এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • বুলবুলভাজা  পড়াবই  বই পছন্দসই

  • হীরেন সিংহ রায়-এর ‘আমার জার্মানি’ - একটি আলোচনা (প্রথম পর্ব)

    মিলন দাস
    পড়াবই | বই পছন্দসই | ১৭ ডিসেম্বর ২০২৩ | ১৪৯১ বার পঠিত | রেটিং ৪.৫ (৪ জন)
  • প্রথম পর্ব | দ্বিতীয় পর্ব


    বাবা বললেন কথাটা হ্যামবারগ নয় রে, উচ্চারণ হবে হামবুর্গ। বাবা হলেন কমলা কিঙ্কর সিংহ রায়। যিনি বলেছেন তাঁর পুত্রকে—নাম হীরেন সিংহ রায়। সেই প্রথম জার্মানি ও জার্মান ভাষা সম্পর্কে হীরেনের প্রথম পাঠ বা পরিচয়ও বলা যায়।
    খুবই গোলমেলে অ্যাসাইনমেন্ট। ‘আমার জার্মানি’ বইটার রিভিউ করতে বসেছি। গোদা বাংলায় পুনর্বার দেখা (Review) কি দেখব, কোনখান থেকে দেখব। শুধু জার্মানি হলে কথা ছিল। স্টেট ব্যাঙ্কের চাকরি ১৯৭২ সালে। জলপাইগুড়ি বহরমপুর শ্যামবাজার ব্রাঞ্চে কাজ শেখা। তিন বছর বাদে দু-বছরের জন্য জার্মানির ফ্রাঙ্কফুট অফিসে বদলি।
    ফ্রাঙ্কফুটের প্রথমদিন একটি অসামান্য অবদান। পুরো লেখাটার মধ্যে ছড়িয়ে আছে রসিকতার মণিমুক্ত। যে লেখক নিজের দুঃখ নিয়ে নির্মল রসিকতা করতে পারে তার লেখনি কোন মার্গে উঠতে পারে এই অধম রিভিউ রাইটার তা কল্পনাও করতে পারেননি। আসার সময় হাতে ছিল ১২৫ ডলার তার মধ্যে ৫৫ ডলার নিজের সুটকেসের লাইনিংয়ের মধ্যে লুকিয়ে রেখেছিলেন। হাতে পেনসিলের মতো করে ধরা ছিল ৭০ ডলার। হীরেন পৌঁছে গেলেন ফ্রাঙ্কফুর্টে কিন্তু সুটকেস পৌঁছলো না। নিজের অসহায় অবস্থার বিবরণে যে স্যাটায়ার লুকিয়ে আছে, তা এককথায় নান্দনিক।
    ফ্রাঙ্কফুটে হোটেলের এক পরিবর্ত আছে। পেনসন। অ্যাপোলো পেনসনের দোতলায় রাত্রিবাস। প্রথম রাত। বেজায় ঠান্ডা ঘরের মধ্যে। হীরেন ওভারকোটটা মুড়ে শুয়ে পড়লেন। পরে জানা গেল জায়গাটি রেড লাইট এরিয়া।
    ড্রেসনার ব্যাঙ্ক সাময়িক আস্তানার ব্যবস্থা করে রেখেছে। বিদেশ বিভুঁই। নতুন দেশে আসার উত্তেজনা ততক্ষণে চলে গেছে। শুমানস্ত্রাসে চারতলা ফ্ল্যাট বাড়ি। হীরেন বাড়িতে ঢোকার জন্য বোতাম টিপবেন। কিন্তু কোনো বোতাম নেই? সেই সময় ব্রিগিটা নামে এক মাঝবয়সি মহিলা গেট দিয়ে ঢুকলেন। পরিষ্কার ইংরেজিতে জিগেস করলেন ‘আমি আপনার কি সেবা করতে পারি’, আপনি কি শ্রী সিঙ্ঘারাম? তিনি আরো বললেন, একটি সুটকেস আমার অফিসে আছে। আপনার বাক্স এসে গেছে আপনার আগেই।
    হীরেনের ভাষায় ‘তাঁর পদপল্লবে লুটিয়ে পড়ার দুর্বার বাসনাকে কোনো মতে সংযত করে ধন্যবাদ জানালাম।’ হীরেন যখন ওনার সুটকেস হারানোর গল্পটি শোনালেন, তখন ব্রিগিটা জানালেন, ‘এ ব্যাপারে ইউরোপীয় বিমান সংস্থাগুলির অপার দক্ষতা আছে। যেটি যেখানে যাবার নয়, সেটি সেখানে প্রস্থান করে।‘ তিনি একবার হেলসিঙ্কি যাচ্ছিলেন। তাঁর বাক্সটি চলে যায় হংকংয়ে।
    এই রসিকতাটা বোধ হয় বিধাতার। তিনি চোখ মেরে বললেন ‘কেমন দিলাম’।
    দু-বছরের জন্য জার্মানি এসেছেন। তার ছ-মাস কাটবে ড্রেসনার ব্যাঙ্কের সঙ্গে। তাঁর পরবর্তী বাসস্থান বোয়েকার পরিবার। ফ্রিঞ্জ লুয়েরমান স্ত্রাসে । ইজারলোন-এ।
    ফ্রাঙ্কফুর্ট স্টেট ব্যাঙ্কের অফিস ছ-মাস কোনো বেতন দেবে না বা দেয়নি। সেখানে ড্রেসনার ব্যাঙ্ক একটা খামে ১০০ মার্ক প্রাথমিক খরচ হিসেবে পাঠিয়েছিল। হীরেনের গন্তব্য গোয়েথে ইন্সটিটুট, স্টেনারস্ত্রাসে, ইজারলেন।
    ব্রিগিটা তাঁকে নিয়ে গেলেন তাঁর সাময়িক বাসস্থানে। দোতলায়। সুসজ্জিত বেডসিটার। টেলিভিসন, ফ্রিজ, সোফা কাম পালঙ্ক সবই আছে। ফ্রিজে দিনদুয়েকের খাবারও আছে। ব্রিগিটা জানালেন এই দু-মাসের সাময়িক বাসস্থানে মালিকানা তাঁরই।
    দু-বছরের জন্য জার্মানি এসেছেন। ছ-মাস কাটবে ড্রেসনার ব্যাঙ্কের সঙ্গে। পরের দেড় বছর ফ্রাঙ্কফুর্টে স্টেট ব্যাঙ্কে। তারপর?
