ভারতের মোট জনসংখ্যার প্রায় ৯ শতাংশ মানুষ কোনো না কোনোভাবে সাইকেল ব্যবহার করেন। অর্থাৎ সংখ্যাটা নেহাৎ কম নয়। ইউরোপের বহু দেশের জনসংখ্যার চেয়েও বেশি। কিন্তু এই পরিমাণ সংখ্যা কি আমাদের দেশে সাইকেলের প্রাধান্যকে চিহ্নিত করে? না, ব্যাপারটা ঠিক এরকম নয়। বিপুল সংখ্যক মানুষ, নিত্য প্রয়োজনে, বিপদে-আপদে, কর্মস্থলে, হাসপাতালে, ব্যবসা-বানিজ্যে প্রতিদিন প্রায় বিনা খরচে, একবিন্দু দূষণ না ছড়িয়ে সাইকেল ব্যবহার করলেও, আমাদের পরিবহন ও নগরনীতি প্রণয়নে তার প্রতিফলন নেই, আর্থ-সামাজিক স্বীকৃতি নেই। কদর নেই সংস্কৃতিতেও। অর্থাৎ সারা পৃথিবীতে ইদানিং যে ‘বাইসাইকেল-কালচার’ কথাটি শোনা যায় – সামান্য কিছু ব্যতিক্রম ছাড়া তার বাস্তব অস্তিত্ব আমাদের দেশের প্রায় কোনো শহরেই নেই। ‘বাইসাইকেল-কালচার’ মানে নারী-পুরুষ নির্বিশেষে, বিভিন্ন বয়সের ও সামাজিক অবস্থানের মানুষ শহরের ছোটো ছোটো দূরত্বগুলি সাইকেল নিয়ে অবাধে ও নিরাপদে যাতায়াত করবেন প্রশাসনের প্রত্যক্ষ উৎসাহ ও সমর্থনে। বড় শহরে মোটরযানের পাশাপাশি সাইকেলের জন্য আলাদা পথ ও পরিকাঠামো থাকবে। নগরপরিবহন ব্যবস্থায় সাইকেল অন্যান্য যানবাহনের সমান গুরুত্ব তো পাবেই। বরং দূষণবিহীন, জ্বালানি-নিরপেক্ষ যান হওয়ার কারণে পাবে একটু অগ্রাধিকার।
আজ বিশ্ব সাইকেল দিবস। ২০১৮ সালে রাষ্ট্রসংঘ ঘোষিত এই দিনটি উদযাপনের সঙ্কল্পপত্রে কিন্তু শুধুমাত্র পরিবেশ-সংরক্ষণ, স্বাস্থ্য বা সাশ্রয়ের কথাই বলা হয়নি। বলা হয়েছিল আরো বেশি সাইকেলের ব্যবহার বাড়াতে পারে নাগরিক সহনশীলতা, সামাজিক ও মানবিক যোগাযোগ। আজকের পৃথিবীতে দাঁড়িয়ে সাইকেল প্রকৃত অর্থেই বিশ্বজনীন শান্তির বার্তা বহন করে। তবে এই ঘোষণা শুধুমাত্র ভিত্তিহীন ইউটোপিয়া নয়। সাইকেল বা অন্যান্য অ-মোটরচালিত যানবাহন ও পথচারীদের নিয়ে কাজ করা নগর ও পরিবহন পরিকল্পনাবিদরা বিগত প্রায় কয়েক দশক ধরে এই ব্যবস্থার স্বপক্ষে মত দিয়ে আসছেন। ভারতের মতো তৃতীয় বিশ্বের দেশে সাইকেল পরিকাঠামো ও প্রশাসনিক মান্যতা শহরের পরিবহন ব্যবস্থায় সমতা আনতে পারে। সেইসঙ্গে শহরের রাস্তাঘাট হয়ে উঠতে পারে নিরাপদ, কমতে পারে দুর্ঘটনার প্রবণতা। ২০১৩ সালের সমীক্ষা অনুযায়ী, ভারতে