৮ই নভেম্বর, ২০১৬, রাত্রি আটটা। এই খণ্ড মুহূর্তটি ভারতবাসী সহজে ভুলবে না। বিনা মেঘে বজ্রপাত প্রবাদবাক্যটির সঠিক অর্থ কী, এই এক মুহূর্তে জেনে ফেলেছিল প্রায় আপামর ভারতবাসী, যখন টেলিভিশনের পর্দায় জাতির উদ্দেশে ভাষণ দিয়ে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী জানালেন, তার চার ঘন্টা পরে, রাত বারোটার পর থেকে বাতিল হয়ে যাচ্ছে তৎকালীন প্রচলিত ১০০০/- ও ৫০০/- টাকার নোট। এসব নোট যার কাছে যা আছে, ব্যাঙ্কে জমা করে ফেলতে হবে পরবর্তী ৭ দিনের মধ্যে (পরে অবশ্য প্রায় পাঁচবার এই সময়সীমা বাড়ানো হয়েছিল)। ভারতের অর্থনৈতিক ইতিহাসে এই ঘটনা "নোটবন্দী" বা "ডিমনিটাইজেশন" নামে চিহ্নিত হয়ে আছে।
এই নোটবন্দীকরণের উদ্দেশ্য কী ছিল, দেশজুড়ে তার প্রতিক্রিয়া কেমন ছিল, পার্শ্ব-প্রতিক্রিয়াই বা কী ছিল, এসবই এখন ভারতবাসী মাত্রেই তো বটেই, পৃথিবীর প্রায় সকলেরই মোটামুটি জানা। তবু হয়তো আলোচনার কারণে সে সব চর্বিত চর্বণ দু’য়েকবার উঠে আসবে। এটিএমের সামনে সেইসব সুদীর্ঘ লাইন, লাইনে দাঁড়িয়ে মৃত্যু, নগদ টাকার হাহাকার, ছোট ব্যবসাদারদের আর্তনাদ, আরও অসংখ্য গল্প এখন এদেশের লোকগাথা হয়ে ছড়িয়ে আছে। কিন্তু আজ আমরা মূলতঃ দেখব, পাঁচ বছর পর, নোটবন্দী আমাদের কী দিল না দিল, সেই ব্যালান্স শিটের হিসেব। আমি অর্থনীতিবিদ নই, কিন্তু অর্থনীতি আর পাঁচজন সাধারণ মানুষের মতই আমার জীবনকেও প্রভাবিত করে। সেই প্রভাবটুকুই দেখার চেষ্টা এখানে- কাজেই এ লেখা আংশিক অ্যানেকডোটালও বটে।
অর্থনীতিবিদরা প্রায় সবাই বলেছেন, পাঁচ বছর পরে অন্ততঃ নিশ্চিতভাবেই বলা যায়, নোটবন্দীকরণ একটি ব্যর্থ পদক্ষেপ, এবং তার প্রভাব ভারতীয় অর্থনীতির বেশ বড়সড় ক্ষতিই করেছে। কারণ ডিমনির ঘোষিত উদ্দেশ্য ছিল দু’টি- কালো টাকা বাজেয়াপ্ত করা আর সন্ত্রাসবাদের কোমর ভাঙা। দু’টোই এখন মোটামুটিভাবে জাতীয় ঠাট্টায় পর্যবসিত। কিন্তু প্রশ্ন জাগে অন্যত্র। একটু অভিজ্ঞতাসম্পন্ন এবং ভক্ত নন, এরকম প্রায় প্রত্যেকেই ঘোষণার কয়েক ঘন্টার মধ্যেই পরিষ্কার বলে দিয়েছিলেন, এই প্রক্রিয়াটি ব্যর্থ হতে বাধ্য, কারণ এর প্রাথমিক ধারণাভিত্তিই (বেসিক অ্যাজাম্পশন) ভুল। এখন প্রধানমন্ত্রী বা অর্থমন্ত্রী বা অন্য মন্ত্রীরা জনপ্রতিনিধি- অর্থনীতির বিশেষজ্ঞ নন- তাদের ভুল ভাবা অসম্ভব নয়- কিন্তু এত বড় একটা রাষ্ট্রীয় পদক্ষেপ তো শুধু তাদের "এক্সপার্টিজ" এর ভরসায় নামিয়ে দেওয়া যায় না- সরকারি বিশেষজ্ঞদেরও ভূমিকা থাকে। সেখানে রিজার্ভ ব্যাঙ্কের গভর্নর সহ দেশের সেরা অর্থনীতিবিদেরা থাকেন। তারা এই ভুল বেসিক অ্যাজাম্পসন নিয়ে এত বড় ব্যাপার নামিয়ে দেবেন, এটা কি খুব স্বাভাবিক ব্যাপার?
