পুত্রের ফাইমোসিস (সুন্নত / খৎনা) অপারেশন হ’ল উনিশশ’ নিরানব্বই এ। উপায় ছিল না অপারেশন ছাড়া। অদ্ভুত লাগে যে এখনকার প্রায় নব্বই শতাংশের বেশি ছেলেদের এ অপারেশন করাতেই হয়। আমাদের সময়ে এসব তো কমন ছিল না। বুঝিনা এর কারণ।
ফিমোসিস (phimosis) হল এমন একটি অবস্থা যেখানে ছেলেদের লিঙ্গের মুখের মসৃণ টিসু দিয়ে তৈরি সামনের চামড়া যা মূত্রনালীর মাংসকে ঢেকে রাখে এবং রক্ষা করে। স্বাভাবিক অবস্থায় এটি লিঙ্গের মুখটিকে ঢেকে রাখলেও উত্তেজিত অবস্থায় এই চামড়াটি খুলে গিয়ে গুটিয়ে যায়। এটি না খুলে গেলে প্রস্রাবের সময় লিঙ্গের মুখটা বেলুনের মতো ফুলে ওঠে। আমাদের মুসলিম সমাজে ছেলেদের এই অংশটিকে কচি বাঁশের তৈরি ছুরি ব্যবহার করে অপারেট (Circumcision) করে দেওয়া হয়। এবং এটা করে থাকেন ওই ধর্মের গ্রাম বা শহরের গুরুরা। একে ‘সুন্নত’ বা ‘খৎনা’ করা বলা হয়ে থাকে। এই মুসলিম সমাজে এই অপারেশনটি যেদিন ধর্মগুরু বা ইমামেরা করে থাকেন সেদিন একসাথে অনেক ছেলেদের এটি কেটে দেন। কিশোর এবং প্রাপ্তবয়স্কদের মধ্যে, এটি উত্থানের সময় ব্যথা হতে পারে, তবে অন্যথায় এটি বেদনাদায়ক নয়।
সাধারণভাবে প্রাপ্তবয়স্ক হওয়ার আগে অনেকেরই ঠিক হয়ে যায়। তবে সেফ রাস্তা হল সাত-আট বছরের মধ্যে এই অপারেশনটি করিয়ে নেওয়া।
যাই হোক উনিশশ’ নিরানব্বইতে আমার ছেলের বয়স সাত বছর। ডাক্তার বিষ্টুবাবু জানালেন যে এবারে এই অপারেশনটা করিয়ে নিলেই ভাল। বল বাহুল্য উনি অনেকবারই নিজে দেখিয়ে দিয়েছিলেন কিভাবে হাত দিয়ে টেনে টেনে ওটাকে ঠিক করে নেওয়া যায়। কিন্তু আমরা পারিনি বাড়িতে সেইভাবে করতে। অগত্যা অপারেশন।
দেখানো হ’ল সেসময়ের এক উজ্জ্বল সার্জন ডাঃ এল চৌধুরীকে। চেম্বারে দেখানো হল তাঁকে। ডাক্তার বিষ্ণুপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়ের লেখা প্রেসক্রিপশন দেখলেন। স্থির হল কয়েকদিন পরেই মধ্য কলকাতার এক চালু নার্সিং হোমে উনি করবেন এই অপারেশন। নার্সিং হোমের খরচ-খরচা বাদে ওনার পারিশ্রমিক ধার্য্য করলেন আট হাজার টাকা। যাই হোক অপারেশন হয়ে গেল। নার্সিং হোমের বিল হ’ল তিন হাজার সত্তর টাকা। এছাড়া ওষুধ।
##
১৯৮০
