এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • খেরোর খাতা

  • আজ নববর্ষের আখ্যান

    Somnath mukhopadhyay লেখকের গ্রাহক হোন
    ১৩ এপ্রিল ২০২৪ | ৭৬৪ বার পঠিত | রেটিং ৪ (২ জন)
  • খেরোর খাতায় প্রকাশিত এই নিবন্ধ আর ইদবোশেখি সংখ্যার সুরটি এক - এই সুর ঐতিহ্য ও বহুত্বের উদযাপনের সুর। একটি গুরুত্বপূর্ণ সংযোজন হবে - এই বিবেচনায় নিবন্ধটি ইদবোশেখিতে জুড়ে নেওয়া হলো।
    ছবি: রমিত চট্টোপাধ্যায়

    আজি নব বরষের শুভদিনে 

        

    নব বরষে, নব হরষে, জাগিয়া উঠুক প্রাণ - এই আত্যন্তিক যাচনা নিয়েই নতুন বছরকে আহ্বান করে নেওয়া। চৈত্র শুক্লা প্রতিপদ তিথি থেকেই ভারতের নানান প্রান্তের মানুষ নতুন বছরকে সাদর আমন্ত্রণ জানানো শুরু করেছে। গ্রেগরিয়ান ক্যালেন্ডারের দাপটে একালে দেশীয় দিনপঞ্জিকাগুলো একরকম কোণঠাসা। তবুও এই একটা দিন নববর্ষ বরণের অজুহাতে ফেলে আসা সাবেকিয়ানাকে মান্যতা দেওয়া প্রায় হারিয়ে যেতে বসা সামাজিক সাংস্কৃতিক যাপনকে আঁকড়ে ধরার চেষ্টা করা।

    সুবিশাল ভারতবর্ষের নানান প্রান্তের মানুষ কীভাবে তাঁদের নতুন বছরকে বরণ করে নেয় সেকথা জানতে আমাদের আগ্রহ থাকাটা খুব স্বাভাবিক। ভৌগোলিক দূরত্বের সঙ্গে সঙ্গে মানুষের আচার অনুষ্ঠানের নিয়ম রীতিতে বিস্তর পার্থক্য ঘটে । এ দেশের ক্ষেত্রেও যে তেমনই ঘটেছে তা টের পেলাম ভিন্ন ভিন্ন প্রদেশের নববর্ষ উদযাপনের রীতি নিয়মের কথা পড়তে গিয়ে। নিমগ্ন পাঠের অবকাশে বারবার মনে হয়েছে যে এমন‌ই সব প্রাণবান উৎসবের আঙিনায় যত বেশি করে সকলে যোগদান করবো ,তত আমাদের মধ্যে বিভেদ, বিচ্ছিন্নতার ব্যবধান ঘুচে যাবে। মানুষ হিসেবে আমরা পরস্পর আর‌ও আরও কাছে আসতে পারবো‌। আরশি নগরের পড়শির খোঁজ খবর না নিয়ে, গলা বাড়িয়ে বিশ্বমানব বা গ্লোবাল সিটিজেন হতে গেলে সেই ময়ূরপুচ্ছধারী দাঁড়কাকের দশা হবে আমাদের। নববর্ষের শুভেচ্ছা বিনিময়ের মাধ্যমে এক সহমর্মিতার বাতাবরণ গড়ে উঠুক আমাদের মধ্যে এমন ইচ্ছে নিয়েই এই নিবন্ধ রচনা।
                     
    এই নিবন্ধটিতে বাঙালির নববর্ষ তথা পয়লা বোশেখের কথা নিয়ে আলাদা করে কিছু বলার চেষ্টা করিনি, কেননা বাঙালির নববর্ষ উদযাপন সংস্কৃতির সঙ্গে সুধী পাঠকমন্ডলী সম্যক পরিচিত। বরং এই নিবন্ধটি পড়তে পড়তে অন্যদের উৎসবের রঙ রস রূপ গন্ধকে নিজেদের মধ্যে মিলিয়ে মিশিয়ে একাকার করে নিতে পারলে হয়তো ভারতীয় হিসেবে এক আশ্চর্য পরিচিতি লাভ করবো আমরা। আর তাই হবে নববর্ষের সবথেকে সেরা উপহার। নববর্ষের এই আয়োজন কেমন লাগলো তা কিবোর্ডে আঙ্গুল চালিয়ে প্রাণভরে লেখার অনুরোধ রইলো। অয়মারম্ভ শুভায় ভবতু।
          


    এই নিবন্ধের একেবারে শুরুতেই স্কুল বেলার এক শ্রদ্ধেয় মানুষের কথা বলবো আপনাদের। মানুষটি আমাদের ক্লাসে আসতেন অবরে সবরে। ক্লাসে ঢুকতেন টকটকে লাল কাগজে মলাট দেওয়া একটা ডাইরি হাতে। আমাদের শব্দভাণ্ডার কতটা শক্তপোক্ত তা যাচাই করাই ছিল তাঁর প্রধান উদ্দেশ্য। খুব গুরুগম্ভীর বিষয়ী আলোচনা ছেড়ে হালকা মেজাজে সময় কেটে যেত বলে আমরাও ঐ শব্দার্থ খোঁজার খেলায় মেতে উঠতাম।

    আজ আমি সেই খেলাটাই আপনাদের সঙ্গে খেলবো বলে মনে মনে ভেবে রেখেছি। কি রাজি তো? আমি কতগুলো শব্দ বলবো । আপনাদের বলতে হবে এদের মধ্যে মিল কোথায়? সবাই রেডি? তাহলে শুরু করি ? আচ্ছা বলুন তো পুথান্ডু , গুডি পাডোয়া , ভিশু , ইউগাডী, নভরেহ্ এগুলো কিসের নাম? আর এদের মধ্যে মিল কোথায়?
    বলুন - এ…এক….দুইইই …তি ইইই ..ন ..।

