# করোনাকালীন ( দুই)
এগারো
অদিতির ঘুম ভাঙল সাতটায়। অন্যান্য দিন ছ' টায় উঠে পড়ে।অন্যান্য দিন সাধারণত আটটা সাড়ে আটটার মধ্যে বেরিয়ে যায় স্কুটি নিয়ে ।লকডাউনে ওর'কাজ চলছে।হুহু করে পরিযায়ী শ্রমিক ঢুকছে।ছবি তোলা।ইন্টারভিউ নেওয়া। বেরোয় সারাদিনের মত।ব্রেকফাস্টটাই সবাই একসঙ্গে করে।
আজ বিছানায় শুয়ে শুয়েই ঠিক করল বেরোবে না।লকডাউন ইন ট্রু সেন্স। একদম বাড়িতে বন্দী থাকবে।পাশেই জানালার পর্দা সরিয়ে দিল টেনে।খুলে দিল জানলা এসি বন্ধ করে। একটা হলুদ ডানা ফড়িং এসে বসেছে গাছের ডালে।ডালটা একেবারে জানলা ঘেঁষা।কী স্বচ্ছ ডানার ফড়িং । জালি কাটা ডানাতে হলুদ রঙ আছাড়ি পিছাড়ি খাচ্ছে।কিচেনে টুকটাক শব্দ। মানে সুনিধি উঠে পড়েছে। নিশ্চয়ই চা ব্রেকফাস্ট তৈরি করছে। বেরোবে না ভেবেই বিছানাতে নিঃসাড়ে পড়ে থাকল অদিতি। বেশ ক্লান্ত শরীর। জোর পাচ্ছে না।ফোন খুলে দেখল একবার। দেবরূপের কোনো ওয়াপ মেসেজ নেই। ফোন নেই।
সকালে উঠেই অদিতি রোজ ফোন করে। আজ ওর খুব বিরক্ত লাগছে। হোয়াই ইজ দিস গাই গেটিং সো ডিফিকাল্ট? নিশান্তের সঙ্গে স্টিফ ব্যবহার করছে! যে নিশান্ত ওর প্রাণ বাঁচিয়েছে!
সো আনগ্রেটফুল! হাউ ক্যান ওয়ান বি সো কোল্ড?
অসুস্থ প্রেমিকের ওপর রাগ করে থাকা মুশ্কিল। যদিও সে এখন কমপ্লিটলি আউট অব ডেন্জার।অদিতি দুবার কল করতে গিয়েও থেমে গেল।গতকাল খুব মিন লেগেছে দেবরূপকে। অথচ ও মিনমাইন্ডেড নয়।পজেসিভ নয় বিশ্রী টাইপের।এই জন্যেই তো ভালো লাগে ওকে !
ছেড়ে দিল।থাক।করবে না ফোন আজ। নিশান্তকে ফোন করে বলে দেবে চলে যেতে চেকাপে। না বললেও অবশ্য যাবে নিশান্ত।ওভার পার্টিকুলার ম্যান।
অদিতি ফড়িং এর স্বচ্ছ হলুদ ডানা ভেদ করে একটা সবুজ পাতা দেখছিল।অনেক অনেকদিন বাদে একটা অলস দিন কাটাবে ঠিক করেছে। তারপর মাথার ভেতর টং করে উঠল।
দেবরূপের ব্রেকফাস্ট? সুস্থ থাকলে কোনো ব্যাপার না।হি ইজ প্রেটি কমপিটেন্ট ।ভালো রান্নাবান্না করতে পারে। কিন্তু এখন ও অসুস্থ ।মাথা টাথা ঘুরে যায় যদি!
কিন্তু কালকের ব্যবহারটা জঘন্য ছিল।হি শুভ হ্যাভ সেইড সরি। কিন্তু বলেনি।ফোনও করেনি। হতে পারে অসুস্থ।মন ভালো নেই।বাট হি শুভ বি রিজনেবল।
অদিতি আবার রাগ ও জেদ সংগ্রহ করলো বাইরে রোদের থেকে।তাপ বাড়বে ক্রমশ।যথেষ্ট গরম বৃষ্টি সত্ত্বেও ।রোদে রোদে ঘুরে ওর বাদামি ত্বক গাঢ়তর। মাথাটা ভারি। এখন স্নান করবে মাথা ভিজিয়ে ।তারপর বেরোবে ঘর থেকে। কোনো রিস্ক নেয় না ও।সুনিধি একবার নক করে গেলো।
দেরি হবে।শুয়ে শুয়ে বললো অদিতি। আদারওয়াইজ ভেরি মেচুওর। শান্ত। ধৈর্য্য আছে। কিন্তু পোস্ট কোভিড বড় গুমরে থাকা ছেলেটা মাথা থেকে যাচ্ছে না।কী খাবে ব্রেকফাস্ট? নিশান্তকে বলাই যায় বাড়ি থেকে কিছু করে নিয়ে যেতে।
ভেবেই হেসে ফেলল অদিতি । নিশান্তের বাড়িতে ইনভিটেশন শুনলেই দেবরূপ আগে একটা ওয়ান পট কিছু বানিয়ে নেয়। এগুলো প্রি কোভিড দিনের কথা।
দেবরূপ কুকস উইদ প্যাশন। তার নিজের মায়ের মত।মুমতাজের মত।সুনিধি খানিকটা। এই বাঙালিরা বড্ড রাঁধতে আর খেতে ভালবাসে।মানে রিচুয়ালি করে ব্যাপারগুলো।অদিতি খেয়াল করেছে।সুক্তোর সবজি কাটা আলাদা। ডালনা আলাদা।ইভন ডিফরেন্ট টাইপস অফ আলুভাজা।ঝিরিঝিরি।ডুমোডুমো অ্যান্ড অল দ্যাট।
তো এই ছেলে নিশান্তের বাড়িতে খেতে গিয়ে বসে আছে। মিসি রোটি এলো।ছোট কটোরিতে কালি দাল এলো। পেঁয়াজ ভাজা এলো।করেলা এলো বেসনের পুর ভরা।কটোরি আসছে পরপর । ভেন্ডিকা সবজি।দই। দেবরূপ এমন অল্প করে খাচ্ছে যেন এরপর জামবাটি ভর্তি ঘি চপচপে আলুফুলকপির ডালনা , পাঁঠার মাংস বা কাতলার মুড়িঘন্ট আসবে। অদিতি মায়ের হাতে এইসব রান্না অনেক খেয়েছে।দেবরূপ লাভস টু ইট হিয়ার। দ্য বেংগলি কানেকশন ওয়র্কস।
কিন্তু নিশান্তের বাড়িতে খাওয়া শুনলেই আগে রান্না করে রাখে ছেলেটা! ফিক করে হাসল অদিতি ।
বাট ইট ইজ সিরিয়াস। এখন কোনো আহ্লাদীপনা নয়।হি ইজ রিকাভারিং। কাউকে একটা বলে দেবে আজকের মত ব্রেকফাস্ট, লাঞ্চ, ডিনারের ব্যবস্থা করে দিতে। আজ কিছুতেই বেরোবে না সে। একদম না। টোট্যাল রেস্ট ।কোয়ালিটি টাইম উইদ পাপা অ্যান্ড সিস। অতুলকে ফোন করল শেষমেষ। উড়ে গেছে হলুদ ডানার ফড়িং ।এখন ডাল ফাঁকা। মা ' কে ছাড়া এই বাড়িটার মতই। ন্যাড়া ন্যাড়া সবকিছু।
স্যান্ডউইচ আর ফল নিয়ে যাবে অতুল।নো নিড টু ওরি। হি উইল গেট কম্প্যানি অ্যাজ ওয়েল।
একমাথা ভিজে চুল নিয়ে ব্রেকফাস্ট টেবলে তিনজন। মাথা শুকিয়ে নেয়নি ড্রায়ারে। ভিজে চুলে থাকলে মাথা অনেকক্ষণ ঠান্ডা থাকে। ইডলি বানিয়েছে সুনিধি। সম্বর টেস্টস রিয়ালি গুড। অসম্ভব ইনট্রোভার্ট একটা মেয়ে সুনি।পুরো লকডাউন বাড়িতে বসে কাটাচ্ছে।একদিনও বাইরে যায়নি।ইভন বাগানেও নামে না।ভয় পায়। যখন হার্টে অসহ্য যন্ত্রণা হয়, পুরো নীল হয়ে যায় ছটফট করতে করতে।চোখে দেখাও কষ্ট। অপারেশন হয়ে যাওয়া দরকার।নিজের জামাকাপড় নিজে কেচে মেলে দিয়েছে অদিতি । ডাইনিং এর পাশে ছোট লনে পতপত করে উড়ছে কাপড়জামা । অচ্যুত স্নান করে নেমেছেন। মাঝখানে প্লেটে স্তূপীকৃত ইডলি। দেবরূপ খেতে ভালোবাসে। ইশশ।কয়েকটা যদি পাঠিয়ে দেওয়া যেত!
পেপার স্যানিটাইজার দিয়ে স্যানিটাইজ করে নিয়েছেন খবরের কাগজ।অচ্যুত বরাবর ব্রেকফাস্ট টেবিলে কাগজ পড়েন।সুনিধি একটা গোলাপি কুর্তা পরেছে। ওর ফর্সা রঙে গোলাপি আভা।মায়ের মত। মুমতাজ ন'টার দিকে ফোন করবেন ।আম্ফানের পর নেট কানেকশন ছিল না পাঁচদিন। ভয়ানক দুশ্চিন্তা গেছে তখন।অচ্যুত বেছে বেছে আম্ফান রিলেটেড খবরগুলো পড়ে শোনাচ্ছেন।আর্মি নেমে গেছে ত্রাণে। তাই দুশ্চিন্তা অনেক কম।ইন্ডিয়ান আর্মি তুঝে সালাম।হেডলাইন।
দুই বোন পাশাপাশি বসে পা দুলিয়ে খেত সামনের দেওয়ালে বসে। লনের পরেই কোমর সমান দেওয়াল ।মুমতাজ দুই মেয়েকে দেওয়ালে বসিয়ে দিতেন । ছড়া বলত দুজন।প্রচুর বাংলা ছড়া শিখিয়েছিল মা। শিবঠাকুরের বিয়ে অ্যান্ড অল দ্যাট। ভুলে গেছে এখন।
সুনিধি সম্বর আনতে কিচেনে যাচ্ছে। অনেক লম্বা চুল হয়েছে ওর।রাতে বেণী বেঁধেছিল।সেটাই ।উস্কোখুস্কো দেখাচ্ছে।
অচ্যুত খবর পড়তে পড়তে অস্ফুটে ওহ্ নো বলে উঠলেন।
- ওয়াটস রঙ ?
