সৌম্য বাড়ি ফিরে দেখল রজত মাইক্রোওয়েভে খাবার গরম করছে। চাইনিজ। বাইরে থেকে নিয়ে এসেছে।
সৌম্য হাত মুখ ধুয়ে কিচেনে এসে দুটো থালা ধুতে ধুতে বলল “খবরগুলো পাওয়া গেল?”
রজত বলল, “অনেকটা।”
সৌম্য থালা আর গ্লাস টেবিলে রেখে বলল, “নে, এক এক করে বল, খেতে খেতে শুনি।”
নিজের প্লেট থেকে চামচে করে চাউমিন তুলে সৌম্যর প্লেটে দিল রজত। খাবারের প্রথম গ্রাসটা একে অন্যকে বেড়ে দেয় ওরা। বহুদিনের অভ্যেস। আগে বেশ একটা প্রেম-প্রেম ব্যাপার ছিল। এখন সেটা এতটাই অভ্যাসে পরিণত হয়ে গেছে, যে খাওয়ার শুরুতে এই কাজটা আপনাআপনিই হয়ে যায়।
রজত চাওমিন মুখে পুরে বলল, “তোর অনুমানটাই ঠিক। তুহিন সেদিন পুরো সন্ধ্যেটা ঋকের বাড়িতে ছিল না। অন্তত একবার তো বেরিয়েইছিল। ওর কল লিস্ট থেকে জানা যাচ্ছে, যে সন্ধ্যে পাঁচটা পঞ্চান্নয় ওর ফোনে একটা কল আসে। দিল্লির নাম্বার। সাম আনন্দ মিশ্র। মিনিট পাঁচেক কথা হয়। তারপর তুহিনের ফোন থেকে ওই নাম্বারে আবার একটা ফোন যায়। সেটা সাতটা পনেরোয়। সেই ফোনটা যখন করা হয়, তখন তুহিনের টাওয়ার লোকেশন হাওড়া স্টেশনের কাছাকাছি। এইবার কল ডিউরেশন দু’মিনিটেরও কম। এর ঠিক পরেই ও পৃথাকে মেসেজ করে। এরপর অনেকক্ষণ কোনো কল রেকর্ড নেই। তারপর আবার তুহিনের ফোনে কল ঢোকে রাত দশটায়। লোকেশন ঋকের বাড়ি। ফোন এসেছিল ফুড ডেলিভারি বয়ের কাছ থেকে।”
সৌম্য চিন্তিত মুখে মাথা নাড়ল। তারপর বলল, “তার মানে তুহিন সন্ধ্যেবেলা ঋকের বাড়িতে ছিল না। অর্থাৎ, বিষপ্রয়োগটা ও যেখানে গেছিল সেখানেও হতে পারে।”
রজত বলল, “ঠিক। কিন্তু আমাকে একটা কথা বল। তুই কী করে আগেভাগেই অনুমান করেছিলি, যে তুহিন সেদিন বিকেলে বা সন্ধেয় বাড়ির বাইরে ছিল?”
সৌম্য বলল, “দ্যাখ, সেদিন ঋকের বাড়িতে আমরা বেসিনে দুটো ডিনারের থালা দেখেছিলাম। কিন্তু কফি কাপ ছিল একটা। অর্থাৎ, বিকেলে ঋক যখন কফি খেয়েছে, তখন তুহিন বাড়িতে ছিল না।”
- কিন্তু এটাও তো হতে পারে যে তুহিন কফি খায়নি। বা, ঋক বাড়ির বাইরে ছিল?
- হতেই পারত, কিন্তু সেটা যে হয়নি সেটা বুঝতে গেলে তোকে তুহিনকে জানতে হবে। আশেপাশে কফি হবে আর ও কফি খাবে না, এটা অসম্ভব। আর ও কক্ষনো দুধ-কফি খায় না। অলওয়েজ ব্ল্যাক কফি। ও ল্যাকটোজ ইনটলারেন্ট। আর ওই বেসিনের কফি মগে দুধ-কফি খাওয়া হয়েছিল। অতএব অনুমান, ঋক যখন কফি খেয়েছে, তখন তুহিন বাড়ি ছিল না।
“স্প্লেন্ডিড।” উচ্ছসিত হয়ে বলল রজত।
সৌম্য ওর উচ্ছাসে জল ঢেলে দিয়ে বললো, “ম্যাডাম সত্যবতী, এটা আপনিও বুঝতে পারতেন, যদি আপনি তুহিনকে চিনতেন। এতে বিশেষ কোনো গোয়েন্দাগিরি নেই।”
রজত বলল, “তবে আমি কিন্তু এর মধ্যে একটা গোয়েন্দাগিরি করে ফেলেছি।”
- কী রকম?
