২০০৬ সালের ২১ সেপ্টেম্বর লালগড় থানার ঝিটকার জঙ্গলে ল্যান্ডমাইন বিস্ফোরণের তাজা ক্ষত সবে শুকিয়েছে। সেই বছরের নভেম্বর মাসের ১২ তারিখ, বিকেল চারটে নাগাদ আমার ইমিডিয়েট ‘বস’ পুলকেশ ঘোষের ফোন! তাঁর নির্দেশ, আমাকে পশ্চিম মেদিনীপুর থেকে বদলি করা হয়েছে পূর্ব মেদিনীপুরে।
কেন আচমকা মাসের মাঝখানে আমাকে ওই জেলার দায়িত্ব? উত্তরে পুলকেশদার একটাই কথা, ‘এটা বরুণবাবুর (বরুণ সেনগুপ্ত) নির্দেশ। তোমাকে ওই জেলায় চটজলদি যেতে হবে। নন্দীগ্রাম বলে একটা ব্লক আছে, সেখানে নাকি জমি নেওয়া হবে, তা নিয়ে ভবিষ্যতে বড় আন্দোলন হতে পারে। তাই এখন থেকে তা নজর রাখতে হবে।’
পুলকেশদার কাছ থেকে নির্দেশ পেয়ে একটু আধটু খোঁজখবর করে জানতে পারলাম, সিঙ্গুরে জমি আন্দোলন তখন তুঙ্গে, নন্দীগ্রামেও জমি নেওয়া হবে বাম মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের সাধের কেমিক্যাল হাব গড়ার জন্য। বিষয়টি তখনও সেভাবে কোনও সংবাদমাধ্যমে আসেনি। তলে তলে নাকি হলদিয়ার বেতাজ বাদশা লক্ষ্মণ শেঠের সঙ্গে বুদ্ধবাবু সালিম গোষ্ঠীদের হাতে জমি তুলে দেওয়ার কাজ চালিয়ে যাচ্ছেন। এর বেশি কোনও তথ্য আর পাচ্ছিলাম না। কিন্তু বসের নির্দেশে আমাকে যেতেই হবে পূর্ব মেদিনীপুর জেলায়। হাতে সময় দেওয়া হয়েছে মাত্র চারদিন। অগ্যতা পরদিন মেদিনীপুরে বর্তমানের ক্যামেরাম্যান, আমার সব সময়ের সঙ্গী দেবনাথ মাইতিকে নিয়ে মাথা গোঁজার ঠাঁই খুঁজতে রওনা হই পূর্ব মেদিনীপুরের জেলাসদর শহর তমলুকে। সঙ্গে অবশ্যই ছিল দেবনাথের সেই বিখ্যাত বাইক। ওই বাইকে চেপেই ফেব্রুয়ারি থেকে নভেম্বর, আমার ন’ মাসের মেদিনীপুর জেলায় কাজ করা। ঝিটকার জঙ্গলে সেই বাইকে চেপেই গিয়েছিলাম।
মূল কথায় আসা যাক, এই ভূমিকা দেওয়ার কোনও দরকার ছিল না! আসলে নন্দীগ্রাম আন্দোলন নিয়ে অনেক বোদ্ধা, অনেক সংবাদপত্র প্রচুর কিছু ফাটিয়ে বেড়ায় তো, তাই বাংলার অন্যতম সংবাদপত্র বর্তমান যে এই আন্দোলনের অনেক আগে থেকেই নন্দীগ্রামের কথা তুলে ধরেছিল, সেটা অনেকেরই অজানা। তার উপর শিল্পের পক্ষে থাকা আনন্দবাজারের ঘন ঘন ভোল বদলও হয়েছে এই নন্দীগ্রাম আন্দোলন সম্পর্কে। আনন্দবাজারের সেই পালটি খাওয়ার কথায়ও পরে আসছি।
