১৯০২ এর সেপ্টেম্বরে, মৃত্যুর মাস তিনেক আগে, কাশ্মীরে থাকাকালীন,কর্নেল জেমস টডের ‘অ্যানালস অ্যান্ড অ্যানটিকুইটিস অফ রাজস্থান’ বইটি দেখে সহচরদের বিবেকানন্দ বলেছিলেন, “বাঙলার আধুনিক জাতীয় ভাবসমূহের দুই তৃতীয়াংশ এই বইখানি হইতে গৃহীত।”
ভুল কিছু বলেননি। রঙ্গলাল বন্দ্যোপাধ্যায় থেকে মাইকেল মধুসূদন, বঙ্কিমচন্দ্র হয়ে জ্যোতি-রবি-অবন ঠাকুর, কার কল্পনাকেই-বা প্রভাবিত করেনি টডের বই-এর মুসলমান শাসকদের বিরুদ্ধে রাজপুত পৌরুষ ও নারী সতীত্বের আপোষহীন লড়াইয়ের চিত্র? ‘কেতুনপুরে বকুল-বাগানে/কেসর খাঁয়ের খেলা হল সারা।/যে পথ দিয়ে পাঠান এসেছিল/সে পথ দিয়ে ফিরল নাকো তারা’ পড়েছি রবীন্দ্রনাথের ‘হোরিখেলা’ কবিতায়। “বিধর্মী শত্রু সোনার মন্দির চূর্ণ করে বল্লভীপুর ছারখার করে চলে গেল,” পড়েছি অবন ঠাকুরের রাজকাহিনীতে। ছোটবেলায়। আমরা অনেকেই। কেই-বা শোনেনি রঙ্গলালের অমর সৃষ্টি, ‘স্বাধীনতা-হীনতায় কে বাঁচিতে চায় হে, কে বাঁচিতে চায়? দাসত্ব-শৃঙ্খল বল কে পরিবে পায় হে, কে পরিবে পায়’? তিনি তো ব্রিটিশ দাসত্বের কথা বলছেন না, মুসলিম-দাসত্বের কথা বলছেন।
রাজপুত-মুসলমান, শিখ-মুসলমান ও মারাঠা-মুসলমান লড়াই-এর কাহিনী উনিশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধে, প্রথমে বাংলায় ও পরে দেশের অন্যান্য প্রান্তে, হিন্দু জাতীয়তাবাদের গঠনে বিশেষ ভূমিকা রেখেছিল। এর মধ্যে প্রথম ও অন্যতম প্রধান ছিল রাজপুতদের মুসলিম-বিরোধী লড়াই-এর কাহিনী আর দেশব্যাপী এই কাহিনীর মূল উৎস ছিল ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির কর্মচারী, কর্নেল জেমস টডের লেখা, ১৮২৯-এ প্রকাশিত বইটি।
ব্রিটিশরা সুপরিকল্পিত ভাবে একদিকে হিন্দুদেরকে ‘মুসলিম কুশাসন’ থেকে রক্ষার টোপ দিয়ে যে-ভাবে এ উপমহাদেশকে হিন্দু-মুসলিম অঙ্কে ভাগ করল, তারই ফলশ্রুতিতে ভারতে গড়ে ওঠা প্রথম জাতীয়তাবাদ হল হিন্দু জাতীয়তাবাদ। উনিশ শতকে ভারতীয় জাতীয়তাবাদের দেখা মেলেনি। টডের লেখায়, রাজপুতদের কাছে টানার অঙ্ক থেকে তাঁদের গৌরবান্বিত করতে গিয়ে মারাঠা ও মুঘল দুই-এর বিরুদ্ধেই বিদ্বেষের চাষ করা হয়েছে; মুসলিমদের বিরুদ্ধে একটু বেশী। পরে, উনিশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধে বালগঙ্গাধর তিলক ও অন্যান্যরা মারাঠা গৌরব তুলে ধরার চেষ্টা করেন, কিন্তু সে মারাঠা গৌরবও যত-না ব্রিটিশ বিরোধী, তার চেয়ে কিছু কম মুসলিম বিরোধী নয়।
এখন হঠাৎ টড-এর এই বইটিকে নিয়ে আলোচনার কারণ মূলত দুইটি। প্রথমত, সম্প্রতি ‘জ্ঞানগঞ্জ - উপনিবেশ-বিরোধী কর্পোরেট-বিরোধী চর্চা’র তরফে ৩২-পৃষ্ঠার একটি পুস্তিকা প্রকাশিত হয়েছে। নাম ‘টডের তরবারি: ভদ্রবিত্তের ইসলাম বিদ্বেষ ও রাজপুত-পৌরুষের খোঁজ’। টডের বই বাংলা সাহিত্যকে কিভাবে প্রভাবিত করেছে সে নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা আছে বরুণ চক্রবর্তীর ১৯৫০-এ প্রকাশিত বই, ‘টডের রাজস্থান ও বাঙ্গালা সাহিত্য’তে। বর্তমান পুস্তিকাটির লেখক অত্রি ভট্টাচার্য ও বিশ্বেন্দু নন্দ সেই বইটি সহ আরও নানান রচনার উল্লেখ করেছেন, টডের ইতিহাস বিকৃতির প্রতি নরম ভাব দেখানোয় বরুণবাবুর মৃদু সমালোচনাও করেছেন, এবং বর্তমান বাংলায় হিন্দু সমাজে প্রকট হওয়া সাম্প্রদায়িকতার প্রেক্ষিতে উনিশ শতকের বাংলায় জাতীয়তাবাদের নির্মাণে মুসলিম-বিদ্বেষের ভূমিকাকে ফিরে দেখতে চেয়েছেন।
