ক্যানভাস
প্রবুদ্ধ বাগচী
আজ সকাল থেকে আকাশের মুখ কুয়াশায় ঢাকা। বেলা সাড়ে নটাতেও রোদ্দুরের কোনো নাম গন্ধ নেই। প্ল্যাটফরমের মাঝখানে দাঁড়িয়েও সিগন্যাল পোস্টের আলো বোঝা যায় না। আপ ডাউন দুদিকের ট্রেনই আজ লেট চলছে। নতুবা এই সময়টায় স্টেশনে এত ভিড় থাকে না। শেডের তলায় শেষ সিমেন্টের বেঞ্চিটা পেরিয়ে ওর অস্থায়ী গুমটির সামনে এসে দাঁড়াল নিরাপদ।
গুমটি বলতে যা বোঝায় তা ঠিক নয়। ছোট একটা বক্স খাটের মতো বড় বাক্স। তার খোলটার মধ্যে থাকে ওর কেনা বেচার জিনিস। সল্টেড বাদাম, ভুজিয়া, চানাচুর, নোনতা বিস্কুটের ছোট বড় প্যাকেট। গতকালের বিক্রি না হওয়া কয়েকটা সিঙ্গাপুরি কলা। কাঠের ডালাটা খুলতেই বাসি কলার একটা গন্ধ নাকে লাগে। ওই ডালাটা উলটে দিলে সামনেটা বেশ একটা কাউন্টারের মতো। ওখানেই সাজিয়ে রাখা যায় নিরাপদর কেনা বেচার জিনিসগুলো। ব্যাস এইবার ওই খোলটার মধ্যে বসে দিব্যি দোকানদারি করা যাবে। ভেতরটায় বেশ পুরু করে চটপাতা। শীতের দিনে বেশ গরম হয়।
বাদাম চানাচুর ভুজিয়ার পাশাপাশি খইনি পাতাও থাকে ওর কাছে। একটা শুকনো ন্যাকড়ায় লম্বা লম্বা পাতাগুলো জড়ানো আর একটা টিনের ডিবায় চুন। আগে বিড়ি সিগারেটও রাখত। ইদানিং রেলের প্ল্যাটফর্মে বিড়ি সিগারেট বিক্রি করতে দেয় না। প্রথমে কিছুদিন লুকিয়ে চুরিয়ে রাখত। তবু রেল পুলিশ একদিন টের পেয়ে বহুত হুজ্জত করল। প্ল্যাটফর্মে বসতে ওদের মাসোহারা দিতে হয়। ওদের চটালে মুশকিল। পেটে টান পড়ে যাবে। তারপর থেকে বিড়ি সিগারেট বাদ দিয়ে দিয়েছে। শুধু খইনি পাতা। পুলিশের কেউ কেউও ওর থেকে খইনি নেয়।
ডালার ভিতর থেকে রেডিওটা বার করে ওপরে রাখল নিরাপদ। একটা ছোট দাঁড়িপাল্লাও আছে। দাঁড়িপাল্লা ছাড়া যেন কারবার জমে না। যদিও এখন সবই প্যাকেট তবুও ওটা না রাখলে কেমন যেন ন্যাড়া ন্যাড়া লাগে। ইদানিং রেডিওর এফ এম শোনার বাতিকের পাশে অন্য একটা মজা হয়েছে নিরাপদর। ওর মোবাইলে পাড়ার দোকান থেকে সিনেমা ভরে আনে। দুপুরের দিকে বিক্রিবাটা কমে গেলে সামনের কাঠের কাউন্টারটার খাঁজে কায়দা করে আড়াআড়িভাবে আটকে দেয় খুদে যন্ত্রটাকে। তারপর দিব্যি সামনে বসে সিনেমা দেখে। ছবিগুলো অবশ্য খুব ছোট। তাতে কী? টিভিতে বা হলে গিয়ে দেখলে তো আর পেট ভরবে না। এই এক খাসা ব্যবস্থা।
