আমি বানিয়ে কিছু লিখতে পারি না। তাই গল্প লেখা আমার কম্মো নয় ধরেই নিয়েছি। লিখি, যা আমার চারপাশে ঘটে চলেছে নিত্যদিন, তাই নিয়েই। তাই আমার লেখায় স্কুলের "ফার্স্ট বয়" সহদেব আসে। পাড়ার মাতাল নিতাইদা আসে। প্রথম ভাল লাগা সেই কিশোরী মেয়েটি ঢুকে পড়ে কত লেখায়!!একজনের কথা লিখতে গেলেই আরো দু চারজনের কথা মনে পড়ে যায়। লিখে ফেলি তাদের কথা। আপনারা খুঁজে খুঁজে পড়েন সেই সব "হাবিজাবি" লেখা। এই আমার অনেক পাওয়া। আজ এক অশান্ত সময়ের আর একটি ছেলের কথা শোনাই আপনাদের।
অনেকবার লিখেছি আমাদের পাড়া ছিল নক্সালপন্থীদের দখলে। বাইরে টা সি পি এম। "পেটো"র শব্দ শোনা প্রায় অভ্যাসে পরিনত হয়ে গিয়েছিল আমাদের। কি ভয়ংকর ছিল সেই শব্দ যারা শোনেন নি তাদের বোঝানো অসম্ভব। বাহাত্তরে " নক্সালমুক্ত" হল আমাদের পাড়া। শুরু হল কংগ্রেস এর যুগ। তবে গণ্ডগোল প্রায় থেমে গিয়ে স্বাভাবিক হতে শুরু করলো আমাদের পাড়া। কেউ কেউ কখনো সখনো বেঁচে যাওয়া "পেটো" ফাটাতো। আমাদের মনে পড়তো কি ভয়ংকর সময় পার হয়ে এসেছি আমরা। কিন্তু সত্যি সত্যি দ্রুত স্বাভাবিক হয়ে আসছিল আমাদের পাড়া।
পঁচাত্তরে চাকরী পেলাম আমি। বন্ধুদের মধ্যে সবচেয়ে শেষে। উনআশি তে বিয়ে করলাম শম্পাকে। আশীর মাঝামাঝি মনে হয়। তখন আমাদের ফ্লাটেই আড্ডা মারতাম সবাই। এক রবিবার সকালে হঠাৎ ঘনঘন "পেটো"র শব্দ। একেবারে আমাদের ফ্লাটের সামনে। রাস্তার ধারের ঘরে বাবা থাকতেন। স্পিন্টার ঢুকে এল ঘরে। বাইরে থেকে চিৎকার করে কে বললো - জানলা বন্ধ করে দিন। আমাদের ফ্লাটে তখন বন্ধুরা সবাই। বেশ কিছুক্ষন পর অবস্থা শান্ত হলে বেরিয়ে শোনা গেল মিল্কডেয়ারীর ভাঙা বোতল আর স্ক্রাপ কে পাবে তাই নিয়ে দু দল কংগ্রেসী দের মধ্যে ঝামেলা। তখন বোতলে দুধ দেওয়া হত। বড় বড় দুধের গাড়ি বেরতো ভোরের আলো ফোটার আগেই। প্রচুর শব্দ হত। গাড়ির জার্কিং এ প্রচুর দুধের বোতল ভাঙ্গা পড়তো। সেই টেন্ডার কে পাবে তাই নিয়ে ঝামেলা। প্রায় শুরু থেকে একজনই পেত সেই বরাত। নতুন প্রতিদ্বন্দ্বী এসেছে।
প্রায় মাসদুয়েক চলার পর আগের জন রণে ভঙ্গ দিয়ে পালালেন এলাকা ছেড়ে।
সেই সময় সেন্ট্রাল ডেয়ারী কোয়াটার্সে একটি ছেলে থাকতো। বাচ্চা ছেলে। তখন বয়েস খুব বেশী হলে পনেরো। ধরা যাক তার নাম অরুণ। ভদ্রলোকের ছেলে। সে হঠাৎ ভীড়ে গেল এই নতুন দলটির সাথে। ওদের ফাইফরমাশ খাটতো। পরের বছর মাধ্যমিক পাস করলো। পাড়ার উঠতি মস্তান তখন অরুন। আমাদের কে কিন্তু সম্মান করতো। পেটানো চেহারা।