- হরিবলি রঙ। একটা হাতি। আনারস খেতে গেছিল । আনারসের মধ্যে বম্ব ছিল। ইট এক্সপ্লোডেড। অ্যান্ড দ্য প্রেগন্যান্ট এলিফ্যান্ট ওয়েন্ট টু আ নিয়ারবাই পন্ড টু কুল হারসেল্ফ। শী ইজ ডেড।
সামনের প্লেটে পড়ে আছে ধবধবে সাদা নিখুঁত গোল ইডলি। ধূমায়িত চা। সুস্বাদু সম্বর। কোন সকালে উঠে সুনি করেছে এতসব।ইনফ্যাক্ট রোজ করছে।মায়ের অভাবটা ডাইনিং টেবিলে পুষিয়ে দিচ্ছে মেয়েটা।
বাইরে নিখুঁত হাওয়ায় উড়ছে কাচা জামাকাপড় । রোদের গন্ধ মেখে নিচ্ছে লুটোপুটি করে।সার্ফের উজ্জ্বল গন্ধ মিশে দৃশ্যান্তর তৈরি করছে উড়ন্ত কাপড়ের আড়ালে দেওয়ালে বেড়ালের চলাফেরার বিভিন্ন স্ক্রিনশট।
এইসব দৃশ্য খানখান হয়ে ভেঙে যাচ্ছে। ও দেখতে পাচ্ছে একটা বিশাল প্রাণী। তার মুখের মধ্যে বিস্ফোরণ ঘটেছে।গলগল করে রক্ত পড়ছে চোয়াল বেয়ে। দাঁতের ফাঁক দিয়ে । অনাগত সন্তানের ভার নিয়ে হাতিটি নেমে যাচ্ছে জলে।কষ্ট হচ্ছে।ভীষণ কষ্ট।
ও উঠে পড়েছে।খাবে না আর। অচ্যুত ফোনে ব্যস্ত।খেয়াল করেননি।
সুনিধি সম্বর এনেছে আরো।
ও মুখ ধুচ্ছে বেসিনে।
সুনিধি খুব শান্ত গলাতে বলল, আই হ্যাভ রেড ইট অন এফ বি। ওখানে লোকেরা খুব গরিব।ওদের আনারস খেয়ে যায় হাতিতে। লোক্যালিটিতে ঢুকে পড়ে।
দোতলায় নিজের ঘরে উঠে যেতে যেতে সুনিধির দিকে তাকাল ও।
ভীষণ রোগা, দুর্বল টাইপ বোনটাকে নিষ্ঠুর মনে হল।নাকি যন্ত্রণা পেতে পেতে ঠান্ডা হয়ে গেছে এমন!
ওপরে উঠে যেতে যেতে নিজেই একটা নীলাভ যন্ত্রণা টের পেল সেও। যেন ছাত থেকে নামছে চুঁইয়ে । কুয়াশার মত। টপ টপ করে পড়ছে। একটা মস্ত হাতি দাঁড়িয়ে আছে এক পুকুর জলে।এক মুখ বিস্ফোরণ নিয়ে।বোবা। অসহায় যদিও বিশাল।
কিন্তু তার জ্বালা যন্ত্রণা একটুও কমছে না।একটুও না।
তরতর করে সিঁড়ি বেয়ে উঠে যাচ্ছে অদিতি।যেন একধাপ করে যন্ত্রণা পার হয়ে যেতে চাইছে।যেন একটা করে ধাপ পার হয়ে ওপরে উঠে গেলে শান্তি।আজ ওপর থেকে নামবেই না, খেতে আসা ছাড়া।এখনো পর্যন্ত একবারও ফোন করেনি দেবরূপ।দিস হার্ডলি হ্যাপেনস।
সিরিয়াস কিছু হল না তো?
বুকটা ধ্বক করে উঠল অদিতির।( চলছে)
#করোনাকালীন (দুই)
বারো
হাত পায়ের কাঁচের আঘাতের দাগ এখনো প্রকট। ত্রিদিব ভোরে উঠে ল্যাপটপ খুলেছেন। সকাল আটটা থেকে মিটিং আজ।সব পেপার স্ক্যান করে রেডি রাখতে হবে । এম ডি নিজে থাকবেন।অনেকটা কাজ শেষ করে এনেছেন।মালবিকা অঘোরে ঘুমোচ্ছেন।আচ্ছন্ন ভাব একটা।ট্র্যাংকুলাইজার খেলে যেমন হয়।অনেকক্ষণ এরকম ঘুমে তলিয়ে থাকবেন ।শ্যামা এসে টেনে তুলবে।স্নান করাবে। দৈনন্দিন সমস্ত কাজ সম্পর্কে যেন একটা অনীহা এসে গেছে মালবিকার ।
এসি বন্ধ করে জানলা খুলে দিলেন ত্রিদিব। তাকানো যায় না বাগানের দিকে। সব গাছ একেবারে নুয়ে , ভেঙে পড়ে আছে। পাতা প্রিন্ট করা পর্দাটা টেনে দিলেন।থাক।এত ধ্বংসদৃশ্য আর দেখতে ভালো লাগে না।বুকে একটা চাপ ধরে আছে।
ঘরের বাইরে এলেন ।মেয়ের ঘরের দরজা বন্ধ ।ঝড়ের পর কেমন হয়ে গেছিল মেয়েটা। হাতে পায়ে তারই মত কাঁচ টাচ ফুটে একেবারে যা তা অবস্থা ।তবে খেটেছে খুব ঐ সময় ।জল ছেঁচে বের করা, কাঁচ তোলা,মালবিকার দেখাশোনা করা।সব সামলেছে।
শ্যামা আসার পর অনেকটা হাঁপ ছেড়ে বেঁচেছেন দুজনেই। রান্নাবান্না, ঘরদোর পরিষ্কারের দিকে আর ফিরে দেখতে হচ্ছে না।হোয়াট আ রিলিফ!
মালবিকার দায়িত্বও শ্যামার ওপর। ত্রিদিব বা টুপুর শুধু কোন ওষুধ কখন বলে দেন।
টুপুরও রেহাই পেয়েছে অনেক।একটু ঘুমাচ্ছে মেয়ে নিশ্চিন্তে । ও বেরোচ্ছে এখন। কোনো একটা রিলিফ ওয়র্কে যোগ দিয়েছে, ত্রিদিব অত জানেন না।তবে মুখ দেখে মনে হয় মুড ভালো থাকছে।যে যাতে ভালো থাকে তাই করুক।
ওদিকে বাবু সেরে উঠেছে । স্লাইট রিলিফ।
ভাঙা কাঁচ এখন রিপেয়ার করা যাবে না।না লিভিংরুমে।না ল্যান্ডিং এ। এখন সব পড়ে আছে তছনছ হয়ে । একটা ভয়ঙ্কর ঝড়ের সাক্ষী । ব্যালকনিতে বসলেন ত্রিদিব। শ্যামা ঠিক চা দিয়ে যাবে সময়মত।
এইসময়গুলো রিনাকে ফোন করেন তিনি। রিনাও ভোরে ওঠে।ছেলে ঘুমায় ।নিশ্চিন্তে নিরিবিলিতে কথা বলা যায় ।
আজকে রিনা একবারেই ফোন ধরল। ঝড়ের পর খুব টেনশনে আছে ও।জানালার কাঁচ টাচ ভেঙে একাক্কার। অবশ্য হাত পা কাটেনি ওদের। মা ছেলেতে এককোণে বসেছিল। রিনার ছেলে গোগোল ক্লাস টু। ত্রিদিব ওকে গুগল বলে ডাকলে খুব মজা পায় ছেলেটা। বেচারা বাপের আদর পায়নি কখনো।শান্ত শিষ্ট।পড়াশোনাতে ভাল। রিনা ওকে সেইন্ট লরেন্সে দিয়েছে।খুব খাটে বাচ্চার পেছনে। বর ছিল সিৎজোফ্রেনিক।খুব মারধোর করতো রিনাকে। ডিভোর্সের পর বেশ সুখে শান্তিতে আছে রিনা। চেহারা অনেক ভাল হয়েছে। ত্রিদিবের অনেকটাই জুনিয়র হলেও চল্লিশ তো পেরিয়েছে।কিন্তু কী ফিগার রেখেছে এখনো!
