এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • বুলবুলভাজা  আলোচনা  রাজনীতি  বুলবুলভাজা

  • ওরা ১০৩২৩

    তন্ময় দে
    আলোচনা | রাজনীতি | ২৬ মার্চ ২০২১ | ৩০০০ বার পঠিত
  • ১০৩২৩। দেখলে একটা সংখ্যা মনে হয় বটে, কিন্তু আদপে তা নয়। অন্তত ত্রিপুরার মানুষের কাছে। আর যদি ত্রিপুরার কোনও শিক্ষক এ সংখ্যা দেখেন, তখন তাঁর মনে হবে একটা আন্দোলনের কথা, রক্তস্রোত ও মৃত্যুর কথা, বর্বরতার কথা। এই নিবন্ধ সেই ইতিহাসের লিপি।

    উত্তম কুমার দে, ত্রিপুরা রাজ্যের গ্রামপাহাড়ের অজ-গাঁয়ের হতদরিদ্র পরিবারের এক ছাত্র। জীবনে কোনদিনও গৃহশিক্ষকের কাছে পড়ার ক্ষমতা হয়নি। তথাপি নিজ প্রচেষ্টায় জীবনের যোগ্যতা নির্ণয়ের তিন-তিনটি পরীক্ষায় প্রথম স্থান অধিকার করে ১৯৯৬ সালে স্নাতক হন। এরপর পরিবারের হাল ধরতে বিকল্প না থাকায় গৃহশিক্ষকতার কাজে করে পরিবার প্রতিপালন করতে থাকএন। এর মধ্যে রাজ্য শিক্ষা দপ্তরের বিজ্ঞপ্তি মূলে ২০০২, ২০০৬, ২০০৯ সালে তিন তিন বার ইন্টারভিউ দিয়ে সেই মোতাবেক যোগ্য বলে বিবেচিত হওয়ায় ২০১০ সালের ৩১ শে মার্চ স্নাতক শিক্ষক হিসেবে শিক্ষা দপ্তর থেকে অফার পান এবং ২০১০ সালের ২১ শে মে চাকরিতে যোগদান করেন। নিয়োগস্থল ছিল বাড়ি থেকে বহুদূরে। এর পর, হঠাৎ করে ২০১৪ সালের ৭ই মে সংবাদমাধ্যমে জানতে পারেন তাদের বিপক্ষে কে বা কারা মামলা করেছে ফলে ত্রিপুরা উচ্চ আদালত তাদের চাকরি নাকচ করেছে।

    বিশ্বজিত দাস, বাড়ি অমরপুর- অভাবের সংসারে চাকরিটা আশীর্বাদের মত এসেছিল। ৫ বছর বাঁধামাইনেতে চাকরি করার পর বেতন নিয়মিত হতেই সংসারে স্থিরতা এল। বাড়ির অভিভাবকের কথা মেনে বিয়েটাও সেরে নিলেন। সংসার বড় হল, নিশ্চয়তার জীবনে আগামীর স্বপ্ন দেখা যখন শুরু করছিলেন ঠিক তখনই নেমে এল বিপর্যয়। ২০১৪-য় চাকরি যাওয়ার সংবাদে বিপর্যস্ত, কিন্তু সরকারের আশ্বাসে কিছুটা হলেও আশায় ছিলেন। এর মধ্যে ত্রিপুরায় রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের স্রোতে গা ভাসালেন আগামীর আশায়। ভাবলেন কেন্দ্রের এতবড় নেতামন্ত্রীরা যখন বলছেন তো কিছু একটা হবে। সংসার চালানো দুষ্কর হয়ে আসছিল। কিন্তু ২০১৮ সালে সরকার পরিবর্তন হতেই এক অন্য চিত্র। কোথায় প্রতিশ্রুতি? কোথায় কী? পেটে ভাত নেই কিন্তু চোয়াল শক্ত করে নামলেন আন্দোলনে। একের পর এক ৫৮টা রাত্রি কাটালেন আগরতলার রাজপথে চাকরির দাবিতে। এরপর এলো এক কালো সকাল। বিপ্লব দেবের পুলিশের কাঁদানে গ্যাসের শেল আর নির্মম লাঠির আঘাতে লুটিয়ে পড়লেন রাজপথে। আহত হয়ে হাসপাতাল থেকে ছাড়া পেয়ে শরীর সারলেও অভাব ছাড়লো না। সমাজ থেকে একরাশ অভিমান ও আত্মগ্লানি নিয়ে গত ৪ মার্চ ২০২১ এ নিজ বাড়ীতে আত্মহত্যার পথ বেছে নেন তিনি।