    বেশ আমিই বরং বলে দিই। এটাতো খেলা, এখানে হারজিতের কোনো প্রশ্নই নেই। যে শব্দগুলো আমি বললাম সেগুলো হচ্ছে ভারতের নানা প্রান্তের নববর্ষ উৎসবের নাম। ভারতের মতো এক সুবিশাল দেশে উৎসবের তো শেষ নেই , সারা বছর জুড়েই কোথাও না কোথাও উৎসবের নাকাড়া বেজেই চলেছে, তবে এইসব উৎসবের মধ্যে নতুন বছর শুরুর উৎসবের আনন্দ‌ই আলাদা। সারা বছরের নানান পাওয়া না পাওয়ার দ্বন্দ্ব দূরে সরিয়ে আবার নতুন আশায় বুক বাঁধার দিন হলো এই নববর্ষ উদযাপন উৎসব।  



    নতুনভাবে সবকিছুকে গড়ে তুলতে হবে এই ভাবনাটাই সকলকে মনে মনে বেশ চাগিয়ে রাখে। তৈরি হয় নতুন উন্মাদনা, জোশ। এই বিশেষ দিনটিকে ঘিরে রয়েছে নানান সংস্কার, লোকাচার, ধর্মীয় অনুষ্ঠান। ভারতের বিভিন্ন প্রান্তে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা মানুষজন কীভাবে দেশীয় ক্যালেন্ডারের প্রথম দিনটিকে পালন করে তা জানার মধ্য দিয়ে এক একাত্মতা, বিশ্বাস  ও নির্ভরতার সম্পর্ক গড়ে ওঠে। আসুন এবার তা জেনে নিই এক এক করে।

        

    উৎসবের আয়োজন শুরু করি একেবারে উত্তরে থাকা কাশ্মীর থেকে। সাবেক কাশ্মীরের হিন্দু পণ্ডিত সম্প্রদায়ের মানুষেরা ভারতীয় ক্যালেন্ডারের প্রথম দিনটিকে পালন করে নভরেহ্ উৎসবের মধ্য দিয়ে। কাশ্মীরী হিন্দু সম্প্রদায়ের নববর্ষ উৎসবের দিনটিকে পালন করা হয় কিংবদন্তি দেবী শারিকা মাতাকে শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করার মধ্য দিয়ে। কাশ্মীরী পণ্ডিতদের বিশ্বাস , একদা শ্রীনগরের হরি পর্বতের শিখরপ্রদেশে সূর্যদেবের প্রথম আলোকপাতের ঘটনাকে স্বাগত জানাতে জড়ো হয়েছিলেন সাত পৌরাণিক ঋষি – অত্রি, গৌতম,জমদগ্নি, বশিষ্ঠ,কশ্যপ, বিশ্বামিত্র এবং ভরদ্বাজ। এই সাত ঋষির শুভাগমনের দিনটিকে মাথায় রেখেই দেবীমায়ের কাছে নতুনভাবে সবকিছুকে উপস্থাপন করা হয় নভরেহ্ উৎসবে। নির্দিষ্ট শুভ দিনটি যত‌ই এগিয়ে আসে তত‌ই বাড়তে থাকে প্রস্তুতির উন্মাদনা। এই দিনটিতে একটি বড়ো থালায় ভক্তিভরে সাজিয়ে রাখা কতগুলো উপকরণকে শয্যা ত্যাগের পর একে একে প্রথম দেখেন পরিবারের সদস্যরা । তাঁরা বিশ্বাস করেন শুভ ফলদায়ক জিনিসগুলো দিনের শুরুতেই দর্শন করলে বছরের বাকি দিনগুলোতেও শুভ ফললাভ হয়। কী থাকে এই থালায়? 

       

    থালায় রাখা হয় একটি পঞ্জিকা, দেবী শারিকা মাতার একটি ছবি, নতুন চাল ভর্তি একটি পাত্র, কিছু টাটকা এবং শুকনো ফুল, দুধ, দ‌ই, দুব্বো ঘাস, আখরোট,ভাত, লবণ,রুটি,মধু আর আয়নার মতো প্রতিদিনের ব্যবহার্য নানান উপকরণ। আগামী দিনে যাতে এমন‌ই সব জিনিসের জোগানে টান না পড়ে সেই প্রার্থনাই করা হয় দেবীর কাছে। থালায় আরও রাখা হয় একটি মুদ্রা, লেখার জন্য কাগজ,কলম, দোয়াত। এই থালাতেই রাখা হয় কিছু তেতো ভেষজ। আসলে বছরের সব দিনগুলোই আনন্দে কাটেনা, 
    কিছু দুঃখ, কিছু তিক্ততাকে মেনে নিতে হয় ‌। তাই থালাতে তাকেও রাখা হয় ‌। আসলে সবটাই প্রতীকী, সবটাই গভীর ব্যঞ্জনাময়। এই থালা দেখার পর চলে সকলের সঙ্গে কুশল বিনিময়, আত্মীয়স্বজন, বন্ধুবান্ধবদের বাড়িতে যাওয়া, এক‌ই সঙ্গে থাকে ভুঁড়িভোজের আয়োজন।



    এবার আমরা জেনে নিই দক্ষিণী রাজ্যগুলোয় কীভাবে নববর্ষ উদযাপন করা হয়। দক্ষিণের চারটি প্রধান রাজ্য অন্ধ্রপ্রদেশ, তেলেঙ্গানা, তামিলনাড়ু এবং কর্ণাটক রাজ্যে নববর্ষ উদযাপন করা হয় উগাদী বা যুগাদী নামে। তেলেগু দিনপঞ্জিকা অনুসারে এই দিনটিকে নির্দিষ্ট করা হয়। খুব সকালে ঘুম থেকে উঠে সবাই ভালো করে তেল ও বিশেষ কিছু উপাচার শরীরে মেখে স্নান সেরে নেয়। পরা হয় এই উপলক্ষে কেনা নতুন জামাকাপড়। বাড়িগুলো ফুল আর আমের পল্লব দিয়ে সুন্দর করে সাজানো হয়। উঠোনে দেওয়া হয় বিশেষ ধরণের রঙ্গোলি। বাড়ির মহিলারা এই কাজটি করে থাকেন। গৃহ দেবতার বিশেষ পূজা হয় এই দিনে। চলে শুভেচ্ছা বিনিময় ও আশীর্বাদ গ্রহণের পর্ব।


