এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • হরিদাস পাল  পর্যালোচনা (রিভিউ)  সিনেমা

  • আধুনিক চীনের একটি ছবি ঃ একটু পাপের  স্পর্শ 

    Sandipan Majumder লেখকের গ্রাহক হোন
    পর্যালোচনা (রিভিউ) | সিনেমা | ০২ সেপ্টেম্বর ২০২৩ | ১২৫০ বার পঠিত | রেটিং ৪ (১ জন)
  • একজন  শিল্পী দায়বদ্ধ থাকেন নিজের বিবেকের কাছে। সেই বিবেক তাকে বারবার মনে করিয়ে দেয় অসুখী মানুষদের কথা। শিল্পী যত তাঁদের কথা বলবেন, সমাজের অসুখ তত বেশি চিত্রিত হবে। যেখানে একদলীয় শাসন, যেমন চীন, বর্তমান ভারতবর্ষ বা পশ্চিমবঙ্গে – সেখানে অধিকাংশ শিল্পী অবশ্য শাসককে রুষ্ট করার মত প্রসঙ্গ আমদানি করেন না। যেমন চীনের পঞ্চম প্রজন্মের চলচ্চিত্র  পরিচালকরা ‘পিরিয়ড পিস ‘ তৈরিতে মন দিয়েছিলেন। বেশ শিল্পকলানৈপুণ্য দেখানো হল ,আবার বর্তমানের সমাজব্যবস্থা সম্পর্কে কোনো মন্তব্য করার থেকে অব্যাহতি পাওয়া গেলো। কিন্তু চীনের ষষ্ঠ প্রজন্মের  একদল চলচ্চিত্রকার সময়ের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে সাহসী আখ্যান উন্মোচনের  ঝুঁকি নিচ্ছেন। এদের মধ্যে জিয়া  জাংকির ( Jia Zangke)নাম আমাদের  শ্রদ্ধার সঙ্গে উচ্চারণ করতে হবে। ওর ছবি সবসময় চীনে  ঠিকমত প্রদর্শিত হয় না, একটি ব্যতিক্রম বাদ দিয়ে সরকারী ফাণ্ডিং ছাড়াই  ছবি করে এসেছেন , ২০০৪ সালের আগে মোটামূটি ‘আণ্ডারগ্রাউণ্ড’  ফিল্মমেকারের তকমা পেয়ে এসেছেন এসব মেনেও বলতে হবে যে  জিয়াকে ছবি করা বন্ধ করতে হয় নি। বর্তমানে তিনি তাঁর জন্মভূমি সাংসি প্রদেশের ফিল্ম অ্যাকাডেমির ডিন।

