আজ একটু নিজের কথা বলি। গত কয়েকবছর ধরেই আমি নিজেকে 'ভাষা শহীদ' বলে আসছিলাম। নেহাত মজা করে নয়, বিশ্বাস করে। বাংলা পড়তে এসেছিলাম, অন্য জায়গায় চান্স না পেয়ে নয়, ভালোবেসে। অনায়াসে বি.এসসি ও এম.এসসি-এর মায়া কাটিয়ে, বাড়ির সবার বিরুদ্ধে গিয়ে সাহিত্য পড়ব বলেই সাহিত্য পড়েছি। তখন মনে হয়নি, এর ভবিষ্যত কি। অদূরে অন্নজলের সংস্থান কি হবে তা নিয়েও ভাবিনি। এখন বুঝি ভাবলে ভাল হত। সকলের মতে মাথা যেহেতু খুব একটা মন্দ ছিল না, বিশ্বাস রেখেছিলাম শেষ একটা কিছু নিশ্চয়ই করে উঠব - হয়ত কোনো একটা পছন্দের বিষয় নিয়ে গবেষণা করার সুযোগ হবে।
এখন সে শখ মিটেছে। UGC, NTA ও NET সে শখ মিটিয়ে দিয়েছে। মেধা ও শ্রম এখানে খুব একটা কাজে লাগবে না। সেসব শিকেয় তুলে যদি ভাবা যেত খুব কষে মুখস্থ করে উতরে যাব, তাও সম্ভব নয়। এবার প্রশ্ন হল কেন নয়? উদাহরণ দিই।
'পুনশ্চ' কাব্যগ্রন্থের যে কবিতাটি উদ্ধৃতি চিহ্ন দিয়ে শেষ হয়েছে, - সেটি হল বলে অতঃপর চারটি বিকল্প। প্রসঙ্গত জানিয়ে রাখি 'পুনশ্চ'য় কবিতা সংখ্যা পঞ্চাশটি।
প্রশ্ন যদি হজম না হয়ে থাকে আরও দুই-একটা উদাহরণ দিই - 'শ্রীকৃষ্ণকীর্তন'-এর বিভিন্ন অংশ থেকে পাচঁটি পংক্তি তুলে দেওয়া হল, ক্রমানুসারে সাজাও।
বিজয়গুপ্তের 'মনসামঙ্গল' ও রামেশ্বর ভট্টাচার্য্যের 'শিবায়ন' থেকেও একই রকম প্রশ্ন। বেশিরভাগ প্রশ্নই করা হয়েছে এমনটাই - "প্রদত্ত সংকেতে শুদ্ধ ক্রমের সঠিক বিকল্পটি হলো -"।
এর সাথেই, গত কয়েক বছর ধরে আরও যে ধরণের প্রশ্ন আসছে তার থেকেও দুই-একটা বলি -
এক. রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কয়েকটি প্রবন্ধ থেকে নীচে কয়েকটি শুদ্ধ-অশুদ্ধ মন্তব্য দেওয়া হল।
দুই. 'উজ্জ্বলনীলমণি' থেকে কয়েকটি শুদ্ধ-অশুদ্ধ মন্তব্য দেওয়া হল।
তিন. 'নবজাতক' কাব্যের কয়েকটি রচনার নাম ও সেগুলি রচনার স্থান দুটি তালিকায় দেওয়া হল - উভয় তালিকার মধ্যে সামঞ্জস্য বিধান করো।
চার. 'ইঁদুর' গল্পের সমাপ্তি বাক্যটি হল -
পাঁচ. সমর সেনের 'একটি বেকার প্রেমিক' কবিতায় 'কলতলা' শব্দের সঙ্গে প্রথমে 'য়' তারপর 'র' ব্যবহৃত হয়েছে - শুদ্ধ না অশুদ্ধ।
ছয়. 'পূজারিণী' কবিতার (উল্লেখ্য কবিতাটি ছাপা অক্ষরে ২০ পৃষ্ঠার বেশি) কয়েকটি লাইন - শুদ্ধ ক্রমের সঠিক বিকল্প সাজাও।
পরের নেট পরীক্ষাটিতে এরা যদি উপন্যাস ও গল্প-প্রবন্ধ থেকে কোন পরিচ্ছেদের পর দাঁড়ি-কমা আছে বা অমুক প্রকাশনীর অমুক পরিচ্ছেদের এত নম্বর পৃষ্ঠায় উক্ত শব্দগুলির শুদ্ধ-অশুদ্ধ নির্বাচন করো জাতীয় প্রশ্ন করে, তাতেও আশ্চর্য হব না। কারণ বুঝে গেছি এদের দ্বারা সবই সম্ভব।
UGC NET বর্তমানে এমনই এক পরীক্ষা যেখানে মেধা বা শ্রমের কোনও জায়গা নেই, থাকার মধ্যে আছে কেবল আন্দাজ এবং একমাত্র আন্দাজ।
নেট-এর গণ্ডি পেরিয়ে যারা আশা করে নিজ পছন্দের বিষয় নিয়ে গবেষণা করবে বা আপাত ভাবে JRF এর টাকায় অস্বচ্ছল বাড়িটিকে আর্থিকভাবে সাহায্য করবে ও ভবিষ্যতে একটি স্বাচ্ছন্দ্যপূর্ণ জীবনের প্রত্যাশায় রাতের পর রাত, মাসের পর মাস পরিশ্রম করে চলেছে - তাদের স্বপ্নকে কার্যত বুড়ো আঙুল দেখিয়ে চলছে রাষ্ট্রের মামদোবাজি। যত জানবে তত কম মানবে- এই তো নিয়ম। ফলে উচ্চশিক্ষা নিতান্ত খারাপ জিনিস, তার জন্য খরচ বাজে খরচ। ফলাফল পরীক্ষা শেষের ২৪ ঘন্টার মধ্যে সে পরীক্ষা বাতিলের খাতায়। শোনা যাচ্ছে বাতিল পরীক্ষা আবার হবে। আমরা যারা পরীক্ষায় বসব, তারা আবার করে একটি প্রহসনের মুখোমুখি হব, এম সি কিউ নির্ধারণ করবে আমাদের সাহিত্য পাঠের দক্ষতা।