     
    এমন শুভ দিনে বিশেষ কিছু রান্না হবেনা এমনতো নয়। এই দিনের দুটি বিশেষ পদ হলো বেব্বুভেলা ও পাচাদি। প্রথমে আসি বেব্বুভেলার কথায়।প্রায় প্রতিটি বাড়িতেই নিম পাতা, কাঁচা আম, তেঁতুল,গুড়, লবণ আর লঙ্কা সহযোগে এই স্যালাড জাতীয় খাবারটি তৈরি করা হয়। উপকরণগুলোর নাম পড়েই যারা মুখ বেঁকিয়ে হাসলেন তাঁদের বলি, বেব্বুভেলার এই ছয়টি উপাদান আসলে জীবনের ছয়টি বিশেষ অবস্থার প্রতীক। গোটা বছর তথা গোটা জীবনে অনেক অনেক পরীক্ষা দিতে হয় আর নিম হলো তার প্রতিনিধি, দুঃখের পাশাপাশি সুখ‌ও আসে আমাদের প্রতিদিনের জীবনে তাই গুড়কে রাখা হয় সুখ আর অনাগত বিস্ময়ের প্রতীক হিসেবে, জীবনের নানা পর্বের নানান অভিজ্ঞতা জীবনকে বিচিত্র রসে মাখামাখি করে আরও উপভোগ্য করে তোলে তাই দেওয়া হয় লঙ্কা , তেঁতুলের টক হলো জীবনের নতুন চ্যালেঞ্জ , আম হলো অ্যাডভেঞ্চার আর লবণ ছাড়া যে জীবন অচল। এই আশ্চর্য সুন্দর ব্যাখ্যা পড়ে আমি যেমন চমৎকৃত হয়েছিলাম আপনারাও নিশ্চয়ই তেমনই মনে করছেন। আসলে আমাদের পূর্বজরা জীবনকে দেখেছিলেন গভীর অন্তর্দৃষ্টি নিয়ে আর তাই প্রতিটি উপকরণ, প্রতিটি উৎসব এমন সুন্দর, অর্থপূর্ণ হয়ে উঠেছে মানুষের জীবনে‌। তাঁদের ভাবনার গভীরতাকে কুর্ণিশ জানানোর ক্ষেত্রে কোনো দ্বিধা থাকা বোধহয় উচিৎ নয় আমাদের তরফে। অন্য দিকে ছয় রকমের ভিন্ন ভিন্ন উপকরণে তৈরি সম্পূর্ণ আলাদা আলাদা স্বাদের চাটনি হলো পাচাদি। আসুন, পাচাদির ছয় রকমের চাটনির সোয়াদ নিতে নিতে এই পর্বের ইতি টানি। ‌



    দক্ষিণ ছেড়ে আবার উত্তরে যাবার আগে আমাদের আরও দুই রাজ্যের নববর্ষের কথা শুনে নিতে হবে। প্রথমেই চলুন ঈশ্বরের আপন দেশ বলে পরিচিত কেরালায়। এই রাজ্যের নববর্ষ উৎসবের নাম বিষু। সূর্যের বিষুব রেখায় অবস্থান থেকেই এই কথাটির উৎপত্তি। কেরালার মানুষজনের বিশ্বাস বিষুর দিন থেকেই প্রকৃতপক্ষে সূর্যের উত্তরায়ণ পর্বের সূচনা। পৌরাণিক লোকবিশ্বাস অনুযায়ী এই দিনেই ভগবান বিষ্ণুর হাতে নরকাসুর বধ হয়েছিলেন।

    নববর্ষ সুখ, সমৃদ্ধি ও শান্তির বার্তা বয়ে নিয়ে আসে। গাছে গাছে শিউলি ফুল ফুটলে আমরা যেমন শরৎ ঋতুর আগমন টের পাই কেরালার মানুষ‌ও ঠিক তেমনই গাছে গাছে কানিকোন্না ফুল (সোঁদাল) ফুটতে শুরু করলেই বুঝতে পারে নতুন বছরকে স্বাগত জানাবার কাল সমাগত। প্রকৃতি যেন বলে, জীর্ণ পুরাতন ক্লান্তি,যাক্ দূরে যাক্। নতুন বছর সকলের জন্য মঙ্গলদায়ক হোক।



    আগামী বছরে সবাই যেন খুব সুখী জীবন যাপন করে সেই কামনায় শুভ বস্তু বা বিষুক্কানি দেখার পালা শুরু হয় সকাল থেকেই। একটা থালায় সাজিয়ে রাখা হয় ধানের ছড়া, সুমিষ্ট ফল,কানিকোন্না ফুল, সোনা এবং মুদ্রা। প্রথাগত ভাবে বাড়ির সবথেকে প্রবীণা মহিলা সযত্নে বিষুক্কানি সাজিয়ে রাখেন সকলের দর্শনের অপেক্ষায়।



    ভগবান কৃষ্ণের মূর্তির সামনে রাখা হয় বিষুক্কানি, ভক্তিভরে জ্বালিয়ে দেওয়া হয় মঙ্গলদীপ নীলাবিলাক্কু। সকাল থেকেই ঘরে ঘরে, মন্দিরে মন্দিরে মানুষের বিষুকান্নি দেখার ব্যস্ততা চোখে পড়ে।
       
