শীঘ্রপতনের শতবর্ষ
যৌবন স্বভাব সুলভ দোষ প্রভৃতি কারণে অতিরিক্ত শুক্রক্ষয় জন্য ধাতুদৌর্ব্বল্য ঘটিলে অর্থাৎ বীর্য্য তরল, সহজেই বীর্য্যপতন, স্বপ্নদোষ, ইন্দ্রিয় শিথিলতা, ধ্বজভঙ্গ…
এইসব বাঙালির প্রাচীন রোগ। ১৮৯৫-৯৬ সালের ‘দে এণ্ড ব্রাদার্স’ এর ‘নূতন পঞ্জিকা’ থেকে উদ্ধৃত করলাম উপরের কয়েক লাইন। ‘রামপুর বোয়ালিয়া, রাজসাহী’-র শ্রীব্রজরাখাল দাস এই বিজ্ঞাপন দিয়েছিলেন নূতন পঞ্জিকায়। তাঁর ওষুধের নাম ‘মদন বটিকা’। বিজ্ঞাপনে বলা হয়েছিল ‘এই মহৌষধ সন্ন্যাসী হইতে প্রাপ্ত’ এবং আরও বলা হয়েছিল ‘উপকার না হইলে মূল্য ফেরত দিব’। পুরো বিজ্ঞাপনটা পড়ুন--
এই বিজ্ঞাপন থেকে জানা যাচ্ছে শতাধিক বর্ষ পূর্বে বাঙালির ধ্বজভঙ্গ তথা যৌন রোগের টাইপ। কী সুন্দর সুন্দর নাম! এই বিজ্ঞাপনে আমরা দেখছি ঔষধ সেবনে তিন সপ্তাহের মধ্যে ‘রোগ সমূহ অচিরে দূরীভূত’ হবে। আর গ্যারান্টির কথা তো আগেই বলা হয়েছে। সেকালের পঞ্জিকার পাতায় পাতায় এহেন বিজ্ঞাপনে বাঙালির যৌনরোগের ধরণ সম্পর্কে একটা স্পষ্ট ধারণা হয়। এই নিঁখুত কাজ বিজ্ঞাপন ছাড়া আর কোথায়ই বা মিলবে! কেমন ছিল সেকালের বাঙালির মদন বটিকা সেবনের উপলক্ষ তার এক ঐতিহাসিক নিদর্শন পেশ করলাম। আর একালের বাঙালি? তার অবস্থা কী? যৌনরোগের টাইপ কেমন? এই ২০২০ সালের ৯ নভেম্বর তারিখে সংবাদ প্রতিদিন পত্রিকায় প্রকাশিত একটি বিজ্ঞাপন দেখা যাক। মন দিয়ে দেখুন--
সেই শীঘ্রপতন, সেই স্বপ্নদোষ, সেই লিঙ্গ ছোট বা কমজোরী, সেই নপুংসতা-- কালও ছিল, আজও আছে। কিছুই বদলায়নি। কেবল সেদিনের ‘মদন বটিকা’ এদিনের ‘ভিগোরেস্ট ক্যাপসুল ও তেল’ হয়েছে। আর ঠিকানার বদলে এসেছে ফোন নম্বর। বিজ্ঞাপন বহাল আছে। বাঙালির ধ্বজভঙ্গতা বহাল আছে। সেখানে কিচ্ছু পালটায়নি। সবই ওই ফর্ম ফিলাপের মতো, সেম অ্যাস অ্যাবভ!
