এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • হরিদাস পাল  ধারাবাহিক

  • করোনাকালীন (দুই)

    Anuradha Kunda লেখকের গ্রাহক হোন
    ধারাবাহিক | ০১ সেপ্টেম্বর ২০২০ | ২৪৩৪ বার পঠিত
  • দ্বিতীয় খন্ড করোনাকালীন


    এক
    ইস রাতকা কোই সুবাহ্ নহি হোতা।
    একুশে মে দু' হাজার কুড়ি পরবর্তী।
    কলকাতা।

    আস্তে আস্তে অন্ধকার সরে যাচ্ছিল।ভোর হবার একটু আগে দুধের সরের মতো সাদা অন্ধকার যেন লেগে আছে চারপাশে।বাড়িঘর।গাছপালা।যেন কিছু নেই।পাখির ডাক সাধারণত এই সময় থেকে শোনা যায়।বিশেষ করে এই অঞ্চল বেশ সবুজ।কিন্তু আজ কোনো পাখি ডাকছে না এখন। মৃতের শহর।মৃত্যুনৈঃশব্দের ভোর।একটা অতিপ্রাকৃতিক নৈঃশব্দ্য যেন চেপে বসেছে চারদিকে। শুধু শন শন হাওয়ার তুমুল তাণ্ডব এখনো পাক খেয়ে খেয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে। মনে হচ্ছে তার কোনো শুরুও নেই।শেষও নেই।সে যেন যুগান্তের অদম্য কোনো বাতাস , যার নিঃশ্বাসে সভ্যতা লুটিয়ে পড়ে মাটিতে।সব কীর্তিস্তম্ভ ছারখার হয়ে যায়। এরপর শুরু হল ঝরঝর করে বৃষ্টি । সাধারণত এই সময় বৃষ্টি হলে ভালোই লাগে। একটু হাল্কা শীত শীত ভাব হয়।কিন্তু আজ তার কোনো লক্ষণ নেই বা থাকলেও সেটি অনুভূত নয়। এই গা ছমছমে উষা যেন সিনিস্টার। এর পরে আলো ফুটবে কি না বা আদৌ কখন ফুটবে, সে কথা এখন কেউ ভাবছে না।অতিকায় কোনো প্রাগৈতিহাসিক ডায়নোসর টেনে হিঁচড়ে ভেঙে চুরে সব শেষ করে চলে যাচ্ছে।এখনো তার লেজের ঝাপটা এসে পড়ছে এদিক ওদিক ।প্রবল ঝোড়ো বাতাস এখনো রীতিমত শক্তিশালী ।
    ত্রিদিব জোর করে উঠে দাঁড়ালেন।সারারাত না ঘুমিয়ে শরীর টলমল করছে। সারা গা , হাত, পা ক্ষত বিক্ষত খুব সন্তর্পণে পা টিপে টিপে ছাতে উঠছিলেন তিনি।একটু অসতর্ক হলেই আবার পা কেটে একাকার হয়ে যাবে। অনেক শখ করে একতলার ল্যান্ডিং, ,দোতলার ল্যান্ডিংএ কাঁচ বসিয়েছিলেন।গ্লাস পেইন্টিং করা দুর্মূল্য কাঁচ টুকরো টুকরো হয়ে পড়ে আছে সারা ল্যান্ডিং আর সিঁড়ি জুড়ে ।বাইরের বাতাস আর বৃষ্টির ছাঁট এসে পড়ছে বাড়ির অন্দরে।ভিতর আর বাইরে বলে কিছুই নেই।পায়ে তীব্র ব্যথা।
    ছাতে এসে আরেক বিভীষিকা। কোনো দৈত্য যেন ভেঙে চুরে তছনছ করে গেছে মালবিকার সাধের ছাতবাগান।একটি গাছও দাঁড়িয়ে নেই নিজের জায়গায় ।পেঁপে ।পেয়ারা গাছগড়াগড়ি খাচ্ছে। শখের আলো গুলো ফেটে চৌচির। এখানেও কাঁচ ভেঙে পড়ে আছে। সবকিছু ডিঙিয়ে ত্রিদিব ছাতের কিনারে এসে দাঁড়ালেন।চতুর্দিক যেন জাদুবলে লন্ডভন্ড হয়ে গেছে। আশেপাশের সমস্ত বাড়ির ছাতের একইরকম চেহারা।কেউ টেনে টেনে প্রাণের সমস্ত রস নিংড়ে নিয়েছে।ত্রিদিব ছাতা এনেছেন কারণ বৃষ্টি পড়েই চলেছে। বাতাস এসে ছাতায় টান দিচ্ছে । ত্রিদিব দেখলেন মোড়ের মাথায় উল্টে পড়ে আছে অশ্বথগাছটি। যেটা দীর্ঘকাল এই পাড়ার রিক্সা এবং অটোচালকদের ছায়া দিয়ে এসেছে।সারা গায়ে, পায়ে কাঁচ ফোটার অসহ্য যন্ত্রণা । টেট ভ্যাক নিতে কোথায় যাবেন বুঝতে পারছেন না।মেয়েকেও দিতে হবে।
    অন্ধকার সরে যাবার কথা অথচ সরটা কাটছে না। বিশ্রী একটা গুমোট।ইলেকট্রিকের পোল উল্টে পড়ে আছে।লোডশেডিং হয়ে গেছে গত সন্ধেতেই।কখন কারেন্ট আসবে কিছু বলা যাবে না। ইনভার্টার যতক্ষণ টানতে পারে ততক্ষণ । এই সমস্ত দুর্যোগ ও ধ্বংসে যার সবচেয়ে বিচলিত হবার কথা, ভয় পাবার কথা, মন খারাপ হবার কথা, সে একটিও শব্দ মুখ দিয়ে উচ্চারণ করেনি।
    বেডরুমে খাটে বাবু হয়ে বসেছিল শুধু। কোনো সশব্দ বাতাস, কোনো ভয়ংকরের আভাস তাকে বিচলিত করেনি। ছাতে বাগানের ধ্বংসস্তূপ দেখতে চায়নি সে।
    মালবিকা ঠায় বসে আছে খাটের ওপর।কোনো কথা নেই।কোনো হেলদোল নেই।কিছুটা সময় কাল রাতে বিচলিত হয়েছিল মাত্র।তারপর আবার নিথর।
    আম্ফান বা উম্ফান নামের এক দৈত্য এসে গুঁড়ো করে দিয়ে গেছে সভ্যতার আস্ফালন।মানুষ গুঁড়ো হয়ে গেছে তার দাপটে।
    মালবিকার যেন তাতে কিছুই এসে যায় না।

    অনেক আগে থেকেই তো আবহাওয়ার পূর্বাভাস ছিল।দূরদর্শনের খবরে। করোনা মৃত্যু তালিকার সঙ্গে সঙ্গে চলে আসছিল এক ঝড়ের পূর্বাভাস।সতর্কবাণী ।উড়িষা আর পশ্চিমবঙ্গের উপকূলবর্তী এলাকায় থেকে সরিয়ে নেওয়া হয়েছিল চার লক্ষ মানুষ।বারবার সাবধান করা হচ্ছিল মৎসজীবীদের। হোটেল খালি এমনিতেই। লকডাউনের জেরে ট্যুরিস্ট নেই উপকূলবর্তী এলাকায়।সে এক বাঁচোয়া। যারা খেতে পায়, ভান্ডারে যথেষ্ট খাদ্য মজুত ছিল করোনার কারনেই।যারা খেতে পায় না, তাদের আপদ বালাই নেই।শুধু হা পিত্যেশ করে থাকা কখন কোনো স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা এসে কিছু খাবার দেবে।অথবা সরকারি সংস্থাতে মিলে যাবে কিছু।

    আম্ফান এসেছিলো ঘন্টায় একশো পঁচাশি কিমি গতিবেগে।সেদিন মে মাসের কুড়ি তারিখ । মালবিকা ঘুমিয়েছিলেন। ট্রাইকা ফাইভ তাঁকে আচ্ছন্ন করে রাখে। কোনোমতে দিশাহারা চোখ খুলে দেখলেন তাঁর ঘরে কাঠের জানালা ঠকঠক করে কাঁপছে। এ বাড়িতে শুধু তাঁর ঘরেই কাঠের জানলা।কারেন্ট নেই ।একটা ভ্যাপসাভাব। হঠাৎ একটা জানালা খুলে কাঁচ ভেঙে গেল ঝনঝনিয়ে।মালবিকার মাথাতে একটা তীব্র ব্যথা। টুপুউউউর। বলে ডাক দিয়ে উঠে গেলেন বিছানা থেকে। মা মারা যাবার পর এই প্রথম মেয়েকে নাম ধরে ডাকলেন মালবিকা । এই প্রথম ঝটিতি বিছানাতে উঠে বসা । কী তীব্র ব্যথা যেন বয়ে গেল সারা শরীরে।অসহ্য যন্ত্রণা ।এত শব্দ হচ্ছে কেন চারদিকে । ঝনঝন ঝনঝন ।কিছু ভেঙে পড়ছে তো পড়ছেই। শেষ নেই। একটা গোটা সমুদ্র যেন আছড়ে পড়েছে বাড়িতে ।লিভিং রুমে এসেছেন টলতে টলতে। মা মারা যাবার পর মালবিকা দোতলায় যাননি আর।একতলাতেই আছেন । এসে দেখলেন লিভিং রুমের পূব দিকের মেঝে থেকে সিলিং পর্যন্ত তোলা বিশাল কাঁচ দুলছে তাসের মত। যেন এই ভেঙে পড়ে যাবে। ত্রিদিব আর মেয়ে ঐ বিশাল কাঁচের ফ্রেম দুহাতে চেপে আটকে ধরে রাখার চেষ্টা করছে। মালবিকা হতভম্ব ।দাঁড়িয়ে আছেন প্রেতিনীর মত অবিন্যস্ত চুলে । পরনে একটা কাপ্তান। ফলে তাঁর শরীরটিকে মনে হচ্ছিল কোনো অদ্ভুত অশরীরী। মালবিকার হাত পা অসাড়। দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখলেন বাইরের প্রবল বাতাস , ঝড় এসে কাঁচের বিশাল ফ্রেমকে তছনছ করে ভেঙে গেল।ত্রিদিবের হাত পা ফালাফালা হয়ে কেটে রক্ত পড়ছে। কাঁচ ছড়িয়ে পড়েছে সর্বত্র।টুপুরের সারা পায়ে কাঁচ বিঁধেছে।বাবা মেয়ে ক্ষত বিক্ষত হয়ে দাঁড়িয়ে আছে আধোঅন্ধকার ঘরে। অত রক্ত মালবিকা কী করে সামলাবেন? কী করবেন ? কী করবেন তিনি?ঘরের মধ্যে এখন ঢুকছে প্রবল ধুলো বালি।কাঁচের খন্ড উড়ছে।