    বিষু উপলক্ষে তৈরি করা হয় বিশেষ ধরণের খাবার বিষু সাধ্য। এই থালিতে থাকে বিষু কাঞ্জি (চাল, নারকেলের দুধ সুস্বাদু মশলা দিয়ে তৈরি) বিষুকাট্টা ( নতুন চালের গুঁড়ো, নারকেলের দুধ আর গুড় দিয়ে তৈরি), সাইড ডিশ হিসেবে থোরান, নিম পাতা দিয়ে তৈরি ভেপ্পাম্পু রসাম, টক বা পাকা আমের ঝোল মাম্পাজাপ্পুলিসেরি। মন্দিরে মন্দিরেও চলে পঙতিভোজনের পর্ব।
    আর ফাটানো হয় নানানরকম বাজি। বিষুর কয়েকদিন আগে থেকেই চলতে থাকে আতশবাজির প্রদর্শনী বা পাদক্কম।



    নববর্ষের দিনটিকে স্মরণীয় করে রাখতে চেষ্টায় কোনো খামতি রাখতে চায়না কেরালার মানুষজনেরা।
        
    কেরালা ছেড়ে এবার চলুন তামিলনাড়ু রাজ্যের নববর্ষ উদযাপন উৎসবে যোগ দিতে। এই তামিল ভাষাভাষী মানুষের রাজ্যে নববর্ষের প্রথম দিনটিকে বলা হয় পুথান্ডু বা পুথুভারুদম। তামিল বর্ষপঞ্জির প্রথম মাস চিথিরাই। এই বিশেষ দিনেই পুথান্ডুর আয়োজন। উগাদীর পাশাপাশি পুথান্ডু উৎসবের আয়োজনে মেতে ওঠে তামিলনাড়ুর আপামর জনসাধারণ। ঘরে ঘরে তৈরি করা হয় মাঙ্গান পাচাডি নামের বিশেষ খাবার যা নানান স্বাদের খাবারের এক লোভনীয় সংশ্লেষ। এক থালায় সাজিয়ে দেওয়া নানান বিচিত্র স্বাদের আহার্য আসলে জীবনের বিভিন্ন পরিস্থিতিতে যুঝবার ক্ষমতা প্রদান করে বলেই ঐ রাজ্যের মানুষেরা বিশ্বাস করে। মন্দিরে মন্দিরেও চলে বিভিন্ন অনুষ্ঠান‌। পারস্পরিক সৌহার্দ্য বিনিময়ের মাধ্যমে সকলের মঙ্গল কামনায় কেটে যায় দিনটি পরম আশায় বুক বেঁধে যে আগামী বছর ভালো কাটবে সকলের। আঙিনা জুড়ে কোলাম বা আলপনা আঁকা পুথান্ডুর এক অনবদ্য পরম্পরা।

            

    এবার চলুন ভারতের পশ্চিম প্রান্তীয় রাজ্য মহারাষ্ট্রের নববর্ষ উৎসবের আঙিনায়। এই রাজ্যের ঐতিহ্যমণ্ডিত নববর্ষ উৎসবের দিনটিকে বলা হয় গুড়ি পাডোয়া। এক বৈশিষ্ট্যপূর্ণ গুড়ি বা ধ্বজা উত্তোলনের মাধ্যমে বছরের এই বিশেষ দিনটির মাঙ্গলিক উদযাপন শুরু করেন মহারাষ্ট্র, গোয়া ও দমনে বসবাসরত হিন্দু সম্প্রদায়ের মানুষেরা। একটি লম্বা দণ্ডের মাথায় একটি নতুন শাড়ি বা ধুতি বা অন্য কোনো রঙ্গিন কাপড়ের টুকরো বাঁধা হয়, আম্র পল্লব, নিম পাতা ও ফুলের মালা দিয়ে ‌। বিশেষ উপকরণ হিসেবে এই ধ্বজায় ঝোলানো হয় চিনির বাতাসার মালা যা গাথি নামে পরিচিত। ধ্বজাদণ্ডের শীর্ষ ভাগে রাখা হয় উল্টানো তামা অথবা রূপোর তৈরি একটি ছোট ঘটি। বাড়ির একটি উন্মুক্ত অংশে ঐ সুসজ্জিত ধ্বজাটিকে স্থাপন করা হয় ভক্তিভরে। 

     

    মানুষের বিশ্বাস এই ধ্বজা বা পতাকা ভগবান ব্রহ্মার পতাকার প্রতীক , সুতরাং নববর্ষের পুণ্য দিনে এই গুড়ি বা পতাকা ঘরে স্থাপন করলে তা সমস্ত বিপদের আশঙ্কাকে দূর করে ও সংসারের সুখ সমৃদ্ধি ও সৌভাগ্য নিয়ে আসে। বিশেষ ধরনের খাবার তৈরি করা হয় এই উপলক্ষে। লোকজন সারা দিন উৎসবের আমেজেই মজে থাকে।



    চলুন পঞ্জাব। শিখ ধর্মের মানুষ নববর্ষ উদযাপন করতে সবাই প্রস্তুত হয়েছেন। আমরাও এই আনন্দযজ্ঞে সামিল হ‌ই। পঞ্জাব রাজ্যের নববর্ষ উৎসবকে বলা হয় বৈশাখী। কৃষি প্রধান পঞ্জাবে বৈশাখী উদযাপিত হয় রবিখন্দের ফসল কাটার আনন্দকে ঘিরে। অবশ্য এর সঙ্গে জড়িয়ে আছে শিখ খালসা বাহিনী তৈরির উজ্জ্বল স্মৃতি। আসুন এই অবসরে সেই ইতিহাস নিয়ে কিছু কথা আলোচনা করে নিই। ১৬৯৯ খৃষ্টাব্দের ১৩ এপ্রিল শিখ ধর্মের দশম গুরু, গুরু গোবিন্দ সিং মোঘলদের বিরুদ্ধে মরণপণ সংগ্রামের আহ্বান জানিয়ে অকুতোভয় খালসা বাহিনী গঠন করেন। শিখদের নবম গুরু তেগ বাহাদুর ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করতে নারাজ হ‌ওয়ায় তাঁকে হত্যা করা হয়। দশমগুরু গোবিন্দ সিং এই বৈশাখ মাসেই নতুন মন্ত্রে দীক্ষিত করলেন তাঁর অনুগামীদের। তাই পঞ্জাবের মানুষের কাছে বৈশাখী উৎসব অন্যতর তাৎপর্য বহন করে।
     
