শিরোনামে ব্যবহৃত দু’টি শব্দের প্রয়োগ যথাযথ হচ্ছে কিনা, তাই নিয়েই এই লেখা। অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের ভারতীয় শাখার প্রধান, আকার প্যাটেল তাঁর ‘প্রাইস অফ দ্য মোদী ইয়ার্স’ বইয়ে ‘ব্যাড মুসলিম’ পরিচ্ছেদে ২০১৫-র ৩০ মে থেকে ২০১৯-এর ২৩ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত সময়ে ঘটা ৮৩টি ‘লিঞ্চিং’-এর ঘটনার উল্লেখ করেছেন। প্রকৃত সংখ্যাটা যদিও এখন আরও অনেক বেশি। এই ধরনের লিঞ্চিং-এর ঘটনা আমাদের কলকাতার বিভিন্ন বাংলা খবরের কাগজে নিয়মিতই প্রকাশিত হয়েছে ‘গণপিটুনি’ বা গণপিটুনিতে আহত বা মৃত্যুর ঘটনা হিসেবে।
ইংরেজিতে যা ‘গ্যাঙ্গরেপ’ বাংলায় তা ‘গণধর্ষণ’। সাম্প্রতিক হাঁসখালির গণধর্ষণের ঘটনা নিয়ে পশ্চিমবঙ্গ তোলপাড় হয়েছে। ঘটনার তদন্তে নেমেছে সিবিআই। গণপিটুনি এবং গণধর্ষণ দুটিই এখন রাজনৈতিক শব্দ। দুটি শব্দই খবরের কাগজে নিয়মিত লেখা হচ্ছে। টেলিভিশনে অ্যাঙ্কররা বলছেন। আমরা আমাদের কথায় ব্যবহার করছি। এই শব্দ দু’টি নিয়ে কিছু নৈতিক প্রশ্ন আমি এই লেখায় তুলতে চাই আলোচনার জন্য। সাংবাদিক হিসেবে কাজ করতে গিয়ে, টেলিভিশনের আলোচনায় কথা বলতে গিয়ে এবং অন্য রাজ্যের সাংবাদিক বন্ধুদের সঙ্গে আলোচনা থেকে এই প্রশ্ন গুলো আমার মনে উঠে এসেছে। একজন সাংবাদিক হিসেবে বিষয়টি রিপোর্ট করছি। চাইছি প্রশ্নগুলি নিয়ে আলোচনা হোক। বা প্রশ্নগুলি আদৌ আলোচনার যোগ্য কিনা, সে কথাও ভেবে দেখার জন্য পাঠকের কাছে আবেদন জানাই।
হরিচরণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের বঙ্গীয় শব্দকোষে ‘গণ’ দিয়ে ১৭-১৮টি শব্দ থাকলেও গণধর্ষণ, গণপিটুনি শব্দ দুটি নেই। ঢাকা বাংলা একাডেমী থেকে ২০১৩ সালে তিন খণ্ডে প্রকাশিত, গোলাম মুরশিদ সম্পাদিত ‘বিবর্তনমূলক বাংলা অভিধান’-এ ‘গণ’ দিয়ে প্রায় ৬০টি শব্দ থাকলেও ওই দুটি বাংলা শব্দ সেখানেও নেই।
গণঅভ্যুত্থান, গণ-অসন্তোষ, গণ-আন্দোলন, গণউত্থান, গণজাগরণ, গণদেবতা, গণতন্ত্র, গণনাট্য, গণনায়ক, গণপতি, গণপরিষদ ইত্যাদি শব্দগুলির মধ্যে একটা শক্তির কথা আছে, সবাই মিলে কাজের মত একটা উদ্যোগের কথাও আছে। গণকবর, গণহত্যার মত শব্দের মধ্যে তা নেই। এই শব্দগুলো গণ উদ্যোগ থেকে জন্মও নেয়নি। কিন্তু গণধর্ষণ, গণপিটুনি শব্দের মধ্যে ভুল ভাবে একটা গণ উদ্যোগের ইঙ্গিত রয়েছে। যদিও প্রকৃত ঘটনা হল ‘গণ’ নয়, কিছু বা কয়েকজন দলবদ্ধ দুষ্কৃতীর কাজ এগুলো। কোথাও কোথাও তারা রাজনৈতিক দুষ্কৃতী। এখানে ‘গণ’ শব্দ ব্যবহার কি যুক্তিযুক্ত?
