সবাইকে শুভ বিজয়া জানিয়ে লেখাটা শুরু করলাম। এই লেখা চলতে থাকবে।
হিন্দুবাদীরা বলবে, আমি মুসলমানপ্রেমিক। বাংলাদেশ সম্পর্কে আমার নাকি আসলে কোনো ধারণা নেই।
আর ইসলামীরা বলবে, আমি বড্ড বেশি হিন্দু হিন্দু করি। দুর্গাপুজোতে গিয়ে ছবি তুলি। কৃষ্ণচন্দ্র দে আর তাঁর ভাইপোর গাওয়া "জয় সীতাপতি সুন্দর তনু প্রজারঞ্জনকারী" গান শুনলে আমার চোখে জল আসে। পান্নালাল ভট্টাচার্য্যের শ্যামাসংগীত শুনলেও আমি কাজকর্ম ভুলে দাঁড়িয়ে থাকি।
তার ওপর আমি আবার দীর্ঘদিনের ছাপ মারা আরএসএস। যদিও বেরিয়ে এসে "দানবের পেটে দু দশক" নামে বই লিখেছি, তাছাড়া ইংরিজি আসল বইটা তো আছেই, কিন্তু যারা বলবার তারা বলবেই। বিশেষ করে সিপিএম-এর সম্পর্কে আমি অনেক কঠোর সমালোচনা করেছি বলে, এবং সিপিএমের তুলনায় মমতা ব্যানার্জীর সরকারকে বেশি নম্বর দিয়েছি বলে আক্রমণটা তাদের দিক থেকেই বেশি আসে। আর হনুমানদের থেকে অশ্লীল মেসেজ আসে অনেক। খুনের হুমকিও এসেছে দু চার বার।
আরএসএস বিজেপি এবিভিপিতে আমার কৈশোর আর যৌবনের এক দীর্ঘ সময় কাটানো আমার জীবনের এক দুঃসহ লজ্জা। না, মানুষগুলো সবাই খারাপ ছিলোনা। স্নেহশীল দাদা ছিল অনেক, আর বন্ধু ছিল তারও অনেক বেশি। তারা সবাই রক্ত চাই জাতের ছিলোনা। আজকের আরএসএস বিজেপির সঙ্গে সেকালের লোকদের তফাৎ ছিল অনেক। তাদের মধ্যে লোভ, দুর্নীতি, মিথ্যাচার ও অশ্লীলতা আজকের মতো মাথা চাড়া দেয়নি। আমার বাবা ছিলেন তাদেরই একজন।
আমার লজ্জা বাংলায় থেকে রবীন্দ্রনাথ সত্যজিৎ নজরুল বিজ্ঞান শিল্প ভালোবেসে ওদের সঙ্গে এতগুলো বছর নষ্ট করার লজ্জা। একটাই তো জীবন!
জামাত বিএনপি বা উগ্র ধর্মান্ধ মুসলমানদের সঙ্গে আরএসএস বিজেপি বিশ্ব হিন্দুদের আমি প্রচুর মিল খুঁজে পাই। যা তেমন কেউ জানেনা, কারণ তেমন কেউ আরএসএসকে আমার মতো এতো কাছ থেকে দেখেনি। এই মিলগুলো সংক্ষেপে বলা খুব দরকার।
জামাত ইসলামী বা তাদের ছাত্র শিবির বাংলাদেশে আজ যে তাণ্ডব সৃষ্টি করেছে, তা নিয়ে আরএসএস বিজেপি রাজনৈতিক মাইলেজ তুলছে। সামনেই উত্তরপ্রদেশের মেক অর ব্রেক নির্বাচন। এই নির্বাচনে পরাজিত হলে বিজেপির পায়ের তলা থেকে মাটি সরে যাবে। কংগ্রেস, তৃণমূল এবং দলিত ও অব্রাহ্মণ পার্টিগুলো জোট বাঁধছে। পশ্চিমবঙ্গের নির্বাচনে বিজেপি লক্ষ কোটি টাকা খরচ করেও পর্যুদস্ত হয়েছে। সিপিএম'এর বিশাল ভোট পেয়েও বাংলার মাটিতে মার খেয়েছে বিশালভাবেই। এখন এই অর্থনৈতিক ও স্বাস্থসঙ্কটের ব্যর্থতা ঢাকবার জন্যে দরকার ধর্ম ও দাঙ্গার লাইন। হিংসা ও রক্তপাতের লাইন। বাবরি মসজিদ ও গুজরাটের দিনগুলো আবার মনে পড়ে যাচ্ছে।
ওদিকে বাংলাদেশে শেখ হাসিনার নেহেরু বা ইন্দিরা গান্ধী স্টাইলে শক্ত হাতে উগ্র সাম্প্রদায়িক শক্তিকে দমন করে রাখার জন্যে জামাত ও হেফাজত জাতীয় অন্ধকারের জীবেরা খাঁচার মধ্যে ছটফট করছে। ঠিক যেমন আগেকার দিনে জনসঙ্ঘ ও হিন্দু মহাসভা ছটফট করতো। এই খাঁচা থেকে বের হয়ে না আসতে পারলে তাদের মৃত্যু নিশ্চিৎ। ওখানেও আবার একাত্তরের রাজাকার আলবদর আল শামস গণহত্যাকারীদের কথা, আর হাজার হাজার বাঙালি মেয়েদের অবিশ্বাস্য অত্যাচার করার কাহিনী আবার মনে পড়ে যাচ্ছে।
দুই দেশের এসব কথা কল্পকাহিনী নয়। নিদারুণ বাস্তব। মিডিয়া তা আমাদের যতই ভুলে থাকার রেসিপি দিয়ে যাক না কেন। ক্রিকেট, বলিউড, ড্রাগ, ডিভোর্স আর ফ্যাশন দিয়ে যতই তাদের খবরের পাতা ভরিয়ে দিক না কেন।
জামাত এবং আরএসএস একই মধ্যযুগীয় বর্বর কালচারের দুই পিঠ। ধর্মান্ধতা, ঘৃণা, নারীবিদ্বেষ, বিজ্ঞানবিদ্বেষ, প্রাচীনপন্থী জীবনদর্শন।
এদিকে হিন্দি। ওদিকে উর্দু। এদিকে অংবংচং। ওদিকে বোরখা পাঁচ বছর বয়েস থেকে। মাদ্রাসার অতি বাড়বাড়ন্ত। সৌদি প্রভাব।
এদিকে তীব্র মুসলমানবিদ্বেষ। ওদিকে তীব্র হিন্দুবিদ্বেষ।
এদিকে মসজিদ ভাঙা। ওদিকে মন্দির।
__________
ব্রুকলিন, নিউ ইয়র্ক
১৮ই অক্টোবর, ২০২১
পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।