তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়কে আমি দেখেছি। আমি নিজেই বিস্মিত হই, আমাদের গদ্য সাহিত্যের তিন স্তম্ভ, তিন বন্দ্যোপাধ্যায়ের অন্য দু'জনকে আমি দেখিনি, তারাশঙ্করকে আমি দেখেছি। দেখাটা আশ্চর্য ব্যাপার মনে হয়। ঈশ্বরকে দেখা যায়, সৃষ্টিকর্তাকে? বড় লেখক তাে সৃষ্টিকর্তা। তিনি চারপাশের বাস্তবতা থেকে নানা উপাদান সংগ্রহ করে নিজের মতাে করে একটি জগৎ নির্মাণ করেন। যা দেখেছেন লেখক তা দিয়ে তাঁর পৃথিবী নির্মাণ করেন, তার ভিতরে আমাদের না দেখা এক পৃথিবী গড়ে ওঠে। বড় লেখক, বড় শিল্পী তা করেন। বাস্তবতা আর কল্পনা মিলে মিশে যায় সেখানে। সীমাহীন কল্পনাই তাে এই ব্রহ্মান্ডের সৃষ্টিসূত্রে নিয়ে গেছে। ঈশ্বর কণিকার অস্তিত্ব খুঁজে বেরও করেছে মানুষ। আমি আমার ঈশ্বরকে দেখেছি বাল্যকালে। পদার্থ বিদ্যার কথা, বােসােন ইত্যাদি এল কথায় কথায়, রাঢ়ের লেখক তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে তার সম্পর্ক কোথায়? সম্পর্ক কল্পনায়। তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায় সেই ঈশ্বর কণিকার মতাে, যাঁকে ছাড়া জনজীবনের সাহিত্যের সূত্রপাত হতাে কিনা সন্দেহ আছে। আর তাঁর উত্তরাধিকার নিয়ে যে লেখকরা এসেছেন, তাঁদের যেন তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায় অনিঃশেষ ভর যুগিয়ে গেছেন, ঈশ্বরকণা ভর না জোগালে এই মহাব্রহ্মান্ডের সৃষ্টি হত না। তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায় না এলে আমাদের সাহিত্যের এই ধারাটির জন্ম হত না। যে ধারা ক্রমাগত পুষ্ট হয়েছে তাঁর উত্তরাধিকারীর হাতে। এখনাে হয়ে যাচ্ছে।
তারাশঙ্কর না এলে আমাদের যে বিস্তীর্ণ জনজীবন, নিম্নবর্গীয় মানুষজনের কথা বাংলাভাষায় লেখা হত কিনা সন্দেহ। আমাদের সাহিত্যের এই ধারাটি তারাশঙ্করের হাতে জন্ম নিয়েছিল। তার আগে আমাদের ভাষায় এই নিম্নবর্গীয় ভূমন্ডলের কথা ছিল না তা নয়। রাঢ় বাংলার আর এক লেখক শৈলজানন্দ মুখােপাধ্যায় কয়লাকুঠির গল্পে শুরু করেছিলেন। হ্যাঁ, তিনিই সূত্রপাত ঘটিয়েছিলেন বাংলা গল্পের ভূমন্ডলের বিস্তার করে। তাঁকে স্মরণ করেও বলা যায় তারাশঙ্কর যে ভাবে ওই ভূ-মন্ডলকে ধারণ করেছিলেন তাঁর সাহিত্যে, গল্পে, উপন্যাসে, সেখানে তিনিই একক। এ ক্ষেত্রে তিনি ঈশ্বর, তিনিই সৃষ্টিকর্তা। আমি এই সৃষ্টিকর্তাকে দেখেছি। রাঢ়ের মানুষ তারাশঙ্কর উত্তর কলকাতার শেষ প্রান্তে যেখানে তাঁর অনেকটা জীবন কাটিয়েছেন সেখানে আমি বেড়ে উঠেছি বাল্যকাল থেকে, আর এখনাে সেখানেই রয়ে গেছি। ছেলেবেলায় আমাদের এই বেলগাছিয়া টালা পাক অঞ্চলে দুই প্রিয় লেখককে আমি দেখেছি, তারাশঙ্কর এবং নরেন্দ্রনাথ মিত্র। এখানেই থাকতেন শৈলজানন্দ মুখােপাধ্যায়, শনিবারের চিঠির সজনিকান্ত দাসের শনিরঞ্জন প্রেস, সেও এখানে। এই পরিমন্ডলে যে বড় হয়, সে অবাক হত, যে মানুষটি আরােগ্য নিকেতন লিখেছেন, কবি, হাঁসুলিবাঁকের উপকথা, ধাত্রীগ্রাম, গণদেবতা.... তিনি ওই বাড়িটার সামনে ডেক চেয়ার পেতে বসে থাকেন? চুপচাপ। শীতের রােদে বসে আছেন রাঢ়ের ব্রাহ্মন, আমি অবাক হয়ে দেখছি। বইগুলি সব আমাদের বাড়িতে আছে। আমাদের পাঠ্যপুস্তক সাহিত্য চয়নে তাে রয়েছে তাঁর গল্প ডাক হরকরা। দিদির বইয়ে পড়েছি সাড়ে সাত গন্ডার জমিদার। বড় হচ্ছি ওইসব গল্প আর উপন্যাস পড়তে পড়তে। ডাইনি, তারিণী মাঝি, অগ্রদানী, বরমলাগের মাঠ, দেবতার ব্যাধি, জলসাঘর, নারী ও নাগিনী,কালাপাহাড় পড়তে পড়তে.... কী আশ্চর্য তিনিই বসে আছেন শীতের রৌদ্রে? তিনি যেদিন চলে যান, সকাল থেকে তাঁর বাড়ির সামনে গিয়ে দাঁড়িয়ে আছি। ঘাসের উপর বসে আছি বাইরে। ভিতরে যাওয়ার কথা ভাবতে পারিনি। কত মানুষ! আমি অতি সামান্য এক যুবক। তাঁকে একদিন প্রণাম করেছিলাম মাত্র। সেই পদ স্পর্শ যেন হাতে লেগে আছে। তাঁর হাতটি আমার মাথায়। আমার মনে হচ্ছিল অতিবড় স্বজন কেউ চলে যাচ্ছেন। কত বড় মৃত্য! বটবৃক্ষের পতন। মাথার উপরের ছায়াটি যেন সরে গেল। বাড়ি ফিরলাম শবযাত্রা রওনা হলে। পুরােন জি.ই.সি. রেডিওতে বীরেন্দ্রকৃষ্ণের গলায় ধারা বিবরনী শুনেছিলাম চুপ করে। তিনি যে পৃথিবীর কথা শুনিয়েছেন, সেই পৃথিবী, সেই সব মানুষজন, আরােগ্য নিকেতনের জীবন। মশায়, হাঁসুলিবাঁকের বনােয়ারি করালী, নসুবালা, সুচাঁদ,কালােশশী, পাখি, সুবাসী, নয়ন, নিমতেলে পানু, জলসাঘরের বিশ্বম্ভর বা ডাইনি গল্পের সেই বুড়ি যে কিনা ধুধু লালমাটির ডাহি প্রান্তরের ভিতর একা থাকে একটি ধস্ত কুটিরে, যুবক যুবতি দুটিকে দেখে যার জিভ লালায় ভরে যায়.... এই জগতের কথা আমাদের। সাহিত্যে ছিল না। ছিল না রাঢ়ের নিঃসঙ্গ প্রান্তর, উদাসী বাতাস, পাহাড়ের মত মানুষগুলির কথা। ছিল না। ভাগ হতে হতে সাড়ে সাতগন্ডার জমিদারির কথা। আমরা তারাশঙ্করে যা পেয়েছি তা আর পাইনি কোথাও।
কোনাে কোনাে সমালােচক, কট্টর বামপন্থীরা বলতেন, তারাশঙ্কর ক্ষয়িষ্ণু জমিদারতন্ত্রের জন্য হা হুতাশ করে গেছেন সমস্তজীবন। তিনি তাঁদের প্রতিনিধি। একদল মানুষ আছেন, তাঁরা কৃমিকীট ঘেঁটেই জীবন কাটিয়ে দিতে ভালবাসেন। গুনী মানুষকে নিন্দা করেই তাঁদের সুখ। তারাশঙ্কর এঁদের হাত থেকে রেহাই পাননি। কিন্তু এও সত্য এইসব গুটিকয় অন্ধ নিন্দুকের তারাশঙ্করকে দেখার চেয়ে অগণিত পাঠক তাঁকে গ্রহন করেছেন শ্রদ্ধায়। বাংলা সাহিত্যের পাঠক অবাক হয়ে লক্ষ্য করেছেন, এই বসন, বনােয়ারি, করালি, কাহার পল্লীর কথা যে সাহিত্যে আসতে পারে, তা ছিল কল্পনার অতীত। আমাদের প্রকৃত উপন্যাস যা