এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • হরিদাস পাল  ধারাবাহিক  উপন্যাস

  • ময়ূরঝর্ণা - পর্ব ৪ 

    বিতনু চট্টোপাধ্যায় লেখকের গ্রাহক হোন
    ধারাবাহিক | উপন্যাস | ০৮ ডিসেম্বর ২০২৩ | ৮৬৪ বার পঠিত
  • তেল কিনতে বেরিয়ে হঠাৎই অন্ধকার ফুঁড়ে সামনে এসে দাঁড়ানো এই অনন্তকে দেখে চমকে উঠেছিল জবা। এতটাই ঘাবড়ে গিয়েছিল, প্রথমে কিছু বলতেই পারেনি।
    ‘কেমন আছিস? বাড়িতে সবাই ভালো?’
    ‘ভালো আছি অনন্তদা।’
    ‘বাড়িতে এসেছিলাম বাবা-মাকে দেখতে, এখনই চলে যাব। তুই তো পড়া ছেড়ে দিয়েছিস শুনলাম, আমাদের সঙ্গে যাবি?’
    অনন্তর প্রশ্ন শুনে চুপ করে দাঁড়িয়েছিল জবা। এই প্রশ্নের জন্য কোনও প্রস্তুতি ছিল না তার।
    ‘দু’বেলা খাবার পাবি, বাবা, মা, বোনদেরও একটু দেখতে পারবি।’
    আর কিছু ভাবার ছিল না জবার, ‘যাব অনন্তদা।’
    ‘ঠিক আছে, আমি সামনের অমাবস্যার দিন আসব, রেডি থাকিস। আর কাউকে কিছু বলবি না। সন্ধে সাতটায় ঠিক এখানে চলে আসবি, কেউ যেন কিছু জানতে না পারে,’ কথাগুলো বলেই অন্ধকারে মিলিয়ে গিয়েছিল অনন্ত। জবা জিজ্ঞেস করারও সময় পায়নি অনন্ত কেমন আছে।
    তারপর থেকেই শুধু দিন গুণেছে জবা, কবে আসবে অমাবস্যা। অবশেষে সেদিন এল, আর পাঁচটা দিনের মতো মায়ের সঙ্গে জবারা তিন বোন সকাল সকাল গিয়েছিল জঙ্গলে। রোজ বেলা তিনটে-চারটের মধ্যে ফিরে আসে, সেদিন মাকে বলে একটু আগেই বাড়ি ফিরে এল জবা। মাথার কাঠগুলো নামিয়ে রাখল উঠোনের এক কোণে। এগিয়ে গেল বাবার দিকে। ঘরের ঠিক বাইরে মাটির বারান্দায় খাটিয়ায়  শুয়ে আছে বাবা। চোখ দুটো বন্ধ, একটা হাত ভাঁজ করে মাথার ওপর রাখা। গত ক’দিন ধরে বাবার শরীরটা আবার খারাপ হয়েছে, কাজে যেতে পারছে না। জবা বাবার খাটিয়ার পাশে গিয়ে দাঁড়াল।
    ‘বাবা, শরীর ঠিক আছে এখন?’
     
