-কোভ-২-এর আক্রমণে কালো ও অন্য বর্ণের মানুষ, জনজাতির মানুষ এবং শ্রেণী-নির্ভর অসাম্য নাটকীয়ভাবে ভঙ্গুর হয়ে পড়ছে, আবার এগুলো সংবাদপত্রের প্রথম পাতার খবর হচ্ছে সেরকম এক মুহূর্তে স্বাস্থ্যের ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠিত এ সুযোগ থেকে মানুষকে বঞ্চিত করা দেশের পক্ষে সবচেয়ে কুৎসিৎ সময় – যা স্বাস্থ্যের অসাম্য আরও বাড়িয়ে তুলবে।”
ল্যান্সেট-এর একটি প্রতিবেদনে (“COVID-19 exacerbating inequalities in the US”, এপ্রিল ১৮, ২০২০) দেখানো হয়েছিল ট্রাম্প ২০১৬ সালে যে সমস্ত অঞ্চল থেকে ভোট বেশি পেয়েছিলেন করোনা বিপর্যয়ের সময়ে সেসব অঞ্চল অনেক বেশি আর্থিক অনুদান পেয়েছে। উদাহরণ হিসেবে নিউ ইয়র্ক খুব সামান্য আর্থিক অনুদান পেয়েছে, অথচ আমেরিকার দক্ষিণের রাজ্যগুলো (যেসব জায়গা থেকে ট্রাম্পের বিপুল ভোট এসেছে) অনেক বেশি আর্থিক সাহায্য লাভ করেছে। এখানে ভারতের সাথে কোন মিল পাওয়া যাচ্ছে? একটি সবচেয়ে “শক্তিশালী গণতন্ত্র”, আরেকটি “বৃহত্তম গণতন্ত্র”-এর দেশ।
অর্থাৎ, বিষয়টি চলে এলো রাষ্ট্রের তরফে সামাজিক অসাম্যের ক্ষেত্রে, বিশেষত স্বাস্থ্যের অসাম্যের ক্ষেত্রে, কি দৃষ্টিভঙ্গী নেওয়া হবে এবং রাষ্ট্রের পদক্ষেপ এই অসাম্যকে ত্বরান্বিত করবে কিংবা উপশমিত করবে – এ প্রশ্নে।
সায়ান্স-এর মতো বিশ্ববন্দিত জার্নালে প্রকাশিত হয়েছিল (১৫ মে, ২০২০) “An Unequal Blow” শিরোনামে একটি প্রবন্ধ। প্রবন্ধে বলা হয়েছিল – “যে সমস্ত মানুষেরা সবচেয়ে বেশি রিস্ক বহন করে তারা প্রান্তিক – দরিদ্র এবং সংখ্যালঘু, যারা এমনভাবে সামাজিক বৈষম্যের মুখোমুখি হয়েছে যে তাদের স্বাস্থ্য ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে বা স্বাস্থ্যের সুযোগ পাওয়া থেকে অনেক দূরে রয়ে গেছে অতিমারিকালের আগেও।”
২০১৩ সালে NEJM-এএকটি প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়েছিল “Dead Man Walking” (নভেম্বর ১৪, ২০১৩) শিরোনামে। এ প্রবন্ধ থেকে জেনেছিলাম লেখকদের একজন দরিদ্র “কালো রোগীর” ইন্সিউরেন্স না থাকার জন্য তিলে তিলে অমোঘ মৃত্যুর দিকে এগিয়ে যাবার ভয়ঙ্কর অভিঘাত লেখদের ভাষায় “shocked”, “saddened”, “disheartened” এরকম কোন শব্দবন্ধ দিয়েই প্রকাশ করা সম্ভব হচ্ছিলনা – “We were simply appalled.” কারণ? এই হতভাগা দরিদ্র মানুষটি কোলনের ক্যান্সারে ভুগছিল। ইন্সিউরেন্স না থাকার জন্য জীবনের জমানো সমস্ত সঞ্চিত অর্থ (১০,০০০ ডলার) সিটি স্ক্যান করানোর মতো সাধারণ পরীক্ষানিরীক্ষায় ব্যয়িত হয়ে গেছে। লেখদের বক্তব্য – “আমাদের বহু রোগীর ক্ষেত্রে কেবলমাত্র দারিদ্র্য চিকিৎসার সুযোগ পাওয়া থেকে বঞ্চিত করে।” লেখকদের শেষ কথা – “আমাদের কাছে ভয়াবহ এবং বেদনাদায়কভাবে নিষ্ঠুর মনে হয় যে মি. ডেভিস (রোগীর পরিবর্তিত নাম) এবং তার মতো এই ধনী দেশের হাজারো হাজারো মানুষ মরে যাবে স্রেফ ইন্সিউরেন্স না থাকার জন্য।” ঘটনাটি আমাদেরকে আরও দুটি কঠোর সত্যির সামনে দাঁড় করিয়ে দিল – (১) ইন্সিউরেন্স থাকা বা না থাকার ওপরে রোগীর বেঁচে থাকা বা মরে যাওয়া নির্ভর করছে, এবং (২) যেহেতু রাষ্ট্র নাগরিকের স্বাস্থ্য এবং ইন্সিউরেন্সের দায়িত্ব নেয়না (বহুজাতিক ইন্সিউরেন্স হাঙ্গররা বসে আছে সেখানে) সেজন্য সার্বজনীন কোন ইন্সিউরেন্স নেই। ইন্সিউরেন্স মূলত তুলনায় সম্পন্নদের জন্য। এজন্য Affordable Care Act (ACA)-এর মতো আংশিক সংস্থানও তুলে দেবার প্রস্তাবে NEJM-এর তীক্ষ্ণ প্রতিবাদী প্রতিবেদন প্রকাশিত লেখা হল।