    তারপরে দেশে ফিরে আসা। এখানে করুণ রসের একটা বেহালা বেজে উঠল। আবার সেই টালা পার্কের মিনিবাসে ৬৫ পয়সার টিকিট কেটে অফিস যাওয়া। শ্রীধর, হীরেনের সহকর্মী কলকাতার ম্যাক্সমুলার ভবনে খানিকটা জার্মান শিখে এসেছে। হীরেন কোনো চেষ্টাই করেননি। ওর কথায় ‘স্টেজে মেরে দেব’ জার্মানিতে প্রথম দিন ৩০ নভেম্বর ১৯৭৭ সাল।
    ডিসেম্বর মাসে জার্মান শিক্ষার ক্লাস শুরু। প্রচণ্ড ঠান্ডা। হীরেন অন্ধকারে বাড়ি থেকে বেরিয়ে আট ঘণ্টা বাদে আবার অন্ধকারে বাড়ি ঢোকেন । হীরেন দিদিমণিকে (ব্রিগিটে লেনহার্ডকে) জিজ্ঞেস করলে ‘কোন ভাষার মাধ্যমে জার্মান শেখানো হবে? মহিলা উত্তর দিলেন, ‘ক্লাস আরম্ভ হলেই বুঝতে পারবেন।’ এর আগে বিহারে থাকাকালীন হিন্দি আর ইংরেজি শিখেছিলেন বাংলার মাধ্যমে। তখন শব্দের অর্থ পরিষ্কার হয়ে গেছে। গোয়েথে ইন্‌সটিটুতে জার্মান শেখানো হয় জার্মান ভাষার মাধ্যমে। শিক্ষক-শিক্ষিকাদের বলা আছে কোনো ভাবেই অন্য কোনো বিদেশি ভাষা ব্যবহার করা যাবে না। প্রয়োজনে অঙ্গভঙ্গি করবেন, বোর্ডে ছবি আঁকবেন। জার্মান ব্যাকরণ বড়ো কঠিন বস্তু। জার্মান ভাষায় নারী পুরুষ ভেদে বাক্য সংগঠিত হয়। ব্যস। হয়ে গেল ‘আমি সাত হাত জলে পড়লাম। অবশ্য আমার ডুবে যেতে অতটা জলের প্রয়োজন হবে না।’
    ‘স্কুলে সংস্কৃত পড়েছিলেন’। এই রিভিউ-লেখকও ওই একটু স্কুলে পড়েছে। পণ্ডিত স্যার সংস্কৃতের কোনো ছোটো কবিতা বলতে বলতেন, লাস্ট বেঞ্চে বসে ইংরেজির টুইঙ্কিল টুইঙ্কিল লিটিল্ স্টার মিন মিন করে বলতাম। ক্ষিরোদবাবু (পণ্ডিত স্যার) বলতেন ‘নেক্সট’। সেই স্কুলেই তো হীরেন পড়তেন। যখন সংস্কৃতের কথা হচ্ছে তখন হীরেনের স্কুলের কথা মনে পড়ল। এখন ওকে ভাবাচ্ছে ‘কেন সে সংস্কৃতটা শিখিনি।’ উলটে হীরেন ব্রিগিটে ম্যাডামকে প্রশ্ন করলেন, ‘আপনাদের স্কুলেও তো ল্যাটিন শেখানো হয়।’ উত্তর ‘শেখানো হয় বটে, কিন্তু ছেলেমেয়েরা ভালোভাবে শেখে না। ব্রিগিটে জিজ্ঞেস করলেন, ‘আপনি ইন্দো ইউরোপীয় ভাষা গোষ্ঠীর নাম শুনেছেন। এই পরিবারে জার্মান এবং সংস্কৃত এই দুটি ভাষার আত্মীয়তা অত্যন্ত গভীর। সংস্কৃত ব্যাকরণ যদি একটু ঝালিয়ে নিতে পারেন, জার্মান কারক বিভক্তিতে মোটেও হোঁচট খাবেন না, এমনকি শব্দের নারী পুরুষ চরিত্র নির্ধারণ করতেও সুবিধে বোধ করবেন। যারা শুধু ইংরেজি শিখে এসেছে তাদের পক্ষে এই বেড়াগুলি টপকানো অনেক কঠিন।’
    যা হোক বন্ধুরা খুঁজেপেতে ‘হেল্পস টু দি স্টাডি অফ স্যানসক্রিট’ বইটি কলেজ স্ট্রিটের পুরোনো দোকান থেকে খুঁজেপেতে পাঠিয়ে দেয়। হীরেন কৃতজ্ঞ সেই বন্ধুদের কাছে। হীরেন বলছেন , ‘মিশরে রোসেটা পাথর খুঁজে পেয়ে যেভাবে ভাষাবিদরা উল্লসিত হয়ে একদিন হায়ারোগ্লিফিকসের অর্থ উদ্ধারে ব্রতী হয়েছিলেন, আমার উচ্ছ্বাস তার তুলনায় কিছু কম ছিল না।’ মজার ব্যাপার হীরেন স্প্যানিশ শিখেছেন জার্মান ভাষার মাধ্যমে।
    ইজারলোন শহরের ফ্রিতস লুয়েরমানস্ত্রাসের ৪ নম্বর ছোটো দোতলা বাড়ির বাসিন্দা দুজন। ওয়ালটার ও হিলডেগারড বোয়েকার। দুজনের কেউ ইংরেজি বোঝেন না, হয়তো বোঝেন কিন্তু বলতে অক্ষম। মিসেস্ বোয়েকার সকাল সাড়ে ছ-টায় হীরেনকে ঘুম থেকে তুলে দিতেন। বাসে দশ মিনিট যাওয়ার পর গোয়েথে ইনস্‌টিটুট। এককালে কোনো ধনী লোকের ভিলা ছিল, ওনার কথায় ‘এই প্রথম ব্রেড রোল দেখলাম, জার্মানে ব্রোটশেন। ছোটো গোলাকৃতি। তাকে আধখানা করে চিরে চিজ বা জ্যাম পুরে খাওয়া। চায়ের ব্যবস্থা ছিল না, ঘন কালো কফি পরবর্তী চার ঘণ্টা সচেতন রাখার পক্ষে বেশ কার্যকরী।’ মানে যাতে ঘুম না আসে।
    ক্লাসে বহু লোকের সঙ্গে আলাপ হয়েছিল। তার মধ্যে একজন পোলিশ ডাক্তার। কোনো মতে সীমানা টপকে পালিয়ে এসেছেন। সে দেশে পুলিশের অনির্বার প্রশ্ন স্বামী কোথায়। নাম ইওয়ান প্রোবকা। তিনি বলতেন প্রেসিডেন্ট কার্টারকে আবেদন জানাবেন তার স্ত্রীকে যেন পোল্যান্ড থেকে আসতে দেওয়া হয়। ‘বড়ো দুঃখী মুখ দেখেছি তার। জানি না শেষ অবধি তাদের মিলন হয়েছিল কিনা।’ এখানে মানবিক হীরেন।
    ড্রেসনার ব্যাঙ্ক ৪০০ মার্ক দিত মাসে। গুনে গুনে খরচ করতে হয়। সকালে গোয়েথে ইনস্‌টিটুটের খাওয়া জোটে। দুপুরবেলা কাছাকাছি একটা খাবারের জায়গায় সস্তার খাবার পাওয়া যায়। দু-মার্কের ভাত ও মাংসের ঝোল (হাঙ্গেরিয়ান গুলাশ)। সন্ধ্যায় দুটো রুটি মাখন খেয়ে ঘুম। ২ মার্ক মানে আট টাকা।
    শীতকাল। প্রথম তুষারপাত দেখার অভিজ্ঞতা হলো। দেশ থেকে পুরানো একটা ওভারকোট এনেছিলেন। সেই কোট আর একটা বাঁদুরে টুপি পরে হেঁটে বেড়ান। সস্তায় দুটো গ্লাভস কিনেছিলেন। পোস্ট অফিসে দাঁড়িয়ে চিঠি লিখছেন হীরেন। ডান হাতের গ্লাভসটা ভুলে ফেলে আসেন। তারপর দামের জন্য আর দস্তানা কেনা হয়নি। কোটের পকেটে হাত ডুবিয়ে রাখেন।
