জীবনের চেয়ে বড় নেশা আর নেই। সে নেশায় পা টলোমলো করে, দৃষ্টি ঘনিয়ে আসে, আমরা তবু মুখ তুলে আকণ্ঠ পানের জন্য এই আকাশ থেকে মাটি, জল থেকে বাতাস, সবুজ থেকে ধূসর - সকলকে ডেকে বলি - আরো দাও, আরো, আমার তৃষ্ণা যে মেটে নি। আমরা যুদ্ধ করে যাই মরণের সাথে, বলি - আরো জীবন দাও। আজ সকালে ওই পর্দার ফাঁক দিয়ে চুঁইয়ে পড়া আলো আমার বিছানার পাশে এসে পড়ল, তখন বুঝলাম বিগত চার দিনে জীবনের নেশা গাঢ়তর হয়েছে। যাত্রা থেমে গেছে কাল রাতেই, তবু দিনের আলোয় তার খোয়ারি ভাঙে নি মোটে – ধীরে, অতি ধীরে নিঃশব্দ পদসঞ্চারে আমার মধ্যে সে আরো গভীরে ঢুকে পড়ছে, আমায় আচ্ছন্ন করছে – যেন নেশাতুর আমি এখনো সেইসব ঘাসে, জলে, পদ্মের বনে, হলদে পাখির ডানায় রয়ে গেছি। আছি – আছি – আছি – সেখানেই আছি আজও -।
‘নুরা কুদো লেই’। প্রেম প্রস্তাবের ফুল। মেইতেই ভাষায় এর আক্ষরিক অর্থ, অন্তত রতন যা বলল, তাতে দাঁড়ায় – এমন ফুল যা কোনো মেয়েকে উপহার দেওয়া যায়। বেগুনি রঙের এই ফুল ইম্ফল থেকে মৈরাঙ আসার পথে চোখে পড়েছে, এদিক ওদিক ফুটে ছিল বেশ কিছু, কিন্তু দীর্ঘ সবুজ ঘাসে পরিবৃত হয়ে একটিমাত্র এইখানে এই যে ফুটেছে, এই যে তার চারপাশে আর কেউ নেই, তাতেই তার যে কী অহংকার - এ যেন প্রেমিকার সেই একচেটিয়া অধিকারের একান্ত ইচ্ছে, যেখানে সে শুধু একা প্রেমিক-হৃদয়ের দখল নেবে।
এমন করে অনেকটা এগিয়ে এসে কাহিনি শুরু না করে, একটু বরং পেছিয়ে যাই, শুরু করি গতকালের কথা দিয়ে। দিনটা ছিল বাংলা নববর্ষ।
এখানে ভোর হয় আগে আগে আগে। পাঁচটারও আগে দেখি আলো ফুটেছে আকাশে, তবে আলো-ছায়া যেন যেতে চাইছে না কিছুতেই। জানলার পর্দা সরিয়ে দিলাম, ওমা, আগের রাতেও তো এতো পাহাড় চোখে পড়েনি। সন্ধ্যায় প্রাক্-পূর্ণিমার আলো ইম্ফল শহরের ব্যস্ত জনজীবনের চলাচলে ঢাকা পড়েছিল বটে, কিন্তু রাত ঘনালে ভারতের উত্তর-পুবের এই পাহাড় ঘেরা নগরীতে কেমন এক মায়াময় নিস্তব্ধতা নেমেছিল। পাহাড়গুলোর আকৃতি অন্ধকারে স্পষ্ট হয় নি, কেবল মাঝে মাঝে দু’একটা গাড়ির আলো তাদের উচ্চ অস্তিত্বকে জানান দিচ্ছিল। মেঘ ছিল বুঝি রাতে। আর তাই তো আজ উষাকালে ঘন মেঘের সাথে অরুণ আলোর মিতালি শহরের এপ্রান্ত থেকে ওপ্রান্ত পর্যন্ত, এবং তারপরেও। সে মোহময় আলো দীর্ঘ পাহাড়ের রাশি এঁকে দেয় আকাশের গায়ে। কাছের সবুজ পাহাড় থেকে ওপাশে নীল – সবার মাথায় একটা লালচে হলুদ আভা – সূর্যদেবের রথ যেন থমকে আছে ওই সীমাতেই। আমি চটপট খাতা-পেন নিয়ে বসে পড়লুম, যদি কিছু ধরে রাখা যায়। ওমনি দেখি চুড়োয় থমকে থাকা সাদা মেঘ গড়িয়ে গড়িয়ে নামতে শুরু করলে, তারপর গপ করে পাহাড়গুলোকে গিলে ফেললে, তারপর সব বেমালুম উধাও – সামনে শুধুই সাদা পর্দা একটা। আমি ধুত্তেরি বলে আজকের সূচী অনুযায়ী বেড়ানোর জন্য তৈরি হতে গেলাম।
ইম্ফল পৌঁছেছি কাল দুপুরে, যাত্রার মূল আকর্ষণ লোকটাক লেক – পৃথিবীর বিস্ময়। অনেকে সেকথা জানলেও খুব বেশি মানুষের বেড়ানোর লিস্টিতে সে স্থান পায় নি, তাই নববর্ষের ছুটিতে যখন এক ব্যাগ বাঙালী উত্তরবঙ্গ অধিকার করেছে, আমরা তখন চুপিসাড়ে এখানে। বাংলা নববর্ষের ঠিক আগের দিনই মণিপুরে নববর্ষ উদযাপন হয়। তাই কাল হোটেলে ঢোকার সময় দেখি দুটি একেবারে খুদে মেয়ে হলুদ রঙের পোষাকে নাক বরাবর তিলক কেটে (রসকলি কি?), মুখে একগাল হাসি নিয়ে আর মাথায় ছোট্ট স্টিলের বালতি নিয়ে (সম্ভবত পুজো সেরে) বাড়ি ফিরছে। আমাদের দলের সকলের মোবাইল বেরিয়ে এল, ওদের ছবি উঠল প্রচুর। আমরা মেয়েদুটিকে ও তাদের পরিবারকে “হ্যাপি নিউ ইয়ার” জানিয়ে হোটেলে চেক ইন করলাম।
