এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • হরিদাস পাল  আলোচনা  গান

  • এক গান, দুই গায়ক, তিন বন্ধু

    সম্বিৎ লেখকের গ্রাহক হোন
    আলোচনা | গান | ০৫ ডিসেম্বর ২০২২ | ১২৯৭ বার পঠিত | রেটিং ৫ (১ জন)
  • কুমিল্লা মশাই এক আশ্চর্য জায়গা। গেল শতাব্দীর দশ আর বিশের দশকে তিন বন্ধু গানে মশগুল থাকত। হিন্দি-উর্দুর বাগধারা ধার করে বলা যায় বলা যায় তিন বন্ধু একসঙ্গে হলে চার চাঁদ লেগে যেত। তাদের মধ্যে দুজন কলকাতায় পড়াশুনো করতে এলেন ১৯২৪ সালে। তৃতীয়জনও একই সময়ে এসে থাকবেন, যদিও আমি কোথাও সেই তথ্য পাচ্ছি না। প্রথমজন হলে হিমাংশু দত্ত, দ্বিতীয়জন হলেন কুমার শচীন দেববর্মন আর তৃতীয়জন হলেন অজয় ভট্টাচার্য। 

    হিমাংশু দত্ত, যাঁকে সলিল চৌধুরী বলেছিলেন 'দা ফাদার অফ মডার্ন বেঙ্গলি সংস', মারা যান ১৯৪৪ সালে। সেই অল্প জীবনের মধ্যে রবীন্দ্র-নজরুলের তুমুল উপস্থিতির মধ্যে স্বল্প কিছু সুর দিয়ে নিজের স্বকীয়তা এমনই দেখিয়েছিলেন, আজও বাঙলা গানের জহুরীরা হিমাংশু দত্তর সুর বললে গড়াগড়ি যান। হিমাংশু দত্তর কিছু সুরে পশ্চিমী চলনের ছাপ স্পষ্ট, যেমন 'তোমারই পথপানে চাহি' (অন্যপাঠে 'তোমারই মুখপানে চাহি')। কিন্তু হিমাংশু দত্ত সঙ্গীতের পশ্চিমী প্রকরণ, বিশেষতঃ হার্মনি - সুরসঙ্গতি - সেরকম আত্মস্থ করেন নি। তাঁর সুরের বৈশিষ্ট্য ছিল, প্রকরণ যাই হোক শেষ পর্যন্ত তা বাংলা গান হয়ে উঠছে। যে পথ আগে রবীন্দ্রনাথ ও দ্বিজেন্দ্রলাল দেখিয়ে গেছেন। হিমাংশু দত্তর গানের সুরে ভারতীয় রাগ সঙ্গীতের ছাপই বেশি। অথচ, প্রচলিত রাগের ভেতর থেকে বের করে আনতে পারতে অচেনা ফ্রেজ।

    অজয় ভট্টাচার্যও ব্যতিক্রমী গীতিকার ছিলেন। সুধীর চক্রবর্তী বলেছিলেন যে, যখন রবীন্দ্রনাথের দেখানো সঞ্চারীর ধরণ যখন অন্য কোন গান লিখিয়ে অনুসরণ করতে পারেন নি - সবাই শুধু সুরের পরিবর্তনের জন্যে সঞ্চারী ব্যবহার করতেন - তখন অজয় ভট্টাচার্যই একমাত্র  রবীন্দ্র-অনুসারী, অন্ততঃ কিছুটা, হতে পেরেছিলেন। এখানে সেই সঞ্চারীর বৈশিষ্ট্য বলি। রবীন্দ্রনাথের গান খুবই ব্যক্তিগত। তাঁর আনুষ্ঠানিক বা স্বদেশ পর্যায়ের অল্প কিছু গান বাদ দিলে সব গানই তাঁর ব্যক্তিগত উচ্চারণ। কিন্তু তিনি সঞ্চারীতে প্রচলিত সুরে চলনে পরিবর্তন আনার সঙ্গে সঙ্গে গানের কথা ব্যক্তিগত উচ্চারণকে তুলে নিয়ে যেতেন এক সার্বজনীন বাচ্যে। যদিও এ গানে সঞ্চারী নেই। সুধীর চক্রবর্তীর সঙ্গে আমি এখানে একমত না হয়েও বলতে পারি, ভাষার ব্যবহারে না হলেও, চিত্রকল্পে অজয় ভট্টাচার্য তুলনামূলকভাবে রবীন্দ্র-অনুসারী।

    শচীন দেববর্মনের কথা আর কীই বা বলা যায়। কী পরিবেশন, কী সঙ্গীতসৃষ্টি - দুয়েই ফার্স্ট-ক্লাস-ফার্স্ট। শচীনকর্তার সাঙ্গীতিক বুনিয়াদ তৈরি হয়েছিল ত্রিপুরা, কিন্তু তার চেয়েও বেশি, কুমিল্লা অঞ্চলের লোকসঙ্গীতে আরে হিন্দুস্তানী শাস্ত্রীয়সঙ্গীতে। ভীষ্মদেব চট্টোপাধ্যায় একই সঙ্গে তাঁর সাঙ্গীতিক গুরু ও বন্ধু। কিন্তু শচীনদেবের বাংলা গানের সুরে আমি হিমাংশু দত্তর প্রভাব শুনতে পাই। বাহার রাগে হিমাংশু দত্তর সুরে 'আলোছায়া দোলা' গানটি শচীনদেবের সুরও হতে পারত। ঠিক যেমন শচীনদেবের সুরে মারু-বেহাগে 'শ্রীমতি যে কাঁদে' গানটা হিমাংশু দত্তর সুর হতে পারত।