    ‘হ্যাঁ রে, কাল ভাবছি কাজে যাব।’ বাবার গলায় কাজে যেতে না পারার অপরাধবোধ, যা অপরাধী করে দেয় জবাকে। তার মনে হয়, শরীর কেমন আছে জিজ্ঞেস না করলেই ভালো হত। সে তো জানে বাবার শরীর ভালো নেই, টানা দাঁড়িয়েও থাকতে পারে না বেশিক্ষণ। কীভাবে সারাদিন পাথর ভাঙার কাজ করবে। গত এক বছর ধরে তো এরকমই চলছে, দিন দিন আরও খারাপ হচ্ছে। আরও রোগা হয়ে গেছে বাবা। প্রথম যখন শরীরে গোলমাল ধরা পড়ে বাবাকে ঝিলিমিলি স্বাস্থ্য কেন্দ্রে নিয়ে গিয়েছিল জবা। ডাক্তার বলেছিল লিভার বড় হয়েছে, সেখানে কিছু হবে না, বাঁকুড়া বা মেদিনীপুর নিয়ে যেতে। কিন্তু অত দূর বাবাকে নিয়ে যাওয়ার সামর্থ ছিল না তাদের। বাবা নিজেও চায়নি তার চিকিৎসার জন্য কাজের ক্ষতি হোক। একদিন কাজ না করলে তো খাবার বন্ধ। তারপর কিছুদিন ভালো ছিল, গত তিন মাস ধরে দিন দিন বাবার অবস্থা খারাপ হয়েছে।
    ‘না বাবা, কাজে যাওয়ার জন্য বলছি না,’ কোনওভাবে নীচু স্বরে বলল জবা। তারপর বসল বাবার খাটিয়ায়। তার মনে হল, অনেকদিন বাবার এত কাছে বসেনি। তাকিয়ে থাকল বাবার মুখের দিকে। কিন্তু কী বলবে? কথা খুঁজে পেল না জবা, চুপ করে বসে থাকে।
    ‘কিছু বলবি?’ একটু উঠে বসল শ্রীমন্ত সর্দার, তাকাল মেয়ের দিকে।
    ‘না বাবা,’ বলেই উঠে পড়ল জবা। তার মনে হল, আর এক মিনিটও বসলে বাবা ঠিক বুঝে যাবে কিছু। তার ভীষণ ইচ্ছে করল বাবার মাথায় একবার হাত বুলিয়ে দেয়, পারল না। দৌড়ে বারান্দা থেকে নেমে গামছাটা হাতে নিয়ে এগোল বাড়ির পিছনের পুকুরের দিকে। শ্রীমন্ত সর্দার কী বুঝল কে জানে, আবার শুয়ে পড়ল খাটিয়ায়। পুকুরে হাত, মুখ ধুয়ে ফিরে ঘরে ঢোকার সময় জবা দেখল বাবা চোখ বন্ধ করে শুয়ে আছে, গালে অনেক দিন না কাটা দাড়ি, মাথার চুলগুলো এলোমেলো, প্রায় পাট কাঠির মতো সরু হাত দুটো বুকের ওপর রাখা। জবার মনে হল বাবা কাঁদছে, ভাঙা গাল দুটো ভিজে গেছে চোখের জলে। মা, দুই বোন ফিরে এসেছে। তাদের সামনে স্বাভাবিক থাকতে হবে, জবা গামছাটা দিয়ে নিজের মুখ, চোখ ভালো করে মুছল। তারপর ঘরের কোণে রাখা কাঠের বাক্সটা খুলে জর্দার কৌটো বের করল। জমানো কিছু টাকা ছিল, জবা দেখল সতেরো টাকা আছে। দুই বোনকে পাঁচ টাকা করে দিল, বাকিটা হাতে নিয়ে বেরোল ঘর থেকে।
     