তাঁদের ভাষায়, “একবিংশ শতকে ডিজিটাল হিন্দুত্বের ভরা জোয়ারে প্রাক-হিন্দুত্ববাদী সময়ে এবং আজকের সিনেমায় টড প্রভাবী হিন্দুত্বের কুড় খুঁজতে, উপনিবেশ-বিরোধী কর্পোরেট-বিরোধী চর্চার গবেষকেরা প্রখ্যাত ভদ্রবিত্ত মহাজনদের সযত্নে তৈরি প্রগতিশীলতার মুখোশ নেড়েচেড়ে দেখতে চাইছে।”
দ্বিতীয় কারণ, টডের বইটি বিশ্ব গবেষণার সেই অংশ ভুক্ত, যার নাম এডওয়ার্ড সাইদ দিয়েছিলেন ‘ওরিএন্টালিসম’। বাংলায় প্রাচ্যবাদ। পাশ্চাত্যের পণ্ডিতদের দ্বারা, পাশ্চাত্যের প্রয়োজন উপযোগী করে লেখা প্রাচ্যের ইতিহাস। সেই ইতিহাস থেকেই পছন্দ মত অংশবিশেষ নিয়ে ভারতের ইতিহাস নতুন করে লেখার চেষ্টা করছে সংঘ পরিবার-ভুক্ত হিন্দু জাতীয়তাবাদী সংগঠনগুলি। তাঁরা ভারতের শাসন ক্ষমতায় থাকায় এই কাজ সরকারি স্তরেই হচ্ছে। ইতিহাস বদলের এই প্রচেষ্টার সময়ে ইতিহাসকে ফিরে দেখা খুব প্রয়োজন।
আঠারো ও উনিশ শতক জুড়ে এই পশ্চিমা গবেষকরা যে ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলের বা গোটা উপমহাদেশের ইতিহাস লিখলেন, তা মূলত সংস্কৃত-কেন্দ্রিক, হিন্দুদের ইতিহাস। মুসলিমদের হাত থেকে তারা শাসন ক্ষমতা কেড়ে নিচ্ছে, এমন এক দেশের যার বিপুল সংখ্যাগুরু মানুষ হিন্দু। সুতরাং এ-দেশ শাসন করতে গেলে হিন্দু সমাজকে জানতে-বুঝতে হবে। এই তাগিদ থেকে তাঁরা পলাশী যুদ্ধের পর থেকেই হিন্দু ধর্ম ও সমাজ সংক্রান্ত খোঁজ খবর নিয়ে, ফারসিতে লেখা বই পড়ে, নানান বই লিখতে থাকেন।
সেই সব বই প্রায় সর্বাংশে প্রাক-মুসলিম ভারতের ইতিহাস, বিশেষত বৈদিক সভ্যতার ইতিহাস। মূলত কলকাতা, কাশী ও দক্ষিণের কিছু অঞ্চলের ব্রাহ্মণরাই তাঁদের অধিকাংশ তথ্যের উৎস। হিন্দুদের আইন-কানুন-ইতিহাস সবই সংস্কৃতে লেখা। আঠারো শতকের পশ্চিমা লেখকদের মধ্যে খুব সামান্য সংখ্যক নিজে সংস্কৃত শিখেছিলেন। সেই ধারা উনিশ শতকে পুষ্ট হয়।
এই সময়ের পশ্চিমা লেখকদের রচনার মূলত দুটি ধারা ছিল। একটি মূলত হিন্দুদেরকে কুসংস্কারাচ্ছন্ন, অলস, বিশৃঙ্খল, অসভ্য জাতি হিসাবে বর্ণনা। এই গোত্রের লেখাকে অনেকে অ্যাংলিসিস্ট বলেন। আরেক ধারা ছিল তৎকালীন হিন্দুদের অবক্ষয় স্বীকার করেও প্রাচীন বৈদিক সভ্যতার ঔৎকর্ষে মুগ্ধ হেয়ে বৈদিক সভ্যতা নিয়ে প্রবল প্রশংসা সূচক লেখা। এই ধারাকে অনেকে ইন্ডোলোজি বা ভারতবিদ্যা বলেন। কোম্পানির সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতি উইলিয়াম জোন্স ও জার্মান ভারতবিদ ম্যাক্স ম্যুলারের মতই এই ধারার গুরুত্বপূর্ণ প্রতিনিধি টড। কিন্তু ম্যুলারের কাজ যদি গুরুত্বপূর্ণ হয় গবেষণার ব্যাপকতা ও গভীরতার জন্য, টডের লেখা তার রাজনৈতিক উদ্দেশ্যের জন্য।