বঙ্কিমচন্দ্রে শুরু, তার ভিতরে ছিল মধ্যবিত্ত মানুষ, তারা ইংরেজি শিক্ষায় শিক্ষিত পুরুষ আর সামন্তপ্রভুর অন্দর মহলের নারী। ১৯২৯ সালে পথের পাঁচালি প্রকাশিত হল, পরের দশবছরের ভিতর পদ্মানদীর মাঝি, পুতুলনাচের ইতিকথা প্রকাশিত হল। পদ্মানদীর মাঝি যতটা বাস্তব, তার চেয়ে বেশি কল্পনা আশ্রিত, হােসেন মিঞার চরিত্র কল্পনায় তা ধরা যায়। আসলে পদ্মা নদীর মাঝি তাে ভয়ঙ্কর এক উপনিবেশ গড়ার কাহিনি। সেই উন্নয়ন, ময়নাদ্বীপে যে উপনিবেশ গড়ে তুলছিল আফিমের কারবারি হােসেন মিঞা তার জন্য তােক তুলে নিয়ে যাচ্ছিল পদ্মার কুল থেকে। এই রকম লােক সরবরাহ তাে উনিশ শতক আর বিশ শতকের প্রথম তিরিশ বছর ঘটেছিল ব্রিটিশ উপনিবেশগুলিতে। রেললাইন পাতা, আফিম চাষ, আখ চাষ করাতে আমাদের দেশের কত অসহায় মানুষ ভিনদেশে চালান হয়ে গেছে। মানিকের পদ্মানদীর মাঝি তাে। ইতিহাসের সেই উপাদানকেই ময়না দ্বীপের রূপকে ধরে রেখেছেন। ময়না দ্বীপের কথাই পদ্মানদীর মাঝি উপন্যাসের কথা। এই উপন্যাস পদ্মার তীরের জেলেদের জীবন যতটা তার চেয়ে অনেক বেশি ঔপনিবেশিক আগ্রাসনের। নিম্নবর্গের মানুষ, জেলে মালােদের জীবন দেখতে পাই তিতাস একটি নদীর নাম (অদ্বৈত মল্লবমর্ণ) উপন্যাসে৷ সতীনাথ ভাদুডির টোডাই চরিত মানস উপন্যাসে৷ তবুও বলতে হয় জমি মাটি সংপৃক্ত মানুষ যে মস্ত হয়ে গল্প উপন্যাসের চরিত্র হয়ে উঠতে পারে সে বিষয়ে গভীর কোনাে ধারণা তৈরি ছিল না বাঙালি পাঠকের। ব্যতিক্রম তাে ছিলই। রবীন্দ্রনাথই তাে লিখেছেন শাস্তির মতাে গল্প। শরৎচন্দ্র মহেশ বা অভাগীর স্বর্গ। কিন্তু হাঁসুলিবাঁকের উপকথা কি লেখা হয়েছিল ? রাঢ়ের ওই মাটি, দুঃসহ জীবন, নানা উপকথা আর প্রাচীন সংস্কার আর মনের ভিতরে গেড়ে বসা বিশ্বাস নিয়ে ঘুমিয়ে থাকা কোপাই নদীর তীরের কাহার আর আটপৌরে (তারাও একই জনজাতি, কর্মে পৃথক হয়ে পৃথক নাম) দের যে কাহিনী তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায় আমাদের শােনালেন কথক ঠাকুরের মতাে, তার কোনাে পূর্বসুরী ছিল না। বাংলা ভাষায় উপন্যাস তখনাে সাহিত্যের নতুন আঙ্গিকের অভিজ্ঞতা। বঙ্কিমে যার শুরু তা পুষ্ট হতে আরম্ভ করেছে বিভূতিভূষণ, মানিকের হাতে। কিন্তু হাঁসলিবাঁকের উপকথা। সত্যই স্তম্ভিত করেছিল। রাঢ়ের রুখা আর শুখা মাটির ভিতরে যে অত রস আর আউলবাউলের দেশের মানুষের যে অত রােষ তা তারাশঙ্কর না পড়লে জানা যেত না। তারাশঙ্কর যেন কোদাল, টামনা শেষ পর্যন্ত রেল কারখানার গাঁইতি মেরে কাহার পল্লীর মাতবর বনােয়ারির মতাে আপাত পাথুরে মাটির পাথর সরিয়ে বের করে এনেছেন কুমারী মৃত্তিকা, কালাে মাটি, বীজ ফেললেই ধান। হাঁসুলিবাঁকের উপকথা আরম্ভ হয় এক ভয়ানক শিসের শব্দে। আমার এখন এই বয়সে পড়তে পড়তে মনে হয় ওই