কিন্তু তা সত্ত্বেও ডিমনি হয়েছিল, এবং তা ব্যর্থও হয়েছিল, সব আশঙ্কাকে সত্যি প্রমাণ করে। এই হয়ে যাওয়া আমাদের একটিই সিদ্ধান্তে পৌঁছে দেয়- ডিমনি ব্যর্থ হবে জেনেও সরকার বেপরোয়া ভাবেই এই সিদ্ধান্ত আমলাদের ওপর তথা দেশবাসীর ওপর জোর করে চাপিয়ে দিয়েছিল। এবং ডিমনির কারণ যা বলা হয়েছিল, তার অসারতা সরকার জানত - কিন্তু তা সত্ত্বেও সেটি প্রয়োগ করা হয়েছিল কোনো গভীরতর উদ্দেশ্য সিদ্ধ করতে। যে উদ্দেশ্যের পিছনে জনহিত নয়, জনপ্রতিনিধিদের ব্যক্তিগত বা দলগত স্বার্থ জড়িত ছিল। অতএব, সেই উদ্দেশ্যটি কি, সেটা স্পষ্ট হলে তবেই আমরা ঠিকঠাক বুঝতে পারব, ডিমনিটাইজেশন সেই প্রকৃত উদ্দেশ্যের প্রেক্ষিতে কতখানি সফল বা ব্যর্থ, তার দেশজোড়া অভিঘাতই বা আদতে কী এবং কতটা।
নোটবন্দীর প্রথম যে অভিঘাত আমরা প্রত্যক্ষ করেছিলাম, সেটা হল, দেশ জুড়ে নগদের জন্য হাহাকার, নগদের অভাবে স্থানীয় ছোট ছোট দোকান, বাজারের ব্যবসা কার্যত বন্ধ হয়ে যাওয়া, এবং এই সব সামাল দিতে পে টি এম, রু পে র মত বিভিন্ন অনলাইন প্ল্যাটফর্মের রমরমা তৈরি হওয়া। এই অনলাইন প্ল্যাটফর্মগুলি অল্প কিছু সংখ্যক, মূলতঃ শহুরে মানুষ, আগে থেকেই ব্যবহার করতেন। কিন্তু এই সময় থেকে ব্যাপকহারে শহর-মফস্বল-গ্রাম নির্বিশেষে এগুলির ব্যবহার বাড়তে থাকে। শুধু এগুলি ব্যবহার করার উদ্দেশেই বহু মানুষ নতুন করে ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট খুলতে বাধ্য হন (ব্যাঙ্কের সুদ কমা, ব্যাঙ্ক সংযুক্তিকরণ, উঠে যাবার আশঙ্কা, এসব এরপরে ক্রমে ক্রমে আসিবে- সে অন্য প্রসঙ্গ)। এবং সরকারের তরফে সদর্পে ঘোষণা এবং ভক্তদের ঢক্কা-নিনাদিত প্রচার ছিল যে, এইবারে আমরা সম্পূর্ণ ডিজিটাল ইন্ডিয়া হব। পাঁচ বছর পরে আমরা এখন জানি যে, ডিজিটাল ইন্ডিয়া হয়নি। আচ্ছে দিনের মতই, ওটাও জুমলা ছিল।
কিন্তু তবুও, ডিমনি সংক্রান্ত সরকারের যাবতীয় দাবির মধ্যে এই একটি দাবিতেই কিছুটা সততা ছিল বলে মনে হয়। অর্থাৎ সরকার সত্যিই চেয়েছিল, ডিজিটাইজেশন হোক। এই চাওয়ার সাথেও জনস্বার্থের সম্পর্ক নেই, বলাই বাহুল্য- কিন্তু এই চাওয়ায় অন্য কারো স্বার্থ ছিল। যাদের স্বার্থ দেখার জন্য এই সরকার দায়বদ্ধ- ঋণবদ্ধও সম্ভবত- ভারতের উঠতি কর্পোরেট শক্তি (পড়ুন আম্বানি - আদানি - চোকসি প্রমুখ)। আর্থিক লেনদেন সম্পূর্ণ ডিজিটাল হলে, আপনি দিনে ক কাপ চা খান কিম্বা ফুলকপি খেলে আপনার গ্যাস হয় কি না, এই সমস্ত তথ্যই এই সব কর্পোরেটের নখদর্পণে থাকবে। মনে করে দেখতে পারেন, নোটবন্দীর কিছুদিন আগে থেকেই আপনার আধার কার্ড, যাতে আপনার বায়োমেট্রিক্স তথ্য আছে, এই কর্পোরেটদের হাতে চলে এসেছে- সরকারের "ভুলে"। আপনি ভাবতেই পারেন যে আমার আপনার মত অকিঞ্চিৎকর মানুষের তথ্য জেনেই বা এরা করবে টা কি? কিন্তু ভুল ভাবনা। শুধু আমার তথ্য নয়- আমাদের তথ্য। আমরা একশো তিরিশ কোটি। আধুনিক পৃথিবীতে সবথেকে ক্ষমতাশালী অস্ত্র- বিগ ডেটা। এই তথ্যের জন্য কয়েক হাজার বা কয়েক লাখ মানুষ মেরে ফেলতে হলে যে কোনো কর্পোরেট সেটা নির্দ্বিধায় করে ফেলবে। সরকার চালানো মন্ত্রীদের কয়েকশো কোটি দিতে তারা কেনই বা ভাববে?
