(১) বন্দে মাতরম্
সুজলাং সুফলাং
মলয়জশীতলাং
শস্যশ্যামলাং
মাতরম্৷৷
শুভ্র-জ্যোৎস্না-পুলকিত-যামিনীম্
ফুল্লকুসুমিত-দ্রুমদলশোভিনীম্
সুহাসিনীং সুমধুরভাষিণীম্
সুখদাং বরদাং মাতরম্৷৷
(২)
আনন্দমঠ উপন্যাসে একটা ফুটনোটে শ্রী বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় লিখে দিয়েছিলেন 'মল্লার- কাওয়ালি তাল'। এটা নিশ্চয়ই বন্দেমাতরম গাইবার নির্দেশনা দিয়েছিলেন তিনি। পরে রবীন্দ্রনাথ যখন কংগ্রেসের সম্মেলনে এই গানটি গেয়েছিলেন তখন কি তিনি মল্লার রাগেই গেয়েছিলেন? প্রথমবার কে সুর করেছিল গানটি? কিরকম ছিল সেই সুর? রবীন্দ্রনাথ প্রথম গেয়েছিলেন বটে, কিন্তু আরও কয়েকবার এই গান কংগ্রেসের জাতীয় অধিবেশনে গাওয়া হয়েছিল। সেগুলি কি সব একই সুরে গাওয়া ছিল?
এইগুলি জানার কৌতূহল আমার সেই ছোটবেলা থেকেই। মুক্তধারা বঙ্কিমচন্দ্রের বইগুলি প্রকাশ করেছিল, উপন্যাসগুলি আর কমলাকান্তের দপ্তর আমি একসাথে কিনেছিলাম আজিজিয়া বুক ডিপো থেকে। প্রথম পড়েছিলাম দেবী চৌধুরানী, এরপর দুর্গেশনন্দিনী। এরপরের ধারাবাহিক ক্রম মনে নাই। আনন্দমঠ প্রথমবার পড়ার সময় গানটা খুব মনোযোগ দিয়ে পড়িনি। ছোট ছিলাম, খটোমটো লাগছিল, অর্থ বুঝতে পারছিলাম না। কিছুদিন পরেই আনন্দমঠের দ্বিতীয় পাঠের সময় গানটা পড়তে পড়তে গাঁ ঝমঝম করে উঠেছিল।
আমার স্পষ্ট মনে আছে, গানের প্রথম অনুচ্ছেদটা শুনে মহেন্দ্র বিস্মিত হয়ে জিজ্ঞাসা করে, মা! কে এই মা! দ্বিতীয় অংশটা শুনে মহেন্দ্র আরও চমকে ওঠে, 'ওরে, এ তো দেশ, এতো মা নয়'। এইখানে থেমে আমি গানটা বারবার পড়েছি- পুরো গানটা। এবং সারা শরীরে সেই বিদ্যুৎ ঝলক আমি এখনো মনে করতে পারি। হ্যাঁ, তাই তো এতো মা এবং দেশ! এবং বাংলাদেশ! এতো আমার বাংলাদেশ। বাংলাদেশ।
(৩)
আমার অন্তরে একটা উগ্র জাতীয়তাবাদী প্রবণতা আছে। আগে অনেক প্রবল ছিল- একদম মেরে ফেলবো কেটে ফেলবো, কেঁদে কেটে ভাসিয়ে ফলব ধরণের উগ্র। অনুমান করি সেই উগ্র জাতীয়তাবাদী বীজটা আমার অন্তরে প্রোথিত হয়েছিল আরও ছোটবেলায়, বুদ্ধি হওয়ারও আগে, একদম যুদ্ধের সময়- যখন আমি নিতান্ত শিশু সেইসময়। আর সেই সুপ্ত বীজে জল হাওয়া রোড জুগিয়েছে আর সেটার ভাষা দিয়েছেন বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়- বিশেষভাবে এই গানটা।
আমি এই গানটার যেসব সুর করা হয়েছিল শুরু থেকে সেগুলি জানতে খুবই আগ্রহী। না, অন্তরে সেই উগ্র জাতীয়তাবাদী প্রবণতা আর নাই- সেই নেতিবাচক ব্যাপারটা থেকে আমি অনেকখানি মুক্ত। সেই মুক্তিটা ঘটেছে বুদ্ধি দিয়ে, পড়াশুনা দিয়ে, রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড ও শিক্ষা আলাপ আলোচনা এইসবের ভিতর দিয়ে। কিন্তু আবেগের ব্যাপারটা কিনা একটু ইয়ে, চট করে দুর হয় না। কি করে যাবে? প্রেমের মধ্যে কিনা সবচেয়ে ঝাঁঝালো প্রেম হচ্ছে দেশপ্রেম নামক জাতীয়তাবাদী ধারণাটি।
বন্দেমাতরম গানটি ওরা নাকি ভারতের জাতীয় সঙ্গীত করবে ভেবেছিল। করেনি, কিন্তু এর একটা অংশ ওরা স্তোত্র হিসাবে পাঠ করে। এটার আবার নানাপ্রকার 'আধুনিক' সুরও হয়েছে। এ আর রহমান একটা সংস্করণ করেছে সেটা আবার তুমুল জনপ্রিয়। এইটা আমার ভাল লাগেনা। আমাদের বাঙলার গান, ওরা কিসব করে!
(৪)
কিছু না। এমনিই মনে পড়লো- সুজলাং সুফলাং মলয়জশীতলাং শস্যশ্যামলাং মাতরম্৷ এবার আমাদের বাম্পার বোরো ফলন হয়েছে।
লিখেছেন ইমতিয়াজ মাহমুদ।
সবার দৃষ্টিভঙ্গিই থাকুক।