রিনার একটা গুণ বললে গুণ।দোষ বললে দোষ। ফোন তুলেই ওর যেটা প্রয়োজন বা প্রায়োরিটি সেটা ও পটপট করে বলে ফেলে। রাখঢাক নেই। যেমন এই ভোরবেলা, গরম তেমন নেই, ত্রিদিব ফোন করেছেন।কোথায় একটু মিষ্টি করে রোম্যান্টিক কথা বলবে, তা না, হুট করে বলল
- তুমি কি আজ একবার আসবে তরুদা? এলে দুটো এল ই ডি ল্যাম্প আর স্যানিটাইজার কিনে এসো তো। আলো গুলো খারাপ কিচেন আর বাথরুমে।খুব অসুবিধে হচ্ছে গো।
রিনা সহজেই লোকজনকে আপন করে নিতে পারে। কথায় কথায় আদুরে টানে " গো" বলে।সে তো ত্রিদিবের পাড়ারই মেয়ে । বিয়ের পর চলে গেছিল ব্যাঙ্গালোর । বরের কাছে মারধোর খেয়ে ছেলে নিয়ে ফিরে এসেছে কলকাতায় ।একটা চাকরিও জুটিয়েছে প্রাইভেট ফার্মে।খুব করিতকর্মা। কোনো ভণিতা নেই। একদম ক্লিয়ার কাট ।ঝকঝকে।স্মার্ট।
ত্রিদিব গেলেই বলে, এই তরুদা , চা করছি।জোম্যাটোতে কাটলেট আনাবে? কিংবা বলবে গোগোলকে পড়তে দিয়ে চলো লেকের ধারে ফুচকা খেয়ে আসি। ব্রেকফাস্ট করে আসি চিনেপাড়াতে ডাম্পলিং দিয়ে ।
লেকের ধারে ফুচকা খেতে বা রাস্তার ওপর ডাম্পলিং খেতে মালবিকা কখনোই যাবেন না। জ্যোমাটোতে কাটলেট বা ফিশফ্রাই আনিয়ে খাওয়াও তার পছন্দ না। বরং সব কিছু জোগাড় যন্ত্র করে বানাতে বসে যাবেন। বাইরে খেতে গেলে আগে থেকে ঠিক করতে হবে হায়াট না পিটার ক্যাট।গোলপার্কের ধারে চল্লিশটাকার বিরিয়ানি , যেটা বেঞ্চিতে বসে খেতে হয় সেটা খাবার কথা মালবিকা ভাবতেই পারেন না, সেটা রিনা অনায়াসে বসে খেয়ে নেবে। চেয়েও নেবে একহাতা।
রিনার কাছে এসে খুব রিল্যাক্সড বোধ করেন ত্রিদিব । কোলবালিশে হেলান দিয়ে বিছানাতে বসে পড়েন। পুরোনো অনেক গল্প গাছা হয়। রিনা বলে , বসো তরুদা। আমি চা করে নিই। জানো তো এই চা টা কিনতে গিয়ে মিনিদির সঙ্গে দেখা। এ মা, কী বুড়ি হয়ে গেছে গো। সব চুল পাকা।কোনো মানে হয়, কালার করলেই তো পারে।
এই চা কোনো ব্লু , গ্রিন নীলরক্তের চা নয়।একেবারে সিটিসি। কড়া করে দুধ , চিনি দিয়ে চা।ত্রিদিব পুরোনো দিনে ফিরে যান চায়ে চুমুক দিয়ে ।ববি প্রিন্ট শার্ট আর বেলবটম পরে রিনা কলেজ যাচ্ছে।
এই তরুদা।তুমি বড্ড ঘামছো গো। বলেই একলাফে এসে ওড়না বা আঁচল দিয়ে ত্রিদিবের দৃশ্যমান বা অদৃশ্য ঘাম মুছিয়ে দেয়। তখন ওর শরীর থেকে একটা অদ্ভুত লেবু লেবু গন্ধ বেরোয়। ও কিশোরীর মত হেসে ত্রিদিবের গলা জড়িয়ে ধরে বলে, ঘামটা শুকাক। তারপর ইউটিউবে গান চালিয়ে দুজনে একটু নাচব তরুদা।হ্যাঁ? বলেই টক করে ড্রেসিংটেবলে গিয়ে একটু লিপস্টিক মেখে এক পাক নেচে নেয়। তখন ত্রিদিব সত্যিই ঘামতে থাকেন। রিনা নির্দ্বিধায় ডাক দেয়, চলে এসো তরুদা।ফ্যানের নিচে।এই কোমরে হাত দাও।এইভাবে নাচো।ওয়ান টু। চা চা চা!
ত্রিদিবের মনে হয় তাঁর বয়স কুড়ি বছর কমে গেছে।অফিসের কাজের টেনশন একেবারে উধাও।পুরোদস্তুর টগবগ করে ওঠেন।পাড়াতে বিসর্জনে যেমন নাচতেন। আসলে নাচতে
আরেকটাও ব্যাপার আছে।রিনার সামনে যত ইচ্ছে উদোম খিস্তি দেওয়া যায় ।কাউকে চরম খিস্তি করলে বেশ হাল্কা বোধ করা যায় ।এটা রিনাই শিখিয়েছে তাঁকে।
রিনা নিজেও ব্যাপকহারে খিস্তি দেয়।বাড়িওয়ালা।বস। অফিসকলিগ। পাশের ফ্ল্যাটের বউ। ওর সবকিছুতে বেশ একটা মাখো মাখো ব্যাপার থাকে।এমনকী গালাগালিতেও।
রিনার খাটে উঠে মোটা পাশবালিশটাকে তাকিয়া বানিয়ে বসে ত্রিদিব একটি মুক্ত, দায়ভারহীন জীবন উপভোগ করেন ঘন্টা দুয়েক । ঐ সময়টা গোগোল একহয় সাঁতার বা পড়া বা ছবি আঁকার ক্লাসে থাকে। বাড়িতে " বান্চোত" শব্দ ব্যবহার করাতে মালবিকা তীব্র ঘৃণার দৃষ্টিতে তাকিয়েছিলেন। রিনা নিজেও বলে, ত্রিদিবকেও বলতে উস্কায়। ত্রিদিব বাড়ি ফেরার জন্য তাড়াহুড়ো করলে রিনা ত্রিদিবের থুৎনি নেড়ে দেয়।বলে , সুইট হারামি।
আজ বোঝা গেল রিনার মুড তেমন ভালো নেই।
- শোনো তরুদা। এলে বিকেলের দিকে তাড়াতাড়ি এসো। আমাকে একবার কাউন্সিলরের বাড়িতে যেতে হবে সন্ধেবেলা।ভোটার লিস্টে নাম নেই।আচ্ছা তোমার হাত পা কাটাগুলো শুকালো?
- না। শুকায়নি এখনো।শোন। আজ আমি যেতে পারব না।লকডাউনে যাওয়া ঠিক না।
- কেন গো? কতদিন আসো না। সেই লকডাউন শুরু হয়েছে পর থেকে দেখা নেই । চলে এসো। ঘুগনি বানাবো। কিমা দিয়ে খাবে না নিরামিষ?
লকডাউন গুলি মারো তো।সবাই বেরোচ্ছে।
ত্রিদিব চেয়ারে একটু ছড়িয়ে বসলেন । ইজি চেয়ারে ক্যাম্বিসের কাপড়।
- নারে। আজ আর যাব না। ঘা গুলো শুকাক। তুই কাউকে দিয়ে বাল্বগুলো আনিয়ে নে। অন্ধকারে থাকিস না।পড়েটরে গেলে কেলেংকারি হবে।
রিনা ফিচেল হাসে।মুড ভালো হচ্ছে ধীরে ধীরে।
- কেলেংকারির আর কী বাকি থাকল তরুদা?
- কেন, কেউ কিছু বলেছে নাকি?
- লকডাউনের আগে অফিসের সাগর বোস আর মিহির দাস।আমাদের কোল্ড ড্রিঙ্কস খেতে দেখেছে কোয়েস্টে। ফুডকোর্টে মুখোমুখি ।
- দুর'। ওতে কিছু হয়না। খেতেই পারি। ওসবে কান দিস না ।লোকজন জোটেও তোর।
- সিনেমা দেখতেও দেখেছে। ঐ যে গো। নগরকীর্তন দেখলাম যে কোয়েস্ট মলে। উফফ। ঋত্বিক কী কাঁদল বাবারে! লাস্ট কান্নাটা মনে আছে?
রিনার এটা দোষ।কোন কথা থেকে কোন কথায় চলে যায় ফস করে।বকেই যায় অনর্গল।
- বাদ দে। একদিন সিনেমা দেখতে দেখলেও কিস্যু হয় না।
- একদিন না।অনেকদিন দেখেছে।প্রিয়ার সামনে।নিক্কো পার্কে। ঐ জন্য তো তোমাকে বলি, বাইরে চলো।কলকাতার বাইরে। সে তো তুমি যাবে না।
রিনা ফোঁস করে একটা নিঃশ্বাস ছাড়ল।
ত্রিদিবের একটু বিরক্ত লাগল ।তিনি অত দুর্বার প্রেমিক নন। অফিস ঘর সংসার বজায় রেখে টেখে যেটুকু হয়। রিনা লাফিয়ে লাফিয়ে বড় বেড়ে যাচ্ছে
- বাদ দে তো। রাখছি ফোন।
ওপার থেকে রিনা একটু ঢং করে। এসব বেশ ভালো আসে তার।ত্রিদিব এপার থেকে দেখতে পান রিনা ঠোঁট ফোলাচ্ছে।পাউট করছে।
- আসবে না তাহলে? স্পষ্ট বোঝা যায় রিনা পেখম ছড়ালো। এবার বিপজ্জনক হবে।
ত্রিদিব থামালেন নিজেকে ।
- নাহ্। তুই আলোটা আনিয়ে নে। তাছাড়া সোশ্যাল ডিস্ট্যানসিং চলছে। হামি খাওয়া বারণ।
ওপাশে একটা ঢং এর শব্দ শুনতে শুনতে ফোন কাটলেন ত্রিদিব।মাথা ঘোরালেন।
মালবিকা দাঁড়িয়ে ব্যালকনির ঐ প্রান্তে।ঘন নীল কাফতান ও খোলা চুলে প্রেতিণীর মত।
একা।সকালবেলাটি যেন অন্ধকার হয়ে আছে।ত্রিদিবের মনটা কেমন নড়বড়ে হয়ে গেল।
রক্তিম ফোন করেছিল সকালে। লকডাউনে ভীষণ বোর হয়ে যাচ্ছে। একদিন কী সে আসবে টুপুরের বাড়ি?যদি সম্ভব হয়, আজ?
