২০১৩ সালটি বাংলাদেশের ইতিহাসের জন্য বিশেষভাবেই গুরুত্বপূর্ণ। এবছর প্রায় একইসাথে দুটো আন্দোলন দেখা দিয়েছিল। শাহবাগ আর শাপলা বলে যথাক্রমে তারা পরিচিত। উভয়ের পক্ষে বিপক্ষেই খরচ হয়েছে বহু কালি। লেখা হয়েছে অন্তত কিছু বই, বিশ্লেষণধর্মী নিবন্ধ। আন্দোলন দুটিকে কেন্দ্র করে অনেক খুনও ঝরেছে। সেই ইতিহাস সুপরিচিত, তাই পুনরাবৃত্তি ঘটাব না।
আগ্রহের সাথে লক্ষ্য করছি, সাম্প্রতিক বাংলাদেশে একটি বিশেষ ধরণের বয়ান জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। বন্ধু সাদিক মাহবুব ইসলামের একটি ফেসবুক পোস্টে এই বয়ানের মূলকথা পরিষ্কারভাবে ব্যক্ত হয়েছে। তিনি লিখেছেন
, “… আজকের দিনে একমাত্র মেরুকরণ হওয়া উচিত আওয়ামীপন্থী আর আওয়ামী বিরোধী।” ইসলামের এই প্রত্যাশার পেছনের আকাঙ্ক্ষা আমি বুঝি। শাহবাগী শব্দটাকে টার্ম অফ অ্যাবিউজ হিসাবে ব্যবহার করার যে ঝোঁক দেখা যায় তাতে এমন আকাঙ্ক্ষা যুক্তিঅসঙ্গতও নয়। কিন্তু খোদ আকাঙ্ক্ষাটিতেই সরলীকরণের ঝোঁক চোখে পড়ে।
শাহবাগ আর শাপলা উভয়ের অন্তর্গত কিছু গোষ্ঠীর সাথে আওয়ামী লীগ সরকারের বিভিন্ন মাত্রায় যোগসাজশ রাজনৈতিক কারণে ঘটেছে। আবার এটাও সত্য, রাজনীতির জরুরত খাটো না করেই বলা যায়, মানুষের এজেন্ডা নিছকই প্রচলিত অর্থে রাজনৈতিক নয়। মানুষ সামাজিক জীব, সমাজে রয়েছে সাংস্কৃতিক জীবন সম্পর্কে নানান ধারণা, রাজনীতি অনেক সময়ই এসব ধারণা বাস্তবায়নের উপায়।
শাহবাগের যুদ্ধাপরাধের বিচারের রাজনীতি হঠাৎ আবির্ভূত হয়নি। যুদ্ধোত্তর বাংলাদেশে নাফিসা কবিরদের প্রাথমিক দাবিদাওয়া থেকে শুরু করে জাহানারা ইমামদের একাত্তরের ঘাতক ও দালাল নির্মূল কমিটির আন্দোলন হয়ে গণজাগরণ মঞ্চ পর্যন্ত একটা ধারাবাহিকতা চিহ্নিত করা যায়। একই কথা শাপলার ইসলামপন্থী রাজনীতির ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে জামায়াতে ইসলামীর ভূমিকা তো আছেই, তার সাথে ১৯৭৩ সালের চতুর্থ আরব-ইসরায়েল যুদ্ধ (ইয়োম কিপ্পুর যুদ্ধ বা রমজান যুদ্ধ নামেও পরিচিত) ও ১৯৭৯ সালের ইরানি বিপ্লবের প্রভাবে এই রাজনীতি মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশগুলোতে ক্রমাগত জনপ্রিয়তা লাভ করে। নিঃসন্দেহে উভয় আন্দোলনেরই নিজস্ব সমকালীন বৈশিষ্ট্য ছিল। কিন্তু একইসাথে এই আন্দোলনগুলো একটা ধারাবাহিকতারও অংশ। শাহবাগ আর শাপলার মধ্যে দূরত্ব যেটুকু আছে তা রাজনৈতিক বটেই; কিন্তু এই রাজনীতির কেন্দ্রে যতটা না দলীয় বিবেচনা আছে, তারচে বেশি আছে সাংস্কৃতিক জীবন সম্পর্কে ধারণার সংঘাত।