করোনা অতিমারির সময়ে এই অসাম্য এবং এর ভয়াবহতা আরও প্রকট হয়ে উঠেছে। NEJM-এ প্রকাশিত একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রবন্ধের শিরোনাম “Structural Racism, Social Risk Factors, and Covid-19 – A Dangerous Convergence for Black Americans” (সেপ্টেম্বর ১৭, ২০২০)। এখানে পরিষ্কারভাবে বলা হল – “A lack of financial resources resulting from years of structural racism confers a host of social risks, including food insecurity, housing instability, and limited access to transportation. In addition, people facing these risk factors are less likely to have insurance to pay for Covid-19 testing and are more likely to avoid using the health care system because of high costs.” অর্থাৎ, নির্জলাভাবে এটা সত্যি যে স্বাস্থ্য কেবলমাত্র একটি সংজ্ঞা নয়, এর সাথে যুক্ত হয়ে আছে রাষ্ট্রিক রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক ও বিশ্ব দৃষ্টিভঙ্গীর প্রশ্ন। এখানে প্রশ্ন উঠে আসবে দেশের মানুষের বিষয়ে, রাষ্ট্রের সাথে নাগরিকের সম্পর্কের ব্যাপারে কি অবস্থান নেবে রাষ্ট্রের পরিচালক ও নীতি নির্ধারকেরা সে বিষয়ে।
চিকিৎসাবিজ্ঞানের ইতিহাসের চূড়ামণি হেনরি সিজারিস্ট, যিনি হার্ভার্ড ইউনিভার্সিটির অধ্যাপকও ছিলেন, ১৯৩০-এর দশকে কয়েক বছর ধরে সদ্য গড়ে-ওঠা রাশিয়ায় ছিলেন, রুশ ভাষা শিখেছিলেন। নিবিড়ভাবে এর স্বাস্থ্য এবং চিকিৎসাব্যবস্থা পর্যবেক্ষণ করেছিলেন। হার্ভার্ডে ফিরে এসে লিখলেন সোশ্যালাইজড মেডিসিন ইন দ্য সোভিয়েত ইউনিয়ন (১৯৩৭)। তাঁর রাশিয়ার বাস্তবতার অভিজ্ঞতা থেকে সঞ্জাত পর্যবেক্ষণের ঐতিহাসিক গুরুত্ব আছে – “পাঁচ হাজার বছর ধরে মেডিসিনের ইতিহাসের জগতে যা অর্জিত হয়েছে তাকে প্রথম যুগ বলা যায় ঃ কিউরেটিভ (সারিয়ে তোলা) মেডিসিনের যুগ। এখন সোভিয়েত ইউনিয়নে একটি নতুন যুগ শুরু হয়েছে – প্রিভেন্টিভ (প্রতিরোধী) মেডিসিনের যুগ।” (পৃঃ ১০৪) এ কথা অন্য কেউ এত স্পষ্ট করে জানাননি। এই বইয়েই লিখলেন – “এ ব্যাপারে কোন সন্দেহ থাকতে পারেনা যে সোভিয়েত সিস্টেমের সামাজিক ইন্সিউরেন্স পুঁজিবাদী দেশের যেকোন ইন্সিউরেন্সের চেয়ে অকল্পনীয়ভাবে উৎকৃষ্ট।” লিখলেন – “এটা সম্পূর্ণত নতুন একটি মেডিক্যাল দৃষ্টিভঙ্গী। এ দৃষ্টিভঙ্গীর উৎস হল এক নতুন সামাজিক ব্যবস্থা। এ হল সোশ্যালিস্ট মেডিসিন ... এর জন্য কোন জাতীয়বাদী কিংবা সাম্রাজ্যবাদী প্রোগ্রাম সফল করার তাগিদ নেই।” আরও জানালেন – “যে সব স্যানাটরিয়াম এবং হেলথ রিসর্টগুলো আগে কেবলমাত্র হাতে গোনা কয়েকজন ধনীর সুযোগ হিসেবে ছিল সেগুলো সবকটাই সমস্ত মানুষের জন্য খুলে দেওয়া হয়েছে।” এক অমোঘ সত্যি তিনি যেন খুলে দেন আমাদের বোধের জগতে – “কেবলমাত্র জনতার স্বাস্থ্য বিবেচনায় রাখা হয় এবং এটা বাহ্যত স্পষ্ট যে মানুষের সক্রিয় অংশগ্রহণ ছাড়া কোন স্বাস্থ্য পরিকল্পনাকে কার্যকরী করা সম্ভব নয় ... সোভিয়েত ইউনিয়ন পৃথিবীর প্রথম দেশ যে মেডিসিনকে আক্ষরিক অর্থে সামাজিক চেহারা দিয়েছে, প্রথম দেশ যে জনতার স্বাস্থ্যকে রাষ্ট্রের দায়িত্ব বলে গ্রহণ করেছে।”
রাশিয়ায় বেশ কয়েক বছর কাটিয়ে আসার পরে প্রায় হুবহু একই কথা বললেন আরও দুই বিশেষজ্ঞ স্যার আর্থার নিউজহোম (Arthur Newsholme) এবং জন অ্যাডামস কিংসবেরি তাঁদের Red Medicine: Socialized Health in Soviet Russia (১৯৩৮) গ্রন্থে (এ নিয়ে পরে আরও আলোচনা হয়েছে) – “বাস্তবিকই, সোভিয়েত ইউনিয়ন পৃথিবীতে একটিমাত্র দেশ যে দেশের সীমান্তের মধ্যে বসবাসকারী প্রতিটি পুরুষ, নারী এবং শিশুর জন্য পরিপূর্ণ প্রিভেন্টিভ ও কিউরেটিভ মেডিসিনের সুযোগ পৌঁছে দেবার লক্ষ্যে একটি পূর্ণাঙ্গ ব্যবস্থা গড়ে তুলেছে এবং কার্যকরী করছে।” (পৃঃ vii)
প্রসঙ্গান্তরে গিয়ে বলা যায়, মার্ক্স তাঁর ক্রিটিক অফ গোথা প্রোগ্রাম-এ বলেছেন – “আমাদের এখন যে বিষয় নিয়ে আলোচনা করতে হচ্ছে তা একটি কমিউনিস্ট সমাজ, যে সমাজ নিজের ভিত্তির ওপরে বিকশিত হয়নি। বরঞ্চ, বিপরীত দিক থেকে, এটা যেহেতু শুধুই পুঁজি-নির্ভর সমাজের মধ্য থেকে উন্মোচিত হয়, ফলে অর্থনৈতিকভাবে, নৈতিকভাবে এবং বৌদ্ধিক জগতের প্রতিটি ক্ষেত্রে পুরনো সমাজের জন্মচিহ্নের ছাপ বহন করে। কারণ এই পুরনো সমাজের গর্ভ থেকেই নতুন সমাজ উত্থিত হয়েছে।” এরকম এক যন্ত্রণা ও ক্লেদের ভার বলশেভিক রাশিয়াকেও বহন করতে হয়েছে।