    - আপনার ঠিক কী নিয়ে ভয় করছে মালবিকা?
    ড. মজুমদার খুব মৃদুস্বরে প্রশ্ন করলেন।
    প্রায় দেড় ঘন্টা । চুপ করে বসে আছেন মালবিকা।স্পেশাল সেশন চলছে। অনেক চেষ্টা করে ড.ঈশান মজুমদারের অ্যাপয়েন্টমেন্ট নিয়েছেন ত্রিদিব।
    ঈশান বয়সে তরুণ। কিন্তু বেশ ভারি ভারি ডিগ্রি । চোখদুটো খুব মায়াময় ।সাধারণত কাউনসেলিং করে তার জুনিয়ররা।কিন্তু মালবিকার কেস ঈশান নিজে দেখছেন। স্পেশাল কেসগুলো যেমন দেখেন। দিনে দুটো। যাস্ট দুটো।
    ফর্মটা ভালো করে পড়ে নিয়েছিলেন অনলাইনেই।মিসেস মালবিকা মন্ডল সেনগুপ্ত । হ্যাঁ ।মালবিকা এইভাবেই নিজের নাম লেখেন। স্কুলে। যেকোনো অফিশিয়াল কাজে।
    মালবিকার শাশুড়ি খুব পিটপিটে মানুষ। তিনিও স্কুল টিচার। ব্রাহ্ম স্কুলে পড়িয়েছেন। কিন্তু সবসময় সাদা শাড়ি পাট পাট করে পরে কাঁধে ব্রোচ লাগিয়ে স্কুলে গেছেন। কোনোদিন লিপস্টিক নেইলপলিশ ব্যবহার করেননি।
    মালবিকা লাল কালো ইক্কত বা সবুজ হলুদ ধনেখালি পরেছেন, আলগা হাতখোঁপাতে গয়না ,ঠোঁটে ব্রাউন লিপস্টিক ।কাঁধে চামড়ার শৌখিন ব্যাগ। শাশুড়ি তীব্র চোখে তাকালেন।তিনি মুখে কম কথা বলেন।
    আবার আজ তোমার ঐ থাই ফুড রান্না হবে? শোনো।আমার জন্য পরোটা আর আলুর তরকারি করবে।
    ইচ্ছে করে তোয়ালে রাখলেন চেয়ারে। জানেন মালবিকার ইরিটেশান হয়।
    মালবিকা স্কুল সেরে বাজার হয়ে ফিরবেন। পাঁচছজন বন্ধুকে ডেকেছেন।ফিরে ওদের ডিনারটা বানাবেন। বেসিল রাইস উইথ পাপায়া , লেমন চিকেন উইংগস।ইচ্ছে করলেই মা ওসব খেতে পারেন।উনি আমিষ খান। বাড়িতে । কিন্তু আজ খাবেন না।
    শাশুড়ি হাত ধুচ্ছেন।
    এইসব সাজগোজ করে স্কুল! আমাদের বদ্যিদের বাড়িতে এসব বাজে কালচার ছিল না কখনো।
    তিনি দত্তগুপ্ত । পাল্টিঘরে এসেছেন। সুযোগ পেলেই মালবিকার বিবাহপৃর্ব পদবি নিয়ে ঠুকে দেন।
    - শী অলওয়েজ অ্যাকিউজড মি ফর বিইনগ আ মন্ডল।
    - হু? কে অ্যাকিউজ করতেন?
    মালবিকার স্থির দৃষ্টি ডাক্তারের চোখে।
    - আচ্ছা। আই আন্ডারস্ট্যান্ড। আপনার শাশুড়ি । কিন্তু তিনি তো নেই।মারা গেছেন।
    খচ খচ করে কাঁচ টেনে বের করছেন মালবিকা । তখনো ঝড়ের সমান দাপট। হুড়মুড় করে ধুলো আর ঝড় ঢুকে পড়ছে ঘরে ।এখন আর কাঁচের বাধাটুকুও নেই। একটা বড় কাঁচের টুকরো। রক্ত বেরিয়ে এল গলগল করে।
    হাউহাউ করে কেঁদে উঠলেন মালবিকা। এতদিন বাদে।

    শাশুড়ি উল বুনতে বুনতে বললেন, শোনো। তোমাদের মন্ডলবাড়ির নিয়মকানুন এখানে দেখাতে এসো না।আমাদের লক্ষ্মীপুজোর নিয়ম আলাদা।ঐ পট পুজো টুজো আমাদের বংশে নেই।আরো একটা কাঁচের টুকরো বিঁধে গেল পায়ে।

    মালবিকা ঘুরে ঘুরে নাচছে। কোমরে আঁচল জড়ানো।হলুদ শাড়ি । মালবিকা মন্ডল। বিশ্বভারতীর শ্রীসদনের মেয়ে ।
    চক্ষে আমার তৃষ্ণা ওগো, তৃষ্ণা আমার বক্ষ জুড়ে ।
    কপালে চুল এসে পড়ছে। কুমকুমরন্জিত হাতে সরিয়ে দিলেন। এক পাক ঘুরে। আমি বৃষ্টিবিহীন বৈশাখী দিন। আর্তি ঝরে পড়ছে।
    মালবিকার দুচোখ দিয়ে ঝরঝর করে জল পড়ছে।সন্তাপে প্রাণ যায় , যায় যে পুড়ে । আঙুলের মুদ্রা কী সুনিপুণ । হাতে , গলাতে রূপদস্তার গহনা।
    প্রথম সারিতে মুগ্ধ ত্রিদিব। প্রোগ্রাম দেখতে এসেছেন কলকাতা থেকে। বন্ধুদের সঙ্গে ।ত্রিদিবের খুড়তুতো বোন সুমি মালবিকার ক্লাসমেট।
    - এই যে মালবিকা ছোড়দা।
    মালবিকা হাতজোড় করে নমস্কার করলেন।ত্রিদিব সেনগুপ্ত দেখলেন ভারি কমনীয় নমস্কার করার ভঙ্গিটি।

    - শী ইজ নো মোর। আপনি মাথা থেকে ওঁর কথাগুলো একদম ঝেড়ে ফেলুন । আপনি তো একজন ইনটেলিজেন্ট মহিলা। কী সাবজেক্ট আপনার?
    মালবিকা কোনোদিন কোনো নিষ্ঠুর মন্ত্র পড়তে পারলেন না। খুব বেশি হলে বাপের বাড়িতে গিয়ে মায়ের কোলে মুখ গুঁজে কাঁদতেন। সেখানেও বলে দেওয়া হয়েছে, নিজের পছন্দমত বিয়ে করেছো। নিজে সামলাবে।আমাদের বলতে আসবে না। হাওড়ার বিশ্বনাথ মন্ডল কনট্র্যাক্টরি করে যেমন বাড়ি হাঁকিয়েছে, তেমন ছেলেমেয়েদের ভালো স্কুলে কলেজে পড়িয়েছে। চোখ ধাঁধানো তত্ত্ব পাঠিয়েছে মেয়ের বিয়েতে । শ্বশুরবাড়ির লোকজন খুবই ভদ্র। ঠারেঠোরেই কন্ট্রাক্টরির পয়সাকে একটু বাঁকা চোখে দেখছেন।পরিশীলিত বাঁকা কথা।
    মালবিকা গুমড়ে মরছেন। ত্রিদিব অফিস ট্যুওর নিয়ে ভীষণ ব্যস্ত তখন।
    আমি বৃষ্টিবিহীন বৈশাখী দিন...ঝড় উঠেছে তপ্ত হাওয়ায় হাওয়ায়, মনকে সুদূর শূন্যে ধাওয়ায়...এত ঝড় কোনোদিন দেখেননি । কাঁচ ভেঙে ভেঙে বিঁধে গেছে ত্রিদিবের পায়ে।টুপুরের পায়ে।আর কত ঠাকুর!
    শোলেতে হেমা মালিনী কাঁচের ওপরে নেচেছিল না! মালবিকা মাথাটা হেলিয়ে বসলেন।
    - আপনি রিল্যাক্স করে বসুন মালবিকা। ফিল ফ্রি। মনের ডাক্তারের কাছে কিছু লুকোতে নেই।
    বিড়বিড় করছেন।যেন মনে মনে কথা বলছেন। কাঁচের ওপর নাচ।