ছোট বা বড় শহরের মোট যাতায়াতের আশি শতাংশই তিন কিলোমিটারের কম ও সত্তর শতাংশ দশ কিলোমিটারের কম। এই ছোটো দূরত্বের যাতায়াতগুলিই সাইকেলের পক্ষে আদর্শ। আধুনিক নগরবিদ্যায় যে পরিবহনকেন্দ্রিক উন্নয়নের কথা বলা হয় – অর্থাৎ আবাসিক অঞ্চলের সঙ্গে নিকট দূরত্বের কর্মক্ষেত্র ও বানিজ্যকেন্দ্রের পরিকল্পনা – স্বাভাবিকভাবেই কলকাতা বা অন্যান্য শহরে তার অস্তিত্ব রয়েছে। আলাদা করে বানাতে হয় নি। তাই ইউরোপের বহু শহরের মতো সাইকেল-কেন্দ্রিক পরিবহনের সুযোগ নিশ্চিতভাবে রয়েছে কলকাতার ক্ষেত্রেও। অভিজাত আলিপুর থেকে পার্ক স্ট্রিটের দূরত্ব মাত্র ৬ কিলোমিটার। পার্কস্ট্রীট থেকে লালবাজার বা বিবাদী বাগ ৫ কিলোমিটারেরও কম। সাইকেলে এই দূরত্ব যেতে সময় লাগে বড়জোর ২৫ মিনিট থেকে আধঘন্টা। সঠিক পরিকাঠামো থাকলে সবার জন্যই উপভোগ্য হয়ে উঠতে পারে এইসব ছোটো দূরত্বের সাইকেল-রাইড। কার্বন নিঃসরণ শূণ্য। একটি রিপোর্ট অনুযায়ী নেদারল্যান্ডসের মানুষ গাড়ি বাদ দিয়ে যে পরিমাণ সাইকেল চালান ও তার ফলে যে পরিমাণ কার্বন ডাই-অক্সাইড নির্গমন কম হয়, তা কোনো একটি বছরে সাড়ে পাঁচ কোটি বৃক্ষরোপনের সমতুল্য। আমাদের শহরেও রোজকার সাইকেল-আরোহীর সংখ্যা কম নয়। নানারকম প্রতিকূলতার মধ্যেও ২০১১ সালের জনগণনা অনুসারে কলকাতা শহরের প্রায় ১০% যাতায়াত হত সাইকেলে। সাইকেল চালান, আমাদের গ্রাম, মফস্বলের কোটি কোটি মানুষ। কার্বন-এমিশন প্রতিরোধে এই ভূমিকাও কম নয়। কিন্তু আমাদের সংস্কৃতি একে ইন্ধন দেয় না। বরং সংস্কৃতিকে বহুদিন ধরে পরোক্ষে নিয়ন্ত্রণ করে মোটরগাড়ি-কেন্দ্রিক অর্থনীতি বা বানিজ্য ও বিপণন নীতি।
উল্টোদিকে আমরা যদি প্রথম বিশ্বের একদম সামনের সারির শহরগুলোর দিকে তাকাই, তাহলে দেখবো প্রত্যেকটি শহরের অভ্যন্তরীণ যাতায়াতে সাইকেলের অগ্রাধিকার। হাঁটাচলা ও সাইকেলকে গুরুত্ব দেওয়ার পাশাপাশি, গাড়ির ব্যবহার কমিয়ে গণপরিবহনে জোর দেওয়া ও গণ-পরিবহনের সঙ্গে সাইকেল-নেটওয়ার্ককে সংযুক্ত করা। যার মানে অনেক বেশি খোলামেলা, প্রাণবন্ত, নিরাপদ ও বাসযোগ্য শহর। আমস্টারডাম বা কোপেনহেগেনের মতো ইউরোপের অন্তত কিছু শহরের প্রশাসন সেই সাত বা আটের দশকেই এটা বুঝেছিলেন যে, এই পরিবহণ নীতি সামাজিক ও অর্থনৈতিক ন্যায়ের পক্ষে অনুকূল হবে। কিন্তু শহরের বিপুল সংখ্যক মানুষের সাইকেল-নির্ভরতা স্বত্তেও আমরা এইধরণের নীতি এখনও প্রয়োগ করতে পারছি না কেন? অন্যান্য অনেক কারণের পাশাপাশি সম্ভবত সিদ্ধান্ত প্রণেতাদের মধ্যে একটা অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তার বোধ কাজ করে। গাড়ি-কেন্দ্রিক শিল্পনীতি, জ্বালানির আমাদানি, পার্কিং ব্যবস্থা, রাস্তাঘাট, ফ্লাইওভার – ইত্যাদি মিলিয়ে যে স্বল্পমেয়াদী অর্থনীতির বুনোট ও ক্ষমতার বৃত্ত তৈরি হয়েছে – তাকেই তাঁরা স্থিতাবস্থা হিসেবে ধরে নেন। সাইকেল কিন্তু সরাসরি বিকল্প ও দীর্ঘস্থায়ী অর্থনীতির সন্ধান দেয়। ২০১৮ সালের একটি গবেষণায় বলা হয়েছিল ভারতের বড় বড় শহরের যাতায়াতের গড় দূরত্ব ৮ কিলোমিটারের কম (কলকাতার ক্ষেত্রে তা ৫-৬ কিলোমিটারেরও কম)। এর অর্ধেকও যদি মোটরচালিত যানবাহনের পরিবর্তে সাইকেলের মাধ্যমে যাতায়াত শুরু হয় - তবে এক বছরে দেশের মানুষের সাশ্রয় হতে পারে ১৮ লক্ষ কোটি টাকা। যা ভারতের ২০১৫ -১৬ আর্থিক বছরের ১.৬% জিডিপির সমান। সাম্প্রতিক সময়ে ‘বাইকনমিক্স’ বলে একটি চর্চার কথা শোনা যাচ্ছে। যাতে বলা হচ্ছে একটি গাড়ি কিনে, একজন যদি যাতায়াত করেন শহরের রাস্তায়, অনেকটা রোডস্পেস নেওয়া বা দূষণজনিত প্রত্যক্ষ প্রভাবের পাশাপাশি সমাজের প্রতিটি মানুষকে তার জন্য বহন করতে হয় প্রচুর পরিমাণ মাথাপিছু সরকারি খরচ, যা আদতে তাঁর প্রদত্ত করের চেয়ে অনেকাংশে বেশি।
নেদারল্যান্ডসের প্রধানমন্ত্রী মার্ক রুট। পার্লামেন্ট এবং তাঁর অফিসে নিয়মিত সাইকেল চালিয়ে যাতায়াত করেন।
রাষ্ট্রসংঘ বা বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতো আন্তর্জাতিক সংস্থার পাশাপাশি আমাদের দেশের জাতীয় পরিবহন-নীতিসহ কেন্দ্র বা রাজ্যনিয়ন্ত্রিত সংস্থার বিভিন্ন সুপারিশে বারবার সাইকেলকে গুরুত্ব দেওয়ার কথা থাকলেও বিড়ালের গলায় ঘন্টাটি এখনও বাঁধা যাচ্ছে না। কোভিড-পরবর্তী সময়, যখন বিশেষভাবে আমাদের সাইকেলমুখী করেছে – শহরে সাইকেলের পক্ষে পদক্ষেপ নেওয়ার এটাই সঠিক ও সুনির্দিষ্ট সময়। শহর বদলালে বদলাবে পৃথিবী। রাষ্ট্র বা প্রশাসনের বাইরে যে বৃহত্তর পৃথিবী ও সমাজ – যে সমাজ ধনী-দরিদ্র, নারী-পুরুষ বিভিন্নভাবে বিভক্ত ও বিপন্ন, যে পৃথিবী উষ্ণায়ণ ও জলবায়ু পরিবর্তনে জর্জরিত – সাইকেল তাতে কিছুটা মুক্তির হাওয়া আনুক।