টডের বই একই সাথে প্রাচ্যবাদ ও ভারতবিদ্যার অংশ। সেই সাথে, এই প্রথম এই বিশাল রূপে প্রাচীন ভারত নয়, বরং মুসলমানদের সাথে লড়াইরত মধ্য যুগের হিন্দুদের ইতিহাস এলো। এছাড়া, টড-ই প্রথম প্রাচীন লিখিত গ্রন্থের বাইরে গিয়ে, তৎকালীন সমাজে প্রচলিত লোকগানে যে ইতিহাস আছে, তাকেই প্রামাণ্য হিসাবে গণ্য করলেন। বাংলায় এই বই-এর তথ্যে ভর করে, সুলতান আলাউদ্দিনের চিতোর আক্রমণের কাহিনীকে কেন্দ্র করে (যে গল্প রাজকাহিনীতেও আছে), রঙ্গলাল লিখলেন আখ্যান কাব্য ‘পদ্মিনী’। ১৮৫৭-তে প্রকাশিত এই বই বাংলা সাহিত্যে স্বদেশ-চেতনামূলক রচনার প্রথম দিকের এক গুরুত্বপূর্ণ প্রতিনিধি।
টড কেন, কি উদ্দেশ্যে নানান ভাবে ইতিহাস বিকৃত করেছিলেন, তার বিবরণ পাঠক পূর্বে উল্লিখিত পুস্তিকাটিতে পাবেন। আমি সেই বিবরণে যাচ্ছি না। তবে, টড শুধু ইতিহাসকে নিজের পছন্দ মত সাজিয়েই নেননি, এমন এমন দাবি/অনুমান করেছেন যা পরবর্তীকালের ঐতিহাসিকরা উড়িয়ে দিতে বাধ্য হয়েছেন।
আমরা যদি প্রাক-ব্রিটিশ ভারতের ইতিহাস দেখি, তা কোন হিন্দু বনাম মুসলিম লড়াই-এর ইতিহাস নয়। তা রাজায় রাজায় লড়াই-এর ইতিহাস। যে পৃথ্বীরাজ চৌহানকে অনেক সময় ভারতের শেষ হিন্দু সম্রাট বলা হয়, তিনি যখন মুহম্মদ ঘোরির কাছে পরাস্ত হচ্ছেন ও দিল্লিতে মুসলিম শাসনের সূচনা হচ্ছে, তখন উত্তর ও উত্তর-পশ্চিম ভারতের সামান্য অংশই তাঁর শাসনাধীন। বাংলার পাল বংশ তখন উত্তর ভারতেরও অনেকাংশ দখল করেছেন। পালরা বৌদ্ধ ছিলেন। তার আগেই ঘনঘন যুদ্ধ হয়েছে চৌহানদের রাজত্বের সাথে পশ্চিমের চালুক্যদের, দিল্লীর টোমারদের,মধ্য ভারতের পরমার ও চান্ডেল রাজ্যের। দক্ষিণে গোটা একাদশ শতক জুড়ে চলেছে চোল-চালুক্য লড়াই। পরমাররা চোলেদের সাথে চালুক্যদের বিরুদ্ধে জোট বেঁধেছে।
এঁরা সব হিন্দু রাজা, হিন্দু রাজত্ব, কিন্তু কোনও হিন্দু জাতীয়তাবাদ বা বোধ এঁদের বাঁধেনি। কারণ গোটা ভারতীয় উপমহাদেশে হিন্দু জাতীয়তাবাদ বা একাত্মবোধ জাতীয় কিছুর অস্তিত্ব ছিলনা। এমনকি দিল্লিতে সুলতানেট প্রতিষ্ঠার পরও হিন্দু রাজারা একে অন্যের বিরুদ্ধে লড়ে চলেছেন। ধর্ম নয়, শাসনই ছিল শাসকের চালিকাশক্তি।
ইতিহাস দেখাচ্ছে, পশ্চিমে মধ্য এশিয়ায়,আধুনিক আফগানিস্তান-তাজিকিস্তান-উজবেকিস্তান সীমান্তের ব্যাকট্রিয়া অঞ্চল থেকে শুরু হয়ে পূর্বে মধ্য গাঙ্গেয় অববাহিকা পর্যন্ত যে ভূভাগ, এই অংশে সাম্রাজ্য গঠন, বিস্তার ও বিলুপ্তির একটি ধারাবাহিকতা আছে, বাংলা, দাক্ষিণাত্য ও উত্তরপূর্ব অধিকাংশতই যার বাইরে থেকেছে। বস্তুত, ভারতীয় উপমহাদেশের সর্ববৃহৎ অংশ এক শাসনের অধীনে এসেছে খ্রিষ্টপূর্ব দ্বিতীয় শতকে মৌর্যদের পর আবার ব্রিটিশ আমলে। যে অখণ্ড ভারত নামক ঐক্যবদ্ধ প্রাচীন হিন্দু রাষ্ট্র ও সভ্যতার দাবী হিন্দু জাতীয়তাবাদীরা করে থাকেন গোটা দক্ষিণ এশিয়া প্রসঙ্গে, তার কোনও অস্তিত্বই ছিলনা।