পূর্বভূমিকা
বঙ্গজীবনে বোরোলীনের ভূমিকা বিজ্ঞাপন মারফতই জানা যায়। জীবনের নানা ওঠাপড়ায় বোরোলীন জ্ঞাতে-অজ্ঞাতে বাঙালিবাড়ির ড্রেসিং টেবিলে হাজির হয়ে যায়। পঞ্জিকাও তাই। মানুন না মানুন,আমরা সকলেই সংস্কারপন্থী। কেউ সু-এর আর কেউ কু-এর। আর পঞ্জিকা এই দুই-কেই ধারণ করে। সেই কাল থেকে এই কাল পর্যন্ত। বিজ্ঞাপন এই সংস্কারের বাহন। আমাদের জীবনযাপনের দৈনন্দিনতায় যে ওঠাপড়া ছড়িয়ে থাকে, তার হিসেব পাওয়ার একমাত্র সহজলভ্য উপায় বিজ্ঞাপনসেবন। এতে শরীর ও মন স্বতঃই চাঙ্গা থাকে। অঙ্গে অঙ্গে রংমশাল জ্বলতে থাকে। কী ছিল বঙ্গে, তা কী হয়েছে এই অঙ্গে, এর এক সচিত্র ধারাবিবরণ বিজ্ঞাপন মারফত যেমন যেমন পাওয়া যায়, তেমন তেমন সাজিয়ে দিলাম।
বাঙালির কপাল, রোগভোগ আর কবচ আংটি
যৌনবলের গল্পে বাঙালির সেই ট্রাডিশন যে সমানে চলেছে, তার ভুরি ভুরি উদাহরণ দেওয়া যেত। কেবল শতাধিক বর্ষের ব্যবধানে দুটিমাত্র বিজ্ঞাপন দিয়েই বিষয়টির কেল্লা ফতে করার পর এবার আসব বাঙালির কপালে। কপালের লেখাও ‘যা ছিল আগের মতো রয়ে গেল’। ব্যাপারটা দেখা যাক। ১৯২৮-২৯ সালের পি, এম, বাকচির পঞ্জিকায় একটা কবচের বিজ্ঞাপন ছিল। ‘প্রত্যক্ষ ফলপ্রদ অব্যর্থ মহৌষধ’ সেই কবচ। কোন্ কামে লাগে এই কবচ? দেখুন এবং মন দিয়ে পুরোটা পড়ুন--
‘এই অত্যদ্ভুত বৈদ্যুতিক গুণসম্পন্ন কবচ’-এর অপার মহিমা। বাঙালির কত জটিল ব্যাধি অচিরে আরোগ্য হয়েছে এই কবচ ধারণে। ব্যাধিগুলি কী? মেহ, প্রমেহ, সর্বপ্রকার বাত, একশিরা, অর্শ, স্বপ্নদোষ, হিষ্টিরিয়া-- কত রকমের রোগ! কী ভ্যারাইটি! বাঙালির শরীর যেন বৈচিত্র্যের মধ্যে ঐক্য। আর আমরা সবসময়ই ঐক্যের পক্ষে। ফলে যাবতীয় বৈচিত্র্য ঐক্যবদ্ধভাবেই এখনও বাঙালির শরীরে সসম্মানে অবস্থিত। এবং যাবতীয় প্রতিকার-প্রতিরোধের জন্য কবচ-তাবিজ-মাদুলিও হাজির। শরীরের ক্ষয় কিংবা কপালের পচন যাই হোক না কেন, চিকিৎসার্থে কবচ একম্ অদ্বিতীয়ম্। এই হাজিরার মিছিল চলছে যেন। আসুন দেখতে থাকি। ১৯৫৩-৫৪ সালের পি, এম্, বাকচির পঞ্জিকা থেকে নেওয়া একটা বিজ্ঞাপন--
যত রোগই থাকুক, প্রতিকারের উপায় একটাই। ‘রক্ষা-মাদুলী’। সে যক্ষা হোক বা পক্ষাঘাত। রীতিমতো সার্টিফিকেট প্রাপ্ত মাদুলি। কাজ না করলে পুরস্কারেরও ব্যবস্থা আছে। রোগের কথা আর কী বলব! এত শ্রুতিমধুর রোগের নাম কোথায়ই বা পাওয়া যাবে! কয়েকটা নাম ফের পড়ছি-- ভগন্দর, গ্রহণী, কুরণ্ড, গণ্ডমালা, মূত্রকৃচ্ছ…