    বৈশাখীর দিনটিকে ঘিরে শিখ ধর্মাবলম্বীদের মধ্যে গভীর আবেগ জড়িয়ে আছে। তাই এই দিনে সবাই সকাল সকাল গুরু দরবারে হাজির হয়। সেখানে সাবাত কীর্ত্তনে অংশ নেন সকলে।চলে লঙ্গর বা পঙতিভোজন।গুরু গ্রন্থসাহেবকে নিয়ে আয়োজিত হয় ধর্মীয় শোভাযাত্রা। চলে আলিঙ্গন ও শুভেচ্ছা বিনিময়ের পর্ব। বন্টন করা হয় মিঠাই। 



    আর চলে উচ্ছল ভঙ্গিমায় বিখ্যাত ভাঙরা আর গিদ্দা নাচ । সব মিলিয়ে এক জমজমাট খুশির প্যাকেজ।
       
    সারা ভারতবর্ষ থেকে নববর্ষের উপহার নিয়ে আমরা এখন এসে পড়েছি ভারতের পূর্ব প্রান্তের অসম রাজ্যে‌‌। অসমের নববর্ষের দিন মানেই একরাশ খুশির লহর ব‌ইয়ে দেওয়া বোহাগ বিহুর আয়োজন। বিহু হলো অহমীয়া মানুষের অহমিকা। নতুন ক্যালেন্ডারের প্রথম দিনটিতে অসমীয়া নববর্ষ উৎসব উদযাপন উপলক্ষে সমগ্র রাজ্য খুশির লহরে নাচতে থাকে। বিহু নাচের তালে তালেই বোহাগ বিহু বা রঙ্গালি বিহু যেন এসে হাজির হয়। খেত ভর্তি ফসল ঘরে তোলার আনন্দ বিহু উৎসবের আয়োজনের সঙ্গে মিলেমিশে একাকার হয়ে যায়। 



    বোহাগ বিহু হলো এক মহামিলনের উৎসব। উৎসবের আঙিনায় তাই সবার নিমন্ত্রণ। পরম্পরাগত রঙ্গালি বিহুর সাত সাতটি উপপর্যায় আছে - ‘সোট,’ ‘ রাতি,’ ‘গোরু,’
    ‘মানুহ’, ‘কুটুম’, ‘মেলা’, ও ‘সেরা’। বিহুর এই পর্বের বিভিন্ন উপপর্যায়গুলো থেকে একটা বিষয় হয়তো খুব পরিষ্কার যে বোহাগ বা রঙ্গালি বিহু সর্ব স্তরের মানুষ ও প্রাণির প্রতি দায়বদ্ধতার কথা বলে। এজন্য একে সাত বিহুও বলা হয়।
     
    চৈত্র মাসের শেষ সপ্তাহ থেকেই বোহাগ বিহুর আয়োজন শুরু করা হয়। তবে পয়লা বৈশাখের দিনটিকে মানুহ বিহু বা মানুষ বিহু বলা হয়। এই দিনটিতে পরিবারের প্রবীণ সদস্যদের কাছে আশীর্বাদ প্রার্থনা করা হয়। পাশাপাশি মৃত আত্মজনদের উদ্দেশ্যে শ্রদ্ধা জানানো ও তাঁদের আত্মার উদ্দেশ্যে নৈবেদ্য নিবেদন করার রীতি রয়েছে। অসমের ঐতিহ্যবাহী গামুসা বা গামছা দেওয়া হয় এদিনের বিশেষ উপহার হিসেবে। এই গামুসা বিনিময়ের মধ্য দিয়ে বন্ধুত্ব ও প্রেমের সম্পর্ক রচিত হয় সকলের সঙ্গে। বিহুর ষষ্ঠ দিনটিকে বলা হয় মেলা বিহু। এইদিন বিহু নাচের আসর পাতা হয়। ঢোল, ঢোলক, পেঁপা বা শিঙ্গা, টোকা,সুতুলি আর বাঁশির শব্দের ঝঙ্কার এবং নর্তক নর্তকীদের আন্দোলিত দেহ লাস্যে মুখরিত হয়ে ওঠে বোহাগ বিহুর উৎসব প্রাঙ্গণ । চলে খাওয়া দাওয়া আর শুভেচ্ছা বিনিময়ের পালা।



    ভারতের বিভিন্ন রাজ্যে নববর্ষ উৎসব উদযাপনের কথা বলতে বলতে আমরা এখন এসেছি ভারতের পূর্ব প্রান্তের ছোট্ট রাজ্য মণিপুরে। মার্চ মাসের শেষের দিকে অথবা এপ্রিল মাসের গোড়ায় সংখ্যাগুরু মণিপুরী মেইতেই সম্প্রদায়ের মানুষেরা উদযাপন করে তাঁদের নতুন বছরকে স্বাগত জানানোর উৎসব সজিবু চেরাইওয়া । নতুন বছর
    অনেক অনেক প্রত্যাশার সন্দেশ বহন করে নিয়ে আসে। ভারতের অন্যান্য অংশের তুলনায় উত্তর পূর্ব প্রান্তসীমায় অবস্থিত রাজ্যগুলোর সামাজিক ও সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডল একেবারেই আলাদা। তাই এখানকার উৎসবগুলো অনেকটাই স্বতন্ত্র চরিত্রের। 