    উত্তম কুমার সাহা, চাকরিচ্যুত ১০৩২৩ শিক্ষকের একজন। চাকরি যাওয়ার পর অভাবে ছিলেন, তদুপরি ওঁর ৬ বছরের অসুস্থ ছেলের চিকিৎসা করানোর জন্য দ্বারে দ্বারে ঘুরতে হয়েছিল। ঋণ-ধার করেও কোনও রকম চালিয়ে গিয়েছেন ছেলের চিকিৎসা। কিন্তু শেষরক্ষা হল না। গত ১১ই মার্চ সকাল ৬ টায় মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়লো উনার প্রাণপ্রিয় পুত্র।

    এরকম হাজারো উদাহরণ আছে। লিখতে বসলে লেখক ও পাঠক- উভয় পক্ষ ধৈর্য হারাবেন। ২০১৮ থেকে ২০২১ এর ফেব্রুয়ারি মাস অবধি কমপক্ষে ৮৫ জন শুধু আত্মহত্যাই করেছেন। ৩৮ লাখ জনসংখ্যার ছোট্ট এই রাজ্য ত্রিপুরায় সরকারি চাকরিরত কর্মীর সংখ্যা দেড় লাখের মত। প্রান্তীয় ও দূরবর্তী রাজ্য হওয়ার ফলে বেসরকারি সংস্থা এখানে প্রায় নেই বললেই চলে। ছোট ব্যবসা আর সরকারি চাকরি ত্রিপুরায় উপার্জনের মূল দুটি পন্থা। সে হিসেব ধরলে প্রায় ৬ লক্ষ মানুষ এই সরকারি চাকরির উপার্জনের উপর সরাসরি নির্ভরশীল। সেখানে ১০৩২৩ পরিবারের প্রায় ৫০ হাজারেরও বেশি মানুষ আজ অর্থনৈতিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত। যাঁরা ব্যংক থেকে ঋণ নিয়েছেন তাঁদের নোটিস ধরানো হয়েছে, একাউন্ট ফ্রিজ করে দেওয়া হয়েছে। গড় হিসেবে ধরলে তাঁদের বয়স ৪৫ থেকে ৫০ এর মধ্যে, অর্থাৎ নতুন করে আবার জীবিকা শুরু করার সামর্থ ও চালিকাশক্তি – কোনটাই আর তাদের মধ্যে নেই। কেউ ইট ভাঙছেন, কেই মাছ বিক্রি করছেন, কেউ সবজি বিক্রি তো কেউ পানের দোকান দিয়ে সংসার চালাচ্ছেন। অভাব এদের এতই তাড়না করে বেড়াচ্ছে যে বৃদ্ধ বাবামায়ের চিকিৎসা বা পুত্র-কন্যার পড়াশোনাও চালাতে গিয়ে হিমসিম খাচ্ছেন প্রৌড়ত্বের পথে পা বাড়ানো ঐ ১০৩২৩।