শিক্ষায় মাতৃভাষাই মাতৃদুগ্ধ। এই নীতি সর্বাংশে অনুসৃত হলে এমন সুন্দর বাংলা নামের রোগগুলি বাঙ্গালিরা একডাকে চিনতে পারত। যাই হোক। দুঃখ করে লাভ নেই। বিজ্ঞাপনে ফিরি। এবার দেখুন ১৯৬২-৬৩ সালে দুটো বিজ্ঞাপন। পি, এম, বাকচি থেকে উদ্ধৃত করছি। পাঠে মনোনিবেশ করুন--
এই কবচ মারাত্মক। জ্যান্ত-মরা, স্ত্রী-পুরুষ-- সবরকমের ক্যারেক্টার ধরা পড়বে এখানে। মোকদ্দমায় জেতা-চাকরি পাওয়া-লটারি পাওয়া-মৃত আত্মার দেখা পাওয়া-মনের মতো মানুষকে পাওয়া-বস্তুকে পাওয়া--- কোনও পাওয়া এই কবচের কেরামতির বাইরে নেই। কবচের যেমন ক্ষমতা, বাঙালির না-পাওয়ার তালিকাও তেমনি বিস্তৃত। খেদ-হতাশা আর তার উপশম-- এই নিয়েই কবচের মহিমা, বিজ্ঞাপনের গরিমা। এই চমৎকার কবচ-মাদুলি বঙ্গজীবনে বোরোলীনের চেয়ে কোনও অংশে সামান্য নয়। এমনি আরেকটি ‘তন্ত্রের অলৌকিক শক্তি’ উপলব্ধি করুন--
‘শত্রুদিগকে বশীভূত ও পরাভূত’ করে তারপর এই কবচ আর যা করে এসেছে তা হল ‘কলেরা, বসন্ত, প্লেগ, কালাজ্বর প্রভৃতি মহামারির হাত হইতে আত্মরক্ষা ও অকালমৃত্যু হইতে নিষ্কৃতিলাভ’। এই রোগের তালিকায় একটা করোনা ভরে নিলেই ইদানীন্তনত্ব অ্যাকাডেমিক্সের ণ-ত্ব বিধি ষ-ত্ব বিধি মেনে, বঙ্গীয় সমাজে দিব্যি ‘দৈবশক্তি’র স্বল্পমূল্যের পরিষেবা দিতে পারত। এই কবচ-তাবিজ অপ্রতিহত গতিতে তান্ত্রিক-জ্যোতিষের কার্য্যালয় থেকে আর্কাইভ পর্যন্ত ঘুরে বেড়াচ্ছে। পঞ্জিকার পাতায় চোখ পাতলে এ তথ্য জানা যায়। বঙ্গজীবন এখানেও আরেকভাবে ঐতিহাসিক নথিতেই আটকে আছে। নাক সিঁটকে লাভ নেই। এবার একটু একালে আসি। ২০২০ সাল।
কী বুঝলেন? ‘পাঁচ পুরুষের বিখ্যাত লক্ষ লক্ষ মানবের পরীক্ষিত ও প্রশংসিত’ কবচ। এই কবচ কী করতে পারে না তা-ই অনুসন্ধানের বিষয়। আর যা এ করতে পারে তার সবক’টাই বাঙালির কোষে কোষে কষে গেঁথে আছে। সেই কবে বাঙালি জাতির উদ্ভব হয়েছিল; তার পর থেকে বাঙালি ‘কুগ্রহের থেকে মুক্তি, চাকুরীপ্রাপ্তি, পদোন্নতি, ব্যবসা বা লেখাপড়ায় উন্নতি, স্মৃতিশক্তি বৃদ্ধি, দুরন্ত শিশু ও শত্রু বশীভূত, স্বামী-স্ত্রীর বিচ্ছেদ মিলন’… এইসব গ্যাঁড়াকল থেকে কোনদিনও মুক্তি পায়নি। কেবল কাব্য করেছে, ‘মুক্তি ওরে, মুক্তি কোথায় পাবি?’