ইছামতী নদীর ধারে বাংলাদেশের যশোর জেলার এক বেনামি গ্রাম—গোগা। একটি ছেলে তার বাবা-মাকে ছেড়ে সেখানে সেজোজ্যাঠার ঘরে শৈশবকে সঙ্গে এবং সাঙ্গ করে কিশোর হচ্ছিল। রোজদিনের সন্ধেগুলো তার সঙ্গে জড়িয়ে যেত রূপকথার আদলে। রান্নাঘরে উনানের ধারে বসে সেজো জেঠিমার গল্প বলার সহজ-সরল ঢং যখন রচে দিত এক অদ্ভুতুড়ে জগৎ, হ্যারিকেনের আলতো আলোয় সে জগতে রূপকথার আলেয়ায় দেখা যেত— ছেলেটির মন জেগে রয়েছে অপার কৌতূহল নিয়ে। অচিরেই সজাগ শিশুটি টের পেল, কখন যেন শরৎ চাটুজ্জে তার অন্তর্জগৎ অধিকার করে নিয়েছেন এক অদ্ভুত ভালোলাগায়! গল্পবাজ পড়শি সত্যকাকার মুখে শ্রীকান্ত-ইন্দ্রনাথদের গল্প শুনতে শুনতে ছেলেটির হৃদয়ে বোনা হয়ে যাচ্ছিল গল্পবীজ। গোগ্রাসে রবীন্দ্রনাথ-শরৎচন্দ্রের গল্প পড়ার নেশা ছেলেটিকে গল্প পড়তে উৎসাহী করে তুলেছিল। ছেলেটির জীবনের গল্প গড়িয়ে যাওয়ার আগে যে কথাটি বলে নেওয়া জরুরি, ছেলেটি রমানাথ রায়। আর সে কারণেই তাঁর জীবনের গল্প এভাবে বলে ফেলার নয়। বলতে ভালোই লাগছিল, হয়তো শুনতেও। ভালোলাগার এই চলতি ধরন তাঁর পছন্দ ছিল না মোটে। গল্পের ঘাড়ে নিজেকে চাপিয়ে দিতে গিয়ে তিনি বুঝেছিলেন—‘এক যে ছিল রাজা’ কিংবা কাহিনি সর্বস্ব আর যে-কোনো ভুলচুক গাল্পিকতা সে সময়ের সঙ্গে বড্ড বেমানান। আসলে শিশুকালে শোনা রূপকথার রূপকে নয়, খটখটে বাস্তবটাকে রমানাথ দেখে ফেলেছিলেন চোখের নাগালে। ফ্যান্টাসি আর ফ্যানভাতের দুনিয়ায় দ্যাখনদারি তাই তিনি মিলিয়ে দিতে চাইলেন গল্পের চালে। গল্প বলার প্রচলিত রীতিটিকে নাকচ করে দিয়ে রমানাথ চাইলেন—অন্য কিছু, অন্য রকম!
‘মহাদিগন্ত’ সাহিত্যপত্রে (ডিসেম্বর’৮২/জানুয়ারি’৮৩) ‘আমার কথা’ শীর্ষক রচনায় রমানাথ রায় লিখেছেন—“সাহিত্যিক হব বলে আমি কোনোদিন সাহিত্য করিনি। সাহিত্য আমার কাছে শুধু বেঁচে থাকার একমাত্র আশ্রয় নয়, জীবনযুদ্ধে টিকে থাকারও একমাত্র অস্ত্র। তাই কৈশোর থেকে সাহিত্য ছাড়া অন্য কাউকে আমার সঙ্গী করিনি। আজও প্রতিদিনে, প্রতি মুহূর্ত পার হচ্ছে সাহিত্যকে কেন্দ্র করেই। সাহিত্য ছাড়া অন্য কিছু আমি ভাবি না, ভাবতে আনন্দও পাই না। ধার্মিকের কাছে যেমন ঈশ্বর, আমার কাছে তেমনি সাহিত্য। সাহিত্য না থাকলে আমার জীবন দুর্বহ হয়ে উঠত। আমাকে হয়তো আত্মবিনাশের কোনো পথ বেছে নিতে হত।”(পৃ-৯) সাহিত্যকেই জীবনযুদ্ধে টিকে থাকার অস্ত্র শানিয়েও রমানাথ গল্পের ভুরিভোজে পাঠকের মন-পসন্দ গল্প জোগান দিয়ে সাহিত্যিকের মনোনয়ন পেতে চাইলেন না। নিজের মধ্যেই যখন বাস্তব-অবাস্তব, সত্য-মিথ্যা, স্বপ্ন-কল্পনার কনসেপ্ট ব্রাউনিয়ন মোশনে ঘুরতে থাকল, তখন জেলে-কৃষক-শ্রমিক-ধোপা-নাপিত-বেশ্যা প্রমুখ কল্লোলের কেঁচো খুঁড়লেন না, নিজেই হয়ে উঠতে চাইলেন অফুরান বিষয়! সাহিত্যের কেন্দ্রে স্থাপন করলেন নিজেকে, নিজের মধ্যে দিয়েই বের করে নিয়ে এলেন সমসময়ের মানুষের সমস্যা ও সংকট। লেখার সময় রমানাথের ‘ব্যক্তি আমি’ হয়ে উঠল ‘সর্বজনীন আমি’। বাংলা সাহত্যের গতানুগতিক রাজপথ এড়িয়ে রমানাথ নির্মাণ করলেন এক নতুন পথ।
