কিন্তু খেলাটা দড়ি-টানাটানির। ফলে সোভিয়েতকে ভুলে যাওয়া একেবারেই ঠিক না। সেখানেও এর মধ্যে নানা ঘটনা ঘটতে থাকে। 'বিনাকা গীতমালা' যে বছর, সেই ৫৩ সালেই মারা যান স্তালিন, যা দিয়ে এই লেখার শুরু। এবং ক্ষমতায় আসেন ক্রুশ্চেভ-মালেনকভ। মালেনকভকে হঠিয়ে ক্রুশ্চেভের নিরঙ্কুশ ক্ষমতা পেতে কয়েকবছর লাগে। কিন্তু সোভিয়েত নীতি বদলাতে থাকে প্রথম থেকেই। স্তালিনের সময় ভারতের প্রতি সোভিয়েতের নীতি ছিল, সমর্থন এবং বিরোধিতার। আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে সমর্থন, আভ্যন্তরীন সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে একদিকে 'শ্রমিক-কৃষক-পন্থী' বোম্বে সিনেমার পিছনে থাকা, অন্যদিকে নেহরুর উল্টোদিকে গিয়ে বহুজাতিক ভারতীয় যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষে থাকা। শক্তপোক্ত এক সোভিয়েত ব্লক তৈরি করতে গিয়ে গোড়া থেকেই ক্রুশ্চেভ বিরোধিতার জায়গাটা উড়িয়ে দেন। ঠান্ডা যুদ্ধ চলছে, ফলে ভারতের সঙ্গে তাঁর সুসম্পর্ক দরকার ছিল, সেটা ঐক্যবদ্ধ ভারত হলেই ভালো হয়। ফলে বহুজাতিকতা এবং যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামো নিয়ে সোভিয়েতের বক্তব্যটা নাটকীয়ভাবে বদলে যায়। ক্রুশ্চেভের নিজের বক্তব্যের চেয়েও এই পরিবর্তনটা নাটকীয়ভাবে দেখা যায় কমিউনিস্ট পার্টির নথিতে। স্তালিনের মৃত্যুর ছমাসের মধ্যে মাদুরাই পার্টিকংগ্রেসের প্রাক্কালে অজয় ঘোষ একটি দলিলে পার্টির অবস্থান ব্যাখ্যা করেন। সেটা ছাপা হয়ে বেরোয় পরের বছর। তাতে যা লেখা হয়, তার হুবহু উদ্ধৃতি এরকমঃ "মনে রাখতে হবে, কমিউনিস্ট পার্টি ভারতের একতার পক্ষে... বিভিন্ন প্রদেশে সরকার এবং জনগণের মধ্যে যোগাযোগের মাধ্যম হিসেবে হিন্দিকে উৎসাহ দিতে হবে... যেখানে অন্য ভাষা বলা হয়, সেখানে পার্টি সেই জাতির ভাষার অধিকারের পক্ষে দাঁড়ালেও একই সঙ্গে অতি অবশ্যই হিন্দিকে উৎসাহ দেবে এবং জনপ্রিয় করবে"।
(১) দেখাই যাচ্ছে অবস্থানে বদলটা অত্যন্ত দ্রুত এবং চমকে দেবার মতো। পার্টি কংগ্রেস হয় ৫৩ সালের ডিসেম্বর মাসে, এটা তার আগে লেখা। প্রসঙ্গত স্তালিন মারা গিয়েছিলেন আগস্ট মাসে। কোনো প্রত্যক্ষ প্রমাণ নেই, তবে কমাসের মধ্যেই এই পুরো উল্টোদিকে যাত্রা সোভিয়েতের প্রভাব ছাড়া অসম্ভব। চমক দিয়ে শুরু করে, কয়েক বছরের মধ্যেই বৃত্তটা আস্তেসুস্থে সম্পূর্ণ হয়। ক্রমশঃ মারোয়াড়ি আগ্রাসন 'মিথ' এ পরিণত হয়। এবং পরবর্তী কংগ্রেস থেকেই কমিউনিস্ট পার্টি বেনিয়াদের পুরো বাদ দিয়ে একচেটিয়া বনাম ছোটো পুঁজিপতিদের দ্বন্দ্ব নিয়ে মাথা ঘামাতে শুরু করে।
