১.
কবরে শুয়ে থাকতে আমার ভালো লাগে না। জায়গাটা খুব ঘিঞ্জি। নড়াচড়ার উপায় নেই। তাছাড়া গল্পগুজব করার জন্যও এখানে কেউ নেই। এটা একটা ঘরের মতো যা চিরতরে বন্ধ, যেখানে কেউ আসে না, যায় না। একা লাগে আমার। খুব মনখারাপ হয়…
তাই কোনো কোনো রাতে আমি বেরিয়ে পড়ি। স্বজনদের কাছে যাই। যদিও পৃথিবীতে আমার স্বজন বেশি ছিল না।
আব্বার কবরটা পুশকুনির ঘাটলা থেকে একটু দূরে। আমাকে যেদিন কালো পোষাকের ফেরেশতারা তুলে নিয়ে গেলো তার ছয় মাস আগে তিনি সড়ক দুর্ঘটনায় মারা যান। আমি তার একমাত্র ছেলে, তবে একমাত্র সন্তান নই, আমার একটা ছোটো বোন আছে। ছিল। অন্যভাবে বলা যায় আমি তার ভাই ছিলাম। যখন বেঁচে ছিলাম। মৃত্যুর পরে কেউ আর কারো থাকে না।
আম্মাকে দেখতে যাওয়ার সাহস হয় না আমার। বাতাসে ফিসফিসানি শুনি তিনি পাগল হয়ে গেছেন। সারাদিন একটা গাছের নিচে বসে বিড়বিড় করেন। বোকার মতন হাসেন। স্বাভাবিক। আমি তার একমাত্র ছেলে, যেহেতু আমি মরে গেছি বা আমাকে মেরে ফেলা হয়েছে, তাই আমার মায়ের মাথা খারাপ হয়ে যাওয়ারই কথা। আমাকে গর্ভে ধারণ করা থেকে শুরু করে পৃথিবীতে আনতে তার দশ মাস লেগেছিল, আশ্চর্যজনক ব্যাপার, আমাকে পৃথিবী থেকে কবরে পাঠাতে কালো পোষাকের ফেরেশতাদের মাত্র দশ মিনিট লেগেছে।
নীলা স্বাভাবিক আছে। নীলা আমার বোন, মানে, আমি যখন বেঁচে ছিলাম তখন সে আমার বোন ছিল। আমাকে তুলে নিয়ে যাওয়ার সময় ও খুব ছোটো ছিল, এখন একটু বড়ো হয়েছে, অল্পবয়সী হওয়ার একটা সুবিধা হচ্ছে শোক তীব্র হলেও তা খুব অল্পসময়েই কাটিয়ে ওঠা যায়। ও খুব ভালো ছাত্রী, রাত জেগে পড়ে। কস থিটা, সাইন থিটা, এইসব হাবিজাবি বিষয়। ওর পড়ার টেবিলে একটা হারিকেন জ্বালানো থাকে।
হারিকেনের হলুদ আলো ওর মুখের ওপর পড়ে। ও এমনিতেই মিষ্টি। এই আলোয় ওকে আরো বেশি মিষ্টি লাগে। কবর থেকে উঠে আমি নীলার কাছে যাই। ওর পড়ার টেবিলের পাশের বিছানায় বসে থাকি। জন্মের পরেই ওর একটা মারাত্মক অসুখ হয়েছিল। আব্বা হযরত শাহজালালের মাজারে গিয়ে কান্নাকাটি করেছিলেন। এইসব কান্নাকাটিতে কতোটা কাজ হয় জানি না, তবে ওর অসুখটা ভালো হয়ে যায়। ছোটো থাকতে ও খুব ন্যাওটা ছিল আমার। সারাক্ষণ আদর খাওয়ার জন্য পেছন পেছন ঘুরতো। অনেকদিন শান্তিমতো ঘুমাই না, একটু বড়ো হয়ে যাওয়া নীলার ঘাড়ে মাথা রেখে, ঘুমিয়ে পড়তে ইচ্ছা করে আমার। কিন্তু আমি এই কাজটা করতে পারি না, কেননা আমি মরে গেছি, নীলা জীবিত।
আমি রুখসানার বাড়ির সামনে গিয়ে ঘুরাঘুরি করি। রুখসানাকে ভালোবাসতাম আমি। সেও আমাকে ভালোবাসত। আসলে বাসত না। আমার মৃত্যুর ঘটনাটা সে খুব স্বাভাবিকভাবে নেয়। বাপ মায়ের পছন্দ করা পাত্রকে বিয়ে করে। তার স্বামীভাগ্য ভালো। ভদ্রলোক আর্মিতে আছেন। আর্মির লোক সুন্দরী বিয়ে করতে পছন্দ করে। যারা স্বল্পশিক্ষিত হবে। আর খানিকটা মাথামোটা। রুখসানা এমন কোনো আহামরি সুন্দরী ছিল না। গ্রামের রক্ষণশীল পরিবারের মেয়ে হিসেবে যথেষ্ট শিক্ষিত। আর খুবই বুদ্ধিমতী। ভদ্রলোক কি দেখে পছন্দ করলেন জানি না। রুখসানা এখন আর এই বাড়িতে থাকে না। আর আমি তার নতুন ঠিকানা জানি না।
এরপর আমি যার কাছে যাই সে শামীম। শামীম অবশ্য ঠিক স্বজন ছিল না আমার। অই আমার বাড়ি চিনিয়ে দিয়েছিল সেই রাতে। কালো পোষাকের ফেরেশতারা যখন আমাকে তুলে নিতে এলো তখন আমি পাবদা মাছের ঝোল দিয়ে গোগ্রাসে ভাত খাচ্ছিলাম। ওরা খাওয়া শেষ হওয়ার অপেক্ষা করে নি। আমার দিকে তাকিয়ে হাসতে হাসতে বলেছিল অনেক খাইসস, বাকি খাওন বেহেশতে গিয়া খাবি। শামীম কুত্তার বাচ্চাটাকে খুন করতে ইচ্চ্ছা করে, কিন্তু পারি না, একবার মরে গেলে খুন করা যায় না।
২.