খ্রিষ্টপূর্ব চতুর্থ শতকে মগধ (বিহার)-কেন্দ্রিক নন্দ সাম্রাজ্য পূর্বে বাংলা থেকে পশ্চিমে সিন্ধু অববাহিকার কিয়দংশ পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল, কিন্তু উড়িষ্যা, মহারাষ্ট্র ও দাক্ষিণাত্য ছিল তাদের আওতার বাইরে। সেখানে ছিল অন্য নানান হিন্দু রাজারা। খ্রিষ্টপূর্ব চতুর্থ থেকে দ্বিতীয় শতকে এক কেন্দ্রীয় শাসনের অধীনে সর্বোচ্চ এলাকা এসেছিল মৌর্য শাসনে। মগধের হিন্দু রাজা চন্দ্রগুপ্ত মৌর্য ও বিন্দুসার সাম্রাজ্যকে দক্ষিণে নর্মদা নদী পার করাতে পারেননি। অশোকের আমলে সাম্রাজ্য পশ্চিমে আফগানিস্তান হয়ে ইরান,উজবেকিস্তান সীমান্ত অবধি পৌঁছয় এবং দক্ষিণে উড়িষ্যা, অন্ধ্র, মহারাষ্ট্র জয় করে, পুবে বাংলা-অসম। যদিও কেরল-তামিল নাড়ুর কিয়দংশ দখল করতে পারেনি। কিন্তু অশোকের সাম্রাজ্য বৌদ্ধ সাম্রাজ্য আর বৌদ্ধরা ছিলেন তীব্র বেদ-ব্রাহ্মণ বিরোধী।
মৌর্যদের পর এলো মধ্য এশিয়ার কুশান বংশ। কণিষ্কের আমলে তাঁরা মগধ অবধি দখল করেছেন। কণিষ্কের এক রাজধানী মথুরা, আরেক পেশোয়ারে। তাঁরা হিন্দু ছিলেন না। তাঁদের ধর্মীয় চিন্তায় গ্রিক,জোরোয়াস্টার বা জরথুস্ট্রপন্থী, শৈব ও বৌদ্ধ চিন্তার মিশ্রণ ছিল, যদিও তাঁরা মধ্য এশিয়ায় বৌদ্ধ ধর্ম প্রসারে বিশেষ ভূমিকা নিয়েছিলেন। কিন্তু বাংলা, উড়িষ্যা, দাক্ষিণাত্য তাঁদের আওতার বাইরে ছিল।
শক ও কুশান উভয়ই মধ্য এশিয়া থেকে আসা উপজাতি।যে মধ্য এশিয়া থেকে একদা, প্রায় দেড় হাজার খ্রিস্টপূর্বাব্দে আর্যরা এসেছিলেন উত্তর পশ্চিম ও উত্তর ভারতে, সেই মধ্য এশিয়া থেকেই খ্রিষ্টপূর্ব তৃতীয়, দ্বিতীয় ও প্রথম শতকে শক ও কুশানরা ভারতে আসেন। তাঁরা উত্তর, উত্তর-পশ্চিম ও পশ্চিম ভারতের বিস্তীর্ণ এলাকায় শাসন করেন। ক্রমে দক্ষিণ-পশ্চিম ভারতের সাতবাহন হিন্দু রাজাদের সাথে বিবাহ সূত্রে আবদ্ধ হয়ে তাঁরা এদেশের অঙ্গ হয়ে যান।
এর পর আবার বড় সাম্রাজ্য হিন্দুদের গুপ্ত বংশ, খ্রিস্টীয় দ্বিতীয় থেকে ষষ্ঠ শতক। তাঁরা পূর্বে ব্রহ্মপুত্র পর্যন্ত, পশ্চিমে শক ও কুশানদের সরিয়ে আফগানিস্তানের কিয়দংশ অবধি নিজেদের অধীনে আনলেও দাক্ষিণাত্যের অনেকটাই আনতে পারেননি।
এরপর আবার দক্ষিণ এশিয়ার এক বৃহদাংশ এক শাসনের অধীন আসে প্রায় হাজার বছর পরে, মুঘল আমলে। ততদিনে দিল্লির তখতে প্রায় সাড়ে তিনশ বছর মুসলিম রাজত্ব হয়ে গেছে। একের পর এক সব বংশই এসেছে সেই মধ্য এশিয়া থেকে, পার্থক্য এই যে ততদিনে মধ্য এশিয়ায় ইসলামের প্রভাব ব্যাপক, ফলে এই দফায় যারা এসেছে তাঁরা সবাই মুসলিম, আর মধ্য এশিয়া থেকে আসা এক মুসলিম বংশ আরেক মুসলিম বংশের হাত থেকে দিল্লির গদি ছিনিয়ে নিয়েছে।
