যন্ত্রের ইতিহাস নিয়ে বই খুব একটা নজরে পড়ে না। বাংলায় সেটা আরও কম। যেমন, রেল ইঞ্জিনের ইতিহাস। আর সেটা যদি বিজ্ঞানের কোনও যন্ত্রপাতি হয়, তাহলে তো কথাই নেই। এদিক দিয়ে গৌতম গঙ্গোপাধ্যায়ের ‘আকাশে মেলেছি চোখ’ (২০২২, বিভা পাবলিকেশন) একটি জরুরি বই।
বইটি দূরবীনের ইতিহাস নিয়ে। এটি এমন একটি যন্ত্র যাকে আধুনিক বিজ্ঞানের সূত্রপাতের মূলে ছিল বললে অত্যুক্তি করা হয় না। দূরবীনের সাহায্যে সৌরকলঙ্ক, শুক্রের দশা, বৃহস্পতির উপগ্রহ আবিষ্কার করেই গ্যালিলিও মান্ধাতা আমলের ধ্যানধারণার মূলে কশাঘাত করেছিলেন। এর আগে কোপার্নিকাসের বই বেরিয়েছিল বটে, কিন্তু তাতে খুব একটা হেলদোল হয়নি জনমানসে। অনেকের কাছে কোপার্নিকাসের নতুন ধারণা শুধুমাত্র ‘মতবাদ’ হয়েই রয়ে গিয়েছিল, যার পালে এসে হাওয়া দিয়েছিল গ্যালিলিওর আবিষ্কারগুলোর চমক। তারপর আর ফিরে তাকায়নি বিজ্ঞানের জয়যাত্রা। তাই দূরবীনের মাহাত্ম্য – অন্য যে কোনো বৈজ্ঞানিক যন্ত্রের তুলনায় অনেক বেশি। ভগীরথের শঙ্খের মত এই যন্ত্রটি হাজারেরও বেশি বছরের ধারণার শিকলে আটকে থাকা অবস্থা থেকে মুক্ত করে নিয়ে এসেছিল বিজ্ঞানের ধারা।
এমন একটি বই পড়তে গিয়ে প্রথমেই প্রশ্ন জাগে, যন্ত্রের দরকার কীসের? এই প্রশ্নের উত্তর খোঁজার উপলক্ষ্য করেই গৌতমবাবুর বই শুরু হয়েছে। দরকারটা হল মাপজোখের। যা ছাড়া আধুনিক বিজ্ঞান এক পা-ও এগোতে পারে না। প্রাচীনকালে যুক্তি দিয়েই প্রমাণ করার চেষ্টা হত। যার যুক্তি অকাট্য মনে হত তার চিন্তাকেই মেনে নেওয়া হত সত্য বলে। আধুনিক বিজ্ঞান এসে এই ‘মনে হত’-র ব্যাপারটা সরিয়ে হাতেনাতে প্রমাণের ভূমিকা বড় করে তুলে ধরল। কিন্তু তার জন্য চাই সূক্ষ্ম মাপজোখ করার ক্ষমতা। যত গভীর, যত কঠিন প্রশ্ন, তত সূক্ষ্ম সেই প্রশ্নের পরীক্ষার মাপজোখ। তাই দূরবীন এসে যখন আকাশের মাপজোখ করার ক্ষমতা বাড়িয়ে দিয়েছিল, তখনই আধুনিক বিজ্ঞান তরতর করে এগিয়ে যেতে শুরু করেছিল।
এই জরুরি কথাগুলো অনেক সময় আমাদের মাথায় থাকে না। গৌতমবাবু বইয়ের প্রথমেই যথাযথ উদাহরণের সাহায্যে এই কথাগুলো টেনে এনে পাঠকের রসাস্বাদনের সঠিক উপায় বাতলে দিয়েছেন। শুধু কোন সালে কী ধরনের দূরবীন বানানো হয়েছিল এবং তার সাহায্যে কী নতুন জ্যোতিষ্ক আবিষ্কৃত হয়েছিল, তার তালিকা বানানোর জন্য বই লেখার কথা ভাবেননি তিনি, এটা বুঝিয়ে দিয়েছেন প্রথমেই। পাঠকের মনে প্রশ্ন তুলে ধরা এবং সেই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে খুঁজতে দূরবীনের উত্তরোত্তর উন্নতির গল্প বলেছেন তিনি।
ফলে তাঁর বই পড়ে শুধু জ্যোতির্বিজ্ঞান নয়, বিজ্ঞানের সামগ্রিক ইতিহাস সম্বন্ধেও একটা ধারণা জন্মায় পাঠকের মনে। নতুন প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে সূক্ষ্ম থেকে সূক্ষ্মতর যন্ত্র বানান বিজ্ঞানীরা। আবার, অন্যদিকে, এইসব নতুন যন্ত্র খুলে দেয় প্রকৃতির একেকটা নতুন জানালা। তাদের সাহায্যে আবিষ্কৃত ঘটনা বিজ্ঞানীদের সামনে তুলে ধরে আরেকগুচ্ছ নতুন প্রশ্ন। যার উত্তর খুঁজতে ঘটে নতুন আবিষ্কার। বিজ্ঞানের ইতিহাসের এই মূল ধারাটি গৌতমবাবুর বইতে পরিষ্কারভাবে ফুটে উঠেছে।