ক্লিন শেভ করে আফটার শেভ, ডিও সব চড়িয়ে আসবে।পোশাকে এতটুকু ভাঁজ নেই। ছোট থেকে দাদাকে এলোমেলো দেখেছে। পরিচ্ছন্ন কিন্তু বাতিক নেই। রক্তিমকে নিতে অসুবিধে হয় তাই।
টু ফ্যাস্টিডিয়াস।
টুপুর সচেতন হয়ে যায় সঙ্গে সঙ্গে । রক্তিম আসা মানেই ভীষণ ক্লান্তিকর একটা সময় ।কনস্ট্যান্টলি ওকে অ্যাটেনশন দিয়ে যেতে হবে। একেবারে সেলফ এনগেজিং নয়। কিছু না কিছু সাপোর্ট ওর চাই। ফিল্ম দেখতে চল।বা খেতে চল। লকডাউনে সেইসব বন্ধ ।ওর পাগল পাগল লাগছে। একা ঘরে বসে ফিল্ম দেখতে পারে না। লং ড্রাইভে গেলে বোর করে ছাড়ে।নিজের অফিশিয়াল কাজের কথা।কাকে ধমকালো।কাকে স্যাক করলো। কোন মেয়েকে সিডিউস করলো। হ্যাঁ ।রক্তিম এতটাই নিজেকে নিয়ে কনফিডেন্ট যে মেয়ে ঘটিত ব্যাপারগুলোও টুপুরের সামনে অবলীলায় বলে। এবং সেই দিন থেকেই টুপুর মনে মনে জানে যে সে তার মায়ের হিসেব মতো রক্তিমকে বিয়ে করছে না।কাজেই রক্তিম তার কোমর জড়িয়ে কাছে টেনে নেবে শরীরী খেলার জন্য, এরকম কোনো সিচুয়েশন সে তৈরিই হতে দেবে না। তার ডিসিশন নেওয়া হয়ে গেছে।শুধু ঘোষণা করা বাকি। এখন এড়াতে হবে। টুপুর অবলীলায় বলে দিল, "পাড়াতে অনেক কোভিড কেস ।না আসাই ভালো।তাছাড়া আমার নিজেরও একটু জ্বর জ্বর করছে।"
মোক্ষম দাওয়াই।সঙ্গে সঙ্গে দশহাত পিছিয়ে গেল রক্তিম।
বয়সের সঙ্গে সঙ্গে চেনা মুখগুলো অচেনা হয়ে যায় তখন তাদের চেনার চেষ্টা না করাই ভালো।এখন রক্তিম আসা মানে ওর নিজের কাজকর্ম নষ্ট।
আই আইটির গোপালি ইউথ ওয়েলফেয়ার সোসাইটি প্রায় দুহাজার দুস্থ পরিবারকে সাহায্য করে। টুপুর সেখানে কিছু অফিশিয়াল কাজ করে।অনলাইনে চিঠি পাঠাতে হবে।নতুন ব্রোশিওর এসেছে।সেইমত কাজ হবে। ওদের আইআইটিতে দুজন ছাত্র'কোভিড পজিটিভ ধরা পড়ার পর সমস্ত হস্টেল সিল্ড। স্টুডেন্টস সিনেটের চেয়ারম্যান নিনাদ লোহাকারে টুপুরকে একটা পিটিশন তৈরি করতে বলেছে ।প্রতিটি ছাত্র বা ছাত্রীকে দশ হাজার টাকা মেস ফি দিতে হয় মাসে।এবার সেটা মকুব হোক।সব ছাত্র ছাত্রীদের এটাই ডিম্যান্ড ।সেই লেখাপত্রের কিছু দায়িত্বও টুপুরের।অতএব সময় নষ্ট করা যাবে না। এসব মিটিয়ে অ্যাপের কাজ নিয়ে বসবে।গোটা একটা ফেজ গেছে নিজেকে ঘরে বন্ধ রেখে।এখন বেরোতে হবে। ইটস টাইম টু গো আউট।জাহিদের টিমের সঙ্গেই বেরোবে। ঘরে বসে থাকা ইউজলেস।আর হ্যাঁ ।মা সুস্থ হয়ে উঠলেই এটা পাবলিকলি জানাতে হবে।সে রক্তিমকে বিয়ে করছে না।
ল্যাপটপে অনলাইনে কাজ সেরে , আড়মোড়া ভাঙল। আয়নায় নিজেই নিজেকে পছন্দ হল না। জিনস নয়। একটা সূতীর ট্রাউজার পরে নিল। এগুলো খুব কমফর্টেবল।গরমে কষ্ট হয় না। সাদা ওভারসাইজড শার্ট পরল একটা। চুলগুলো চুড়ো করে মাথার ওপর বাঁধা। একটু পদে লাগছে এখন।সামার কুল লুক । মাস্ক বেঁধে নিল।মধুবনী ডিজাইন করা মাস্ক। বন্ধু বানাচ্ছে।বেশ কয়েকটা আনিয়ে নিয়েছে।
টিকটিকি ওপর থেকে দেখল।
- মোটেই সময় দিচ্ছো না আমাকে আর।
- তোমারি তো পাত্তা পাওয়া যায় না।
- ঝড়ে ভয় পেয়ে লুকিয়ে ছিলাম।এরকম ঝড় দেখিনি কখনো।
- আমিও দেখিনি। গত একশো বছরে এমন ঝড় হয়নি।ভাবতেও ভয় লাগে।
- অনেক দূরে যাচ্ছো?
- না। খুব দূর না। ফিরে এসে বলবো তোমায়।
টিকটিকি হাসল।
দরজা খুলে দিলেন ঈষৎ মাথা ঝুঁকিয়ে ইরফান খান। এক মুখ দাড়ি। হাসিতে বিষন্নতা ।
ও বেরোবার সময় উঁকি দিল মালবিকার ঘরে।চুপচাপ বসে আছেন।দৃষ্টি শূন্য।তবু ভালো উঠে বসেছে।ভাবল টুপুর।
মা।বেরোচ্ছি।
দুবার ডাকার পর মালবিকা ঘাড় ফেরালেন একটু।
ড.মজুমদার বলেছেন বারবার ডাকতে হবে। ইনভল্ভ করতে হবে ।যে কোনো কাজে।
এক বাটি আলু সিদ্ধ করিয়েছে শ্যামাকে দিয়ে ।হাতে ধরিয়ে দিল।
- একটু খোসা ছিলে রেখো তো।দম হবে।
মালবিকা কেমন এক অদ্ভুত চোখে তাকালেন ।ঘরটা ঠান্ডা।কেমন বিষন্ন ।আগের মত হেসে উঠছে না।শূন্য ফুলদানি।বেডকাভার পাল্টানো হয়নি কতদিন।শ্যামাদিকে বলতে হবে।
শ্যামা শ্যাম্পু করে দিয়েছে বলে চুল ফুলে ফেঁপে আছে মালবিকার।আধিদৈবিক উপস্থিতি যেন। অন্যমনস্ক ।উদাস। কঠিন।
সাইড টেবিলে আজকের খবরের কাগজ। বেরোবার আগে কাগজটা একবার হাতে নিল ও
দু' জন ডাক্তার মারা গেছেন । বয়স তিরিশের কোঠাতে। ফ্রন্টলাইন যোদ্ধাদের মৃত্যু শুরু হয়েছে । ঘরে বসে অনেকসময় কিছুই টের পাওয়া যায় না।(চলছে)
#করোনাকালীন ( দুই)
তেরো
শ্যামা ঘষে ঘষে রান্নাঘরের টাইলসের দাগ তুলছিল। সাদার ওপর হলুদ ফুল টাইলসে সহজে তেলময়লা ধরে।তার এতদিনের অনুপস্থিতিতে বৌদি নিজেই করেছে এইসব।কিন্তু একা হাতে অত কী আর পারে? যতই এক্সস্ট ফ্যান বসাও আর চিমনি বসাও, দেওয়াল ময়লা হবেই।আর যেরকম তেল মশলা ব্যবহার হয় এ বাড়িতে, চিমনিও একেবারে নোংরা হয়ে আছে।কেরোসিন তেল দিয়ে চিমনি পরিস্কার করলো শ্যামা ।সকালের জলখাবারের ব্যবস্থা হয়ে গেছে। টুপুর বেরিয়ে যাবে কাজে। দাদা কাজে বসে গেছে।
এখন অনেকটা সময় শ্যামার হাতে।তাই দীর্ঘদিন অযত্নে পড়ে থাকা রান্নাঘর সার্ফের জলে ধৌত হচ্ছে।সার্ফের সঙ্গে লাইজল মেশালে একটা তীব্র গন্ধ হয়।পরিস্কার পরিচ্ছন্ন গন্ধ ।গ্যাসের কোণায় কোণায় লেগে থাকা ময়লা, বার্ণারে উথলে ওঠা দুধের চিহ্ন,সব সাফ করেছে। এখন টাইলস। নোংরা সাফ করতে গেলে নিজের সঙ্গে হওয়া হাজার নোংরামি মনে পড়ে যাচ্ছে শ্যামার।
সংসারে যত অন্যায় সব শ্যামার সঙ্গেই হতে হবে বুঝি? অমন গুছিয়ে গাছিয়ে সংসার করছিল।কুটোটা নাড়তে হত না কাউকে।বেয়াক্কেলে ভগবান এক ঝটকায় ভেঙে দিল।বোন সূঁচ হয়ে ঘরে ঢুকে ফালা হয়ে বেরিয়ে গেল।
শাশুড়ি থাকত'এককোণে গার্জেন হয়ে পড়ে।তবু একটা গজগজ করার মানুষ তো ছিল। সেও গেল।ছেলেটা ভুগল।শ্যামার রোগ ধরল নিজের সেন্টারে যেতে হল।কম দুর্বল হয়েছে শরীর! কাজ করতে গিয়ে টের পাচ্ছে। সেখান থেকে বাড়ি ফিরেছে কী না ফিরেছে কী যে ঝড় এলো! চোখের সামনে সব শেষ ।বউদির দেওয়াপুরোনো ফ্রীজ কত যত্নে রেখেছিল । ফ্রীজটা তো উল্টে পড়ে গেল চোখের সামনেই। একে বলে পোড়া কপাল ।জিনিসপত্র গিয়ে একদিন দেখে আসতে হবে। যেটুকু রাখতে পারা যায় । তিল তিল করে যোগাড় করা সব।
টাইলসের ওপর থেকে ময়লা এমন করে ঘষছে শ্যামা, যেন তার কপাল থেকেই পোড়া দাগ ঘষে ঘষে তুলতে চাইছে।সে কী আর ওঠে! শ্যামা যেন যত জোরে পারে ঘষে যাচ্ছে স্ক্রচ বাইট। দূরে যাক।দূরে থাক সব আপদ। হঠাৎ কালুর কুৎসিত হাসিটা মনে পড়লে আরো জোরে টাইলস ঘষে।বউদি দেখলে রেগে কাঁই হয়ে যেত।এসব জিনিস জোরে পরিস্কার করতে হয় না।জানে শ্যামা
কিন্তু যখন রাগ চড়ে যাচ্ছে মাথাতে তখন আর জ্ঞান থাকছে না। শ্যামাকে যেন কিছুতে ভর করেছে। দাঁত কড়মড় করে ঘষে চলেছে তো চলেইছে।রান্নাঘরের দরজার পেছনে একটা ক্যালেন্ডার সাঁটা সেলোটেপ দিয়ে ।শ্যামাই সেঁটেছিল জানুয়ারি মাসে। দরজার পেছনটা ঝাড়তে গিয়ে হঠাৎ ক্যালেন্ডারের পাতায় চোখ পড়ল শ্যামার । এটা মে মাস না? হায় কপাল!