কিন্তু মুঘল আমলে, বিশেষত আকবরের আগে পর্যন্ত, তাঁদের শাসন সেই উত্তর, উত্তরপশ্চিম ও মধ্য ভারতের কিয়দংশেই সীমাবদ্ধ ছিল। মুঘল আমলের শেষ দিকে মহারাষ্ট্র-কেন্দ্রিক মারাঠা সাম্রাজ্যের উত্থান হলেও, সেই মারাঠারাও বহু হিন্দু রাজ্যের সাথে যুদ্ধে জড়িয়ে ছিল। মারাঠা-রাজপুত যুদ্ধ হয়েছে একাধিকবার, রাজপুতদের সাথে পাঠান বা মুঘলদের কখনও সন্ধি, কখনও সংঘাতের সম্পর্ক থেকেছে। মুঘল-রাজপুত জোট বেঁধে পাঠানদের বিরুদ্ধে লড়েছে, আবার মুঘল-পাঠান জোট বেঁধে শিবাজির মারাঠা সাম্রাজ্যের বিরুদ্ধে লড়েছে। সুযোগ পেলেই মারাঠারাও বাংলা থেকে পাঞ্জাব ছত্রখান করেছে। মহারাষ্ট্রে আবার তীব্র জাতিভেদ প্রথার সুযোগ নিয়ে, এক দলিত-নির্ভর সৈন্যবাহিনীর সাহায্যে ব্রিটিশরা মারাঠা সাম্রাজ্য দখল করেছে।
কিন্তু টডের লেখা ইতিহাস, মূলত রাজপুতদের ‘জয়’ করার উদ্দেশ্য নিয়ে, মুসলিম সম্রাটদের ব্যাপক কালিমান্বিত করল এবং রাজপুত-মারাঠা দ্বন্দ্বও খুঁচিয়ে তোলার চেষ্টা করল। ব্রিটিশদের সাহায্যে গৌরবময় রাজপুত জাতি মোগল-মারাঠা অত্যাচার থেকে মুক্তি পেল, এই তাঁর প্রতিপাদ্য। অথচ রাজপুত বলতেও কোনও একটি বিশেষ রাজ্য বোঝায় না, পশ্চিম ও মধ্য ভারত জুড়ে ছড়িয়ে থাকা নানান রাজপুত রাজত্ব নিজেদের মধ্যেও অনেক যুদ্ধে জড়িয়েছে।
টডের রচনা-পুষ্ট যে সাহিত্য-ধারা, তা ভারতে সদ্যজাত জাতীয়তাবাদকে ভুল পথে চালিত করল, যদিও জাতীয়তাবাদীরা টডের লেখা থেকে মূলত মুসলিম-বিরোধী অংশটাই নিলেন, মারাঠা-বিরোধী অংশগুলি এড়িয়ে গেলেন। এটা খানিক আশ্চর্য, কারণ আঠারো শতকে বাংলায় বারম্বার মারাঠা হানা তো শিশুদের ঘুমপাড়ানিয়া গানে স্থান করে নিয়েছিল। হয়ত, এই দিকটি বিশেষ অনুসন্ধানের দাবী রাখে।
আলোচ্য পুস্তিকার লেখক দ্বয় বাংলায় মুসলিম বিদ্বেষের উৎস পাঁচ শতক আগে থেকে লক্ষ্য করেছেন। এক স্থানে বলছেন যে, “মুসলমান ভয়ঙ্কর, ‘গোব্রাহ্মণদ্রোহী’ মুসলমানের অধীনে চাকরি করা পাপের ধারণা সাভারকর-গোলওয়ালকদের রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সঙ্ঘ আর স্যাঙ্গাৎদের চালানো উপনিবেশিক প্রকল্পের থেকেও পুরোনো, বঙ্গভূমে এই ভদ্রবিত্তিয় ধারণার বয়স ৫০০ পার।” তাঁরা, ‘চৈতন্যচরিতামৃত’ কাব্য থেকে উদ্ধৃত করছেন ‘ম্লেচ্ছ জাতি ম্লেচ্ছ সঙ্গী করি ম্লেচ্ছ কাম।/গোব্রাহ্মণদ্রোহী সঙ্গে আমার সঙ্গম।’
কিন্তু প্রাক-ঔপনিবেশিক সমাজের বিদ্বেষকে, আমার মতে, অন্য দৃষ্টিতে দেখা উচিৎ। এই বিদ্বেষ সমাজে শুধু ধর্মভেদে নয়, জাতি ভেদেও ছিল; নিচু জাতির প্রতি এরকম বিদ্বেষের প্রমাণও পাওয়া যাবে। ঔপনিবেশিক যুগের বিদ্বেষ অন্যরকম, যখন বাঙালি ভদ্রলোক সমাজ জাতি বিদ্বেষ কমিয়ে, শূদ্রদের খানিকটা কাছে টেনে, বিদ্বেষের অভিমুখ মুসলমানদের দিকে চালনা করার চেষ্টা করছেন।
প্রাচ্যবাদী ভারতের ইতিহাস শুরু থেকেই ইসলাম-বিদ্বেষে দুষ্ট। তৎকালীন ইউরোপে মুসলিম এবং ইহুদী বিদ্বেষ দুই-ই বেশ মাথা চাড়া দিয়েছিল। সেই ইসলাম বিদ্বেষী দৃষ্টি নিয়েই তাঁরা ভারতের ইতিহাসকে মূলত বৈদিক জাতির ইতিহাস হিসাবে দেখানোর চেষ্টা করেন, বিশেষত যখনই তাঁরা বুঝতে পারেন যে, বৈদিক সাহিত্য ইসলাম তো বটেই, সম্ভবত ইহুদীদের থেকেও প্রাচীন।
