সৈকতদাকে ধন্যবাদ, লেখাটার জন্য। প্রথমে একটা কথা পরিষ্কার করে নিই— যে দুটো স্টাডির কথা উল্লেখ করেছি, তার কোনওটাতেই কিন্তু বুদ্ধ্যঙ্ক এবং আবেগাঙ্ক কম থাকা আর দক্ষিণপন্থায় বিশ্বাসী হওয়ার মধ্যে ওয়ান-টু-ওয়ান ম্যাপিং থাকার দাবি করা হয়নি। আমিও কোনও মতেই দাবি করিনি যে, আইকিউ বা ইকিউ কম থাকাটা দক্ষিণপন্থী রাজনীতিতে বিশ্বাসী হওয়ার নেসেসারি বা সাফিশিয়েন্ট কন্ডিশন। অর্থাৎ, আইকিউ/ইকিউ কম থাকলেই কেউ দক্ষিণপন্থী রাজনীতিতে বিশ্বাসী হবে, অথবা কেউ দক্ষিণপন্থী রাজনীতিতে বিশ্বাসী হলেই তার আইকিউ/ইকিউ কম, কোনওটাই দাবি করার নয়। দাবি এইটুকুই যে, দুটোর মধ্যে বেশ স্ট্রং কোরিলেশন আছে।
তার চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্ট (অন্তত আমার মতে) এইটা: সিস্টেম টু-র উপর নিরন্তর চাপ পড়তে থাকলে মানুষের বুদ্ধ্যঙ্ক কমে, এবং তারা দক্ষিণপন্থী প্রচারের সামনে ভালনারেবল হয়ে যায়। এই দাবির প্রথম অংশ, অর্থাৎ সিস্টেম টু-র উপর চাপ ও তার ফলে ঘটা ইগো ডিপ্লিশন আচরণবাদী অর্থনীতির তত্ত্বে অত্যন্ত সুপরিচিত। আগ্রহী পাঠক সেন্থিল মুলাইনাথন ও এলডার শাফির-এর লেখা স্কেয়ারসিটি নামের বইটা দেখে নিতে পারেন। অত্যন্ত সুখপাঠ্য বই, পড়লে ভাল লাগবে। দাবির দ্বিতীয় অংশটা মূলত আমার। তার পিছনে এম্পেরিকাল স্টাডি নেই, বুঝতেই পারছেন— আমি নিতান্ত সাংবাদিক, আচরণবাদী অর্থনীতির গবেষক নই। কিন্তু, দাবিটা হাওয়ায় ভাসমান নয়— মুলাইনাথন ও শাফির যে উদাহরণগুলো দিয়েছেন, এই দাবিটা সম্পূর্ণত সেই ছকে বসে যেতে পারে। বইটা পড়লে এই বিষয়ে সংশয় থাকবে না।
সৈকতদার লেখার মূল প্রতিপাদ্য হল, দক্ষিণপন্থী রাজনীতির বিরুদ্ধে সিস্টেম ওয়ানকে কী ভাবে ব্যবহার করা যায়, তার পথ খোঁজা। সেই কথায় ঢোকার আগে বলি, ‘দক্ষিণপন্থী’ বলতে এই লেখায় আমি মূলত সোশ্যালি কনজার্ভেটিভ রাজনীতির কথা বলেছি— বিজেপি যে রাজনীতি করে— অর্থনৈতিক দক্ষিণপন্থার কথা নয়। ফলে, তার প্রতিস্পর্ধী অবস্থান— আমার মতে— বামপন্থী অবস্থান নয়, সামাজিক ভাবে উদারবাদী অবস্থান। এই কথাটা আলাদা করে উল্লেখ করলাম, কারণ অর্থনৈতিক ও সামাজিক, দুই গোত্রের দক্ষিণপন্থার সঙ্গে লড়াইয়ের অস্ত্র এক নয়। ভারতের ক্ষেত্রে অর্থনৈতিক দক্ষিণপন্থার বিরুদ্ধে অস্ত্র খোঁজা অবান্তর, কারণ ক্যাপিটালিজ়মের নামে এখানে যা চলে, যা চলছে, তা নিখাদ ক্রোনিইজ়ম। কিন্তু, আপাতত সেই প্রসঙ্গে ঢুকব না।