    মণিপুরী ক্যালেন্ডার অনুযায়ী সজিবু হলো বছরের প্রথম মাস। হিন্দু চান্দ্র পঞ্জিকা অনুসারে চৈত্র শুক্লা প্রতিপদের দিন সাজিবুর তারিখটি ঠিক করা হয়। এদিক থেকে দেখলে বলা যায়, মহারাষ্ট্রের গুড়ি পাডোয়া, কর্ণাটক , তেলেঙ্গানা ও অন্ধ্রপ্রদেশ রাজ্যের উগাদী বা ইউগাদীর সঙ্গে তাল মিলিয়ে এক‌ই শুভ তিথিতে মণিপুরী মেইতেই সম্প্রদায়ের মানুষেরা তাদের নববর্ষ উৎসব সাজিবু চেরাইওয়া পালন করে। সমস্ত শুভ শক্তির আহ্বান ও অশুভ চিন্তার বিণাশ কামনায় মেইতেই মানুষেরা মেতে ওঠেন বছরের এই বিশেষ দিনটিতে। দিনটি শুরু হয় একেবারে ব্রাহ্ম মুহূর্তে 



    সিলভান দেবতা লাইনিংথু সানামাহিক ও মৃত আত্মজনদের আত্মার উদ্দেশ্যে নানান ধরনের উপাচার নিবেদনের মাধ্যমে। এগুলো কাঁচা অবস্থায় উৎসর্গ করা হয়। সমস্ত উপকরণকে বাড়ির বাইরে আগে থেকেই পরিষ্কার করে ধুয়ে রাখা স্থানে ভক্তিভরে সাজিয়ে দেওয়া হয়। আরাধ্য দেবতার অনুমোদন পাওয়ার পর সেই উপকরণের দ্বিগুণ জিনিস দিয়ে শুরু হয় রন্ধনের মূল পর্বটি। এই বিশেষ দিনটিতে পরিবারের পুরুষ সদস্যরা হেঁসেলের দায়িত্ব নিষ্ঠার সঙ্গে পালন করেন। চলে খাওয়া দাওয়া আর শুভেচ্ছা ও উপহার বিনিময়। সম্প্রতি অবিশ্বাস আর অস্থিরতা গ্রাস করেছে এই রাজ্যটিকে। সেই সব অন্ধকার দূরে সরিয়ে নতুন বছরে আবার নতুন করে সখ্যতা হৃদ্যতা ও বিশ্বাসের পরিবেশ ফিরে আসুক, এইটিই হয়তো হবে এই বছরের সাজিবু চেরাইওয়া পালনের একমাত্র লক্ষ্য।
          
    উত্তরে কাশ্মীর থেকে দক্ষিণে কন্যাকুমারী, পশ্চিম প্রান্তীয় মহারাষ্ট্র থেকে দেশের একেবারে পূর্ব সীমান্তে থাকা মণিপুর রাজ্য পরিক্রমা করে এলাম আমরা নববর্ষ উৎসবের প্রার্থনা, শুভকামনা আর প্রত্যাশার উপহারকে সঙ্গী করে। সেই বহু প্রচলিত লোকায়ত প্রবচনটির কথা মনে করে বলতে হয়, সকাল দেখে বোঝা যায় দিনটা কেমন কাটবে। মা ঠাকুমা দিদিমাকে বলতে শুনেছি, বছরের প্রথম দিনটাকে যেমন করে কাটাবি , বাকি দিনগুলোও সেভাবেই কাটবে। ছোটোবেলায় এসব কথা ভীষণভাবে মনে গেঁথে যেত। মা নীল ষষ্ঠীর উপোস করতেন। সারাদিন নির্জলা উপোসের পর সন্ধ্যায় নীলকন্ঠ শিবের মাথায় জল দুধ ঢেলে উপবাস ব্রত ভঙ্গ করা। আসলে নীল ষষ্ঠীর উপোস ছিল দুদিন বাদে হ‌ওয়া নববর্ষের প্রস্তুতি। সন্তানের মঙ্গল কামনায় মায়ের এই কৃচ্ছতা মনে গভীরভাবে গেঁথে যেত। এখনও সেই ট্র্যাডিশন সমানে চলেছে। 
     
    নববর্ষের বিকেলে মায়ের হাতে তৈরি নতুন জামা আর প্যান্টালুন পড়ে দাদুর হাত ধরে যেতাম হালখাতা করতে। দোকানের পাশে ফাঁকা জায়গায় মাটির জালায় ভরা থাকতো বরফের কুচি মেশানো কাঁচা আমের শরবত। ঐ এক গ্লাস পানীয় পরাণ ঠাণ্ডা করে দিত। সেকালে তো আর প্লাস্টিকের বোতল ভরা ঠাণ্ডা পানির এমন চল ছিলনা। দোকানীরা প্যাকেট হাতে ধরিয়ে দিতেই বাড়ির পথে পাড়ি দেওয়া। বাড়িতে এসে কীভাবে সেই প্যাকেটগুলোর সদগতি করা হতো সে অবশ্য অন্য কাহিনি। বারান্তরে প্রকাশ্য।
    জীবনের অনেকগুলো নববর্ষের দিন কাটিয়ে এলাম। তাই স্মৃতিভাণ্ডে অনেক কাহিনী জমা হয়েছে এতকাল। সবগুলো উগড়ে দিলে জাবরকাটার রসদের যে আগামীদিনে টান পড়বে! তাই অলমতি বিস্তারেন …..।
        

     
    ** এই নিবন্ধটি লেখার জন্য এন বি টি প্রকাশিত ভারতের উৎসব শীর্ষক ব‌ইটির সহায়তা নিয়েছি। বিভিন্ন পত্র পত্রিকায় নানান সময়ে প্রকাশিত নিবন্ধগুলোও কাজে লেগেছে। ছবির জন্য বিভিন্ন উৎস কাজে লাগাতে হয়েছে ‌। সকলের কাছেই বিনম্র কৃতজ্ঞতা জানাই।
     