তারপর জিভ কাটল।
বাবলু এই বাড়িতেও এদিক ওদিক ঘুরে বেড়ায় ।কেউ কিছু বলে না। হরপ্রীতের কাছে যখন ছিল, তখন থেকেই তার' কিছুটা হলেও একটা ছন্নছাড়া ভাব এসেছে। ইস্কুল বন্ধ কতদিন।খেলা নেই। বাপ নেই। মাসে একদিন ইস্কুলে ডাকে।চাল , ডাল দেয়।বইয়ের সঙ্গে তার ভাবভালোবাসাও নেই
জলে ভেসেও গেছে বুঝি সব ।দোতলায় বড় ওঠে না সে।একতলাতেই মায়ের আসে পাশে ঘুরঘুর করে।টিভি চললে দেখে।যা হয়, তাই দেখে।বেশির ভাগ সময় খবর চলে।
বাবলুর ধারণা কোনো না কোনো একদিন তার বাবার খবর আসবে টিভিতে।তাই সে খবর শোনে।এ বাড়িতে আসার পর বাবলু কেবল বন্ধ দরজা দেখে। বস্তিতে সব খোলা দরজা থাকত।
দ্বিতীয় দিনে একটা বন্ধ দরজা হঠাৎ ন' টার দিকে খুলে গেল। বাবলু হাঁ করে তখন দেওয়াল ঘড়ি দেখছিল। দরজা খুলে বেরোল সেই মেয়েটা। যে দরজা খুলে চিৎকার করেছিল।রাগী রাগী দেখতে ।দরজা বন্ধ করে ঘরের মধ্যেই থাকে।
বাবলু এরকম সাজের মেয়েমানুষ টিভিতেই দেখেছে।বস্তিতে এরকম মেয়েছেলে নেই ।মেয়েটা টিভির মেয়েদের মত একটা হাঁটু পর্যন্ত প্যান্ট পরেছে।গায়ে ছেলেদের মত শার্ট। পিঠে ব্যাগ।মাথায় টুপি ।হাতে কালুদাদের মত উল্কিকাটা। বাবলু এবং সে পরস্পরকে খানিকক্ষণ দেখল।
মেয়েটা ব্যাগ পিঠে সোজা ফ্রিজের দিকে এগিয়ে গিয়ে ফ্রিজ খুলে দুটো আপেল বের করল। একটাতে নিজে কামড় দিল আরেকটা ছুঁড়ে দিল বাবলুর দিকে। বাবলু ক্যাচটা নিল কিন্তু আপেলটা হাতে ধরে দাঁড়িয়ে থাকল। মেয়েটা ধপাস করে একটা সোফাতে বসে পড়ে বলল, কোন ক্লাসে পড়িস?
বাবলু ক্লাস থ্রি। মেয়েটা এবার জিজ্ঞেস করল,
- পড়াশোনা করছিস?
ইস্কুলের ক্লাস বন্ধ হয়েছে পরের থেকে বাবলুর বইয়ের সঙ্গে সম্পর্ক নেই। ক্লাসের কথা মনে পড়লে ভালো লাগে না। টিভিও ভালো লাগে না। খেলতে ইচ্ছে করে।
মেয়েটা কচকচ করে আপেল খেতে খেতে বলল,
পড়তে বসবি আজ থেকে। যেটা পারবি না , জিজ্ঞেস করবি।বাবলু ঘাড় নাড়ল।মেয়েটা বলল
- বই আছে?
বাবলুর মা রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে এল।বিশাল এক টিফিনবাটি দিল মেয়েটার হাতে।
-কী দিলে শ্যামাদি?
-ঐ তুমি যা বললে।রুটি আলুভাজা।পেঁয়াজ দিয়ে নরম করে ভেজেছি।
-বেশি করে দিয়েছ তো? পাঁচ ছ' জন থাকবে কিন্তু।
- অনেক দিয়েছি।হয়ে যাবে তোমাদের।
বাবলুর মা ওকে রাতে কী খাবে জিজ্ঞেস করল। মেয়েটা বলল পাঁউরুটি টোস্ট খাবে। আর ডিমসেদ্ধ। বাবলুর রুটি মাংস খেতে ইচ্ছে করে।বা তড়কা।মাংস দিয়ে । বাবা মাঝেমাঝেই নিয়ে আসতো।বাপ ব্যাটাতে জমিয়ে বসে খেত রাতের বেলা।আসনপিঁড়ি করে বসে বাবলু রুটি ছিঁড়ে মাংস মুখে পুরতো। কত আনন্দ। ওরকম আর বোধহয় হবে না।বাবলু জানে যে বাবা ভেগে গেছে। জুহিমাসির সঙ্গে ।
বাবলুর মা আঁচলে হাত মুছতে মুছতে বলল, একটু পায়েস করেছি।খাবে? আজ বাবলুর জন্মদিন।
বাবলু মায়ের দিকে হাঁ করে তাকাল। আজ তার জন্মদিন? সে ভুলেই গেছিল।জন্মদিনে বাবা মাছ আর মাংস দুটোই আনত। কেক এনেছিল । ভেগে যাবার আগে।জামা দিয়েছিল একটা।গতবছর মা দিয়েছিল জামা।
মেয়েটার আপেল খাওয়া শেষ। বড়বড় রাগী চোখে বাবলুর দিকে তাকিয়ে থাকল। অনেক কাজল পরেছে বলে ধেবড়ে গেছে।
তারপর অনেকক্ষণ ঘাড় নাড়ল।বাবলুকে দেখল।যেন নতুন দেখছে।
বাবলুর মা' কে বলল,
তাহলে আজ রাতে লুচি মাংস করো। বড় বড় আলু দেবে। মা কি তোমাকে কেক বানাতে শিখিয়েছে?
শ্যামা বউদির কাছে অনেক কিছু শিখেছে।ছ্যাঁচড়া।মুড়িঘন্ট। পায়েস।নামানোর আগে এক চিমটে নুন দিলে স্বাদ খোলে । অর্ধেক বাতাসা অর্ধেক মিছরির পায়েস করে বউদি।
কিন্তু কেক করতে পারবে না শ্যামা ।মাইক্রোআভেনে কী সুইচ দিতে হয়, সময় হিসেব করে টরে, অত পারে না।
মেয়েটা আবার ভাবল। সব দোকান বন্ধ । ফোন বের করল।কত বড় ফোন ।এসব ফোনে গেম থাকে বাবলু জানে। তারপর কাকে ফোন করল।বাবলু শুনল, বলছে, তোর কেক হোম ডেলিভারি হবে? ফাটিয়ে তো ব্যবসা করছিস লকডাউনে। শোন ।এটা বার্থডে কেক। কী নাম হবে? এই তোর ভাল নাম কী রে?
শ্যামাই বলে দিল।রাজেশ। রাজেশ মিস্ত্রি ।
- হ্যাঁ ।রাজেশ নাম লিখবি।
মায়ের হাতে টাকা দিল মেয়েটা।বলল, শোনো ।কেক বাড়িতে দিয়ে যাবে ।টাকা দিয়ে দিও।আর মাংস আছে তো?
- ঘাড় নাড়ল শ্যামা ।তারপর বলল, হরপ্রীতকে একটু আসতে বলব?
- রাগী মেয়েটা তাকাল।তারপর বলল, ডেকে নিও। এসে যেন আগে সাবান দিয়ে হাত পা ধোয়। আমার জন্য ওয়েট করবে না।আমার রাত হবে।সন্ধেবেলা কেক কাটবে। মা' কে এনে বসাবে।মোমবাতি জ্বালবে।ঠিক আছে? বাবাকেও ডাকবে।
শ্যামা ঘাড় নাড়ল ।
আনন্দে চোখে জল এসে গেল বাবলুর। মাংস! লুচি! কেক! এর চেয়ে বেশি ভালো আর কী হতে পারে!
এই রাগী মেয়েটা বাবার চেয়েও ভালো তো।ভীষণই ভালো।
কাঁধে ব্যাগ ফেলে বেরিয়ে গেল টুপুর।শ্যামা দরজা বন্ধ করে ছেলের দিকে তাকিয়ে দেখল। বড় শুকনো লাগল মুখখানা ।বলল, যা স্নান করে নে। এদের বাথরুমে স্নান করতে বাবলুর বড় অসুবিধে হচ্ছে । এত যন্ত্রপাতি দেখে কেমন ভয় ভয় লাগে।চোখ দেখল শ্যামা ছেলের।
তারপর বলল, ছাতে কল আছে।পরিষ্কার করেছি অনেকটা। ছাতে স্নান করে নে যা।
গলির মুখে দাঁড়িয়ে টুপুর। রোদ বেশ চড়া। বড় গাছটা পড়ে গিয়ে কেমন ন্যাড়া ন্যাড়া লাগছে জায়গাটা।এখনো বেশ কিছু ডালপালা ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ে আছে।ইলেকট্রিকের কিছু তার জড়ানো। দোকানপাট বন্ধ । জাহিরকে ফোন করল একবার।কাছাকাছি এসে পড়েছে ওরা।মিনিট পাঁচেক লাগবে বললো।
কাছাকাছি কোনো গাছ নেই যে ছায়াতে দাঁড়াবে। কেমন রুক্ষ লাগছে শহরটা। তাদের বাড়ির মত।শ্রীহীন। ছায়াহীন।বেশ কিছু মাঝারি গাছও উপড়ে গেছে।
ক্রমশ পৃথিবী থেকে গাছ কমে যাচ্ছে। লকডাউন কালে দূষণের অভাবে ভারি মায়াময় সবুজে ভরেছিল শহরটা। দেখার কেউ ছিল না। না থাক।তাতে সবুজের কিছু আসে যায় না। ফুল নিজের আনন্দে ফোটে।আম্ফান এসে বুঝিয়ে দিল শহরে কত সবুজ ছিল। সব ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ে আছে।
এরপরেও মানুষ গাছ কাটবে।
ঘসসস করে একটা মারুতি সুইফট এসে দাঁড়াল সামনে। টুপুর তাকালো। কালো কাঁচ নামিয়ে এক মহিলা মাথা বাড়ালেন।চোখে সানগ্লাস আছে।তা সত্ত্বেও একনজরে মুখের কাটিং দেখেই বোঝা যায় মহিলার গ্রেস।জ লাইনটা দারুণ।
দরজা খুলে নামলেন গাড়ি থেকে ।টুপুর দেখল কালো চটির ফাঁকে পার্ল পিঙ্ক নখপালিশ। একটা বেবি পিংক চিকণকারি পরেছেন মহিলা।
- আচ্ছা , শোনো, তুমি করে বললাম। প্লিজ ডোন্ট মাইন্ড ।
ওঁর গলায় একটা সিম্পল পার্ল স্ট্রিংগ।
ত্রিদিব সেনগুপ্ত ।দ্যাখো এই অ্যাড্রেস। মোবাইল খুলে অ্যাড্রেস দেখাচ্ছেন। কোনদিকে বলতে পারবে?