    ক্লাসে নিউজিল্যান্ড কানাডার ছেলেমেয়েরা আছেন। তাঁদের এড়িয়ে চলেন। এক ‘ইংরেজি তো জানিই।’ দুই ওদের উচ্চারণ বুঝতে কষ্ট। আর শিখতে গিয়েছি জার্মান, ইংরেজি নয়। ইরানিয়ান বৈজ্ঞানিক বা সিরিয়ান ডাক্তার অথবা জাপানি ব্যাঙ্কার—জার্মান এদের কাছে একেবারে নিরপেক্ষ ভাষা। ভুলভাল দু-পক্ষেই করা যায়। নির্দ্বিধায়। তবু তো জার্মান বলা হচ্ছে।
    এবারে একটু ইতিহাসে আসা যাক। ইংরেজকে ক্রিসমাস ট্রি শেখান সাক্সা কোবুরগ গথা থেকে আগত এক জার্মান রাজকুমার। ভিক্টোরিয়ার সঙ্গে বিয়ের পরে আলবার্ট ইংল্যান্ডে তাঁর শ্বশুরবাড়ি এলেন। বড়দিনের সময় তিনি পত্নীকে জিজ্ঞেস করলেন, প্রিয়ে, ক্রিসমাস এসেছে। ট্রি কই, যেমন আমাদের দেশে দেখি? সে ছাড়া ক্রিসমাস মানায় না। অতএব মহারানি হুকুম করলেন ওই গাছটি যেন বাড়ি বাড়ি লাগানো হয়। কয়েক দিনের জন্য। প্রাকৃতিক কারণে ইউরোপে পাইন গাছ অনেক জন্মায়। বড়দিনের ওই সামগ্রিকভাবে ডালপালা কাটাকাটির পরেও তারা ঠিক বেঁচে থাকে। ক্রিসমাস ট্রি-রূপে বাড়ি, বসবার ঘরের শোভাবর্ধন করে। একটা ছোটো পাইন গাছের ডালকে আলো আর উপহার দিয়ে সাজানো।
    গোয়েথে ইনস্‌টিটুটের পড়াশোনা শেষ হলে এবারে বাড়ি ছাড়তে হবে। বোয়েকার পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগ ছিল বহুদিন। চিঠিপত্র খবরাখবর আদানপ্রদান, কার্ড বিনিময়। একদিন কার্ডের পরিবর্তে এলো ওনাদের মেয়ে অনিতার একটি চিঠি। একই বছরে বাবা-মা দুজনেই মারা গেছেন। আত্মীয়তা কোন পর্যায়ে পৌঁছোলে হীরেন বলতে পারেন ‘আমার জীবনের একটি অধ্যায়ের ইতি।’
    ১৯৯০ সাল। দীর্ঘ ১৩ বছর বাদ পুরানো জার্মান শিক্ষার স্কুল গোয়েথে ইনস্‌টিটুটে ইজারলোনে হীরেন এলেন। শুনলেন আগের অধ্যক্ষা ব্রিগিটা লেনহার্‌ড্ চলে গেছেন চিলির গোয়েথে ইনস্‌টিটুটে। নতুন অধ্যক্ষা হীরেনের সঙ্গে গল্পে মেতে উঠলেন। হীরেনের প্রমোশনে যারপর নাই খুশি হলেন। অফিসের কর্মচারীকে বলে হীরেন যে বাড়িতে থাকতেন সেটাও যোগাড় করে ফেললেন। বললেন, ‘আপনার একটা ইন্টারভিউয়ের ব্যবস্থা করেছি। ‘ কাগজের নাম ইজারলোনার ক্রাইসআন জাইগার, ওখানকার আনন্দবাজার।
    ছবি সহ ইন্টারভিউ হলো। ক্যাপশন ‘১৩ বছর বাদে ইজারলোনে ফিরলেন হীরেন সিংহ রায়।’ সেটি হীরেনের কাছে এখনও সযত্নে আছে।
    গোয়েথে ইনস্‌টিটুটের অফিসের মহিলা খুঁজেপেতে বার করে ফেললেন হীরেন কোন বাড়িতে থাকতেন। দোতলা থেকে নেমেই দেখলেন অনিতা আর তার স্বামী পিটারকে। রাত্রিবাসের জন্য ঝুলোঝুলি ফ্রিতস লুয়েরমানস্ত্রাসেটতে । ওয়ালটার ও হিলডেগার্ড বোয়েকারের মৃত্যুর পর অনিতা আর পিটার এখানেই থাকে। অনিতাকে চিনতে কোনো অসুবিধা হয়নি।
    একদিন পিটারই হীরেনকে নিয়ে এসেছিলেন ইজারলোন স্টেশন থেকে এই বাড়িতে। পিটার খবর পেয়ে তাড়াতাড়ি অফিস থেকে ফিরে এলেন। বোয়েকারদের বাঁধানো ছবিতে শ্রদ্ধা জানিয়ে যে ঘরে থাকতেন সেটা দেখে ওদের নিয়ে এলেন হীরেন নিজের হোটেলে। অনেক গল্প হলো। তাঁর কথায় ‘মনে হলো অনেক দিনের হারানো আত্মীয়স্বজনকে খুঁজে পেয়েছি... হোক না তা ক্ষণিকের।’ সন্ধ্যাভোজন এবং সাথে পুরোনো গল্পে গল্পে কেটে গেল অনেকটা সময়। এই হচ্ছে কলঙ্কহীন একটা আস্ত মানুষ, যা আমরা সারা জীবন চেষ্টা করেও হতে পারব না।
    এবারে একটু ব্যক্তিগত কথা । এই লেখার সঙ্গে ‘আমার জার্মানি’-র কোনো সম্পর্ক নেই। বাড়িতে আনন্দবাজার, যুগান্তর, অমৃতবাজার পত্রিকা, দি স্টেট্‌স্‌ম্যান, (তখনও টাইমস্‌ অফ ইন্ডিয়া, হিন্দুস্থান টাইম্‌স্, আজকাল—এগুলো আসেনি।) একগাদা রিপোর্টার, ক্যামেরাম্যান, পাড়ার বয়স্ক কিছু লোকজন, নিজের দাদা, বউদি, বাড়ির সকলে হাজির। লোক আর ধরছে না। ততক্ষণে চারদিকে রটে গেছে, হীরেন সিংহ রায় হিউম্যানিটিস্ বিভাগে হায়ার সেকেন্ডারিতে প্রথম হয়েছে। খোঁজ খোঁজ কোথায় হীরেন? হীরেন তখন নিশ্চিন্তে সিনেমা হলে। একবার ভাবুন। হীরেনের কোনো তাপ-উত্তাপ নেই। প্রথম হওয়াটা ওর কাছে কোনো ব্যাপারই নয়। এটা একেবারে একটা প্রাক্‌টিকাল জোক।
    ইজারলোনে গোয়েথে ইনস্‌টিটুট যখন ইন্টারভিউয়ের ব্যবস্থা করে, ১৩ বছর আগে যে ইনস্‌টিটুট থেকে সে জার্মান শিক্ষা নিয়েছিল, খবরের কাগজের নাম ইজারলোনার ক্রাইসআন জাইগার, আমাদের বাংলা আনন্দবাজার, তারা লিখেছিল, ‘১৩ বছর বাদে ইজারলোনে ফিরলেন হীরেন সিংহ রায়’। সারা বরাহনগর তো বটেই, সারা কলকাতা জেনে গেছে হীরেন সিংহ রায় উচ্চমাধ্যমিকে প্রথম হয়েছেন। ইন্টারভিউ নিতে কাগজের লোকজন রিপোর্টার সব এসেছেন। কিন্তু উনি কাজটি (সিনেমা দেখা) সুচারুরূপে সম্পন্ন করলেন, তারপর ধীরে সুস্থে বাড়ি ফিরলেন। হীরেনকে দেখে পাড়ার ছেলেরা হৈহৈ করে উঠল। ‘কোথায় গিয়েছিলিসি। সব কটা কাগজ এসেছে তোর ইন্টারভিউ নেবে।’
    হীরেনের উত্তর ‘সিনেমা দেখতে’।
    প্রসঙ্গান্তরে গিয়ে দুটো ইন্টারভিউয়ের তুলনা টানলাম।
    সত্ত্ব, রজঃ, তমঃ, তিনটি গুণের মধ্যে হীরেনের মধ্যে সত্ত্ব গুণ উঁচু মাত্রায়। রজঃ তমঃ ভাবটি খুব নিচু, এই হলো হীরেন। প্যান্ট জিনস্ পরা একজন সাধু।
    ইজারলোনে ভাষা (ফ্রাঙ্কফুর্টে) শিক্ষা এবং বিভিন্ন দফতরে কাজ শেখার পরে নুরেমবেরগ অফিসে আমদানি ও রপ্তানির ব্যবসা ব্যাঙ্ক কিভাবে পরিচালনা করে একমাস তার শিক্ষা দেওয়া হবে। স্টেট ব্যাঙ্কে এটা শেখার সুযোগ হয়নি।
    ড্রেসনার ব্যাঙ্কের এক কর্মী,ফ্রাউ গিসালা ওয়েবার বাড়িতে থাকার ঠিকানা। সকালের জলখাবার ওনারাই সরবরাহ করবেন। এছাড়া রান্নাঘর বাসনপত্র সহ ব্যবহার করার সম্পূর্ণ অধিকার দেওয়া হলো। বোয়েকার পরিবারে সেই স্বাধীনতা ছিল না।
    ফ্রাঙ্কফুর্ট অফিসের ব্রিগিটে বলেছিলেন, ‘আপনি তো প্রায় বিদেশযাত্রা করছেন’, নুরেমবাগের ট্রেন টিকিট আমার হাতে ধরিয়ে দিয়ে আরও বললেন, কি ভাগ্যে ভিসা লাগে না ব্যাভেরিয়া যেতে। এই রসিকতা চালু ছিল বহুদিন।
    প্রাশিয়ান সম্রাটের প্রতিভু বিসমার্কের ‘জার্মানি এক হও’ এই ডাকে ব্যাভেরিয়ার রাজা লুডভিগ অবশেষে সাড়া দেন। সব ব্যাভেরিয়ানের মতে একান্ত অনিচ্ছায়। তিনি বার্লিনেও দেখা করতে যাননি। একটি টেলিগ্রাম পাঠিয়ে সংযুক্ত জার্মান রাষ্টের যোগদানের সম্মতি জানিয়েছিলেন। ফ্রাঙ্কফুর্ট ছাড়ালে মাইন নদীর দক্ষিণ তীর থেকে আল্পস অবধি বিস্তীর্ণ যে ভূখণ্ড, সেটিকে তাঁরাই স্বাধীন রাজ্য ব্যাভেরিয়া বলে আজও মনে করেন। (বায়ার্ন মিউনিক ফুটবল দল এখানকারের) ব্যাভেরিয়া সীমান্তের পুলিশও জার্মান নয়। ‘ব্যাভেরিয়ান সীমান্ত পুলিশ’।
    ফ্রাউ ওয়েবার ছেলেকে নিয়ে বাড়িতে থাকেন। বিবাহ বিচ্ছিন্ন হওয়ার পর। ছেলে উলিয়ান ফুটবল পাগল। বায়ার্ন মিউনিখের পাগল সমর্থক। ‘সান্ধ্যভোজনটা আমরা একসাথে সারলাম’। হীরেন উবাচ।
    ফ্রাউ ওয়েবার, ড্রেসনার ব্যাঙ্কের কর্মী, ঠিক করলেন, সকালে জলখাবারটা উনিই দেবেন।
    ব্যাঙ্ক অবধি পৌঁছে দিয়ে ফ্রাউ ওয়েবার হীরেনের দায়িত্বভার দিলেন ফ্রাউ ক্রিস্টিনে ব্লাই নামে এক অত্যন্ত আধুনিকার, যিনি মিউনিখে পড়াশোনা করেছেন। ক্রিস্টিনে যাঁর হাতে হীরেনকে সমর্পণ করলেন তাঁর নাম হেলমুট কোটশোয়ার, বৈদিশিক বাণিজ্য বিভাগের একজন আধিকারিক।
    নুরেমবেরগের সঙ্গে নাৎসি পার্টির সম্পর্ক অতি গভীর। ১৯৩৩ থেকে ১৯৩৮ সাল অবধি পার্টির বার্ষিক সম্মেলন হত এই শহরে। সাম্প্রতিক ইতিহাস জানতে হীরেন প্রবল ইচ্ছুক। কিন্তু এই ব্যাপারে এ দেশের মানুষের অনীহা প্রবল। হেলমুট প্রথম ব্যক্তি যিনি হীরেনকে অকপটে শোনালেন তাঁর অভিজ্ঞতার কাহিনি।
    হেলমুট কোটশোয়ার, ছোটোখাটো সাড়ে পাঁচফুটের মতো লম্বা হবেন। চুলে পাক ধরেছে, স্বল্প দাড়ি গোঁফ, কথা বলেন নিচু স্বরে। হেলমুট কোর্টশোয়ার এবং হীরেনের বন্ধুত্ব দীর্ঘদিন ছিল। অন্তত তাঁর অবসর প্রাপ্তি পর্যন্ত।
    ‘যুদ্ধের পরে জার্মানিতে যে ইকনমিক মিরাকল বা অলৌকিক অর্থনৈতিক উন্নয়ন বলে যেটা আপনারা জানেন, সেটা মোটেই অলৌকিক নয়। নিজের পেশি দেখিয়ে বলেছিলেন, ‘কোনো মিরাকল নয়, আমরা এই হাতের জোরে সেই অসাধ্য সাধন করেছি। ১৯৪৫ সালে যুদ্ধের শেষে নুরেমবেরগ শহর একেবারে ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছিল। সারাদিন হাজার হাজার মানুষের সঙ্গে বাবা-মাও পাথর জড়ো করেছেন, বয়ে নিয়ে গেছেন শহরে বাইরে।
    সন্ধেবেলা আমার বাবা পড়িয়েছেন স্কুলে। তিনি ছিলেন জিমেন্সের ইঞ্জিনিয়ার। যুদ্ধের শেষে যখৰ বাড়িঘর ভবিষ্যৎ সব হারিয়ে গেছে, এঁরা ভাঙা দেশকে এইভাবে গড়েছেন।
    হেলমুটের সঙ্গে লাঞ্চ করতে করতে হীরেন জিজ্ঞেস করলেন, ‘স্বস্তিকা আপনাদের দেশে নিষিদ্ধ প্রতীক কিন্তু আমাদের দেশে এটা সর্বত্র দেখবেন।’ হেলমুট বললেন, ‘মজার ব্যাপার আমাদের জানা ছিল না। শুধু ভারত কেন, পৃথিবীর নানান সভ্যতায় স্বস্তিকা দেখা যায়। কোরিয়া, তাইওয়ান এমনকি গ্রিক সভ্যতায়। কোরিয়াতে স্বস্তিকা বামমুখী। আপনাদের আর নাৎসিদের ডানমুখো।
    কেউ কিন্তু হিটলার বা নাৎসিদের নাম করে না। হেলমুট হীরেনকে নিয়ে গেলেন সরকারি লাইব্রেরিতে। হেলমুট দেখাচ্ছেন বিভিন্ন স্বস্তিকার ছবি। হঠাৎ একটি কমবয়সি ছেলে এসে হেলমুটকে বলল, ‘কেন এইসব নিষিদ্ধ শিল্প দেখাচ্ছেন বিদেশিদের? শিক্ষা হয়নি এখনও?’