    প্রায় সাড়ে ছ’টা বাজে, সন্ধে নেমে গিয়েছে। আজ তো আবার অমাবস্যা। রীতিমতো প্রস্তুতি নিয়ে আগাম ঘোষণা করে ঘন অন্ধকার নেমেছে বেলপাহাড়িজুড়ে, শুধু বাঁশপাহাড়ির জগদ্বন্ধু মাহাতোদের বাড়িতে হ্যাজাক, হ্যারিকেনের আলো জ্বলছে। বাকি সব ঘর অন্ধকার, সামান্য দু’এক ঘরে জ্বলছে কুপি। ‘মা আজ একটু ডিমের ঝোল করবে?’ মেয়ের প্রশ্নে চুপ করে থাকল লক্ষ্মী সর্দার। জবা তো জানে ঘরে ডিম নেই, তাও প্রশ্নটা করল। বাড়ি থেকে বেরনোর একটা উপায় বের করতে হবে তো!
    ‘দাঁড়াও, আমি দীনু কাকার দোকান থেকে ডিম কিনে আনি,’ বলেই জবা পা বাড়াল। ঠিক সাতটায় আসবে বলেছে অনন্তদা। বাড়ি থেকে পাঁচ মিনিটের রাস্তা সাড়ে তিন মিনিটে পৌঁছে দোকান থেকে ডিম কিনল জবা। সে খাওয়ার সময় পাবে না, তাও পাঁচটা ডিমই কিনল। তারপর একটু সরে বট গাছটার আড়ালে গিয়ে দাঁড়াল। মিনিট পনেরো পর এল অনন্ত। লম্বা লম্বা পা ফেলে অনন্তর হাঁটা দেখে জবা চিনতে পারল, বেরিয়ে এল গাছের আড়াল থেকে। যদিও কোথাও কেউ নেই, তবু সতর্কভাবে এদিক-ওদিক দেখে জবার কানের কাছে মুখ অনন্ত বলল, ‘রেডি তো?’
    ‘হ্যাঁ’
    ‘একটা-দুটো জামা, গামছা, কিছু নিসনি?’
    ‘গুছিয়ে রেখেছি, যাওয়ার সময় হাতে করে নিয়ে নেব। ডিম কেনার নাম করে বেরিয়েছি বাড়ি থেকে।’
    ‘ঠিক আছে, আমি এগোচ্ছি। জামা-কাপড়ের প্যাকেটটা নিয়ে মিনিট দশেকের মধ্যে চলে আয়, আর দেরি করা যাবে না। আমি বাঁশপাহাড়ির মোড়ে মিষ্টির দোকান ছাড়িয়ে নিম গাছটার নীচে অপেক্ষা করছি,’ বলেই যেভাবে এসেছিল সেভাবে লম্বা পা ফেলে হাঁটা দিল অনন্ত।
    জবা ছুটল বাড়ির দিকে। বিকেলে ঘরে ফিরেই দুটো জামা, চিরুনি, গায়ের চাদর পলিথিনের প্যাকেটে ভরে ঘরের পিছনে পেয়ারা গাছের গোঁড়ায় রেখে এসেছে সে। হাতে প্যাকেট নিয়ে ঘর থেকে বেরোলে ঠিক কারও চোখে পড়বে। ঘরে ফিরেই মা’র হাতে ডিমের প্যাকেটটা ধরিয়ে দিল জবা। গিয়ে দাঁড়াল বাবার খাটিয়াটার পাশে, কিন্তু কিছু বলতে পারল না।
    ‘মা, দীনু কাকা খুচরো পয়সা দিতে গোলমাল করেছে। আমি একটু দোকান থেকে ঘুরে আসছি,’ বলেই আর দাঁড়াল না জবা, তাকালো না কারও মুখের দিকে, অপেক্ষা করল না জবাবেরও। বেরিয়ে গেল বাড়ি থেকে।
     
    আজ এত মাস বাদে এই লোকটার দিকে তাকিয়ে বাড়ি ছাড়ার দিন সন্ধ্যায় দেখা বাবার মুখটা মনে পড়ে গেল জবার। এই লোকটার কান্না দেখে মনে পড়ল সেদিন বাবার চোখ বেয়ে নেমে আসা জলের কথা। মনে হল, সেদিনও বাবা অনেক কিছু বলতে চাইছিল, বলতে পারেনি। তার বদলে শূন্য চোখে তাকিয়েছিল তার দিকে, যে চোখের দিকে বেশিক্ষণ তাকাতে পারেনি সে। তার মনে হচ্ছিল, বেশিক্ষণ বাবার পাশে বসলে অদৃশ্য যে জলের ধারা বাবার ভাঙা দু’গালে সে দেখতে পাচ্ছে তাই দৃশ্যমান হয়ে উঠবে। আজ এই মানুষটাকে দেখে একইরকম মনে হচ্ছে জবার, একটু এগিয়ে আস্তে করে লোকটার কাঁধে হাত রাখল। তারপর আবার বলল, ‘কাকা কী হয়েছে? শরীর খারাপ করছে? দাদা কী জানতে চাইছে বল...।’ মেয়েটার কথায় যেন মনের জোর ফিরে পেল লোকটা।
    শরীর, মনের সব শক্তি এক জায়গায় এনে সে বলে, ‘আমার নাম সুবল মান্ডি, বাড়ি ময়ূরঝর্ণা। বাড়িতে বউয়ের তিন দিন ধরে জ্বর। বউকে ডাক্তার দেখাতে নিয়ে যেতে পারছি না। কীভাবে যাব, কোনও কাজ নেই, খাবার পয়সা নেই। দুই ছেলে, এক মেয়েকে নিয়ে কোনও ভাবে চলে আমাদের,’ একটু দম নেয় লোকটা। এদিক-ওদিক একবার দেখে।  সবাই তাকিয়ে আছে তার দিকে। এরপর গলায় আরও জোর এনে সুবল মান্ডি বলে, ‘আমি চাই হাসপাতাল চাকাডোবাতেই হোক, এখানে যদি হাসপাতাল থাকত তবে তো বউটার চিকিৎসা করতে পারতাম।’ আর কিছু বলতে পারে না সুবল মান্ডি। যেভাবে হঠাৎ কথা শুরু করেছিল, সেভাবে হঠাৎই থেমে যায় সে।
    এই পরিস্থিতির জন্যই যেন অপেক্ষা করছিল এত বড় জমায়েতটা। ঝাড়গ্রাম মহকুমার বেলপাহাড়ির এক প্রান্তিক গ্রাম ময়ূরঝর্ণার কোন এক হতদরিদ্র দিন মজুর সুবল মান্ডি যেই না বলল হাসপাতাল চাই চাকাডোবাতেই, মিটিংয়ে আসা সমস্ত মানুষের যেন প্রাণ প্রতিষ্ঠা হল, নির্বাক মুখগুলো ভাষা পেল। মেঘ কেটে ঝলমল করছে চাকাডোবার আকাশ, প্রতিটা মানুষের মুখ প্রায় স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। এই সময়টার জন্যই অপেক্ষা করছিল সুকান্ত। রিলে রেসে দুই সেরা দৌড়বীর যেভাবে ব্যাটনের হাতবদল করে, সেভাবেই সুবল মান্ডির কথা ছিনিয়ে নিয়ে সুকান্ত বলে, ‘আপনারা সবাই বলুন, আপনারা কী চান? আপনারা যদি চান স্বাস্থ্য কেন্দ্র চাকাডোবায় হোক, তবে কাল থেকেই এই আন্দোলন শুরু করব আমরা। এই দাবি আদায় করে তবেই থামব।’
     
