লোকসভা নির্বাচনের ফলাফল বেরোনোর পর বোঝা গেছে এই ভোট হয়েছে বিজেপি / নো বিজেপি এই বাইনারি থেকে। এই রাজ্যে ইণ্ডিয়া জোটের কোনো চিহ্ন ছিল না। সিপিআইএম কে তৃতীয় পরিসর থেকেই লড়তে হত। কারণ মমতা বন্দোপাধ্যায় প্রাথমিকভাবে কংগ্রেসকে দুটি আসন ছাড়ার কথা বললেও সিপিআইএমের নাম, স্বাভাবিকভাবেই করেন নি। ফলে সিপিআইএমের নেতৃত্বের সামনে বিকল্প ছিল একটি আসনেও প্রতিদ্বন্দ্বিতা না করা যে পথে তাঁরা হাঁটেন নি। তবে সিপিআইএম একা নয়, দোর্দণ্ডপ্রতাপ অনেক দল যারা এনডিএ এবং ইন্ডিয়া, কোনো জোটেই ছিল না, তারা কেউ একটি আসনও পায় নি। এই তালিকায় আছে তামিলনাড়ুতে এআইএডিএমকে, ওড়িশায় বিজু জনতা দল, তেলেঙ্গানায় কে চন্দ্রশেখর রাওয়ের ভারত রাষ্ট্র সমিতি, উত্তরপ্রদেশে মায়াবতীর বহুজন সমাজ পার্টি, হরিয়ানায় দুষ্যন্ত চৌটালার দল। ফলে তৃতীয় পরিসরের জায়গা এবারের ভোটে ছিল না।
অতঃপর পশ্চিমবঙ্গে সিপিআইএমের কী করণীয়? সিপিআইএমএল, লিবারেশনের সম্পাদক দীপংকর ভট্টাচার্যর সাক্ষাৎকার বিভিন্ন নিউজ পোর্টালে পাওয়া যাচ্ছে। দীপংকরবাবুর বক্তব্য হল, তৃণমূল ও বিজেপিকে সমার্থক করে বিজেমূল তত্ত্ব মানুষ নেয় নি। সিপিআইএমকে বিজেপিকে প্রধান শত্রু ঠাউরে তার বিরুদ্ধে আক্রমণের সিংহভাগ চালিত করতে হবে। এখন পর্যন্ত এর বাইরে আর কোনো নিদান শুনতে পাই নি। কথাটা হল দীপংকরবাবুর কথাটা ঠিক না ভুল?
যে কোনো ন্যূনতম রাজনৈতিক বোধ সম্পন্ন মানুষই বুঝতে পারবেন কথাটিতে ভুল কিছু নেই। একটি আঞ্চলিক দল, তা যতই দুর্নীতিগ্রস্ত হোক বা যতই স্বৈরতন্ত্রী -- একেবারে দেশের সামাজিক সংহতি এবং সাংবিধানিক মূল্যবোধকে বিনষ্ট করতে বদ্ধপরিকর একটি ফ্যাসিস্টপ্রতিম দলের বিপদ অনেক বেশি – দেশের সাধারণ মানুষ, সংখ্যালঘু, শ্রমিক, কৃষক এবং ধর্মনিরপেক্ষ শক্তির কাছে। সিপিআইএমের সর্বোচ্চ নেতৃত্ব সেটা বোঝেন। কিন্তু নিচের দিকে সবাই কতটা বোঝেন সন্দেহ আছে। আমি জেলাস্তরের নেতাকেও বলতে শুনেছি – তৃণমূলকে পরাস্ত না করলে বিজেপিকে হারানো যাবে না। তার আগে তিনি ঘন্টাখানেক ধরে বিজেপির বিপদ নিয়ে বুঝিয়েছেন, বোঝান নি যে এমন নয়। কিন্তু তারপরই তার এই বিভ্রান্তিকর সিদ্ধান্ত । রণকৌশলের দিক থেকেও তা ভুল। কারণ এই ভোট প্রমাণ করেছে আরেকবার, সিপিআইএমের হিন্দু ভোট কেটে বিজেপিতে যা গেছে তা না ফেরা পর্যন্ত সিপিআইএম শক্তিশালী হবে না। এই ভোটের যে অংশ সাম্প্রদায়িক কারণে বিজেপির মতাদর্শের ভক্ত হয়ে গেছে তা আর ফিরবে না কারণ বিজেপির ভাববলয়ে মুসলিম বিরোধিতা যতটা থাকে, বামপন্থার বিরোধিতা তার চেয়ে কম কিছু থাকে না। কিন্তু বাকি আরো হাজার একটা কারণে, তৃণমূলের বিরোধিতার কারণে শক্ত প্রতিপক্ষের খোঁজে যে ভোট বিজেপিতে গেছে, সেই ভোট ফিরতে পারে যদি ভোটারদের বিশ্বাস করানো যায় যে এই রাজ্যে বিজেপি কোনোদিনই ক্ষমতায় আসবে না, বিশেষত ২০২১ এবং ২০২৪ সালের ভোট সেই তত্ত্বেই সীলমোহর দিয়েছে।