গণ থেকে গণেশ। এই বিষয়ে দীর্ঘ আলোচনা করেছেন দেবীপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায় তাঁর লোকায়ত দর্শন বইয়ে। তিনি বিভিন্ন পুঁথি, পুরাণ উল্লেখ করে বলেছেন, ‘গণ’ মানে হল শক্তি যা সঙ্ঘবদ্ধ মানুষের কথাও বলে। গণেশ শূদ্রদের দেবতা। ব্রাহ্মণ পরশুরাম তাকে কুঠার ছুঁড়ে মারলে তার একটি দাঁত ভেঙে যায়। সেই কারণেই হাতির মাথাওয়ালা এই দেবতার একটি দাঁত ভাঙা। পুরাণে আছে গণেশ ইচ্ছে করলে পরশুরামের কুঠারের আঘাত এড়াতে পারতেন। কিন্তু ওই কুঠার তার পিতার তৈরি। কুঠার লক্ষ্যভ্রষ্ট হলে বাবার অসম্মান হবে। তাই গণেশ ওই আঘাত নিজের দাঁতে গ্রহণ করেছিলেন। উচ্চ বর্ণের জন্য বিঘ্ন সৃষ্টিকারী গণদেবতা কী করে সিদ্ধিদাতা গণেশ হলেন, দেবপ্রীসাদের লেখা থেকে সেই কাহিনী আমরা জানতে পারি। এই কথাগুলো এই কারণে বলা যে ‘গণ’ শব্দের সঙ্গে কোথাও একটা নিপীড়িত মানুষ, প্রতিবাদ, জোট বাঁধা ইত্যাদি ভাব লুকিয়ে রয়েছে। ফলে গণফৌজ, গণঅভ্যুত্থান, গণজোট, গণরোষ যখন বলা হয় সেটা বেমানান হয় না। কিন্তু গণধর্ষণ, গণপিটুনিতে সেই সদর্থক ভাবটি নেই।
অসমের সাংবাদিক বন্ধুদের কাছে এই প্রশ্ন রেখেছিলাম। ওঁরা বললেন, ওঁরা অনেকেই গ্যাঙ্গরেপকে ‘দলবদ্ধ-ধর্ষণ’ লেখেন, লিঞ্চিংকে লিঞ্চিংই লেখা হয় অসমে, দলবদ্ধ-আক্রমণও লেখেন কেউ কেউ। কেউ কেউ অবশ্য গ্যাঙ্গরেপকে গণধর্ষণও লেখেন। মুম্বাইয়ের মারাঠি পত্রিকার এক সাংবাদিক জানালেন গ্যাঙ্গরেপ ওরা লেখেন, সামূহিক বলাৎকার, এবং লিঞ্চিংএর মারাঠি হল ‘চেচুন (লিঞ্চ) মারণে (কিল)’।
হিন্দিতেও সামূহিক বলাৎকার এবং সামূহিক পিটাই লেখা হয়। কেউ লেখেন লিঞ্চিং, কেউ আবার লেখেন ‘পিট পিট কর মারনা’। তামিলেও শুনেছি গণ শব্দ ব্যবহার হয়না, যে শব্দ ব্যবহার হয় তার অর্থ ‘সমবেত’।
বিভিন্ন রাজ্য থেকে সংগৃহীত এই সব তথ্য থেকে দেখা যাচ্ছে কয়েকজন দুষ্কৃতীকে কোনও ভাষাতেই ‘গণ’ শব্দ দিয়ে বোঝানো হচ্ছে না। বাংলা অভিধানেও এই শব্দ নেই। তাহলে এই শব্দ এলো কোথা থেকে? হয়তো এই শব্দ দু’টি এসেছে বাংলা সংবাদপত্র থেকে। তাৎক্ষণিক প্রয়োজনে কেউ ব্যবহার করেছিলেন। সেই থেকেই চলে এসেছে।
হিন্দিতে, মারাঠিতে যে সামূহিক শব্দ ব্যবহার করা হচ্ছে, এই ‘সামূহিক’ কিন্তু সংস্কৃত শব্দ। হরিচরণের বঙ্গীয় শব্দকোষে ‘সামূহিক’ শব্দটি না থাকলেও ঢাকা বাংলা একাডেমীর বিবর্তনমূলক বাংলা অভিধানে শব্দটি আছে। অর্থ বলা হয়েছে ‘সমূহ’। শিবনারায়ণ রায়ের একটি লেখায় সামূহিক শব্দের ব্যবহার কী ভাবে হয়েছে, তার একটি উদ্ধৃতিও ওই অভিধানে রয়েছে। ফলে গণপিটুনি, গণধর্ষণের পরিবর্তে আমরাও প্রয়োজনে ‘সামূহিক হামলা’, ‘সামূহিক ধর্ষণ’ বলতেই পারি।
বাংলা ভাষায় ধর্ষণ এবং পিটুনি প্রসঙ্গে গণ শব্দের ক্রমাগত ব্যবহার যদি চলতে থাকে, এমন হতেই পারে যে, এর ফলে আমাদের মনের গভীরে ‘গণ’ সম্পর্কে যে সদর্থক ধারণা রয়েছে, সেই ধারণা আঘাত প্রাপ্ত হবে। মনে রাখতে হবে ‘গণ’ বলতে আমাদের মনে ভিতরে যে ভাবের জন্ম হয়, দীর্ঘ দীর্ঘ সময় ধরে, বহু সৎ উদ্যোগের মধ্যে দিয়ে তৈরি হয়েছে সেই ধারণা বা ভাব। তাই মনে হয়, গণধর্ষণ, গণপিটুনির মত শব্দ তৈরি করে, গণআন্দোলন, গণজাগরণের মত শব্দের পাশে তাদের জায়গা করে দেওয়া অনৈতিক কাজ।