১৯১৭ সালের নভেম্বর মাসে রাশিয়ায় জারের শাসন উৎখাত করে কমিউনিস্ট পার্টি তথা আমজনতার শাসন কায়েম হবার পরে চিকিৎসা এবং স্বাস্থ্যব্যবস্থার জগতে মার্ক্সের ওপরের কথাগুলো দৈববাণীর মতো বাস্তব হয়েছিল যেন। আমি বিপ্লবোত্তর রাশিয়ার শুধুমাত্র চিকিৎসা ও স্বাস্থ্যব্যবস্থার ক্ষেত্রটিতে সীমাবদ্ধ থাকবো। সময়কাল ১৯১৭ থেকে ১৯৩৭। হেনরি সিজারিস্ট তাঁর পূর্বোক্ত পুস্তকে রাশিয়ার চিকিৎসা এবং স্বাস্থ্যব্যবস্থা নিয়ে বলেছিলেন – “আমার মনে হয় নীচের ৪টি পয়েন্ট সোভিয়েত স্বাস্থ্যব্যবস্থার বৈশিষ্ট্যসূচক বিষয়গুলোকে পরিষ্কার করবেঃ (১) মেডিক্যাল সার্ভিসের জন্য কোন খরচ নেই, ফ্রি এবং সবার জন্য লভ্য, (২) সমস্ত স্বাস্থ্যব্যবস্থায় সর্বাধিক গুরুত্ব পায় প্রিভেনশন বা রোগ-প্রতিরোধী ব্যবস্থা, (৩) সমস্ত স্বাস্থ্য-সংক্রান্ত কাজকর্ম দেখাশোনা করে কেন্দ্রীয় সংস্থা – পিপল’স কমিশারিয়েটস অফ হেলথ, (৪) স্বাস্থ্য-সংক্রান্ত বিষয় অনেক বড়ো পরিধিতে ভাবা হয়। সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র ঘোষণা করেছে রাষ্ট্রের সার্বিক মঙ্গলের জন্য মানুষের স্বাস্থ্যসুরক্ষা একান্ত আবশ্যিক।”
আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে (এখানে ইউরোপ ধরে নিতে হবে) ১৮৪৮-এর রাজনৈতিক অস্থিরতা, মানুষের প্রতিবাদ ও প্রতিরোধ আন্দোলন (বিশেষ করে ফ্রান্স, ইংল্যান্ড ও জার্মানিতে) স্বাস্থ্যের জন্য একটি জাতীয় আন্দোলনের জন্ম দিয়েছিল। নতুনভাবে জনস্বাস্থ্যের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান এবং আইন-কানুন, সোশ্যাল মেডিসিন এবং এপিডেমিওলজির মতো স্বাস্থ্যের নতুন শাখা তৈরি হল। আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন হল মেডিসিনের দর্শনের জগতে – নতুন করে বিশিষ্টতা পেলো প্রিভেন্টিভ মেডিসিন বা আগাম রোগ-প্রতিরোধের বিষয়। টমাস কুনের অনুসরণে বলা যায় মানুষের গণ আন্দোলন এবং স্বাস্থ্যের দাবীতে সোচ্চার হওয়া মেডিসিনের দর্শন ও ভাবনার জগতে একটি “প্যারাডাইম শিফট” ঘটালো – বেড সাইড মেডিসিনকে অতিক্রম মেডিসিন এলো জনসমাজে এবং জনস্বাস্থ্য একটি আলাদাভাবে চিহ্নিত অবস্থান হল।
এগুলো যখন ইউরোপের অগ্রণী দেশগুলোতে চলছে তখন জারের রাশিয়ায় এর কোন প্রভাবই প্রায় পড়েনি। তা সত্ত্বেও কিছু কিছু পদক্ষেপ ওখানে নেওয়া হয়েছিল – যেমন, “মেডিক্যাল স্যানিটারি ওয়ার্কার্স ইউনিয়ন” তৈরি হয়েছিল ১৮২০ সালে, স্মল পক্সের জন্য শিশুদের বাধ্যতামূলক টীকাকরণ চালু হয়েছিল ১৮৮৫ সালে, “রাশিয়ান ফার্মেসি সোসাইটি ফর মিউচ্যুয়াল অ্যাসিস্ট্যান্স” জন্ম নিল ১৮৯৫ সালে। হাওয়ার্ড লিখটার জারের রাশিয়ার স্বাস্থ্যব্যবস্থাকে “আতঙ্কজনক” বলেছেন। লিখটার তাঁর গ্রন্থ A comparative approach to policy analysis: health care policy in four nations (১৯৮০)-এ বলছেন – “রাশিয়ার এক সুবিশাল অংশে কোন ধরনের মেডিক্যাল ব্যবস্থাই চূড়ান্তভাবে অনুপস্থিত ছিল।” সেসময়ে রাশিয়ার মানুষদের চিকিৎসার জন্য মাথাপিছু বরাদ্দ ছিল ৯১ কোপেক যা বর্তমান হিসেবে প্রায় ৯৫ পয়সা। রাশিয়ার পূর্বাঞ্চলে প্রতি ৫৬৬৫ জন মানুষের জন্য ১ জন ডাক্তার ছিল, এবং প্রতি ১০০০ জনের জন্য ১টি হাসপাতাল বেড ছিল। গ্রামাঞ্চলে ওষুধের দোকান প্রায় ছিলনা বললেই চলে। ১৯১৪ থেকে ১৯২০-র মধ্যে যে সমস্ত ডাক্তারদের জোর করে মিলিটারিতে নেওয়া হয়েছিল তাদের মধ্যে ১০,০০০ জন মারা যায়।
