

আষাঢ় মাসের বিকেলে ছোট হল্ট স্টেশনে বসে আছি।আকাশ মেঘলা, লোকজন তেমন নেই।চোখে না পড়ার মতো চা দোকান। পাশে কদমগাছে অজস্র ফুল ফুটে আছে।
হঠাৎ দেখি কিছু লোকজন দল বেঁধে প্ল্যাটফর্মে উঠে এল।গ্রাম্যদেশের মানুষ সব।কথা বলতে বলতে যাচ্ছে। বেশ ঝলমলে জামাকাপড়।বুঝলাম, হাট থেকে ফিরছে।
সামনের লোকটির কাঁধে একটা কাপড় জড়ানো খাঁড়া।অল্প কিছু অংশ বেরিয়ে আছে, আলো লেগে অল্প চমকাচ্ছে। কদিন পরে নিশ্চয়ই কোনো জাগ্রত থানে বলির ব্যাপার আছে।
দলের ছোট সদস্যের হাতে একটা দড়ি, দড়ির শেষ প্রান্তে একটা কালো পাঁঠা আপনমনে নিশ্চুপে হেলতে দুলতে চলছে। পাঁঠার কানে ও মুখের কাছে অদ্ভূত কায়দায় ছোট মেয়েদের চুল বাঁধার লাল রঙের ফিতে জড়ানো,জড়ানোর ভঙ্গিতেই বোঝা যাচ্ছে সযত্নে রচিত।প্ল্যাটফর্মের দক্ষিণ বরাবর ওরা সিধে হেঁটে মাঠে নেমে মিলিয়ে গেল।
দেড় বা দুদিনের মাথায় যে পশু বলি হবে তার মাথায় বালিকার টকটকে লাল ফিতে, মৃত্যুকে নিয়ে যে লোকটি এমন চিন্তা করেছে সে ভাবুক লোক, রস আছে, সামান্য গম্ভীর, সূর্য পাটে বসলে একটা বিড়ি খায় নিয়ম করে।
লোকটির কথা ভেবে কদম গাছের নীচে বসে এক কাপ চা কিনি। বোঝার চেষ্টা করি, দোকানি শিল্পী না কারিগর। কতোটা যত্নে লিকার ছেঁকছে, আদারস বা লেবু শেষে বিটলবণ বা গোলমরিচ দিচ্ছে কি না।
বেলা কিছুটা আছে। চা খেয়ে মিনিট কুড়ি ঘুরে বেড়াই আরেক ইষ্টিশনে। পেচ্ছাপখানার দেওয়ালে সাঁটা বিজ্ঞাপন পড়ছি। লিঙ্গবর্ধক যন্ত্র, মা মনসা মোবাইল সেন্টার, তিন মাসে ফ্রিজ সারানো শিক্ষা।
হাঁটতে হাঁটতে পৌঁছে যাই বাস রাস্তার পাশ দিয়ে বিরাট এক বটগাছের পাশে। পাশে পুকুর। পুকুরে গভীর কলমিলতার ঢেউ। আকাশে বিরাট চাঁদ উঠব উঠব করছে।
সিমেন্ট বাঁধানো চাতাল পার করলে আশ্রম। আগে শুনেছি এই আশ্রমের কথা। তমাল গাছের শিকড় বাঁধিয়ে দেওয়া হয়েছে বসার জন্য। মাধবীলতা বুকে হেঁটে গাছের মাথায়। চারিদিকে ধূপধুনোজলের ভেজা ভেজা শান্তির গন্ধ।
শ্রীখোল সামনে রেখে এক ভাঙাচোরা বুড়ো মানুষ বসে আছে। সাদা ধুতি পরনে, খালি গা, গলায় কন্ঠী,একটা পা নেই। দেওয়ালে ক্রাচ ঠেসিয়ে রাখা। বগলে ক্রাচ রেখে লাফাতে লাফাতে চাতাল, তারপর উঠে এল। ক্রাচ আর সিমেন্টের মেঝের ঘর্ষণের আওয়াজে কারুণ্য আছে।
গিয়ে বসলাম। বাড়ি খবর সব শুধাল সেই মানুষ, কাজকর্মের খবর। বললাম - আমি অনেকদূর পড়াশোনা করেছি কিন্তু আমি বেকার, উপার্জনের চেষ্টা করছি।
আমিও বিভিন্ন বিষয় জিজ্ঞাসা করছি সেই মানুষকে। ফ্যাকাশে মানুষ একটানা কথা বলতে পারছে না, কাশির বেগ আসছে, কপালের শিরা ফুলে উঠছে।
গানের কথা বলছে। কীর্তন গায়। গৌর অন্তপ্রাণ সে, শ্রোতাদের দেখলে বুঝতে পারে কে কেমন শ্রোতা।
ধরা যাক, ভেকশ্রোতা অর্থাৎ ব্যাঙ সারাক্ষণ গলা ফুলিয়ে ডেকে চলছে, ও কেবল ডাক নয়, কীর্তন করে চলেছে আপমনে জগৎ সংসার ভুলে।
সর্পশ্রোতা, গান শুনতে শুনতে ঘোর ও ভাবে আবেশ হল, তখন মানুষ দুলতে শুরু করে বসে বসেই, সাপ যেমন ফণা দোলায়।
শ্রীখোল খানিক সরিয়ে হাঁটু মুড়ে বসে থেকেই দুলে দুলে এই ভঙ্গি করে দেখাল আমায়।
রাজহাঁস-শ্রোতারা গানে ভেজাল থাকলেও মূল সুরটুকু নেয়, বাকি গ্রহণ করে না, ফেলে দেয়, দুধ রেখে জল ফেলে দেওয়ার মতো।
বকশ্রোতা ভালো না।ভাণ করে।গানের রস না গ্রহণ করেও এমন ভাব করে যেন সে খুব রসিকজন, সে গান শোনে না কাউকে শুনতেও দেয় না।
আসলে একজন মানুষ সাপব্যাঙহাঁসবক বয়ে নিয়ে চলে, আজীবন।
খুব চমক লাগল আমার এইভাবে গানের শ্রোতাদের দেখার দৃষ্টিকে। ইতিমধ্যে ঘোমটা-টানা বউ সন্দেশ প্রসাদ দিয়ে গেছে। নিমকাঠের রাধাকৃষ্ণ, ষড়ভুজ চৈতন্যের কাছে প্রদীপ জ্বলছে, শীতলভোগ দেওয়া হয়ে গেছে।
আমি শুধালাম - সংসার করেছেন?