    ১৯৩৪ সালে হিমাংশু দত্তর সুরে, অজয় ভট্টাচার্যর কথা শচীন দেববর্মনের রেকর্ড বেরোল যার একদিকে 'আলোছায়া দোলা' আর অন্যদিকে 'যদি দখিনাপবন আসিয়া ফিরে গো দ্বারে'। প্রথম গান বাহার রাগে। দ্বিতীয় গান, আমি স্থির করেছিলাম, জৌনপুরী রাগে। কবীর সুমন দেখলাম বলছেন, গানটা 'দেবগান্ধার' রাগে। পরে শুনলাম ভীষ্মদেব চট্টোপাধ্যায়ের পুত্র জয়ন্ত চট্টোপাধ্যায় জানাচ্ছেন, গানটা গান্ধারী রাগে - জৌনপুরীতে শুদ্ধ গান্ধার লাগালে সে রাগ পাওয়া যায়। কথায় আছে পন্ডিতরা যেখানে একমত হতে পারছেন না, সেখানে মূর্খের মুখ খোলা কদাপি উচিত নয়। তবে মুর্শিদ মুজতবা বলেছেন, সেখানেই বরং মূর্খ মুখ খুলতে পারে, কারণ পন্ডিতরা একমত নয় বলে সমবেত কিল-চড়ের হাত থেকে রেহাই পাওয়ার সম্ভাবনা আছে। 

    কিন্তু রাগ-টাগ নয়। আসল কথা হল, গানটা হিমাংশু দত্ত নিয়েছিলেন সায়গল সাহেবের 'ঝুলন ঝুলায়ে' বলে একটা গান থেকে।.১৯৩৩ সালে প্রকাশিত এই গানটার সুর যে কার রচনা, তার খোঁজ আমি পাইনি। প্রচলিত বন্দিশ থেকে আহৃত? সায়গাল সাহেবের নিজের রচনা? তাঁর কোন গুরুর? রাইচাঁদ বড়াল বা পঙ্কজ মল্লিক - যাঁরা সেই সময়ে নিউ থিয়েটার্সের বাঁধা সঙ্গীত পরিচালক ছিলেন? জানিনা। রাইবাবু বা পঙ্কজ মল্লিককে বাদ দেওয়া যেতে পারে। কারণ ঠিক পরের বছরই বাংলায় হিমাংশু দত্ত এই সুর নিজের নামে চালাবেন, তার সম্ভাবনা কম। কিন্তু সায়গলের গানটায় তান-টান রেখেও সুরের পরিমিতিবোধ দিয়ে, আর সুরের যে অংশগুলোর জন্যে গানটার বৈশিষ্ট্য সেগুলো হাইলাইট করে যে সুর করলেন - সেটি আপাদামস্তক একটি বাংলা গান হয়ে উঠল। সাধে কী আর বলি, এই তিন লগনচাঁদা কুমিল্ল্যা বছর পনেরোর মধ্যে এমন সব বাংলা গান দিলেন যে চিরকালের জন্যে বাংলা গান বদলে গেল।

    মজার কথা হল, কৃষণরাও শংকর পণ্ডিতের দেবগান্ধার শুনুন। সায়গল বা শচীনকর্তার গানের সুরের সঙ্গে মিল পাবেন। প্রসঙ্গতঃ ইউটিউবে আব্দুল করিম খানের দেবগান্ধারী রাগে একখানা মারাঠি নাট্যসঙ্গীত আছে। উৎসাহীরা শুনে দেখতে পারেন।


    রইল মল্লিকার্জু্ন বুয়ার গান্ধারী। ডি ভি পালুসকরের গান্ধারী একটা রেকর্ডিংও ইউটিউবে আছে। 


    অবশ্যই সায়গল-সাহবের গানটা। 


    আর সঙ্গে রইলে কর্তার গানখানা যা শুধু কর্তার গান নয় - তিন বন্ধু - হিমাংশু-অজয়-শচীনের গান।

     
    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।
  • আলোচনা | ০৫ ডিসেম্বর ২০২২ | ১২৯৭ বার পঠিত
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • হীরেন সিংহরায় | ০৫ ডিসেম্বর ২০২২ ১৪:২৫514408
  • অশেষ ধন্যবাদ !  হিমাংশু দত্ত অসাধারণ। সলিল চৌধুরীর আগে শ্রেষ্ঠ বাঙালি সংগীতকার । খুব ছোটবেলায় গ্রামের বাড়িতে দম দেওয়া গ্রামোফোনে ( তার নাম ছিল কলের গান!) গালার রেকর্ডে শোনা - রাতের ময়ূর ছড়ালো যে পাখা আকাশের নীল গায়। এখনো বুকের ভেতরে বাজে - তুমি কোথায় তুমি কোথায়। 
  • সন্তোষ বন্দোপাধ্যায় | 2401:4900:1042:36e7:0:29:8d46:***:*** | ০৬ ডিসেম্বর ২০২২ ১৮:০৪514424
  • অপূর্ব !! প্রতিবেদন কারী তাঁর মুনসীয়ানা ‌‌‌‌‌‌দেখিয়েছেন! এই বিষয়ে আরো অজানা তথ্য আমাদের ঋদ্ধ করতে পারে। ধন্যবাদ!!
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : guruchandali@gmail.com ।


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। চটপট মতামত দিন