পরে অনেক বাড়ির সামনেই দেখলাম, কলাপাতায় অন্ন-ব্যঞ্জনের সম্ভার সাজিয়ে রাস্তার ওপর রাখা আছে। এমন অর্ঘ্য নিবেদন আমাদের দেশের প্রাচীন কিছু বেঁচে থাকা রীতির মধ্যে একটা বলে আমার মনে হয়। ঘরের বাইরে ভোগের খাবার সাজিয়ে রাখার মানে কিছুতেই দেবতার প্রতি কোনো অসম্মান হতে পারে না, বরং একথা যেন বলতে চাওয়া যে, দেবতা ওই ঘরের কোণে, মন্দিরের গর্ভগৃহেই কেবল নেই, আমার দেবতা আছেন এই সমগ্র বিশ্বের মধ্যে, ওই প্রাণীসকলের মধ্যে। মণিপুরে এই রীতির কারণ সঠিক বলতে পারি নে, তবে জানি, এখনো কিছু স্থানে যজ্ঞের বা পুজোর অন্ন পশু-পখিদের জন্য এমন করে খোলা জায়গায় সাজিয়ে দেওয়া হয়।
মণিপুরের ব্যাপকভাবে বৈষ্ণবধর্মীদের বসবাস। একসময় স্থানীয় রাজাদের আনুকূল্য লাভ করেছিল এই ধর্ম। শোনা যায় নরোত্তম দাসের সম্প্রদায়ের একটি শাখা এখানে বাসা বাঁধে। সময়টা পঞ্চদশ শতক, চৈতন্যদেবের মৃত্যুর পঞ্চাশ বছর পার করে। অনেক মানুষের কপালে এখনো তাই সুন্দর করে তিলক আঁকা। কাল বিকেলে আমরা ইম্ফলের কৃষ্ণমন্দির দেখতে গিয়েছিলাম। বিস্তৃত অঞ্চল, সুন্দর বাগান, তার মাঝে সাদা ধবধবে মন্দির, মাথার তিনটি চুড়ো সোনালি রঙ করা। নাটমন্দির পেরিয়ে গর্ভগৃহ। সেখানে তিনটি ভাগে দেবতা থাকেন। মধ্যে রাধাকৃষ্ণের যুগল মূর্তি, বাঁদিকে সম্ভবত কৃষ্ণ-সুদামা, আর ডানদিকে জগন্নাথ-সুভদ্রা-বলরাম। মণিপুর কেমন করে ওড়িশায় মিশে গেল ভাবতে ভাবতে দেখি আরতি শুরু হল, সঙ্গে খোল-করতাল, আর জলদমন্দ্র শঙ্খধ্বনি। এমন দুহাতে দুটি বিশাল শঙ্খ নিয়ে একফুঁয়ে একসাথে বাজাতে কখনো দেখি নি। এই বাজন-সঙ্গীরা নাটমন্দিরে – পুরোহিত গর্ভগৃহে। সকলের পরনে কমলা রঙের নরুণ পেড়ে সাদা ধুতি – অনেকটা লুঙ্গির মতো করে পরা। তিনভাগে পুজো হল। সহ-পুরোহিত (অন্তত তাই মনে হল) আমাদের সেই সেই দেবতার দরজার সামনে দু’ধারে লাইন করে দাঁড় করিয়ে দিলেন। মনে হল যেন নাটমন্দির থেকে দেবতার আসন – একটি পথ তৈরি হল – দেবতার আবাহনের। প্রতি আরতির শেষে হাঁটু মুড়ে মাটিতে মাথা ঠেকিয়ে প্রণাম করতে ইশারা করছিলেন। আমরা অনেকেই হাঁটুর কথা ভেবে মনে মনে “ওরে বাবা, আচ্ছা ঠাকুর, এখান থেকেই তোমায় নমো করলুম” বলে সরে সরে গেলাম। আরতি থামতে নিস্তব্ধতা ভারি হয়ে এল, সাদা ছিটদার পায়রাগুলো নেমে এল সাদা পাথরের অঙ্গনে। মৌসুমীদি হাতে আঙুরের থোকা নিয়ে বসছিল, যে আসছিল তাকেই প্রসাদ বিলোচ্ছিল। আমায় দিতে চাইল, আমি নিলুম না দেখে অবাক হল। আমি বললুম – ও তুমি বুঝবে না, ওই ভগবান নামক লোকটির সাথে আমার ছত্তিস কা আখড়া। মনটা বেশ দ্রব হয়ে আসছে, মনে হচ্ছে এই তোমার চরণেই আকাশ আমার – হঠাৎ চটকা ভাঙল। কৃষ্ণাদি গিয়েছিলেন আরতির উপচারের কিছু চেয়ে নিতে, পুরোহিত সভয়ে সরে গিয়ে দু’কথা স্থানীয় ভাষায় শুনিয়ে দিয়েছে বোধহয়। আরেকজন মণিপুরী মহিলা ভাঙা ভাঙা হিন্দিতে ক্ষমা-টমা চেয়ে নিয়ে বলল – আসলে, পুরোহিতদেরকে মেয়েদের স্পর্শ করা নিষেধ তো। সরল স্বভাব কৃষ্ণাদি আরতির পলতের অংশ পেয়েই খুশি হল, আমার মনটা কিন্তু তেতো হয়ে গেল। সেই তো, শ্রীরাধা, সুভদ্রা - এঁরা তো ঈশ্বরী, আমরা নেহাতই মর্তধামের ক্লেদক্লিষ্ট মানবী। ধর্মের অন্তঃস্থিত গভীর মনন যেখানে দেবতার সাথে মিলনেই সম্পূর্ণতা পায়, সেখানেই আবার এই ঘৃণা, এই দূরে সরিয়ে রাখা ধর্মের ঠোঙায় মুড়েই পরিবেশিত হয়। সত্য সেলুকাস, কী বিচিত্র এই দেশ! নিবাত প্রদীপ শিখার মতো একটা স্থির ভাব আমার মনকে অধিকার করছিল, নষ্ট হয়ে গেল, উঠে এলাম নাটমন্দিরের সিঁড়ি থেকে। বাইরে আসতে স্বাতী বলল – কী ব্যাপার দিদি? জমে গিয়েছিলে তো? তোমাদের নাকি ভক্তিভাব জাগ্রত হয়েছে? আমি দীর্ঘশ্বাস ফেলে মনে মনে বললুম - আরেকটু হলেই হচ্ছিল আর কি। খুব বাঁচা বেঁচেছি বাপু।