    কিন্তু এটা হওয়ার কথা ছিল না। মসনদে থাকা তৎকালীন বাম শাসিত রাজ্য সরকার ও শিক্ষা দপ্তর সূত্রে জানানো হয়েছিল যে তাদের চিন্তার কোন কারণ নেই, সরকার তাদের হয়ে সুপ্রিম কোর্টে যাবে এবং তাদের চাকরি সুরক্ষিত থাকবে। সেই মোতাবেক তৎকালীন সরকার সুপ্রিম কোর্টে যায় এবং দীর্ঘ শুনানির পর ২৯শে মার্চ ২০১৭ এ সুপ্রিম কোর্ট হাইকোর্টের রায়কেই মান্যতা দেয় এবং চূড়ান্ত রায় প্রদান করে যে ৩১শে ডিসেম্বর ২০১৭ সেই সকল শিক্ষকের চাকরি খারিজ হবে। তারপর তৎকালীন সরকার ত্রিপুরার শিক্ষাব্যবস্থা অটুট রাখার জন্য এই চাকুরিচ্যুত শিক্ষকদের আরো এক বছর শিক্ষক পদে রাখতে সুপ্রিম কোর্টে আপিল করে। সেই আপিল এর পরিপেক্ষিতে মাননীয় সুপ্রিম কোর্ট চাকুরিচ্যুত শিক্ষক দের ৩০ জুন ২০১৮ পর্যন্ত ad-hoc হিসাবে নিযুক্তি দেওয়ার পরামর্শ দেয়। সেই হিসাবে রাজ্য শিক্ষা দপ্তর ২৭শে ডিসেম্বর ২০১৭ টার্মিনেসন লেটার দেয় এবং পয়লা জানুয়ারি ২০১৮ থেকে Ad-hoc হিসাবে নিযুক্তি দেয়। এর পর তৎকালীন বাম সরকার এই চাকুরিচ্যুত শিক্ষকদের বিকল্প নিযুক্তির কথা ভেবে শিক্ষাদপ্তরে অশিক্ষক পদে প্রায় ১৪ হাজার শূন্যপদ সৃষ্টি করে। তৎকালীন শিক্ষামন্ত্রী তপন চক্রবর্তী বলেন যে যারা চাকরিচ্যুত হয়েছেন তারা ত্রিপুরারই সন্তান, তাদের বিকল্প কর্মসংস্থানের দায় সরকারেই। কিন্তু নিয়োগের আগেই ফের আইনি বেড়াজালে জড়িয়ে যায় এই সিদ্ধান্তটি। এরই মধ্যে ২০১৮ ইং রাজ্য বিধানসভা নির্বাচনের প্ৰস্তুতি শুরু হয় এবং তৎকালীন প্রধান বিরোধী দল বিজেপি (বর্তমান সরকার পক্ষ) এই মর্মে ঘোষণা করে তারা যদি নির্বাচিত সরকার গঠন করে তবে এই চাকুরিচ্যুতদের চাকরির স্থায়ী সমাধান করবে এবং তা ভিসন ডকুমেন্টও তা প্রকাশ করে। বিজেপি নেতা সম্মেলন করে এও ঘোষণা দেন যে তারা যদি এই সমস্যার স্থায়ী সমাধান করতে না পারেন তাহলে জনগন যেন ২০১৯ এ লোকসভা নির্বাচনে বিজেপি কে ভোট না দেন। কিন্তু ক্ষমতায় আসার পর ১৮০ ডিগ্রি ঘুরে ২০১৮ সালে বিপ্লব দেবের নেতৃত্বাধীন বিজেপির নবঘটিত সরকার চাকুরিচ্যুতদের সমস্যা নিয়ে সব উদ্যোগ বানচাল করে। পুরনো চাকরি তো বহাল হয়ই না। আবার পূর্ববর্তী সরকার যে ১৪ হাজার অশিক্ষক শূন্যপদ সৃষ্টি করেছিল তাও বাতিল করে দেয়। তবে তারা শিক্ষক স্বল্পতার কারণে ও শিক্ষা ব্যবস্থাকে টিকিয়ে রাখার জন্য পূর্ববর্তী সরকারের মত ২৩ শে জুন ২০১৮ সুপ্রিম কোর্টে আবেদন জানায় এই ad-hoc শিক্ষকদের আরো দুবছর বহাল রাখতে। সেই মোতাবেক ০১-১১-২০১৮ তারিখ সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতি এই ad-hoc শিক্ষকদের ২০২০ সালের ৩১শে মার্চ পর্যন্ত স্বপদে বহাল রাখার অনুমোদন দেন। ইতি মধ্যে TET এর মাধ্যমে কিছু সংখ্যক Ad-hoc শিক্ষক টেট শিক্ষক পদে চাকরি পান এবং বাঁধা-বেতনে নিযুক্ত হন। কিন্তু ০৭ মে ২০১৪ ত্রিপুরা হাই কোর্টের মাননীয় প্রধান বিচারপতি দীপক গুপ্তার রায়ের 125 প্যারায় উল্লেখ করেন যে “………it is further made clear that if the persons who are selected in the previous selection are again selected than the service rendered by them earlier shall ne counted for the purpose of seniority pension and another purpose” কিন্তু শিক্ষা দপ্তর তা না মানায় সেই শিক্ষকরা হাই কোর্টে আবেদন জানায় এবং গত ২১-০১-২০১৯ মাননীয় হাই কোর্ট শিক্ষকদের পক্ষে রায় দেন ও সমস্ত সুবিধা দেওয়ার আদেশ প্রদান করেন রাজ্য সরকারকে । অপরদিকে মাননীয় দীপক গুপ্তার রায়ের 127 প্যারায় উল্লেখ ছিল ” since we have set aside the revised employment policy which applies to a large category of posts and not merely to teachers , we would like to make it clear that our judgment shall be prospective in nature and shall not effect the appointments already made unless the said appointment are already under Challenge before the court on the ground that the employment policy is illegal ” কিন্তু কোন এক অজানা কারণে ২০১০ ও ২০১৪ সালে শিক্ষক পদে চাকুরিপ্রাপ্ত ১০৩২৩ জনকে আর পুনর্বহাল করা হয় না।