। বাস্তববাদী এইসব তাবিজ-কবচ আর মা-ত্রিশক্তি ও শ্রীগুরু পাগলানন্দ কৃপাধন্য নবগ্রহ রক্ষাকবচ পাঁচ পুরুষ ধরে লক্ষ লক্ষ বাঙালিকে ‘আত্মনির্ভর’ করে এসেছে। এর অপার শক্তি বাঙালির যাবতীয় কষ্ট-হতাশা, অভাব-রোগভোগ দূর করে বাঙালিকে মহামৃত্যুঞ্জয়ী করে তুলেছে। সবিনয়ে আরেকটি নিবেদন। পাঠক, আপনিও অনুগ্রহ করে গোটা বিজ্ঞাপনটা বার কয়েক পড়বেন। এতে আপনার জ্ঞানবৃদ্ধি হবে। জানতে পারবেন নোবেল পুরস্কার, আনন্দ পুরস্কার, এশিয়ান পেইন্টস শারদ সম্মান কিংবা বঙ্গভূষণ, বঙ্গবিভূষণ ছাড়াও জগৎ সংস্কারে আরও কতরকমের পুরস্কার আছে--
এতক্ষণ ধরে বিভিন্ন শ্রুতিমধুর রোগের নাম দেখছিলাম। এখন দেখলাম কবচের বিভিন্নতা। মহেশ্বর কবচ, প্রজাপতি কবচ, হরিদ্রা-গণেশ কবচ-- একেক কবচের একেক কাজ। অর্শ রোগের কবচও আছে। বিজ্ঞাপনে এত এত কবচের নাম থাকলেও দামের বেলায় বলে দেওয়া হয়েছে, ‘পত্রে বা ফোনে জানিবেন’। ঠিক যেন ‘ইনবক্স করুন’-এর মতো ব্যাপার। যত দিন পাল্টেছে তত কেবল বিজ্ঞাপনের ভাষা এবং অভাব-অনটনের বিষয় পাল্টেছে। ব্যস, এইটুকুই। কপাল-মনোবল-যৌনবল তথৈবচঃ। ফলে কবচ-মাদুলির কোনদিনই ডাউন মেমোরি লেন হওয়ার জো নেই। তারপর সময়ের সঙ্গে সঙ্গে আসরে হাজির হচ্ছে সময়োপযোগী আরও কতকিছু--
‘জয়শ্রীরাম’-এর টাইমে হনুমানের যে একটু প্রভাব-প্রতিপত্তি বাড়বে এতে আশ্চর্য হওয়ার কিছু নেই। তিনি একটা গাছ চিনতে না পেরে গোটা পাহাড়টা মাথায় করে নিয়ে এসেছিলেন, আর সামান্য চাকরি-ব্যবসা-পড়াশোনা! মাত্র তিনটে শনি আর তিনটে মঙ্গলবার। ব্যস। যাবতীয় আর্থিক সংকট, সমস্যা, এমনকি অরুচিও গায়েব। জয় বজরংবলী! বঙ্গদেশস্থিত কলিকাতা মহানগরীর নানা সাইজের নানা ক্লাসের অলিতে গলিতে এখন শনি-মঙ্গলবারে যুবক এবং গৃহবধূরা এমনকি স্কুলপড়ুয়ারাও একবার অন্তত ঢুঁ মারেন জীবনের অরুচি দূর করতে। পঞ্জিকার পাতা থেকে শহরের অলি গলিতে শ্রীহনুমানের এখন দোর্দণ্ড জয়যাত্রা। ছোট-মেজো-বড় নানা সাইজের তাঁর মন্দির। বিজ্ঞাপন তারই খবর সূচিত করে। কবচ-মাদুলির দিন পেরিয়ে আমরা কেবল ‘যন্ত্রম্’-এর যুগে ঢুকেছি মাত্র। বিসমিল্লায় গলদ নেই। চেখেই দেখুন। যা চাইবেন অনলাইনেই পাবেন--