কথাটা হল, নিরন্তর অভাব বা অন্য নিরাপত্তাহীনতার কারণে সিস্টেম টু-র উপরে চাপ, এবং তার ফলে ঘটা ইগো ডিপ্লিশন এবং বুদ্ধ্যঙ্ক হ্রাসের কথাটাকে যদি মেনে নিই— গবেষণা বলছে যে, মেনে নেওয়াই উচিত— তা হলে এমন স্ট্র্যাটেজির সন্ধান করতে হয়, যা সাধারণ মানুষের সিস্টেম ওয়ানকে একই ভাবে উদ্দীপ্ত করবে, দক্ষিণপন্থী প্রচার যেমনটা করে। এই ক্ষেত্রে আমি সৈকতদার অবস্থানের সঙ্গে দ্বিমত পোষণ করছি। ‘বিজেপি এসে যাবে’, এই ভয় ২০২১ সালের পশ্চিমবঙ্গ বিধানসভার নির্বাচনে তাৎপর্যপূর্ণ প্রভাব ফেলেছিল কি না, যথার্থ সমীক্ষাভিত্তিক গবেষণা ছাড়া তা নিশ্চিত করে বলা কারও পক্ষেই সম্ভব নয়। কিন্তু, রাজ্যের ভোটিংয়ের ইতিহাস যদি স্মরণে রাখি, তবে বলতেই হয় যে, এই রাজ্যে অ্যান্টি ইনকাম্বেন্সি চিরকালই অতি কম। একটা টিপিং পয়েন্টে না পৌঁছনো অবধি শাসকদের পক্ষেই ভোট পড়ে। বিজেপির রাজনীতি সম্ভবত সেই টিপিং পয়েন্টে পৌঁছতে পারেনি। তবে, সৈকতদার পয়েন্টের মতো আমার এই কথাটাও কনজেকচার মাত্র। আদালতে দাঁড়িয়ে প্রমাণ করতে বললে পারব না।
কিন্তু, তাতে সিস্টেম ওয়ানের দখল নেওয়ার বিকল্প স্ট্র্যাটেজি খোঁজার কাজটা গুরুত্ব হারায় না। এক জন হিন্দু নাগরিকের জন্য বিজেপি ঠিক কোন ভীতি তৈরি করতে পারে, যেটা তাকে একেবারে আদিম ভয় পাইয়ে দেবে? মেয়েরা যদি বিজেপি-কে দেখে আদিম ভয় পেত, তা হলে কি উত্তরপ্রদেশে যোগী আদিত্যনাথের সগৌরব প্রত্যাবর্তন ঘটত? অসমের ডি-ভোটার তালিকা দেখে কি পশ্চিমবঙ্গের বাঙালি হিন্দু ভয় পাবে? বাঙালিত্বের পরিচিতি কি হিন্দুত্বের পরিচিতির মতো জোরদার, যাতে বাঙালি পরিচয়কে পশ্চিমবঙ্গের হিন্দু বাঙালি তার হিন্দু পরিচয়ের উপরে রাখতে পারে? আমার কাছে এই প্রশ্নগুলোর উত্তর এখনও নেতিবাচক। কিন্তু, তার মানে এই নয় যে, বিকল্প স্ট্র্যাটেজি খোঁজা ছেড়ে দিতে হবে।
তবে, শুধু সিস্টেম ওয়ানের উপর পাল্টা দখলদারি স্থাপনের চেষ্টায় লেগে থাকলে রাহুল গান্ধীর নরম হিন্দুত্বের মতো হবে ব্যাপারটা। ওটা মূলত বিজেপির মাঠ। সেখানে নেমে, তাদের খেলাতেই, তাদের হারানো খুব কঠিন। সেই চেষ্টা চলুক। কিন্তু পাশাপাশি খেলাটাকে বদলে দেওয়ার চেষ্টাও করতে হবে।
এক বার ভাবলাম, ‘খেলা হবে’ লিখে শেষ করি। তার পর, নিজেকে সামলে নিলাম। থাক!