কালকের বেড়ানোর সূচি কৃষ্ণ মন্দিরেই শেষ হয়েছিল। আজকের সূচি কাঙলা ফোর্ট দিয়ে শুরু। কিন্তু সেই সাদা পাহাড়-ঢাকা মেঘটা এখন ঝরোঝরো ধারায় ঝরছে। দুম করে থেমেও গেল। এই মেঘ-রৌদ্রের দেশে এমন লুকোচুরি চলল আমাদের যাত্রাভর। কাঙলা ফোর্টেও তাই। বিশাল গেট দিয়ে খানিক এগিয়ে গোবিন্দজীর পুরোনো মন্দিরের সামনে দাঁড়িয়ে – হঠাৎ ঝেঁপে নামল। মাথা বাঁচাতে শেডের নিচে দাঁড়াতে হল। শেডের ওপর দিয়ে হলদে-সাদা থোকা থোকা ফুলে ভর্তি গাছ। এমন দীর্ঘদেহী গাছের সংখ্যা খুব কম নয় এখানে। হালকা নীলচে বেগুনি রঙের ফুলের গাছ ইম্ফল শহরের এদিক ওদিক দাঁড়িয়ে। কেউ বলতে পারে না কী নাম। জাকারান্ডা সম্ভবত। গাঢ় হলদে ফুলওয়ালা মেপল পাতার মতো পাতা নিয়ে অমনই আরেকটি গাছ দাঁড়িয়ে ছিল কাল বিকেলের ইম্ফল ওয়ার সেমেট্রির প্রবেশদ্বারের সামনে। এই সেমেট্রিটি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ব্রিটিশ কমনয়েলথ-এর মৃত সৈনিকদের। স্তব্ধ নিশ্চুপ শান্ত সেমেট্রির বাইরের ওই দীর্ঘশরীর গাছেরা ঘন ছায়া বিছিয়ে রাখে - কেমন মন খারাপ হয়। যেন কত জীবনের অকালে থেমে যাওয়া গান এখানে এসে জড়ো হয়েছে। হতেই পারে এইসব গাছেদের বংশলতিকাটি সুদূর ইউরোপে, সেখান থেকে ব্রিটিশদের সাথে জাহাজে করে এসেছে এই পাহাড় ঘেরা ভূমিতে। সেইসব মানুষেরা চলে গেছে - বিলম্বিত আয়ু নিয়ে এরা আজও গভীর শোকের নিগড়ে বাঁধা পড়ে আছে।
এসব কথা সত্যি কিনা কে জানে? স্থানীয় মানুষজনের সাথে কথা বলা সহজ নয়। কিছু মানুষ হিন্দি ও ইংরাজি জানেন – মোটামুটি কাজ চলে। কিন্তু মাটির কাছাকাছি যারা, তাদের ভাষা মেইতেই। আশ্চর্যের ব্যাপার, এদের প্রচলিত লিপি বাংলা, অথবা খুব ঠিকঠাক বললে অসমিয়া। গাড়ির চালক রবিন জানাল, মেইতেই হরফ চলে কম, এখন ইস্কুল কলেজে নতুন করে শেখানো হচ্ছে। অবশ্য কিছু দোকানের নাম মেইতেই লিপিতে চোখে পড়ল। এদিকে ফলটা আমাদের পক্ষে বেশ মজাদার হল – আশেপাশে লেখাপত্তর, বিজ্ঞাপন যা আছে, সব গড়গড় করে পড়ে চলেছি বটে – কিন্তু মাথামুণ্ডু কিছুই বুঝতে পারছি না।
কাঙলা ফোর্টে থেকে বেরিয়ে সোজা মৈরাঙ রওনা হলাম। বিষ্ণুপুর জেলার মৈরাঙের স্থান মাহাত্ম্য কিছু কম নয়, এখানেই ভারতের মাটিতে প্রথম তিনরঙা পতাকা উঠেছিল, আর সেটা এই ১৪ই এপ্রিলই, সালটা ১৯৪৪। এখানেই ছিল আই এন এ -এর হেডকোয়ার্টার। ইম্ফল থেকে মৈরাঙ যাবার ৪০ কিমি পথ আমাদের সাথে ছিল মাঠের ওপারে সবজেটে নীল পাহাড়। পথে পড়ে সাদু চিরু ঝর্ণা। মসৃণ পিচমোড়া রাস্তা ফেলে গাড়ি ঘুরে গেল ডানদিকে। এখানে ধান ফলে বছরে একবারই। সেই ধান মোড়ানো নেড়া ক্ষেতের মাঝবরাবর পাহাড়কে লক্ষ্য করে গাড়ি চলে লাফাতে লাফাতে। তারপর পাহাড়ি জনবসতি – ছোটো ঘর, অর্থনৈতিক স্বচ্ছলতার অভাব চোখে পড়ে সহজেই। সাদু চিরু পিকনিক স্পট হওয়াতে বাড়তি কিছু রোজগারের সুবিধা রয়েছে। বাড়ির বাইরে স্থানীয় মদ বিক্রি হয় – পুরোনো ফেলে দেওয়া বিলাতি মদের বোতলে। ভাতের মদ। এখানে একরকম কালো চাল পাওয়া যায় – তার মদও আছে দেখলাম। সঙ্গে ঝাল ঝাল পাঁপড় আর লঙ্কার আচার।
এই ঝাল খাওয়াটা দেখছি মণিপুরের বেশ পছন্দের। স্থানীয় লঙ্কা মোটাসোটা, ট্যারাব্যাঁকা, আর খুব ঝাল – নাম ‘উমড়ো’। ঠিক ছিল, ফেরার পথে কেনা হবে, হয়েওছিল, অনেকেই কাগজে মুড়ে উমড়ো নিয়ে ফ্লাইটে উঠেছিল। ইম্ফলে নেমেই আমরা অথেন্টিক মণিপুরী কুইসিন খেতে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলাম। স্টিকি রাইসের থালার চারদিকে ঝপাঝপ নেমে পড়েছিল একই মাপের ছোট ছোট দশটি বাটি – বোয়াল মাছের পদ শুদ্ধু। তাদের মধ্যে রূপ-রঙের বিশেষ তফাৎ না থাকায় কেবলই সব গুলিয়ে যাচ্ছিল। হয়ত আমার কাছে শাকের বাটি দুটো, ঈশিতার