বছর দুয়েক হ’ল চাকরি পেয়েছি আধা সরকারি সংস্থায়। তখন আমাদের শনিবারেও আধবেলা অফিস করতে হত। এমনই এক শনিবারের বিকেলে বাড়ি ফিরে এসে দেখছি বাবা এঘর ওঘর পায়চারি করছে। সেদিনই বাবার বিকেলের কোলফিল্ড এক্সপ্রেস ধরে ধানবাদ চলে যাওয়ার কথা ছিল। কিন্তু বাবা তখনো বাড়িতে।
মা জানালো বাবার প্রস্রাব হচ্ছে না উলটে একটা ব্যথা তলপেটে। মনে হচ্ছে ধানবাদ যাওয়া হবে না। আমার বাবার সহ্যশক্তি ছিল অসীম। ক্রমশঃ ব্যথা আর অস্বস্তি বাড়তে লাগল। তখনো কলকাতায় এতো মাল্টিস্পেশালিটি হাসপাতাল কোথায় ! ফিল্ম আর্টিস্ট আর বড়লোকেদের জন্য ওই বেলভিউ আর উডল্যাণ্ডস।
আমাদের পারিবারিক ডাক্তার টবিন রোডের ডাঃ কৃষ্ণপদ বসাক, এলএমএফ। টবিন রোডের মোড়ে ওনার চেম্বার সেসময় খুবই ব্যস্ত। মিক্সচার আর পুরিয়ার সহাবস্থানে আমাদের সমস্ত অসুখ মায় টাইফয়েড অব্দি সারতে দেখেছি। বাহন বলতে ডাক্তারবাবুর একটা কালো হারকিউলিস সাইকেল। সামনের হ্যাণ্ডেলে একটা টিনের ক্যারিয়ারে থাকতো সেই ডাউস কালো ব্যাগ। দিনরাত রুগী দেখে বেরাচ্ছেন আমাদের অঞ্চলে। শুনতাম বাড়িতে কাটা, ছেঁড়া, ভাঙা মায় প্রসব অব্দি করিয়ে দিতে পারেন তিনি। আমার ঠাকুর্দার বিকেলের আড্ডাও বসতো ওই চেম্বারেই।
নাটোর থেকে পালিয়ে আসা এই ডাক্তার বসাকই ছিলেন আমাদের ভরসা। এখন ভাবি ডাক্তারবাবুকে তো কখনো জিজ্ঞেস করাই হয়নি নাটোরের কথা। বনলতা সেনের নাম শুনেছেন কিনা ইত্যাদি। তবে ঠাকুর্দার কাছে শুনতাম খেতে খুব ভালবাসতেন তিনি। নিজের হাতেই রোজ বাজার করা একটা প্যাশন ছিল তাঁর। তাঁর ওই চেম্বারের কম্পাউনডার ছিলেন রামকৃষ্ণ’দা। আমাদের আরেক ভরসার মানুষ। চেম্বারে বসে রুগী দেখতেন আর তারপর বি টি রোডের একটা ধূসর দৃষ্টি মেলে রামকৃষ্ণদাকে বলে যেতেন মিক্সচার আর পুরিয়ার কম্পাউণ্ডগুলো। হালখাতার মতো একটা লম্বা খাতায় লিখতেনও - যা বলছেন। আর সেসময় আমাদের বাকির খাতা ছিল ওনার কাছে। মাস গেলে মেটানো হ’ত ওষুধের দাম। চব্বিশ ঘন্টা পাওয়া যেত বিপদে আপদে। এ যে কতোখানি ভরসা ছিলো তা এসময় দাঁড়িয়ে বুঝতে পারি।
আশি সালে আমার ঠাকুর্দা স্বর্গগত। ডাক্তার বসাক কিন্তু আছেন। বিকেলের চেম্বার খুলতেই গিয়ে বললাম বাবার কথা। আধঘন্টার মধ্যেই ছুটে এলেন। বাবার তখন এক কষ্ট আর আতঙ্ক মেশানো ফ্যালফ্যালে মুখচোখ। শুনলেন। দেখলেন। তারপরই আমায় পাঠালেন দোকানে একটা ‘ক্যাথিটার’ কেনার জন্য। তার আগে পর্যন্ত নামই শুনিনি এই বস্তুটির। পরবর্তী কালে বাবার জন্য কতোবার যে কিনতে হয়েছে তার ইয়ত্তাই নেই।