ভৌগলিকভাবে পৃথিবীর এক-ষষ্ঠাংশ জুড়ে বিস্তৃত রাশিয়ার ভূখণ্ডে বাস করতো প্রায় সাড়ে ১৭ কোটি মানুষ। ১২.৯% ভাগ মানুষ বাস করতো শহরাঞ্চলে, ৮৭% বাস করতো গ্রামাঞ্চলে। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের অভিঘাতে মস্কোর জনসংখ্যা ১৫ লক্ষ থেকে কমে ৯০০,০০০ হয়ে যায়। পেত্রোগ্রাদে ২০ লক্ষ থেকে কমে দাঁড়ায় ৬০০,০০০-তে। ১৯১৩-র হিসেব বলছে নবজাত শিশুদের ৫০% অবৈধ এবং রাশিয়ার মানুষের সেসময়ে গড় আয়ুষ্কাল ছিল ৩২ বছর। সমগ্র রাশিয়া জুড়ে স্বাস্থ্যের প্রধান সমস্যা ছিল – যৌন রোগ, টাইফাস, যক্ষ্মা, কুষ্ঠ, চোখের রোগ ট্র্যাকোমা, প্লেগ, স্মল পক্স, কলেরা এবং ম্যালেরিয়া। ১৯১৩-র আরেকটি হিসেব বলছে সেন্ট পিটার্সবার্গ শহরের ৪% মানুষ মদ্যপ ছিল। ১৯১৪ সালে সিফিলিস বা গনোরিয়ার মতো যৌন রোগে আক্রান্তের সংখ্যা ছিল ১৫ লক্ষ। সেনাবাহিনীতে যারা কাজ করতো তাদের ১০% যক্ষ্মায় আক্রান্ত ছিল। ভ্লাদিমির রেশেৎনিকভ এবং অন্যান্যরা তাদের গবেষণাপত্র “দ্য হিস্টরি অফ পাব্লিক হেলথকেয়ার ইন রাশিয়া”-তে জানাচ্ছেন – “সমগ্র ইউরোপের মধ্যে রাশিয়ান সাম্রাজ্যের স্যানিটারি অবস্থা ছিল সবচেয়ে খারাপের মধ্যে একটি। ১৯০৭ থেকে ১৯১৭-র মধ্যে ১,০০০,০০০-এর বেশি মানুষ টাইফাস মহামারিতে আক্রান্ত হয়েছিল। ১৯১৫ সালে নথিভুক্ত মহামারি জনিত রোগীর সংখ্যা ৮০০,০০০। এর মধ্যে ১৭৮,০০০ জন টাইফয়েড এবং ৪৩,০০০ কলেরা রোগী। ১৯০৯-এ স্মল পক্সে মৃত মানুষের সংখ্যা ৩২,০০০। সবমিলিয়ে মৃত্যুহার ছিল প্রতি হাজারে ২৫-৩০ জন। গড় আয়ুষ্কাল ছিল মোটামুটি ৪০ বছর। প্রতিবছর যে ৬০,০০,০০০ শিশু জন্মগ্রহণ করতো তাদের মধ্যে ২০,০০,০০০ মারা যেত বিভিন্ন অসুখে এবং অপুষ্টিতে। ১৯শ শতকের শেষে এবং ২০শ শতকের গোড়াতে শিশু মৃত্যুর হার ছিল প্রতি ১০০০ শিশুতে ২৫০ জন (যা কল্পনার বাইরের একটা ফিগার!)। ১৯১০-এ প্রতি ১০০০-এ গড় মৃত্যুর হার ফ্রান্সে ১৭.৭, গ্রেট ব্রিটেনে ১৩.৫, জার্মানিতে ১৬.২ এবং আমেরিকাতে ১৫.৯।। প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শুরু হবার পরে সরকারি বিভিন্ন নীতি এবং স্বাস্থ্যব্যবস্থা নিয়ে ক্রমবর্ধমান অসন্তোষের মুখে পড়ে সরকার ২১ সেপ্টেম্বর, ১৯১৬-তে সেন্ট্রাল বোর্ড অফ হেলথ তৈরি করে। সঙ্গতভাবেই ধরে নেওয়া হয় এটা সম্ভবত পৃথিবীর প্রথম সরকারি স্বাস্থ্য দপ্তরের (মিনিস্ট্রি অফ হেলথ) আদিরূপ।”
১৯০৫ থেকে নারী ও শিশু শ্রমিকদের সংখ্যা বাড়তে শুরু করে। ১৯১৪ সালে কম-উন্নত কারখানাগুলোতে ৭৫% শ্রমিক ছিল নারী ও শিশু।
১৯১৭-র নভেম্বর মাসে ক্ষমতা দখলের কয়েকদিনের মধ্যে (নতুন বৈপ্লবিক রাষ্ট্র জন্ম নেবার প্রধান শ্লোগান ছিল “অল পাওয়ার টু দ্য সোভিয়েতস” এবং “ল্যান্ড টু দ্য টিলার্স”) তৈরি হল নতুন “কম্প্রেহেন্সিভ স্যানিটারি লেজিসলেশন” বা “সংহত স্যানিটারি নিয়মাবলী”। এখানে স্পষ্ট ভাষায় জানানো হল – বাণিজ্যিক এবং শিল্পাঞ্চলের উদ্যোগগুলোতে ও নাগরিকের বাসস্থানে পরিচ্ছন্ন পেয় জলের ব্যবস্থা, স্যানিটারি পর্যবেক্ষণ, জাতীয় স্তরে নতুন খালের খনন করবে সরকার। সালমান কেশভজি-র লেখা Blind Spot: How Neoliberalism Infiltrated Global Health-এ লেখক জানাচ্ছেন – “One of the first decrees signed by the Bolsheviks [...] called for 'comprehensive sanitary legislation’ governing clean water, sewerage, industrial enterprises and residential housing.” (পৃঃ ২৮)
বিপ্লবের পরে ১৯১৭ সালেই তৈরি হল “অল-রাশিয়া কংগ্রেস অফ নার্সেস ইউনিয়ন” – ১৯১৮ সালে এর বিভিন্ন অঞ্চলে শাখার সংখ্যা হল ৫৬ এবং সদস্য সংখ্যা ১৮,০০০। ১৯১৮ সালে জন্ম নিলো “কমিশারিয়েট অফ পাব্লিক হেলথ”। নিকোলাই আলেক্সান্দ্রোভিচ সেমাশকো এক বৈপ্লবিক স্বাস্থ্যব্যবস্থার প্রথম পিপল’স কমিশার অফ পাব্লিক হেলথ, অর্থাৎ, রাশিয়ায় জনস্বাস্থ্যের প্রধান ব্যক্তি নির্বাচিত হলেন। উল্লেখযোগ্য হল, এ সময়ে বলশেভিক রাশিয়ার নাম ছিল Russian Soviet Federative Socialist Republic। ১৯২২ সালে জন্ম নেয় USSR। একটি কেন্দ্রীভূত, জনমুখী, সমস্ত স্তরের জনতার জন্য ফ্রি, নিজস্ব খরচ-বিহীন জনস্বাস্থ্য ও স্বাস্থ্যব্যবস্থা জন্ম নিলো। কেন কেন্দ্রীভুত স্বাস্থ্যব্যবস্থার প্রবর্তন করা হয়েছিল? সেমাশকো তাঁর স্মৃতিকথায় জানাচ্ছেন – “centering all public health on a single authorized governing body, the People’s Healthcare Commissariat. Instead of fragmented district management, scattered material and human resources, lack of coordination between various medical agencies in charge of public health, we created a single governing body aimed at combating diseases with maximum conservation of resources and acting in accordance with a developed plan”। আরেক জায়গায় বলছেন – “আমাদের সবকিছুই আক্ষরিক অর্থে শূণ্য থেকে গড়ে তুলতে হয়েছে। এখন আমাদের ৩৯৭,৪৯৬টি বেড রয়েছে রোগীদের জন্য এবং ২৩২টি পরিপূর্ণভাবে সুসজ্জিত ট্রেন আছে। আমরা স্নানের ট্রেন, লন্ড্রি ট্রেন, হাসপাতাল ট্রেন চালু করেছি যা ইউরোপের যেকোন মিলিটারি সংগঠনগুলো করতে পারলে গর্বিত হবে। আমাদের রয়েছে সুবিশাল সুসংগঠিত প্রতিটি স্তরে বিস্তৃত এবং কেন্দ্রীভূত কর্তৃত্ব।”
নিকোলাই আলেক্সান্দ্রো সেমাশকো তাঁর অফিসে
ত্রিমুখী আক্রমণে নবজাত সমাজতান্ত্রিক রাশিয়া চূড়ান্ত বিপর্যস্ত হয়েছিল। ১৯১৮-২০ পর্যন্ত চললো গৃহযুদ্ধ, এর সাথে শুরু হল মহামারি এবং দুর্ভিক্ষ ১৯১৮-২২ অবধি। এস জি হোয়েটক্রফট তাঁর গবেষণাপত্র “Famine and Epidemic Crises in Russia, 1918-1922: The Case of Saratov” প্রবন্ধে দেখিয়েছেন – দুর্ভিক্ষ এবং রোগের ফলে ১৯১৮ থেকে ১৯২০ এই তিন বছরে প্রায় ৪০ লক্ষ অসামরিক বা সাধারণ মানুষ মারা যায়। আবার ১৯২১-এর শেষ তিন মাস থেকে ১৯২২-এর প্রথম ৬ মাসে দেশজুড়ে মানুষের মৃত্যুর সংখ্যা প্রায় ৫০ লক্ষ।
এরকম এক অসম্ভব প্রতিকূল, শক্ত এবং অভাবিতপূর্ব পরিস্থিতির মধ্যে লেনিনের নেতৃত্বে বলশেভিক বা কমিউনিস্ট পার্টি গ্রহণ করেছিল একের পরে এক মানুষ-কেন্দ্রিক কর্মসূচী। তার মধ্যে একটি কর্মসূচী ছিল স্বাস্থ্য এবং জনস্বাস্থ্যকে ঘিরে। এই দুই কর্মসূচীর ভরকেন্দ্রে ছিল রুশ ভূখণ্ডের সমস্ত স্তরের, জাতের (রাশিয়াতে সেসময়ে ১৭৫টি জাতিসত্তার মানুষ ছিল), এবং ধর্মের মানুষের অসীম গুরুত্ব। এবং অবশ্যই অগ্রাধিকার ছিল শ্রমিক এবং যারা কারখানায় বা জমিতে শ্রম দিয়ে দেশের জন্য সম্পদ তৈরি করছে, দেশকে বাঁচিয়ে রাখছে সেরকম সমস্ত মানুষের। এদের তৈরি সম্পদ ব্যয় করা হয়েছে এদের স্বাস্থ্যের সমস্যা সমাধানের জন্য। রাষ্ট্র নিজে এ দায়িত্ব নিয়েছে শুধু নয়, একে প্রসারিত করেছে।
১৯২০ সালে শ্রমিকদের জন্য পৃথিবীর ইতিহাসে প্রথম “rest home” বা চিকিৎসার সুযোগ সমেত নার্সিং হোম তৈরি হল। এরপরে ১৯২৫ সালে ইয়াল্টায় কৃষকদের জন্য তৈরি হল “রেস্ট হোম”। এ সুযোগ-সুবিধে পৃথিবীর অন্য কোন দেশে তখন অকল্পনীয় একটি ভাবনা ছিল, কারণ অন্য সমস্ত দেশেই এদের শ্রম আত্মসাৎ করে ব্যক্তিগত মুনাফা এবং সম্পদের পাহাড় তৈরি হয়। কিন্তু রাশিয়ার যাত্রাবিন্দুই (বা বলা যেতে পারে প্রস্থান বিন্দু) ছিল এদের শ্রমকে অর্গলমুক্ত করে দেশের মানুষের মাঝে সুষম বন্টন করা এবং সার্বিক শ্রীবৃদ্ধি, উন্নয়ন ও বিকাশ ঘটানো। হেনরি সিজারিস্ট তাঁর মেডিসিন অ্যান্ড হেলথ ইন দ্য সোভিয়েত ইউনিয়ন (১৯৪৭) খুব স্পষ্ট ভাষায় বলেছেন – “The very success of the Russian Revolution – often denied but undeniable – frightened the ruling groups of many countries to such an extent that they accepted fascism as a bulwark against socialism. History pursued the iron logic.” (p. viii, নজরটান লেখকের)
ভ্লাদিভস্টক এবং পার্শ্ববর্তী অঞ্চলের মধ্যে একটি অ্যান্টি-টাইফাস ট্রেন চালানো শুরু হল। এই ট্রেনে ৩৫০ জন রোগীকে রেখে চিকিৎসা করা যেত। ৩৫ বগির এই ট্রেনে স্নান করার, জামা-কাপড় ছাড়ার, অপারেশনের যন্ত্রপাতি এবং গায়ের জামা-কাপড় স্টেরিলাইজ করার বন্দোবস্ত ছিলো, ফুটন্ত জলের ব্যবস্থা ছিলো, একটি ট্যাংকার, ক্ষৌরকারদের জন্য আলাদা বগি সমেত ডাক্তার, বিভিন্ন স্তরের চিকিৎসাকর্মী এবং সহায়ক কর্মীদের থাকার সমস্ত ব্যবস্থাও ছিলো। মনে রাখতে হবে এ সময়টি ছিল তীব্র, রক্তক্ষয়ী গৃহযুদ্ধ এবং দুর্ভিক্ষ ও মহামারির এক মরণ-বাঁচন অধ্যায়।
