উপন্যাসদুটির কথা মাথায় উঠে এল মানবেন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়কে নিয়ে এখানে প্রকাশিত সংকলনের লেখাগুলি পড়ে; লক্ষ্য করে দেখলাম অনুবাদক, শিক্ষক বা কবি হিসেবে মানববাবুর পরিচিতি ঘটালেও, ওনারই যুবা বয়সের লেখা এই দুটি ঊপন্যাস - চন্দ্রাহত ও পুনরুত্থান - সংকলনের লেখাদুটিতে অনুল্লেখিত। অনুমান করি হয়ত এই লেখাদুটি প্রায় অপঠিত বা অল্পপঠিত অথবা মানবেন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়ের যা লেখক পরিচিতি - প্রধানতঃ অনুবাদক হিসেবে হলেও তির্যক ও মিতকায় কবিতাগুলিও আলোচিত হয়েছে কখনও - তার সাথে এই লেখাদুটির হয়ত সখ্যতা খুঁজে পাওয়া যায় না। বইদুটির ব্লার্ব থেকে জানি দুটি লেখাই প্রকাশিত হয়েছিল ১৯৬১ সালে কোন ছোট পত্রিকায়, তার পরে হয়ত প্রকাশিত হয়নি, প্রায় চল্লিশ বছর পরে বই আকারে প্রকাশিত হয় ১৯৯৯ সালে, দেজ পাব্লিকেশনস থেকে। চল্লিশ বছরের ব্যবধানে লেখক জীবনের প্রথম দিকের এই স্বাক্ষরদুটি প্রকাশের মধ্যে দিয়ে এইটি অন্তত বোঝা যায় উপন্যাসদুটি লেখকের কাছে দীর্ঘ সময়ের ব্যবধানেও অপ্রয়োজনীয় হয়ে যায়নি।
পুনরুত্থান উপন্যাসটি নয়টি পরিচ্ছেদে শ'খানেক পাতায় শেষ হয়েছে। বিশ্লেষণ করতে গেলে হয়ত উপন্যাসটির অর্থ শব্দর ফাঁক দিয়ে গলে যেতে পারে কিন্তু এরকম বলা যায় যে উপন্যাসটি কুবের সেন নামে প্রধাণ চরিত্রটির আত্মপরিচয় খোঁজার কাহিনি। যদিও চরিত্রটি নিজেকে কুবের সেন নামে নিজেকে পরিচয় দেয় - পরিচয়ও ঠিক নয়, তাকে ঐ নামে ডাকা হলে সে সাড়া দেয় বলেই সে মনে করে ঐটি তার নাম আর এও মনে করে যে নাম তো বড়জোর একটি ছাপ বা লেবেল বা চিহ্ন, সুবিধের জন্য যা তৈরী হয়েছে - সেই কুবের সেনের বাবা তার জন্মের আগেই মৃত, মা তার জন্মের পরেই এবং সে অনাথ্ আশ্রমে মানুষ, অনাত আশ্রমে যখন আনা হয়েছিল তখন তার গলায় ছিল একটি সোনার হার যাতে লাগানো ছিল একটি পাঁচ কোণা তারার আকার বিশিষ্ট একটি লকেট, সেই কুবের সেন একদিন বাড়ী থেকে বেরিয়ে একটি কবরখানার পাশে তিনতলা পলেস্তারা খসা একটি ফ্ল্যাটের সামনে উপস্থিত হয়, হলকা ওঠা আর হাওয়া তেতে ওঠা প্রবল গরমের দিন সেদিন, বাড়ীটি তার অচেনা হলেও, সেদিকে না কোনদিন না এলেও, নিজের ভেতরে যেন বাড়ীটিকে তার চেনা মনে হয়, সেই বাড়ীর তিনতলা থেকে কেউ যেন তাকে হাত বাড়িয়ে ডাকে, যার হাতে আলোর মধ্যেও সে দেখতে পায় একটি ঝকঝক করে ওঠা আংটি। ক্রমশঃ সে জানতে পারে যে সেই তিনতলায় কেউই থাকে না তখন, কারণ সেদিনই ঐ তিনতলার বাসিন্দা এক