    সুকান্তকে আর কিছু বলতে হল না, তার প্রস্তুত করা জমিতে ম্যাজিক দেখিয়ে দিল সুবল মান্ডির নীরবতা, চোখের জল আর কয়েকটা মাত্র বাক্য। এ এমন ম্যাজিক যা টিকিট কেটে কলকাতার মহাজাতি সদনে দেখা যায় না, এমন ম্যাজিক দেখাতে গিয়ে ফেল মেরে যায় রাজনীতির আচ্ছা আচ্ছা কারবারি, এ এমন ম্যাজিক যা উত্তরাধিকার সূত্রে শেখা যায় না। তেমনই এক ম্যাজিক ঘটে গেল চাকাডোবা ফুটবল মাঠে। বাঁশপাহাড়ি থেকে ভূলাভেদা, চাকাডোবা থেকে কাঁকড়াঝোড়, বিভিন্ন গ্রাম থেকে আসা মানুষগুলো উঠ দাঁড়াল, তারপর সবাই প্রায় এক সঙ্গে বলে উঠল, আমরা চাই বাঁশপাহাড়িতে নয়, চাকাডোবাতেই এই স্বাস্থ্য কেন্দ্র হোক। এক অদ্ভুত দৃশ্য জন্ম নিল চাকাডোবার মাঠে। এটা বিংশ শতাব্দীর নয়ের দশকের শেষভাগ। কোথায় প্রশাসন, কোথায় সরকার, কোথায় শাসক দল, কোথায়ই বা বিরোধীরা, কেউ জানল না, কেউ টের পেল না বেলপাহাড়ির চাকাডোবা ফুটবল মাঠে যে স্ফুলিঙ্গের জন্ম হল, তা দ্রুত ছড়িয়ে পড়তে চলেছে গ্রামের পর গ্রামে। এরপর জঙ্গলমহলের একের পর এক গ্রামে নানান দাবি নিয়ে এমন অনেক ম্যাজিক শো হবে, যা থেকে জন্ম নেওয়া প্রতিটা স্ফুলিঙ্গ আগামী দিনে গণআন্দোলনের চেহারা নেবে।
     