    মেয়েরা, জানেন ডক্টর, সারাজীবন ভাঙা কাঁচের টুকরোর ওপর নেচে যায় ।সবার দেখাশুনো করতে করতে কাঁচের ওপর নাচ। কখন যে নিজের পায়ে খচ খচ করে কাঁচের টুকরো বিঁধে যায়! এত রক্তপাত । অন্তর্গত পৃথিবীতে তাণ্ডব ।
    কোনো এক প্রসন্ন বদন, প্রসন্ন চিত্ত আনন্দ যেন হেঁটে চলেছেন।মালবিকার ইচ্ছে করছে আবার তিনি কিশোরী হয়ে যান। তাঁর তরুণী কন্যাটির অধিক কিশোরী। টেনে আঁট করে লম্বা একটি বেণী। কানে দুটো সোনার মাকড়ি। আর কোনো আভরণ নেই। তিনি কিশোরী হয়ে নেচে চলেছেন।নুপুরহীন। আভরণ শুধু জরিপাড় নীল শাড়িটি।
    -ঈশানকোণে কালো মেঘের নিষেধ বিদারি, যেমন আসে সহসা বিদ্যুৎ, তেমনি তুমি চমক হানি এসো হৃদয়তলে। এসো তুমি, এসো তুমি।এসো এসো।
    কার জন্য লেখা হল এসব? কার জন্য লিখলেন হ্যাঁ?তোমার শুধু পুণ্যলোক বুঝি? কেন? আমার লোক পুণ্যলোক নয় কেন? আমার বাবা কন্ট্রাক্টর বলে? আমরা মন্ডল বলে?
    - জল দাও।জল দাও। প্রায় ভেঙে যাচ্ছেন । অ্যাটেন্ডেন্ট মেয়েটির মুখে মাস্ক।জল এনে দিল।মালবিকা মুখ দেখতে চাইছেন। ঠোঁটের বিভঙ্গ । কোথাও মুখ নেই কেন? আচ্ছা। বাড়িতে ঐ যে মাছ দিতে আসে ছেলেগুলো, ওদের মুখ দেখা যায় । ওরা গলাতে মাস্ক পরে।ঝড়ের পর এসেছিল ওরা? দেখেননি তো মালবিকা। টুপুরকে জিজ্ঞেস করতে হবে।কি যেন নাম! বশির বোধহয়!
    চোখের জল মুছে নিচ্ছেন।টানা পাঁচ দিন লোডশেডিং ছিল ঝড়ের পরে। ঘুমোতে পারেননি একেবারে। চোখের কোণে গাঢ় কালি। ত্রিদিব তো যত্নে ত্রুটি করেন না। তবু কেন ঐ রিনি নামক নারী ঘুরে ঘুরে আসে!সে খুব সমস্যায় আছে ডিভোর্সের পর, তারজন্য তোমার এত মাথাব্যথা কেন ত্রিদিব? তুমি বলছো আমি মিনমাইন্ডেড? বেশ।তবে তাই।কিন্তু রোজ এত চ্যাট কিসের তোমাদের?
    বুক ফেটে যায় গো, বুক ফেটে যায় ।আমি দেখব না।কী ভয়ঙ্কর দুঃখের ঘূর্ণিঝন্ঝা।মহান বনস্পতি ধূলায় কি লুটাবে..." কোনো নির্মম নিরুৎসূক চৈত্যের সামনে মালবিকা কিশোরী হয়ে নাচতে থাকেন।নাও হে ।নাও।আমার সব অপমান নাও।

    একটা ফোন আসছে বারবার।সাইলেন্ট করা আছে তবু। নেবো ডক্টর?
    - নিন। জল খেয়ে নিন।
    এসি চেম্বারে ঘেমে গেছেন। রুমাল দিয়ে মুখটি প্যাট করে ফোন রিসিভ করলেন মালবিকা ।ওপারে খুব মৃদু ।মিহি একটি কন্ঠস্বর ।
    - আপনি মালবিকা বলছেন তো? শুনুন। দেবরূপ আপনার নাম্বারটা দিয়েছে। আমি মুমতাজ আহমেদ বলছি। আমি, আমি অদিতির মা।ইওর সন দেবরূপ আস্কড মি টু কল ইউ।আমি কলকাতাতে আছি।আই ওয়ান্ট টু মিট ইউ।
    দুই


    টু লিটল কেয়ার
    ঝড়ে লিভিংরুমের দেওয়ালজোড়া কাঁচ খানখান হয়ে পড়ে যাবার পর ও বুঝতে পারলো সিকিউরিটি বলে কোনো চিরকালীন আড়াল নেই। সামনে বাবা হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে ।বাবার সারা হাত পায়ের রক্ত চোখে এল প্রথমে। তারপর গেঁথে যাওয়া কাঁচের টুকরোগুলো। বাবার মুখটা কেমন ভয়ে, বিস্ময়ে, ব্যথায় বেঁকে বেঁকে যাচ্ছিল আর ও চিৎকার করছিল। আসলে ও আর বাবা কাঠের বিশাল ফ্রেমটা চেপে ধরেছিল দুজনে দু'দিক থেকে।এই মহার্ঘ্য কাঁচের পার্টিশন বাবা আনিয়াছে সিঙাপুর থেকে।গ্লাস পেইন্টিং ।মার্ভেলাস রঙ।তুঁতে , মেজেন্টা , হলুদ আর কালোর ডেডলি কম্বিনেশনে একটা বাগানে প্রজাপতি আর পাখি।একটা ফিমেল ফিগার।সে এখন টুকরো টুকরো হয়ে পড়ে আছে।ওরা ভাবছিল যদি এইভাবে আটকে রাখা যায় ।গেল না। ঝড়ের তোড়ে কাঁচ ফ্রেম থেকে ছিটকে এসে বেরিয়ে পড়ল সারা ঘরে।
    ও প্রথমে নিজের দিকে তাকিয়ে দেখেনি।হঠাত্ শরীরে চিনচিনে ব্যথা শুরু হতে তাকিয়ে দেখল। কাঁচ ফুটে আছে গায়ে।পায়ে।রক্ত গড়িয়ে পড়ছে অসহায় ভাবে । হলুদ বা তুঁতে রঙের কাঁচে কাটলেও রক্তের রঙ লাল।
    ঝড় ঢুকে পড়েছিল ওদের বহুমূল্য বৈঠকখানাতে। দেওয়ালে টাঙানো পেইন্টিং খুলে পড়ছে।উড়ছে মালবিকার বহুযত্নে সংরক্ষিত তাঙ্খা।বুদ্ধ উড্ডীয়মান। জানালার তাকে রাখা মালবিকার সাধের চাইনিজ পটারি ভেঙে গেল সশব্দে। আধো অন্ধকারে ওর চলাফেরা স্তব্ধ।কী করবে জানে না। বাতাসের সঙ্গে শুকনো পাতা।ধুলো আছড়ে পড়ছে মুখে।জীবনে প্রথম ও অসহায় বোধ করছে।হাউ টু হেল্প বাবা।কী করবে?
    বিদ্যুত চমকে উঠল আরো একবার। প্রচন্ড তীব্র। সেই আলোতে দেখল লিভিংরুমের দরজায় , যেন কোনো অশরীরী আত্মার মত , দাঁড়িয়ে রয়েছেন মালবিকা। ও চিৎকার করে উঠেছিল।
    মাআআআ। স্টপ।ডোন্ট কাম।কাঁচ ভর্তি।
    পরে ভেবে দেখেছে। দীর্ঘদিন বাদে মা বলে ডেকেছিল সেদিন।

    তিনটে মানুষ পরস্পরকে ধরে হাউহাউ করে কাঁদছে।যাদের মধ্যে দু'জনের সারা গায়ে রক্ত । কাঁচ ফুটে অসহ্য ব্যথা। এদিক ওদিক যাবার কোনো উপায় নেই।কারণ চারদিকে কাঁচ ছড়ানো।যে কাঁচের দেওয়াল এতদিন নিরাপত্তা দিয়েছে, বৃষ্টি এলে টেনে দাও, ঝড় এলে টেনে দাও স্লাইডিং ডোর, ব্যস তুমি নিরাপদ, সেই দেওয়াল ভেঙে পড়ে আছে সামনে। ছাতে একটা ভয়ঙ্কর আওয়াজ । ও বুঝল কিছু একটা ভেঙে পড়ল।ওরা কিছুই ভাবছিল না তখন। তিনজন তিনজনকে ধরে শুধু বেঁচে থাকার চেষ্টা।কিংবা অতদূরও নয়।ধরে থাকা টুকু মাত্র।ছুঁয়ে থাকা।
    বেডরুমে নিয়ে এসে আস্তে আস্তে শরীর থেকে কাঁচ তুলেছেন মালবিকা ।মুখে কোনো কথা নেই। এক একটা কাঁচ ওঠানোর সঙ্গে সঙ্গে ফিনকি দিয়ে রক্তপাত। ডেটল।তুলো।অয়েন্টমেনূটের গন্ধ।
    ও মুখ চেপে যন্ত্রণা সহ্য করেছে।আপাতত আর কোনো কিছু করার নেই। প্রপার ড্রেসিং হবে না। কাল কী আদৌ হবে? ঝড় যেন আরো বেড়ে যাচ্ছে। আজ কী পৃথিবী শেষ হয়ে যাবে? ও মা'কে জড়িয়ে ধরে কাঁদছিল। ভীষণ কাঁদছিল।সেদিন একঘরে ও।বাবা।মা। কোণের ডিভানটাতে হেলান দিয়ে শুয়েছিল। বাবা খাটে উপুর হয়ে শোয়া। মা বসে।চুপচাপ।
    মোমবাতি জ্বলছে। ওদের কোনো কেরোসিন ল্যাম্প নেই।হ্যারিকেন আছে একটা কিন্তু তেল নেই। টুপুরের জন্মদিনের মোটা গোলাপি মোমবাতি জ্বলছে এখন।
    ঝড় আছড়াচ্ছে। এই ঘরের জানালা কাঠের। মালবিকা ঘুমোনোর সময় নিশ্ছিদ্র অন্ধকার ইউ প্রেফার করেন।