কাছে একটাও নয়, বা শ্বেতাদির কাছে ডালের তিনটে। মোট আশিটা বাটি নিয়ে আমরা যখন নাস্তানাবুদ, যখন বাংলা মেশানো হিন্দিতে আমরা “এই, হামকো মাছ দো, এই, ডাল কিধার গয়া, ঔর দোঠো ইয়ে যো ইয়ালো কালারকা তরকারি হায় না, উও দো” – এইসব বলছি, তখন কিচেনের কেউ একজন দুর্বোধ্য ভাষায় গজগজ করতে করতে নিপুণ দ্রুত হাতে প্রত্যেকের মধ্যে ভাগাভাগিটা করে দিয়ে গেল। আমরাও হাঁফ চেড়ে বাঁচলাম। পদের ছিল ব্ল্যাক রাইসের কর্পূরের গন্ধওয়ালা পায়েস – রঙটা বেগুনি। আর বলার মধ্যে আর ছিল বাঁশের শাঁশ দিয়ে তৈরি পদ – যেটা আমরা গন্ধের জন্য মোটেই খেতে পারি নি। মণিপুরের মানুষজনও আসেন দেখলাম এই লক্ষ্মী কিচেনে। দরজার কাছে দাঁড়িয়ে আমরা তখন বৃষ্টি থামার অপেক্ষা করছিলাম। মৌসুমীদি দেখি কিচেনে খেতে আসা মণিপুরীদের ভারি সুন্দর করে বাংলায় - আসুন, বসুন, খেয়ে যান - এইসব বলছে। আমাদের ধমক দিচ্ছে – এই তোরা রাস্তা ছেড়ে দাঁড়া। স্থানীয়রা আমাদের বিস্ময়ের চোখে মাপছে। ভারি অদ্ভুত এই পথের আলাপ। আমরা সাতটি ভিন্ন বয়সের ভিন্ন কাজ-কর্মের মেয়ে জুটেছি – সারথি স্বাতী ও তার ট্রাভেল কোম্পানী ‘মঁ ভয়েজ’। কখন যে আপনি থেকে শুরু করে তুমি-তুইতে এসে পৌঁছেছি খেয়ালও করি নি। চেনা মুখ চেনা পথ চেনা অভ্যেসকে টুকি দিয়ে এই যে চুরি করে খোলা হাওয়া বইল – বিভিন্ন রঙের হৃদয় থেকে ঠিকরে বেরোনো আলো একসাথে রামধনু তৈরি করল – এ যে পরম পাওয়া। পথকে আপন করলে পথেই ঘর হয় – স্বজন মেলে সেখানেই।
আচ্ছা, ফুচকা কি সর্বজনীন লোকাল কুইসিন? মেয়েরা তাই মৈরাঙ পৌঁছে অল্পবিস্তর সাইটসিইং করে হোটেলে ফেরার পথে বাজারের সামনে হইহই করে ফুচকা খেতে নেমে পড়ল। অবাক ব্যাপার, এখানে টক জল ছাড়াও সুজির ফুচকার সাথে ডাল দেয়। বাজার অত্যন্ত ছোট, আমরা ফানেক কিনতে ভেতরে ঢুকলাম। মেয়েদের পরনে মণিপুরে ফানেক প্রচলিত। একটা লম্বা পাড় বসানো কাপড়, তাকে মাঝবরাবর কেটে সেলাই করে পরতে হয়। ওপরের ওড়নার মতো যেটা, তাকে বলে ফি। ড্রাইভার রবিন বেশ মিশুকে, এই মৈরাঙেই আবার তার ঘর। তাই পরিবারের কাছাকাছি আসার আনন্দ তার হাসিকে কান পর্যন্ত ঠেলে তুলেছে। সে একটা পরিচিত দোকানে নিয়ে গেল, কিন্তু আমরা পুরো মহিলাসুলভ ভঙ্গীতে রঙ আর ডিজাইনের ভ্যারাইটি খুঁজতে খুঁজতে গোটা বাজার ঘুরে ফেললাম। প্রতিটি দোকানে বিক্রেতা মহিলা। পাহাড়ে এমনিতেও মহিলাদেরই কাজের জায়গায় বেশি খুঁজে পাওয়া যায়, এই উত্তর-পুব প্রান্তে সেটি আরো বেশি। ইম্ফলে একটি মহিলা পরিচালিত বাজার আছে, আকারে বিশাল, নাম ইমা মার্কেট। মণিপুরী নববর্ষ হওয়ায় সেদিন বন্ধ ছিল অধিকাংশ দোকান।
ইমা মার্কেটের কথা ইন্টারনেট খুললেই পাওয়া যায়। এইসব জেনে শুনে আমার কেমন একটা ধারণা হয়েছিল যে এখানে matrilineal পরিবার প্রথা চলে, অর্থাৎ পারিবারিক সম্পত্তিক্রম মেয়েদের ধারাতেই থাকে। এমনকী এও মনে হয়েছিল যে, মেয়েরা নয়, বিয়ের পর ছেলেরাই বুঝি শ্বশুরঘর করতে আসে। চিত্রাঙ্গদার চিত্রকল্প, তা সে মহাভারতের হোক, বা আমাদের প্রাণের ঠাকুরেরই হোক, সেই অনুষঙ্গকেই কি মনে করিয়ে দেয় না? প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, ‘চিত্রাঙ্গ’ একটি পার্বত্যজাতিরও নাম। রবিন কিন্তু জানাল, এখানে এখন সম্পত্তির ব্যাপারে হিন্দু এক্টই চলে। আর ছেলেদের স্ত্রীর ঘর করতে যাওয়া? আরে, আমরা পাগল নাকি? অবশ্য এও জানাল, মেইতেইদের মধ্যে এ প্রথা না থাকলেও খাসীদের মধ্যে নাকি এখনো কিছু রয়েছে।
মৈরাঙে রাতে শিলাবৃষ্টি হল খুব। টিনের চালের তার আওয়াজ বহুগুণ বেড়ে যায় – আমাদের ভয় হয় কাল সকালে বেরোতে পারব তো? যার টানে এসেছি, তার কাছে পৌঁছতে পারব তো? তার সাথে সাক্ষাৎ বহুদূর থেকে আজ সূর্যডোবার কালে একবার হয়েছিল। যতদূর চোখ যায় ততদূর – মাঝে মাঝে মাথা উঁচু করা মৈনাকের সারি – তাদের ঘিরে জল – বিস্তৃত। লেকের নাম – লোকটাক।