    ** এই ধরনের আরও কিছু লেখা গুরুচণ্ডালির পাতায়।
     আজ মকর সংক্রান্তি।       
    আজ বিষুব দিবস।
    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • Ritabrata Gupta | 103.68.***.*** | ১৩ এপ্রিল ২০২৪ ২১:২৮530574
  • অপূর্ব লেগেছে। অত্যন্ত তথ্য সমৃদ্ধ। শুভ নববর্ষ জানাই !
  • sarmistha lahiri | ১৪ এপ্রিল ২০২৪ ০২:১০530595
  • এতো শুধু নববর্ষের গল্প নয়, এতো নববর্ষের এনসাইক্লোপিডিয়া। এর মাধ‍্যমে নববর্ষের তথ্য সমৃদ্ধ হাতে গরম তথা পেলাম। লেখককে অসংখ্য ধন্যবাদ।
  • অঞ্জনা বন্দ্যোপাধ্যায় | 2405:201:8000:b1a1:dc0c:96a1:a52e:***:*** | ১৪ এপ্রিল ২০২৪ ০৬:৪৯530600
  • আজকের দিনের জন্য একেবারে যথার্থ লেখা। খুব সুন্দর করে কথার জাল বুনেছেন লেখক। তাঁর করার জাদুতে আটকে গিয়ে কি সহজেই না গোটা দেশ ঘুরে এলাম আমরা। প্রাসঙ্গিক ছবির সংযোজন উৎসবের আমেজ আরও বাড়িয়ে দিয়েছে। এই লেখাটি পাঠকদের কাছে আদৃত হোক। শুভ নববর্ষ ১৪৩১।
  • সৌমেন রায় | 2409:40e1:7:5991:8000::***:*** | ১৪ এপ্রিল ২০২৪ ০৯:৪৪530605
  • নববর্ষে ভারত ভ্রমন।
  • Argha Bagchi | ১৫ এপ্রিল ২০২৪ ১৭:১৪530654
  • সুন্দর লেখা। বিষয়ের অনুষঙ্গে কিছু অন্য প্রদেশের ভাষায় তাদের নববর্ষের নাম জেনে ভাল লাগল, কিন্তু মূল লেখাটা বাংলায় হলেও তিনটি অবাঙালী শব্দ (জেনেবুঝেই 'অ-বাংলা' লিখলাম না) চোখে ও কানে বিঁধল। এক, ভাই চারা ("মানুষজন কীভাবে দেশীয় ক্যালেন্ডারের প্রথম দিনটিকে পালন করে তা জানার মধ্য দিয়ে এক একাত্মতা, ভাই চারার সম্পর্ক গড়ে ওঠে"); দুই, বরিষ্ঠ ("প্রথাগত ভাবে বাড়ির সবথেকে বরিষ্ঠ মহিলা"); আর তিন, সন্দেশ ("নতুন বছর অনেক অনেক প্রত্যাশার সন্দেশ বহন করে নিয়ে আসে")। সাধারণত বাংলাভাষায় আমরা এর বদলে সৌভ্রাতৃত্ব, বয়স্ক ও সংবাদ শব্দগুলি ব্যবহার করে থাকি। ওসব শব্দগুলো বদলে না দিলেই আমার আরো ভাল লাগত। কেননা, এই ধরণের অবাঙালী শব্দগুলো কষ্টসাধ্য উচ্চারণে একটি বিশেষ সম্প্রদায়ের অনুগামী স্বয়ংসেবকদের শাখায় শাখায় বৌদ্ধিক আলোচনায় অংশ নিতে গিয়ে একদা খুব শুনতে পেতাম, তখনো সংস্কৃতির (কষ্টসাধ্য উচ্চারণে তারা বলে সংস্ক্রুতি) এই জবরদস্তিতে মর্মাহত হতাম, এখনো হই।

    লেখাটি পড়ে পাঠকের মনে একটা অযথা ধারণা তৈরি হয় যে ভারতে নববর্ষ বোধহয় কেবল হিন্দুরাই পালন করে থাকেন। একমাত্র পাঞ্জাবের কথা বলতে গিয়ে খালসা শিখদের কথা এসেছে, কিন্তু সেটা প্রসঙ্গক্রমে তাদের মুসলিম হতে না চাওয়ার ঐতিহ্যের সাথে জুড়ে ধান ভানতে শিবের গীত গাওয়া হয়েছে। ব্যাপারটা ঠিক ভারতীয় থাকেনি, হিন্দু-ভারতীয় আখ্যান হয়ে গেছে। অথচ, লেখক যে ছবিটা দিয়ে শুরু করেছেন, সেটি ঢাকায় পালিত বিশ্বের সর্ববৃহৎ অসাম্প্রদায়িক মঙ্গল শোভাযাত্রা, যা এই বাংলাতেও গত নয়-দশ বছর ধরে একই উৎসাহে ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে পালিত হয়। পাঠক খেয়াল করবেন, কাশ্মীরে যে নভরেহ্‌ বলা হয়েছে, তা পার্সি সম্প্রদায়ের "নওরোজ" (পার্সি নববর্ষ) শব্দের একপ্রকার কথ্য রূপ। যদি সত্যিই আমাদের একাত্মতা ও সৌভ্রাতৃত্বের কথা বলার ইচ্ছে থাকে, তাহলে দেখতে পাব, পাঞ্জাবের বৈশাখী আসামে বহাগী হয়েছে, আবার কেরালার বিষু-ও আসামে বিহু হয়েছে। কোঙ্কনের সম্বৎসর-পাডবো বাংলার সম্বৎসর-পর্ব ছাড়া আর কিছু নয়। আবার, মহারাষ্ট্রের গুঢ়ি-পারব -এর সাথেও তার মিল পাওয়া যায়। উগাদি বা ইউগাডি না বলে সঠিকভাবে যদি আতস-কাচ ধরতে পারেন, দেখবেন, 'যুগাদি' শব্দটিকে, অর্থাৎ, যুগ-এর আদি দিবস, নব-বর্ষ যাকে বলি আমরা। এজন্য অবাক হওয়ার কিছু নেই, পলিটিক্যাল ভারত আর কালচারাল ভারত এক নয়। কালচার পলিটিক্সের জন্মের আগেও ছিল, কেবল তার মধ্যে রেষারেষি করে আমরা সবাই ভাই ভাই দেখানোর হুড়োহুড়ি-মার্কা রাজনৈতিক মতলব ছিল না। ফলে আমরা এই নিবন্ধে তিব্বত, নেপাল, ভূটান, বাংলাদেশ, মায়ানমার, চীন, শ্রীলঙ্কা, আফগানিস্তান, পাকিস্তান এদের নববর্ষের কথা জানতে পেলাম না। প্রসঙ্গত, চীন ও তিব্বতের ১৫ দিনের নববর্ষ উৎসব আসামে এসে সাতদিনে পরিণত হয়েছে। অথচ, অন্যান্য প্রদেশে সেটি কেবল এক দিনের উৎসব।