শী স্মেলস মিন্ট।
সিভিক পুলিশ ছেলেটি গাড়ি দেখে রাস্তা পার হয়ে এলো।
মহিলা সানগ্লাস খুললেন।চোখদুটো বেশ পছন্দ হয়ে গেল টুপুরের।মায়ের বয়সীই হবেন।কোহল পরা চোখ।মাদকতা আছে।
- আই অ্যাম নিউ টু দিস প্লেস। আই অ্যাম ফ্রম পুনে। লুকিং ফর দিস হাউস।সেনগুপ্তাজ।
টুপুর অবাক হয়ে ওঁর মুখের দিকে তাকাল।( চলছে)
#করোনাকালীন (দুই)
চোদ্দ
নাগপুর কোভিড ক্যাম্পে সুখনলালের পাশে যে পঁয়ষট্টি বছরের বুড়ো ছিল, একদিন ভোররাতে তাকে হাসপাতালে পাঠাতে হল। ডায়াবিটিস ছিল।সঙ্গে আবার কিডনির দোষ।ভেন্টিলেশনে সে মারা গেল। সুখনলাল জানতে পারল রাতে।যখন ভলান্টিয়ার খাবার দিতে এল।
ক্যাম্পে সব খাবার আসে ফয়েল প্যাকে।রুটি চাল দুটোই থাকে।একটা দুটো সবজি।কখনো পনির। একটা মিষ্টি। ডিম রোজ ।খাবার বেশ ভাল।তবে একই আইটেম। কোনোদিন সয়াবিন দেয়। বিরক্ত লাগে সুখনের।রগরগে ঝাল খেতে মন চায় । তবে ক্যাম্প খুব পরিস্কার পরিচ্ছন্ন। ঝকঝক করে তিন বেলা ফিনাইল, লাইজল দিয়ে মোছা হয়। খাবারের স্বাদ প্রথমে ছিল না মুখে । জ্বর কমতেও সময় নিল।তবে পায়ের ফাটা আর তার ব্যথা সহজে গেল না। এখন সে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে হাঁটে।
ক্যাম্পের বাইরে গিয়ে বসে।
সামনেই একটা খোলা মাঠ আছে। জ্বর নেমে যাবার পর সুখনলালের খুব ইচ্ছে করে যে ঐ মাঠের সবুজ ঘাসে সে একটু হাঁটে।সকালবেলা মাঠটা ভেজা ভেজা হয়ে থাকে।তার কেন যেন মনে হয় যে ঐ ভেজা মাঠে হাঁটলে তার কড়া , ফাটা পায়ে একটু আরাম লাগবে। একটু চয়ন আসবে।কিন্তু খালি পায়ে খোলা মাঠে যাওয়া এখন তার বারণ। এখানে স্বেচ্ছাসেবকবাহিনী খুব সতর্ক। সাদা গেঞ্জি এবং খাকি বারমুডা টাইপের প্যান্ট পরে , প্রায় যান্ত্রিক দ্রুততায় তারা চার পাঁচটা ক্যাম্প ছোটাছুটি করে খবরদারি করে।তাদের মুখেই খবর পেল সুখনলাল। বাবুরাম নামে যে গোলমত মুখের ছেলেটা তাদের তোয়ালে , সাবান দিতে আসে, সেই নিচু গলায় বলেছিল, উও বুডঢা মর গিয়া। উও যো তুমহারে বগলকা বেডমে থা।
নাগপুরে তখন কোভিড মৃত্যুর সংখ্যা নয়।
ঠিক পাশের বেডে দিন পাঁচেক ছিল লোকটা । হাসিখুশি স্বভাবের ।সবাইকে ডেকে খুঁজে কথা বলত।মাথার চুল পড়ে গেছে সব প্রায়। বনোয়ারীলাল । বাড়িতে বউ আর তিন ব্যাটা। বাবুরাম ফিসফিসিয়ে আরো বলেছিল, কোই নহি আয়া ঘরসে বডি লেনে। উও পড়া রহা হাসপাতালমে সারাকা সারা দিন।ফির হাসপাতালওয়ালোনে জ্বালা দিয়া।
সুখনলাল শোনে আর তাজ্জব বনে যায়।বাপরে বাপ।এ কোন রোগ এলো দেশে।মরার পর কেউ ছোঁবে না।পুড়াতে নেবে না
মুম্বাইসে পয়দল নাগপুরতক। কম তো দেখল না সুখনলাল। তিনজনকে চোখের ওপর মরে যেতে দেখল।সে নাহয় রাস্তায় মরা। হাসপাতালের মরাকেও ছোঁবে না কেউ! ছোঁয়াছুতের কত ভয়।নিজের আওলাদ পর্যন্ত ছোঁবে না।এত ভয়। সুখনলাল নিজে তো কম ডাকাবুকো ছিল না বয়সকালে। এখন না হয় সে ছেলের বাপ।কিন্তু যখন বাপের ছেলে ছিল তখন বাপের লাথিঘুষি খেয়েছে প্রচুর।বাড়ি ছেড়ে ভেগেছে কতবার।কিন্তু বাপ মরলে তাকে পুড়িয়েছে তো সহি। নইলে ছেলে কিসের ! হ্যাঁ ।পুড়িয়ে তার কোনো দুঃখ হয়নি, সেইরাত্রেই ধামাকাদার মদ খেয়েছে, এসব ঠিক আছে। কিন্তু আগুন দিয়েছে মুখে। তারপর বন্ধুবান্ধব নিয়ে মদ খেয়েছে, সে আলাদা কথা।
এইসব আলোচনা হয় কোভিড ক্যাম্পে। তবে জ্বর কমার দুদিন পরেই এক নতুন নিয়ম চালু হল সুস্থ হয়ে ওঠা রোগীদের জন্য। রোজ বরাদ্দ হল চবনপ্রাশ আর অবিনাশ বলে একটা অত্যন্ত কর্মঠ চেহারার রোগা , ঢ্যাঙা ব্যক্তি ক্যাম্পে আসতে লাগল প্রাণায়াম আর যোগাসন শেখানোর জন্য ।ইউনিয়ন হেল্থ মিনিস্ট্রী প্রতিটি ক্যাম্পে নিয়ম করেছে। চবন প্রাশ খেতে হবে আর যোগব্যায়াম করতে হবে। আয়ুশ কোম্পানির জিনিস ব্যবহার করতে হবে।মিনিস্টার বলেছে।
অবিনাশ ক্যাম্পে দুবার আসে দিনে। একঘন্টা করে যোগাভ্যাস করায়।
ক্যাম্পে যারা আছে তারা বাপের জন্মে যোগব্যায়াম করেনি ।তবে নতুন অভ্যেস করতে গিয়ে সবাই প্রায় গড়াগড়ি দেবার জোগাড় ।সুখনলালের ফুটবল খেলার অভ্যেস ছিল। শক্তপোক্ত পেটানো শরীর। কোভিড কাহিল করলেও সে যোগব্যায়ামের বেসিকটা সহজেই ধরে নিল। ব্যাপারটা খারাপ না।সেইসঙ্গে আবশ্যিক হয়েছে হলুদ, মুলেথি, আয়ুশ ক্বথ আর সমসমানি বটি। এ একেবারে খোদ মিনিস্ট্রীর হুকুম। কাজেই ক্যাম্পে নিয়মিত ভাবে এগুলো দেওয়া হচ্ছে।
এতৎসত্ত্বেও সুখনলাল বাবুরামকে ম্যানেজ করে বিড়ি আনায় এবং লুকিয়ে ফুঁকে আসে।বিড়ি না খেলে বেগ আসে না পায়খানার।
একমাত্র ঐ সময়ে ।একমাত্র ঐ সময়েই সুখনলালের বাড়ি, শ্যামা এবং ছেলের কথা মনে পড়ে।হেড মিস্তিরির কামাই তো খুব খারাপ ছিল না।ছাত ঢালাই দেবে দেবে করছিল। বাড়িতে ছোকরা মিস্তিরা এসে বেশ গণ্যিমান্যি করেই কথা বলত। তখন নিজেকে একটা কেউকেটা মনে হত সুখনের। রাজা রাজা ভাব। বাচ্চা মিস্তিরিগুলো তো পারলে পা টিপে দেয় কাজের জন্য ।শ্যামা এসে বলত, উঠে পড়ো।নতুন মিস্ত্রি এসেছে দেখা করতে। সেই কোন ভোরে উঠে রান্না করতো শ্যামা । কাজের বাড়ি যাবার আগে সুখনের, ছেলের জন্য ভাত, তরকারি নামিয়ে , শাশুড়ির ভাত বসাতো নিরামিষ উনুনে। সে উনুনে আঁচ পড়তো ভোর পাঁচটায় । নিজেদের রান্না গ্যাসে। হেড মিস্ত্রি একটু বেলা করে ঘুমাতো।মাথায় গামছা বেঁধে শ্যামা তখন চা নামিয়ে যেত ঠক করে।সঙ্গে দুটো টোস্ট বিস্কুট। নতুন মিস্ত্রি বেচারা হত্যে দিয়ে সিঁড়িতে বসে আছে। বছর ষোলো বয়স। কাজ চাই ।কাজ। শ্যামার প্রাণে দয়াধম্ম ছিল।শাশুড়ির নামে গজগজ করতে করতে ভাতের হাড়ি নামানোর ফাঁকে ছোঁড়াটাকে এক কাপ চা, দুটো টোস্ট ধরিয়ে দিত।
এইসব গতজন্মের কথা ভাবতে ভাবতে সুখনলাল বিড়ি খায়।এইসব সুখটানের সঙ্গে শ্যামা আর সুখনের উথালপাথাল প্রেমকাহিনী জড়িয়ে আছে।অবশ্য ভালোবাসা টাসা নিয়ে সুখন কোনোদিন মাথা ঘামায় নি।মোদ্দা কথা, শ্যামা ছাড়া তখন তার চলতো না। শ্যামাও তো সে যেমনটি চায় তেমনটি যুগিয়ে যেত।বউ মানেই তো তাই।কোনো খামতি রাখেনি সংসারে।এমনকি ব্যাটাছেলে বিইয়ে বংশরক্খাও করে দিয়েছে। তবু যে কেন জুহিতে মজল। অনেকদিন বাদে জুহিকে মনে করে গালে হাত দিয়ে ভাবতে বসল সুখনলাল।
ল্যাট্রিনে মাথার ওপর টিন। তাই গরম লাগছে বেশি।কিন্তু বড় নিরিবিলি জায়গা।