১৯১৯-এর জুনে লেনিন একটি ডিক্রি সই করলেন। এই ডিক্রিতে বাচ্চাদের খাওয়ানোর আলাদা ব্যবস্থা করা হল। শিশুদের খাবার ব্যাপারে অগ্রাধিকার দেওয়া হয়েছিল, বয়ঃসীমা ১৬ বছর পর্যন্ত। ১৯২২ সাল ছিল “ভয়াবহ ক্ষুধার বছর”।
পূর্বোল্লেখিত ভ্লাদিমির রেশেৎনিকভ-এর “The history of public health care in Russia” প্রবন্ধে বলা হল – “জনস্বাস্থ্যের উন্নতির জন্য বলশেভিকদের নিষ্ঠা দেখে ডাক্তার এবং নার্সেরাও পিপল’স হেলথকেয়ার কমিশারিয়েট-এর সমর্থনে এগিয়ে এলেন। ১৯১৮ থেকে ১৯২২-এর মধ্যে ১৬টি মেডিক্যাল ফ্যাকাল্টি খোলা হল এবং উচ্চতর মেডিক্যাল শিক্ষা ফ্রি এবং উন্মুক্ত হল RSFSR-এর সমস্ত রুশ নাগরিকের জন্য। সমস্ত মেডিক্যাল পেশাজীবীরা বাধ্যতামূলক সার্ভিস দেওয়া শুরু করলেন ১৯১৮ থেকে। রুশ কমিউনিস্ট পার্টির ৮ম কংগ্রেসে (১৮-২৩ মার্চ, ১৯১৯) সোভিয়েত স্বাস্থ্যব্যবস্থার প্রাথমিক লক্ষ্য এবং বিকশিত হবার স্ট্র্যাটেজি নির্ধারণ করলো। নতুন যেসব প্রতিষ্ঠান এবং ব্যবস্থা জন্ম নিলো সেগুলো পরপর এরকম – আশু চিকিৎসা এবং প্রিভেনশনের জন্য বিশেষ দক্ষতা সম্পন্ন কেন্দ্র, শিশুদের খাওয়ানোর কেন্দ্র, day nurseries, child welfare organizations, child healthcare organizations, জনস্বাস্থ্যের শিক্ষার জন্য আলাদা বিশেষ কেন্দ্র।” জনস্বাস্থ্যের বোধ এবং শিক্ষার বিকাশের জন্য বিভিন্ন জায়গায় বক্তৃতা দেওয়া, লিফলেট বিলি করা, রেডিওতে প্রচার করা এবং সিনেমা দেখানো – এরকম সমস্ত পদ্ধতি নেওয়া হয়েছে।
কেন্দ্রীভূত কিন্তু জনসমাজের গভীর পর্যন্ত প্রসারিত জনস্বাস্থ্যের এবং স্বাস্থ্যের উদ্যোগের ভরকেন্দ্র করা হল ‘district principles”-কে। বিভিন্ন ডিস্ট্রিক্টে ভাগ করা হল সমগ্র পরিচালনার বিষয়টিকে। এই সমগ্র উদ্যোগের ফলে রাশিয়ার প্রিভেন্টিভ স্ট্র্যাটেজি এবং স্যানিটারি পদক্ষেপ যে আলোড়ন তৈরি করেছিল তা কিছু বিশেষজ্ঞের চোখ এড়ায়নি। জার্মানির অস্কার ভোগট এবং লিপম্যান ১৯২৪-এ স্বচক্ষে এর সুদূরপ্রসারী ফলাফল দেখেছিলেন এবং দেশে ফিরে গিয়ে একটি সুবৃহৎ প্রবন্ধ লিখেছিলেন। বিখ্যাত বিজ্ঞানী পাভলভের আমেরিকান ছাত্র W. Horseley Gantt ব্রিটিশ মেডিক্যাল জার্নাল-এ রাশিয়ার স্বাস্থ্যব্যবস্থা নিয়ে ধারাবাহিক প্রবন্ধ লিখেছিলেন। ১৯২৮ সালে এ প্রবন্ধগুলোর সংকলন বই হয়ে বেরোয় – A Medical Review of Russia। একই বছরে আনা হেইন্স-এর বই Health Work in Russia প্রকাশিত হয়। ১৯৩২-এ ইংল্যান্ডের জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ স্যার আর্থার নিউজহোম এবং নিউ ইয়র্কের ডাক্তার জন কিংসবেরি, যিনি Milibank Memorial Fund-এর ডিরেক্টরও ছিলেন, রাশিয়ায় যান প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা অর্জনের জন্য। ১৯৩৩-এ তাঁদের বই প্রকাশিত হল – Red Medicine: Socialized Health in Soviet Russia। এমন দু’জন বিশেষজ্ঞ তাঁদের অভিজ্ঞতা-সমৃদ্ধ এই বইটি লিপিবদ্ধ করলেন যে অনেক চেষ্টা করেও এ বইকে পক্ষপাতদুষ্ট বলা যাবেনা। কি দুর্ভাগ্য! ১৯৩৭-এ প্রকাশিত হল হেনরি সিজারিস্ট-এর Socialized Medicine in the Soviet Union – দীর্ঘ ৭ বছরের রাশিয়ায় বাস, রুশ ভাষা শিখে তাঁর অভিজ্ঞতার ফসল এই অসাধারণ পুস্তকটি।