    পাপের স্পর্শ ( A touch of Sin ) ছবিতে   হিংসা, রক্তপাত, আত্মহনন   ভালো পরিমাণে আছে। কিন্তু এসব আছে এমন একটা সমাজে বাঁচার প্রতিক্রিয়া হিসেবে যেখানে প্রতারণা আছে, নিষ্ঠুরতা আছে, আছে অর্থগর্বী প্রমত্ততা। দেখে কখনো মনে হবে না যে  ৭৪ বছর আগে জনগণতান্ত্রিক বিপ্লব ঘটে যাওয়া , সমাজতান্ত্রিক পথে হাঁটা কোনো দেশের ছবি দেখছি। এখানে যে চারটি আখ্যানকে একসূত্রে বাঁধতে চেয়েছেন জিয়া সেখানে আছে  এমন চরিত্র যে গ্রামের সামাজিক সম্পত্তি একটি খনি বেচে প্রাইভেট প্লেন কিনে ঘুরছে, তার কুকর্মের সাথী গ্রামের প্রধান যে গ্রামবাসীদের প্রতিশ্রুত সুবিধা থেকে বঞ্চিত করেছে। কেউ প্রতিবাদ করলে মার খাচ্ছে। তৃতীয় আখ্যানে  একটি সওনা বাথ সেন্টারের রিসেপশনিস্ট (সেখানে যে ম্যাসেজ করার নামে দেহব্যবসা হয় সেটা স্পষ্ট ) মেয়েকে দুই মহা অর্থবান ব্যক্তি  (এদের মধ্যে একজনকে  চ্লন্ত  গাড়ি থামিয়ে তোলা তুলতে দেখা গেছে ) জোর করে টাকার বিনিময়ে ভোগ করার চেষ্টা করলে তাদের মেয়েটি শেষমেশ বাধ্য হয়ে খুন করে। শেষ আখ্যানে পরিযায়ী শ্রমিকের জীবনের নিরাপত্তাহীনতা, একঘেয়েমি আর শূণ্যতা কে  স্বল্প পরিসরেই তুলে ধরা হয়। এখানে ছেলেটি হুনান প্রদেশ থেকে এসে   ডংগুয়ান শহরে একটা নাইট ক্লাবে ওয়েটারের কাজ নেয়। এখানে যে দেহব্যবসা খোলাখুলি চলে  সেখানে হংকং আর তাইওয়ান থেকে আসা ধনী ব্যক্তিরা টাকা ওড়ায়। ছেলেটি এক দেহপসারিণীর প্রেমে পড়ে। স্বপ্ন দেখে তাকে নিয়ে পালিয়ে যাওয়ার। কিন্তু সে পথ রুদ্ধ। ছেলেটি  শ্রমিকের কাজে ফিরে যায় । সেখানেও অপমানিত হয়ে  কোম্পানির আবাসনের  ( আবাসন না বলে ব্যারাক বললেই ঠিক হয় ) ছাদ থেকে ঝাঁপিয়ে পড়ে আত্মহত্যা করে । এই আখ্যানগুলি সবই কিন্তু কোনো না কোনো সত্যি ঘটনার ছায়ায় নির্মিত। যেমন শেষ আখ্যানে  পরিযায়ী শ্রমিকের আত্মহত্যার ঘটনাটি ২০১০ থেকে ২০১৩ পর্যন্ত Foxconn কোম্পানিতে ঘটে যাওয়া অনেকগুলি শ্রমিকের আত্মহত্যার ঘটনাকে মাথায় রেখেই করা হয়েছে।  এখন প্রশ্ন এই পাপ কার ? এই পাপ সেই ব্যবস্থার যেখানে  উন্নয়ন আর সমৃদ্ধি ঢেকে রাখতে পারেনি এইসব সামাজিক ক্ষতকে। জিয়ার ছবিতে আধুনিক , ঝাঁ চকচকে উন্নয়নের বাহ্যিক চেহারাটা দেখা যায়, কিন্তু সেটাকে কেমন যেন অভিশপ্ত মনে হয়।  পুঁজিবাদী উন্নয়নের পথকে অনুমতি দেওয়ার দাম চীনকে ভালোই দিতে হয়েছে  বোঝা যায়। তাই বলে মাওপন্থীরা যদি মনে করেন  যে  আগে সব ঠিক ছিলো তাহলেও ভুল হবে।  জিয়া তাঁর বিভিন্ন তথ্যচিত্রে  চীনের  ইতিহাস কখনো একটি কারখানার রিয়েল এস্টেটে পরিণত হওয়ার ঘটনাকে সামনে রেখে ( 24 City) বুঝিয়েছেন   আবার কখনো  সাক্ষাৎকার এবং স্মৃতিচারণের মধ্য দিয়ে সাংহাই শহরের ইতিহাস তুলে ধরেছেন ( I wish I knew) । আগে আর্থিক লোভ ছিল না ততটা, কিন্তু ভীষণ  অভাব আর দারিদ্র ছিলো। মনে রাখতে হবে সমাজতন্ত্র কিন্তু আমাদের দারিদ্রের সমবন্টনের স্বপ্ন দেখায় নি, প্রাচুর্যের সমবন্টনের কথাই ছিলো। আর সাংস্কৃতিক বিপ্লবের নামে কি হয়েছিলো সেটা শেষোক্ত তথ্যচিত্রের এক চরিত্রের মুখ থেকে শুনি। তিনি বলছেন সাংস্কৃতিক বিপ্লবের আগে চীনে মানুষ অন্যের প্রাইভেসিকে সম্মান করতো। সাংস্কৃতিক বিপ্লবের সময়  জানা গেলো যে আমাদের  মধ্যে কারা নাকি গুপ্তচর, কেউ নাকি পুঁজিবাদী, কেউ নাকি বিপ্লবী। প্রতিটি গলির মুখে একজন কিশোর ছিলো যে ছিলো বস । তার দলবলই এসব ঠিক করতো । পরে অবশ্য অনেক ‘বিপ্লবী’ পরিবারও হেনস্থার শিকার হয়েছিলো। আবার এইসব পাড়ার দলগুলির সঙ্গে অন্য দলের সর্বত্র  মারামারি চলতো।