আফরিন তাবাসসুম হৃদিতা ভিকারুন্নিসা নূন স্কুলে পড়ে। নবম শ্রেণীর ছাত্রী। সবাই বলে ওর কোনো তুলনাই হয় না।
আসলেই হয় না।
যেমন পড়াশোনায় ভালো, তেমন খেলাধূলায়, তেমন সংস্কৃতিচর্চায়। হৃদিতা কোনো পরীক্ষায় কোনোদিন সেকেন্ড হয় না। সবসময় ফার্স্ট হয়। নাচ পারে। গান পারে। আবৃত্তি পারে। ব্যাডমিন্টন আর দাবা খেলায় ওকে হারানো কঠিন।
ওর বাবা র্যাবের (বাংলাদেশ আমার অহংকার) অফিসার। আর মা গৃহিনী। হৃদিতা ওর বাবা আর মায়ের একমাত্র সন্তান।
এই তো কয়েকদিন আগেই বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র আয়োজিত একটা প্রোগ্রামে চমৎকার কবিতা আবৃত্তি করে সে সবাইকে মন্ত্রমুগ্ধ করেছে। ভাস্কর চৌধুরীর কবিতা। “শক্তির স্বপক্ষে তুমি যার মৃত্যুতেই উল্লাস করো না কেনো, মনে রেখো মানুষই মরেছে”। এই লাইনটা সে যখন পড়ছিল তখন উপস্থিত শ্রোতাদের অনেকের চোখের কিনারেই পানি জমছিল। ওর বাবাও সেই শ্রোতাদের মধ্যে একজন ছিলেন। অনেক ব্যস্ততায়ও মেয়ের জন্য সময় বের করেছেন। মেয়ের প্রতিভার গর্বে বাবার বুক ভরে গেছে।
হুমায়ূন আহমেদ যখন বেঁচে ছিলেন, আমাদেরকে জানিয়ে গেছেন, পৃথিবীতে খারাপ মানুষ অনেক থাকলেও খারাপ বাবা একটিও নেই।
আসলেই নেই।
৩.
আমি কবর থেকে বের হই রাতের বেলায়। সাধারণত। কিন্তু যেসব ভোরে খুব বৃষ্টি হয় সেসব ভোরেও আমি কবর থেকে বেরিয়ে আসি।
সেই মাঠটায় যাই যেখানে আমাকে মেরে ফেলেছিল। রাতের বেলা জায়গাটা খুঁজে পেতে কষ্ট হয়। তাই ভোরেই যাই। একটা নদীর তীরে খোলা হাওয়ার একটা মাঠ। আমি যখন ভাবতাম রুখসানা আমাকে ভালোবাসে তখন ওকে নিয়ে কখনো কখনো যেতাম সেখানে। কালো পোষাকের ফেরেশতারা আমাকে সেখানে নিয়ে গেছিল। ওরা আমার চোখ বেঁধেছিল, আর হাত বেঁধেছিল পিছমোড়া করে, এসব নাকি ওদের অলিখিত নিয়ম। তারপর ক্ষিপ্ত গলায় আমাকে বলেছিল দৌড় দে। আমি দৌড় দেই নাই, একটু জোরে হেঁটে গেছি সামনের দিকে, আর প্রতি পদক্ষেপে আমার বুকের ধুকপুকানি বেড়েছে। আমি জানি একটু পরে আমি মারা যাব। এই বৃষ্টিচিহ্নিত ভোরের আলোয় চোখের সামনে আমি একটা হারিকেনের আলোয় পড়তে থাকা মিষ্টি মেয়েকে দেখছি, দেখছি একটা পাগল হয়ে যাওয়া মধ্যবয়সী মহিলাকে, দেখছি এক আর্মি অফিসারের বৌকে। একটু পরে ওদের কাউকেই আর দেখব না। একটা গুলি আমার বুক এফোঁড়ওফোঁড় করে গেল, রক্ত ফিনকি দিয়ে গড়িয়ে পড়ছে, সবুজ ঘাস লাল হয়ে যাচ্ছে।
রুখসানা, অ্যাঁই রুখসানা, তুমি আমারে ভালোবাসতা না? নীলা, তুই এমন বড়ো হয়া যাইতাসস ক্যান আজব, একটু ছোট থাকলে কী হয়? আম্মা, আমার খুব ভয় লাগে আম্মা, তুমি এমন পাগলের লাহান সারাদিন গাছের নিচে বইয়া বিড়বিড় করো ক্যান?
পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।