    ও দেওয়াল ঠেস দিয়ে কাতরাচ্ছে । মোমবাতির আলোতে দেখছে কালো আলখাল্লা।সোনালি বর্ডার দেওয়া। মাথা ভর্তি সাদা চুল।লম্বা চুল হাওয়াতে উড়ছে।ব্যথায় ওর কান্না পাচ্ছিল। তবু ও কান্না ভুলে গেল। এ কে? একে ও চিনতে পারছে না।মোমবাতির আলোতে লোকটির ছায়া অতিকায় - গির যায়েগি। আজ রাত বহোত কুছ গির যায়েগি।দেয়ার উইল বি মেনি এন্ডস টুনাইট।
    বলতে বলতে লোকটা হাত দুটোকে দোলাচ্ছে। ওর
    আলখাল্লা উড়ছে হাওয়াতে।একটা বিশাল ব্রাউন আলখাল্লা। মস্ত পকেট।
    মনে হচ্ছে ঘরে নয়। ও যেন কোনো এক উন্মুক্ত প্রান্তরে দাঁড়িয়ে আছে লোকটা। ঝড়ে ওড়ে ওর চুল।দীর্ঘ চুল।
    - ইরফান। হোয়াই হ্যাভ ইউ ড্রেসড লাইক দিস?ইউ লুক উইয়ার্ড।
    হা হা করে হেসে উঠল ছায়ামূর্তি ।
    - কী ভেবেছ? ভেবেছো যে এই ভয়ানক ঝড় শুধু বাইরেটা শেষ করে দেবে? আঘাত কি শুধু এই ত্বকে?
    লোকটি ওর হাতের ক্ষততে স্পর্শ দেয়।
    বাট হোয়ের দ্য গ্রেটার ম্যালাডি ইজ ফিক্সড,দ্য লেসার ইজ স্কেয়ার্স ফেল্ট।
    - ইরফান ! ইউ আর অ্যাক্টিং লিয়র! লাস্ট আফটার দ্য লাস্ট লিয়র!
    হা হা করে হাসছেন রাজা লিয়র। মাথায় মুকুট নেই। ঝড়ে দেখা যায় না স্পষ্ট অয়ব।
    আই অ্যাম লিয়র। নট অ্যাক্টিং। আই অ্যাম দ্য পার্সন।
    শরীর বড় নরম।ঝড় উঠেছে মনে।দ্য টেম্পেস্ট ইন মাই মাইন্ড।অপত্যের অকৃতজ্ঞতা ।ফিলিয়াল ইনগ্র্যাটিটিউড। মুখ।আমার মুখ আমার হাত টেনে ছিঁড়ে দেয়।বলে কেন।কেন মুখে খাদ্য তুলে দিয়েছিলি?
    রাজা লিয়র কাঁপছেন।কাঁদছেন ইরফান।
    - না।আর কাঁদব না।ঢালো ।ঢালো বর্ষা।আমি সহ্য করে নেব।আই উইল এনডিওর।এমন ঝড়ের রাতে!
    - তুমি বসো ইরফান।বসো।
    - আই অ্যাম লিয়র।চলে যাও।নিজের আরামে থাকো।আমাকে ভাবতে দাও সেইসব কথা, যা কিনা যন্ত্রণাবিদ্ধ করবে আমাকে!
    পুওর নেকেড রেচেজ।যে যেখানে আছো।কী করে সহ্য করো এই নির্দয় ঝড়?তোমাদের গৃহহীন,অভুক্ত দেহ,তোমাদের সব ক্লান্ত রিক্ত দেহ, কী করে বাঁচবে এই ঝড় থেকে?
    ওহ! আই হ্যাভ টেকন টু লিটল কেয়ার অব দিস।
    টেক ফিসিক।পম্প!আমি তো কোনোদিন ভাবিনি এই দুর্দিনে গৃহহীনদের কথা! আই থট আই ওয়াজ দ্য সেন্টার। আমি নিজেকে কেন্দ্র ভাবতাম।আজ দেখছি কেন্দ্র ছিটকে গেছে ঝড়ে।আমি কে?
    ইরফানের চোখ ঘুরছে বাতাসের সঙ্গে।
    কেমন আছো হে দরিদ্র , রিক্তরা!,কেমন আছো গৃহহীন সব? বেঁচে আছো খিদে পেটে নিয়ে? বলো? এই ঝড় নতুন কী ক্ষতি করে দেবে তোমাদের? গৃহ নেবে? সন্তান কেড়ে নেবে? জেনে রেখো।জেনে রেখো।কিছু নেই।নেই।গৃহ নেই।সন্তান নেই।
    ইরফান যেন উন্মাদ হয়ে গেছেন। যন্ত্রণা বিদ্ধ রাজা লিয়র।
    বড় একটি গাছ আবার পড়ে গেল প্রকান্ড শব্দ করে। ত্রিদিব তেমনি উপুর ।মালবিকা প্রস্তর। কেবল মোমবাতির কাঁপা আলোতে নেচে বেড়াচ্ছে এক উন্মাদ, ক্ষিপ্ত রাজার অবয়ব।
    ইরফান খান নন।রাজা।রাজা লিয়র। বিড়বিড় করে উগরে চলেছেন ক্রোধ ও ক্ষোভ।
    তুমি জানো? তুমি কি জানো? রাজা ফিরে তাকিয়েছেন ওর দিকে। টকটকে লাল চোখ।জল পড়ছে।
    - কে তুমি? এডগার? গ্লওসেসটার? বিদূষক? তুমি কে?ঐ দ্যাখো ঝোড়ো হাওয়া ঢুকে এলো। ঘরের ভেতরে। কানের ভেতরে।মাথার ভেতরে।ওফফফফফ!
    - ইওর এক্সেলেন্সি! আপনি শান্ত হন।
    - নো নো নো নো। নট ইওর এক্সেলেন্সি। ওসব বোলো না আমাকে। আমি মুকুটহীন এক দীন প্রাণ।
    আমার কেউ নেই।কিছু নেই। আই অ্যাম লাইক দেম।দোজ হোমলেস ফোকস। গৃহহীন। খাদ্যহীন।আমার পোশাক ভিজে গেছে দেখো। আমার একটু শুকনো পোশাক চাই।আমার একটুকরো রুটি চাই। দেবে? দিতে পারবে এডগার?
    ওদের কী হচ্ছে বলো তো? যারা মাঠে বসে আছে?
    এই যে তুমি।শোনো শোনো, তুমি।
    এই ভয়ঙ্কর দুর্যোগে অনাবৃত দেহে থাকবার চেয়ে কবরে যাওয়াই শ্রেয়।মানুষ! গুটি পোকার থেকে কেড়ে নিয়েছো রেশম,পশুর কাছ থেকে কেড়ে নিয়েছো তার আস্তানা, ভেড়ার কাছ থেকে পশম।দাও আর সোফিস্টিকেটেড!আনঅ্যাকোমোডেটেড ম্যান!দরিদ্র।খালি পা।পশু!
    এই দানবিক ঝড় ! আমাকে পশুর স্থানে নিয়ে গেছে!
    বলতে বলতে ইরফানের চোখ আগুনের মত জ্বলতে থাকে।ও আগে কখনো ইরফানের এমন চেহারা দেখে নি।
    বাইরে ঝড় উন্মত্তের মত পাক খেতে থাকে। ও ঘরের মধ্যে বসে বুঝতে পারে ঝড়ে উড়ে যাচ্ছে হাজার হাজার মানুষের বাসস্থান।খাদ্য।জীবিকা।
    তাদের মাথার ওপর সামান্যতম আচ্ছাদনটুকুও নেই।এই বহু বছরের ভয়ঙ্করতম ঝড়ে তারা কেবলমাত্র আকাশের নিচে ।
    তিন