সচেতন ভাবে রমানাথ রায় সাহিত্য চর্চা শুরু করেন ১৯৬২-৬৩ নাগাদ। নিজের গড়া পৃথিবীর স্বপ্ন-আবিল পরিবেশের বাইরে যে আর একটা পৃথিবী রয়েছে, তার সঙ্গে তখন বনিবনা হচ্ছিল না রমানাথের। অন্তরাত্মার অনুভবে তিনি একা হয়ে যাচ্ছিলেন ক্রমশ। একাকিত্বের অসহ্য ভার নিয়েই সাহিত্য রচনার মধ্যে দিয়ে তিনি মুক্তি খুঁজছিলেন। ১৯৬৪-তে প্রকাশিত হয়েছিল তাঁর প্রথম গল্প-সংকলন—‘ক্ষত ও অন্যান্য গল্প’। তিনি বুঝে গেছিলেন বেঁচে থাকতে গেলে বাস্তবের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে বাস্তবকেই পরিহাস করতে হবে। রমানাথ উপলব্ধি করেছিলেন দুঃখের হাতে একটা অসহায় দুর্বল প্রাণীর মতো বেঁচে থেকে লাভ নেই; দুঃখের মুখোমুখি দাঁড়ানো প্রয়োজন। তাই সমস্ত রকম সামাজিক-রাজনৈতিক-আর্থিক ও আত্মিক বিপর্যয়ের মধ্যেই পরিহাস বা কৌতুকের অস্ত্রের আশ্রয়ে দুঃখের ধারকে ভোঁতা করে দিয়ে রমানাথ বেঁচে থাকতে চেয়েছেন। সাহিত্যকেই অবরুদ্ধ আবেগ প্রকাশের মাধ্যম করেছেন তিনি।
১৯৬২-র এপ্রিলে দলবদ্ধ ভাবে রমানাথ ‘এই দশক’ নামের একটি বুলেটিন প্রকাশ করেছিলেন। ১৯৬৪ পর্যন্ত যার মোট ন-টি সংখ্যা বের হয়েছিল রমানাথ রায়ের সম্পাদনায়। প্রতিটি সংখ্যায় রমানাথ রায় প্রথামুক্ত চিন্তার প্রকাশ ঘটিয়েছিলেন। ‘এই দশক’ বুলেটিন বন্ধ হয়ে গিয়ে ১৯৬৬-র মার্চে শাস্ত্রবিরোধী ছোটো গল্প আন্দোলনের মুখপত্র রূপে ‘এই দশক’ পত্রিকা প্রকাশিত হলে সেখানেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন রমানাথ। ‘এই দশক’ পত্রিকার ২৪টি সংখ্যার প্রায় প্রতিটিতেই রমানাথ স্বমহিমায় উপস্থিত থেকেছেন। শাস্ত্রবিরোধী গল্প লিখেছেন, আন্দোলনের আদর্শ সম্বলিত প্রবন্ধ লিখেছেন, পাঠকের প্রশ্নের উত্তর দিয়েছেন। আর সব ক্ষেত্রেই দেখা গেছে সাহিত্যের সমস্ত গতানুগতিকতাকে সমূলে উৎখাত করতে চেয়েছেন রমানাথ রায়। কাহিনি, চরিত্র কিংবা স্থান-কাল-পাত্রের পরম্পরা এসব কিছুকে বাদ দিয়ে গল্পকে করে তুলতে চেয়েছিলেন গল্পকারের স্বাধীন বিচরণক্ষেত্র। ‘এই দশক’ পত্রিকার পঞ্চম সংকলনে (অগ্রহায়ণ, ১৩৭৮) রমানাথ রায় ‘খোলা চোখ এবং শাস্ত্রবিরোধী সাহিত্য’ শীর্ষক প্রবন্ধের মধ্যে তুলে ধরেছিলেন শাস্ত্রবিরোধী আন্দোলনের দশটি নীতি। নীতিগুলি পুরাতন সাহিত্যের অসাড়তার প্রতি যেমন দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চেয়েছে, পাশাপাশি শাস্ত্রবিরোধী সাহিত্য নির্মাণের রূপরেখা নির্দিষ্ট করে দিয়েছে।