    লেখক আরো দুটো শব্দ গুলিয়ে ফেলেছেন, হয়ত সঠিক সংস্কৃত অর্থ জেনে ব্যবহার করা হয়নি বলে। ভুঁড়িভোজ নয়, কথাটা ভুরিভোজ (ভুরি মানে বহু)। আর, অলমতি বিস্তারেন নয়, সংস্কৃতে কথাটি অলমতি বিস্তরেণ... অর্থাৎ --- এর বেশী বিশেষ কিছু বলার নেই।
  • Somnath mukhopadhyay | ১৫ এপ্রিল ২০২৪ ২১:২১530658
  • মাননীয় বাগচী মহাশয়কে আন্তরিক ধন্যবাদ। এক‌ই সঙ্গে জানাই ১৪৩১ বঙ্গাব্দের শুভকামনা। এতো মনযোগ সহকারে আমার নিবন্ধটি পড়ে  এমন সুচিন্তিত দীর্ঘ মতামত দিয়েছেন দেখে খুব ভালো লাগছে। 
    শেষ থেকেই শুরু করতে হয় । অলমতি বিস্তরেন হয়েছে বিস্তারেন। এইটি নিছকই মুদ্রণের ত্রুটি যদিও না হলেই ভালো হতো।
    ভুরিভোজ কে ভুঁড়িভোজ করার পেছনে একটা ভাবনা কাজ করেছে। খাওয়া দাওয়া মানেই উদরপূর্তি। ভুঁড়ি ভরা ভোজ -এমন অর্থেই কথাটা প্রয়োগ করতে চেয়েছিলাম। তবে যেহেতু ভুঁড়িভোজ শব্দটি প্রচলিত নয় তাই হয়তো একটু খটকা লেগেছে। সংশোধনের বিষয়ে অবশ্যই ভাববো।
    বৈশাখী,নভরেহ সম্পর্কে আমার কিছু বলার নেই। হয়তো আত্মপক্ষ সমর্থনের জন্য যে কথাগুলো বলবো তাতে কোনো পক্ষই তুষ্ট হবো না। তাই বিনম্র শ্রদ্ধায় বিষয়টিকে পাশ কাটিয়ে যাচ্ছি। অর্ঘ্য বাবু আক্ষেপ করেছেন , উপমহাদেশের অন্যান্য দেশের নববর্ষের কথা কেন আমার নিবন্ধটিতে ঠাঁই পায়নি বলে। আক্ষেপ থাকাটাই স্বাভাবিক। আমার মূল উদ্দেশ্যই ছিল পয়লা বৈশাখের দিনটির অনুষঙ্গে ভারতের আরও কিছু রাজ্যের নববর্ষ উদযাপনের কথা তুলে ধরা। সেখানে হিন্দু মুসলিম শিখ ঈশাই বৌদ্ধ জৈন এসবের কথা তখনও মাথায় আসেনি এখনও নয়। একটা মাঙ্গলিক উপলক্ষ কীভাবে মানুষ পালন করে সে কথাই বলতে চাই, চেয়েছি।তাঁর মধ্যে ধান ভাঙতে শিবের গীত গাওয়া হলে অবশ্যই নিবন্ধকারের অজ্ঞতা।
    কয়েকটি শব্দের প্রয়োগ সম্পর্কে অর্ঘ্যবাবু দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন। অবশ্যই ভেবে দেখবো। তবে কিছু শব্দ ইদানিং এতোটাই বাংলা ঘেঁষা হয়ে গেছে যে  প্রয়োগকালে রক্ষণশীলতা এড়িয়ে গেছি হয়তো সচেতন ভাবেই। বাংলা ভাষার আঙিনায় সন্দেশ ব্রাত্য ? বরিষ্ঠ বললে বয়স্কদের এড়িয়ে যাওয়া হয়? ভাববো অবশ্যই।
    ছবি প্রসঙ্গে বলি , ছবি সবসময়ই প্রতিনিধি মূলক। এ পাড়ের মঙ্গলযাত্রার ভালো ছবি পাইনি, অন্তত আমার চোখে পড়েনি। ভালো বর্ণময় ছবি পেলে তাকেই জুড়ে দিতাম।
    অর্ঘ্য বাগচী মশাইয়ের কাছে কৃতজ্ঞতা প্রকাশের ভাষা নেই। আমি ,"যতদিন বাঁচি ততদিন শিখি"এই দর্শনের অনুগামী। তাই শিখতে বাধা কোথায়? ভালো থাকবেন সবসময়।
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : guruchandali@gmail.com ।


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। পড়তে পড়তে মতামত দিন