    ২০১৭ থেকেই এই চাকরিচ্যুত শিক্ষকরা রাজনীতির ফাঁদে পড়ে যান। নিজস্ব আন্দোলন সংগঠিত করার বদলে, রাজনৈতিক দলগুলির আশ্রয় নিতে শুরু করেন তাঁদের একাংশ। ১০৩২৩ জন ভাগ হয়ে পড়েন বিভিন্ন রাজনৈতিক ভবর্গে। তাদের নিয়ে ভোটের বাজার গরম করতে আসরে নামলো বিজেপির কেন্দ্রীয় ও রাজ্যস্তরের নেতৃবর্গ। কখনও ধরনামঞ্চে, কখনও মিছিলে, কখনও সাংবাদিক বৈঠক করে তাদের কর্মসংস্থানের প্রতিশ্রুতি। ফলত কর্মহীন, ঋণের দায়ে জর্জরিত মানুষেরা প্রতারণার ফাঁদে পড়ে যান। সপ্তম পে-কমিশনের লোভে কর্মচারীরা, মিসড কলে চাকরির লোভে বেকার যুবক-যুবতী ও চাকরি পুনর্বহালের আশায় এই ১০৩২৩ ও তাদের পরিবারের বৃহৎ অংশের ভোটে চলে যায় বিজেপির বাক্সে। ক্ষমতায় আসীন হন মুখ্যমন্ত্রী বিপ্লব দেব ও তার মন্ত্রীমন্ডল। এর পর শুরু হয় অপেক্ষা। বছর দুই কেটে যায় কিন্তু অপেক্ষার আর শেষ হয় না। ধীরে ধীরে সহ্যের বাঁধ ভাঙ্গতে থাকে। ওদিকে ১০৩২৩ এর কিছু সদস্য বিজেপির সান্নিধ্যে ফুলে-ফেঁপে ওঠে ও আন্দোলনকে বানচাল করার প্রচেষ্টা চালাতে থাকে। ১০৩২৩ এর এক প্রতিনিধি দল মুখ্যমন্ত্রীর সাথে দেখা করেন ও তাকে তার নির্বাচনী প্রতিশ্রুতির কথা মনে করান। মুখ্যমন্ত্রী মৌখিক আশ্বাস দেন যে ২ মাসে তিনি এই সমস্যার সমাধান করবেন। এই দিন কয়েক পরেই রাজ্যের শিক্ষামন্ত্রী শিক্ষাদপ্তরে লিখিত পরীক্ষার মাধ্যমে কিছু শূন্যপদ পুরনের কথা ঘোষণা করেন ও এই ১০৩২৩ কে লিখিত পরীক্ষায় বসার অনুরোধ করেন। যাঁদের গড় বয়স ৪০ ও যারা গত ১০-১৫ বছর ধরে শিক্ষকতা করে আসছিলেন, তাঁরা সন্তানসম ছাত্রছাত্রীদের সাথে পরীক্ষায় বসতে অস্বীকার করেন। তাদের একটাই দাবি ছিল যে তাঁদের চাকরিতে পুনর্বহাল করতে হবে, যা আদালতের রায়েও সিদ্ধ ছিল। তাঁরা যখন মুখ্যমন্ত্রীর বক্তব্য জানতে চান তখন মুখ্যমন্ত্রী ৩৬০ ডিগ্রি ঘুরে যান ও বলেন যে তাদের পুনর্বহাল সম্ভব নয়।

