তামিলনাড়ুর ছোট্ট শহর তিরুপাত্তুর। আপাত দৃষ্টিতে বিশ্বের আর পাঁচটা ছোটো শহরের সঙ্গে তেমন কোনো পার্থক্য খুঁজে পাওয়া যাবে না। ২০১০ সাল পর্যন্ত বেশিরভাগ ভারতবাসী হয়তো তেমনভাবে পরিচিতও ছিলেন না এই শহরের সঙ্গে। কিন্তু এরপর থেকেই খবরের শিরোনামে এই শহর। তিরুপাত্তুরকে অন্ধকার থেকে এক লহমায় প্রচারের আলোয় এনে ফেলেছেন যিনি, তিনি এই শহরেরই এক সাধারণ মহিলা।
স্নেহা পার্থিব, পেশায় আইনজীবী। স্নেহার স্বামী পার্থিব রাজা একজন লেখক। নিজের সংসার সামলে রোজ দশটা-পাঁচটার ডিউটি তামিলনাড়ুর কোর্ট, ২০১০ সালের আগে পর্যন্ত এই ছিল স্নেহার রোজনামচা। কিন্তু ২০১০ সালেই এক অভূতপূর্ব কাণ্ড ঘটিয়ে ফেললেন এই আইনজীবী। সেই বছরই সরকারের কাছে স্নেহা আবেদন জানান তাঁকে সম্পূর্ণভাবে জাতি-ধর্মহীন নাগরিক ঘোষণা করার জন্য। যদিও তার বহু পূর্বেই লড়াইয়ের বীজ বপন হয়ে গেছে স্নেহার অন্তরে। সেই লড়াইয়ের অন্যতম শরিক ছিলেন তার মা-বাবাও। সেই লড়াইয়ের হদিশ পেতে গেলে আমাদের পিছিয়ে যেতে হবে আরও কয়েক বছর।
স্নেহার বাবার নাম আনন্দকৃষ্ণ, মা মনিমাঝি। তারা ছিলেন চেন্নাই ল কলেজের সহপাঠী। ল কলেজে পড়াশোনার সূত্রেই দুজনের আলাপ পরিচয়। অতঃপর! আসতে আসতে কাছে এলো বসন্তদিন। মনিমাঝির প্রেমে পড়লেন আনন্দকৃষ্ণ। এই সময় থেকেই ধীরে ধীরে কমিউনিজমের প্রতি আকৃষ্ট হয়ে পড়েন মনিমাঝি এবং আনন্দকৃষ্ণ উভয়েই। জীবন বইতে শুরু করল ভিন্নখাতে, জীবনকে দেখার দৃষ্টিকোণ গেল পাল্টে। মার্কস আর ফ্রয়েডের তত্ত্ব সবসময়ই ভাবাত ল কলেজের এই দুই সহপাঠীকে। একসময় সামাজিক নিয়মে বিবাহ - বন্ধনে আবদ্ধ হলেন তারা। সংসারের দায়বদ্ধতায় আবদ্ধ হয়ে পড়লেও লড়াইয়ের ময়দান ছেড়ে পিছু হটেননি এই দুই সহযোদ্ধা বরং লড়াইয়ের শিকড় পৌঁছে যায় মণিমাঝি আর আনন্দকৃষ্ণর মেয়ে স্নেহার মধ্যেও। তবে তারও আগে মনিমাঝি আর আনন্দকৃষ্ণ ঘটিয়ে ফেলেছেন আরও এক আশ্চর্য কর্মকাণ্ড। তাদের তিন মেয়ের নাম রেখেছেন যথাক্রমে - স্নেহা জেনিফার এবং মমতাজ। অর্থাৎ সর্বধর্মের মেলবন্ধনের এক অভূতপূর্ব নিদর্শন।
এরপর আর পিছনে ফিরে তাকাতে হয়নি তামিলনাড়ুর এই মধ্যবিত্ত পরিবারটিকে। এমনকি স্নেহার স্কুল,কলেজের প্রতিটি কাস্ট অথবা রিলিজিয়নের কলাম ফাঁকা এমনই অভিজ্ঞতা হয়েছে সরকারি আধিকারিকদেরও। অর্থ্যাৎ শৈশব থেকেই একপ্রকার জাতি-ধর্ম-বর্ণের তোয়াক্কা করেননি স্নেহা। স্নেহাও এখন তিন সন্তানের মা,তাদের নাম রাখার ক্ষেত্রেও মণিমাঝির দৃষ্টান্ত অনুসরণ করেছেন তিনি। স্নেহার তিন সন্তানের নাম রাখা হয়েছে অধিরাই, অধীলা এবং আরিফা জেসি - অর্থাৎ আবার সর্বধর্মের সমন্বয়। এই তিন সন্তানের নামের মধ্য দিয়ে স্নেহা যেমন তার লড়াকু মানসিকতা ছড়িয়ে দিয়েছেন নব প্রজন্মের মধ্যে তেমনি আরও একবার ধর্মের সমস্ত বেড়াজালকে যেনো হেলায় ভেঙে ফেলেছেন তিনি।
যদিও তামিলনাড়ুর ছোট্ট শহর তিরুপাত্তুর থেকে এই যুদ্ধটা মোটেই সহজ ছিল না। ২০১০ সালে নিজেকে জাতি-ধর্মহীন ঘোষণা করার আবেদনের কিছুদিনের মধ্যে সেই আবেদন খারিজও হয়ে যায়। কিন্তু স্নেহা তাঁর লক্ষ্য থেকে একচুলও বিচ্যুত হননি। আবারও ২০১৭ সালে আবেদন করেন স্নেহা, স্পষ্ট করেন তাঁর প্রকৃত অবস্থান। এমনকি সরকারকে এও জানান, তাঁর ৩৫ বছরের জীবনে জাতি-ধর্মকেন্দ্রিক কোনো সুযোগ-সুবিধা তিনি গ্রহণ করেননি। হার-না-মানা লড়াইয়ে শেষ পর্যন্ত ২০১৯ সালের ৫ ফেব্রুয়ারি জয়লাভ করেন স্নেহা। সরকার থেকে তাঁকে স্বীকৃতি দেওয়া হয় ভারতের প্রথম জাতি-ধর্মহীন মানুষ হিসেবে।
পুলিশ কাস্টডিতে অমানুষিক অত্যাচারের ফলে নিহত স্নেহলতার নামে নাম রাখা হয় স্নেহার। সে মেয়ে যে হার-না-মানা যোদ্ধা হবে সে তো জানা কথা। ‘ধর্মনিরপেক্ষ’ ভারত যখন ধর্মীয় হিংসার আগুন দেখতে অভ্যস্ত হয়ে উঠেছে, স্নেহা পার্থিব নিঃসন্দেহে সেই অন্ধকার ভারতের বুকে একটি উজ্জ্বল আলোকশিখা। যে আজও নির্ভয়ে বলতে পারে - 'হাল ছেড়োনা বন্ধু...।"
তথ্যসূত্র - বর্তমান পত্রিকা - ১৬ সেপ্টেম্বর ২০২০
পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।