    হেলমুট বললেন, ‘সরকারি লাইব্রেরি থেকে বন্ধুকে কিছু দেখাচ্ছি। এ বই কি এখানে নিষিদ্ধ?’ ছেলেটি মুখ ঘুরিয়ে চলে গেল।
    দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় হেলমুটের বয়স ষোলো। নাৎসি পার্টির বাৎসরিক সম্মেলন দেখেছেন দূর থেকে। ওর বয়সি ছেলেমেয়েরা কিছু না কিছু কাজের ভার পেতেন। কুচকাওয়াজ, পথ নাটিকা, ড্রাম বাজিয়ে গানের দল জড়ো হয়েছে। সকলেই হিটলার গ্রুস (স্যালুট) দিচ্ছেন।
    কংগ্রেস হবে। বিশাল স্টেডিয়াম বানানো হবে। স্কুল ছুটির পরে হেলমুট তার বন্ধুবান্ধব নিয়ে দেখতে যেতেন। শুরু হলো খননকার্য।
    ১৯৩৬ সালে বার্লিন অলিম্পিক। সারা পৃথিবী এসে পৌঁছেছে জার্মানিতে। ১৯৩৮ সালের পার্টি কংগ্রেসের (সেপ্টেম্বরে পার্টি কংগ্রেস হয়) ঠিক একমাস আগে একটা ঘটনা ঘটল। এখন যেখানে ড্রেসনার ব্যাঙ্কের অফিস, তার পিছনেই বিশাল আকারের সিনাগগ, ইহুদিদের সাধন মন্দির। আগস্ট মাস ভাঙা শুরু হল। পার্টি কংগ্রেসের কারণে সেই কাজ সম্পন্ন হতে একমাস লেগে গেল।
    নুরেমবেরগ শহের চার লক্ষ মানুষের বাস। তার মধ্যে ইহুদির সংখ্যা ৯ হাজার। কেন সিনাগগ ভাঙা হল, কেন ইহুদিদের দোকানপাট বন্ধ হল, কেন ইহুদিদের কাছ থেকে জিনিস কেনা বারণ হল, তা বোঝা গেল না। তারপর এলো ১৯৩৯ সালের পয়লা সেপ্টেম্বর।

    কালো ড্রেস পরে নাৎসিদের (যুবকদের) নিয়মিত মিছিল বেরোয়। ১৯৩৯, ১৯৪০, ১৯৪২ সালে শালকে জার্মান চ্যাম্পিয়ন হল। নুরেমবারগের দল শালকের কাছে কাপ ফাইনালে হেরে গেল এক বছর। রাপিড ভিয়েনা জার্মান চ্যাম্পিয়ন হল ১৯৪১ সালে। অস্ট্রিয়া আর জার্মানি তখন এক দেশ।
    স্কুল শেষে ১৯৪২ সালে। তখন হেলমুটের বয়স ১৮ বছর। বাবা বললেন ‘আর বিদ্যে বাড়িয়ে লাভ নেই। এবার আমাদের ছাপাখানায় দু-বছরের ট্রেনিং নাও। তারপরেই এখানে পাকা কাজে লেগে যাবে।’
    ১৯৪৩ সাল নাগাদ যুদ্ধ অনেক কাছাকাছি চলে এলো। রাতের আকাশে শত্রু বিমানের হানা। নুরেমবেরগ শহরের নীচে মধ্যযুগ থেকে আছে একটা বিশাল সুড়ঙ্গ। মানে বিয়ারের ভাঁড়ার। সেটা হলো বিমান আক্রমণের প্রতিরক্ষা আশ্রয়। তরুণ হেলমুট ও তার বন্ধুদের সেখানে কাজে লাগানো হলো। সুযোগ পেলেই মেয়েদের সঙ্গে ভুলভুলাইয়া খেলে। অ্যান্টি এয়ারক্রাফট লাগানো হলো। বুম বুম শব্দ। রাতের বেলা সকলকে বলা হয় সুড়ঙ্গে চলে যেতে। বোমা পড়ে। বাড়ি ঘরদোর সব ভাঙে। ইলেকট্রিকের পোল, জলের পাইপ সব ভেঙে চুরমার। দু-ঘণ্টার মধ্যে সব সারানো হয়। আবার জনজীবন স্বাভাবিক।
    ঘন জঙ্গলে বন্দুক ছোঁড়ার ট্রেনিং হলো। একদিন হেলমুট কিছু চেনা ছেলের সঙ্গে ট্রেনে উঠে বসল। ব্যারনড যিনি এখন ব্যাঙ্কে ইম্‌পোর্টের ব্যবসা দেখেন, খবরাখবর আনার ভার তাঁকে দেওয়া হলো। মোটরবাইকে চিঠিপত্র নেওয়া-দেওয়ার কাজ করেন। হেলমুটের ছোটোখাটো চেহারা দেখে তাকে দেওয়া হলো সেনা ছাউনিতে টেলিফোন বিভাগের কাজ। এবারে জানল যুদ্ধ কতটা কাছে এসে গেছে।
    ১৯৪৫ সালের জানুয়ারি মাসে ২ তারিখে এক পূর্ণিমার রাতে ভয়াবহ বোমাবর্ষণে বহু লোক মারা গেছে নুরেমবেরগে। নুরেমবেরগ একটা ধ্বংসস্তূপে পরিণত হলো।
    ব্যারনড বলল, চল বাড়ি ফিরি। হেলমুট আর ব্যারনড জঙ্গলের পথ ধরে এগোতে আরম্ভ করলো নুরেমবেরগের দিকে। হাতে একটা ফুটো পয়সা নেই। থাকলেও কিছু পাওয়া যেত না। দুই তরুণের ওপর দয়াপরবশত হয়ে চাষিরা তাদের আশ্রয় এবং অন্ন (ভিক্ষা) দিল, মানের খাবারদাবার।
    মার্চ মাস। ফ্রাঙ্কফুর্টের কাছাকাছি দেখা গেল মানুষের সারি। বড়ো রাস্তা ছাড়বার আর কোনো প্রয়োজন নেই। জনস্রোত পশ্চিমমুখী। শোনা যাচ্ছে রাশিয়ানরা পূর্বদিকে। ব্যারনড আর হেলমুটকে দেখে দু-চারজন প্রশ্ন করেল, পূর্বদিকে যাচ্ছ কেন? রাশিয়ানদের পাল্লায় পড়তে? না, তা নয়। তারা চেনে তাদের ছেড়ে আসা শহর নুরেমবেরগ। লাল টালির বাড়ি। পেগনিতস নদী। পাশে ফুটবল মাঠ। আর কোনো ঠিকানা মনে নেই।
    একটা ভগ্নবিশেষ খুঁজে পাওয়া গেল। সেটা হেলমুটদের বাড়ি। মা-বাবা দুজনেই বেঁচে আছেন। হেলমুটকে পেয়ে মা কাঁদলেন। বাবা বললেন, এবার কাজ শুরু করো। বাড়িটাকে বাসযোগ্য করতে হবে। আমেরিকান সৈন্য নুরেমবেরগ শহরের দখল নিয়েছে। বিশে (২০) এপ্রিল ঘটা করে তারা বিজয় দিবস পালন করবে।
    বিশে এপ্রিল ১৯৪৫। হিটলারের ৫৬তম জন্মদিন। জার্মানদের ধারণা হিটলার এখনও আছেন এবং যুদ্ধ পরিচালনা করছেন ব্যাভেরিয়ায় আর গোপন আস্তানা থেকে।
    এটা বই নয় যে হেলমুটের কথাগুলো কোনো ডায়েরি বা খাতায় হীরেন লিঘে রেখেছিলেন। স্রেফ স্মৃতির ওপর ভরসা করে লিখে গেছেন, এই অংশটা শেষ হয়ে এলো। আর একটু বাকি আছে। পাঁচ বছর যুদ্ধ চলেছে। কিন্তু ফুটবল লিগ বন্ধ হয়নি। ২৩ এপ্রিল বায়ার্ন মিউনিক ৩-২ গোলে হারাল মিউনিকের আর এক দলকে, টিএসডি’কে। জার্মানির আত্মসমর্পণ ৮ মে ১৯৪৫।
    হেলমুটের ছাপাখানা থেমে গেছে। দুধ রুটি অমিল। আগে বোমারু বিমান আক্রমণ থামলে ইলেকট্রিক ঠিক হয়ে যেত, কলে জলও আসত। এখন জল আসে না। মাইলের পর মাইল হেঁটে চাষিদের বাড়িতে অন্ন ভিক্ষা। বোমা গুলিতে কত লোক মারা গেছে। এখন খিদেতে, রোগে মৃত্যু, প্রত্যহ।
    এটা কি স্মৃতি। স্মৃতিশক্তি না মন্ত্রশক্তি? হীরেনের মাথায় কি মেমারি কার্ড আছ নাকি আর্টিফিসিয়াল ইন্‌টেলিজেন্স?