প্রাচীন জ্যোতির্বিদ্যা থেকে আধুনিক পর্যায়ে উত্তরণের পরবর্তীকালে দূরবীনের গঠনে বেশ কিছু পরিবর্তন এসেছিল। প্রথমে লেন্স দিয়ে তৈরি হত, কিন্তু দেখা গেল সূক্ষ্ম পর্যবেক্ষণের ক্ষেত্রে দূরবীনের সাইজ এমন মাত্রাতিরিক্ত হয়ে পড়ল, যে সেগুলো সামাল দেওয়াই মুশকিল। তখন এসেছিল আয়নার তৈরি দূরবীন, নিউটনের চিন্তার সূত্র ধরে। তারপর কীভাবে নতুন প্রযুক্তির সাহায্যে আরও বড় মাপের দূরবীন তৈরি করা গেল, এই ঘটনাগুলো গল্পের মতো বলেছেন লেখক।
সঙ্গে রয়েছে বিশেষ কয়েকজন বিজ্ঞানীর জীবন সম্বন্ধে টুকিটাকি খবর। প্রথম গ্রহাণু আবিষ্কার করতে গিয়ে ইতালির বিজ্ঞানী পিয়াজ্জিকে দূরবীনের টঙে চড়তে হয়েছিল। সেখান থেকে পড়ে গিয়ে তাঁর পা ভেঙে গিয়েছিল। অথবা, ইউরেনাসের আবিষ্কর্তা উইলিয়াম হার্শেলের বোন ক্যারোলিনের গল্প। তিনি কীভাবে দাদাকে সাহায্য করতেন, পর্যবেক্ষণে মগ্ন দাদাকে খাবার নিজের হাতে খাইয়েও দিতেন, এবং কীভাবে তিনি নিজে এক যশস্বী জ্যোতির্বিজ্ঞানী হয়ে উঠেছিলেন, সেই কাহিনী।
পৃথিবীতে আধুনিক বড় দূরবীনগুলোর বর্ণনার পাশেই লেখক ভারতের অবস্থিত দূরবীনগুলো নিয়ে আলোচনা করেছেন। এরপর এসেছে মহাকাশে পাঠানো দূরবীনের কথা। সেই প্রসঙ্গে চলে এসেছে এক্স-রশ্মি বা অবলোহিত রশ্মির দূরবীনের আলোচনা। এই ‘অদৃশ্য আলো’র তরঙ্গ আমাদের বায়ুমণ্ডল শুষে নেয়। তাই জ্যোতিষ্কগুলো থেকে বেরনো এক্স-রশ্মি অথবা অবলোহিত/অতিবেগনি রশ্মি পরীক্ষা করতে গেলে যন্ত্রপাতি পাঠাতে হয় বায়ুমণ্ডলের বাইরে। কৃত্রিম উপগ্রহের মাধ্যমে।
শুধু আলোর তরঙ্গই নয়, মহাকাশ থেকে যে শক্তিশালী পদার্থকণাগুলো আসে, বিজ্ঞানীরা সেগুলো ধরারও চেষ্টা করছেন আজকাল। এই নভোরশ্মি বা কসমিক-রে ধরার জন্য বানানো যন্ত্রগুলোও এক ধরনের দূরবীন। শুধু পদার্থকণাতেই আটকে থাকেননি বিজ্ঞানীরা। মহাবিশ্বের দেশকালে অর্থাৎ স্পেস-টাইমে যে তরঙ্গ ওঠে, সেই মহাকর্ষীয় তরঙ্গও ধরা পড়েছে বিজ্ঞানীদের যন্ত্রে। সেটাকেও দূরবীন আখ্যা দিতে হয়। এই একেক ধরনের দূরবীনে ধরা পড়ে জ্যোতিষ্কের চরিত্রের নানা দিক। সেই তথ্য সাজিয়ে জ্যোতিষ্কগুলোর এক সম্যক রূপ বোঝার চেষ্টা করেন বিজ্ঞানীরা। জ্যোতির্বিজ্ঞানে এক বিপ্লব এসেছে বলা যায়। তথ্যের সমাহারে, যন্ত্রপাতির বৈচিত্র্যে, প্রশ্নের গভীরতায়, সবকিছুতেই এক জোয়ার এসেছে। এই শুভক্ষণে দূরবীনের ইতিহাস নিয়ে একটি বাংলা বইয়ের খুব দরকার ছিল।
বইটি কলেবরে বড় নয়, তাই পড়তে বেশি সময় নেয় না। কিন্তু তার রেশ থেকে যায় পাঠকের মনে। বিশেষ করে পরিশিষ্টে যেসব বিষয়ের বিশদ আলোচনা রয়েছে, সেগুলো কৌতূহলী পাঠকের মনকে আরও গভীরে টেনে নিয়ে যাবে।
বইয়ে মুদ্রণপ্রমাদ নেই বললেই চলে। বইয়ের শেষে কিছু জরুরি বইয়ের তালিকা রয়েছে, যা থেকে আরও চিন্তার খোরাক পাবেন পাঠকরা। বিজ্ঞানের ছাত্রদের জন্য তো বটেই, বাংলার সাধারণ পাঠকের জন্য এমন একটি অনন্য বই উপহার দেবার জন্য লেখককে এবং প্রকাশককে ধন্যবাদ জানাই।
- লেখক রামন রিসার্চ ইন্সটিটিউট, ব্যাঙ্গালোর-এ কর্মরত বিজ্ঞানী