বিড়ি টানার জন্য, ভাবার জন্য' ল্যাট্রিনের জবাব নেই।অবশ্য'দোরগোড়ায় কেউ এসে দাঁড়ালে বিড়ির গন্ধ পেয়ে যাবে। পেলেই রিপোট।একটু আবডাল দেখেই তাই ল্যাট্রিনে ঢোকে সুখন।
আসলে শ্যামা তখন বড় ব্যস্ত ছিল। সংসারের কাজটুকু সামলেই দৌড়াত কাজের বাড়ি ।আরে বাবা হেড মিস্তিরির ইনকামে কী সংসার চলতো না? নাহয় ছাত দুবছর বাদে ঢালাই হত। খেটে খেটে শ্যামার চেহারাও হয়েছিল পোড়া কাঠের মত। সেই সময় জুহি এল। অমন ঝলমলে ঢলঢলে চেহারা।দিব্যা ভারতীর মুখ কেটে বসানো ।চোখ মুখ একেবারে টলটলে।
অনেক ভেবেও সুখন নিজের দোষ খুঁজে পেল না।তার জায়গায় যেই থাক , মরদের বাচ্চা, জুহিকে নিয়ে ভাগতই।তার দোষ ছিল না তেমন।তবে কিনা শ্যামা মানুষটা ছিল সাচ্চা। সংসারকে একেবারে তকতকে রাখত।সব হাতের কাছে। খাটতেও পারত খুব। সাচ্চা বলেই শ্যামার সামনে গিয়ে দাঁড়াবার আগে হাজারবার ভাবছে সুখন।
দরজা ধাক্কা দিল কেউ। টাইম আপ।
সকালে একবার সই করতে হয়। তারিখের নিচে সই। সুখন আঙ্গুঠা না। সই দিতে দিতে তারিখ দেখে তার মনে পড়ল , আজ ব্যাটাটার জন্মদিন।
কিন্তু সুখনের ফোন খারাপ হয়ে গেছে।নিজের ফোন থেকে ডিলিট সব নম্বর।যদিও শ্যামার নম্বর মনে আছে তার ।তবু পরের ফোন চেয়ে নিয়ে দুবছর দেখা না হওয়া বউয়ের সঙ্গে কথা বলতে পারবে না সুখন। তবে কী করবে সে কলকাতায় ফিরে?কাজের কোনো কথাই নেই এখন।
ক্যাম্পে খাওয়া খুব পুষ্টিকর।সকালে চারপিস পাঁউরুটি ।দুটো কলা।দুটো ডিম।এক কাপ দুধ দিয়েছে হলুদ মিশিয়ে।বাপের জন্মে এমন খাওয়া সকালে খায়নি সুখনলাল। অনেকেই খায়নি।সুখনের পায়ে হাঁটা পথে ছিল আটা গোলা জল।কদাচিৎ খিচুড়ি । নির্মল বলে ছেলেটা তো বলেই ফেলল, ক্যাম্পে রেখে দিও আরো কয়েকদিন।বাড়িতে গিয়ে এমন খাওয়া কোথায় পাব?
ক্যাম্প থেকে বেরিয়ে মানিকদার সঙ্গে কথা বলতে বলতে সুখন দেখল রাস্তার ওপারে জেনানা ক্যাম্পের সামনে দাঁড়িয়ে সুমিরণ। এ হল সেই গর্ভবতী মেয়ে যে ডাক্তার দেখাতে এসে আর বাড়িতে ফিরতে পারেনি।বাড়ির লোক খোঁজও'করেনি।তিনটে মেয়ের পর আবার যদি মেয়ে হয়? কী হবে খুঁজে।বড় মেয়ে দুটো বাড়িতে আছে।ছোটটা আর পেটেরটাকে নিয়ে সুমিরণ কোভিড ক্যাম্পে । ভালো খাওয়া দাওয়া পেয়ে বেশ দেখাচ্ছে তাকে।সুখনলালের চোখ সুমিরনে আটকে গেল।
পায়ের ব্যথা বেশ কমেছে।পেটের যে সমস্যা ছিল তাও কম। শরীর ভালোর দিকে যাচ্ছে।ফিরে আসছে শক্তি । সুখনলাল দেখল সুমিরণকে লাল একটা শাড়িতে দিব্য সুন্দর লাগছে। (চলছে)
সুখনলালের বস্তির পিছনে দিব্য একখানি পুকুর ছিল।সুখন বস্তির কলে স্নান করতো না।সকাল সন্ধে পুকুরে ঝাঁপাত।শীতকালেও । ছেলেটাকে সাঁতার শিখিয়েছে হাতে ধরে। কখনোসখনো শ্যামাও যে আসতো না , তা তো নয়। ছুটি ছাটা থাকলে, মন মেজাজ ভালো থাকলে তিনজনে মিলেই আসতো পুকুরে।একদিকে বাসন মাজার ঘাট।একদিকে স্নানের। ঘন্টাখানেক পুকুরে উথালপাথাল স্নানের স্মৃতি মনের কোণে ঘাপটি মেরে থাকে।
সুমিরণের দুচোখে একটা আস্ত দীঘি আছে।দেখল সুখন। এই যে কোলে একটা, পেটে একটা নিয়ে ক্যাম্পে পড়ে আছে, বাড়ির লোক খোঁজ নেবার নাম
করে না, তাও বউটার মুখে কোনো তেমন দুঃখটুঃখ নেই।অথবা দুঃখ আছে, কিন্তু ওর মুখটাই ঐরকম।মন ধরা পড়ে না।ঢলঢলে।শান্ত। সুখনের মুখের দিকে তাকিয়ে ভারি মিষ্টি হাসল সুমিরণ।
#করোনাকালীন (দুই)
পনেরো
সুমিরণের মনে ঘোরপ্যাঁচের জায়গা নেই।বিলকুল সিধাসাধা। পনেরো বছর বয়সে বিয়ে, ষোলোতে প্রথম মেয়ে, আঠারোতে দ্বিতীয়টা।তিননম্বরেরটা একটু দেরি করে নিয়েছিল।যাতে ছেলে হয় সেজন্য একটা মান্নত রেখেছিল সুমিরণ, তার বর আর শাশুড়ি ।সপ্তাহে দু'দিন উপবাস আর মঙ্গলবার করে উপাচারী মন্দিরে জল ঢালতে যাওয়া ।পায়ে হেঁটে।খুব মন দিয়ে, ভক্তিভরেই সেসব করেছে সুমিরণ। বংশধর বলে কথা।ব্যাটা বিয়োতে না পারলে কী করে চলবে।কাজেই তাকে যখন যে যা বলেছে তাই করেছে।।উপোস করেছে।পুজোপাঠ তো লেগেই আছে। মান্নত করে একেবারে বৈষ্নোদেবী পর্যন্ত পুজো দিয়ে এসেছে দন্ডি
কেটে।
তার চেহারাটি বড় মায়াভরা। অনেক আদরে থেকেও মেয়েদের এই লাথি ঝাঁটা খাওয়া তিন মেয়ের মায়ের লাবণ্য থাকে না।হাসলে গালে একটা চমৎকার টোল পড়ে। ডাক্তার দেখানোর জন্য সে সাকুল্যে তিনখানা শাড়ি নিয়ে বেরিয়েছিল।একটা তুঁতের ওপর হলুদ ফুল।একটা লালের ওপর কালো।আরেকটা বেগুনি ।ঐ তিনটে শাড়িই সে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে পরছে।এন জি ও থেকে একটা সাদা শাড়ি পেয়েছে।সেটা পরলেও তাকে খুব স্নিগ্ধ দেখায়।সাদা শাড়ি হলুদ পাড়।তবু তার বর কোনোদিনই তার দিকে তেমন চেয়ে দেখেনি। সে নিষ্কাম কর্মযোগ না জেনেই পালন করে এসেছে বাড়ির সকলের মন জুগিয়ে ।
তবু যখন তিননম্বরেরটা মেয়ে হল, তখন সবাই হাল ছেড়ে দিল। বরের আবার সম্বন্ধ দেখা শুরু হয়েছে, কথাবার্তা চলছে, সেই সময় সুমিরণ আবার গর্ভবতী হল। মেয়ে পক্ষ ছেলে দেখতে এলে তাকেই চা করে দিতে হয় ।পোহা বানিয়ে দিতে হয়। সুমিরণ তাতে কিছুই মনে করে না। এতো হবেই।সে যদি ব্যাটা বিয়োতে না পারে তাহলে দোষ তো তার। কাজেই নাগপুরে ডাক্তার দেখাতে তাকে একাই আসতে হল। এবার আর কেউ কোনো আশা করেনি।চারনম্বরটাও মেয়ে হবে ধরেই রেখেছে। এই বউ ছেলে পেটে ধরতে পারবে না।
নাগপুরে লকডাউন শুরু হয়ে গেল। চেক আপে তো কম ঝামেলা ছিল না।হাসপাতালে আউটডোরে লম্বা লাইন।দুদিন ধরে লাইন দিয়ে তবে দেখাতে পেরেছে। বাড়ি ফিরতে পারেনি আর। জ্বর , শুকনো কাশি আর ছোট মেয়ে ।এই তিন সঙ্গী নিয়ে সুমিরণ রাস্তায় পড়েছিল।সেখান থেকে ক্যাম্পে।এর মধ্যে কোনো খোঁজ নিল না কেউ। তবু সুমিরণ হাসে।ভাবে লকডাউন উঠে গেলে প্রথমে বাস , তারপর ছোটা হাতিতে করে ফিরে যাবে গ্রামে। বেটা হবে এবার।সবার মুখে হাসি ফুটবে। আর বেটি হলে কী হবে সে ভাবতে হাত পা ঠান্ডা হয়ে আসে।পিটিয়ে হয়তো মেরেই ফেলবে বাড়ির লোক।বাপের বাড়িতে যাবার উপায় নেই কোনো। বুড়ো বাপ ।মা নেই।ভাই আর দাদা।তাদের'বউরা একটুও দয়া করবে না তাকে। বড় মেয়েদুটোর'জন্য বুক কাঁপে। বয়স খুব বেশি না তাদের।তারপর জন্মের বেশি তফাত না থাকাতে শরীরে পুষ্টি কম। লীলা আর রোমা। ঐ চিন্তাটাই একটু খেয়ে যায় ভিতরে ভিতরে ।তবে সুমিরণ এও জানে যে বেটি সন্তানদের ঝট করে কিছু হয় না।তারা মাটি কামড়ে পড়ে থেকেও বেঁচে যাবে। লাথি ঝাঁটা খাবে কিন্তু মরবে না। আর বৈষ্নোদেবী মায়ের দয়াতে তার মেয়েগুলো সুন্দর। চোদ্দ পনের হতে দেরি। ঠিক বিয়ে শাদি লেগে যাবে।
