সৌম্যদের ফ্ল্যাট আজ জমজমাট। কেস সলভের উদযাপনে জড়ো হয়েছে সবাই। সবাই বলতে সাতজন। সৌম্য, রজত, মানস, পৃথা, মহেশ, দিব্যেন্দুবাবু, এবং সোহিনীদেবী। ওদের দু’-কামরার ফ্ল্যাটের পক্ষে অনেক লোক।
সোহিনীদেবী চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে দিব্যেন্দুবাবুকে বললেন, “আপনার সাহস আছে মশাই। সরকারি চাকরি করে মন্ত্রীকে জেলে পুরলেন?”
দিব্যেন্দুবাবু বললেন, “আমিও যে একটু ভয়ে ভয়ে ছিলাম না এমন কিন্তু ভাববেন না। তবে ইনহেলারের গায়ে তুষারবাবুর আঙুলের ছাপটা পেয়ে যাওয়ায় অনেকটা নিশ্চিন্ত হওয়া গেছিল। ওই পলিটিক্যাল পার্টির লোকজন বলে না, কালো হাত ভেঙে দাও, গুঁড়িয়ে দাও – শেষমেশ ওই কালো হাতই বাঁচাল। তবে কদ্দিন ভেতরে থাকবেন কে জানে? হয়তো দু’দিন বাদেই জামিনে বাইরে এসে আমায় বদলি করে দেবেন কোনো উল্টোপাল্টা জায়গায়। তবে পার্টি মোটামুটি দায় ঝেড়ে ফেলেছে। তাই আশা করছি খুব একটা সুবিধে করে উঠতে পারবেন না।”
পৃথা, হঠাৎ কিছু মনে পড়ে গেছে এমনভাবে বলল, “মানে ওই ইনহেলারটা যেটা রজতবাবু আমাকে দিলেন ট্যাক্সিতে ওঠার সময়। বললেন হাত না লাগাতে? ওইটায় তুষারবাবুর হাতের ছাপ আছে?”
রজত লক্ষ্য করলো যে পৃথা তুষারবাবুকে “বাবা” বলে সম্বোধন করা ছেড়ে দিয়েছে। রজত মনে মনে ভাবল, এরকম একটা ঘটনার পর নিজের বাবাকেই বাবা বলে ডাকার প্রবৃত্তি হবে না, ইনি তো শ্বশুর। পৃথা তবু ভাল, এখনো নামের শেষে “বাবু” লাগাচ্ছে। রজত নিজে হলে সম্ভবত অন্য কিছু লাগাত।
তারপর একটু হেসে পৃথার প্রশ্নের উত্তরে বলল, “আপনার কি মনে হয়, যে ওরকম একটা গুরুত্বপূর্ণ এভিডেন্স আমরা বা পুলিশ এ’রকমভাবে লোকজনের হাতে তুলে দেবে? আসলে এই কেসটার অনেকটাই দাঁড়িয়ে ছিল আপনার অবস্থানের ওপর। তুহিন যে ইনহেলারে মেশানো বিষ থেকেই মারা গেছিল, সে তো ঋকের বাড়ি থেকে ইনহেলারটা উদ্ধার করে তার অ্যানালিসিস করেই বোঝা গেল। কিন্তু প্রশ্নটা থেকে গেল – ওকে ইনহেলারটা দিল কে? তুহিনের কাজের দিন সৌম্য আপনাকে ইনহেলার নিতে দেখেছিল। তাই সবথেকে বেশি সম্ভাবনাটা আপনার দিকেই ছিল। ঋকের বাড়িতে পাওয়া ইনহেলারের গায়ে অবভিয়াসলি আপনার হাতের ছাপও পাওয়া গেল। সুতরাং আমরা ধরেই নিলাম যে ওই ইনহেলারটা তুহিনকে আপনিই দিয়েছিলেন। তাহলে প্রশ্নটা গিয়ে দাঁড়ালো যে আপনি কি জেনেশুনে ওকে বিষ মেশানো ইনহেলারটা দিয়েছিলেন, নাকি নিজের অজান্তে? যদি আপনি নিজের অজান্তে দিযে থাকেন, তাহলে খুনির লক্ষ্য তুহিন ছিল না, ছিলেন আপনি। তাই এই প্রশ্নটার উত্তর জানাটা খুব প্রয়োজন ছিল। সেই জন্য সেইদিন ইনহেলারটা হঠাৎ করে আপনাকে দেওয়া হল যখন আপনি তাড়াহুড়োর মধ্যে আছেন। আপনি হাতে নিয়েই স্বাভাবিক প্রতিবর্ত ক্রিয়ায় বললেন, যে এটা আপনিই তুহিনকে দিয়েছিলেন। যদি ওই ইনহেলারে আপনিই বিষ মিশিয়ে রাখতেন, তাহলে কি সেটা নিজে থেকেই স্বতস্ফূর্তভাবে আমাদের বলে দিতেন?”