লোকটাক ভারতের সর্ববৃহৎ মিষ্টি জলের লেক। কিন্তু যেজন্য গোটা পৃথিবী তার দিকে অপার বিস্ময়ে তাকিয়ে থাকে তা হল, এই লেকের ভাসমান দ্বীপ। দ্বীপ না বলে খণ্ডখণ্ড ঘাসজমি বলা ভালো – তবে তা জলের অন্তঃস্থিত মূল ভূমির সাথে যুক্ত নয় – এক বিচিত্র ভাসমান অবস্থায় তাদের অস্তিত্ব রক্ষা পায়। বিজ্ঞানীর ভাষায় এর নাম ‘বায়োমাস’। জলের ওপর মাটির মোটা স্তর, তার ওপরে দীর্ঘ ঘাস – এই নিয়ে তৈরি বায়োমাস, স্থানীয় কথায় ‘ফুমদি’। গরমের সময় জলস্তর কমে গেলে ফুমদি নিচে নেমে আসে, জলের তলার জমির সাথে ফুমদির ঘাস-মাটির নিচের শিকড়ের সাময়িক সংযোগ ঘটে। আবার বর্ষা এলে বাড়ন্ত জলস্তরের সাথে সাথে ফুমদি ওপরে উঠে যায়। এমন করেই বছরভর চলে ছোঁয়াছুয়ির খেলা।
মণিপুরের জনজীবনের অনেকটাই এই লেকের ওপর নির্ভরশীল। শাকসবজি থেকে মাছ – সবটাই। মানুষজনের অনেকেই পেশায় ধীবর। কখনো যদি ইন্টারনেটে লোকটাক লেকের ছবি দেখা হয়, তাহলে সুবিশাল জলের মধ্যে সবুজ ঘাসের বড় বড় বৃত্ত চোখে পড়বে। ছোটো ছোটো ভাসন্ত ফুমদি বাঁশ দিয়ে জোড়া লাগিয়ে অমন বৃত্ত তৈরি করা হয়, তারপর মাছ ধরার জন্য লিজ দেওয়া হয়। জলের ওপর ঘাস-বৃত্ত দেখতে দেখতে আমাদের বিস্মিত চোখ কূল পায় না। সেন্দ্রা পার্কের ভিউ পয়েন্টের আরেকদিকে মেঘভর্তি আকাশে সূর্য তখন অস্ত যাচ্ছে, পাখিরা তাদের কুলায় ফিরছে। সন্ধ্যা নামার আগেই আবছা রৈখিক বৃত্তের মতো প্রায় গোল চাঁদ উঠল। কাল পূর্ণ চন্দ্রের রাত – আমরা অপেক্ষায়।
রাতে শিলাবৃষ্টি হবার পর পরদিন সকালবেলা স্বচ্ছ নীল আকাশ দেখে মনটা ফুরফুরে হয়ে গেল। সাড়ে ন’টা নাগাদ মৈরাঙের সমতল ছাড়িয়ে গাড়ি উঠে গেল সোজা পাহাড় বরাবর। তার চ্যাপ্টা মাথায় নেমে পড়লাম আমরা। এখানে ৩৬০ ডিগ্রিতে লোকটাক লেক দেখা যায়। আমরা ক’জন ছাড়া জনমনিষ্যি নেই। ওই দূরে দূরে দেখা যাচ্ছে ছোট ছোট ফুমদি, তার ওপর বসত করা জেলেদের ঘর-গেরস্থালী, টিনের চাল রোদ পড়ে চকচক করছে। ওরকম একটা ফুমদিতেই আজ আমরা রাত কাটাব।
এই জলের সাথে, তার ঘাসজমির সাথে পরিচয়ের যেন কয়েকটা পরত ছিল। অনেকটা ঠিক প্রেমের মানুষকে চেনার মতো – বহু দূর থেকে ধীরে ধীরে তার কাছে যাওয়া, তাকে স্পর্শ করা, তার মধ্যে ডুব দেওয়া, তারপর তার মধ্যেই বুঁদ হয়ে যাওয়া। তেমনই ছেড়ে আসার পরও তার সেই নিবিড় থাকাটা মনের মধ্যেই বাসা বাঁধে। পরিচয়ের পরের পরতটা খুলল যখন কাইবুল লামজাও ন্যাশনাল পার্কে এলাম। এটি পৃথিবীর একমাত্র ভাসমান ন্যাশানাল পার্ক। ফুমদিগুলো এখানে একত্রিত হয়ে আদিগন্ত ঘাসজমি তৈরি করেছে - দুপুরের রোদে পোড়া হলদেটে দেখায়। একে আর ঘাসজমি না বলে ঘাস-জঙ্গল বলা ভালো। এখানে বাস করে বিরল লুপ্তপ্রায় প্রজাতির এক হরিণ – নাম সাঙ্গাই। এটি মণিপুরের স্টেট আনিম্যাল। মাথায় শাখাওয়ালা শিং, ঈষৎ কালচে আভার হরিণ। মেয়েদের অবশ্য মাথায় শিং নেই। উঁচু ওয়াচ টাওয়ারে দাঁড়িয়ে চোখে বাইনোকুলার লাগিয়ে ঘাসের মাঝে ওমন একজন মহিলার দেখা পাওয়া গেল – মাথা নিচু করে বসেছিল আনমনে। ন্যাশানাল পার্কের ভলেন্টিয়ার রতন এই জল-জঙ্গলের ইতিহাস-ভূগোল অনেককিছু বোঝাচ্ছিল। সেই অবকাশে আমার চোখ গিয়েছিল অনেক নিচে ঘাসজঙ্গলের মাঝে সরু জলপথের দিকে, এই প্রান্তে এই আমাদের দিকে নীল আর হলুদ রঙের দুটো ডিঙি নৌকো একে অপরকে ঠাসাঠাসি করে দাঁড়িয়ে – পথের অন্যদিকটা সবুজের মাঝে হারিয়ে গেছে এঁকে বেঁকে। স্বাতী বলল – চলো যাই, বোটিং করে আসি। আরে দারুণ তো। এই ইচ্ছেটা কেমন করে শুনে ফেলল ও? “জয়, ইচ্ছের জয়।”