Red Medicine: Socialized Health in Soviet Russia-তে বলা হল – “সোভিয়েত ইউনিয়ন পৃথিবীর প্রথম দেশ যে একটি সম্পূর্ণ সংগঠন গঠন করার দায়িত্ব তুলে নিয়েছে। এই সংগঠনের ডিজাইন হল রাশিয়ার ভূখন্ডে বাস করা প্রতিটি মানুষ, নারী এবং শিশুকে একইসাথে প্রিভেন্টিভ এবং কিউরেটিভ সুরক্ষা পৌঁছে দেওয়া।” (পৃঃ vii) এঁদের পর্যবেক্ষণে – “১৯৩১ সালের মধ্যে দরিদ্রতর জনসমষ্টির জন্য রাশিয়ায় ৭২৪,০০০ বেড তৈরি হয়েছিল সেরে ওঠার কেন্দ্র এবং স্যানাটরিয়ামগুলোতে।” এঁদের চোখে ধরা পড়েছিল – পুঁজিবাদী দেশগুলোর এবং রাশিয়ার স্বাস্থ্যব্যবস্থার একটি মূলগত প্রভেদ হচ্ছে রাশিয়ায় প্রতিটি ডাক্তার রাষ্ট্রের প্রতিনিধি এবং প্রাইভেট প্র্যাক্টিস রয়েছে যৎসামন্য। (পৃঃ ২১৮) বিপ্লবের আগে চিকিৎসকের সংখ্যা ছিল ২৬,০০০। ১৯৩৩ সালে সে সংখ্যা বেড়ে হয়েছে ৭৬,০০০। এঁরা আমেরিকা এবং রাশিয়ার মেডিক্যাল কেয়ারের একটি প্রতিতুলনা করেছিলেন মোট ১০টি পয়েন্টে। (পৃঃ ২৭১-২৭৫) একমাত্র ডেন্টিস্টদের সংখ্যা আমেরিকায় বেশি এবং দাঁতের চিকিৎসাব্যবস্থা উন্নত হওয়া ছাড়া আর কোন ক্ষেত্রেই আমেরিকার ঔকর্ষ খুঁজে পাননি। বরঞ্চ, ব্যক্তিগত মুনাফা-কেন্দ্রিক আমেরিকার যে মেডিক্যাল কেয়ার ব্যবস্থা সেখানে রোগীকে মানুষের উপযুক্ত সম্মান দিয়ে চিকিৎসা হয়না এ কথা জোর দিয়ে বলেছেন। এঁদের তথ্য অনুযায়ী, ১৯১৭-ড় আগে রাশিয়াতে প্রশিক্ষিত চিকিৎসকের সংখ্যা ছিল ২৬,০০০। ১৯৩১-এ সে সংখ্যা হয় ৭৬,০০০। এঁদের দেওয়া বক্তব্য অনুসারে – “Another feature of Soviet medicine, a feature which is perhaps its guiding principle, is that the new service is made available in a special degree to all industrial workers and the poorest of the peasants, and to their families.” (পৃঃ ২৬৮, নজরটান মূল লেখায়) ১৯৩১-এর মধ্যে দরিদ্রতর মানুষের জন্য বিভিন্ন convalescent homes এবং স্যানাটরিয়ামে ৭২৪,০০০ শয্যার ব্যবস্থা ছিল। (পৃঃ ২৬৯) প্রাইভেট প্র্যাক্টিস করা চিকিৎসকের সংখ্যা ১০%-এর বেশি ছিলনা। (পৃঃ ২৭০)
এখানে আমরা উল্লেখ করবো ইংল্যান্ডের ন্যাশনাল হেলথ সার্ভিস (NHS)-এর কথা। আমাদের ধারণা অংশত সোশ্যালিস্ট মেডিসিনের প্রভাব, অংশত ইউরোপের (বিশেষ করে তিনটি দেশ ইংল্যান্ড, ফ্রান্স এবং জার্মানিতে) জনস্বাস্থ্য আন্দোলনের অভিঘাত, অংশত ইংল্যান্ডে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তর সময়ের বিশেষ সামাজিক-রাজনৈতিক পরিবেশ – এসবের সম্মিলিত যোগফলে ঐতিহাসিক NHS-এর জন্ম। ১৯৪৮ সালের জুন মাসে ইংল্যান্ডের প্রতিটি বাড়িতে একটি লিফলেট পৌঁছে দেওয়া হয়েছিল। লিফলেটে বলা হয়েছিল –
“আপনার ন্যাশনাল হেলথ সার্ভিস শুরু হবে ৫ জুলাই। এটা কি? কিভাবে আপনি পাবেন? এই সার্ভিস আপনাকে সমস্ত মেডিক্যাল, ডেন্টাল, এবং নার্সিং-এর ব্যবস্থা জোগাবে। প্রতিটি মানুষ – দরিদ্র অথবা ধনী, পুরুষ, নারী অথবা শিশু – একে পূর্ণত কিংবা এর যেকোন অংশকে ব্যবহার করতে পারবে। কয়েকটি বিশেষ ক্ষেত্র ছাড়া এর জন্য কোন মূল্য দিতে হবেনা। এর জন্য কোন ইন্সিউরেন্সের প্রয়োজন নেই। কিন্তু এটা কোন “দাক্ষিণয়্য বা চ্যারিটি” নয়। আপনারা সবাই এর জন্য অর্থ দিচ্ছেন, প্রধানত একজন ট্যাক্সদাতা হিসেবে, এবং অসুস্থতার সময়ে আপনাদের অর্থের জন্য বিপুল উদ্বেগ থেকে মুক্তি দেবে এই সার্ভিস।” (নজরটান লেখকের)
১৯১৭ সালের ১৩ নভেম্বর (রুশ বিপ্লবের ৫ দিন পরে) সোভিয়েত সরকার যে ডিক্রি জারি করেছিল তাতে বলা হয়েছিল – “(১) ব্যতিক্রমহীনভাবে সমস্ত শ্রমদানকারী শ্রমিকের জন্য সোশ্যাল ইন্সিউরেন্স করা হল যার সুযোগ প্রসারিত হবে শহর ও গ্রামের দরিদ্রদের জন্যও, (২) সমস্ত ধরনের অক্ষমতাকে (যেমন অসুস্থতা, আঘাত, পঙ্গু হয়ে পড়া, বার্ধক্য, মাতৃত্বকালীন অবস্থা, বৈধব্য, অনাথ সন্তান এবং কর্মহীনতাকে) এই ইন্সিউরেন্সের আওতায় আনা হল, (৩) ইন্সিউরেন্সের সমস্ত খরচ রাষ্ট্র বা মালিক বহন করবে, (৪) কাজ চলে গেলে কিংবা অক্ষম হয়ে পড়লে সমস্ত ধরনের খরচ রাষ্ট্র বহন করবে, এবং (৫) যার ইন্সিউরেন্স করা হয়েছে তার ইন্সিউরেন্সের ওপরে সমস্ত অধিকার থাকবে। (হেনরি সিজারিস্ট, Socialized Medicine in the Soviet Union, পৃঃ ৮৬-১০৪)
আমরা বর্তমান ভারতের সাথে একবার মিলিয়ে নিতে পারি। বর্তমান ভারতে স্বাস্থ্যব্যবস্থা নিয়ে আত্মপ্রসাদের বীভৎস রস উপভোগ করার এর চেয়ে ভালো ঊপায় আর কি আছে?