    হতাশ, অবসাদগ্রস্ত, অপমানিত ১০৩২৩ এর উপর নেমে আসে বিষাদের ছায়া। অনেক শিক্ষক শিক্ষিকা এই শোক সইতে পারলেন না। শুরু হল অবসাদে আত্মহত্যার মিছিল। রোজ পত্রিকার প্রথম পাতায় শিরোনাম কোনও না কোনও শিক্ষকের আত্মহত্যার খবর। কান্নার রোলে ভেসে উঠতে থাকল চুরাইবাড়ি থেকে সাব্রুম, কাঞ্চনপুর থেকে খোয়াই। এই হাহাকারের মধ্যেই ধীরেধীরে বিক্ষিপ্তভাবে ছড়িয়ে থাকা শিক্ষক শিক্ষিকারা একত্রিত হতে শুরু করলেন। গড়ে তোলা হল জয়েন্ট মুভমেন্ট কমিটি ১০৩২৩। সরকার তথা মুখ্যমন্ত্রীকে তাদের দাবি মানার চরমসীমা বেঁধে দিলেন তারা। যদিও সরকার তার অনড় অবস্থানেই থাকে। নিরুপায় হয়ে ডিসেম্বরের কড়া ঠান্ডায় আগরতলা সিটি সেন্টারের সামনে খোলা ধরনামঞ্চে সপরিবারে অবস্থান ধর্মঘটে বসেন কয়েক হাজার শিক্ষক শিক্ষিকা। আশ্চর্যভাবে প্রথম দিন থেকেই প্রবল জনসমর্থন পেতে শুরু করে এই আন্দোলন। সংবাদমাধ্যমের শিরোনামে চলে আসে এই অবস্থান আন্দোলন। যত দিন গড়ায় আরও জমজমাট হতে থাকে এই আন্দোলন। ৮ থেকে ৮০ – নারী পুরুষ নির্বিচারে সবাই এই ধরনামঞ্চে এসে তাদের প্রতি সহমর্মিতা প্রকাশ করে যান। ধরনামঞ্চের সামনে একটি দানপাত্র রাখা ছিল, আক্ষরিক অর্থেই এই দানপাত্র কানায় কানায় ভরে ওঠে। শুধু তাই নয়; বস্তার পর বস্তা চাল, ডাল, আলু, সয়াবিন, রান্নার তেল, শাক-সব্জি রাতে ঠান্ডার জন্য কম্বল, পানীয় জলের বোতল দিয়ে আন্দোলনকে সমর্থন জানান রাজ্যের সাধারন জনগন। ছাত্র, শিক্ষক-কর্মচারী, ডাক্তার, আইনজীবী, কবি লেখক সহ প্রায় সব পেশার মানুষ তাদের সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেয় এই আন্দোলনে। এমনকি ইন্ডিয়ান মেডিক্যাল এ্যাসোসিয়েশন দু দুটি মেডিক্যাল ক্যাম্প বসায় ধরনাস্থলে। আগরতলা শহর এমন শৃঙ্খলাবদ্ধ আন্দোলন এর আগে আর কখনও দেখে নি।
    কিন্তু এই আন্দোলনকে সঠিক চোখে দেখেন নি মুখ্যমন্ত্রী তথা শাসক দল। প্রথমে উপেক্ষা, তারপর উপহাস; তারপর আন্দোলনকে বিরোধীদের চক্রান্ত বলে দাবি করে সরকার। কিন্তু আন্দোলনের জোর যতই বাড়তে থাকে ততই সরকারের অস্বস্তি বাড়তে থাকে। রাষ্ট্রীয় তথা আন্তর্জাতিক সংবাদ মাধ্যম (BBC ও CNN) ফলাও করে প্রচার করে এই আন্দোলনকে আরও তেজি করে তোলে। ফলে ৬ এর এ, কৃষ্ণমেনন রোডের বাংলো থেকে নির্দেশ আসে খুব দ্রুত এই আন্দোলনকে খতম করার জন্য। যেমনি ভাবা তেমনি কাজ; ধরনামঞ্চে পাঠানো হল পুলিশের চর। সিটি সেটারে ব্যবসারত দোকানদারদের হঠাৎ করে “অসুবিধা” শুরু হল। আর যখন ধরনাকারীরা সরকারকে চাপে ফেলার জন্য রিলে অনশন শুরু করল ঠিক তখনই সেখানকার কিছু বাসিন্দা (যাদের বাড়ি প্রায় ২০০-৩০০ মিটার দূরে অবস্থিত) তাদের ঘুমের অসুবিধা হচ্ছে এই মর্মে কর্পোরেশনে অভিযোগ দায়ের করলো। তারপর এলো এক অভিশপ্ত রাত ও তার পরের সকাল। সবে প্রজাতন্ত্র দিবসের অনুষ্ঠান শেষ হয়েছে, হঠাৎ ছাব্বিশ তারিখ (২৬-০১-২০২১) সন্ধ্যায় এক আদেশবলে আগরতলা পুর এলাকায় ৪৮ ঘণ্টার জন্য ১৪৪ ধারা জারি করা হল। দেরিতে ঘোষণা করার ফলে অধিকাংশ মানুষের কানে এই খবর পৌঁছায় নি। ফলে আর পাঁচটা রাতের মত সবাই ঘুমাতে গিয়েছিল মঞ্চে অবস্থানরত আন্দোলনকারীরা।