    ‘আমি আর সময় নেব না, অনেক রাত হয়েছে, আপনাদের বাড়ি ফিরতে হবে। আপনাদের কথামতো আমরা এই আন্দোলনের সামনে থাকব। কাল থেকেই শুরু হয়ে যাবে কর্মসূচি। আমি মাঝে মাঝে আসব, কিন্তু এই আন্দোলনের নেতৃত্বে থাকবে আমাদের দুই কম বয়সী কমরেড অনন্ত আর জবা। ওরা আপনাদের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ রাখবে।’ একথা বলে সুকান্ত কাছে ডাকল অনন্ত আর জবাকে। তারপর দুটো হাত মুষ্টিবদ্ধ করে আকাশের দিকে তুলে স্লোগানের মতো করে বলে উঠল, ‘চাকাডোবাতেই স্বাস্থ্য কেন্দ্র গড়তে হবে, বাঁশপাহাড়ির স্বাস্থ্য কেন্দ্র বাতিল কর।’ তার সঙ্গে গোটা জমায়েতটা একই স্লোগান তুলল। শপথ বাক্য পাঠ করে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হল মানুষগুলো। থেমে গেল স্লোগান। সবাই একটু ছড়িয়ে ছিটিয়ে যা যার বাড়ি ফেরার উদ্যোগ নিল। সুকান্ত এবং তার সঙ্গে লোকগুলো একত্রিত হল ফেরার জন্য। অনন্ত, জবা, বলরাম, সাঁওতা, চারজনকে আজকের রাতটা চাকাডোবাতেই থাকার কথা বলে নিজের বাকি সঙ্গীদের নিয়ে ফেরার তোড়জোড় করল সুকান্ত। ঠিক সেই সময় ভিড়ের মধ্যে থেকে একজন এগিয়ে এল তার দিকে। লোকটার নাম সহদেব সিংহ সর্দার। বাড়ি চাকাডোবারই বাঁশলাটা গ্রামে। সহদেব বসেছিল একদম প্রথম সারির ডানদিকের কোণায়, মিটিং করার সময় তাকে দেখতেও পেয়েছিল সুকান্ত। কিন্তু সহদেব আর সে যে পরস্পরকে চেনে তা বুঝতে দেয়নি কাউকে। সহদেব কিছু একটা বলল সুকান্তর কানের কাছে এসে। ফেরার জন্য পা বাড়িয়েছিল সুকান্ত। সহদেবের কথা শুনে ঘাড় ঘোরাল সে, এগিয়ে গেল সেই সুবল মান্ডির দিকে। সুবল মান্ডির কাঁধে রাখল একটা হাত, ‘আপনি চিন্তা করবেন না। আপনার বউয়ের জ্বর সেরে যাবে। আমরা আছি আপনার সঙ্গে।’ কথাগুলো বলেই সঙ্গীদের নিয়ে হনহন করে গোল পোস্টের দিকে এগিয়ে গেল সুকান্ত। মিনিট খানেকের মধ্যে ঘন অন্ধকারে অদৃশ্য হয়ে গেল তারা। সুবল মান্ডি পা বাড়াল বাড়ির দিকে, তার কাছে দৌড়ে এল জবা।
    ‘কাকা বাড়িতে রাতের খাবার আছে?’
    ‘রুটি কিনে নিয়ে যাব বাড়িতে বলে এসেছি।’
    ‘কাকা এক মিনিট দাঁড়াও,’ বলেই অনন্তর দিকে ছুটে গেল জবা।
    ‘অনন্তদা দুটো টাকা হবে?’
    একটা এক টাকার নোট আর দুটো আধুলি এনে সুবল মান্ডির হাতে দিল জবা, ‘দোকান থেকে মিষ্টি কিনে নিয়ে যেও।’ না করতে পারল না সুবল, টাকাটা নিয়ে পা বাড়াল বাড়ির দিকে।
     