কমিউনিস্ট পার্টির ইতিহাস যাঁরা জানেন, এই পরের পর্যায়ের পুরো বিতর্কটাই জানেন, যা পার্টি ভাগ হওয়া পর্যন্ত চলতে থাকে। কিন্তু এখানে সেটা আলোচ্য না, কাজেই বাদ দিয়ে যাওয়া হবে। এখানে সংস্কৃতি নিয়ে কথা হচ্ছে। বহুভাষিকতা এবং যুক্তরাষ্ট্র সম্পর্কে প্রধান বিরোধী দল এবং সোভিয়েত দুম করে মত বদলে ফেলায়, নেহরুর উপর থেকে চাপ অনেকটাই কমে। পার্টির মধ্যের এবং বাইরের আঞ্চলিক শক্তিগুলি অবশ্য বহিজাতিকতার প্রশ্নে তখনও সরব। নেহরুও এক-পা পিছিয়ে এসে আপোষের নীতি নেন। ভাষাভিত্তিক রাজ্যপুনর্গঠন বিবেচনা করার জন্য একটা কমিশন তৈরি করে ফেলেন। সেটাও ডিসেম্বর ৫৩ সালে, যে মাসে পার্টি কংগ্রেস, যেখানে অবস্থান বদলে ফেলবে সিপিআই। ওই একই সময় রেডিও সিলোন জনপ্রিয় হয়ে চলেছে। এই পুরো সময়সীমাটাই এত কৌতুহলোদ্দীপক, যে, এদের মধ্যে কোনো একটা সম্পর্ক আবিষ্কার করে ফেলতে ইচ্ছে করে। সেটা থাকাও খুবই স্বাভাবিক। গপ্পো লিখলে যে কোনো লেখক ওইটুকু স্বাধীনতা নিয়ে নিতেন। কিন্তু হায়, এটা গপ্পো নয়।
কিন্তু গপ্পো না হলেও, মোটা দাগের ঘটনাবলীও কম রোমাঞ্চকর নয়। এর পরের বছর, অর্থাৎ ৫৪ সালেই ঘটে আরও এক কান্ড। সিনেমা নিয়ে নেহরুর ধারণা এবং তাতে সোভিয়েত মদতের কথা আগেই বলা হয়েছে। এর আগে থেকেই সেই ধারণা নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা চলছিল। অর্থাৎ জনপ্রিয় সিনেমা হবে, কিন্তু তাতে শ্রমিক-কৃষক সংক্রান্ত 'বাম' ধারণা গুঁজে দেওয়া হবে। ১৯৫১ সালে এই ঘরানার প্রথম দিকের একটা ছবি রিলিজ করেছিল, যার নাম আওয়ারা। এর চিত্রনাট্যকার ছিলেন, খাজা আহমেদ আব্বাস, যিনি একাধারে আইপিটিএর লোক, নেহরুর খুবই ঘনিষ্ঠ, ক্রুশ্চেভের সঙ্গে ভুল রাশিয়ানে আড্ডা দেন, গ্যাগ্যারিনে মহাকাশ থেকে ফিরলে যেকজন প্রথম দেখা করেন তাঁদের মধ্যে একজন, এবং সর্বোপরি ৪৮ সালের পার্টি-লাইনে বিরক্ত - এই প্রকল্পের পক্ষে আদর্শ। তিনি এবং রাজকাপুর দুজনেই "আওয়ারা" সিনেমাটাকে "প্রগতিশীল" বা "ভবঘুরে জন্মায়না, তৈরি করা হয়" জাতীয় আখ্যা দিয়েছিলেন সে সময়। এবং বস্তুত চিনে এক ঝটিকা-সফর সেরে এসে আব্বাস এই সিনেমায় হাত দেন। এর পরের বছরই তিনি বানান রাহি। আওয়ারা ছিল হিট এবং রাহি ফ্লপ।