শব্দের ভিতর দিয়ে বুঝি রাঢ়ের তেজিয়ান ব্রাহ্মণ সাড়া দিতে লাগলেন, নিজের কথা বলতে শুরু করলেন। কোপাইতীরের সন্ধ্যা, শিসের শব্দে কাহার পল্লী আতঙ্কিত হয়ে উঠতে থাকে। শিস আসছে কোপাইতীরের হাঁসুলীবাঁকের ঘন জঙ্গলের ভিতর থেকে। দেবতা কি যক্ষ বােঝা যাচ্ছে না। কাহাররা জানে ওই শিস ঠাকুর-দেবতার। শেষ পর্যন্ত কী হল, কাহার পল্লীর যুবক করালী, যে কিনা গাঁ ছেড়ে চন্ননপুরের রেল কারখানায় কুলি হয়েছে মাতব্বর বনােয়ারির মত অগ্রাহ্য করে, তার কুকুরটা শিসের শব্দে চঞ্চল হয়ে বনে ঢুকে রক্তাক্ত হয়ে ফিরে এসে মরল, সেই করালী কিনা বাঁশ বনে কেরােসিন ঢেলে শুকনাে পাতায় ধরিয়ে দিল আগুন, বেরিয়ে এল অতিকায় এক চন্দ্রবােড়া সাপ। মরল পুড়ে। মাতব্বর বনােয়ারি আর কাহারপাড়ার প্রাচীন বিশ্বাসে আঘাত পড়ে যখন করালী নিজে বলে সাপটাকে মারতেই সে আগুন দিয়েছিল বাঁশবনে। এই উপন্যাসের সময় গত শতাব্দীর চারের দশক, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ বেঁধেছে, ক্ষয়ে গেছে ১৭৯৩-এর চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের নিগড়, সামন্ত সমাজে আসছে ভাঙন। পুরাতন ধ্যান ধারণা ভাঙছে প্রবেশ করছে নতুন চিন্তা। তারাশঙ্কর যখন লিখছেন, তখন জমিদারি প্রথা অবলুপ্তির কথা হচ্ছে, স্বাধীনতার পর ১৯৫৫ সালে চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত আইন করে অবলুপ্ত হলাে। তারাশঙ্কর বলছেন নব্য বণিক গােষ্ঠীর কাছে সামন্ত সমাজের পরাজয়ের কথা। যে বিশ্বাস অনড় হয়ে চেপে বসেছিল বহু যুগ ধরে, তাকে বিদায় করে নতুন যুগের বিশ্বাসকে খুব সহজেই গ্রহণ করা সম্ভব হয়ে ওঠে না। ভয় থাকে, থাকে উৎকণ্ঠা থাকে, বার বার নতুন আর পুরাতনে দ্বন্দ্ব লাগে। পুরাতন বিশ্বাস যে লালন করে, নতুন যুগের কথা যখন শােনে, তখন সে বিশ্বাস-অবিশ্বাসের দোলায় দোলে। হাঁসুলিবাঁকের উপকথা এই বিশ্বাস–সংস্কার নিয়েই আবর্তিত হয়।
তারাশঙ্কর আমাদের সাহিত্যে একটি স্বতন্ত্র ধারার জন্ম দিলেন। আর ধরা গেল আমাদের গল্প উপন্যাস কোন পথে যেতে পারে। কৃষি নির্ভর এদেশের মানুহে হে, জমির কথা তারাশঙ্করই জানিয়ে ছিলেন প্রথম| আমাদের জমি নির্ভর মানুষ, জমি নির্ভরতা, জমির সঙ্গে মানুষের সম্পর্ক নিরূপণ করেছেন তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়৷ ১৭৯৩ সালের স্থায়ী বন্দোবস্ত হম সমাজের অনেক পরিবর্তন হয়েছিল৷ সেই পরিবর্তনের চেহরও বলতে থাকে জমিদার আর রাত, কোরকা এম সমাজের মানুষ, জমির উপর তাদের অধিকার, নানা সুর, সামন্ত-সমাজের এক পরিপূর্ণ রূপ তাঁর কাছে পাই৷ খাজনা অনাদায়ে সেরেস্তাদারে লােক, আমিন পেয়াদ এসে যখন ঢোল সহরত করে জমির উপর দাঁড়িয়ে ঘােষনা করে নীলামেরগরিব গাঁয়ের মানুষ আতঙ্কে কানে