তাহলে দীপংকরবাবুর নিদান মত বিজেপি বিরোধিতা বাড়িয়ে গেলে, বিজেপি এবং তৃণমূলের বিরোধিতার অনুপাত ৬০:৪০ বা ৮০:২০ করলেই সিপিআইএমের নির্বাচনী সাফল্য আসবে? আদৌ নয়। ভোটের পাটিগণিত অন্য কথা বলে। বামপন্থীরা বিজেপির যত সমালোচনাই করুন না কেন যতদিন কেন্দ্রে বিজেপি আছে এবং সংখ্যালঘুদের সন্ত্রস্ত রাখার আয়োজন আছে ততদিন এই রাজ্যের সংখ্যালঘুরা তৃণমূল কংগ্রেসকেই আঁকড়ে ধরবেন সাম্প্রদায়িকতার প্রশ্নে নিরাপত্তার জন্য। হয়ত, এই সময় বামফ্রন্ট সরকার ক্ষমতায় থাকলে তাঁরা বামফ্রন্টকেই ভোট দিতেন একই কারণে। এটা কোনো দোষের ব্যাপার নয়, এটা রাজনৈতিক কাণ্ডজ্ঞানেরই পরিচায়ক। তাই বামপন্থীদের এই রাজ্যে সাফল্য পেতে গেলে আগে কেন্দ্রে বিজেপি সরকারের পতনের জন্য সচেষ্ট হতে হবে। তার জন্য ধৈর্য ধরে অপেক্ষা করতে হবে। তাই বলে সঙ্গত কারণে রাজ্য সরকারের বিরোধিতার পরিসরটি ছাড়লে চলবে না। তাহলে সেটি বিজেপির হাতে চলে যাবে। অর্থাৎ সিপিআইএম তথা বাম দলকে আগে নিজের সমর্থকদের যে ভোট চলে গেছে বিজেপির দিকে তা ফেরাতে হবে। তারজন্য তৃণমূল সরকারের বিরোধিতার পথ থেকে সরে আসার দরকার নেই। শুধু, সেই ভোটারদের কাছে পূর্বোক্ত নেতার ফরমুলাটাকে উলটো করে হাজির করতে হবে – এই রাজ্যে তৃণমূলকে হঠাতে হলে কেন্দ্রে বিজেপিকে হটাতে হবে। অর্থাৎ বামপন্থীদের প্রাথমিক দায়িত্ব কেন্দ্র থেকে বিজেপিকে হটানো।
কিন্তু এতেই কি চিঁড়ে ভিজবে? একটা বামপন্থী দলের কাজ কি হতে পারে শুধু ফ্যাসিবাদের বিরোধিতা করা (যদিও আপাতত সেটাই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কাজ )। সেটা করার জন্য তো বামপন্থী হওয়ারও দরকার পড়ে না, লিবারাল বুর্জোয়া হওয়াই যথেষ্ট। বস্তুত, ভারতের জাতীয় কংগ্রেস দলের মধ্যে গান্ধীবাদী বা নেহেরুবাদী ঐতিহ্যের যতটুকু টিঁকে আছে, সেটাকে আঁকড়ে ধরেই তাই কংগ্রেসের নেতৃত্বে সর্বভারতীয় স্তরে লড়াইটা চলছে।
সিপিআইএম কি বামপন্থাকে অনুসরণ করে চলেছে আদৌ? এখানে যদিও একটা স্ববিরোধিতা আছে সিপিআইএমের। দেখা গেছে, সর্বভারতীয় ক্ষেত্রে তার যে ঘোষিত নীতি তাতে স্পষ্ট বামপন্থী অভিমুখ থাকে। কিন্তু ভারতের কোনো অঙ্গরাজ্যে শাসনক্ষমতায় দীর্ঘদিন থাকলে সেই অভিমুখ থাকে না। আমাদের রাজ্যে আমরা গত বাম রাজত্বে এই অভিমুখ পরিবর্তন বিশেষভাবে দেখেছিলাম ১৯৯৬ সালে নতুন শিল্প নীতি গ্রহণের পর থেকে। অপারেশন সানশাইন, রাজারহাট, উত্তরবঙ্গে চাঁদমণি হাউজিং এস্টেট --- লক্ষণ পরিষ্কার হচ্ছিল। অবশেষে সিঙ্গুর আর নন্দীগ্রামের পর বাংলার কৃষক সমাজও সিদ্ধান্ত নিল -- এ পার্টি আমাদের আর নয়। শহরের প্রান্তিক মানুষের, গ্রামের কৃষকের এই পারসেপশান ভীষণ গুরুত্বপূর্ণ। তারা যাকে নিজের পার্টি ভাববে সেটাই বামপন্থী পার্টি। নয়ত, নিজেরা ঘোষণা করলেও পার্টি বামপন্থী হয় না। আসলে বাম নেতৃত্ব বুঝে ফেলেছিলেন, যে এই অঙ্গরাজ্যে ক্ষমতা দখল করে যেটুকু রিলিফ দেওয়ার সেটা দেওয়া হয়ে গেছে। এরপর কাঁচা মার্কসবাদীদের মত "সামন্ততন্ত্রের চেয়ে পুঁজিবাদ ভালো — তাহলে নগরায়ন ও ভারী শিল্পের পথে হাঁটা যাক" -- এইরকমই ভেবেছিলেন বোধহয়। তাদের সামনে অনুসরণীয় ছিল দেং জিয়াও পিং এর চীন। একবার সত্তর দশকের গোড়ায় চীনকে অক্ষম অনুকরণ করতে গিয়ে চারুবাবু, সরোজ দত্তরা ডুবেছিলেন। এইবার আরেকবার, যদিও এটা উলটো পথের যাত্রা — চীনকে অনুকরণ করতে গিয়ে বুদ্ধবাবু, নিরুপম সেনরা ডুবলেন। একবার ভাবা যাক, ১৯৯৬ থেকে ২০১১ পর্যন্ত গরীব মানুষদের কোনোভাবে কী বোঝার ছিল যে এখানে একটা বামপন্থী সরকার চলছে? তাদের বোঝারই বা কী দায়? বরং সিঙ্গুর,নন্দীগ্রাম উত্তর পর্বে তারা প্রশাসনিক পঙ্গুত্বই দেখেছে সরকার চালনায়। কাজেই এখন যখন তারা বিভিন্ন সামাজিক প্রকল্পে উপকৃত হচ্ছে (যেটা বুর্জোয়া ব্যবস্থায় সিপিএমের অংশগ্রহণের যুক্তি ছিল) তখন সেটা যারা দিচ্ছে তাকেই নিজেদের প্রতিনিধি ভাবছে। শুধু এই রাজ্যে নয়, বিভিন্ন রাজ্যে। আবার বি জেপি যে ভোটটা পেয়েছে সেখানেও তাদের প্রবর্তিত সামাজিক প্রকল্পগুলির অবদান যে নেই তা নয়।
এবার ভেবে দেখা যাক এই রাজ্যের ভোটে সিপিআইএমের মূল ইস্যু কি ছিল। বিজেপি বিরোধিতার প্রশ্নটি সরিয়ে রাখলে সেটা অবশ্যই রাজ্য সরকারের দুর্নীতি। অবশ্যই ভয়ংকর দুর্নীতি হয়েছে এবং তার বিরুদ্ধে কথা বলতেই হবে। কিন্তু বোঝা গেল এটা মধ্যবিত্তের ইস্যু। শ্রমিক, কৃষকদের ইস্যু কি ছিল আমরা বলতে পারব না। অন্তত সেটা প্রচারে দেখা যায় নি। এমন নয় যে বর্তমানে সিপিআইএমে যারা নিচুতলার সদস্য বা সমর্থক তারা শ্রমিক, কৃষকের কথা ভাবেন না বা নিজেরা মধ্যবিত্ত বলে শুধু মধ্যবিত্ত শ্রেণীরই স্বার্থরক্ষা করতে চান। দীপংকরবাবু সর্বভারতীয় প্রেক্ষিতে সিপিআইএমকে যথাযোগ্য মর্যাদায় বামদল হিসেবে স্বীকৃতি দিচ্ছেন। অমরা রাম রাজস্থানে কৃষক আন্দোলন করেই জিতেছেন। কিন্তু এই রাজ্যে সিপিআইএমের কর্মসূচী ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার অনেক আগেই শ্রেণী দৃষ্টিভঙ্গী থেকে বিচ্যুত হয়েছে।
এটা ঠিক যে দলের শক্তি দুর্বল হলে মধ্যবিত্ত নগরকেন্দ্রিক ইস্যু নিয়ে শহরে আন্দোলন করে প্রাসঙ্গিক থাকা যায়। এই মুহূর্তে সিপিআইএমের বুথভিত্তিক সংগঠন ততটা সবল নয় যে গ্রামে গ্রামে কৃষকের সমস্যা নিয়ে আন্দোলন করা যায়। কিন্তু সবার আগে কর্মসূচীকে শ্রেণীরাজনীতির ভিত্তিতে, প্রান্তিক মানুষের স্বার্থে পুনর্নিমাণ করা দরকার। বামপন্থী দলকে আমরা ‘Party with a difference’ বলি সদস্যদের বা নেতাদের সততার জন্য শুধু নয় (সততা তো অবশ্যই থাকতে হবে), বলি তার শ্রেণী দৃষ্টিভঙ্গীর জন্য। তাই আন্দোলন শহরে আপাতত কেন্দ্রীভূত হলেও ক্ষতি নেই, যদি সঠিক ইস্যু নির্বাচন করা যায় তার অনুরণন গ্রামেও উঠবে। দিল্লীর কৃষক আন্দোলন আমাদের সেটা দেখিয়েছে। তাই অগ্রাধিকার হোক শ্রেণী রাজনীতি। তখন কোনটা কেন্দ্রীয় সরকারের বিরুদ্ধে আর কোনটা রাজ্য সরকারের — আনুপাতিক সেই হিসেব কষার দরকার পড়বে না।
পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।