তাহলে বোঝা গেল নিজের ইচ্ছা নিজেই পূরণ করতে পারবেন। চমৎকার সমস্ত রুদ্রাক্ষ-যন্ত্র-কবচের এই ‘চমৎকারী’, যার দৌলতে আপনি ‘যা চাইবেন তাই পাবেন’-- বঙ্গজীবনে এরও একটা সুদীর্ঘ ঐতিহ্য আছে। আজ থেকে অর্ধশতাব্দী আগে পি, এম, বাকচির পঞ্জিকার পাতায় তার ঐতিহাসিক সাক্ষ্য মেলে। আবার আপনাদের কাছে নিবেদন, পুরো বিজ্ঞাপনটা মন দিয়ে পড়ুন--
২০২০-২১ সালের অর্থাৎ এ বছরের বেণীমাধব শীলের পঞ্জিকায় ছাপা কবচের বিজ্ঞাপনের সঙ্গে মিলিয়ে মিলিয়ে ১৯৫৩-৫৪ সালের পি,এম, বাকচির পঞ্জিকায় ছাপা বিজ্ঞাপনটা পড়ুন আবার। তারপর পাঠক, আপনারা নিজেরাই এই ‘ভাগ্যমিলান্তি' খেলায় পঞ্জিকার পাতার পর পাতা উলটে উলটে, একটা টাইম মেশিনে চড়ে একবার ওপরে যাবেন, একবার নিচে নামবেন। বাঙালি এখানে একটা বেলুন মাত্র। তার ভেতরে হাওয়া ভরা। সেই হাওয়ায় কিলবিল করছে নানাবিধ কবচ-তাবিজ-যন্ত্র-মন্ত্র। বেলুনের এপ্রান্ত টিপে ধরুন, হাওয়া চলে যাবে ১৯৫৩-৫৪-তে, আবার ওপ্রান্ত টিপে ধরুন, হাওয়া চলে আসবে ২০২০-২১-এ। আপনারা খেলা শুরু করে দিন। আমি পরের বিজ্ঞাপনে যাই।
প্রধানমন্ত্রী, দেশবিদেশের রাষ্ট্রপ্রধান, রাষ্ট্রদূত, মন্ত্রী, হাইকোর্ট ও সুপ্রিমকোর্টের বিচারপতি এবং চলচিত্র তারকা দ্বারা সম্মানিত ‘বশীকরণ ও প্রজাপতি কবচের স্রষ্টা’ আপনাদের জন্য নানাবিধ উপশম নিয়ে হাজির হয়েছেন। এও এপ্রান্তের হাওয়া--
বাঙালির হোল লাইফে কেবল বাধা। বিবাহে বাধা--সন্তানলাভে বাধা--বিদ্যায় বাধা--সম্পত্তিলাভে বাধা। বাধার এহেন সামাজিক, ঐতিহাসিক এবং অর্থনৈতিক পরম্পরা বাঙালির জীবনের অঙ্গাবরণ। সামাজিক ইতিহাস ঘেঁটে দেখুন। সেই প্রাচীনকাল থেকে ভুরি ভুরি কন্যাদায়গ্রস্ত পিতার উপস্থিতি। যদিও বা চেষ্টাচরিত্র করে বিয়ে দেওয়া গেল, এবং যদি না পণের দাবিতে শ্বশুরবাড়িতে সেই মেয়েকে পুড়িয়ে ফেলা হয়, তারপর আসরে আসে সন্তানলাভে বাধা। তাও জ্যোতিষ ধরে, জড়িবুটি খাইয়ে যদি বা সন্তানলাভ হল, তারপর তার বিদ্যায় বাধা। এটাও যদি ম্যানেজ করা গেল, সামনে হাজির হল সম্পত্তিলাভে বাধা। এ আহাম্মক বাধা কিছুতেই পিছু ছাড়ে না। সেকালের সেই বাধা একালেও বহমান। তখনও তা দূর করতে স্রষ্টারা কবচ নিয়ে হাজির হতেন, এখনও তাঁরাই দেবদূতের মতো রিলিফ দিচ্ছেন। কেবল তখন