আজও একটা জম্পেশ সিনেমা ভরে এনেছে মোবাইলে। শাহ্রুখ আর করিনা কাপুর। এই মেঘলা দিনে দুপুরে জমবে ভাল। ভাবতে ভাবতেই মনটা বেশ ফুরফুরে হয়ে গেল নিরাপদর। তবে সকালের এই কুয়াশামাখা চেহারাটা যেন কিছুতেই পছন্দ হচ্ছে না ওর। ইচ্ছে না করলেও মনটা যেন খারাপ করে দেয়।
ট্রেন থেকে একদল লোক নামল। ওরই মধ্যে জনা তিনেক ওর দোকানের সামনে। একটা বাচ্চা মেয়ে বাবার হাত ধরে, সঙ্গে মা। বালি হল্ট স্টেশনটা চালু হওয়া থেকে অনেকেই বালি স্টেশনে নেমে সল্ট লেকের দিকে যাওয়ার জন্য ট্রেন ধরত । ইদানিং বড় রাস্তাটা হওয়ার পর হল্ট স্টেশনের পাশ থেকে সল্টলেক রাজারহাট নিউটাউন যাওয়ার জন্য মেলা বাস । ওদিকে কীসব নতুন পার্ক টার্ক আর নানা বেড়ানোর জায়গা হয়েছে শুনেছে নিরাপদ। শীতকালে সেখানে হরেক মজা। এরাও বোধহয় সেখানেই যাবে টাবে। কিন্তু ওই বাচ্চাটা বায়না করে সকাল সকাল নিরাপদর বড় উপকার করে দিল। দুরকমের নোনতা বিস্কুট, তিনটে সল্টেড বাদাম, দুটো চিপসের প্যাকেট —- এক ধাঁয়ে কুড়ি টাকা বউনির পক্ষে বেশ বড়। দশ টাকার নোটদুটো দাঁড়িপাল্লায় ঠেকিয়ে মাথায় ঠেকাল নিরাপদ। দিনের প্রথম খদ্দের। সঙ্গে সঙ্গেই প্রায় আরেকজন। চারটে কলা, দুটো চানাচুর। পনের টাকা। নিরাপদর মনে হল, আজ দিনটা খুব পয়া। হুট বলতে পয়তিরিশ টাকার বউনি বড় একটা হয় না। একটু ভিড় হাল্কা হলেই চাট্টি ভাত খেতে যাবে নিরাপদ। তারপর চাদরটা মুড়ি দিয়ে সিনেমা দেখবে। বেশ হাওয়া ছেড়েছে। কুয়াশা কাটলে ঠান্ডা মালুম হবে।
২.।।
পেটে ভাত পড়ায় চোখটা একটু টেনে আসছিল ঠিকই তবু মোবাইলের পর্দা থেকে চোখ সরাবার উপায় নেই। বেশ ঝকমকে একটা সিন চলছে। বোতামের মতো দুটো যন্ত্র কানে গুঁজে রাখায় চোখ টেনে এলেও কানের ফুরসত নেই। পাহাড়ের গায়ে ঝর্ণা, তারই পাশে বসে আছে নায়িকা করিনা। আর তার চারপাশে ঘুরে ঘুরে গান গাইছে শাহ্রুখ। একেকবার খুব কাছে এসে নায়িকার গলা জড়িয়ে ধরে গালে গাল ঘষে নিচ্ছে, চুমু দিচ্ছে। ঝর্ণার উদ্দাম জলের ধারা তখন ক্যামেরার ক্লোজ আপে। যাকে বলে জমজমাট আশনাই। এমন বিনি পয়সার ফুর্তি আগে নিরাপদ ভাবতেও পারত না। সিনেমা হলে যাওয়া মানেই সাত রকম ঝামেলা। আর তাছাড়া খরচ পাতিও আছে। আরেকটু কাঁচা বয়সে ওসব ধাতে সইত, এখন আর সয় না।
