কার্বি নারী
ফোটো সৌজন্য - ঈপ্সিতা
বিভিন্ন জনজাতির মহিলাদের কি আলাদা কোনও পোষাক নেই? সুরক্ষাকর্মীটি নিজের মোবাইল খুলে দুজনের ছবি দেখান একজন ওঁর মা আরেকজন প্রতিবেশী, ডিমাসা জনজাতি। শুবজিৎ তড়বড়িয়ে বলে মহিলাদের এই পোষাকই গোটা ডিমা হাসাও জেলার ঐতিহ্যবাহী জাতিগত পোষাক। আমার সন্দেহ যায় না, কিন্তু সন্দেহ মেটানোর কোনও উপায় দেখি না। মনে মনে নোট করি ফিরে এসে ঈপ্সিতাকে জিগ্যেস করতে হবে। করেওছি্ যা ভেবেছিলাম তাই, দিব্বি আলাদা আলাদা সব পোষাক আছে বিভিন জনজাতির মহিলাদের। সুজ্জিমামার ওদিকে ঘুম পেয়ে গেছে, বাড়ির দিকে দৌড়াচ্ছেন, আলো দ্রুত মুছে যাচ্ছে মাঝের পাহাড়ের গা থেকে। অতএব আমিও দৌড় দিই, যত তাড়াতাড়ি সম্ভব পৌঁছাতে হবে অ্যাব্রাহাম ভিউ পয়েন্ট।
যেতে যেতে হঠাৎ একজায়গায় প্রায় থামিয়ে শুবজিৎ একটা রেস্তোঁরা দেখিয়ে বলে এখানে খুব উৎকৃষ্ট বিয়ার পাওয়া যায় আমি নিশ্চয়ই আগ্রহী, সেক্ষেত্রে আমরা কি এখন একটু থামব এখানে? আমি একেবারেই আগ্রহী না, আদৌ থামার কোনও দরকার নেই জেনে কেমন যেন মুষড়ে পড়ে বেচারি। এর আগে বহুবার আমার ছবি তুলে দিতে চেয়েছে বিভিন্ন স্পটে, বেশিরভাগই মানা করেছি। নিজের মোবাইল এগিয়ে দিয়ে বলেছে আমার পছন্দমত গান বেছে চালাতে, ফিরিয়ে দিয়ে বলেছি ওর যা ভাল লাগে তাই বাজাক শুধু আরেকটু আস্তে। এমনকি পেছনের সীটে আদৌ গানের আওয়াজ না এলেও হবে। বেচারি ভেবেই পাচ্ছে না এই বিচিত্র পর্যটককে সে কীভাবে খুশী করবে!
অ্যাব্রাহাম ভিউ পয়েন্ট লামডিং –হাফলঙ রোডে, প্রায় হাফলঙ শহরে ঢোকার মুখেই। এদিকটা প্রায় অন্ধকার হয়ে এসেছে, টাওয়ারে উঠলে সূর্য্যের শেষ রশ্মিটুকু পাওয়া যাবে। সিঁড়ি আর রাস্তার মাঝে খানিকটা এবড়ো খেবড়ো পাথর, আলো আঁধারিতে দেখতে খুব সমস্যা হয় আমার। শুবজিৎকে অনুরোধ করি হাতটা ধরতে। কিছু একটা সাহায্য করতে পেরে ভারী খুশী হয়, একগাল হাসে। জায়গাটুকু পেরিয়েই হাঁচড় পাঁচড় করে সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠি। উরেব্বাসরে কি ঠান্ডা হাওয়া হু হু করে বইছে চারদিক খোলা বারান্দাটায়। ইতস্তত দুটো টেবিল, খানকয় চেয়ার। চারপাশে বারান্দা, মাঝখানে এক রেস্তোঁরা, দ্য কিচেন রেস্ট্যুর্যান্ট।
সূর্যাস্ত - অ্যাব্রাহাম ভিউ পয়েন্ট