    কিন্তু ঘুমায় নি জেলাশাসকের দপ্তর, ঘুমায় নি পূলিশ সুপারের দপ্তর, ঘুমায় নি পশ্চিম আগরতলা থানা। রাত ৩-টে, পরিকল্পনা চুড়ান্ত করে পুলিশের বড়কর্তার নেতৃত্বে এক বিশাল পুলিশ বাহিনী রওয়ানা হল আগরতলা সিটি সেন্টারের উদ্দেশে। প্রথম দুদিকের রাজপথ বন্ধ করে দেওয়া হল। এবার ধরনামঞ্চ ও সিটি সেন্টারের সামনে যে শিক্ষক শিক্ষিকারা গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন তাদের লাঠির মুখে ঘুম থেকে তুলে পুলিশের গাড়িতে পোরা হল। মুহূর্তে চলে এল দুটি বেসরকারি বাস, আন্দোলনরত মাষ্টারমশাইদের সেই বাসে তুলে অজ্ঞাত যায়গায় পাঠানো হল। এবার এল দুটি বেসরকারি ট্রাক। একটিতে ধরনামঞ্চ ভেঙে তার অবশেষ তোলা হল আর একটিতে তোলা হল আন্দোলনকারীদের দেওয়া বস্তা বস্তা রেশন, জল, তাদের কম্বল, দানপাত্র (ধরনাকারীদের মতে তাতে প্রায় আড়াই লক্ষ টাকা ছিল) ও অন্যান্য সামগ্রী। ৩০ মিনিটের অপারেশনে একেবারে সাফ হয়ে গেল সিটি সেন্টার প্রাঙ্গণ। ভোরের আলো ফোঁটার আগে যারা প্রাতঃ ভ্রমণে বেরোন তারা প্রায় ৫৮ দিন পর ফাঁকা সিটি সেন্টার দেখে কেমন যেন ঘাবড়েই গেলেন।