তাছাড়া ওর সময়টাই বা কোথায়? এই দোকান থেকেই পেট চালাতে হয়। দুটো পেট বই নয়। নিরাপদ আর ওর বুড়ি মা-টা। বুড়ি অবশ্য এখনও একবাড়ি রান্নার কাজ করে আর ঘরে বসে টুকটাক বিড়ি বাঁধা বা খইনি পাতা কাটা। যাহোক কিছু হাতে আসে। নায়িকা এবার উঠে দাঁড়িয়েছে। নায়কের হাত ধরে ছুটে চলেছে পাহাড়ি একটা বাগানের দিকে, সেখানে সব বাহারী ফুলের ঝাড়। ছোট পর্দা হলে কী হবে, সব বোঝা যায়। এসব সিন দেখলে নিরাপদর বুকের ভিতরটা মাঝে মাঝে হু হু করে ওঠে। আদুরির সঙ্গে ওর ভালবাসাটা যে টিকল না, সে তো ওর দোষ নয়। ও তো চাইত, আদুরির সঙ্গেই ওর জীবনটা কেটে যাক। কিন্তু গোলমালটা তো হল আদুরির বাপটা মরে গিয়ে। বালি জুট মিলের দু নম্বর লেবার লাইনে থাকত ওরা। ওখানেই কাজ করত। নিরাপদ তো তখন ভোঁ কাট্টা ! দুদিন চটকলে কাজ পায় তো বাকি দুদিন বালিখাল- ধর্মতলা বাসে কন্ডাক্টারি করে। আদুরির বাপের বাড়ি থেকে ওসব শুনল না। বাপ মরা মেয়েকে ওরা আর ঘরে রাখতে চায় না। কিন্তু নিরাপদ তো জানত হুট বলতেই পাকা কাজ হয় না। পেটে বিদ্যে নিয়ে সব বাবু বিবিরা ঘুরে বেড়াচ্ছে আর ও তো একরকম মুখ্যুই —-- ক্লাস ফাইভে উঠে আর স্কুল মুখো হয়নি।
শেষ মুহূর্তে নিরাপদ খুব চেষ্টা করেছিল যদি একটা অটোর লোন বার করতে পারে। বালি সালকিয়া রুটটায় দিন গেলে খারাপ আয় হয় না। তবে সেও কি আর সহজে হওয়ার ? মুখ্যু লোকদের এই এক অসুবিধে ! পার্টির দাদাদের না ধরলে ব্যাঙ্ক থেকে লোন বেরোবে না । একজন খুব আশা দিয়েছিল, তবু শেষ অবধি হল না। আর সেই সঙ্গে আদুরিও একদিন ড্যাং ড্যাং করে চলে গেল ডানকুনির শ্বশুরবাড়িতে।
দক্ষিণেশ্বরের গঙ্গার ঘাটে বসে আদুরি একদিন নিরাপদকে বলেছিল, তোমায় ছাড়া আমি বাঁচব না গো ! নিরাপদর মনে পড়ে গেল কথাটা । ঠিক যেন সিনেমার ডায়ালগ। ওই যে ছোট্ট পর্দায় নায়ক নায়িকা এখন ভাব ভালবাসার ডায়ালগ বলছে। পেছনে হাল্কা একটা গানের সুর। কখনো ঝাঁ করে সুরটা চড়ে যাচ্ছে । কানের মধ্যে যেন কী একটা ঘটে যাচ্ছে তখন। মনে হয় কান থেকে বোতামটা খুলে ফেলে দেয় তখন। আদুরির বিয়ের সময় ও এখানে থাকবে না ঠিকই করে নিয়েছিল। সপ্তাহ খানেক ডুব মেরে দিল বাড়ি থেকে। ওপারে এক বন্ধু ছিল টিটাগড়ে। সেখানে কটা দিন কাটিয়ে যখন বাড়ি ফিরল আদুরির বাড়ি তখন ফাঁকা। কদিন একটু খারাপ লাগত। তারপর আবার যে কে সেই।