    ঝড় এসেছে
    একটা টিলার মত উঁচু ভূমিখণ্ডের ওপর বসেছিল বশির, আমির এবং ওদের গোটা পরিবার। আম্মার গায়ে জ্বর, বেদনা। বশিরের ডান পা কেটে গেছে টিনে। রক্ত পড়ছিল দরদর করে। বশিরের দাদা আমিরের বউ গর্ভবতী। বড় তিনটে ছেলে। এবার একটি কন্যাসন্তান আশা করে আছে ফরিদা। শ্যামলা রঙে ভাসা ভাসা চোখ । সারা বিকেল , সন্ধ্যা ধরে দেখেছে বাড়িটা উড়ে গেল।ধাড়ার বেড়ার দেওয়াল ধ্বসে পড়ল আগে।উড়ে গেল মাথার ওপরের টিন। একটাই ঘর ছিল। মাঝে ছালা দিয়ে পার্টিশন করে একদিকে আমির, ফরিদার সংসার। অন্যদিকে আম্মা। নানী।বশির।সুহেল। মাঝে মাঝে সালমান থাকত ইদানিং ফিরে এসে। টিনের চাল উড়ে গেল তাসের মত।।
    শুধু বশিরদের ঘরের না।আশপাশের অনেক ঘর তখন পড়ে যাচ্ছে। নিচু জমির ওপর বাড়ি।ভদ্রলোকেরা বলে লো ল্যান্ড ।দেওয়াল পড়বেই। তবে ঐ বাঁশের বেড়ার ঘরে নতুন বউ হয়ে এসেছিল ফরিদা। আমির লম্বা, ছিপছিপে সুঠাম এক মৎসজীবী তখন। ফরিদার চোখভরা হাসি।আমির বশিরের বাপ , পরদাদাও মাছ ধরেছে। যারা মাছ ধরে তারা বলতে গেলে দিন আসে দিন খায়।যেদিন বেশি মাছ, সেদিন একটু ভালো খাওয়া দাওয়া ।যেদিন কম, সেদিন খাওয়াও কম।ওদের পরদাদা ছিল জালাল মাঝি। লোকে বলতো জালাল মাঝির নৌকা খালি ফিরত আসে না। জালাল মাঝি এলাকার নামজাদা মানুষ ছিল বটে।জালালের তিন নম্বর ছেলে সালাহউদ্দিন ওদের বাপ।সেও মাছ ধরেছে।আমির বংশের মধ্যে প্রথম ট্রলারের মাঝি হয়েছে।এটা পদোন্নতি তো বটেই ।এইসব দেখেশুনেই ফরিদার আব্বু আমিরের ঘরে মেয়ে দিয়েছিল।সেই ঘর ঝড়ে উড়ে গেল কোথায় ।শাদির সময় কয়েক ডজন মুরগি দিয়ে গেছিল ফরিদার আব্বু। ঐ একখানা ঘরের মধ্যেই পলোর নিচে রাখা ছিল মুরগিগুলো।টানা তিনচারদিন । সে কী আনন্দ!চালের রুটি বানিয়েছিল আম্মী।নিজে হাতে দশ বারো ঘর লোকের রান্না করেছে ঘরের সামনে ঐ মাটির চুলাতে। বাপের বাড়ি থেকে কয়েক হাড়ি পিঠা এসেছিল। শীতকালে বিয়া। কতদিন রেখে রেখে ঐ পিঠা খেয়েছে সবাই। ফরিদার ফুফুর হাতের পিঠা।কিছু থাকল না।কিছু না। ছানা বুকে চেপে ফরিদা দেখল টিনের বাক্স ভেসে চলে যাচ্ছে। ভেসে যাচ্ছে বিয়ার শাড়ি।পিঠার হাড়ি। আব্বুর দেওয়া ঘড়ি। বেগুনি রঙের জমির ওপর সলমা চুমকি বসানো শাড়িতে ফরিদা। গোসল সেরে নতুন পাঞ্জাবি পরে এসেছে আমির ।গায়ে আদরের গন্ধ, যাতে মাছের গন্ধ ঢেকে যায়।সব গন্ধ কোথায় যেন সব ভেসে যায়।একটা ফোটো তুলেছিল ফরিদা আর আমির। তখন ছেলেপুলে হয়নি। গোঁসাবার স্টুডিওতে রঙীন ছবি।দুজনেরই হাসি মুখ। একটা ফ্রেমে সেঁটে রেখেছিল। ছবিটা বুঝি গেল ভেসে। ও কী আর থাকে!
    শাড়ি জামা ভিজে সপসপ করছে। পুরনো একটা প্ল্যাস্টিক জড়িয়ে বাচ্চাকে বাঁচানোর চেষ্টা করেছিল ফরিদা। কোলের এবং পেটের। দুটোকেই বাঁচাতে চেয়েছিল। বড় দুটোকে ডানায় জাপটে বসেছিল আমির।তার বলিষ্ঠ দুটো বাহু দিয়ে কিলো কিলো মাছ সে জালে তোলে। কিন্তু সেদিন মনে হচ্ছিল যার হাতে কোনো জোর নেই।হালকা বাঁশের মত। প্যালপ্যাল করছে।ছেলেদুটো উড়ে যাবে যেকোনো সময়ে।
    নানী কেঁপে যাচ্ছে সমানে। আম্মীকে নিয়ে আঁকড়ে বসেছিল বশির।চোখের সামনে শুধু ধুলো আর অন্ধকার।শব্দে যেন কান ফেটে যায় । বাচ্চাগুলো চিৎকার করে কাঁদছে। তাদের থামানোর কোন উপায় তখন কারু জানা নেই।ঝড়ের শব্দে ঢাকা পড়ে যাচ্ছিল চিৎকার ও কান্না।একটানা গোঁ গোঁ আওয়াজ ঝড়ের।
    এখানে সব বাড়ির মাথাতে টিন বা অ্যাসবেসটস। খেলনার মত পড়ে যাচ্ছে এক এক করে। গাছের তলাতেও বসা যায় না। এলাকার বড় গাছ পড়ে যেতে শুরু করেছে সশব্দে। সুলেমান আলি ভিজতে ভিজতে বলল, আল্লা, রহেম করো।বাড়ির সকলে আতঙ্কে আছাড়িপিছাড়ি করছে। এইরকম ঝড় সে তার সত্তর বছর বয়সে দেখে নি। কেবল তার মেজ ছেলে সালমান, চোখে একরাশ সমুদ্রের ঢেউ নিয়ে পাথরের মত দাঁড়িয়ে থাকল ভাঙা বাড়ির দোরগোড়ায় ।

    ঝড়ের শব্দ ছাপিয়ে একবারই একটা কলরব উঠেছিল। একটা তীক্ষ্ম চিৎকার ।
    লিয়াকতের বাড়িতে কেউ নেই। বউ গেছে বাপের বাড়ি তিন বছরের ছেলে নিয়ে । ঝড়ের সময় ঘরে ফিরে তালা খুলতে গেছিল লিয়াকত।অ্যাসবেসটসের স্লিট এসে গলাতে বসে গেছিল তার। গলা কেটে রক্তপাত হয়ে মরে গেল উনত্রিশ বছরের লিয়াকত আলি।
    সারাদিন রোজা চলেছে।ইফতারের সময় পায়নি কেউ।ভয়ে খিদে চলে গেছে যেন।কেবল বাচ্চারা হাঁক পেড়ে কাঁদছে। মেয়েরাও।
    খানকা শরিফ ভেসে গেল বোধহয় । কে যেন চেঁচিয়ে বলল, গোপাল ঢালি জলের তোড়ে ভেসে গেছে। কারু মুখে আর কোনো কথা নাই। মাটি আঁকড়ে পড়ে আছে মেয়ে মরদ সবাই। ডাইনোসর নাচছে তার আদিম নৃত্য । থপ থপ করে পা ফেলছে যেখানে ইচ্ছে সেখানে।লেজের ঝাপটে ছিটকে দিচ্ছে বাড়িঘর ।গাছ।
    সুহেল, সালমান, মজিল পুকুরের দিকে তাকিয়েছিল।হুড়মুড় করে নদীর জল ঢুকে পড়ছে পুকুরে। একটাও মাছ থাকবে না আর।একটাও না।সব নদীতে ভেসে চলে যাবে নয় মরে যাবে। জোয়ান ছেলেগুলো মুখ শুকনো করে উদোম ভিজছে।বহুকাল আর মাছ পাওয়া যাবে না।মরে যাবে মাছ। ভাবতেই মাথার মধ্যে খিদে মোচড় দিয়ে ওঠে আর তারপর পেটের মধ্যে নামতে থাকে। রোজার পর খাওয়া নাই। শরীর যেন শরীর না।হাওয়া ।
    সুলেমান , সালমান, মজিদ, গোপাল দাস ।এরা সবাই কোভিডের তাড়ায় বাড়ি ফিরেছে। ফেরার সময় গোপালের একহাত হয়ে গেছে মালিকের সঙ্গে । ফেরার খরচা পাতি কিছুই দিতে চায়নি মালিক। কোচিনে ওরা নৌকার শেয়ারিং পায়। প্রতি নৌকাতে ন'জন লোক থাকে।মাছের শেয়ার হয়ে জনপ্রতি পনেরো হাজার টাকা মাসিক আয়। নিজেদের জন্য হাজার পাঁচেক রেখে বাড়িতে দশ হাজার পাঠাতে পারে ওরা। মার্চ মাস থেকে সেই আয়টুকু বন্ধ । গোপাল দাস আর ফিরবে না কোচিনে।সুহেলও বলছে ফিরবে না।মালিকের সঙ্গে যা ঝগড়া হয়েছে! তবে সালমান ফিরবে। ওর চোখে সমুদ্রের নেশা আছে। মাঝসমুদূরের নিলাজ নীল মায়া লেগে আছে ওর চোখে। সাঁ সাঁ করে ট্রলার নিয়ে বেরিয়ে যাবার নেশা। সালমান আর কোনোদিন পুকুরে, নদীতে মাছ ধরতে পারবে না। ওর ঘিন আসে। ও সমন্দর যাবে।আবার।
    প্রবল ঝড় আর বৃষ্টির মধ্যে দিয়ে সালমান দেখতে পাচ্ছিল ও ট্রলারে যাচ্ছে মাঝ সমন্দরে। একা।
    আর ভিজে লাট হতে হতে ফরিদা দেখল, বাড়িঘর সব পড়ে গেছে।কিছু নাই ।কিছু নাই। শুধু ওর মাটির উনান ভাসে নাই। চেপ্টে গেছে
    কিছুটা। কিন্তু আছে। আখা জ্বলবে তাহলে আবার। ঠিক জ্বলবে একদিন, ঝড় থেমে গেলে।কিন্তু ছবিটা কী খুঁজে পাবে আর? কাদামাটিতে মিশে যাবে কখন!একখানই বটে ছবি ছিল ফরিদার আমিরের সঙ্গে ।