টবিন রোডের মোড়ে ওষুধের দোকান বলতে এক রেঙ্গুন ড্রাগ স্টোর। আমার এক বন্ধু চায়না’দের। আর ডাক্তার বসাক এবং ডাক্তার ব্যোমকেশ বাবুর চেম্বার ছিল ওষুধের খনি।
আমি দোকান থেকে কিনে আনলাম ‘ক্যাথিটার’। খুব সরু নরম প্লাস্টিকের একটা পাইপের মতো। এরপরে ডাক্তারবাবু ওটার থেকে বস্তুটি বার ক’রে বাবার ইউরিনারি পথে লাগিয়ে দিলেন। মুক্ত হ’ল ইউরিন। অস্বস্তি দূর হ’ল কিছুটা।
এরপরে ডাক্তার বসাক সাজেস্ট করলেন কোনো সার্জেনকে দেখাতে। তখনো এতোখানি স্পেশালাইজেশন সেভাবে আমরা জানিও না। অফিসের এক কলীগ দাদা যিনি ছিলেন আমাদের সমস্ত কিছু সাল্টে দেওয়ার কারিগর। তিনি ব্যবস্থা করে ফেললেন। শ্যামবাজারের মণীন্দ্র চন্দ্র নন্দী মহাবিদ্যালয়ের পাশে ছিল ডাক্তার দীপক চন্দের চেম্বার। ওই অবস্থায় নিয়ে গিয়ে দেখানো হ’ল ওনাকে। উনি দেখেশুনে বললেন এক নার্সিং হোমে পরের দিন ভর্তি করে দিতে। অপারেশন করতেই হবে। প্রস্টেট গ্ল্যাণ্ড বেড়ে গিয়ে তখন ওই অবস্থা।
বাবা ভর্তি হলেন ছোড়দি’র নার্সিং হোমে। বাগবাজারে। ওই যে গো, হরিশা হাটের বাড়ির মালিক হ্যারি সাহা’র বাড়ির ঠিক উল্টোদিকে যে গলিটা ঢুকে গেছে সেই গলির মধ্যে একটা ছোট্ট দোতলা বাড়ি। পরিচিতি ছিল কিন্তু ওই ‘ছোড়দি’র নার্সিং হোম নামেই। আসলে ছোড়দি ছিলেন ওই নার্সিং হোমের প্রধান নার্স শুধু নয়, সব কিছুই। খুব মিষ্টি আর অকৃত্রিম ব্যবহারের পরিচয় পেয়েছিলাম সেই ক’দিনে।
বাবার তখন টকটকে লাল ইউরিন হচ্ছে। দেখতে পাচ্ছি ক্যাথিটার ব্যাগে জমা সে ইউরিনের রঙ। সম্ভবত পরের দিন বেলা বারোটা নাগাদ অপারেশন করলেন ডাক্তার দীপক চন্দ। আমি আর আমার বন্ধুরা ছিলাম নিচের রোয়াকে বসে। গলিতে চলছিল ক্রিকেট খেলা।
তখনো প্রস্টেট অপারেশন হত ওপেন সার্জারি করেই। ঘন্টা দুয়েক বাদে ডাক্তার চন্দ নামলেন নিচে। আমায় বসে থাকতে দেখে বলে উঠলেন – ‘কি করছো তুমি ! বাড়ি চলে যাও ! আমরা আছি এখানে সবাই। চিন্তার কিছু নেই। যাও যাও বাড়ি যাও !’ কি দার্ঢ্য সেই গলায়। উনি যখন অপারেশন করেছেন সেহেতু চিন্তার কিচ্ছুটি নেই – এমন ভাব আর কি তাঁর। তারপরেই একটা বাচ্চার হাত থেকে ক্রিকেট ব্যাটটা নিয়েই খেলতে শুরু করে দিলেন। কোনো টেনশনের চিহ্নই নেই চোখেমুখে। ড্রাইভার গাড়িটা নিয়ে এলে ব্যাট ফিরিয়ে দিয়ে চড়ে বসলেন গাড়িতে।