- আমি দিল্লির লোকজনের কাছে খোঁজ নিয়ে জানলাম আনন্দ মিশ্র, মানে তুহিনকে ওই দিন বিকেল যে ফোনে করেছিল, সে গে সার্কেলে বেশ পরিচিত মুখ। দেখতে শুনতে খুবই ভালো এবং দক্ষ প্লেবয়।
- হুম। ছবিটবি পাওয়া গেল?
- ইশশ্, যেই বলেছি দেখতে শুনতে ভালো, অমনি ছবির খোঁজ, না?
- আরে না রে বাবা। দরকার আছে। একটু ইনস্টা বা ফেসবুক দ্যাখ তো। প্লেবয় যখন, সোশ্যাল মিডিয়ায় নিশ্চয়ই থাকবে।
রজত খানিক বাদেই ইনস্টা থেকে দিল্লির আনন্দ মিশ্রর প্রোফাইল বার করে সৌম্যকে দেখাল। ছবি, ভিডিও, কমন ফ্রেন্ড দেখে অনুমান করা যায় এই সেই উদ্দিষ্ট ব্যক্তি। সত্যিই আকর্ষণীয় চেহারা। পেটানো শরীরের সঙ্গে মিষ্টি হাসি আর মুখে একটা অদ্ভুত সারল্য। বহু ছেলে যে এর প্রেমে পড়ে, তার যথেষ্ট কারণ আছে।
সৌম্য ভালো করে দেখে ওর মুখের একটা ক্লোজআপ ছবি ডাউনলোড করে নিল। আড়চোখে দেখল, রজত গম্ভীর মুখে দেখেছে। মনে মনে একটু হেসে সৌম্য ছবিটা মানসকে হোয়াটস্যাপে পাঠিয়ে দিল। সঙ্গে প্রশ্ন, “এ কি সেই সন্ধ্যের পার্টিতে ছিল?”
দু’সেকেন্ডের মধ্যেই উত্তর এসে গেল, “হ্যাঁ, এই সেই আমন শর্মা, যে এসে তুহিনের ঘাড়ে চুমু খেয়ে বলেছিল ‘আই মিসড ইওর সেক্সি নেক’।”
সৌম্য মেসেজটা রজতকে দেখাল। রজত মেসেজটা পড়ে খানিকটা আশাহত আর খানিকটা অবিশ্বাসী গলায় বলল, “তার মানে তুহিন ঋককে ঠকিয়ে ডবল টাইমিং করছিল?”
- হতে পারে। তবে আমার ধারণা অন্য
- কী?
- কালো রামধনু
- পৃথার ফরোয়ার্ড করা তুহিনের মেসেজটার কথা বলছিস?
- হ্যাঁ। মনে করে দ্যাখ, কী লেখা ছিল – “চাঁদের আলোর পান্থশালায়, রামধনুর রং কালো। জীবনে যদি কিছু খুঁজতেই হয়, তবে শান্তির সন্ধান কোরো, অন্য কিছুর নয়।” শান্তি অর্থাৎ আমন। তুহিন যে আমাদের আমনকে খুঁজে বার করতে বলে গেছে, সেটা তো এখন বোঝাই যাচ্ছে। অর্থাৎ, আমন শর্মা যে আসলে আনন্দ মিশ্র – ও সেটা জানতো না। এইবার বাকি অংশটার মানে আমাদের বুঝতে হবে। রামধনু বললে আমাদের কমিউনিটিতে প্রথমেই মনে পড়বে এলজিবিটি বিষয়ক কিছু। আর কালো শব্দটাকে যদি অপরাধের অনুষঙ্গে দেখি তবে প্রথমেই মনে আসে ব্ল্যাকমেলিং। অর্থাৎ, আনন্দ সম্ভবত তুহিনকে তার গে পরিচয় নিয়ে ব্ল্যাকমেল করছিল। তুহিনের অফিস থেকে নিয়মিত ক্যাশ তোলা আর তারপরেই দিনকতকের জন্য ছুটিতে যাওয়া – সেদিকেই ইন্ডিকেট করে। কোনও গোপন লেনদেন না হলে এরকম ক্যাশ তুলবে কেন বল?
রজত বলল, “আমরা যেহেতু ঋকের বাড়িতে কোনও টাকা পাইনি, অতএব ধরে নিতে পারি, যে তুহিন সেদিন সন্ধ্যেবেলাই টাকাগুলো আমন ওরফে আনন্দকে দিয়ে এসেছিল। প্রশ্নটা হল, তার আগে ও এরকম একটা মেসেজ পৃথাকে পাঠাল কেন? ও কি কোনও বিপদের আশঙ্কা করছিল?”