এরপরেও আরও কিছু কথা থাকে। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পরে১৯২০ সালে তৈরি হল লিগ অফ নেশনস। এর অন্যতম কর্মকর্তা ছিলেন নরওয়ের স্বাস্থ্য প্রধান কার্ল ইভাং। তিনি জানাচ্ছেন যে “স্বাস্থ্য” বিষয়টি রাজনৈতিক নেতাদের কাছে গুরুত্বপুর্ণ কোন ব্যাপার ছিলনা – “One interesting historical example is that health was “forgotten” when the Covenant of the League of Nations was drafted after the first World War. Only at the last moment was world health brought in, producing the Health Section of the League of Nations, one of forerunners of the present FAO (Food and Agricultural Organization), as well as WHO.” (k. Evang, “Political, National and Traditional Limitations to Health Control”, Health of Mankind, eds. Gordon Wolstenhome and Maeve O’Konnor, CIBA Foundation 100th Symposium, 1967, p. 202)
মনে রাখা দরকার, যে সময়ে পৃথিবীর তাবড় ধনতান্ত্রিক দেশগুলো “স্বাস্থ্য” শব্দটিকে ভুলে যাচ্ছিল সেসময়ে বলশেভিক রাশিয়ায় সবার জন্য, সমস্ত নাগরিকের জন্য স্বাস্থ্যের নতুন মহাযজ্ঞের উদ্বোধন শুধু হয়নি, প্রবল উদ্দীপনা নিয়ে সবার কাছে স্বাস্থ্যের সুযোগ পৌঁছে দেবার কর্মযজ্ঞ বিপুল গতিতে চলেছে। সিজারিস্ট তাঁর Medicine and Health in the Soviet Union (১৯৪৭) গ্রন্থে বলছেন – “সোভিয়েত মেডিসিনে কোন আপোষ নেই। এর কাঠামো সহজেই বোঝা যায় কারণ এটা বাস্তবোচিত, যুক্তিযুক্ত এবং স্বচ্ছ।” (পৃঃ ২৪) তিনি সোভিয়েত মেডিসিনের চারটি বৈশিষ্ট্যকে সবচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করেছিলেন – (১) মেডিক্যাল সার্ভিস খরচবিহীন, এবং সবার কাছে লভ্য, (২) সমস্ত স্বাস্থ্যসংক্রান্ত কার্যক্রমের কেন্দ্রে রয়েছে “promotion health and prevention of disease”, (৩) কেন্দ্রীয় সংস্থা, স্বাস্থ্যমন্ত্রক (পূর্বতন পিপলস’ কমিশারিয়াট অফ হেলথ) সমস্ত স্বাস্থ্যসংক্রান্ত কাজকর্ম পরিচালনা করে, এবং, এর ফলে (৪) অনেক বৃহৎ পরিসরে স্বাস্থ্য নিয়ে পরিকল্পনা করা যায়। (পৃঃ ২৪-২৫)
কিন্তু কেন্দ্রীভূত, ক্ষমতাশালী যে স্বাস্থ্যের কাঠামো গড়ে উঠেছিল আশঙ্কা হয় সে কাঠামোর মধ্যেই পরবর্তীতে পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে অপরিমেয় ক্ষমতাসম্পন্ন আমলাতন্ত্র গড়ে উঠেছিল, যা শেষ অব্দি মানুষের স্বরকেই হয়তো বহুক্ষেত্রে রুদ্ধ করেছে।
অনবদ্য স্যার।
অজানা অনেক তথ্য...বারবার সমৃদ্ধ হলাম স্যার
সোভিয়েত রাশিয়ার স্বাস্থ্য সম্বন্ধে অনক তথ্য পেলাম..... ধন্যবাদ
তথ্যপূর্ণ ও যুক্তিযুক্ত লেখা। পড়ে অনেক কিছু জানতে পারলাম।
খুব ভালো লাগল স্যার
খু ব প্রাসঙ্গিক এবং গুরুত্তপূর্ণ লেখা ।স্বাস্থ্য পরিষেবা
সামাজিক দায় নিয়ে যারা কাজকরেন , প্রত্যাককের কাছে
এই ঐতিহাসিক বিশ্লেষণ পৌঁছে দেব . পড়া দরকার
কিউবার স্বাস্থ্য ব্যবস্থা ও স্বাস্থ্য নীতিমালা জানতে চাই।
অনেক অজানা তথ্য পেলাম
অসামান্য ।
খুবি ভালো লাগলো পড়ে অসাধারণ | ধন্যবাদ স্যার .