পুস্তিকার লেখক দ্বয়ও এই ইউরোপ থেকে ভারতে আমদানি করা এই ইসলাম বিদ্বেষের প্রসঙ্গ টেনেছেন। লিখেছেন, “টড ‘এনালস’এ ইউরোপীয় ইসলামোফোবিয়া ধার করে মুঘলদের তাতার বা তুর্কি দুর্নামে অভিহিত করলেন। টড পরিকল্পিত রাজনীতিতে রাজপুত ইতিহাসের সঙ্গে ইওরোপিয় ইতিহাসের তুলনা টানলেন।… প্রতাপের মৃত্যুকে তিনি তুলনা করলেন দেশের স্বাধীনতার শত্রুদের বিরুদ্ধে লড়া কার্থাজিনিয়ানদের সঙ্গে। প্রতাপ সিংহের দেশে মুঘলদের আবির্ভাবকে তুলনা করলেন গ্রিসে বর্বর পারসিক হামলার সঙ্গে।”
তাঁরা লিখছেন, “যে ইসলামবিদ্বেষী চর্চার সূত্রপাত আমাদের ভদ্রলোকিয়া পূর্বপুরুষেরা করে গেছেন, তার ভাবজগতের মূর্তিগুলো আজ যদি না আমরা ভাঙতে পারি, তাহলে সামনের লড়াই সে রাজনৈতিক হোক, সামাজিক হোক কোনোটাতেই এক পাও এগোনো যাবেনা।”
তাঁরা সম্ভবত ঠিকই ধারণা করছেন। টড-প্রভাবিত বিকৃত ইতিহাস যেহেতু বাংলায় হিন্দু জাতীয়তাবাদের নির্মাণে বিশেষ ভূমিকা রেখেছিল, এবং সেই হিন্দু জাতীয়তাবাদী ধারার এক পুনরুত্থান ঘটানোর চেষ্টা করছে বর্তমানের হিন্দু দক্ষিণপন্থী সংঘ পরিবারভুক্ত নানান সংগঠন, তাই এই বিকৃত ইতিহাসের মূলোচ্ছেদ করা বর্তমান সময়ে এক গুরুত্বপূর্ণ কাজ।
কিন্তু এ প্রসঙ্গে পুস্তিকাটিতে একটি বিশেষ ত্রুটিও লক্ষ্য করলাম।
লেখক দ্বয় রবীন্দ্রনাথের ‘কথা ও কাহিনী’ গ্রন্থে প্রকাশিত টড-প্রভাবিত চারটি কবিতার কথা উল্লেখ করে মুসলিম-বিদ্বেষ ছড়ানোয় তাঁর ভূমিকার উল্লেখ করেছেন। সেই প্রসঙ্গে এক স্থানে লিখেছেন, “বাঙালির প্রাণের রবীন্দ্রনাথ- তার ‘বৃহত্তর ভারত’ (নামটি কেমন যেন আজকের সঙ্ঘী ‘অখণ্ড ভারত’ চিন্তার পুরাতনী সংস্করণ) প্রবন্ধে লিখেছেন- ‘এই অগৌরবের ইতিহাসমরুতে রাজপুতদের বীরত্ব-কাহিনীর ওয়েসিস থেকে যেটুকু ফসল সংগ্রহ করা সম্ভব তাই নিয়ে স্বজাতির মহত্ত্ব পরিচয়ের দারুণ ক্ষুধা মেটাবার চেষ্টা করা হত’।”
এটি পড়ে সন্দেহ হল, তাঁরা রবীন্দ্রনাথের মূল প্রবন্ধটি হয়ত বুঝতে ভুল করেছেন। বা, গোটাটা পড়েন নি। কারণ এই প্রবন্ধের (বক্তৃতার) বৃহত্তর ভারতের সাথে সংঘ পরিবারের অখণ্ড ভারতের কোনও দূরতম সম্পর্কই নেই। উপরন্তু, এই লেখাটি আসলে রবীন্দ্রনাথের আত্মসমালোচনা।
হিন্দু মেলার আবহে বড় হওয়া রবীন্দ্রনাথের লেখালেখিতে, ১৮৭০-এর দশক থেকে ১৯০৫ পর্যন্ত, হিন্দু জাতীয়তাবাদের প্রভাব শুধু ‘কথা ও কাহিনী’ নয়, ‘নৈবেদ্য’-তেও পাওয়া যায়। ‘কথা ও কাহিনী’তে একই ভাবে জোসেফ কানিংহ্যামের লেখা ‘হিস্ট্রি অভ দ্য শিখস’-প্রভাবিত ‘প্রার্থনাতীত দান’ বা ‘বন্দী বীর’ কবিতা স্থান পায়। পাঠান নবাব যখন বন্দী শিখদের তাঁদের অন্যতম ধর্মীয় নিশান বেণী কেটে ফেললেই মুক্তি দেওয়ার প্রস্তাব দেন, তখন ভাই তরু সিংহের মুখে রবীন্দ্রনাথ লিখছেনঃ “যা চেয়েছ তার কিছু বেশি দিব/বেণীর সঙ্গে মাথা।”
যে ‘বন্দি বীর’ কবিতায় লিখেছেন তাঁর অবিস্মরণীয় পঙক্তি ‘জীবন মৃত্যু পায়ের ভৃত্য, চিত্ত ভাবনাহীন’, সেই কবিতাতেই লিখছেন “‘জয় গুরুজির’ হাঁকে শিখ বীর/সুগভীর নিঃস্বনে।/মত্ত মোগল রক্তপাগল/ ‘দীন্ দীন্’ গরজনে।” বা, “সম্মুখে চলে মোগল-সৈন্য/উড়ায়ে পথের ধূলি,/ছিন্ন শিখের মুণ্ড লইয়া/বর্শাফলকে তুলি।” কিংবা, “বন্দার কোলে কাজি দিল তুলি/বন্দার এক ছেলে।/কহিল, "ইহারে বধিতে হইবে/নিজহাতে অবহেলে।”