“একজ্যাক্টলি। তারও আগের প্রশ্ন, প্রতিবার টাকা দেওয়ার জন্য তুহিন শহরের বাইরে গেলেও এইবার আনন্দ মিশ্র কলকাতায় এল কেন? এমনি এমনি?” সৌম্য কাঁধ ঝাঁকাল।
রজত বলল, “তাছাড়া এটাও ভাব, যে এরকম নিয়মিত সোনার ডিম পাড়া হাঁসকে আমন শর্মা খুন করতেই বা যাবে কেন?”
- সেটা ঠিক কথা, তবে এইটা ভুলে যাস না, হি ওয়াজ দ্যা ওনলি সন অফ আ ভেরি পাওয়ারফুল মিনিস্টার। তাছাড়া তুহিন কিন্তু মোটেও বোকা ছিল না। হতেই পারে, ও সাপও মরে আর লাঠিও না ভাঙে – এমন কিছু একটা বন্দোবস্ত করেছিল। কিন্তু সেটা এক্সিকিউট করার আগেই ওকে সাপের ছোবল খেয়ে মরতে হল। এখন ওই সাপটাকে খোঁজাই আমাদের কাজ।
- কিন্তু ওকে পাবি কোথায়? ওর ফোন তো আনট্রেসেবল। দিল্লির লোকজনও তো বলল, যে গত এক সপ্তাহ ধরে তার নাকি কোনও পাত্তাই নেই!
- কেন? ওই যে চাঁদের আলোর পান্থশালা? যেখানে তুহিনের ফোনের টাওয়ার পাওয়া গিয়েছিল, তার আশেপাশে মুনলাইট নামের কোনও হোটেল বা লজ আছে কিনা খুঁজে দেখতে হবে।
রজত মাথা নেড়ে বলল, “আমি অলরেডি দেখে নিয়েছি, নেই।”
সৌম্য হতাশ হয়ে বলল, “নেই?”
“না রে। এই দ্যাখ, ওই টাওয়ারের দু’ কিলোমিটারের মধ্যে যে ক’টা হোটেল আছে, তার লিস্ট। মুনলাইট বা সেরকম নামের তো কিছু পেলাম না”, রজত একটা কাগজ সৌম্যর দিকে এগিয়ে দিল।
সৌম্য কাগজটার দিকে ভুরু কুঁচকে খানিকক্ষণ তাকিয়ে রইল। তারপরে লাফিয়ে উঠে বলল, “গেট রেডি। লেটস গো।”
রজত অবাক হয়ে বলল, “কোথায়?
সৌম্য ওই লিস্টের ওপর একটা নামে আঙুল ঠেকিয়ে বলল “এখানে।”
রজতের মুখে একটা হাসি খেলে গেল। তারপর বলল, “ইশশ্, এটা আমার আগে চোখে পড়ল না? এই জন্যই তুই ব্যোমকেশ আর আমি সত্যবতী।”
সৌম্য নিজের প্রশংসায় একটু লজ্জা পেল। তারপর বলল, “অনেক হয়েছে, এখন চল। এমনিতেই অনেক দেরি হয়ে গেছে। পাখি হয়তো এতক্ষণে ফুড়ুৎ। তবে কি জানিস তো, খালি খাঁচাতেও অনেক সূত্র পড়ে থাকে।”
****
সৌম্য আর রজত যখন জীবন লজে গিয়ে পৌঁছল তখন ঘড়িতে প্রায় বারোটা। হাওড়া স্টেশনের আশেপাশে এমন ছোটখাটো লজের সংখ্যা প্রচুর। টিমটিমে আলো, ছোট ঘর। এক রাতের ভাড়া খুবই কম। মূলত ছোট ব্যবসায়ী, যাঁরা বিভিন্ন জেলা থেকে বিভিন্ন কাজে কলকাতায় আসেন, এই লজগুলো তাঁদের রাতযাপনের জায়গা। খরচও কম, নিয়মের কড়াকড়িও কম। বাইরে থেকে কাউকে আনলেও কেউ খুব একটা আপত্তি করে না। ফলে হোটেলের রুমেই ছোটখাটো মিটিং, লেনদেন, কখনোসখনো সস্তায় কেনা সেক্স – সবই করে নেওয়া যায়।
জীবন লজের কাউন্টারে যে ছেলেটি বসে ছিল, তার নাম পিন্টু। বয়স অল্প। প্রথমে কিছু বলতে না চাইলেও, পরে পুলিসের ভয় দেখিয়ে তার মুখ খোলানো গেল। ড্রয়ারে রাখা একগাদা কাগজপত্র ঘেঁটে একটা ঘষা খেয়ে কালি উঠে যাওয়া জেরক্সের কাগজ বার হল। আনন্দ মিশ্রর ভোটার আই ডি কার্ড। ঠিকানা প্রায় অস্পষ্ট। তার মধ্যেই “ঝুনঝুনু রাজস্থান” এইটুকু পড়া যাচ্ছে।
রজত পিন্টুকে জিজ্ঞাসা করল – আনন্দর সঙ্গে দেখা করতে কেউ এসেছিল কি না। পিন্টু বলল, যে ওদের লজে লেখালেখির কোনও সিস্টেম নেই। তবে স্মৃতি থেকে বলতে পারে, অন্তত দু’জন লোক সেইদিন সন্ধ্যেবেলা আনন্দর সাথে দেখা করতে এসেছিল। প্রথমজনকে মনে আছে, কেননা তার চোখে সন্ধ্যে সাতটার সময়ও সানগ্লাস ছিল। সে ঘণ্টাখানেক আনন্দর রুমে ছিল।
- আর দ্বিতীয় জন?