এই প্ল্যাটফর্মের দোকানটা পাকাপাকি হতে মা বলেছিল বটে বে-থার কথা। আর তেমন কানে তোলেনি। মনে একবার দাগা লাগলে তা আবার ঘষে মেজে নেওয়া বড় ঝকমারি । তখন ও মাঝে মাঝে যেত ওই পাড়ার বুল্টির ঘরে। সবাই ওকে ওই নামেই ডাকে। বাজারের মেয়েছেলে হলেও ওর মনটা বড় ভাল। বলতে গেলে নিরাপদকে একটু আলাদা চোখেই দেখে।
একদিন হঠাৎ এই স্টেশনেই দেখা হয়েছিল আদুরির সঙ্গে। উত্তরপাড়া থেকে কী একটা কাজ সেরে ট্রেন ধরবে বলে দাঁড়িয়েছিল প্ল্যাটফর্মে। নিরাপদর গুমটি তখন খোলা। ওকে বসে থাকতে দেখে সামনে এল। বিয়ের পর শরীরটায় বেশ জেল্লা লেগেছে। শাড়ি টাড়িও বেশ ঝলমলে।
নিরাপদর সামনে এসে বলল, শুনেছিলাম, প্ল্যাটফর্মে দোকান দিয়েছো । তা চলছে টলছে কেমন ?
— ওই আর কী
তারপর চিপসের একটা মাঝারি প্যাকেট হাতে তুলে বলল, এটা কত ?
নিরাপদ আদুরির মুখের ওপর একবার তাকাল। তারপর বলল, লাগবে তো নাও। দাম লাগবে না।
হুড়মুড় করে এইসব কথা যখন মনের মধ্যে এসে জড়ো হচ্ছিল ঠিক তখনই একটা হই হই এর শব্দ প্ল্যাটফর্ম জুড়ে। মোবাইলের ছোট পর্দাটা থেকে নিরাপদ চোখ তুলে তাকাল বাইরে। প্ল্যাটফর্মের দিকে কিছু মানুষের জটলা । গণ্ডগোলের আওয়াজটা আসছে ওখান থেকেই। কিছু হল নাকি ওখানে ?
ঝটপট মোবাইল বন্ধ করে দোকান ফেলে নিরাপদ দৌড়োয় সেদিকে। ততক্ষণে ট্রেনটা প্রায় প্ল্যাটফর্ম ছুয়ে ফেলেছে। জোরে জোরে দুবার হর্ন বাজিয়ে থেমে যেতে চাইছে বোধহয়। নিরাপদ তাকিয়ে দেখল সিগন্যাল সবুজ হয়ে আছে। যেখানটায় জটলা ঠিক তার সামনে লাইনের ওপর একটা মেয়েছেলে। আর প্ল্যাটফর্মের ওপর থেকে একটা ছেলে লাফ দিয়ে পড়তে চাইছে লাইনে। বাকিরা তাকে দুহাত দিয়ে জাপটে রেখেছে। নিরাপদ বুঝল কিছু একটা কিচাইন হয়েছে। মনে হচ্ছে সুইসাইড কেস। মেয়েটার দিকে এগিয়ে আসছে ট্রেনটা। প্ল্যাটফর্মের ওপর থেকে লোকগুলো আপ্রাণ চেঁচাচ্ছে, সরে যান ! সরে যান! আর ছেলেটাও পাগলের মতো ছটফট করছে। নিরাপদ আরেকবার মেয়েটার দিকে তাকাল।চেনা চেনা লাগছে। ততক্ষণে মেয়েটাও ছুটতে আরম্ভ করেছে উল্টোদিকে।