“না আর গল্প নয়, গল্প বলতে পারব না”—‘এই দশক’ পত্রিকার ষষ্ঠ সংখ্যায় রমানাথের ‘কথা’ গল্পের প্রথম বাক্য এটি। আবার এই বাক্যটিকেই রমানাথ রায়ের সমগ্র সাহিত্যের/সাহিত্য সৃষ্টির মূল কথা বলা যায়। একাশি বছরের জীবনে, প্রায় ষাট বছরের নিরন্তর সাহিত্য সাধনায় পাঠকের ক্ষুন্নিবৃত্তির তেমন কোনো ব্যবস্থাই করেননি তিনি। অথচ তিন শতাধিক ছোটো গল্প, প্রায় পনেরোটি উপন্যাস এবং বেশ কিছু মননশীল প্রবন্ধে বাংলা সাহিত্যকে সমৃদ্ধ করেছেন তিনি। কাহিনিলোভী পাঠককে পরিতৃপ্তি দিতে পারে না রমানাথের গল্প-উপন্যাস। ‘বলার আছে’, ‘গোগা’, ‘কোকো’ কিংবা ‘গিলিগিলি’, ‘তক্তপোশ’, ‘লোলা বিয়ার খায়’-এর মতো অজস্র গল্পে, ‘ছবির সঙ্গে দেখা’, ‘ভালোবাসা চাই’, ‘মাননীয় মুখ্যমন্ত্রী’ প্রভৃতি প্রায় প্রতিটি উপন্যাসে তিনি বেছে নিয়েছেন ভিন্ন ভিন্ন বলার ধরন। অনেক সময় শব্দের বা বাক্যবন্ধের পুনরাবৃত্তিতে ধরতে চেয়েছেন দিন যাপনের ক্লান্তি। হামেশাই অর্থহীন চরিত্র নাম ব্যবহার করে আসলে তিনি গুরুত্ব দিতে চেয়েছেন চরিত্রগুলির অন্তরধর্মে এবং সেই সূত্রেই তাদের বিশিষ্ট করে তুলেছেন। প্রচলিত সাহিত্যের গোঁড়ামি, সংস্কার কিংবা অবশ্য-পালনীয় নিয়মগুলি থেকে বেরিয়ে এসে লেখার ক্ষেত্রে স্বাধীনতা উপভোগ করেছেন। অঁদ্রে ব্রেতোর মতোই স্বপ্ন-বাস্তবের ভেদরেখা মুছে দিয়ে সাহিত্যের মধ্যে তুলে ধরতে চেয়েছেন প্রকৃত বাস্তবতা বা স্যুররিয়ালিটিকে। কাফ্কার মতো করে খুঁজে নিতে চেয়েছেন ব্যক্তি মানুষের বিক্ষত আত্মানুসন্ধানের চালচিত্র। আত্মপ্রকাশের সঠিক পথ আবিষ্কারের জন্য রমানাথ বেছে নিয়েছেন বেদনাদায়ক, অন্তহীন এক অদ্ভুত ফর্ম। আবার ফর্মকেই কখনও বিষয় বানিয়ে তুলেছেন জয়েসের ঢঙে। আমৃত্যু তিনি প্রথাগত সাহিত্যের বিরোধিতা করেছেন। প্রতিষ্ঠা বা প্রতিষ্ঠানের তোয়াক্কা না করে বাণিজ্যিক কাগজের পাশাপাশি বরাবর লিখে গেছেন লিটিল-ম্যাগাজিনে। গোষ্ঠীবদ্ধ সাহিত্য আন্দোলনগুলি সময়ের নিয়মে যখন থেমে গেছে, গভীরতর অন্বেষণে রমানাথ চলে গেছেন রূপান্তরের পথে। সাহিত্যের ইতিহাসের স্বাভাবিক ছন্দে তাঁর লেখা জীবনেও পালাবদল ঘটেছে। কিন্তু কখনও তাঁর সাহিত্যিক মতাদর্শ থেকে সরে আসেননি রমানাথ।
সাহিত্যের এই একনিষ্ঠ সৈনিক বাংলা সাহিত্যকে পৌঁছে দিয়ে গেছেন এক নতুন ভবিষ্যতে।
স্বীকার করি, তার নাম শোনা হলেও এপারে তার বইপত্র কিছুই পড়া হয়নি। তবে কিছু বই পড়ে ফেলবো নিশ্চয়ই।
এই গুণী মানুষ সম্পর্কে আরও জেনে ভাল লাগলো।
সৌম্যর এই লেখাটি খুব সংংক্ষেপে খুব সুন্দর ভাবে রমানাথ রায়ের সাহিত্য ও জীবনকে তুলে ধরেছে। রমানাথ বাবুর প্রাবন্ধিক সত্ত্বার উল্লেখ থাকলে আরও ভালো লাগত। আন্তরিক ধন্যবাদ লেখককে।