পিন্টু জানাল, যে, দ্বিতীয়জন এসেছিল প্রথমজন চলে যাওয়ার আধঘণ্টা পর। তাকে মনে আছে, কেননা, কিছু একটা নিয়ে আনন্দর সঙ্গে তার চেঁচামেচি হচ্ছিল। পাশের রুমের গেস্ট কমপ্লেন করায় পিন্টু ওপরে গিয়ে ওদের আস্তে কথা বলতে বলে এসেছিল।
- এই দ্বিতীয়জন কেমন দেখতে ছিল মনে আছে?
- সেভাবে তো দেখিনি স্যার। সাধারণ চেহারা। তবে একটা খুব ভালো পারফিউম লাগিয়ে এসেছিলেন। এইখান দিয়ে যাওয়ার সময় গন্ধটা পেয়েছিলাম।
- আর কিছু?
- না স্যার, তবে এই দ্বিতীয় লোকটি আবার পরের দিন সকালে এসেছিলেন। দশ পনেরো মিনিটের জন্য। উনি চলে যাওয়ার মিনিট পনেরোর মধ্যে আনন্দবাবু চেক আউট করে বেরিয়ে যান।
সৌম্য জিজ্ঞেস করল, “বেরিয়ে কোথায় গেছেন – কোনও ধারণা আছে?”
পিন্টু বলল, “উনি এয়ারপোর্টে যাওয়ার জন্য এই লজের বাইরে থেকেই একটা ট্যাক্সি নিয়েছিলেন। আসলে এখান থেকে তো সবাই ব্যবসার মালপত্র নিয়ে স্টেশনে যান, তাই বাইরে দুটো ট্যাক্সি দাঁড়িয়েই থাকে। তবে আমাদের লজ থেকে এয়ারপোর্ট যেতে এই প্রথম কাউকে দেখলাম স্যার। তাই মনে আছে।”
- ওই ট্যাক্সিওয়ালার সাথে কথা বলা যাবে?
- কেন যাবে না স্যার, এক্ষুনি ফোন করে ডেকে নিচ্ছি। আপনারা একটু ওয়েট করুন।
জীবন লজ থেকে বের হয়ে দিব্যেন্দুকাকুকে ফোন করে কিছু খবর যোগাড় অনুরোধ করল সৌম্য। তারপর রজতকে বলল, “আমাকে কালকের সকালের ফ্লাইটেই জয়পুর যেতে হবে।”
রজত অবাক হয়ে বলল, “তোকে মানে? আমি যাব না?”
সৌম্য হেসে বলল, “না। তুই ভুলে গেছিস যে কালকে মা আসছে। আমার ফেরা অবধি তুই মায়ের সাথে থাকবি।”
রজত বলল, “মানে? আমি কেন থাকব? তুই থাক। আমি রাজস্থান যাই।”
সৌম্য বলল, “না। তুই কলকাতা থাক। তোর এখানে অন্য কাজও আছে।”
রজতের নিমরাজি মুখ দেখে সৌম্য মনে মনে হাসল। এত শখ যখন, থাক এখন শাশুড়ির সাথে। ও জানে, যদি রজতকে রাজস্থান যেতে বলত, তাহলে ও মুখে কিছু না বললেও, মনে মনে ভাবত যে সোহিনীদেবী কলকাতা আসছেন বলেই সৌম্য ওকে সরিয়ে দিল। পরে সেই নিয়ে আবার অশান্তি হত। তার থেকে এই ভাল।
সংসারের শান্তি বজায় রাখতে কত অভিনয়টাই না করতে হয়।