যদি এটাকে সাংস্কৃতিক রাজনীতি বলে শনাক্ত করি, তার মীমাংসা এক দশকে হয় না।
বিশ্ব ইতিহাস থেকে দুটি নজির দেখানো যাক।
পশ্চিমে একসময় র্যাডিকাল ফেমিনিজমের মৃত্যু ঘোষিত হয়েছিল। অনেকেই র্যাডিকালদেরকে বিগত যুগের রেলিক ধরে নিয়েছিলেন। স্রেফ মহাফেজখানা আর যাদুঘরেই থাকতে পারে যারা। অথচ সম্প্রতিকালে র্যাডিকাল ফেমিনিজমের একপ্রকার প্রত্যাবর্তন ঘটছে। তা একদিকে তত্ত্বগত, অমিয়া শ্রীনিবাসনের ২০২১ সালে প্রকাশিত
দ্য রাইট টু সেক্স যার একটি প্রতিনিধিত্বশীল উদাহরণ। কিন্তু একইসাথে প্রায়োগিকই, যার উদাহরণ মিটু আন্দোলন।
সমকালীন ফেমিনিস্টদের অনেকেই লিবারেল ফেমিনিজম প্রত্যাখ্যান করে র্যাডিকাল ফেমিনিজম আঁকড়ে ধরার প্রয়াস পাচ্ছেন।
১৯১৮ সালে একাতেরিনবুর্গে রাশিয়ার শেষ জার দ্বিতীয় নিকোলাস এবং তাঁর পরিবারের সদস্য ও ভৃত্যদেরকে খতম করেন বলশেভিকরা। অনেকেই এতে রাশিয়ায় জারশাহি ঐতিহ্যের চিরঅবসান দেখেছিলেন। এঁরা দূরদৃষ্টিহীন ছিলেন।
কারণ অই ঘটনার ৯০ বছর পর, ২০০৮ সালে, রাশিয়ার সর্বোচ্চ আদালত জার ও তাঁর পরিবারকে দায়মুক্তি দেন। শেষ জারকে পূর্ণ মর্যাদায় পুনর্বাসিত করা হয়। বর্তমান রাশিয়ায় আনুষ্ঠানিকভাবে জারশাহি নেই এটা ঠিক। কিন্তু অনানুষ্ঠানিকভাবে জারশাহির আবেগ খুব দৃশ্যমানভাবেই আছে, পুতিনের পররাষ্ট্রনীতিতে যা সুস্পষ্টভাবে প্রতিফলিত হয়।
র্যাডিকাল ফেমিনিজম বা রুশ জারশাহির শেষ পরিণতি কী হবে, তা আজ থেকে ৫০০০ বছর পরে বলা যাবে।
ইতিহাসে কিছু দু-চার-দশ বছরে শেষ হয় না।
শাহবাগ আর শাপলার মেরুকরণের ঐতিহাসিক ভিত্তি আছে। এসব আন্দোলনের ধারাবাহিকতা টিকিয়ে রাখার এজেন্ডাও আছে। তাই এগুলো থাকবে।
ইসলামের আকাঙ্ক্ষা আওয়ামি লীগ সরকারের পক্ষাবলম্বন ও তার বিরোধিতাকে একমাত্র মেরুকরণ করে তোলা। এটা সম্ভব না। কোন সমাজেই এমন একমাত্র মেরুকরণ থাকে না। যা সম্ভব তা হল প্রধান মেরুকরণ নির্ধারণ; সেটা সম্ভব অন্যান্য মেরুকরণ মেনে নিয়েই। তবে সেক্ষেত্রে আওয়ামি লীগের বিরোধিতা যারা করবেন, তাদেরকে একটি সাধারণ ভবিষ্যৎ কল্পনা করতে হবে, এবং তা বাস্তবায়ন করার জন্য লড়তে হবে। সেক্ষেত্রে আওয়ামি লীগের বিরোধিতা যারা করেন, তারা শাহবাগ ও শাপলার মেরুকরণটা এড়িয়ে গিয়ে, দু-পক্ষেরই অধিকাংশ মানুষের কাছে গ্রহণযোগ্য মনে হবে এমন একটি রাজনৈতিক কর্মসূচি তৈরি করতে পারেন। বলে রাখি, এটা করা সহজ হবে না।