পৃথা জিজ্ঞেস করল, “আর আমি যদি জেনেশুনে নিজেকে নির্দোষ প্রমাণের জন্য ওটা বলে থাকি?”
সৌম্য হা হা করে হেসে বলল, “রজতের অবজারভেশন লাই ডিটেক্টরের ওপর দিয়ে যায়। মিথ্যে বলে ওর হাত থেকে বাঁচা মুশকিল। তাই আমিও কোনো গণ্ডগোল করলে সঙ্গে সঙ্গে স্বীকার করে নিই। কক্ষনো লুকোই না।”
রজত সৌম্যর কথায় একটু লজ্জা পেয়ে বলল, “না, তেমন কিছু নয়। কিন্তু অত কিছু ভেবে উত্তর দেওয়ার জন্য আপনার তো একটু সময় চাই। আপনি কিন্তু সেদিন কোনো সময় নেননি। তাছাড়া আপনার মুখ চোখের অভিব্যক্তিরও কোনো পরিবর্তন হয়নি। এতটা করতে হলে আপনাকে পেশাদার অপরাধী হতে হবে।”
পৃথা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে বলল, “আপনারা তো খুব খারাপ লোক মশাই। ওই দিন ও’রকম দুম করে আমাকে বাড়ি থেকে বার করে নিয়ে গেলেন, কী ভয়ানক টেনশনে ছিলাম, সে আর আপনারা কী বুঝবেন?”
রজত খানিকটা কৈফিয়ত দেওয়ার মত করে বলল, “না না, আপনাকে হেনস্থা করার কোনো অভিপ্রায় আমাদের ছিল না। কিন্তু ওই বাড়িতে আপনাকে রাখতে আমরা সাহস পাচ্ছিলাম না। যতই হোক, সাপ যে আবার ছোবল মারবে না – তার গ্যারান্টি কী?”
মানস একটু ফিক করে হেসে বলল, “হোমো সাপ”। তারপর বলল, “কিন্তু আমাকে একটা জিনিস বল, লোকটা যখন নিজেই গে, তখন ছেলেকে এত হেনস্থা করতো কেন?”
সৌম্য বলল, “এটাকে আসলে বলে ইন্টার্নালাইজড হোমোফোবিয়া। অনেক হোমোফোবিক মানুষ আসলে নিজেরাই গে বা লেসবিয়ান। নিজেদের ওরিয়েন্টেশনকে ঢাকতে এরা ওভার কম্পেনসেশন করে আরো বেশি বেশি হোমোফোবিক হয়ে যায়। এরা সব সময় ভয়ে ভয়ে থাকে, যে যদি এরা কুইয়ার মানুষজনকে সাপোর্ট করে, তবে লোকে এদের কুইয়ার ভাববে। তুষারবাবুও তাদের মধ্যে একজন। তার সাথেই ছিল কনজারভেটিভ ভোটব্যাংক হারানোর ভয়। সব মিলিয়ে উনি ওই রকম হোমোফোবিক হয়ে উঠেছিলেন। তবে শুধু তুষারবাবু নন, মনে রাখিস আমাদের পলিটিশিয়ানদের অনেকেই এর শিকার। আমি ধরে ধরে এরকম বেশ কয়েকজন পলিটিশিয়ানের নাম বলে দিতে পারি। বিশেষত দিল্লি আর ব্যাঙ্গালোরের। আর আনন্দের মত এরকম অল্পবয়সী, আকর্ষক ছেলেরা এইসব হাই এন্ড ক্লায়েন্টদের গোপনে সার্ভিস দেয়, ফর সাম ক্যুইক ক্যাশ। অল গোজ ওয়েল যতক্ষণ না কোনও গোপন ক্যামেরায় কিছু রেকর্ড হয়ে যায়।”
“কিন্তু তুহিনটাই বা এমন বাপের জন্য এতটা রিস্ক কেন নিতে গেল বল তো?” মানস আবার জিজ্ঞেস করল।