বেশ একটা বড় গোলমাল। এরকম মাঝে মাঝে হয়। দিনভর স্টেশনে বসে থাকলে এরকম সিন সিনারি মাগনা দেখা যায় বটে। তবে আজ দিনটাই বড় মেঘলা। লোকজন কম। নাহলে এমন হুজ্জুত ঝামেলা ভর দুপুরে বড় একটা হয় না। হয় রাতের দিকে। একটু ফাঁকায় ফাঁকায়। তাও এখন কিছু ব্যাপারী ট্যাপারী ছিল বলে একটা হিল্লে হয়ে গেল। ট্রেনটা থেমে গেছে। এলেম আছে ড্রাইভারের। নাহলে এই দিন দুপুরে রক্তারক্তি হত আর কি। কী যে হয় মানুষজনের ! নিরাপদ আর আগ্রহ বোধ করে না। এবার পুলিশ আসবে। তবে মেয়েটা প্রাণে বেঁচে গেল। কিন্তু আসল গোলমালটা বোধহয় থেকেই গেল। ওই ছেলেটা আর মেয়েটার ভিতরের গোলমালটা । ওটা ট্রেনের ড্রাইভারের হাতে নেই। নিরাপদর মনটা আবার উদাস হয়ে গেল।
৩।।
আজ রাত আটটার মধ্যেই প্ল্যাটফর্ম শুনশান। বিকেলে পেরোতেই কুয়াশাটা আরো ঘন হয়ে এসেছে। বেশ কনকনে ঠান্ডা লাগছে এই শেডের নীচেও। দূরের সিগন্যাল পোস্টের আলোটাও যেন ঝাপসা। অন্যদিন সাড়ে ন’টা দশটা অবধি দোকান খোলা রাখে নিরাপদ। আজ অফিসবাবুরাও সব তাড়াতাড়ি বাড়ি ফিরে গেছে। বিক্রিবাটা নেই। ঝাঁপ গুটিয়ে চলে যাওয়ার কথাই ভাবছিল নিরাপদ। সামনের রেডিওতে এফ এমে হিন্দি গান চলছে। সঙ্গে বকর বকর। মাঝে মাঝে ট্রেন আসবার ঘোষণা আর ট্রেনের যাতায়াতের শব্দের মধ্যে শুধু ওই রেডিওর আওয়াজটাই যেন থম মেরে থাকা সন্ধেটাকে জ্যান্ত রেখেছে। নয়তো প্ল্যাটফর্মটা যেন এক নিঝুম মাঠ।
জুট্মিলের রাতের শিফটের ভোঁ বাজল। উস্খুশ করছিল নিরাপদ। বদলিতে যখন কাজ করত মাঝে মাঝে রাতে ডিউটি পড়ত। শীতকালে র্যাপার মুড়ি দিয়ে যেত বটে, তবে মিলের ভিতর খুব গরম। মেশিনের গরম। আজকের দিনটায় কেন যে সব পুরোনো কথা মনে পড়ছে কে জানে ! দুপুরের হই হইটাও মনে পড়ে গেল হঠাৎ। শেষ অবধি মেয়েটার কী হল কে জানে ! রাতের বেলা মনটা মাঝে মাঝে হু হু করে ওঠে। আজ একবার বুল্টির ঘরে গেলে কেমন হয়? মনের মধ্যে চিন্তাটা একবার ঘাই মেরে আবার মিলিয়ে গেল।
ওর পেছনের শান বাঁধানো বেঞ্চিটায় কখন বা একজোড়া ছোঁড়াছুঁড়ি এসে বসেছে। নিরাপদ খেয়াল করেনি। এখন দুজনে খুব তক্কাতক্কি হচ্ছে। বেশ জোরে। নিরাপদ সব শুনতে পাচ্ছে। তবু একটু কান পাতল ।
মেয়েটা বলছে, তুমি আমায় সেদিন বলোনি কেন কথাটা ?