আঙুল দেয়। জমি নীলাম মানে জমি হারানাে। এই রকম ছোট ছোট অনিবার্য বা কত রয়েছে তাঁর গল্পে, উপন্যাসে৷ জমি তিনি চিনতেন, আর চিনতেন বিভূতিভূষণ, ইছামতি উপন্যাস পড়লে তা ধরা যায়। কিন্তু তারাশঙ্কর জমিদারির পত্তন, জমি বিলি, জমি চারে | রকম স্বত্ব যতটা জানতেন আমাদের ভাষায় আর কেউ তা জানতেন বলে জানি না। হাঁসুলিবাঁকের উপকথায় সেই ইতিহাস আছে। হাঁসুলীবাঁকের জমির ইতিহাস আমাদের জমিরই ইতিহাস। হাঁসুলীবাঁকের লৌকিক পর আমাদেরই লৌকিক পরব। অঞ্চলভেদে তা একটু আধটু ভিন্ন বটে, কিন্তু মূল সুর তাে একই।
হাঁসুলী বাঁকে করালী নতুন যুগের কথা আনে কোপাই নদীর তীরে সেই গাঁয়ে। করালীই হয়ে ওঠে প্রাচীন নিগড়গুলি ভাঙার রূপক যেনব। বনােয়ারি স্নেহশীল মানুষ, করালীকে পছন্দ করে তার সাহস আর বীর্যবত্তার জন্য। কিন্তু যখন তার প্রাচীন বিশ্বাসে আঘাত পড়ে সে চঞ্চল হয়। করালীকে নিবৃত্ত করতে গিয়ে ব্যর্থ হয়। সে কাহার পল্লীর মঙ্গল চায়। করালীর জন্য, করালীর কাজের জন্য উৎকণ্ঠিত হয়। এই উৎকণ্ঠা সমস্ত উপন্যাসে ছেয়ে আছে। এই উৎকণ্ঠাই নতুন যুগকে গ্রহণ আর পুরাতন যুগকে বর্জনের ভিতর খুঁয়ে থাকে সর্বক্ষণ। এই কথা তারাশঙ্করের সব উপন্যাসে জড়িয়ে আছে। জড়িয়ে আছে তাঁর গল্পে। পুরাতনের বিদায়ের ভিতর যে বিষাদ, তা আছে তারাশঙ্করে। কিন্তু সেই বিষাদ সামন্ত প্রথার জন্য হাহাকার নয়। নয়ই। তিনি এক যুগ সন্ধিক্ষণের লেখক। তিনি এক ইতিহাসের স্রষ্টা। তাঁর গল্প-উপন্যাসে সেই যুগের ইতিহাসকে নির্মাণ করা যায়। দ্বিতীয় বিশ্ব যুদ্ধ হাঁসুলী বাঁকের মতাে বহু গ্রাম সমাজকে ছিন্ন ভিন্ন করে দিয়েছিল, হাঁসুলী বাঁকের গরিব অন্নহীন কাহারেরা গিয়েছিল চন্ননপুরে রেলের কারখানায় কাজ করতে। ১৩৫০-এর আশ্বিনের প্রলয়ঙ্করী বানে হাঁসুলীবাক শেষ হয়ে গিয়েছিল। এই বান তাে ইতিহাস। তারাশঙ্কর বলছেন,
“বন্যার কথা উপকথা নয়, ইতিহাসের কথা। ১৩৫০ইংরিজি ১৯৪৩ সালের বন্যা। তেরশাে পঞ্চাশের যে বন্যায় লে-লাইন ভেসে গেল, সেই বন্যা। ইতিহাসে আছে তার কথা। দামােদরের অজয়ের ময়ূরাক্ষীর কোপাইয়ের বন্যায় শুধু রেল-লাইন ভাসে নি, হাঁসুলী বাঁকের মত অগণিত স্থানের উপকথার পটভূমি ভেসে গিয়েছে, পরিবর্তিত হয়ে গিয়েছে। ইতিহাস অবশ্য কর্তার বাণী, কালরুদ্রের খেলা, হরির বিধান মানে না। সে বলে—আকস্মিক, কাকতালীয়। বলুক—সত্য যাই হােক, কাহারেরা একে সত্য বলেই মানে।”
হ্যাঁ, সেই প্রলয়ঙ্করী বন্যায় বালি পড়ে ধ্বংস হয়ে যাওয়া হাঁসুলী বাঁকে করালী ফিরেছিল। সবল হাতে বালি কাটছিল করালী আর মাটি খুজছিল। তারাশঙ্কর বলেছেন, " উপকথার কোপাইকে ইতিহাসের গঙ্গায় মিশিয়ে দেবার পথ কাটছে। নতুন হাঁসুলী বাঁক।”
আমাদের বাংলা ভাষারও যাত্রা শুরু হল নতুন এক পথে।