সৌম্য একটা নিশ্বাস ফেলে বলল, “সেটাই তো আমাদের চরিত্রের বৈশিষ্ট। কাছের লোক, বিশেষত বাবা-মায়ের থেকে approval পাওয়ার জন্য আমরা সারা জীবন অপেক্ষা করে থাকি। তুহিনও সম্ভবত সেটাই ভেবেছিল, যে তুষারবাবুকে এই বিপদ থেকে বাঁচালে হয়তো উনি ওকে মেনে নেবেন। ও বুঝতে পারেনি, যে মেনে নেওয়া আর না নেওয়া – সেটা তুই কী করলি আর না করলি তার ওপর ডিপেন্ড করে না। এটা তো ঠিক ট্রান্সাকশনের ব্যাপার নয়। আসলে তুহিনের প্রতি তুষারবাবুর যে ব্যবহারটা ছিল, সেটা ছিল নিজের প্রতি ঘৃণার রিফ্লেকশন। তার সঙ্গে তুহিন কী করল, না করল – তার কোনো সম্পর্ক ছিল না।”
“সত্যি বাবা” হঠাৎ একটা স্বগতোক্তি বার হয়ে এল সোহিনীদেবীর মুখ থেকে। “ঘাটের মড়া বুড়ো বউটাকে মারতে গিয়ে ছেলেকে মারল আর শেষে নিজেই কিনা… ছিঃ।”
রজত বুঝতে পারল না, সোহিনীদেবী ঠিক কোনটাকে ছিঃ বললেন। তুষারবাবুর আচরণকে, না সমকামিতাকে। ও একটু ক্ষুব্ধ স্বরেই বলল, “স্বাভাবিক প্রবৃত্তিকে জোর করে ঢাকাচাপা দিয়ে রাখলে তা পচে উঠে গন্ধ বেরোবেই।”
সেহিনীদেবী বললেন, “তা ঢাকাচাপা দিয়ে রাখাই বা কেন বাপু?”
রজত গোমড়ামুখে বলল, “ঢাকা চাপা না দিয়ে রাখার জো আছে? সত্যি কথা শোনার সাহস কজনের আছে?”
সোহিনীদেবী একটু তীক্ষ্ণ স্বরেই বললেন, “বলার সাহসই বা ক’জনের আছে?”
তারপর সোজা সৌম্যর দিকে ফিরে বললেন, “তোমাদের বাসায় দুটো শোওয়ার ঘর। আমি না থাকলে রজত নাকি এই গেস্টরুমটায় শোয়। তা আমাকে একটা কথা একটু বুঝিয়ে বলবি, যে ছেলে গরমে দিনে তিনবার চান না করে থাকতে পারে না, সে ওই ঢিকিস ঢিকিস ফ্যানের তলায় কী করে এই কলকাতার গরমে রাত কাটায়? আর কেনই বা পুরো গরমকালে পাখাটাকে সারিয়ে নেয় না?”
তারপর রজতের দিকে ফিরে বললেন, “আর তুমি বাপু নাকি কাজের জন্য এই বাড়িতে থাকলে ওই গেস্টরুমেই শোও। তা এই বাথরুমে রাখা টুথপেস্টটার গায়ে এত ধুলো জমে কোত্থেকে বলতে পার? প্রতি দু’-তিন মাস পরপর এসে দেখি ওই বাথরুমের পেস্ট-সাবান পাল্টে যায়, এই বাথরুমে পেস্টের টিউবের গায়ে আমি যেমনটি দাগ কেটে রেখে যাই, তেমনটিই থাকে। এতটুকুনি খরচ হয় না। অথচ ফোনে প্রায়ই শুনি, তুমি নাকি রাত্রে কাজের প্রয়োজনে এখানে ছিল। তা বাপু, মুখটুখ ধোও না নাকি? নাকি রাত্রে এই ঘরে শুয়ে সকালে উঠে ওই বাথরুমে যাও মুখ ধুতে?”