করোনাক্রান্তিতে এপারে গণপরিবহন এড়াতে নারী-পুরুষের মধ্যে বেশ জনপ্রিয় হয়ে দাঁড়িয়েছে সাইকেল। চায়নিজ সাইকেল সেই পাকিস্তান আমল থেকেই জনপ্রিয়, হালে ভারতীয় “হিরো” মিলছে। আর দেশি দুটি কোম্পানি “আরএফএল” ও “মাগুরা গ্রুপ”ও বেশ উন্নত সাইকেল তৈরি করছে।
ঢাকায় নোমান নামে এক তরুণ উদ্যোক্তার হাতে তৈরি সাইকেল রীতিমত হইচই ফেলে দিয়েছেন। তার তৈরি সাইকেল বিদেশেও রপ্তানি হচ্ছে।
আশার কথা, তরুণ সমাজের একটি বিশাল অংশ লুফে নিয়েছে এই দুচাকার বাহন। তাদের নিজস্ব বিভিন্ন ক্লাব তৈরি হয়েছে। অনলাইনেও সাইকেল কেনাবেচার জমজমাট বাজার গড়ে উঠেছে। মাত্র চার-পাঁচ হাজার টাকাতেই এখন ভাল মানের পুরনো একটি সাইকেল কেনা সম্ভব।
আর সেদিন ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের মেয়র একটি সংক্ষিপ্ত সাইকেল লেনের উদ্বোধনও করলেন।
নগরজুড়ে সাইকেল লেন এখন সময়ের দাবি।
ভাবনাটিকে উস্কে দেওয়ার জন্য লেখককে ধন্যবাদ।
জয়তু দ্বিচক্রযান!
সমস্যার মূলে যেতে হলে কারণ খুঁজতে হবে উন্নয়ন প্রক্রিয়ার অসমতার গভীরে। সব জায়গায় অর্থনৈতিক সুযোগসুবিধা যদি সমানভাবে না থাকে, তাহলে মানুষকে নানা প্রয়োজনে দূরদূরান্তে যেতে হয়।
দিল্লী শহরে কাজের জন্য ২৫-৩০ কিলোমিটার একেক দিকে যাওয়া আসা করেন বহু মানুষ।প্রতিদিন গুরগাঁও দিল্লী নয়ডা এই তিন রাজ্যব্যাপী যাতায়াত অপরিচিত নয়।
স্কুল ভর্তির জন্য ৮ কিলোমিটার নীতি কার্যকরী হয় নি কারণ সব এলাকার স্কুলের মান সমান নয়।
একই অবস্হা স্বাস্হ্য পরিকাঠামোর ক্ষেত্রেও।
অতএব উন্নত বিশ্বে যা সহজ, তা উননয়নশীল ও জনবহুল ভারতবর্ষে সহজ নয়। কলকাতা ছোট শহর। দিল্লী কিংবা মুম্বাই শহরের সমস্যা অন্য মাত্রায় , আয়তন এবং কাজকর্ম দুই ভাবেই।
বৃত্তাকার শহর একটি নতুন ধারণা যেখানে জীবনযাপনের সবকিছু ৪ কিলোমিটারের মধ্যে থাকবে। তেমন হলে তবেই মানুষের যাতায়াতোর প্রয়োজন কমবে , সাইকেলে চলতে পারবে সকলে। কোভিডের পরিপ্রেক্ষিতে এই আলোচনাটি আরো জরুরী হয়েছিল।সমাধান খুঁজতে হবে সেখানেই।