    চাকাডোবার মাঠ এখন ফাঁকা, সবাই যে যার মতো বাড়ি চলে গিয়েছে। মাঠের এক ধারে চুপচাপ বসে আছে চারজন। অনন্ত, জবা, সাঁওতা আর বলরাম। চারজনের মধ্যে সবচেয়ে বেশি দিন সংগঠনে আছে বলরাম। বলরাম সোরেন, বাড়ি বাঁকুড়ার খাতরায়। চারজন বসে কিছুক্ষণ কথা বলল। তারপর খেতে বসে গেল তারা। মাথাপিছু চারটে রুটি, একটা রসগোল্লা। রসগোল্লার রসে রুটি ডুবিয়ে খেতে খেতে নিজেরা ঠিক করে নিল, কাল থেকেই গোটা এলাকায় মানুষের মধ্যে প্রচার শুরু করতে হবে। দুটো দলে ভাগ হয়ে তারা গ্রামে গ্রামে যাবে। খাওয়া শেষ করে একটু দূরে দাঁড়িয়ে বিড়ি ধরাল বলরাম আর সাঁওতা। এই ফাঁকাটুকুই খুঁজছিল জবা।
    ‘আচ্ছা অনন্তদা, আমাদের বাড়ি বাঁশপাহাড়িতে বলেই কি স্বাস্থ্য কেন্দ্র বাঁশপাহাড়ির বদলে চাকাডোবায় করার আন্দোলনের দায়িত্ব সুকান্তদা আমাদের দিল,’ গলা নামিয়ে প্রশ্নটা করল জবা।
    জবার প্রশ্নে চমকে উঠল অনন্ত। তার তো মাথায় আসেনি এমনতারা কথা। জবার নিরীহ প্রশ্নের কোনও জবাব খুঁজে পেল না বাঁশপাহাড়ি তো বটেই, গোটা বেলপাহাড়িরই সেরা ছাত্র অনন্ত পাল। শুধু বলল, ‘এর পিছনে কী কারণ, কোনও রাজনীতি আছে কিনা জানি না। তবে বাঁশপাহাড়ি, চাকাডোবা, প্রপার বেলপাহাড়ির গরিব মানুষের মধ্যে কোনও বিরোধ নেই।’
    আরও কিছুক্ষণ গল্প করল চারজন। কোনও আন্দোলনের বা বিপ্লবের কথা না, মাওবাদ-মার্ক্সবাদের কথা না, সংগঠনের কথাও না। উনিশ থেকে বাইশের চারটে ছেলে-মেয়ে আলোচনা করল নিজেদের বাড়ির অবস্থা, বাবা-মায়ের শরীর স্বাস্থ্য, ভাই-বোনের সঙ্গে অনেক দিন দেখা না হওয়ার দুঃখের কথা নিয়ে। তারপর আস্তে আস্তে শোওয়ার প্রস্তুতি নিল তারা। চাকাডোবা মাঠের এক ধারে সিমেন্টে বাঁধানো একটা চাতাল। সেখানে যে যার চাদর পেতে শুয়ে পড়ল। যাদের জন্য আন্দোলন তারা বাড়ি চলে গিয়েছে অনেকক্ষণ। সেই মানুষগুলোর মতোই গরিব পরিবারে জন্মানো চারটে ছেলে-মেয়ে খোলা আকাশের নীচে শুয়ে ঝলমলে চাঁদের আলোয় এই স্বপ্ন দেখতে দেখতে ঘুমিয়ে পড়ল, একদিন এই অন্ধকার কেটে যাবে। সবার জীবনে আলো ফুটবে। দিন একদিন পালটাবে, পালটাবেই।
     
    সেই সময়ের কাছাকাছি ঝাড়গ্রামে কোয়ার্টারে ফিরে রাতের খাবার শেষ করে সিগারেটের প্যাকেটটা নিয়ে সোফাস বসে টিভি চালাল অনিরুদ্ধ। পৌনে বারোটা বাজে। তাড়াতাড়ি শুতে হবে আজ, কাল অনেক ভোরে উঠতে হবে। সিগারেট শেষ করেই দশ মিনিট বাদে অনিরুদ্ধ টিভি বন্ধ করল। প্রায় একই সময়ে গোটা বেলপাহাড়ি যখন গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন, তখনও নিজের দুই সঙ্গীকে নিয়ে হেঁটে চলেছে আজ চাকাডোবার মাঠে সবাই যাকে সুকান্ত বলে বলে চিনল সেই লোকটা। তার আসল নাম বনমালী দেশোয়ালি। বাড়ি বাঁকুড়ার রাইপুরের রসপাল গ্রামে। তিরিশের কোঠায় পা রাখা বনমালী বিনপুরের শিলদা কলেজের সায়েন্স গ্র্যাজুয়েট। শিলদা কলেজে পড়তে পড়তেই মাওয়িস্ট কমিউনিস্ট সেন্টারের (এমসিসি) নেতাদের সঙ্গে যোগাযোগ। পড়াশোনা ছেড়ে পাকাপাকি সংগঠনের কাজে যুক্ত হওয়া কয়েক বছর আগে। এই মুহূর্তে পশ্চিমবঙ্গের ঝাড়গ্রাম এবং খাতরা, দুই মহকুমায় এমসিসি সংগঠন বৃদ্ধির দায়িত্বে বনমালী এবং তার আরও দুই সঙ্গী দূর্গা হেমব্রম ওরফে দ্বিজেন এবং সুধাংশু সিংহ। আজ রাতের মধ্যে তাঁদের পৌঁছতে হবে বাঁকুড়ার রানিবাঁধে।
     