বৃদ্ধ মহিলা গলায় দড়ি দিয়ে আত্মহত্যা করেছেন (যিনি সুখীই ছিলেন, তার ছেলেরাও প্রতিষ্ঠিত, জীবনের সুসময় এখন, অতএব আত্মহত্যা করার এইটি প্রকৃষ্ট সময়, চিঠিতে এইরকমই লিখে যান বৃদ্ধা মাহিলাটি আত্মহত্যার আগে) এবং তাঁর পরিবারের সদস্যরা লাশকাটা ঘরে গেছে, অতএব কারোর ডাকার সম্ভাবনা নেই কুবেরকে তিনতলা থেকে, তবুও ঐ বাড়ীরই বাসিন্দা নীলা বলে একটি মেয়ের সাথে কুবের একতলা ও দোতলার অন্য বাসিন্দাদের সাথে পরিচয় করে এইটা জানার জন্য যে ঐ দিন, ঐ সময়ে তাদের মধ্যে কেউ তিনতলায় গিয়েছিল কিনা। সেরকম যে হয়নি সেটা কুবের সেন ঐসকল বাসিন্দাদের সাথে কথা বলতে গিয়ে জানতে পারে আর সেইসকল দৃশ্য আর চরিত্রদের মধ্যে দিয়ে আত্মপরিচয়ের থীমটি যেন উপন্যাসটিতে প্রসারিত হয়। উপন্যাসটির শেষের আগের পরিচ্ছেদে দেখা যায় যে কুবের সেন পাশের কবরখানার মধ্যে চলে যায়, সেখানে দেখতে পায় দুটি লোককে যাদের পেশা হল কবর থেকে মৃতদেহ তুলে বাইরে সরবরাহ করা, দেখতে পায় বৃদ্ধ ভদ্রলোকটিকে যার সাথে বাড়ীটিতেই তার আলাপ ও কথা হয়েছিল, বৃদ্ধটির পেশা কবরের ওপর নাম উৎকীর্ণ করা এবং প্রায় সুররিয়াল ও সিনেম্যাটিক এই পরিচ্ছেদটিতে কুবের সেন একটি কবরের ডালা খুলে তার ভেতরে শুয়ে পড়তে থাকে, সেই কাজটি করার আগে সে দেখে যে বৃদ্ধ লোকটি একটি পাথরে লিখে ফেলেছেন কথাকটি 'এখানে ঘুমায় এক মানবহৃদয় যার জলে লেখা নাম', ডালা বন্ধ করে দেওয়ার আগের মুহুর্তে নীলার উপস্থিতি ঘটে সেখানে এবং নীলা তাকে আবার বাড়ীর ভেতরে নিয়ে যায়। উপন্যাসটির শেষ পরিচ্ছেদে তিনতলা থেকে ভেসে আসা এক সুরের টানে কুবের তিনতলায় যায়, একটি ঘরের ভেতর থেকে আলো আসতে থাকলে সে ঘরের ভেতরে ঢোকে, সেখানে একটি টেবিল, টেবিলের ওপারে একটি মানুষ, আলোর জন্য যার মুখ দেখা যায় না, শুধু দেখা যায় তার হাতের আঙুলে বড় একটি আংটি, তাকে তো এখানে ডাকা হয়েছে কুবের এরকম বললে লোকটি সেটি সম্পূর্ণ অস্বীকার করে এবং কবরখানার মৃতদেহ পাচারকারী দু'জনের মধ্যে একজনকে ডাকলে, সে ডেকে আনা লোকটি কুবেরকে শরীরসুদ্ধ তুলে ধরে ঘর থেকে সিঁড়িতে ছুড়ে ফেলে দেয় ! উপন্যাসটি শেষ হয় যখন ঐ সিঁড়িতেই নীলার কোলে কুবেরের ফেটে যাওয়া মাথা, তিনতলায় তো কেউ থাকে না তাও কেন কুবের সেখানে গেছিল এই প্রশ্নের উত্তরে কুবের বলে যে "ওরাই সবাইকে ডাক দেয়, কখনও অনেক কথা বলে আমন্ত্রণ জানায় - আর শেষকালে বাতিল জিনিসের মত ছুঁড়ে ফেলে দেয়" অথচ কুবের এও বুঝতে পারে যে ঐ লোকটির আঙুলে যে আংটিটি আছে সে তো তার হারের লকেটের মতই !