আস্তে আস্তে বড় হল সেই ছেলে। সেন্ট্রাল ডেয়ারী কোয়াটার্সেরই উঁচু ক্লাসে পড়া একটি মেয়ের সংগে গভীর প্রেম করতে দেখা গেল অরুণকে। দুজনের বাবাই আমাদের পরিচিত ছিলেন। ঘণিষ্ট ছিলেন না। দুজনেই প্রচুর চেষ্টা করলেন যাতে এই সম্পর্ক না টেকে। একদিন সেই মেয়েটিকে তার বাবা মা পাঠিয়ে দিলেন দুরে কোথাও। বেশ মনমরা দেখতাম সেই ডাকাবুকো অরুণকে। এভাবেই চলে যাচ্ছিল দিন।
একদিন অফিস থেকে ফিরে আড্ডা মারতে বেরিয়ে শুনি অরুণ সেই মেয়েটিকে নিয়ে পালিয়েছে। মেয়েটি তখন সাবালিকা। পুলিশে খবর দিলেন মেয়েটির বাবা মা। পুলিশ অরুনের কিছু বন্ধুদের জেরা করে জানতে পারলো যে ওরা কালিঘাটে বিয়ে করেছে। রেজিস্ট্রিও। মেয়েটি সাবালিকা বলে পুলিশ হাত গুটিয়ে নিল। কিছুদিন পর মেয়েটির বাবা ট্রান্সফার নিয়ে বাঁচলেন।
প্রথমে আমরা আশ্চর্য হয়েছিলাম কি দেখে অরুনকে পছন্দ করেছিল সেই মেয়ে? সম্পন্ন পরিবারের মেয়ে ছিল সে। তারপর কত দিন / বছর কেটে গেছে। ভুলেই গিয়েছিলাম ওদের কথা।
সেদিন গিয়েছিলাম সেন্ট্রাল ডেয়ারী কতগুলি আউটলেট করেছে কলকাতায় তার একটায়। বেশ বড় সেই আউটলেটটি। বেশ কিছু জিনিষ কিনছিলাম সেখান থেকে। যে দুজন বসে সেখানে তাদের বদলে অন্য একজনকে দেখলাম। মুখ দেখিনি তার। বলছিলাম - এটা দিন, ওটা দিন। হঠাৎ সেই ভদ্রলোক আমায় বললেন- আমাকে আপনি বলছো কেন বাসুদা? তাকিয়ে দেখি আমাদের অরুণ!! ঝকঝকে চেহারা। আমি বললাম তুই? বললো - এই আউটলেটটার ম্যানেজার আমি। জীবনে অনেকবার প্রকৃত আশ্চর্য হয়েছি আমি। এটা সেইরকম আর একবার। বললো - ভেতরে এসো তুমি আগে। গেলাম ভেতরে। বললো - মধ্যমগ্রাম স্টেশনের পাশেই বাড়ি করেছি বাসুদা। বললাম- ট্রেনে,যাতায়াত করিস? বললো - না বাসুদা, বাইকে আসি। পঁয়তিরিশ মিনিট লাগে। ছেলেটা জুলিয়ান ডে তে পড়ে।ক্লাস টেনে ওকে নামিয়ে দিয়ে আসি। বললাম - ( মেয়েটি) কেমন আছে? বললো - ভাল আছে গো। মধ্যমগ্রামের একটা স্কুলে পড়ায়। বাবা আছেন, মা নেই। ওর বাবা মাও মেনে নিয়েছে আমাদের এখন। তবে, তোমরা তো জানো ও (মেয়েটি) না থাকলে আমার কি হত?
রুপকথা নয় পাঠক, একশো শতাংশ সত্যি কথা।
চলে আসার সময় ভাবছিলাম না "সব গুটিপোকা প্রজাপতি হয় না" সত্যিকথা, কিন্তু কোন কোন গুটিপোকা সত্যি সত্যি প্রজাপতির মত সুন্দর হয়।
অরুণ আর ওর স্ত্রী তেমনই দুই সুন্দর প্রজাপতি।
ভাল থাক ওরা........।
আহা! মনটা ভাল হয়ে গেল।
খুব ই ভালো লাগে আপনার এই ধারাবাহিক লেখা .
Khub bhalo laglo sab holo.
আপনার লেখা বিশেষ ভাবে উপভোগ করি। এটাও খুব ভালো লাগল। আর এই গুরুচণ্ডালীর সাথেও পরিচিত হলাম। ধন্যবাদ।
এমন সাবলীল লেখা পড়তে ভালো লাগে।
মনকাড়া লেখা, সব কটি পর্বই।
সব্বাইকে আন্তরিক ধপ্ন্যবাদ।