    হীরেন জার্মানির প্রাণকেন্দ্রে ঢুকেছেন এবং যে রি-সার্চ করেছেন তা প্রণিধানযোগ্য। পুরোনো শহর দেখানোর জন্য টুরিস্ট ধরার প্রয়োজন নেই। গোটা নুরেমবেরগ শহরটাই পুরোনো। অন্তত এক হাজার বছর মানুষ বাস করছে।
    রোমের পতনের চারশো বছর বাদে শারলামেন পোপ তৃতীয় লিওকে নারী এবং অর্থঘটিত সমস্যা থেকে উদ্ধার করলে, কৃতজ্ঞ পোপ তাঁকে সম্রাট পদে অভিষিক্ত করেন। পোপা যা ছুঁয়ে দেবেন সেটাই পবিত্র। শারলামেনের তিন ছেলে। নিজেদের মধ্যে মারামারি করার পর সন্ধি করলেন। শর্ত অনুযায়ী লোয়ার ও রোন নদীর পশ্চিমটা পেলেন চার্লস, আজকের ফ্রান্স, রাইনের পুরোটা পেলেন লুইস, আজকের জার্মানভাষী ইউরোপ, লোথার পেলেন হল্যান্ড থেকে ইতালির অংশ।
    ১৫২১ সালে ওয়রমস শহরের পার্লামেন্টে (ইম্পিরিয়াল ডিয়েটে) ঘোষিত হল মার্টিন লুথার বদ লোক। পোপ অভ্রান্ত। মার্টিন লুথার এই সহজ সত্যকে অস্বীকার করে। সুতরাং মার্টিন লুথার বধের যোগ্য।
    সাম্রাজ্যের সীমানা ছিল আজকের জার্মানি, দক্ষিণ ফ্রান্স, হল্যান্ডের কোনা থেকে ইতালি নিয়ে। মোটামুটি জার্মান রাজত্ব আর ভাষা। না আছে নিজেদের সৈন্য না আছে রাজধানী। ভোলতেয়ার বলেছিলেন, এটি পবিত্র নয়, রোমান তো নয়ই। সাম্রাজ্যটাই বা কোথায়? হয়তো এই কথা শুনে নেপোলিয়ন বন্দুক তরবারি চালিয়ে সেই সাম্রাজ্যের বারোটা বাজালেন। তবুও এই সাম্রাজ্য টিকেছিল বারোশো বছর।
    অঘোষিত রাজধানী বলে নুরেমবেরগের একটা বিশেষ সম্মান ছিল। দেওয়াল ঘেরা গোটা নুরেমবেরগের সেই দেওয়ালে তিনটি ফ্রেমে বাঁধানো ছবি দেখেছেন হীরেন । নীচে লেখা আছে গত পরশুর নুরেমবেরগ। মধ্যযুগের নুরেমবেরগের ছবি। মাঝের ছবিটি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে সম্পূর্ণ ধরাশায়ী বোমা বিধ্বস্ত শহর। গতকালের নুরেমবেরগ। তৃতীয় ফ্রেমে আপনি দেখছেন আজকের নুরেমবেরগ। তৃতীয় ফ্রেমে কোনো ছবিই নেই সেটা আজকের নুরেমবেরগ।
    ১৯৩৫ সালের সেপ্টেম্বর মাসে জাতিসম্পর্কিত আইন নথিবদ্ধ করেন জাতীয় সমাজতান্ত্রিক জার্মান শ্রমিক দল। তেরো বছর আগে তাঁদের নেতা লিখেছিলেন একটি গ্রন্থ। নাম ‘আমার সংগ্রাম’। সেখানে লেখা আছে ‘উচ্চতর ও নিম্নতর প্রজাতি’র মিলনের সন্তানসন্ততি হবে নিম্নমানের। ইহুদের সঙ্গে নীল রক্তের জার্মানদের বিবাহ বা বিবাহ-বহির্ভূত সম্মেলন বে-আইনি ঘোষিত হল। সামনেই বার্লিন অলিম্পিক। এতদিন সব চুপচাপ ছিলেন। অলিম্পিকের শেষে শুরু হলো নতুন আইনের খেলা। ইহুদি ব্যবসা বয়কট, ১৯৩৮ সালে সিনাগগ পোড়ানো। তারপর সোজাসুজি গ্যাস চেম্বার।
    ইহুদি নিধনের খতিয়ান দেওয়া যাক একটু পিছিয়ে অর্থাৎ পরশু দিনের নুরেমবেরগের।
    ১২৯৮-তে গির্জায় বন্টিত প্রসাদের অবমাননার দায়ে ৭২৮ জন ইহুদি নিধন। যদিও সে কারণ কখনও প্রমাণিত হয়নি। ফ্রাঙ্কনিয়া প্রদেশের দেড়শো গ্রামে ও শহরে বিশ হাজার ইহুদি হত্যা।
    ১৩৪৯ ইহুদির কারণেই প্লেগে মৃত্যু এই অভিযোগে ৫৬০ জন ইহুদি হত্যা। তাঁদের বাড়িঘর ভেঙে গির্জা প্রতিষ্ঠা, ড্রেসনার ব্যাঙ্কের সামনে যেটা এখন দেখা যায়।
    ১৩শ শতাব্দী থেকে ১৫শ শতাব্দী ইহুদিদের কোনো কাজ বা ব্যবসা করা বারণ। একমাত্র মাংস, ঘোড়ার ব্যবসা ও ধারের কারবার মঞ্জুর হলো।
    এই প্রসঙ্গে একটা তুলনা না টানলেই নয়। জাতীয় সমাজতান্ত্রিক জার্মান শ্রমিক দলের নেতার লেখা বইটি ‘আমার সংগ্রাম’, যেখানে লেখা আছে উচ্চতর ও নিম্নতর প্রজাতির মিলনের সন্তানসন্ততি হবে নিম্নমানের। এটার সঙ্গে আমাদের দেশের মনুসংহিতার বিশেষ সাদৃশ্য ল‍ক্ষ্য করা যায়।
    ১৪৬৭ খ্রিশ্চান হত্যার অপরাধে (অপ্রমাণিত) ১৮ জন ইহুদিকে পোড়ানো হয় সদর বাজারে।
    ১৪৯৮ সালে নুরেমবেরগ থেকে ইহুদি বিতাড়ন। সমস্ত সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত। সমাধিস্থল ভাঙা হলো। সমাধিপাথর গেল বাড়ি আর গির্জা বানানোর কাজে। দুশো বছর নুরেমবেরগ ইহুদি শূন্য। ১৭ শতকে ইহুদিদের প্রত্যাবর্তন। মাথা পিছু করের বিনিময়ে। রাজ্যে অর্থ সঙ্কট চলছে তখন। কিন্তু নাগরিকত্ব দেওয়া হলো না।
    ১৯৩৩ ইহুদিদের সংখ্যা ৯০০০।
    ১৯৩৫ জাতিগত আইন পাশ। ইহুদিদের ব্যবসা বন্ধ। জার্মান ইহুদি বিবাহ বন্ধ। বাড়িঘর লুঠ। ৪০০ ধনী ইহুদিকে দাঁত দিয়ে ঘাস কাটার কাজে লাগিয়েছেন ।
    ১৯৩৮ সিনাগগ পোড়ানো, গ্যাস চেম্বারে মানুষ পাঠানো শুরু। ১৯৪৫ মোট ইহুদিদের সংখ্যা ৬৮।
    পরশুদিন আর গতকালের কাহিনির পাশাপাশি রাখা বোধ হয় সমীচিন।
    নুরেমবেরগ শহর কর্তৃপক্ষ নাৎসি স্থাপত্যের সংরক্ষণ চান। সংস্কার নয়। যে মঞ্চে দাঁড়িয়ে হিটলার বক্তৃতা দিতেন সেটা একটু ভাঙাচোরা অবস্থায় আছে। মঞ্চের মাথার উপর স্বস্তিকাটি বোমা দিয়ে উড়িয়ে দেওয়া হয়েছে।