সরু ডিঙি নৌকোগুলো একটা নাম আছে – মী। কিন্তু সেগুলো মূলত দাঁড়-বাওয়া প্রতিযোগিতায় লাগে বলে মনে হয়। চলাচলের জন্য নিত্য ব্যবহার্য আমাদের এই ডিঙিটি আকার ছোট। তবে পাশাপাশি আমরা আটজন দিব্যি তাতে ধরে গেলাম। ডিঙি চলল সরু জলপথ বেয়ে - দুপাশে লম্বা লম্বা ঘাস এই নতুন অতিথিদের হাত বাড়িয়ে ছুঁতে চায়। কালো ফিঙে ঘাসের আগায় বসে আমাদের দেখে – তারপর উড়ে যায়। আমাদের দিকে মুখ করে দাঁড় বাইতে বাইতে ভলেন্টিয়ার রতন গল্প করে, হিন্দি বলা রপ্ত করেছে সে, সুর টেনে টেনে কথা বলে। ওই যে ওই ঘাসের মধ্যে জন্মায় পাতা – সেটা শাক হিসেবে খাওয়া হয়। কী যেন নাম শুনলাম? – ‘লেইতেই’ কি? আমরা উত্তেজিত হয়ে বকবক শুরু করলে শ্বেতাদি মিষ্টি করে ধমকায় – নীরবতা পালন করো সব। আমরা চুপ। দাঁড়ের ছপছপ শব্দ কানে আসে – কোথায় নিরন্তর একটা পাখি ডাকছে। কালো জলের মধ্যে জলজ উদ্ভিদ তার জড়ানো আঙুল বিস্তার করে, আমরা ঠাণ্ডা জল স্পর্শ করি। গুনগুন করে রতন বলে – ওই যে ওই বেগুনি ফুল – তার নাম ‘নুরা কুদো লেই’ – মেয়েকে দিতে পারা যায় এমন ফুল। যে সে সময় দেবার নয়, যাকে তাকে দেবারও নয়, প্রেমের প্রস্তাব করা হয় এই ফুল দিয়ে। বিবাহিত মহিলারা ডান কানে ফুল গুঁজে রাখে – অর্থাৎ, কেটে পড়ো বাপু, রাস্তা বন্ধ। আর প্রেমে আগ্রহী মেয়েরা বাঁ কানে ফুল গোঁজে। ছেলেটির কাছ থেকে পাওয়া ফুল যদি সে ডানকানে পরে নেয়, তার মানে সে সেই প্রস্তাবে রাজি, আর যদি দু’কান থেকেই ফুল ফেলে দেয় – তবে আর কী, ছেলেটির কপাল পুড়ল। এসব ঘটে কখন? যে কোনো সময়েই ঘটতে পারে, প্রেমের কি আর পঞ্জিকা লাগে? তবে দোল বা হোলি এখানে পাঁচদিনের উৎসব, অফুরন্ত নাচ-গানের সাথে সাথে সেই উৎসবকালে নিজের মনের মানুষকে খুঁজে নেবার রীতি এখনো প্রচলিত। প্রসঙ্গত একটা কথা না বলে পারছি না। আমাদের দেশে প্রাচীনকালে মহা সমারোহ প্রেমের উদযাপন হত। অকারণ লোকলজ্জা আর সমাজের রক্তচক্ষু তখন আমাদের এমন করে পেঁচিয়ে বাঁধে নি। কামদেবের মন্দিরে পুজো হত চৈত্রমাসের ত্রয়োদশীতে। পরে সম্ভবত প্রেমের ঠকুর কৃষ্ণের সাথে একাত্মতার কারণে দোল বা হোলির মাঝে সেই মদনোৎসব ফল্গুধারায় লীন হয়।
বুনো শুয়োরের বাস আছে এই ঘাস-জঙ্গলে। বাচ্ছার জন্ম দিতে এখানেই ঘর বানায় তারা – তাদের পরিত্যক্ত ঘরে সাঙ্গাই হরিণেরাও বংশবৃদ্ধি করে। এই সাঙ্গাই হরিণের আরেকটা নামও আছে - ডান্সিং ডিয়ার। ঘাসজমির ওপর দিয়ে লাফিয়ে চলে তারা, ভাসমান জমি তরঙ্গের আকারে দুলতে থাকে – মনে হয় বুঝি নৃত্যরত হরিণ। হরিণের নাচ কপালে না থাকলে কী হবে, দুধের স্বাদ ঘোলে তো মিটল – মৌসুমীদি কার্পেটের মতো জমিতে নেমে লাফাচ্ছিল মনের সুখে। আমরা আশ্চর্য হয়ে দেখলাম, সত্যি জমি নড়ছে ঢেউএর মতো, কিন্তু মৌসুমীদির পা একটুও ডুবছে না। তবে জোঁক ধরল একটা।
এই ঘণ্টাখানেকের বিস্ময় যে সব নয়, তা তখনও বুঝি নি। প্রকৃতি তার অপার করুণা সাজিয়ে রেখেছিল আমাদের জন্য – রোদ, বৃষ্টি, মেঘ, জ্যোৎস্না – কী নেই সেখানে? দেখাশোনা-পরিচয়ের পরের পরতটা খুলল লেকের বুকের মধ্যিখানে প্রবেশ করে। ফুমদিতে হোমস্টে। তাদের জোড়া ডিঙি নৌকো এসে বাক্স-প্যাঁটরা সমেত আমাদের তুলে নিল। মাথায় টোকা দেওয়া মেইতেই মহিলা দাঁড় ঠেলে ঠেলে সামনের দিকে এগোতেই সরু জলপথ বিস্তার পেল। দুপাশে বেগুনি শালুকের সম্ভার, হাত বাড়িয়ে তাদের ধরা যায়। ঘাট বলতে শুরুতেও কিছু ছিল না – মাটি পেরিয়ে ঘাস পেরিয়ে নৌকায় চড়া, নামবার সময়ও তেমনই – সোজাসুজি ফুমদিতে গিয়ে ওঠা। কালো নরম দোদুল্যমান মাটিতে যাতে পা বসে না যায়, তাই লম্বালম্বি বাঁশ ফেলা রয়েছে। এল শেপের ফুমদিতে মোট তিনটে কটেজ, তাছাড়া যারা দেখাশোনা করে, সেইসব জেলেদের জন্য নির্দিষ্ট আরো দুটি একচালা ঘর। আমাদের কটেজটি বাঁশের, সামনে বারান্দা মতো। ব্যবস্থা খুবই সাদামাটা – কিন্তু চমৎকার।