হয়ত উপন্যাসটিতে খুঁজে পাওয়া যাবে কাফকার লেখার হাড়গোড়, বিশেষ করে 'দ্য ক্যসল' উপন্যাসটির কথা মাথায় আসতে পারে, যেখানে ল্যান্ড সার্ভেয়র জোসেফ কে ঐ ক্যাসলে উপস্থিত হলেও প্রাণান্তকর চেষ্টা চালিয়ে যায় দুর্গটিতে ঢোকার অনুমতি পাওয়ার জন্য, ঐ উপন্যাসটিতে অতীতহীন জোসেফ কে আর এই উপন্যাসটিতে কুবের সেনের সমস্যা হয়ত কাছাকাছিই, নিজের পরিচয় খুঁজে পাওয়া। এও লক্ষ্য করি যে পুনরুত্থান উপন্যাসটি বই হয়ে প্রকাশের সময়ে উৎসর্গ করা হয়েছে ভূমেন্দ্র গুহকে এবং উৎসর্গপত্রটিতে ব্যবহার করা হয়েছে তাজেউশ রুজেভিচ নামে এক পোলিশ কবির কবিতার অংশ যেখানে বলা হয়েছে যে একটি লেখা হয়ে যাওয়ার পরে তার ভিত বা বনিয়াদ সরিয়ে নিতে যে ভিত বা বনিয়াদের ওপরে লেখাটি দাঁড়ায় কারণ ঐদুটি বস্তু লেখাটিকে আঁটকে রাখে কিন্তু সরিয়ে নিলে লেখাটির আস্ত গড়ন উঠে দাঁড়াবে আর উড়াল দেবে বাস্তবতার ওপরে আর পরিণামে সেই বাস্তবতার সাথেই তার ধাক্কা লাগবে ! দীর্ঘদিন পরেও লেখাটি বই আকারে প্রকাশ করলেও মানবেন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়ের যেন স্থির ধারণা ছিল লেখাটির অভিমুখ সম্বন্ধে, দৈনন্দিনের বাস্তবের থেকে দূরে থাকা এই লেখাটি - যদিও একটি লেখাকে বাস্তব হয়ে উঠতে বা কংক্রীট হয়ে উঠতে যা দরকার সেসব লেখাটিতে আছে, যথা দৃশ্য বা সংলাপ - অর্থের দিক দিয়ে যেন একটি অনির্ণীত ও রহস্যময় অবস্থানে থাকে কিন্তু দৈনন্দিনের সাথেই যেন তার সুড়ঙ্গলালিত এক সম্পর্ক থাকে (যেমন ঐ বাড়ীটির এক বাসিন্দা, অমলদা নামে চরিত্রটি বলেছিল, এরকম তো আজকাল কতই হচ্ছে যে একজন কেউ ভাবছে সে দোতলা থেকে তিনতলায় যাবে কিন্তু যেতে গিয়ে দেখছে যে যাওয়ার সিঁড়িটিই নেই), নিজের পরিচয় খোঁজার থীমটিও পরিণতি পেতে পারে বাস্তবতার সাথে সম্পর্কে এসেই। কিন্তু উপন্যাসটির নামের মধ্যে একটি আয়রনি আছে, পুনরুত্থান তো মৃত অবস্থা থেকে পুনর্জাগরণ, অন্ধকার থেকে উঠে আসা, লেখাটির প্রথম দিকে কুবের ভেবেওছিল যে এক অন্ধকার তাকে সব সময়ে ঘিরে আছে, হয়ত সেই অন্ধকার তার জন্ম ইতিহাসের সাথে যুক্ত, কিন্তু শেষ পর্যন্ত তো সেই ইতিহাসের বা বাড়ীটির তিনতলা থেকে ডাক পাওয়ার রহস্যের নিরসন হয়না, কোন সম্ভাষণই তার কানে এসে পৌঁছল না এরকম এক সুসুপ্তির মধ্যে সে চলে গেল অথবা হয়ত মরেই গেল সে, জীবনের ঘিরে থাকা অন্ধকার থেকে মৃতের জগতে তাকে চলে যেতে হল, পুনর্জাগরণের আশা থাকলেও সেই আশা পরিণতি পায়না, পুনরুত্থানের পথটা, নিজেকে খোঁজার পথটা কেমন হতে পারে এবং শেষে সেই পথ আনন্দময় বা আশাময় পরিণতিতে পৌছবে না কিন্তু পুনরুত্থানের চেষ্টাটা থাকবে হঠাৎ করেই যেন ওপর থেকে সংকেত এসে গেলে, মানুষের জীবনটা যে এরকম হয়ে ওঠে, সেসবের বাস্তবিক বিবরণ যেন রয়ে গেছে উপন্যাসটিতে এবং ফলতঃ উপন্যাসটির নামের অনির্দিষ্টতাও।