    মাঠের চারপাশের গ্যালারি আর নেই। নাৎসি প্যারেডের জন্য দু-কিলোমিটার দীর্ঘ, চল্লিশ বর্গ মিটার চওড়া বিশাল পথ তৈরি হয়েছিল। সেটি শেষ হবার আগেই যুদ্ধ বেধে যায়। প্যারেড হয়নি। সাদাকালো গ্রানাইট পাথরের সেই পথ এখনও আছে।
    শ্রীধর (হীরেনের সহকর্মী) আর হীরেন তার ওপর হেঁটে একটা সঙ্গীতানুষ্ঠানে যোগ দেন। দিনটা ছিল পয়লা সেপ্টেম্বর, ১৯৭৯, বিশ্বযুদ্ধ শুরু হওয়ার চল্লিশ বছর পূর্তি উপলক্ষে। মুখ্য শিল্পী এসিডিসি এবং আফ্রিকার অসামান্য গায়িকা মিরিয়াম মাতেবা। হাজার লোকের সমাবেশ।
    এই বিশাল ময়দানে দাঁড়িয়ে মানুষ শুনতো অ্যাডলফ হিটলারের বক্তৃতা। জনতা উদ্বুদ্ধ হয়ে তাঁকে শ্রম ও রক্তের শপথ দিয়েছেন। বক্তৃতা মঞ্চের পিছনে দেড়শোটি সার্চলাইট সোজা আকাশের দিকে উঠে আলোকস্তম্ভ তৈরি করে। আলবার্ট স্পেয়ারের অনন্য সৃষ্টি।
    এই সময়কার এক আশ্চর্য দলিল পাওয়া যায়। লেনি রিফেনসটালের ডকুমেন্টারি ছবি ‘সঙ্কল্পের জয়’। কোনো সংলাপ বা ধারাভাষ্য নেই। সামান্য কিছু শব্দ দিয়ে পরিচয় করিয়ে দিয়েছেন। বিষয়বস্তু বা বক্তার কাছে। নেপথ্য সঙ্গীত নেই। নেতাদের পূর্ণ বক্তৃতা নয়। মাত্র দু-চার লাইন।
    এবারে একটু সংক্ষেপ করা যাক। ৯ নভেম্বর ১৯২৩ সালে মিউনিকের ফেলডহেরনহাল থেকে মুষ্টিমেয় কিছু অনুসরণকারীকে নিয়ে ক্ষমতা দখলের প্রথম অভিযানে নামেন হিটলার। পুলিশের গুলিতে ষোলোজন প্রাণ দিলেন। সবচেয়ে কম বয়েস ছেলেটির নাম কার্ল লাফরস, বয়েস ১৮। হিটলারও আহত হয়েছিলেন, গ্রেপ্তারও হলেন। ব্যর্থ অভিযান।
    হিটলারের আত্মজীবনী মাইন কাম্ফ (আমার লড়াই) বইতে তাঁর দর্শন, দৃষ্টিভঙ্গি, ভবিষ্যতের পরিকল্পনা ব্যাখ্যা করেছেন। তাঁর মূল লেখায় বলেছেন, জার্মানি এবং অস্ট্রিয়াকে একত্র হয়ে মহান মাতৃভূমিতে পরিণত করতে হবে। জার্মান রক্ত যাঁদের শিরায় বইছে তাঁদের সকলের এক জার্মান পতাকার তলায় আসা প্রয়োজন।
    জানুয়ারি ১৯৩৩ ক্ষমতা অধিগ্রহণ। সেপ্টেম্বর মাসে বিশাল নাৎসি পার্টি কংগ্রেস নুরেমবেরগের জেপেলিনফেলডে। সেই মঞ্চে অধিষ্ঠিত অনেক মানুষের বিচার ও শাস্তি হয় আট কিলোমিটার দূরের একটি বিচার প্রাসাদে, ফুরথারস্ত্রাসের একশো দশ নম্বরে। অভ্যুদয় থেকে পতনের সময় বারো বছর। সাক্ষী নুরেমবেরগ।
    সেই ধ্বংসস্তূপের ওপরে নতুন জার্মানির জন্ম। বারো বছরের নাৎসি শাসনে ক্ষমতার উৎস ছিলেন হিটলার স্বয়ং। মানুষের অধিকার অথবা রাজনৈতিক মতান্তরের কোনো স্থান ছিল না।
    ১৯৪৯ সালে মে মাসে যে সংবিধান বলবৎ হলো তার প্রথম উনিশটি ধারায় প্রতিষ্ঠিত হয়েছে মানবিক অধিকার। কুড়ি নম্বর ধারায় বলা হয়েছে এই গণতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্রের সব অধিকারের উৎস জনগণ।
    মানবিক অধিকার এই তালিকায় সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য রাজনৈতিক আশ্রয় এবং উদ্বাস্তু পুনর্বাসন। যুদ্ধের পরে অনেক জার্মান পূর্ব ইউরোপের চেক, পোল্যান্ড ইত্যাদি নানান জায়গায় আটকা পড়েছিলেন। তাদের ফিরিয়ে আনার জন্য এটা জরুরি।
    সাতের দশকে ভারতীয় উপমহাদেশের কিছু মানুষ এই কানুনের সদ্ব্যবহার শুরু করেন। ফ্রাঙ্কফুর্ট বিমানবন্দরে নেমে পাসপোর্ট আধিকারিকের সমনে চিৎকার করে বলেন, আমি আমার দেশে, আমার নিজের রাজনৈতিক কারণে উৎপীড়িত হয়েছি। আমাকে আশ্রয় দিন। কেউ যদি জার্মানিতে রাজনৈতিক আশ্রয় চান, তবে তাঁকে ফিরতি প্লেনে তুলে দেওয়া হয় না। তবে কতখানি যুক্তিযুক্ত সেটা বিচার হবে। যতদিন তা না হচ্ছে ততক্ষণ এই মানুষগুলির শুধু থাকা খাওয়া নয়, তার জন্য যোগ্য অনুবাদকের ব্যবস্থাও জার্মান সরকার করবে।
    আরব দুনিয়াতে টালমাটাল চলছে। দলে দলে মানুষ ডিঙ্গিতে ভূমধ্যসাগর অতিক্রম করে সিরিয়া, তুরস্ক থেকে হেঁটে নিরাপদ আশ্রয়ের জন্য ইউরোপের দিকে চলেছেন। চ্যান্সেলর আঙ্গেলা মেরকেল ঘোষণা করলেন। জার্মানি দশ লক্ষ উদ্বাস্তুর পুনর্বাসন করবে।
    দুনিয়ার কোনো দেশের এই হিম্মত হয়নি। ইউরোপের বিভিন্ন দেশে তার বিরোধ চলছে। হাঙ্গেরিতে উঠেছে কাঁটা তারের বেড়া। ইতালির সমুদ্রতটে পুলিশ পাহারা। কিন্তু মিউনিক স্টেশনে সাধারণ মানুষ খাবার জামাকাপড় নিয়ে সিরিয়ান উদ্বাস্তুতে স্বাগত জানিয়েছেন। সরকার কোনো প্রতিরোধ না মেনে নিজেদের প্রচেষ্টায় স্থির থেকেছেন।
    হীরেনের কথায়, ‘সবার উপরে মানুষ সত্য। মাতৃসমা আঙ্গেলা মেরকেল বললেন, ‘‘আমরা এটা পারি।’’ হীরেন বললেন ‘‘মাতৃসমা’’। বিদেশে জন্মেছেন বা বিদেশি পিতামাতার সন্তান এমন নাগরিকের সংখ্যা এক কোটির বেশি। অভিবাসিদের গ্রহণ করা, সম্মান দেওয়া, সমাজে তাদের স্থান তৈরি করে দেওয়ার ব্যাপারে জার্মানির স্থান মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র আর সৌদির আরবের পরেই।
    নুরেমবেরগের তিনটে ফ্রেমঅলা ছবির কথা মনে আছে? ‘পরশু, কাল আর আজ!’ আরো একটা ছবি হবে ‘‘আগামীকালের প্রতিশ্রুতি’’।