সকলে মোবাইলে প্রচুর ছবি তুলছিল। অনীতাদি খুব ভালো ছবি তোলে। আমি কিন্তু ক্যামেরা বন্ধ করে দিলাম, এমনকী ছবি আঁকতেও পারছিলাম না। মনে হচ্ছিল আমার মন-বুদ্ধি-অন্তঃকরণের সবটা দিয়ে এই অপার অসীম প্রকৃতিকে শুষে নিই। ওই যে দূর দিয়ে আমাদের ঘিরে রয়েছে পাহাড়শ্রেণী, এই যে জল, তার মাঝে দুপুরের রোদে ঝকঝকে শালুকের দল, বউ কথা কও ডেকে চলে একটানা সুরে – এ তো শুধু ওই ছবিতে ধরবে না – রূপ-রস-গন্ধ-শব্দ-স্পর্শের সবটুখানি তো এই মনও ধরে রাখতে পারে না – সে যে কেবলই উপচে পড়ে – অহৈতুকী এই সম্ভারে অবগাহন করাও যে সহজ নয় বড়।
দুপুর গড়িয়ে যেতেই দৃশ্যপট গেল বদলে। সূর্যাস্ত হয় নি তখনো – গোধূলির কনে দেখা আলোয় স্তিমিত নম্র হয়ে এল তপ্ত ধরণী। দ্রুত লয়ে মেঘ জমল আকাশ জুড়ে – পাহাড়ের রঙ ঘন হল – জলে, ঘাসে উঠল বাতাসের ঢেউ। ঘনঘোর আকাশ মথিত করে বিদ্যুৎ চমকাল – যেন মহাকালের ধূসর পর্দাখান ফ্যাঁস করে লম্বালম্বি ছিঁড়ে গেল, রুদ্ররূপের ঝলক মনের অন্তরতম পাপকেও অনাবৃত করে গেল নিমেষে। গুনগুন করে শুরু হয়ে ঝেঁপে বৃষ্টি এল। এমন করে বৃষ্টি দেখি নি কখনো। আদিগন্ত, এপাশ ওপাশ সবখানে, যতদূর চোখ যায়, ততদূর – জলের ওপর, ঘাসের ওপর, শালুকের পাতার ওপর, আমাদের প্রত্যেকের দীর্ঘ জীবন সংগ্রামে জ্বলে যাওয়া মনের ওপর শীতল জলের ধারা এল।
সন্ধ্যে হল যেই – জল ঝরিয়ে মেঘ সরিয়ে চাঁদ উঠল পুন্নিমের। একি মহারাজ – এত রূপ সাজিয়েছিলে যদি, আগে কেন দাও নি তবে? নাকি সকলকিছুর সময় থাকে – সে পাওয়া পেতে গেলে অধিকারী হতে হয়, দুহাত তবেই ভরে যদি নিঃশেষে সব সমর্পণ করি। তারও যে প্রস্তুতি দরকার – মাথা নত করে পেতে শেখা দরকার।
এখানে সোলার লাইটের একটা ব্যবস্থা আছে, কিন্তু আমরা আলো নিভিয়ে বসেছিলাম মুড়িসুড়ি দিয়ে। নীলচে আভার রাতের মাঝে চন্দ্রমা তার তরল আলো লুটিয়ে দিয়েছে বারান্দার ওপর। শালুকেরা চোখ বন্ধ করে ঘুমিয়েছে। আমরা কেবল জেগে জেগে এই গ্রীষ্ম রজনীতে কোজাগরী পালন করি, মায়াময় হালকা চাদর লোকটাক লেকের ওপারে রেখে আসা আমাদের জীবনের দুঃখ-ক্ষতর উপর হাত বোলায়। একে একে চেপে রাখা বিরহ-বিচ্ছেদ-প্রেম-বেদনার কথা বেরিয়ে এসে সামনে দাঁড়ায় – পথের সাথীদের কাছে নিজেকে উজাড় করে মনের আরাম আসে।
পরদিন ভোরে সোনাঝরা রোদ উঠেছে তখন – আমরা ক’জন মহানন্দে আবার ডিঙি নৌকায় চেপে ভেসে পড়লাম। আজ ফেরবার পালা, তার আগে শেষবারের মতো এই জলের উপর ভেসে বেড়ানোর সুযোগটি হাতছাড়া করা যাবে না কিছুতেই। যে মেইতেই মহিলাটি কালকে আমাদের নিয়ে এসেছিল, সেই সামনে বসে দাঁড় টানছিল। ডিঙির পিছনে আরেকজন জোয়ান ছেলেও দাঁড় বাইছিল। দু’জনের কথোপকথনের মধ্যে ‘আতেই’ শব্দটি ঘুরে ফিরে আসছে। মৌসুমীদি দেখি এই সদা হাস্যমুখ মহিলাকে ‘আতেই’ বলেই সম্বোধন করছে, আর তাতে সাড়াও মিলছে। এখানকার মানুষজনের সাদাসিধে জীবনযাত্রায় তাদের আনন্দের পাত্রটি সদাই যেন টইটুম্বুর হয়ে রয়েছে। কিন্তু প্রাণ খুলে যে দুটো কথা কইব, সে উপায় নেই। দু’দিক থেকেই ভাষার দুর্লঙ্ঘ্য ব্যবধান। তাই আমরা নিরন্তর বাংলাই বলছিলাম, আর ওরা মেইতেই-তেই, বাকিটা হাত-পা-মাথা নেড়ে – ইশারায়। বিস্ময়ের কথা এই যে, এরা পুরোনো হিন্দি গান শোনে, জানে ও গাইতে পারে। বলিউডের মহিমা। এই যেমন, আজ সকাল থেকে কে যে ‘আ যা, আই বাহার দিল হ্যায়’ গানটা প্রথম গাইল, কে জানে? তারপর থেকে আমার মাথার মধ্যে গানটা ঘুরে ঘুরে আসছে যাচ্ছে। আতেইও দেখি সেটাই গাইছে। বাক্স গুছিয়ে রওনা দেবার আগে মৌসুমীদি ফুমদির ধারে বসে বাসন মাজছিল যে মেয়েটি, তার সাথে একপ্রস্থ ‘এক দো তিন’ নেচে নিল।