    টিভি থেকে যারা এসেছিল , তাদের সবার মুখে মাস্ক ।হাতে হাতজামা। ছেলে বেশি।মেয়ে কম।অনেকের মাথাতে প্ল্যাস্টিকের টুপি। কমবেশি একরকম কথাই জিজ্ঞেস করছিল ওরা। কতজন লোক গ্রামে।কতজন মারা গেছে। বাড়িঘর পড়ে গেছে কতজনের। জমির খবর নিচ্ছিল। ধান শেষ হয়ে গেছে সবটাই। ভেসে গেছে। পুকুর শুখা হয়ে যায় মাছের সিজন শেষে।তখন ঐ জমিতে ধান রোয়া দেয়। ভেসে গেছে সব।
    ওরা বলছিল সব দূরে দূরে থাকো। দূরে থাকার কথা কেন বলছে ওরা বুঝল না তেমন কেউ।ফরিদা ওড়না দিয়ে মুখ মাথা ঢেকে রেখেছে। বাকি মেয়েরাও তাই।।মুখবাঁধা কাপড় নিয়ে স্কুল বাড়িতে গিয়ে উঠল গোটা গ্রাম।সেখানে আলো নেই।জল নেই। মাথার ওপর ছাতটুকু আছে শুধু ।

    ত্রাণ ধরা একটা বড় কাজ।হ্যাঁ ।এটাই বলে ওরা।ত্রাণ ধরতে হবে।কে কীভাবে কী ধরবে, সেটা সেইই জানে।কোনো কোনো ত্রাণের পুঁটলিতে ছেঁড়া জামাকাপড় আসে।এত ছেঁড়া যা পরা যাবেই না। ন্যাতা কানির কাজে লাগবে। ওমনি করে বান্নিটোলার মণি দাস , বয়স ষাঠ ।একটা বস্তা পেয়েছিল।ছুঁড়ে দিয়েছিল ট্রাক থেকে। মণি টেনে নিয়ে গিয়ে দেখে এক বস্তা স্যানিটারি ন্যাপকিন।

    কুয়াশায় সব গাছ হলুদবর্ণ হয়ে গেছে।রিলিফে একধামা মুড়ি আর গুড় পেয়েছে জুমানি সর্দার। বছর পঁয়তাল্লিশ বয়স।আয়লাতে সব খেয়েছিল।চাষের জমি শেষ হয়েছিল নোণা জল ঢুকে।সব মাছ মরেছিল। অনেক কষ্টে একটা এন জি ও ধরে কাছাকাছি একটা পুকুরে মাছ চাষ করতে পেরেছিল এবার।ঝড়ে সব গেল। জুমানির চোখ দিয়ে জল পড়ে না আর।বর গেছে বাঘের পেটে।এই অঞ্চলে জুমানির মত মেয়েদের বলে বাঘ- বিধবা।সাতজেলিয়াতে একশোর বেশি বাঘ- বিধবা আছে।একটা গোটা পাড়াই তো আছে ।
    বিধবা- পাড়া।শিবা সর্দার দুটো বেটি নিয়ে বিধবা পাড়াতে থাকে।বরকে বাঘে টেনেছে।পোল্ট্রির কাজ তার।ঝড়ে শ'খানেক মুরগি আর আশিটা মত মুরগির ছানা মরে গেছে।একটা মেয়ে উনিশ বছরের। আরেকটা ক্লাস টেন।দুই মেয়ের কাঁধে হাত দিয়ে উঠে দাঁড়াবার চেষ্টা করছে শিবা। কোমরে চোট পেয়েছে ঝড়ের দিন পড়ে গিয়ে।মাসে পাঁচ ছয় হাজার টাকা আয় তো ছিল বটে।এখন কিছু নাই।
    টুপুর নিথর দাঁড়িয়েছিল। জাহির বা মেধার কাছে ত্রাণের কাজ কিছু নতুন ব্যাপার না । কোভিডের শুরু ।লকডাউনের শুরু থেকেই তারা একেকটা অঞ্চল ধরে কাজ করে যাচ্ছে।
    টুপুর একটা বদ্ধ ঘর থেকে বেরিয়ে খোলা প্রান্তরে পড়েছে। তার পা ডুবে যাচ্ছে লবণাক্ত মৃত্তিকায়।এ জীবন সে কখনো প্রত্যক্ষ করেনি আগে।
    চার


    শ্যামার সংসার
    এত ধূলা।এত অন্ধকার আর এত,বাতাস।কিছু দেখা যায় না।মাথার ওপর থেকে টিনের চাল যখন উড়ে যাচ্ছে , তখন শ্যামার মনে হচ্ছিল একটা টিন যদি ঘাড়ে এসে পড়ে? বাবলুকে বুকের মধ্যে সেঁটে নিয়ে চৌকি ধরে বসেছিল শ্যামা। শুধু শব্দ। বুঝতে পারছিল বাসনপত্র উড়ে যাচ্ছে। পড়ে যাচ্ছে ঝনঝন শব্দে ।কী কোথায় যাচ্ছে কোনো ঠিক নাই। শ্যামা হাউহাউ করে কাঁদে বাবলুকে জড়িয়ে ।টুসিবৌদির জানালা খুলে গেছে। মালতিদের টিনের চাল উড়ে গেল চোখের সামনে দিয়ে ।এত ভয়ংকর ঝড় কখনো চোখে দেখেনি শ্যামা ।সব যেন তছনছ হয়ে যাচ্ছে। বস্তিতে অধিকাংশ ঘরে টিনের চাল। সুখনলাল বলছিল ছাত ঢালাই করবে করবে। সেই আজ করবে আর কাল করবে।মানুষটাই হাওয়া হয়ে গেল।তার দেওয়া চালটুকু ছিল মাথার উপর। সেও উড়ে গেলে শ্যামা বেকুব বনে গেল। ঝনঝন শব্দ করে ভেঙে পড়ছে বস্তির উল্টো দিকে শোরুমের কাঁচ।মদন আর শিবু দৌড়ে গেল ঘরের সামনে দিয়ে চিৎকার করতে করতে । কোথায় গেল কে জানে।দরজা জানালা খুলে যাচ্ছে মনে হয়। দিগ্বিদিক জ্ঞান নেই শ্যামার ।শুধু বাবলুর মাথায় কিছু ভেঙে না পড়ে। ঘরের যেটূকু অংশে চাল বেঁচে আছে, হামাগুড়ি দিয়ে ছেলেটাকে টানতে টানতে নিয়ে বসলো শ্যামা ।খালি চৌকির পাশে একফোঁটা জায়গা। ওপরের টিনটুকু লেগে আছে।না হলে ভিজে শেষ হবে। অনেকটা ভিজে গেছে।সময় কখন পার হবে সেই অপেক্ষায় দেওয়ালের সঙ্গে সেঁটে বসে থাকল দুটো প্রাণী। হাজার হাজার প্রাণী। উড়ে গেল লক্ষ লক্ষ ঘরের চাল।টিন।টালি ।অ্যাসবেসটস।বঙ্গোপসাগর কাঁপছে। মাথার ওপর ছাত নেই।ভেঙে পড়ছে ঘরের দেওয়াল আর ফসল ভেসে যাচ্ছে খড়কুটোর মত। শ্যামাসুন্দরী তার মধ্যে সিকিখানিক খড়কুটোও না।
    এত বাতাস কোথায় থাকে, কোথা থেকে এলো মাগো! তিল তিল করে জমানো সংসার উড়ে যাচ্ছে চোখের সামনে দিয়ে । ভিজে ন্যাতাকানি হয়ে যাচ্ছে যথাসর্বস্ব । টিভি আছড়ে পড়ে গিয়ে জলে ভাসে।কুকুরগুলো বাইরে কেঁদে যাচ্ছে সমানে।ভেসে গেল বোধহয় জলের তোড়ে। কারেন্ট কখন চলে গেছে। ভর বিকেলবেলা ঘুটঘুটে অন্ধকার ।শ্যামার মনে হচ্ছে আর রক্ষা নাই।আর বাঁচবার উপায় নাই।কিন্তু সে নিজে না বাঁচলে ছেলেটা বাঁচবে কেমন করে। সে যে এখনো বড় ছোট।তারপর মাথার ওপর বাপ নাই। সুখন চলে গিয়েছিল বটে কিন্তু শ্যামার সংসার কেড়ে নিতে পারেনি। শাশুড়ি , ছেলে, ঘরদোর, বাসনকোসন আনাজপাতি , বউদিদের বাড়ি সব নিয়ে জাঁকিয়ে সংসার করেছে শ্যামা । একটা মানুষ তাকে ফেলে গেছে তো কী হয়েছে। শ্যামাসুন্দরী অমন কমজোরি মেয়েমানুষ নয় যে স্বামী লাথি মারলে কাঁদতে বসবে। সে তো আর পালায়নি।যে ভেগেছে সে বুঝুক । সে ভুগুক। ধম্মের কল বাতাসে নড়ে।বলতো শাশুড়ি মা। তা কার ধম্মের কল কীভাবে নড়ে সেসব শ্যামা জানে না অত।কিন্তু নিজের সংসারের হাল সে ছাড়েনি। দশরথ , সুফলদের সঙ্গে মশকরা করেছে সুখনের ওপর রাগে।অপমানে। খানিক নিজের মন ভোলাতে।কিন্তু সংসার এদিক থেকে ওদিক হতে দেয়নি। এমনকি ঐ দুর্মুখ শাশুড়ির ছাড়া কাপড় দু'বেলা সাবান ঘষে ফর্সা করে কেচেছে আর টানটান করে মেলেছে একফালি পিছনের ঘাসজমিতে। কাচা কাপড় তুলে ভাঁজ করতে শিখিয়েছিল বউদি। আগে শ্যামা যেমন তেমন করে ভাঁজ করত। মাঝখানে একটা ভাঁজ।তারপর গোটানো। বউদি হাতে ধরে শিখিয়েছিল কী করে জামা পেতে দুই কাঁধ বরাবর পিছনে ভাঁজ করতে হয়। হাতাও। তারপর বুকের কাছে ভাঁজ। তোষকের তলায় রেখে দিলে একেবারে ইস্তিরি। সুখনের আর ছেলের শার্ট ঠিক এভাবে ভাঁজ করত শ্যামা । শাশুড়ির সঙ্গে চুটিয়ে ঝগড়া করতে করতে পাট পাট করে ভাঁজ করতো বুড়ির থান। সব কাচা কাপড় ভাঁজ করে খানিক আলনাতে , খানিক আলনার নিচের বাক্সর ওপর গুছিয়ে রেখে গামছাগুলো দরজার পিছনে ঝুলিয়ে রাখত পেরেকে। ওঘর থেকে শাশুড়ি চেঁচাত, আমার গামছা আলাদা রাখলি না? তোদের সগড়ির গামছার সঙ্গে রাখলি ক্যানে? শাশুড়ির গামছা , কাপড় আলাদা করে তুলে রাখতে হত। রোদ লাগা কাপড়ে যে কী মায়া মায়া গন্ধ থাকে!
    সেই সমস্ত সংসার উড়ে যাচ্ছে চোখের ওপর দিয়ে ।ভেসে যাচ্ছে।ভেঙে যাচ্ছে। শ্যামার হাত পা ঠান্ডা হয়ে গেছে ভিজে ।টুসিবৌদির চিৎকার আর কান্না শোনা যাচ্ছে। কিছুই থাকল না আর।কিচ্ছু থাকল না। কোভিড এলেও শ্যামা দমেনি।বউদির টাকাটা ছিল হাতে।মাস্ক বানিয়েছে হরপ্রীতের সঙ্গে ।এখনো বেশ কিছু কাপড় জমানো ছিল ঘরে।থৈ থৈ জলে ভাসছে।
    এইবার আর কিছু থাকল না। সুখনলাল পারেনি। কোভিড পারেনি । কোয়ারেন্টাইনেও শ্যামা ভেবেছে ফিরে ঘরদোর শুদ্ধ করবে। নতুন করে কাজ শুরু করবে মাস্ক আর স্যানিটাইজারের । কিন্তু সব ভাসছে। শ্যামার বোধবুদ্ধি নাই আর। ঘরের কোণে বসে আকাশে তাকাতে ভয় করে। শুধু অন্ধকার । চোখে ধূলা ঢুকে জ্বালা। হঠাৎ মনে হল বাবলু বোধহয় ভয়ে সাড়হীন হয়ে আছে।
    নিজের সমস্ত ভয়, জ্বালা যন্ত্রণা ঝেড়ে ফেলে শ্যামা বুকে চেপে ধরা ছেলেকে ঝাঁকালো।
    - উঠো ।বাবা। ভয় নাই।উঠো। মুখ তুলো। আমি আছি তো। তোমার মা আছি তো। সব ঠিক হয়ে যাবে।সব।
    শ্যামার গায়ে কী ভর করেছিল কে জানে। সব জিনিস পত্র ছত্রখান হয়ে পড়ে আছে। ঝড়ের তাড়ায় কিছু দেখা যায় না। ছেলে ভয়ে প্রায় বেহোশ।দাঁড়াতে গেলে পড়ে যাচ্ছে শ্যামা। পায়ের কাছে উপুর হয়ে বাসন কোসন। কাঁচের দু তিনটে কাপ গ্লাস ফাটছে।হাতড়ে হাতড়ে ধ্বংসসতূপ থেকে বাইরে আসার চেষ্টা করছিল শ্যামা। তখন না বেরোলে মাথার টিন ভেঙে পড়বে।আর উপায় নেই।এক হাতের মুঠিতে শক্ত করে ধরে ছেলের হাত।বেরোনোর সময় শ্যামার মনে হল তার বেড়াল মঞ্জুর কথা। সে কোথায় আছে এখন? মঞ্জু ঠিক আছে এই প্রচন্ড ঝড়জলে?বড় নেওটা ছিল যে সে তার!