১৪ মার্চ পুলিশের গুলি চালনার কথায় আসার আগে পাঠকদের জেনে নেওয়া দরকার কেন সেদিন গুলি চলেছিল। তার উৎস কোথায়? তখনও নন্দীগ্রামের জমি অধিগ্রহণের বিষয়টি সংবাদমাধ্যমে আসেনি। ১৮ নভেম্বর বর্তমানের পূর্ব মেদিনীপুর জেলার দায়িত্ব নিয়ে কাজ শুরু করি। নতুন জেলা, তেমন কাউকে চিনি না জানিও না। জেলার ভূগোলও প্রায় অজানা। তবে ২০০৬ সালের বিধানসভা ভোটের কভার করতে গিয়ে দু’-একজনের সঙ্গে পরিচয় হয়েছিল। তাতেই ভর করে কাজ শুরু। পরদিন ২০ নভেম্বর ওই জেলায় বর্তমানের চিত্র সাংবাদিক পার্থপ্রতিম দাস, মহিষাদলের সুমন মণ্ডলসহ আরও দু’-একজন সাংবাদিককে নিয়ে নন্দীগ্রামটা দেখতে গিয়েছিলাম। তবে সেদিন হলদিয়া হয়ে ঢুকেছিলাম। হলদিয়ার ঘাটে গাড়ি রেখে লঞ্চে করে নন্দীগ্রামের কেন্দেমারি ঘাটে গিয়ে পৌঁছয়। আগে থেকে স্থানীয় এসইউসিআইয়ের নেতাদের বলা ছিল আমাদের যাওয়ার কথা। কারণ, তখন একমাত্র এসইউসিআই নন্দীগ্রামের জমি না দেওয়ার আন্দোলন সংগঠিত করছিল। আর তাদের সঙ্গে আলাদা করে এই আন্দোলন সংগঠিত করছিল সিদ্দিকুল্লা চৌধুরির জমিয়তে উলামায়ে হিন্দ।
যাই হোক, বিকেল সাড়ে চারটে নাগাদ আমরা ওপারে কেন্দেমারি ঘাটে পৌঁছয়। সেখানে তখন এসইউসিআইয়ের ভবানী দাস সহ কয়েকজন অপেক্ষা করছিলেন আমাদের জন্য। আমাদের কথা মতো তাঁরা সেখানে একটি মশাল মিছিলও করেন। সেই মিছিলে ছিল হাতে গোনা মাত্র সাতজন। পরদিন বর্তমান পত্রিকা সেই ছবিও ছেপেছিল।
সেদিনই ভবানী দাসের সঙ্গে পরিচয়। তিনি সবার অলক্ষ্যে আমার হাতে তুলে দিয়েছিলেন এক মোক্ষম অস্ত্র! তেমন কিছুই নয়। হলদিয়া ডেভেলপমেন্ট অথরিটি থেকে বের করে আনা সেই তথ্য। যাতে এইচডিএ-র চিফ এক্সিকিউটিভ অফিসারের স্বাক্ষর করা সেই নথি। সেখানে উল্লেখ করা হয়েছে নন্দীগ্রাম ব্লকের ৯০টি মৌজার মধ্যে ৪৫টি মৌজার জমি কেমিক্যাল হাব গড়তে তুলে দেওয়া হচ্ছে সালিম গোষ্ঠীর হাতে। রাজ্য সরকারের কাছে পাঠানো সেই নথিতে উল্লেখ ছিল কোন কোন মৌজার কোন দাগ নম্বরে কত জমি অধিগ্রহণ করা হচ্ছে। একজন সাংবাদিকের কাছে এটা তখন একটা বড় হাতিয়ার আগামী বেশ কয়েকদিন ধরে ফলোআপ চালিয়ে যাওয়ার জন্য। হাতছাড়া করিনি। পরদিন সেই তথ্য সহ বর্তমানের প্রথম পাতার পেটে সবুজ তালিকা করে তা ছাপা হয়।
সেই শুরু নন্দীগ্রামের কথা রোজ বর্তমানের পাতায় তুলে ধরা। প্রতিদিন একটি করে নতুন অ্যাঙ্গেলে সংবাদ ছাপা হচ্ছে, অন্যদিকে নন্দীগ্রামে জোরদার হচ্ছে জমি না দেওয়ার আন্দোলন। এমনকি তখনকার শাসক সিপিআইয়ের স্থানীয় বিধায়ক ইলিয়াস মহম্মদও রাজ্য সরকারের বিরুদ্ধে মুখ খুলতে শুরু করেছেন। দিন যত এগোচ্ছে, তপ্ত হতে থাকে নন্দীগ্রামের মাটি। এর মধ্যে এই আন্দোলনে নিজেকে জড়িয়ে নেন তৃণমূল কংগ্রেসের সদ্য উঠতি নেতা শুভেন্দু অধিকারী। প্রায় দিন তিনি নন্দীগ্রামে যাচ্ছেন, সভা-সমাবেশ করছেন। মানুষের সঙ্গে মিশে যাচ্ছেন, আর পরদিন বর্তমানের পাতায় ফলাও করে সংবাদ প্রকাশ হচ্ছে।