আমার এখনো মনে আছে, এই অপারেশন ফি বাবদ উনি চেয়েছিলেন দুহাজার টাকা। আমার মাস মাইনে তখন সাতশোর আশেপাশে। আমার সেই সর্ববিশারদ দাদা বললেন ওনাকে – ও সবে চাকরিতে ঢুকেছে, এতো টাকা দিতে পারবেই না। আমার দিকে তাকিয়ে ডাক্তার চন্দ আমায় জিজ্ঞেস করলেন – কতো দিতে পারবে ? আমি বললাম দেড় হাজার অব্দি পারবো স্যার। বেশ, তাই দিবি। এক মুহূর্তে চব্বিশ বছরের ছেলেকে আপন করে নিলেন তিনি। পরে নানান ঘটনায় বুঝেছি তিনি রুগীদের কাছে সত্যিই ভগবান।
ওনার সম্ভবত দু-খানা এফআরসিএস ডিগ্রী ছিল। একটা নর্মাল সার্জারির। অন্যটা অর্থোর। পরে জেনেছিলাম উনি আমাদের এই বনহুগলির NIOH (ন্যাশনাল ইন্সটিট্যুট অফ অর্থোপেডিক্যালি হ্যাণ্ডিক্যাপড) হাসপাতালে এ দীর্ঘদিন জড়িয়ে ছিলেন। আমার দেখা ওর চেম্বারের একটা ঘটনা বলি।
বাবাকে দেখাতে নিয়ে গেছি। বসে আছি। ভেতরে যে রোগীর সাথে কথাবার্তা বলছেন তা প্রায় সবই শুনতে পাচ্ছি। একটি মেয়ের পেটের যন্ত্রণা নিয়েই দেখাতে এসেছেন। তার পেটে হাত দিয়ে দেখা হয়ে গেছে। উনি বলছেন গলব্লাডারে স্টোন হয়েছে। অপারেশন করাতেই হবে। রুগীর বাবা সম্ভবত বলছেন একটা সোনোগ্রাফি করানোর কথা হয়তো আরো সিওর হবার জন্যে। ডাক্তার চন্দ বললেন – আপনার পয়সা বেশি থাকলে করাতেই পারেন তবে আমি যা বলেছি তা জেনেবুঝেই বলেছি। সেসময় ওই বারবার যাতায়াতের ফলে শুনেছিলাম যে মেয়েটির স্ক্যান বা সোনোগ্রাফি করিয়েছিলেন ওর বাবা। কিন্তু রেজাল্ট ছিল একই। গলব্লাডারে স্টোন ! ভগবান ছাড়া আর কি-ই বা বলি বলুন তো। এরকম অজস্র ঘটনা শুনতাম সেসময় ডাক্তারবাবুর চেম্বারে আমায় বেশ কয়েকবারই যেতে হয়েছিল বাবার রিপোর্টিং করতে গিয়ে। এছাড়া হাত পা ভাঙাভাঙি ছিল জলভাত ওনার কাছে।
বাবা একদম সেরে গেছিল এই অপারেশনের পরে। কিন্তু ভেতরে ভেতরে ম্যালিগন্যান্সি শুরু হয়ে গেছিল। তখন প্রস্টেটের এতো ওষুধ ছিল না। তাও একটা ট্যাবলেট খেতে দিয়েছিলেন এবং বলেছিলেন সেটা বন্ধ না করতে। যথারীতি মধ্যবিত্তের সংসারে সে ওষুধ খাওয়া বন্ধ হয়েছিল মাস ছয়েক পরেই।
কি কনফিডেন্স দেখেছি ডাক্তার দীপক চন্দের কথাবার্তায়। ডায়াগোনিসিস অব্যর্থ। কোথায় হারিয়ে গেলেন ওনারা ! গরীবের মসীহারা !
……চলবে……পরের পর্বে…
#
©গৌতমদত্ত