সার্টিফিকেট দিতেন গাঁ-গঞ্জের মানুষজন, এখন সার্টিফিকেট দেন বিচারপতি, রাষ্ট্রদূত, চলচ্চিত্র তারকারা। নইলে বিষয়টা একই। এইসব তাবিজ-কবচের ‘চমৎকারী’ শুধু যে পঞ্জিকার পাতাতেই আটকে আছে এখন, তা নয় কিন্তু। বাংলা খবরের কাগজও এই বিজ্ঞাপন প্রচারের এক গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যম।
আকর্ষণীয় বক্ষযুগলের একাল-সেকাল।।
উনিশ শতকের গোড়ার দিকে কাল্জানা নামে একটা ওষুধের বিজ্ঞাপন পঞ্জিকার পাতায় পাতায় ছেয়ে থাকত। আগে বিজ্ঞাপনটা আপনারা ভালো করে পড়ুন--
এই বিজ্ঞাপনে জনৈক বিখ্যাত ইংরাজ চিকিৎসকের একটি উদ্ধৃতি আছে এবং আছে একটি অমোঘ ঘোষণা।
‘আপনার স্ত্রীকেও--
কালজানা সেবন করাইয়া
রীতিমত স্বাস্থ্য ও শক্তি-সমন্বিত পূর্ণ যৌবনোচিত
মধুময় জীবন ভোগ করিতে দিন।’
অর্থাৎ স্ত্রীকে সেবন করাবেন স্বামী। বউয়ের জন্য বর ওষুধ কিনে আনছে। কেন? কারণ পূর্ণ যৌবনোচিত করতে হবে। এই যে করতে চাওয়া এর একটা প্রেক্ষাপট আছে। ব্রিটিশ সরকার উনিশ শতকে বাঙালিকে আধুনিক কেরানি শিক্ষায় শিক্ষিত করে যে অফিস-কালচারের পত্তন করেছিল, তাতে ঘরে ঘরে এইরকম পূর্ণযৌবনোচিত স্ত্রীর প্রয়োজন হয়ে পড়েছিল। কেননা, ঘরে তখন নেহাতই যা ছিল, বটতলার প্রহসনের ভাষায় তা হল এইরকম--
নিজনারী আছে ঘরে যাহা বলি তাহা করে
নানা রূপ গুণ ধরে তাহে মন রয় না।
কেরানিশিক্ষায় শিক্ষিত নব্য বাঙালি তখন ঘরের ‘নিজনারী’ নিয়ে সন্তুষ্ট ছিলেন না। সাহেব-সুবোদের সঙ্গে মেলামেশা করার সুযোগ পেয়ে বা দূর থেকে তাঁদের দেখতে পেয়ে, তাঁদের ‘নিজনারী’রা কেমন, সে সম্পর্কে একটা আভাস পেত তখনকার নব্যবাঙালিরা। বটতলার বহু প্রহসনে কেরানি বাঙালির বহুবিধ উপাদেয় কাহিনি ছড়ানো আছে। ফলে বিজ্ঞাপনে সেই বাঙালি বাবুদেরই টার্গেট করা হয়েছিল। তাই, ‘আপনার স্ত্রীকেও কালজানা সেবন করাইয়া…’ এমন বাক্য দেখা গেল। এবং সেক্ষেত্রে, কালজানার গুণে বঙ্গীয় ‘নিজনারী’ কেমন দেখতে হতে পারে তার বর্ণনার পাশাপাশি যে ছবি বিজ্ঞাপনে ব্যবহার করা হল, তাও ইউরোপীয় মুখ। বঙ্গীয় নিজনারী তখন বাড়ির বাইরে বেরিয়ে এসে ওষুধের দোকান থেকে কালজানা কিনে আনবে এমন ভাবনার ঠাঁই কল্পবিজ্ঞানেও মেলে না। তো সেইসময়কার ‘নিজনারী’ তার শরীর নিয়ে একটু চিন্তাভাবনা করুক, তা বিজ্ঞাপনের ভাষায় বারবারই হাজির হয়েছে।
