এই ধরণের মানুষরা অন্যের খারাপ লাগতে পারে ভেবে নিজের কাজকে কার্পেটের তলায় লুকিয়ে ফেলতে পারেন না, এই ভেবে যে তা করলে জনপ্রিয় হওয়া যাবে । তাঁরা বেশ বিপজ্জনক, তাঁদের থাকে চূড়ান্ত উন্মাদনা, দায়িত্বহীন এনার্জি, যেমন ভাই আর বোনের প্রেম, প্রেমের সীমারেখা লঙ্ঘন করে তারা ।
আমি এখন মলয়দার ‘ছোটোলোকের ছোটোবেলা’ পড়ছি । তাঁর কটু শৈশবের উষ্ণ স্মৃতিচারণা, মতামতে সমঝোতাহীন, অবাক-করা সততা এবং তীক্ষ্ণ ব্যঙ্গে ও বক্রোক্তিতে পরিপূর্ণ । মলয়দার শৈশব কেটেছিল প্রাক-স্বাধীন ভারতের বিহার রাজ্যের পাটনা শহরের এক এঁদো পাড়ায় । বালক মলয়ের চোখ দিয়ে দেখা জগতকে তিনি তুলে ধরেছেন, এবং অনেক সময়ে বর্তমানের জ্ঞানী, চোটখাওয়া লেখকের দয়াহীন সততায় গড়ে তুলেছেন ন্যারেটিভ । তাঁদের পরিবার, সাবর্ণ রায়চৌধুরীদের বংশ, মিথ্যা কুসংস্কার ও অতীত গৌরবে আক্রান্ত, অসহ্য দারিদ্রের মাঝে মাথা চাড়া দিয়েছিল । মলয় দারিদ্রের কথা বলেন, প্রথম দেখা এক উলঙ্গ বিধবার কথা, দুইজন বোবা দর্জি যারা তাঁদের বাড়ির সকলের পোশাক সেলাই করত, পায়খানা থেকে বেরিয়ে অদ্ভুত নিয়মপালন, পাটনা মিউজিয়ামের কিপার অব পেইনটিংস অ্যাণ্ড স্কাল্পচার তাঁর বড়োজেঠার সঙ্গে সেখানে গিয়ে দর্শনার্থীরা কেমন গ্রিক মূর্তির লিঙ্গে হাত দিচ্ছে তা এক বালকের বিস্ময়ে যে ঢেউ তোলে তার বর্ণনা ।
বইটা থেকে পাঠক পাবেন অনেককিছু, যা চাই তাই, সবকিছু, যখন কিনা প্রথম দৃশ্য থেকে শুরু হয় মলয়দার পনেরো বছরের জাঠতুতো ভাই বাড়িতে একজন বেশ্যাকে এনে বিদায় দেবার সময়ে মাঝরাতে ধরা পড়ার ঘটনা । কম বললেও একথা বলতে হয় যে মলয় রায়চৌধুরী একজন ডিস্টার্বিং লেখক । অনেক সময়ে আমি ওনার গড়ে তোলা দৃশ্যাবলী ও ঘটনায় প্রতিহত হই, এমনকি বিবমিষায় আক্রান্ত হই । কখনও বা মনে হয় তাঁর কবিতা যেন ফাঁদ পেতে রাখে, মর্মার্থহীন গোঁসায় ঠাশা, নঙর্থক এবং উত্তেজনাপূর্ণ । তারপর আমি ফিরে আসি সন্ধ্যার প্রশান্তিতে এবং সবকিছু আবার নিজের জায়গায় স্হান করে নেয় — সময়, ক্রোধ, মানুষের অবস্হার প্রতি অবিশ্বাস ।
আশি বছর বয়সের এই মানুষটার সঙ্গে কথা বলার সময়ে আমি ক্রুদ্ধ এবং নিজেকে ব্যর্থ অনুভব করি, যে লোকটা অবসর নিয়ে স্ত্রীর সঙ্গে মুম্বাইতে থাকেন । লোকটার এতো বুকের পাটা হলো কেমন করে যে বিস্ময়করভাবে নিজের সততা প্রকাশ করে ? কোন সে স্পর্ধার অনুমতি লোকটা পেয়েছে যে এরকম দায়িত্বজ্ঞানহীনভাবে স্বাধীন । এই প্রশ্নগুলো মলয়দাকে করলে আমি ওনার দেয়া উত্তরে নিঃশব্দ হাসি শুনতে পাই:-
“তুই কি কখনও ভেবে দেখেছিস তোর জীবনে কে এমন হতে পারে যাকে তুই একই সঙ্গে ভালোবাসিস আর ঘৃণা করিস ? আমি সেই ধরণের ক্ষতিকর জীব যে আক্রান্ত হওয়াকে উপভোগ করে ! তুই কি লক্ষ্য করেছিস যে আলফা পুরুষ জানোয়ার তার বিপক্ষকে হারাবার জন্য মাথাকে ব্যবহার করে ? বাইসন, জিরাফ, সিংহ, হাতি, গণ্ডার, কুমির, যেকোনো ক্ষমতাবান জানোয়ার । আমি সেই ধরণের জানোয়ারদের মতন অস্তিত্ব বজায় রাখি, যারা একটা দলের নেতৃত্ব দেয় । যেমন সিংহ । সিংহের মতন আমি একাকীত্ব পছন্দ করি । লেখার জন্য আমি আমার মস্তিষ্ক ব্যবহার করি । পাঠক তো অপ্রাসঙ্গিক । ভাষাই হলো প্রেমিকা, যাকে আমি ভালোবাসি।” আমরা যারা ভেবেচিন্তে পা ফেলি তারা এই ধরণের ঔদ্ধত্য কেবল হাঁ করে দেখি । আমরা একে বলতে পারি ক্ষিপ্ত তারস্বর ; আমরা উত্যক্ত হয়ে পাতার পর পাতা বিতর্ক করতে পারি, ওনাকে ঘরে তালা বন্ধ করে রাখতে পারি, কিন্তু ওনাদের কলম কেড়ে নেবার ক্ষমতা, কষ্টযন্ত্রণা লাঘব করার ক্ষমতা, আমাদের নেই ।