‘কথা ও কাহিনী’ প্রকাশিত হয় ১৯০৮-এ, কিন্তু লেখাগুলি ১৮৯৯-১৯০০ সালের। এরপর, ১৯০৫-এ শিবাজির স্তুতিতেও কবিতা লিখেছেন রবীন্দ্রনাথ। অনুরোধে লিখেছেন, কিন্তু লিখেছেন। ওদিকে মহারাষ্ট্রের জ্যোতিবা ফুলে-সাবিত্রীবাই ফুলেরা কিন্তু সেই ১৮৬০-এর দশকেই মারাঠা সাম্রাজ্যকে দলিত বিরোধী বলে চিহ্নিত করেন, সেই সাম্রাজ্যের প্রতি কোনরকম গৌরব বোধে অস্বীকার করেন।
রবীন্দ্রনাথের চিন্তায় হিন্দু জাতীয়তাবাদী দৃষ্টিভঙ্গি প্রসঙ্গে এক ব্যাপক পরিবর্তন আসে ১৯০৭-০৮ নাগাদ থেকে। বঙ্গভঙ্গ-বিরোধী আন্দোলনে মুসলিম সমাজের অনিচ্ছা তাঁকে হিন্দু জাতীয়তাবাদী চিন্তার বিপদ চিনিয়ে দেয়। তাঁর সাধের আন্দোলনে মুসলিমদের অনুৎসাহের জন্য তিনি হিন্দুদেরই দ্যর্থহীন ভাবে দায়ী করেন, মুসলিমদের এত দিন দূরে সরিয়ে রাখার জন্য। এটি তাঁর জীবনে এক গুরুত্বপূর্ণ মোড়, কারণ এর পর তিনি ক্রমশই হিন্দু জাতীয়তাবাদ এবং পরে সার্বিক জাতীয়তাবাদী চিন্তাভাবনারই বিরোধী হয়ে ওঠেন।
তাঁর এই ‘বৃহত্তর ভারত’ বক্তৃতাটি এই দ্বিতীয় পর্যায়ের, ১৯২৭ সালের। এটি গোটা টড-অনুসারী সাহিত্যধারারও সমালোচনা। আমি সংশ্লিষ্ট অংশটি আরেকটু বেশী উদ্ধৃত করছি, পাঠক যাতে একটা ধারণা করতে পারেন।
ইংরেজ আমলে পাঠ্যপুস্তকে ক্রমাগত শুধু বিদেশী শক্তির কাছে ভারতের পরাজয়ের ইতিহাস পড়তে হওয়ার গ্লানির প্রেক্ষিতে তিনি লিখছেন, “এই অগৌরবের ইতিহাসমরুতে রাজপুতদের বীরত্বকাহিনীর ওয়েসিস থেকে যেটুকু ফসল সংগ্রহ করা সম্ভব তাই নিয়ে স্বজাতির মহত্ত্ব-পরিচয়ের দারুণ ক্ষুধা মেটাবার চেষ্টা করা হত। সকলেই জানেন, সে সময়কার বাংলা কাব্য নাটক উপন্যাস কিরকম দুঃসহ ব্যগ্রতায় টডের রাজস্থান দোহন করতে বসেছিল। এর থেকে স্পষ্ট বোঝা যায় দেশের মধ্যে আমাদের পরিচয়-কামনা কিরকম উপবাসী হয়ে ছিল।… বস্তুত এই অসহ্য ক্ষুধাই আমাদের মনকে তখন নানা হাস্যকর অত্যুক্তি ও অবাস্তবতা নিয়ে তৃপ্তির স্বপ্নমূলক উপকরণ-রচনায় প্রবৃত্ত করেছিল। আজও সেদিন যে একেবারে চলে গেছে তা বলতে পারি নে।”
এখানে তিনি টডের জনপ্রিয়তার কারণ ব্যাখ্যা করছেন এবং ঐ পর্যায়ের লেখাকে ‘হাস্যকর অত্যুক্তি ও অবাস্তবতা নিয়ে তৃপ্তির স্বপ্নমূলক উপকরণ’ হিসাবে চিহ্নিত করছেন।
তিনি আরও লিখছেন, “লোকে যখন দরিদ্র হয় তখন বাইরের দিকে গৌরব খুঁজে বেড়ায়। তখন কথা বলে গৌরব করতে চায়, তখন পুঁথি থেকে শ্লোক খুঁটে খুঁটে গৌরবের মালমসলা ভগ্নস্তূপ থেকে সঞ্চয় করতে থাকে। এমনি করে সত্যকে ব্যবহার থেকে দূরে রেখে যদি গলার জোরে পুরাতন গৌরবের বড়াই করতে বসি তবে আমাদের ধিক্।”