সোহিনীদেবীর কথা বলার ধরণ শুনে সবাই হো হো করে হাসতে শুরু করে দিল। পৃথা বলল, “কাকিমার তো সাংঘাতিক নজর!”
সোহিনীদেবী বললেন, “সাংঘাতিক নজরের আর কী দরকার বল তো? তিরিশ পেরুনো দুটো ছেলে বিয়ে-থা না করে একসাথে থাকছে, একজনের বাড়ির তেল-নুন-মশলা মায় ঘর মোছার ন্যাকড়াটা কোথায় থাকে সেটা অন্যজন জানে, আর অন্যজনের কোন খাবারে কতটা নুন লাগে সেটা প্রথমজন জানে। তার ওপর আবার একজনের বিয়ের কথা বললে অন্যের মুখ গোমড়া হয়ে যায়। আরে বাবা, আমিও তো ইস্কুলে পড়িয়েছি, নাকি? এতদিনে কম ছেলেপুলে তো দেখলাম না। কোনটা বন্ধুত্ব আর কোনটা তার থেকে বেশি কিছু, তা ক্লাসে বসে ফিসফিস করার রকম দেখেই বুঝতে পারি।”
সৌম্য একটু অনুযোগের গলায় বলল, “তাহলে এতদিন বিয়ে বিয়ে করতে কেন?”
সোহিনী দেবী বললেন, “বিয়ে করে থিতু হতে বলেছি। কিন্তু মেয়ে বিয়ে করতে হবে এমন কখনো বলেছি? এখনো তো বলছি, বিয়ে করবি তো করে নে। আমি দাঁড়িয়ে থেকে বিয়ে দেব।”
মানস হাঁ হয়ে বলল, “বাপ রে, কাকিমা তো পুরো অ্যাক্টিভিস্ট! লোকজনের কথারও কোনো টেনশন নেই দেখছি।”
সোহিনীদেবী একটু গাঢ় গলায় বললেন, “লোকজন? সৌম্যর বাবা মারা যাওয়ার পর ঝড় ঝাপ্টা সামলে এই যে ছেলেকে বড় করলাম, ক’টা লোকজন এসে সাহায্য করেছে যে আজ কিছু বলতে আসবে?”
তারপর মানসকে একটু হালকা গলায় বললেন, “তুমিও যদি কাউকে পাও তো নিয়ে এস। এক লগ্নেই বিয়ে দিয়ে দিই। কেউ আছে তো বল, লুকিয়ে রেখ না।”
মানস হাতজোড় করে বলল, “পেলেই সোজা আপনার কাছে নিয়ে আসব কাকিমা। নো ঢাকাচাপা। আপনার কাছে লুকিয়ে লাভ নেই বুঝে গেছি। আপনি শার্লকহোমসের বাবা!”
সোহিনীদেবী বললেন, “ধুর মুখপোড়া। ওই সাদা চামড়ার বাপ কেন হতে যাব? কেন সৌম্য-রজতের মা বুঝি গোয়েন্দা হতে পারে না? ওই যে ঋতুপর্ণর সিনেমাটায় রাখির মত।”
রজত হঠাৎ স্বভাববিরুদ্ধ ভাবে চেঁচিয়ে উঠল, “থ্রি চিয়ার্স ফর কাকিমা ডিটেক্টিভ, হিপ হিপ হুররে।”
সৌম্য উঠে গিয়ে সোহিনীদেবীর কাঁধে মাথা রাখল।
ঘরে তখন সবার মুখে হাসি, চোখে জল।
এই লেখাটা উৎসর্গ করলাম বন্ধু জয়দীপের স্বর্গগতা মা এবং আমাদের কাকিমা মমতা জানা এবং তাঁদের মত বাকি অনেক মায়েদেরকে যাঁরা শুধু সমাজের নয়, নিজেদেরও অনেকদিনের জানাবোঝার বাইরে বেরিয়ে তাঁদের সমকামী সন্তানদের পাশে দাঁড়িয়েছেন। তাঁদের মত মানুষদের জন্যই ভারতের প্রান্তিক যৌনতার মানুষদের ওপর থেকে ৩৭৭-এর অভিশাপ সরে গেছে।