    প্রাথমিক ধাক্কা কাটিয়ে বাকি আন্দোলঙ্কারীরা একে অপরের সাথে যোগাযোগ করে আবার একত্রিত হলেন সিটি সেন্টারের সামনে। কিন্তু বিধি বাম। একত্রিত আন্দোলনকারীদের উপর আবার হামলে পড়ল সরকারি শাসন ব্যবস্থা। লাঠির মুখে যে যেদিকে পারেন পালিয়ে বাঁচতে লাগলেন। সকালবেলা টিভি খুলে ত্রিপুরার জনগন তখন সরাসরি সম্প্রচার দেখছেন সেই পৈশাচিকতার। লুকিয়ে থাকা নিরস্ত্র ভয়ার্ত শিক্ষকদের একে একে বের করে গাড়িতে তুলে আবার নিয়ে যাওয়া হল কোনও এক অজ্ঞাত যায়গায়। কিন্তু ততক্ষনে প্রচুর আন্দোলনকারী জড়ো হয়ে গেছেন। ভয়ে দুঃখে, অপমানে তাদের চোখে জল, ভাবলেন সব যখন শেষ তখন শেষ চেষ্টাই করবেন। সিটি সেন্টার থেকে ৩ মিনিটের হাঁটা পথ মুখ্যমন্ত্রীর সরকারি বাসভবন। সবাই এবার “শেষ চেষ্টা” করতে সকালের রোদের সাথে গিয়ে উপস্থিত হলেন মুখ্যমন্ত্রীর সরকারি বাসভবনের সামনে- শেষ দেখার জন্য।

    হ্যাঁ, শেষ দেখেছিলেন ওরা। তখন সকাল দশটা, কয়েক হাজার নিরস্ত্র, নির্ঘুম শিক্ষক শিক্ষিকাদের উপর “শেষ” আঘাত। প্রথমে জলকামান, তারপর কাঁদানে গ্যাসের সেল, অবশেষে লাঠিচার্জ। শতাব্দী পুরোনো রবীন্দ্র স্মৃতি বিজড়িত উমাকান্ত একাডেমির সামনে লাঠির আঘাতে লুটিয়ে পড়লেন কমল, ইসমাইল, তপন, ডালিয়া, পিয়ালী, সোমেনরা, সাথে প্রবল ইটবৃষ্টি। ১৫-২০ বছর ধরে যারা জাতির মেরুদন্ড হিসেবে শিক্ষকতা করে সভ্য সমাজ বানিয়েছিলেন তারাই আজ ক্ষমতার মারে রক্তশোভিত রাজপথে ভূলুণ্ঠিত হয়ে “শেষ দেখে’ই ছাড়লেন। হাসপাতালে যাবার পর আস্তে আস্তে সবাই চলে গেল, বিকেলে কর্পোরেশনের জলের গাড়ি এসে সেই রক্তাক্ত রাজপথ ধুয়ে দিয়ে সেই রাজপথকে সভ্য করে দিয়ে চলে গেল।

    পুনশ্চঃ একদিন পর অজ্ঞাত স্থান থেকে হেপাজতে নেওয়া শিক্ষক শিক্ষিকার ফিরে আসেলেন। আর ৪৮ ঘণ্টা ১৪৪ ধারার মধ্যেই আগরতলা পূর এলাকায় ৩৯ তম বই মেলার উদ্বোধন করেছিলেন বিজেপি শাসিত রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী বিপ্লব কুমার দেব।