    ‘মাতৃসমা’ বলার কারণ, যে কোনো আশ্রয়প্রার্থীকে আঙ্গেলা মেরকেল কোনো রকম পক্ষপাতিত্ব না করে সন্তানের মতো দেখেছেন।
    সবটাই ইতিহাস চলছে। এবার অন্য এক ইতিহাস বলা যাক। হীরেনের গবেষণালব্ধ ফল।
    হীরেন গাড়ি নিয়ে বেরিয়েছিলেন অফিসের ব্যবসার কারণে। যাবেন হেরজোগেন আউরাখ । সেখানে আদিদাস বলে একটা কোম্পানি আছে। যার নাম প্রথম শোনেন ড্রেসনার ব্যাঙ্কের এক্সপোর্ট ডিপার্টমেন্টে। আদিদাস কেবল জুতো বানাতেন। আডলফের ডাকনাম আদি আর দাসলারের দাস। তারপর বানালেন খেলার জুতো। দুই ভাই। রুডলফ আর আডলফ দাসলার।
    কোনো কারণে দুই ভাইয়ের মুখ দেখাদেখি বন্ধ হয়ে গেল। ছোটো ভাইয়ের আদিদাস। বড়ো ভাই প্রথমে তার কোম্পানির নাম রাখেন রুডা (রুডলফ দাসলার) সেটি বদলে নাম দিলেন পুমা। হেরজোগেন আউরাখে দু-ভাইয়ের কারখানা দু-পাশে। এখন দুই কোম্পানি বিশ্বব্যাপী। দুটো ফুটবল টিম। চার বছর আগে পরে দু-ভাই মারা যান। পারিবারিক সমাধিক্ষেত্রে তাদের শেষ শয্যা হয়েছে দু-প্রান্তে।
    এবারে ইতিহাস মিশ্রিত রসিকতায় আসা যাক। হীরেন বলছেন, ‘তিরিশ বছর আগে টেলিফোন করেছি, সাক্ষাৎকারের অনুমতি চেয়ে। সিটি ব্যাঙ্কের সঙ্গে তাঁরা নিশ্চয় দেখা করবেন, তবে একটা প্রশ্ন আছে। সিটি ব্যাঙ্ক কি হেরজোগেনআউরাখে অন্য কোনো বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে পরিচিত? জানি এর একটাই উত্তর। আজ্ঞে না। আদিদাস ছাড়া আমরা তো দাস বংশ কেন, অন্য কোনো বংশের নাম কখনো শুনিনি।’

    এই প্রতিবেদকের নাম মিলন দাস। খোঁচাটা এই দাসকে নয় তো?


    আগামী সংখ্যায় সমাপ্য

    আমার জার্মানি
    প্রকাশক দে পাবলিকেশন
    ১৩ বঙ্কিম চট্টোপাধ্যায় স্ট্রিট
    কলেজ স্ট্রিট বই পাড়া
    কলকাতা ৭০০ ০৭৩

    প্রাপ্তিস্থান
    দে পাবলিকেশন ( আদি দে বুক স্টোর)
    দেজ পাবলিশিং ও দে বুক স্টোর ( দিপু)
    হোয়াটসঅ্যাপ +৯১ ৮৩৩৫০ ৩২৫৪৫ ( তপন দে )
    অর্ডার: deypublications.com
    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক।
    প্রথম পর্ব | দ্বিতীয় পর্ব
  • পড়াবই | ১৭ ডিসেম্বর ২০২৩ | ১৪৯১ বার পঠিত
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • | ১৯ ডিসেম্বর ২০২৩ ১৩:৪৬527063
  • গোটা বই থেকে ধড়াদ্ধড় কপি মেরে দেওয়াকে ঠিক রিভিউ বলে না।
    এই  বইটা আমি পড়েছি। এটার রিভিউ করা যায় কিনা নিশ্চিত নই, বরং বইটাকে পাঠকের সাথে পরিচয় করানো যেতে পারে।
  • মোহাম্মদ কাজী মামুন | ২০ ডিসেম্বর ২০২৩ ২০:৩৫527097
  • বইটার কয়েকটা চাপ্টার পড়ার সৌভাগ্য হয়েছে। বইটি শ্রদ্ধেয় হীরেনদাই সুদূর বিদেশ থেকে পাঠিয়েছিলেন। আমার মত ছোটখাট মানুষের জন্য খুব দামী আর ভারী এই উপহার! কিন্তু বইটির গদ্য আবার অসম্ভব হালকা-পলকা। এবং মধুর। যারা জ্ঞানের রাজ্য পাড়ি দিতে চান, তাদের জন্য এ  যেন এক প্রমোদ তরী যা বয়ে চলতে চলতে এক অপূর্ব আনন্দ শিহরণ ভাসিয়ে নিয়ে যায়। কত যে তথ্য, কত যে কাহিনি, কত জীবনের শিক্ষা - তবু কোথাও নিরেট সিমেন্টের বাঁধন নেই!   খুব সুন্দর প্রচ্ছদ, চোখ জুড়ানো মুদ্রণ মান। 
  • জয় | ২৫ ডিসেম্বর ২০২৩ ২১:১৮527170
  • “বার্লিনের চার দশক”এ আটকে গেছি, হীরেনদা। আপনি Weimar (সঠিক উচ্চারণ টা কি?) Renaissance এর সংগে পরিচয় করিয়ে দিচ্ছেন যেখানে। কিছুই জানতাম না। ধন্যবাদ। ভারী অদ্ভুত লাগে। রাজনীতি আর অর্থনীতির ডামাডোলে মধ্যে হিটলার সলতে পাকাচ্ছে একদিকে। অন্যদিকে বার্লিন হয়ে উঠেছে ইউরোপের কালচারাল এপিসেন্টার। বিজ্ঞান, সিনেমা,  সাহিত্য, থিয়েটার , শিল্পকলা থেকে শুরু করে নারীশক্তি ও অন্যরকম যৌনতার আধুনিক আন্দোলনের পীঠস্থান বার্লিন। ইতিহাসে এই দুই ধারা একই সময়ে, একই স্হানে? আজ মনে হচ্ছে হয়ত হিটলার অবশ্যম্ভাবী ছিল না। একটু এদিক ওদিক হলে ইতিহাস কি অন্যখাতে বইত? চারপাশের দক্ষিনপন্থার রমরমা কে ইতিহাসের চক্রবৎ খেলা ভেবে আত্মসমর্পন করা বোধহয় ঠিক হচ্ছেনা।
  • হীরেন সিংহরায় | ৩১ ডিসেম্বর ২০২৩ ১২:৪৪527301
  •  এই কথাগুলি টেলিপ্যাথিক! ঠিক এইটেই আমার একটা বইয়ের বিষয় হবে। বার্লিন ১৯১৮-১৯৩৩ আমাকে স্বপ্নে তাড়া করে। একটু এদিক ওদিক হলে ইতিহাস অন্য খাতে বইতো - অন্য দিকে হিটলার কোন নতুন কথা বলেন নি( গ্যাস চেম্বার বাদে)!
     
    Weimar এর উচ্চারণ ভাইমার। প্রসঙ্গত ভাইমার সংবিধান প্রণেতারা   গণতন্ত্র সংহার করার কিছু শক্তি শেল হয়তো আপন অজান্তেই তার ভেতরে রেখে গেছেন যার কিছু ছায়া আমাদের সংবিধানে পাওয়া যায়  
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : guruchandali@gmail.com ।


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। না ঘাবড়ে প্রতিক্রিয়া দিন