    বস্তি প্রায় ধ্বসে গেছে।টালি আর টিনের ধ্বংসস্তূপ।কোথায় যাবে এতগুলো মানুষ কেউ বুঝতে পারছে না। কালু বুলন , যারা মাথা উঁচিয়ে মাস্তানি করে বেড়ায়, একেবারে চুপসে গেছে। পেট ব্যথাতে শুয়ে আছে কালু। পা কেটে ফুলে ঢোল নাকি ।ভোর হচ্ছে কিনা বোঝা যায় না। এত অন্ধকার।বেলি তার গর্ভাবস্থা নিয়ে হেঁচকি তুলে যাচ্ছে ।আপাতত কেউই কিছু করতে পারছে না তার জন্য।রেবা হাঁচোড়পাঁচোড় করে দু একটা জিনিস টেনে তোলার চেষ্টা করছে।কিন্তু পারছে না। শ্যামা কোনো জিনিসের কথা ভাবছে না।বাবলুকে বাঁচাতে হবে।আর নিজে বাঁচতে হবে।বস্তির সামনে পাকা দোকানের বারান্দাতে ছেলে নিয়ে বসে থাকল শ্যামা।সারারাত। ওরা বারো তেরোজন বারান্দাটাতে উঠতে পেরেছে।বাকিরা অন্য দালানবাড়ির বারান্দা খুঁজছে।
    ঠায় বসে।সারারাত।
    কিন্তু তারপর! তারপর কী হবে?ঘর বলে কিছু নেই।আর।কোয়ারেন্টাইন সেন্টারে থাকার সময় বুকের মধ্যে একটা আশ ছিল।বন্ধ হোক যাই হোক।ঘর একখানা আছে।শাশুড়ি নেই, বর নেই।কিন্তু মাথার ওপর জাত আছে। একদিনের মধ্যে সে ঘর নেই হয়ে গেল।এবার তবে কোথায় যাবে শ্যামা!সারারাত জলে ভিজে ঝড় সয়ে ছেলেটা নেতিয়ে গেছে একেবারে। পেটে দানাপানি কিছু নেই। এরপর শ্যামা স্পষ্ট বুঝতে পারছে কালুদের দৌরাত্মি কতটা বাড়বে। ভয় পায় না শ্যামা। কিন্তু নিজেকে আরেকটু পোক্ত করতে হবে। আধার কার্ডের ঝামেলাটা মেটাতে হবে।মাথার ওপর একটা ছাত চাই।হরপ্রীত অত কিছু পেরে উঠবে না।নিজেই পরের বাড়িতে থাকে।

    আপাতত একটাই মুখ মনে পড়ল শ্যামার ।যার কাছে গিয়ে দাঁড়িয়ে বলা যায়, একটু থাকতে দেবে?
    ফুঁসে ওঠা ডাইনোসর ফিরে যাচ্ছে নিজের আবর্তে। প্রকৃতি তার নিজের খেয়ালে ধ্বংস ছড়ায়। এইসব নগণ্য বাড়িঘর , গাছপালা, মানুষ , পশুপাখি কিচ্ছু না তার কাছে।কিচ্ছু না।
    পাঁচ


    পোস্ট আম্ফান
    মে মাসের তেরো তারিখ থেকেই একটা নিম্ন চাপ অঞ্চল তৈরি হচ্ছিল প্রায় তিনশো কিমি এলাকা জুড়ে ।কলম্বোর পূর্বদিকে। এই নিম্নচাপের অভিমুখ উত্তর পূর্বদিকে। অভিমুখ বোঝা যায় । কোনদিকে যাচ্ছে কোন জাতীয় ডিপ্রেশন। সব মাপা যায় ।আই এম ডি।ইন্ডিয়ান মেটিওরোলজিক্যাল ডিপার্টমেন্ট।এরা ট্র্যাক করছিলেন নিম্নচাপের গতিবিধি।তাঁদের ঘোষণা ছিল সতেরোই মে নিম্নচাপ তীব্র হবে।আঠারোই মে তীব্রতর।
    পূর্ব মেদিনীপুর ।উত্তর চব্বিশ পরগণা।দক্ষিণ চব্বিশ পরগণা।কলকাতা।হাওড়া।হুগলি।ওড়িশা। আক্রান্ত হতে যাচ্ছে এইসব এলাকাগুলি।বঙ্গোপসাগরের দক্ষিণ পূর্বাঞ্চল এক হাজার কুড়ি কিমি বিস্তীর্ণ এলাকা থেকে বিশাখাপতনম পর্যন্ত ঘনীভূত নিম্নচাপ ।বাতাস জমছে ক্রমশ।

    নিম্নচাপকে ভরসা দিয়ে গেছে সমুদ্রের উপরিভাগের উষ্নতা।উত্তাল হাওয়া। সব ঝড়ের, জন্যেই কিছু ফেভারেবল কন্ডিশন প্রয়োজন ।ওপরের দিকের বাতাস যত ফেভারেবল হয়েছে, নিম্নচাপ তত পরিপুষ্ট হয়েছে।সিস্টেম কনসলিডেটেড।লো প্রেশার। লো প্রেশার থেকে ডিপ্রেশন। ডিপ্রেশনে থেকে সাইক্লোন।একটা আমূল বিবর্তন। বঙ্গোপসাগরের হিংস্রতম, ভয়ঙ্করতম সাইক্লোন।সবকিছুর একটা গোড়াপত্তন থাকে। একটা শুরু ।একটা শেষ।আর তারপরে সবটাই রেশ।আম্ফান মানে আকাশ । রেশ রেখে গেল গোটা দক্ষিণবঙ্গ , ওড়িশা জুড়ে ।