ছেলেটা : সুযোগ পেলাম কই? তুমি তো ফোন ধরছিলে না !
—--- কেন ধরব ? আমায় কথাটা অন্যের থেকে শুনতে হল !
—-- শুনতে হত না, আমি তো তোমায় বলতাম..
—-- ছাড়ো ছাড়ো, আমি এখন সব বুঝে গেছি..
—-- কী বুঝেছো?
—--- যা বোঝার ঠিকই বুঝেছি
নিরাপদ ঘাড় ঘুরিয়ে তাকায়। কতই বা বয়স হবে ছেলে মেয়ে দুটোর ? বোধহয় কলেজে টলেজে পড়ে। উত্তরপাড়া কলেজের ছেলে মেয়েরা ওইদিকে গঙ্গার ধারটায় ফস্টি নস্টি করে। বালি ব্রিজের ওপর রেলিং এর ধারে দাঁড়িয়ে চুমু টুমু খায়। এরাও সেইরকম হবে বোধহয়। তবে এই প্ল্যাটফর্মের দিকে ওরা বড় একটা আসে না। এ বোধহয় কোনো গুরুতর ঝামেলা হবে। হবেও বা। দুপুরের ব্যাপারটার মতো আবার না হয়। সারাদিন এইসব গোলমাল আর ভাল লাগে না নিরাপদর। দিনভর এই মানুষের গপ্পো গুজব আনন্দ দুঃখ দেখতে দেখতে কখনও মন যেন নিজে থেকে এসবের মধ্যে সেঁধিয়ে যায়। তারপর হাঁফিয়ে ওঠে। নিরাপদর ভাল লাগছিল না।
সব গুটিয়ে উঠে পড়ল নিরাপদ। রোজগারের টাকা কটা পকেটে ভরার আগে একবার পেন্নাম ঠুকে নিল কাঠের ডালাটায়। হাজার হোক ওটাই ওর লক্ষ্মী। ঠান্ডাটা এবার খুব মালুম হচ্ছে। ছেলেমেয়েদুটো এখনো গোঁজ হয়ে আসে বেঞ্চিতে। তবে কথার তাপ কিছুটা কমেছে। ভিতরে ভিতরে গুমরচ্ছে কি না কে জানে! পেট খোলসা করে রাগ দুকখু সব বলে ফেললে তো ভাল নইলে ওই গুমরানি থেকেই যে কত কী হয়ে যায়। দিনকাল কেমন যেন ভাল ঠেকছে না । নিরাপদর মনে হয় কেউই যেন ঠিক ভাল নেই। এই সময় এক আধটা বিড়ি ধরালে নেতিয়ে পড়া মনটা একটু তাজা হয়। একবার ও ভাবল, ছেলেমেয়েদুটোকে বলে বাড়ি ফিরে যাওয়ার কথা। সব ভদ্দরলোকের ছেলেমেয়ে —- বাড়িতে মা-বাপগুলো নিশ্চয়ই এতক্ষণ চিন্তা করে মরছে। না, তার দরকার নেই। নিজেকে সামলে নিল নিরাপদ। কী বলতে কী বলে দেবে। তখন সে এক চিত্তির হবে। মনটা এমনিতেই জুত নেই ওতে আরো দলা পাকিয়ে যাবে। আদুরির কথা মনে পড়ছে খুব। কী করছে আদুরি এখন ? এই কুয়াশায় উপচে পড়া সন্ধ্যে … কনকনে শীত …. সামনে একটা লম্বা রাত্তির ।
একটা বিড়ি ধরাল নিরাপদ। সামনের সিগনাল পোস্টে লাল বাতিটা হ্লুদ হয়ে যেতে দেখল। আরো একটা ট্রেন আসছে তার মানে। ট্রেনটার সঙ্গেই চলে যাবে আরো একটা দিন। নিরাপদ হাঁটা দিল।
পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।