    লম্বা লম্বা পা ফেলে বনমালী এবং তার দুই সঙ্গী যতক্ষণে জঙ্গল, গ্রাম, মেঠো রাস্তা পেরিয়ে প্রায় রানিবাঁধের কাছাকাছি, তখন অফিসে বসে আড্ডায় মশগুল অরিন্দম। সবে কয়েক সপ্তাহ হল তার নাইট ডিউটি শুরু হয়েছে। সারাদিন পাড়ায় আড্ডা মেরে সন্ধে আটটায় অফিসে পৌঁছয় অরিন্দম। রাত দশটা-সাড়ে দশটা পর্যন্ত কিছু কপি লেখার কাজ থাকে, তারপর বড় কিছু না ঘটলে আর বিশেষ কাজ নেই। সিনিয়রদের সঙ্গে আড্ডা মেরেই কেটে যায় রাত আড়াইটে পর্যন্ত, তারপর বাড়ি ফেরা। সপ্তাহে একদিন এই নাইট ডিউটিটার জন্য অরিন্দম অপেক্ষা করে থাকে। আজও অন্য দিনের মতোই এক কাপ চা নিয়ে বসে ফোন ঘোরাল, চেক করে নিল কোথাও কিছু হয়েছে-টয়েছে কিনা। তারপর ডেস্কে সিনিয়রদের পাশে গিয়ে বসল। এই কথা সেই কথার পর শুরু হল গল্প। এখন তো আড্ডার রেডিমেড টপিক আছেই, দু’দিন আগে শেষ হয়েছে ক্রিকেট বিশ্বকাপ। তা নিয়েই গল্প জমে উঠেছে আজকাল পত্রিকার ডেস্কে, এমন সময় ঘরের অন্যদিক থেকে গম্ভীর গলায় প্রশ্ন করল রাতের কাগজের দায়িত্বে থাকা শৌনক লাহিড়ী, ‘আর কিছু নেই তো? পাতা ছেড়ে দিচ্ছি।’ চমকে উঠল অরিন্দম, শৌনকদা ফাইনাল পাতা ছেড়ে দিচ্ছে মানে, সাড়ে বারোটা বেজে গিয়েছে। গল্প করতে করতে ভুলেই গিয়েছিল, একজনকে ফোন করার কথা ছিল বারোটা নাগাদ।       

    ক্রমশ।..... 

     
    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।
  • ধারাবাহিক | ০৮ ডিসেম্বর ২০২৩ | ৮৬৪ বার পঠিত
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • সুকান্ত | 2409:4060:2e1a:a373::bbcb:***:*** | ০৮ ডিসেম্বর ২০২৩ ১২:৪১526787
  • অনবদ্য, সবকটা পর্ব একেবারে পেলে যেন ভালো হত...
  • তরুন দাস , বাঁকুড়া | 2409:4061:2e0e:89e1::ba08:***:*** | ০৮ ডিসেম্বর ২০২৩ ১৪:১৫526788
  • খুব সুন্দর । পড়তে রোমাঞ্চ লাগে । পরের পর্বের জন্য wait করছি
  • AMITABHA HALDAR | ১৭ মার্চ ২০২৪ ১৯:১৭529511
  • সর্বহারা ওই মানুষগুলো, আমার বাংলার প্রকৃত মালিক যারা, তাদের জন্য কি দরদ আপনার লেখায়!!
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : guruchandali@gmail.com ।


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। লাজুক না হয়ে মতামত দিন