তাই সুমিরণ হাসে। যে সামনে পড়বে তাকে দেখেই সে দিলসে হাসে। সুখনলাল কোনো ব্যতিক্রম ছিল না।
সুখনলালের চোখে সূমিরণের হাসি লেগে থাকল। পয়দল চলা শুরু হয়েছিল পর থেকে মেয়েমানুষের কথা ভাবার সময় ছিল না তার।শরীরও ছিল না। রাস্তাতে গ্রামের বউরা না খেতে পেয়ে বেশ্যাবৃত্তি করেছে , সুখনকে ডেকেওছে। পকেটে পয়সাও নেই।শরীরে তাগতও নেই। সুখন পেটব্যথাতে অস্থির তখন। কোভিড ক্যাম্পে থেকে ভালো খেয়ে দেয়ে , শরীর মন আবার ঠিক হতে শুরু করেছে।কোভিড মরণকামড় দিতে দিতে ছেড়ে দিয়েছে।একি কম বড় বাঁচা। তাই সুমিরণকে দেখে তার মন খুশি হল। দুজনেই পড়েছিল রাস্তার মধ্যে।প্রায় বেহোশ। দুজনেই যে সুস্থ হয়ে উঠেছে, ঘুরে ফিরে বেড়াতে পারছে, এর চেয়ে সুখ আর কীসে।তাছাড়া সূমিরণের হাসিতে ভারি একটা মিঠাস আছে। দিল জুড়িয়ে যায় । অনেকদিন বাদে সুখন উজ্জীবিত হল।নিজেকে একটু ভালো লাগল তার।নাগপুর থেকে টেরেইন যে ধরা হল না, সে দুঃখ ঘুচলো কিছুটা।
জালালুদ্দিন এবং মিরাজ দুজনেই সুরাট থেকে ফিরছিলো। এদেরও প্ল্যান ছিল টেরেইন ধরার।কিন্তু সরকারি নিয়মে আটকে পড়ে সেই গুড়ে বালি। এরা দুজন নিয়মিত খবরের কাগজ পড়ে। সুখনলালকে হাত নেড়ে ডাকল । ওদের , মানে যারা সেরে উঠেছে তাদের একটি সীমায়িত গন্ডির মধ্যে একঘন্টা হাঁটাহাটির সময় দেওয়া হয়। এখানে নিয়ম খুব কড়া।
মিরাজ আলি গুজরাটে সেলাই করতে গেছিল।পাকা হাত অ্যাপ্লিকের কাজে। সেই কাগজ পড়ে শোনাল। টেরেইন তো যাচ্ছিল । স্টেশনে জল খেতে নেমে মরে পড়ে থাকল এক মা। জন খাটত আহমেদাবাদে । পেট খালি। জলটুকুও জোটে নি।টেরেইন ভরতি লোক।গাদাগাদি ভীড়। আবার টিভিতে বলে দুরে দুরে থাকো। মাস্ক পরো। ঐ ভীড়ে খাবার নাই।যদিও দেবার কথা ছিল।
স্টেশনে মরা মা' কে টেনে টেনে তুলতে চাইছিল দুবছরের ছানাটা।
বুঝতেই পারে নাই যে মা মরে গেছে। আর ঐ মরা
তো সহজে ছোঁয়াও যাবে না।পড়েই থাকল। কত ছবি উঠল। ক্লিক ক্লিক।
সুখনলালের মনে পড়ল তার ফাটা পায়ের ছবি উঠেছিল কত। সে কী ছবি তোলার ধূম।বাপরে। পয়সা নিলে হত পায়ের ছবির ।এখন ভাবে সুখন।তা এ মেয়েলোকটার ডেডবডির ছবি যেই উঠল কাগজে চারদিকে হৈচৈ পড়ে গেল।
শারুখ খান নাকি বাচ্চাটাকে দত্তক নিয়েছে।কাগজে লিখেছে।মিরাজ নাইন পাশ।
শারুখ খান যে দেবতা এই নিয়ে জালাল, মিরাজ ও সুখন, কারুর কোনো সন্দেহ নেই। বাচ্চাটার জীবন তৈরি হয়ে গেল।
মুম্বাইতে থাকতে শাহরুখের বাড়ি দূর থেকে দেখে এসেছে সুখন । জুহির বায়নাতে। তাহলে বাচ্চাটা মান্নতে থাকবে? শাহরুখের ছেলেমেয়ের সঙ্গে?মান্নতে নাকী একশো চল্লিশটা ঘর। আই বাপরে। এ তো মা মরে রাজা বন গিয়া।
মিরাজ অবশ্য খানিক পড়ে জানাল যে বাচ্চা শাহরুখের বাংলোতে থাকতে পারছে না। একটা অনাথ আশ্রমে থাকবে ভাগলপুরে।খাওয়া পরা , লেখা পড়ার সব খরচ শারুখের।সারা জীবন। সে
ও কী কম।
ওরা ধন্দে পড়ে।দত্তক নিল তো বাড়িতে নিল না কেন।দত্তক নেওয়া ছেলে তো বাড়িতেই থাকে। এ কী তবে হিন্দু বাচ্চা? জালাল বলল, দূর, শাহরুখের বউ তো হিন্দু। ওসব কিছু না । আসলে লেবার ক্লাসের বাচ্চা তো।বাড়িতে রাখবে না।
সুখন বলল, মিঠুন কিন্তু ডাস্টবিনে কুড়ানো মেয়ে পেলেছে। সে আবার সিনেমাতে নামবে।
এরপর মিঠুন ও শাহরুখের উদারতার একটি তুলনামূলক নিবিষ্ট আলোচনা চলতে থাকে।শারুখ আর গৌরী ডেলি নাকী একলাখ লোককে খাওয়াচ্ছে করোনার জন্য। এ ও কাগজে লিখেছে।যতই হোক, হিরো হয়ে কিন্তু উঠে আসে সোনু সুদ। লোকটা পর্দার ভিলেন বটে কিন্তু এ সময় পুরো হিরো।কত লোককে যে নিজের খরচায় বাস ভাড়া করে বাড়িতে পাঠিয়েছে। ফ্রি রেশন পর্যন্ত দিয়েছে। শাহরুখের নেওয়া ছেলেটা নিয়ে সুখনলালের একটু কিন্তু কিন্তু থেকেই গেল।ভালো হয়েছে হোমে গেছে ছোঁড়াটা।
ক্যাম্পে এদের পেটে খাবার আছে।পরিচ্ছন্ন বিছানা ও শৌচাগার আছে।অতএব ভালো আছে।
অতএব মিঠুন , শাহরুখ ও সোনু জীবনদেবতা হয়ে ওদের মনে বসবাস করতে থাকেন ।
মা মরে যাওয়া অনাথ শিশুটি ভাগলপুরের অনাথআশ্রমে । সে বুঝেই পায় না তার মা গেল কোথায় ।খালি কাঁদে।খেতে পেলে থামে।ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকে। শাহরুখের সেক্রেটারি একদিন গিয়ে তার সমস্ত ব্যয়ভার কর্তৃপক্ষের হাতে চেকে দিয়ে আসেন। ছবি তোলা হয়।সাংবাদিকদের ভিড়ে শিশুটি হতভম্ব ।তার জন্য চকোলেট নিয়ে গেছেন অনেকেই। সেক্রেটারি তাকে নিয়ে ছবি তোলেন।লোকমুখে কথিত শাহরুখ নিজেও আসবেন শিশুটিকে দেখতে।কিং খানের আসার আশংকায় ও আনন্দে হোমবাসীরা শিহরিত হয়।
সব সাংবাদিক ও সেক্রেটারি সাহেব চলে গেলে নাক দিয়ে সিকনি গড়ানো বাচ্চার গালে এক থাপ্পড় দিয়ে আয়া বলে, চল, খানা হ্যায় তো খা লে।নই তো মর আপনি মা কি তরহা।সারাদিন রিপোর্টার ও ছবিওয়ালাদের সামনে তাকে বাচ্চা কোলে হাসি মুখে পোজ দিতে হয়েছে।খুব বিরক্ত লেগেছে তার । সে নিজে ক্ষত্রিয় । কোন বেজাত কুজাত কোলে নিয়ে ঘুরতে হচ্ছে।কী নসীব!
সুখনলাল ঘুমিয়ে স্বপ্ন দেখে সুমিরণ তার মুখের দিকে তাকিয়ে হাসছে।গনগনে উনুনের আঁচে ফুটন্ত ভাতের ধোঁয়া ।তার ঘুম ভেঙে যায় ।সূমিরণের গালের টোল বড় গভীর। তার'হৃদয়ে একটু রক্তক্ষরণ হয়।শরীর উদ্দীপিত ।
তার কোনো পাপ বোধটোধ নেই।তবু কী যেন চিন চিন করে বুকের ভিতর
কিন্তু যে গোলাপি শাড়িটা পড়েছিল সুমিরণ স্বপ্নে,সেটা সূমিরণের নয়।সেটা যেন কার?
কবে কোথায় দেখেছে! জলে ঢিল মারলে যেমন আবর্ত তৈরি হয়, সুখন তার স্মৃতির আবর্তে ঢিল মেরে মেরে দেখে ।কে পরতো এই গোলাপি শাড়ি?জুহি শাড়ি পরতো না তবে কী শ্যামা? মনে আসে না কেন? সব তাহলে এত'দূর হয়ে গেল!( চলছে)
পড়ছি।
এই খাবার ফয়েলে মুড়ে দেওয়া দেখে মনে পড়ল, আমরা পুণে স্টেশানে শ্রমিক স্পেশাল ট্রেনে খাবার দিতে গেছি, পাঠিয়েছি ঐ এপ্রিল মে'র শুরুর দিকে। গ্লাভস পরে ফয়েল প্যাক বানানো যে কি ঝকমারি!
লেখাটা একেবারে করোনা টাইমলাইন ধরে চলছে। ভাল লাগছে।