ব্যাস ব্যাস কোনোমতে সূর্যাস্তের শেষ কয়েকটা মিনিট ধরে ফেলা গেছে। বাতাসে দূষণ একেবারে না থাকায় অপূর্ব সোনালী থেকে কমলা, গোলাপী, লাল, হয়ে গাঢ় লাল টুকটুকে সুজ্জিমামার টুপ্পুস ডুবটা দেখা গেল। গতবার নামদাফা, রোয়িঙেও দেখেছি এবার হাফলঙেও দেখলাম সূর্য্য ডুবে যাবার একঘন্টা পরেও পশ্চিম আকাশ অপরূপ টকটকে লাল রঙে রাঙিয়ে সেজে থাকে। লক্ষ কোটিবার দেখেও সূর্যোদয় আর সূর্যাস্তের দৃশ্য আমায় একইরকম মুগ্ধ, বিস্মিত করে, একঠায় বসে রইলাম যতক্ষণ আকাশে একফোঁটাও আলো রইল। আজ বেশ কয়েকটা ভিউ পয়েন্টই দেখা হল বটে তবে এইটা আমার সবচেয়ে পছন্দ হল।
সূর্যাস্তের একঘন্টা পরে
অ্যাব্রাহাম ভিউ পয়েন্ট থেকে বরাইল পর্বতশ্রেণী আর হাফলং উপত্যকার প্যানোরামিক ভিউ পাওয়া যায়, দেখা যায় নিউ হাফলং রেলওয়ে স্টেশান, রেলওয়ে ব্রিজ, ন্যাশনাল হাইওয়ের বেশ খানিক অংশ। সূর্যাস্ত ছাড়াও এমনিই চুপচাপ বসে থাকার জন্য দারুণ জায়গা। ইতোমধ্যে নশরিং গেস্ট হাউসের ম্যানেজার ফোন করে জানতে চান রাতের খাওয়া নেব কিনা? সে এক বাঙালি ছেলে, সানি দত্ত, বলি অবশ্যই নেব। মেনুতে দেখেছিলাম ডিমাসা-চিকেন, ওইটে হবে কিনা জিগ্যেস করি। একটু ভেবে নিয়ে জানান হ্যাঁ হয়ে যাবে। রাতে ভাত, ডাল আর ডিমাসা-চিকেন দিতে বলে আয়েশ করে বসে কফিতে চুমুক দিই।
শুবজিৎ নাকি সকালে একবার ভাল করে খেয়ে বেরোয় আবার বাড়ি ফিরে খায়, মাঝে আর বিশেষ কিছু খায় না। আজ এদিক ওদিক যাতায়াত করে ওর পেয়েছে জব্বর খিদে অতএব সে রাইস ন্যুডলস নেয়। খাওয়াদাওয়া শেষ করতে করতে অন্ধকার ঘুটঘুটে হয়ে যায়, এবারে ফেরার পালা। কিন্তু এদের সিঁড়িতেও আলো নেই, অগত্যা আবারো শুবজিৎএর হাত ভরসা। সে বিচলিত হয়ে বারবার বলে তোমার তো ভারী সমস্যা, একা একা ঘুরবে কী করে? আমি হেসে বলি এই তোমার মত কেউ না কেউ জুটেই যায় হাত বাড়ানোর জন্য। ঘাড় নেড়ে নেরে বলে ‘প্রবলেম হ্যায় রে’। বারেবারে বলে ওর বাইশ বছরের জীবনে এমন অদ্ভুত পর্যটক ও আর দেখে নি।
গেস্ট হাউসে ফিরে দেখি নশরিং জমজমাট। প্রত্যেক ঘরেই একাধিক অতিথি, একতলাটা পুরোটাই বাঙালিতে ভর্তি। তারা বেজায় চেঁচিয়ে কথা বলে, খ্যাঅ্যাক করে গলা ঝাড়ে, গাঁকগাঁক করে টিভি চালায়। সানি ফোন করে জানালেন খাবার আসতে একটু দেরী হবে। কত দেরী? না এই মাত্র ঘন্টা দেড়েক মত। অগত্যা বই নিয়ে বসি। এদিকে পাশের ঘরে বিয়েবাড়ির মত হইচই চলছে। একজন ভিডিওকলে কাউকে ঘর দেখাচ্ছেন "এই দ্যাখো এইটা গিজার। বাবু স্যুইচটা দে তো এই দ্যাখো আলো জ্বলছে --- জল গরম হচ্ছে।" খাবার এলো রাত দশটা, ঠিকই আছে সাড়ে আটটায় দিতে বলেছিলাম, দেড় ঘন্টাই লেট বটে। ডিমাসা চিকেন খেতে দিব্বি লাগল, নতুন স্বাদের। চালের গুঁড়ো দিয়ে গ্রেভি বানায়, ফলে বেশ গুরুপাক। খেয়েদেয়ে ঘুম, কাল যাবো মাইবং।
আজ আটচল্লিশ বছর পরে কোথা দিয়ে কেটে গেল ২৪শে ডিসেম্বর, ভাল করে টেরই পেলাম না।