‘১২৭নং, মসজিদবাড়ী স্ট্রীট, কলিকাতা’-- এই ঠিকানায় ‘রিসার্চ হারবাল হোম’ নামে এক ওষুধের দোকানের বিজ্ঞাপনে ‘নিজনারী’কে ইউরোপীয়দের মতো সুশ্রী করে তোলার জন্য কিছু ওষুধের বিজ্ঞাপন ছিল। তার নাম সংকোচক, Birth Control, ইচ্ছামতী পিল, পেসারী পিল এবং টাইট ব্রেস্ট। এই টাইট ব্রেস্টের বিজ্ঞাপনে বলা হয়েছিল ‘দৃঢ় ও উন্নত স্তনই রমণীর সৌন্দর্য’। আরও বলা হয়েছিল এই ওষুধ প্রতিদিন তিনবার করে সাতদিন ব্যবহার করলেই স্তন উন্নত ও সুশ্রী হবে। ওষুধের দাম এক শিশি আড়াই টাকা। অধিকন্তু এই বিজ্ঞাপনের প্রাপ্তি ‘টাইট ব্রেস্ট’ সংক্রান্ত একটি নাতিদীর্ঘ কাব্য।
কথা বাড়িয়ে লাভ নেই। আপনারা সেই কাব্য পাঠে মন দিন। জোরে জোরে পড়লে যিনি শুনবেন তাঁর কানের মধ্যে দিয়ে গিয়ে একেবারে হৃদয়ে আকুলিবিকুলি ঝড় তুলবে। আসুন সবাই মিলে একসঙ্গে পাঠ করি--
‘যুবতীর যাহা কিছু দর্প অহঙ্কার
আনমিত স্তনভার সৌন্দৰ্য-ভাণ্ডার
এ সম্পদ নাহি যার নাহি কিছু তার
যুগল শ্রীফল-বক্ষ নারীর বাহার
যাহার প্রসঙ্গে সুখ আকাঙ্ক্ষা চিন্তনে
উপভোগে ইচ্ছা আর লালসা দর্শনে
না থাকিলে নাহি থাকে নারীর গৌরব
রাখিতে এহেন মহা সম্পদ নিশ্চয়
কোন বালা হৃদে বল সাধ নাহি হয়
করিতে নমিত স্তন আনমিত স্বতঃ
কুচ-যুগ তুঙ্গ করি রাখিতে সতত
বিখ্যাত ‘টাইট ব্রেস্ট’ পেটেন্টের সার
নিয়মিত বক্ষে তব কর ব্যবহার
দেখিতে তরল অতি গন্ধ সুবাসিত
সুন্দর শিশিতে ভরা মন বিমোহিত
দূষিত পদার্থ নাহি ব্যবহারে বেশ
স্তন্যদানে অসুবিধা নাহি মাত্র লেশ
যখন তখন কিম্বা গর্ভ অবস্থায়
ব্যবহার করো সতী বিনা আশঙ্কায়
এই বিজ্ঞাপনে আরও বলা হয়েছিল, ‘ইন্দ্রিয়ব্যাধির অপূর্ব্ব সমাচার। অসাড় বাক্যচ্ছটায় বিজ্ঞাপনের আড়ম্বর করিতে চাহি না। ব্যবহারে আমাদের পরিচয় লউন।’ বুকে বল না থাকলে এমন ভাষা বিজ্ঞাপনে ব্যবহার করা যায় না। আর এই বলই বাঙালির যৌনবল বাড়িয়ে চলেছে। কালে কালে, যুগে যুগে। শুধুমাত্র বিজ্ঞাপনদাতা আর প্রোডাক্টের নাম পাল্টেছে। এই একালে ২০২০ সালের একটা বিজ্ঞাপন দেখা যাক।