কাজেই, ডিমনির সাফল্য- ব্যর্থতার আসল মাপকাঠি হবে এই ডিজিটাইজেশনের প্রসারের হিসেব। এই যে রাতারাতি কোটি কোটি নতুন অ্যাকাউন্ট, ইন অ্যাক্টিভ অ্যাকাউন্টের অ্যাক্টিভ হয়ে ওঠা, ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মগুলির রমরমা- এসব শেষ অবধি কতটা টিকল? আমাদের অভিজ্ঞতা কী বলে? আমরা দেখতে পাচ্ছি, অনলাইন লেনদেন আগের থেকে বহুগুণ বেড়েছে নিঃসন্দেহে- কিন্তু একশো তিরিশ কোটির মধ্যে অন্তত ৯০-১০০ কোটি ভারতবাসী এখনো এই লেনদেনের বাইরেই রয়ে গেছেন। নগদের অভাবে নাভিশ্বাস উঠেছে, কেউ আত্মহত্যা করেছেন, কেউ সর্বস্বান্ত হয়েছেন, কারুর পরিবার ধ্বংস হয়ে গেছে- তবুও এক বিরাট সংখ্যক মানুষ এর মধ্যেও বিকল্প লড়াইটা চালিয়ে গেছেন। নিজস্ব ক্ষুদ্র উৎপাদন নির্ভর মানুষ, যেমন ক্ষুদ্র চাষি, খেতমজুর, দিনমজুর, কামার, কুমোর, ছুতোর, কলের মিস্ত্রী, কুয়ো পরিষ্কারের মিস্ত্রী, ক্ষুদ্র তাঁতি, রিক্সাচালক, ভ্যানচালক, ছোট দোকানদার ইত্যাদি অসংখ্য পেশার মানুষ, যারা চাকরি নির্ভর জীবন যাপন করেন না, তারা টিকে আছেন, সব ঝড় ঝাপটা সামলেও। ডিজিটাল না হয়েও। কর্পোরেটের স্বপ্ন পূরণ হতে এখনো দীর্ঘ ব্যবধান।
ডিমনিটাইজেশন নিয়ে ঠাট্টা বা আতঙ্ক বোধ- যাই করি না কেন, এই কথাটা মনে রাখা দরকার যে ডিমনি তার মূল উদ্দেশ্য পূরণে সম্পূর্ণ ব্যর্থ কিন্তু নয়। প্রাথমিক আঘাতে বেশ বড়সড় অভিঘাতই সে ফেলতে পেরেছিল নিঃসন্দেহে। এবং তার ফলে যেটা হয়েছিল, ব্যর্থতা সত্ত্বেও কর্পোরেট এবং তার পোষ্য কেন্দ্রীয় সরকার এটা বুঝে গেছিল যে, এরকম মার মারতে থাকলে এক সময়ে লক্ষ্য পূরণ হবেই। তার ফলে আমরা দেখেছি কর ব্যবস্থার কেন্দ্রীকরণ, ব্যাঙ্ক সংযুক্তিকরণ, বেসরকারি ব্যাঙ্কিং এর গুরুত্ব বৃদ্ধি, সরকারি ব্যাঙ্কে টাকার গ্যারান্টিকে প্রশ্নের মুখে ফেলে দেওয়া, হ্যাল, এয়ার ইন্ডিয়া, বি এস এন এল এর মত লাভজনক সরকারি সংস্থাগুলিকে ক্রমে অলাভজনক ও গুরুত্বহীন করে দিয়ে বেসরকারি হাতে তুলে দেবার ব্যবস্থা করা, শিল্পপতিদের সরকারি ব্যাঙ্কের ঋণ খেলাপকে পরোক্ষে উৎসাহিত করা, কোভিড অতিমারির সুযোগ নিয়ে দীর্ঘায়ত লকডাউন - ইত্যাদি বিবিধ পদক্ষেপ- যেগুলিকে ডিমনির উত্তরসূরি বলা যায়। ভারতের অনুচ্চ-বিত্ত, অ-মধ্যবিত্ত সাধারণ মানুষ এখনো এইসব আঘাত সহ্য করে চলেছেন, টিকে আছেন। কতদিন থাকবেন, আমরা কেউ জানিনা- কর্পোরেট শক্তিও জানে না- কারণ এই প্রতিরোধের ক্ষমতা কতটা, সেই হিসাব আজ অবধি কেউ মেলাতে পারেনি। তাই সামান্য ভরসা টিকে থাকে শেষ পর্যন্ত। সামান্যই, তবু থাকে।