এর মধ্যে একদিন রাতে সিদ্দিকুল্লার সংগঠনের এক নেতা, পেশায় আইনজীবী একটি নথি তুলে দিয়েছিলেন। যা নন্দীগ্রামের আন্দোলনে এক ভিন্নমাত্রা যোগ করে। সিদ্দিকুল্লাদের সংগঠন প্রস্তাবিত অধিগৃহীত জমি সমীক্ষা করে জানতে পারে, ৪৫টি মৌজার প্রায় ৩৮ হাজার হেক্টর জমি সালিম গোষ্ঠীর হাতে তুলে দেওয়ার জন্য ছোট-বড় ১২২টি মসজিদ-মন্দির ধ্বংস করতে হবে। বর্তমান পত্রিকায় এই প্রতিবেদনটি প্রথম পাতার অ্যাঙ্কারে ৬ কলাম জুড়ে ছাপা হয়েছিল।
নভেম্বর-ডিসেম্বর মাস জুড়েই তলে তলে আন্দোলন সংগঠিত হচ্ছিল নন্দীগ্রামে। ৩০ ডিসেম্বর নন্দীগ্রামে জমি অধিগ্রহণ হবে, এই সংক্রান্ত সভা করছিলেন তখনকার দোর্দণ্ডপ্রতাপ সিপিএম নেতা লক্ষ্মণ শেঠ। সেই সভা থেকেই জমি না দেওয়ার প্রতিবাদের শ্লোগান উঠেছিল। কিন্তু, তাতে তিনি কোনও আমল দেননি। ভেবেছিলেন এতদিন যেভাবে জেলার মানুষ তাঁর কথায় উঠেছেন-বসেছেন। নন্দীগ্রামের জমিও তিনি সেই ভাবেই অধিগ্রহণ করবেন। কিন্তু, মানুষ যে তলে তলে ফুঁসছেন তা তিনি ঘুণাক্ষরেও বুঝতে পারেননি। আর যা হয়, ২০০৭ সালের ২ জানুয়ারি সকালের বর্তমানে ছাপা হল, ‘আজ ৩ জানুয়ারি নন্দীগ্রামে জমি অধিগ্রহণের নোটিশ ঝোলাবে হলদিয়া ডেভেলপমেন্ট অথিরিটি’। নন্দীগ্রামের মানুষ সেই নোটিশ দেখার জন্য অপেক্ষা করছিলেন সিপিএমের একদা গড় গড়চক্রবেড়িয়া গ্রাম পঞ্চায়েত অফিসের সামনে।
বেলা তখন একটা-দেড়টা হবে। আমার স্ত্রীর ১০২ জ্বর। তমলুকে থাকি। খবর এল নন্দীগ্রামে পুলিশ গুলি চালিয়েছে। এর প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই বর্তমানের বর্ধমান অফিস থেকে পুলকেশদার ফোন। ওনাকে বললাম নন্দীগ্রামে গুলির খবরটা। আমাকে উনি বললেন, এখুনি বেরিয়ে যাও। আমি আমার স্ত্রীর প্রচণ্ড জ্বরের কথাটা বললাম। এটাও বললাম গোটা ঘটনাটা আমি তমলুক থেকে করে দিতে পারব। পুলকেশদার একটাই কথা… “দেখি তোমার চাকরি কী করে থাকে।” বলেই ল্যান্ডফোনটা খটাস করে রেখে দিলেন। সংবাদমাধ্যমের চাকরি, কোনও দিন স্থায়ী হয় না। অগ্যতা হাড় কাঁপানো ওই শীতে বেরিয়ে পড়লাম নন্দীগ্রামের দিকে। একটা অ্যাম্বাসাডর ভাড়া করে আমি, কলকাতা টিভির পাবক সাহু, কাজল মাইতি আর এনই বাংলার শুভময় জানার সঙ্গে রওনা দিলাম নন্দীগ্রাম। ঘটনাস্থল গড়চক্রবেড়িয়াতে গিয়ে দেখলাম নভেম্বর থেকে জানুয়ারি, নন্দীগ্রামের আন্দোলনটা বেশ একটা বড় জায়গায় পৌঁছে গিয়েছে। দেখলাম উত্তেজিত মানুষ কীভাবে পুলিশকে খেদিয়েছে নিজেদের বাস্তুভিটা রক্ষা করার জন্য। পুলিশ-প্রশাসনের ঢোকা আটকাতে চারপাশে রাস্তাঘাট কেটে দেওয়া হয়েছে। রাস্তার উপর ফেলে রাখা হয়েছে বড় বড় গাছের গুঁড়ি। রাস্তায় হাজার হাজার মানুষ। গোটা এলাকা ঘুরে অফিসে যখন ফোনে শেষ খবরটা ধরালাম, তখন রাত সাড়ে দশটা বাজে। পুলকেশদা বললেন, আজকের মতো তমলুকে ফিরে যাও নাকি? এলাকার পরিস্থিতি দেখে ওনাকে বললাম, না আমি যাচ্ছি না, কাল সকালে তো আবার আসতেই হবে।
সেই ৩ জানুয়ারি নন্দীগ্রামে গিয়ে ২২ দিন পর তমলুকে ফিরেছিলাম। সেখানেই থাকার ব্যবস্থা করেছিলাম, একটা ঘরভাড়া নিয়ে। শীতের রাত, তাই পলাশ নামে স্থানীয় একটি ছেলে ডেকরেটর থেকে তোশক-লেপ ভাড়ায় জোগাড় করে দিয়েছিল। আমি-পাবক টানা ওই ঘরেই কাটিয়েছিলাম। সেই ৩ জানুয়ারিতে এলাকায় পুলিশের ঢোকা বন্ধ হল। আর কোনওভাবেই পুলিশ নন্দীগ্রামে ঢুকতে পারেনি। এদিকে এই ভূমি-মাটি দখলের আন্দোলন চলে গিয়েছিল অবাম-অতিবামদের নিয়ন্ত্রণে। অবাধ আন্দোলন-সভা-সমিতি হলেও, পুলিশ তার কিছুই জানতে পারেনি। শুধু আঁচই করতে পারছিল। এরই মধ্যে ঘটে যায় ৭ জানুয়ারি ভাঙাবেড়া ব্রিজে জমি আন্দোলনকারীদের সঙ্গে খেজুরিতে ঘাঁটি করা সিপিএম কর্মীদের লড়াই। সেই গোলাগুলির লড়াইয়ে সেখ সেলিম সহ নন্দীগ্রামের তিন কিশোর-যুবকের মৃত্যু হয়। তালপাটি খাল থেকে তুলে আনা সেলিমের বাঁশে বেঁধে আনা ছবিটা আজও চোখের সামনে ভাসে। এই ঘটনার পর ৭ জানুয়ারিতে নন্দীগ্রাম এতিমখানায় বসে গঠিত হয় ‘নন্দীগ্রাম ভূমি উচ্ছেদ প্রতিরোধ কমিটি’। তার আগে এই আন্দোলন হচ্ছিল অসংগঠিতভাবে।
শুধুমাত্র সিপিএম নেতা লক্ষ্মণ শেঠের কিছু ভুল পদক্ষেপের জন্যই নন্দীগ্রামে মানুষ ক্ষিপ্ত হয়ে উঠেছিলেন। আর নন্দীগ্রামের এই আন্দোলন ছত্রভঙ্গ করতে এবং নন্দীগ্রামে আইনের শাসন কায়েম করতেই ১৪ মার্চ পুলিশকে সংগঠিতভাবে গুলি চালাতে হয়েছিল। যে ভুলের মাশুল গত ১০ বছর ধরে দিতে হচ্ছে বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য-বিমান বসু-সূর্যকান্ত মিশ্র-বিনয় কোঙারদের।