প্রকৃত ভারতীয় জাতীয়তার জন্ম বিশ শতকের প্রথম দশকের শেষ থেকেই। এক দিকে ‘গোরা’ উপন্যাসে (১৯০৭-০৯) রবীন্দ্রনাথ হিন্দু জাতীয়তাবাদের ফাঁদ ও বিপদ উপলব্ধি করে এর সমালোচনা ও হিন্দু-মুসলিম ঐক্যের প্রয়োজনীয়তা তুলে ধরার চেষ্টা করলেন। উপন্যাসের নায়ককে দিয়ে বলালেন, “আজ আমি ভারতবর্ষীয়। আমার মধ্যে হিন্দু, মুসলমান, খ্রিষ্টান কোন সমাজের কোনো বিরোধ নেই। আজ এই ভারতবর্ষের সকলের জাতই আমার জাত,সকলের অন্নই আমার অন্ন।” অথবা, “আপনি আমাকে আজ সেই দেবতারই মন্ত্র দিন যিনি হিন্দু মুসলমান খ্রিস্টান ব্রাহ্ম সকলেরই-যার মন্দিরের দ্বার কোন জাতির কাছে কোন ব্যক্তির কাছে কোনদিন অবরুদ্ধ হয় না। যিনি কেবল হিন্দুর দেবতা নন-যিনি ভারতবর্ষের দেবতা।”
আরেক দিকে গান্ধী, ১৯০৯-তে প্রকাশিত বই ‘হিন্দ স্বরাজ’-এ ভারতের ইতিহাস লিখতে গিয়ে মুঘল তথা মুসলমানদের সুস্পষ্টভাবে ভারতীয় হিসাবে চিহ্নিত করছেন।
বাংলাতে এই ভারতীয় জাতীয়তাবাদকে রাজনৈতিক ক্ষেত্রে প্রথম নিয়ে আসছেন দেশবন্ধু, তারপর সুভাষ। এঁরা মুসলমানেদের নয়, ব্রিটিশদেরই উপনিবেশিক শক্তি হিসাবে চিহ্নিত করেন।
এই নবইতিহাসচেতনা থেকেই, ১৯৩৪ সালে, ‘ভারত তীর্থ’ কবিতায় রবীন্দ্রনাথ লেখেনঃ “হেথায় আর্য, হেথা অনার্য/হেথায় দ্রাবিড়, চীন/ শক-হুন-দল পাঠান মোগল/এক দেহে হল লীন।”
এ-কথা কখনই ভুললে চলবে না যে, বাঙালি ভদ্রলোক সমাজের মানসিকতা অনেকাংশেই গড়ে উঠেছিল নবজাগরণের উনিশ শতকে – রামমোহন-বিদ্যাসাগর-রবীন্দ্রনাথদের উদারতা ও হিন্দু পুনর্জাগরণ/জাতীয়তাবাদের সংকীর্ণতা দুই-ই আমরা সে সময়েই পেয়েছি। দুই-ই আমাদের মধ্যে আজও বর্তমান।
আবার রামমোহন, বিদ্যাসাগর, রবীন্দ্রনাথরা মহান না উপনিবেশিতার দালাল, সে প্রশ্নও এর আগে উঠেছে। এই পুস্তিকাতেও মন্তব্য করা হয়েছে, সতীদাহ রোধের জন্য রামমোহনকে ব্রিটিশরা মহান বানালেন।
১৯৩৪-এর জানুয়ারিতে রামমোহন প্রসঙ্গে রবীন্দ্রনাথ বলছেন, বিভেদাছন্ন হিন্দুসমাজের ওপর কুঠারাঘাত আনা রামমোহনকে যারা পাশ্চাত্যের দালাল বা অভারতীয় বলেছিল, তারাই প্রকৃত ঔপনিবেশিক শিক্ষার বাহক। তিনি রামমোহনকে কবীর, নানক, দাদুর প্রকৃত উত্তরসূরি হিসাবে চিহ্নিত করছেন, ইউরোপের জিওডার্নো ব্রুনোর সাথে তুলনা করছেন, এবং বলছেন, “যার নির্মল দৃষ্টির কাছে হিন্দু মুসলমান খৃষ্টান শাস্ত্র আপন দুরূহ বাধা সরিয়ে দিয়েছিল, তাকে আজ তারাই অভারতীয় বলতে স্পর্ধা করছে পাশ্চাত্য বিদ্যা ছাড়া আর কোনো বিদ্যায় যাদের অভিনিবেশ নেই।”
যেভাবে, ব্রাহ্মণ্যবাদী মারাঠা সাম্রাজ্যের বিরুদ্ধে ব্রিটিশ সেনার অংশ হওয়ার জন্য মহারাষ্ট্রের দলিতদের ঔপনিবেশিকতার দালাল বলা যায় না, সেভাবেই তৎকালীন কুসংস্কারাচ্ছন্ন হিন্দু সমাজের, বা রবীন্দ্রনাথের ভাষায় ‘ভেদপ্রবর্তক সনাতনবিধি’র, বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানো রামমোহনের মহত্ত্বের জন্য ব্রিটিশ প্রশংসা বা উদ্যোগ প্রয়োজনীয় নয়। শ্রেণী দৃষ্টি থেকে তাঁদের আলোচনাটা এই রচনার বিষয় নয়, তাই ও প্রসঙ্গে যাচ্ছি না।
রামমোহন হিন্দু জাতীয়তাবাদের অংশ ছিলেন না, তখনও সে বস্তু জন্মায়নি; কিন্তু রবীন্দ্রনাথ যেহেতু মূলত প্রথম ধারার প্রতিনিধি হলেও দ্বিতীয় ধারাতেও বিরাজ করেছেন, তাই তাঁর এই পরিবর্তন, সমালোচনা ও আত্মসমালোচনাকে বাদ দিয়ে এই অধ্যায়ের আলোচনা সম্পূর্ণ হতে পারে না।