    আসলে জিয়া কাউকে খুশি করার জন্য সিনেমা করেন না। এখনকার চীনের সমাজব্যবস্থার সমালোচনা করেন বলেই আগের জমানাকে ভালো বলতে হবে , এমন নিত্যতা সূত্রে বিশ্বাস করেন না তিনি। চীনের জিডিপি বৃদ্ধি, স্বাস্থ্য, শিক্ষা, ক্রীড়ায় উন্নতির  পরিসংখ্যান মিথ্যা নয়। কিন্তু দিনের শেষে পরিসংখ্যান শেষ কথা বলে না। মানুষের মুখ ম্লান  করে দিয়ে কোনো উন্নয়ন সম্ভব নয়। সাংস্কৃতিক বিপ্লবে গণতন্ত্রের সম্প্রসারণ ঘটে নি, নৈরাজ্যের মহড়ায় পর্যবসিত হয়েছিলো সবটা। প্রকৃত গণতন্ত্রের অনুশীলনের সঙ্গে উন্নয়নকে সমন্বিত করার চিন্তা সমাজতন্ত্রের বিংশ শতকের অনুসৃত  কোনো মডেলের মধ্যে নেই। আবার সেটা ছাড়া মানুষের মুক্তির অন্য পথও তো নেই। এটাই বর্তমান সময়ের ট্র্যাজেডি।
     

    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।
  • পর্যালোচনা (রিভিউ) | ০২ সেপ্টেম্বর ২০২৩ | ১২৫০ বার পঠিত
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • পলিটিশিয়ান | 2603:8001:b102:14fa:fbe:d950:9833:***:*** | ০৩ সেপ্টেম্বর ২০২৩ ০৩:০৬523192
  • এসব নেই এমন দেশ আছে নাকি? থাকলে খবরটা দিন, দেখি সেখানে গিয়ে থাকা যায় কিনা।
     
    আরে গ্রামের খনি বেচা নিয়ে এত কথা। ওদিকে প্রেসিডেন্ট ইউক্রেনে পাবলিক মানি সাহায্য বলে পাঠাচ্ছে। আর প্রেসিডেন্টের ছেলে বিভিন্ন কৌশলে সেই টাকা ফেরত এনে নিজের পকেটে ভরছে। পারি না পারি না।
  • xor | 182.69.***.*** | ০৩ সেপ্টেম্বর ২০২৩ ১৯:২৯523198
  • yes হংকংয়ে একসময় আলাদা ছবির ইন্ডাস্ট্রি ছিল। তার বাইরে মূল ভূখণ্ডের চিনা ছবি সহজলভ্য নয়। আপনি কি এটা মুবি তে দেখলেন?
  • Sandipan Majumder | ০৩ সেপ্টেম্বর ২০২৩ ২১:১৭523201
  • @xor, হ্যাঁ, ওটাই  তো দেখার  একমাত্র  জায়গা আইনসঙ্গতভাবে। 
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : guruchandali@gmail.com ।


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। যা খুশি মতামত দিন