রোদ যাতে না লাগে, সে জন্য বেতের টুপি, টোকা বলে যাকে, সেরকম কয়েকটা ধার দিয়েছিল হোমস্টে থেকে। ডিঙিতে বসে সেগুলো মাথায় দিয়ে দিব্যি টকাটক ক’টা ছবি তোলা হল। আমরা এই ছবি তোলার ভারটা অনীতাদির ওপরই পুরোপুরি দিয়ে দিয়েছিলাম। ফুমদি ছাড়িয়ে আতেই-এর নৌকো চলল বড় জলের দিকে। ধীরে ধীরে ছপাৎ ছপাৎ করে তখনো-না-ফোটা শালুকের দল পেরিয়ে নৌকো ঢুকল পদ্মবনে। এ যেন একের পর এক ধারাবাহিক উপহার। যখনই ভাবি এই বুঝি চূড়ান্ত সুন্দর, এই বুঝি পরাকাষ্ঠা, তখনই সুন্দরতর এসে সবদিক আলো করে দাঁড়ায়।
পদ্মের সময় এখন নয়, কিন্তু কুঁড়ি এসেছে। পাতার মধ্যে জলের ফোঁটা টলমল করছে। ডিঙি এগোলে জলের ওপর মাথা তুলে থাকা পদ্মের কুঁড়ি-পাতা মাথা নিচু করে জলে ডুব দেয় – আমরা পেরিয়ে গেল আবার জল ছাড়িয়ে ওপরে উঠে আসে। ভেসে থাকা পাতার ওপর হলুদ ডানাওয়ালা ছোট্ট পাখি তার নির্ভার শরীর নিয়ে অনায়াসে হেঁটে বেড়ায় – এই পাতা থেকে ওই পাতায় হেঁটে হেঁটে পোকা ধরে, উড়ে যায়, আবার এসে বসে। আমাদের ভয় পায় না মোটেই।
বিচ্ছিন্ন ছোটো ছোটো ফুমদির ধারে ঘাসের মধ্যে দেখি কাঠের খাঁচার মতো রাখা। আতেই বলল, এগুলো মাছ ধরার ফাঁদ। খুব ছোটো কিছু মাছ উঠেছে দেখলাম। তাছাড়া ভাসমান প্লাস্টিকের বোতল আর দড়ি জানান দিচ্ছিল যে, বড় বড় জাল পাতা জলের মধ্যে। জেলেরা দেখলাম সেই সব জাল তুলে তুলে মাছ ধরছে, তাদের ডিঙিতে ভরছে। আমরা কাছ থেকে দেখব বলে আতেইকে বললাম নৌকো সেদিকে নিয়ে যেতে। আতেই নিয়েও গেল। আমাদের চোখে মুখে বিস্ময় দেখে ওরা খুব খুশি, ওদের মধ্যে কলকল করে কত কথা কত হাসি যে বয়ে গেল তার ইয়ত্তা নেই।
এবার ফেরার পালা। আবার সেই জোড়া ডিঙি নৌকো, আবার ফেরা জমির দিকে, যেখানে আমরা শুরুর দিনে অপেক্ষায় ছিলাম দূর জলের দিকে চোখ রেখে। কেমন এক স্তদ্ধতা গ্রাস করছিল। স্বাতী শিস দিয়ে গান করছিল – ‘সায়েদ ফির ইস জনমমে মুলাকাত হো না হো’। এ তো বিশেষ কিছু নয়, তবু তো বিশেষ কিছু। ওইখানে যেন রেখে এলাম নিজ সত্তার খানিকটা। জীবনের মদ আরো কিছু আঁজলা ভরে নিলাম, মৃত্যুকে ঠেকিয়ে রাখার ওষুধ পেলাম। এই যে দিনযাপনের লড়াইয়ে প্রতিনিয়ত মরণকে আমরা জয় করে চলি, সে জয়মালার কিছু ফুল এখান থেকে কুড়িয়ে নিলেম। কাল অনেক রাতে, প্রায় ভোরের দিকে, একা একবার বেরিয়েছিলাম বাঁশের ঘর থেকে। মুখোমুখি হয়েছিলাম পশ্চিমের দিকে ঢলে পড়া গোল চাঁদের। চাঁদের আলোয় নিঃশব্দ পদসঞ্চারের বনবেড়াল ঘাসের আড়ালে লুকোলো। ঘুমন্ত ফুমদি, দূরে দূরে আঁধার পাহাড়ের সারি, জলের ওপর হাওয়া দেয় সিরসিরে। এমনই মদনোৎসবের রাতে মনের মানুষের দিকে বেগুনি রঙের ফুল বাড়িয়ে কেউ হয়ত বলে - ভালোবাসবে আমায়? সে ফুল সে মেয়ে কানে পরে, মদমেদুর চোখে তাকায় প্রেমিকের দিকে। হয়ত আমিও। এ শুনশান পৃথিবীতে, যদি কেউ কখনো না থাকে আমার জন্য, তবু আমি এই প্রেম প্রস্তাবের ফুলের মালা গাঁথি যেন, জীবনকে যেন বলতে পারি – আবার ভালোবাসবে গো আমায়?
[সমাপ্ত]
পরিশেষে দুটি কথা না বললেই নয়। প্রথমত, অপরিচিত অন্য ভাষায় শোনা শব্দের ক্ষেত্রে শ্রবণেন্দ্রিয় সঠিক মাত্রায় পুরোদমে কাজ নাও করতে পারে। গবেষণা করে লেখা শুরু করা যেতেই পারত, কিন্ত মনে হল, তাতে এই মৌতাতটি মাঠে মারা যাবে। দ্বিতীয়ত, যাদের জন্য এত নিশ্চিন্তে, এত আনন্দে, কোনোরকম হ্যাপা না পুইয়ে ঘুরে এলাম তাদের কৃতজ্ঞতা জানাব না, তাই কি হয়? তাই তাদের যোগাযোগঃ মঁ ভয়েজ, স্বাতী রায়, ৯৮৩০২৫৮৭৫০, info.monvoyage.co.in।
পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।