দিনকাল পাল্টেছে। সময় দ্রুত গতিতে এগিয়ে চলেছে। আড়াই টাকার ‘টাইট ব্রেস্ট’ এখন Rs. 2100/-র হয়েছে এবং দিনে তিনবার করে সাতদিনের চিকিৎসা এখন ২৮ দিনে পর্যবসিত হয়েছে। এইটুকু তফাত ছাড়া ‘আকর্ষণীয় মহিলা-বক্ষ’ বা ‘টাইট ব্রেস্ট’ আসলে একই। কেননা, বিজ্ঞাপনের সব বক্ষই বঙ্গীয় বক্ষ। কালে কালে, যুগে যুগে পঞ্জিকার বিজ্ঞাপন এমনই সচিত্র সমাজ বিবরণ দফায় দফায় বঙ্গীয় সমাজে পেশ করছে।
শেষের কথা অথবা ট্র্যাডিশনের গ্যারান্টি।।
পঞ্জিকা নাকি শিক্ষিত-পরিশীলিত-সংস্কৃতিমনস্ক… এই ধরনের বাঙালির ব্যবহারের বিষয় নয়। পঞ্জিকা ভীষণ সেকেলে এবং গেঁয়ো। সেখানে কেবল নানাবিধ জ্যোতিষ বচনার্থ, শুভাশুভ, ভক্ষ্য-অভক্ষ্য আর যাত্রানাস্তির দীর্ঘ তালিকা; সঙ্গে গাদা গাদা ‘রিগ্রেসিভ’ বিজ্ঞাপন। এই যেমন এতক্ষণ ধরে দেখছিলাম আমরা। কিন্তু সেই রিগ্রেসিভ বিজ্ঞাপন এখন পঞ্জিকার পাতা থেকে বেরিয়ে সংবাদপত্রের পাতায় ঢুকে পড়েছে। এখানেই আমার মনে একটা প্রশ্ন জাগে। পঞ্জিকার ব্যবহারকারী যাঁরা, তাঁরা পঞ্জিকার বিজ্ঞাপনগুলোয় যা দেখেন এবং যেভাবে দেখেন, আর সংবাদপত্রের পাঠক যাঁরা, তাঁরা সংবাদপত্রের বিজ্ঞাপনগুলোয় যা দেখেন এবং যেভাবে দেখেন, এই দুইয়ের মধ্যে কি কোনও দ্বন্দ্ব আছে? এই ২০২০ সালের ১২ নভেম্বরের আনন্দবাজার, বর্তমান ও ১৫ তারিখের এইসময় পত্রিকার তিনটে বিজ্ঞাপন পরপর দেখাচ্ছি--
আনন্দবাজার পত্রিকা, ১২.১১.২০২০
বর্তমান, ১২.১১.২০২০
এইসময়, ১৫.১১.২০২০
উপরের তিনটে বিজ্ঞাপন ভালো করে মন দিয়ে বেশ কয়েকবার পড়ুন আগে। তারপর ভাবুন সেই ১৮৯৫ সালের একটা বিজ্ঞাপন দিয়ে এই লেখাটা শুরু করেছিলাম। সেই থেকে শুরু করে এই যে ২০২০ সাল পর্যন্ত বিজ্ঞাপন বেয়ে বেয়ে এতটা পথ পেরিয়ে এলাম, এসে কী দেখলাম? যা ছিল অঙ্গে, তা-ই আছে বঙ্গে।
আমি পরীক্ষা করে দেখেছি পাঁজি তে রাশি ফল গুলো একটাও মেলে না !!কিছু গৎ বাধা লাইন দেয়া থাকে !! আর জ্যোতিষী দের কথা কি বলবো ।..সব ভন্ড !!!এটা একটা ব্যবসা ছাড়া কিছু নয় !!জোর করে একটা পাথর লাগিয়ে দিলো আমার হাতে।... কিছুই বুঝলাম না ।..শুধু শুধু কিছু পয়সা গচ্ছা !!নিজে এসব থেকে মুক্ত হলে কি হবে ।..চার পাশে সব চেপে ধরে না !!
দুর্দান্ত কৃষ্ণপ্রিয় দা
আমি আশ্চর্য্য হচ্ছি এটা ভাবে যে তখনকার মতো কনসারভেটিভে বাংলা সমাজেও এতো অনায়াসে যৌন দূষ্কৃয়তা নিয়ে বিজ্ঞাপন ছাপা হতো। আমি তো বলি বাঙালির এতো ধরনের হিপোক্রিসির মধ্যে এটিও আরেক ধরণের।