পৃথিবীতে কিছু হিট সিনেমা হয়, কিছু ফ্লপ। ওই সময় আরও কিছু হিট সিনেমা ছিল, যেমন বাজি, আরপার, লোকে সেসবের নাম মনে রাখেনি। কিন্তু ১৯৫৪ সালে ক্রুশ্চেভের সোভিয়েত এমন এক কান্ড ঘটায়, যাতে এই দুটি সিনেমা ভারতের সিনেমার ইতিহাসে অক্ষয় হয়ে যায়। সোভিয়েত, আমেরিকার বেতার-কান্ডের জবাবেই হোক, বা স্বতঃপ্রণোদিত হয়েই হোক, হঠাৎই লৌহ-যবনিকা তুলে নিয়ে এই দুটো সিনেমাকে (সঙ্গে আরও কয়েকটা ছিল) প্রদর্শনের জন্য ডাকে। সঙ্গে ডাকে নায়ক-নায়িকা এবং কিছু "প্রগতিশীল" ব্যক্তিত্বকেও। প্রসঙ্গত এর আগে একটাই ভারতীয় সিনেমা সোভিয়েতে দেখানো হয়েছিল, সেটাও স্বয়ং পুডভকিনের অনেক কাঠ-খড় পোড়ানোর পর। সেটা একটা বাংলা সিনেমা, যার নাম ছিন্নমূল। কিন্তু এবারের আয়োজন সম্পূর্ণ অন্য ছিল। এবার সবই হিন্দি সিনেমা এবং সরকারি প্রচারযন্ত্র তাদের সঙ্গে। বস্তুত এটা সেই সূচনা, যখন বাছাই হিন্দি সিনেমাকে, শুধু সোভিয়েত নয়, সোভিয়েত-প্রভাবিত অর্ধেক বিশ্বে প্রোমোট করতে শুরু করে দ্বিমেরু বিশ্বের এক বিশ্বশক্তি। নেহরু স্বয়ং বিপননের দায়িত্ব নিয়ে নেন। দেব আনন্দ এবং রাজ কাপুর ও নার্গিসকে সঙ্গে করে একাধিক সফর করেন বিদেশে, যার একমাত্র উদ্দেশ্য ছিল হিন্দি সিনেমার প্রচার ও প্রসার।
অবিলম্বে এত উদ্যোগের ফল ফলে। পৃথিবীর নানা প্রান্ত নতুন এক ঘরানার সঙ্গে পরিচিত হয়। আমেরিকা এবং হলিউডের মুখে ঝামা ঘষে, 'ম্যায় আওয়ারা হুঁ' শোনা যেতে শুরু করে চিন থেকে আফ্রিকা অবধি। সোভিয়েত এবং রাশিয়ার যৌথ প্রকল্প দুই মহানায়কের জন্ম দেয়। রাজ কাপুর এবং দেব আনন্দ। বোম্বের সিনেমা ইন্ডাস্ট্রি এমন এক জায়গায় পৌঁছয়, যেখানে বোম্বেই ভারত। ভারতের আর কোনো সিনেমাকেন্দ্রের সেখানে পৌঁছনো সম্ভব ছিলনা। কারণ রাষ্ট্রশক্তি ও বিশ্বশক্তিরা তাদের তুলে ধরেনি। অনেকেই ভাবেন, তারকারা জন্মায় ক্যারিশমায়। কথাটা এমনিই ঠিক নয়, কিন্তু এই বিশেষ ক্ষেত্রে, রাজ কাপুরকে নকল করেই বলা যায়, ভবঘুরের মতোই তারকারাও জন্মায়না, তাদের তৈরি করা হয়। পঞ্চাশের অন্য হিট সিনেমাগুলোকে আমরা ভুলেই গেছি। এই দুটো থেকে গেছে, এদের নায়করা মহানক্ষত্র হয়েছেন, কারণ এক্ষেত্রে ভারত রাষ্ট্র এবং বিশ্বরাজনীতির সমীকরণ এঁদের নক্ষত্র বানিয়েছে। ক্রোনি ক্যাপিটালিজম কথাটা পঞ্চাশে চালু হয়নি, কিন্তু তার প্রত্যক্ষ উদাহরণ, এর চেয়ে বেশি আর কিছু নেই। এই সময় বা এর পরে, যে ছেলেরা নায়কদের হাবভাব নকল করেছে, যে মেয়েরা পাগল হয়েছে, সেটা ক্রোনি ক্যাপিটালিজমের ঘাড়ে ধরে করানো, ফুকো যাকে বলেছেন, উদ্দীপনার মাধ্যমে নিয়ন্ত্রণ।
সূত্রঃ১।
https://www.revolutionarydemocracy.org/archive/ThirdCongressCPIndiaAGorig.pdf