    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক।
  • আলোচনা | ২৬ মার্চ ২০২১ | ৩০০০ বার পঠিত
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • Ramit Chatterjee | ২৬ মার্চ ২০২১ ১৮:৪০104115
  • লেখাটা পড়ে শিউরে উঠলাম। বীভৎস পরিস্থিতি।

  • দীপ | 2402:3a80:a05:d0a0:68d7:d220:a8c6:***:*** | ২৬ মার্চ ২০২১ ২২:২২104117
  • কোনো গণতান্ত্রিক দেশে শান্তিপূর্ণ আন্দোলনের উপর এই নির্মম আক্রমণ শাসকের চূড়ান্ত ঔদ্ধত্যের পরিচায়ক! শাসককে একদিন এর মূল্য দিতে হবে! সেদিন মানুষ এদের ছুঁড়ে ফেলে দেবে!


    আমাদের শক্তি মেরে, তোরাও বাঁচবিনে রে,     বোঝা তোর ভারী হলে ডুববে তরীখান।

  • নাম দেয়া হবে না | 2001:67c:2628:647:d::***:*** | ২৭ মার্চ ২০২১ ০১:১৯104123
  • ওয়াও। দুক্সে চক্কে পানি আইসা গেল। বাটপারির একটা সীমা রাখেন মশাই। ২০১৪ র হাইকোর্ট এর রায় ২০১৮ সুপ্রিম কোর্টের রায়িকে সুপারসিড করবে?


    প্রথমতম কেসে আসুন, মাত্র ৫৬ জন বেকার, বামফ্রন্ট ক্যাডারদের চাকরি দেয়ার নতুন ক্রাইটেরিয়া "দারিদ্র্য" নামক শয়তানির বিরুদ্ধে কেস করে। হাইকোর্ট এই ৫৬ জনের সাথে এমিকেবল সেটলমেন্ট করে সরকারকে ব্যপারটা মিটিয়ে নিতে অনুরোধ করে। 


    শুয়োরের বাচ্চা বামফ্রন্ট যেহেতু জীবনে কোনোদিন ভুল করে নাই, তাই সুপ্রিম কোর্টে আপিল করে, ও গোয়ামারার খায়। 


    এখন কিছু দালাল এদিক ওদিক ছড়াচ্ছে। 

  • প্রতিভা | 203.163.***.*** | ২৭ মার্চ ২০২১ ০৮:১৪104129
  • এ-ই প্রতিবেদনে অত্যন্ত বিচলিত লাগছে। বিজেপি সরকারের এ-ই ন্যক্কারজনক ভূমিকার পরিপ্রেক্ষিতে শিক্ষকরা কী করবেন বলে ভাবছেন এখন। তাদের যৌথতা কী একেবারেই ভেঙে দিতে পেরেছে এ-ই সরকার ?  খুব আর্ত জিজ্ঞাসা উঠে আসছে, এঁদের এখন কী হবে ?  

  • Ranjan Roy | ২৭ মার্চ ২০২১ ১৫:১৫104138
  • "শুয়োরের বাচ্চা বামফ্রন্ট যেহেতু জীবনে কোনোদিন ভুল করে নাই'


    ----আমরা সকলেই কারও না কারও বাচ্চা! রাজনৈতিক বিতর্কে কারও মাতৃ -পিতৃ কুল উদ্ধার করলে কি বিতর্কএর ওজন বাড়ে?


     মাত্র ৫৬ জন বেকার?


    প্রতিবেদনটি পড়ে মনে হল কয়েকহাজার। সত্ত্যিটা কী? জানতে চাই।

  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:

Tripura, Tripura Teachers Strike, Tripura Movement, Tripura BJP, 10323
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : guruchandali@gmail.com ।


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। যা খুশি মতামত দিন