সেই মানুষ বলল - ঘোমটা মাথায় এল উনি তো গিন্নি আমার।
একবার গান সেরে ফিরছিলাম, মোটরসাইকেল ধাক্কা মারে, তাতেই তো একটা পা যায়, উনি সেবা করে খুব।
ছেলেমেয়ে কটি আপনার?
উত্তর দিতে একটু সময় নেয়। কাশির দমক সামলায়। তারপর মিষ্টি হেসে বলে - এক ছেলে এক মেয়ে, কিন্তু আমার সন্ন্যাস, ওই দ্যাখো ছ' হাতের চৈতন্য, উপর হাত রামের, মধ্য কৃষ্ণের, নীচের হাত গোরার এক যষ্টি ও এক হাতে কমণ্ডলু, সন্ন্যাস নিলে হাতে তো যষ্টি দেয়, গোরা আমায় চিরদিনের সন্ন্যাসী করেছে হাতে যষ্টি দিয়েছে ওই দ্যাখো তাকিয়ে,দেওয়ালে ঠেসানো ক্রাচ দেখায়।
বুঝলাম নিজের দুঃখ কষ্টের মুখের দিকে তাকিয়ে অল্প হেসে এও এক রসিকতা। অপরূপ ঠাট্টা।
আমি হাওয়াবাতাস দুহাতে ধরে বিদায় জানিয়ে বাড়ির পথ ধরি, শেষ লোকালটা ধরতে হবে, আকাশের তলায় আলো অন্ধকারে ভেজা সব গাছপালা হাসছে, আতপচালের গন্ধ বেরিয়েছে সামনের মাঠ থেকে।
kk | 172.56.***.*** | ০৬ জুলাই ২০২৪ ০০:১৭534228
&/ | 151.14.***.*** | ০৬ জুলাই ২০২৪ ০১:১৪534230
শীর্ষা | 2409:4081:be41:c1e6::e14a:***:*** | ০৬ জুলাই ২০২৪ ০৯:১৬534241
প্রতিভা | 115.96.***.*** | ০৬ জুলাই ২০২৪ ০৯:২৬534242
সম্রাট রানো | 2402:3a80:434c:e747:6fa6:ef7e:477:***:*** | ০৬ জুলাই ২০২৪ ০৯:৩৫534244
প্রজ্ঞাপারমিতা | 103.192.***.*** | ০৬ জুলাই ২০২৪ ০৯:৫৩534246
সমালোচক | 66.203.***.*** | ০৬ জুলাই ২০২৪ ১০:১৪534248
সমালোচক | 66.203.***.*** | ০৬ জুলাই ২০২৪ ১২:১৫534255
সমালোচক | 66.203.***.*** | ০৬ জুলাই ২০২৪ ২০:০২534272
কৌতূহলী | 103.249.***.*** | ০৬ জুলাই ২০২৪ ২০:৫১534274
কৌতূহলী | 103.249.***.*** | ০৬ জুলাই ২০২৪ ২০:৫২534276
সমালোচক | 66.203.***.*** | ০৬ জুলাই ২০২৪ ২১:৪৮534277
কৌতূহলী | 103.249.***.*** | ০৬ জুলাই ২০২৪ ২৩:৩৭534279
r2h | 174.163.***.*** | ০৭ জুলাই ২০২৪ ০০:০৩534280
সমালোচক | 66.203.***.*** | ০৭ জুলাই ২০২৪ ০২:০৬534286
সমালোচক | 66.203.***.*** | ০৭ জুলাই ২০২৪ ০২:৩০534288
r2h | 174.163.***.*** | ০৭ জুলাই ২০২৪ ০৭:৫১534291
&/ | 151.14.***.*** | ০৭ জুলাই ২০২৪ ০৮:০৫534292
&/ | 151.14.***.*** | ০৭ জুলাই ২০২৪ ০৮:০৬534293
&/ | 151.14.***.*** | ০৭ জুলাই ২০২৪ ০৮:১১534294
&/ | 151.14.***.*** | ০৭ জুলাই ২০২৪ ০৮:১৪534295