    কালু প্রথমে একটা নিরীহ, মুখ গোমড়া বাচ্চা ছেলে ছিল। যার মা তার বাপের সঙ্গে থাকে না।মা ভেগে এসেছিল অন্য একটা লোকের সঙ্গে । তার নাম গনা। সবাই গনা বলে ডাকে। কালু কোনোদিন তাকে বাপ বলেনি।মা কাজে বেরোলে লোকটা তাকে বিছানায় ডাকতো। খুব ভয় পেত কালু প্রথমে। তারপর অভ্যেস হয়ে গেল। মা জানত না, এমন নয়। কিন্তু কিছু বলত না। গনা যে বাইরের মেয়েমানুষের কাছে না গিয়ে কালুকে ব্যবহার করে, এটা মা মেনে নিয়েছিল। কালুর মধ্যে একটা নিম্নচাপ ছিল।কৈশোরে সেটা ডিপ্রেশনে চলে গেল।কালু সেভেনে স্কুল ছেড়ে দিল। গনা একদিন টপ করে মরে গেল।কালু তখন পনেরো। হাত , পা, চোয়াল শক্ত হচ্ছে। পেছনে আছে মা। কালুর সব দোষ ঢেকে দেবার জন্য। কেউ কিছু বলতে এলে মেনকার মুখ তুবড়ির মত ছোটে। কালুর যাবতীয় ইচ্ছেগুলো ফুটতে শুরু করল।কেউ বাধা দেবার নেই।হাওয়া দেবার আছে।সঙ্গী জুটে গেল যারা , কালু তাদের লিডার। কারণ তার অভিজ্ঞতা বেশি। বাপ মা'কে ঠেঙাত। মা' বাপকে ঠেঙাত। মা গনার সঙ্গে ভেগে এসেও গনাকে ঠেঙাত।গনা মা আর ছেলেকে খিস্তি দিত।পেটাত না।তার বদলে গনা কালুকে বিছানায় তুলত। মা খদ্দেরের জন্য সেলাইঘরে ডিউটির পরে বাজারের পিছনে লাইনবাজারে দাঁড়াত, এই সবই কালুকে খুব দ্রুত পরিণত নিম্নচাপে পরিবর্তিত করে।পার্টির হাওয়া গায়ে লেগে যায় ।কালু খুব ফ্লেক্সিবল। এটা তার বড় গুণ। কালু তুমি কার? যখন যে পার্টি, তার।
    কাজেই যে কোনো আমলেই হোক, কালু অপ্রতিরোধ্য ও অপ্রতিদ্বন্দ্বী শক্তি এলাকার।
    আম্ফান তাকে সাড়ে বারো হাত বেশি সুবিধা দিয়ে দিল।
    ঝড়ের দিন কালু মদ এবং সঙ্গীসাথী নিয়ে সানিবৌদির ঘরে ছিল।তার নাম সানি নয়।কিন্তু সানি লিওনির অনুরক্তরা তার নামটি প্রবর্তন করেছে।অতিরিক্ত ভাজাভুজি খাওয়া কালুর বারণ। জন্ডিস পাঁচবার। লিভারের হাল খারাপ। ঝড়ের দিন কালু পেটব্যথাতে কেৎরে পড়েছিল।তাছাড়া বস্তির লিভারের এইসব সময় যা করা উচিত, সেসব কাজে তার মন বা মতি কিছুই নেই। বিশেষ কিছু করার ছিলও না ঝড়ের মুখে। আর দশজন বস্তিবাসীর মত কালুও একটা পাকা দালান ধরে পড়েছিল।পরদিন বিকেলে সে আস্তে আস্তে মাথা চাড়া দিল।
    ধ্বংসস্তূপের মধ্যে গরীব মানুষ আর কী করতে পারে। এদিক ওদিক ছোটাছুটি করে লাভ নেই। মুড়িটুকু কেনার উপায়ও নেই।সব দোকান বন্ধ তো বন্ধ, জল ঢুকে অর্ধেক জিনিস শেষ। খাবার নেই ।জামাকাপড়ও নেই বলতে গেলে। মাথার ওপর ছাত ও ঘরে দরজা নেই। এই তো শ্রেষ্ঠ সময় রোঁয়াব জমানোর। কালু হামাগুড়ি ছেড়ে উঠে পড়ল।
    সরকারি ত্রাণ এসে যাবে । লোকজনকে কব্জা করতে হবে ঠিকমত। ত্রাণ সামগ্রী বন্টন করবে কালু ।ফেসবুক ছবি উঠবে।এতসব কিছুর মধ্যেও শ্যামাবৌদির দিকে নজর রাখতে হবে তো!
    বেচারি একলা মেয়েমানুষ।বর নেই।শাশুড়ি নেই।কালুর বিবেচনাতে হাজার হোক মেয়েছেলের মাথার ওপর একটা গার্জেন থাকা দরকার।এই মুহূর্তে কালু নিজের চেয়ে ভালো গার্জেন আর কাউকে খুঁজে পাচ্ছে না শ্যামার জন্য।
    সে তো বকলমে শ্যামার ভালোই চায়।মাথায় ছাতা ছাড়া মেয়েছেলে দেখলে তার ভীষণ দুর্বলতা জাগে। ঘর ঠিক করে দেবে। ত্রাণ এনে দেবে। তার বদলে কী সে কিছু চাইতে পারে না।কিন্তু মুশকিল হল, মেয়েছেলেটাকে খুঁজে পাচ্ছে না ঝড়ের পরে। প্যাংলা ছেলেটাকে নিয়ে সে গেল কোথায়? কালু মহা আতান্তরে পড়েছে।


    এইসব জমিতে শাহাজল চোদ্দ পনেরো বছর বয়স থেকে মাছ ধরেছে।এখন তার বয়স পঁয়ষট্টি হল।শাহাজল আতরাফ শ্রেণীভুক্ত ।তার ধারণা এইসব ঝড় ইবলিশের আমদানি।সে নিজে এখন ডিঙি নিয়ে বেরোয় না।এখন ব্যাটারা মাছ ধরে।শাহাজলের চার ব্যাটা ।দুই মাস লকডাউনে মাছের রপ্তানি একেবারে বন্ধ ছিল। তবে মাছ ধরা বন্ধ হয় নাই।অনেক কম দামে ভালো ভালো মাছ ছেড়ে দিতে হয়েছে।বাঁধ ভেঙে গিয়ে বিদ্যাধরী নদীর সমস্ত জল মাছের পুকুরে চলে এসেছে ।কিষানবিহারি মাঝি মাথায় হাত দিয়ে বাবুদের বলছিল ।প্রায় চল্লিশ বিঘা জমিতে পুকুর ভেসে গেছে।মাছের সিজন শেষ হলেই তো ধান বুনেছিল। ধান নাই।সব শেষ।সব।ধানের জমিতে পড়ে আছে ভাঙা টিন আর অ্যাসবেসটস।এ হল মিনাখাম অ্যাসেম্বলি কনস্টিটুয়েন্সি।আতাখামের
    আগে ওরা গেছিল পূর্বদারোগাপুর।সেখানেও নোণাপানি ঢুকে সর্বনাশ করে গেছে ধানের।পাথরপ্রতিমার দ্বীপগুলো সব অদৃশ্য হয়ে গেছে। কিছু নাই। তারক ঘোষ চপচপে ভিজে মাঠ থেকে টেনে টেনে বিনষ্ট ধানগাছ তুলছিল।খররোদে ঘেমে ভিজে গেছে কালো শরীর।ওদের দিকে না তাকিয়েই প্রশ্নের উত্তর দিচ্ছিল। মৌসুমী দ্বীপের দিকে যায়ে দ্যাখেন। কুয়াশাতে ঘিরি আসে। কিছু দ্যাখবার পাইবেন না।তারক বা লিয়াকত। শাহাজল বা আরিফ বা কানাই কারো মুখেই মাস্ক নেই।আপাতত বাইরের লোক দেখলে ওদের একটাই জিজ্ঞাস্য। রিলিফ আসবে কবে?চাল, ডাল দিবে না গভমেন্ট?ত্রিপল দিবে না? ঘরবাড়ি তো কিছু নাই। রিলিফ আসতে কিছুটা সময় লাগে।
    জাহির একটা শক্তপোক্ত টিম করেছে বারোজনের। কোভিডের জন্য ক্রাউড ফাউন্ডিং এবং কমিউনিটি কিচেন ওদের আগেই চলছিল।সোশ্যাল মিডিয়া খুব কাজে এসেছে। মিডিয়ার দিকটা মেধা দেখে। নিয়মিত ।দুদিন বাদে বাদে একটা করে আবেদন। জাহির প্রথমেই বলেছিল, এরিয়া বেছে নিতে হবে। সবদিকে ছড়িয়ে লাভ নেই। যখন দলে দলে পরিযায়ী শ্রমিকরা ফিরেছে , ওরা হাওড়া বেল্টে কিচেন চালিয়েছে।একটা ডিব্বাতে ভাত আর মুরগির ঝোল। ডালটালের ঝামেলার মধ্যে যায়নি। সোজা এবং পুষ্টিকর। যাতে ভাত আর আলু দিয়ে ডিমের ঝোল। কুড়ি টাকা।কমিউনিটি কিচেন খুব কাজে এসেছে।এখনো চলছে , আসলে একটা সিস্টেম তৈরি হয়ে গেছে।
    কিন্তু আম্ফানের পর সবকিছু ছিটকে গেলো। কিচেনের টিনের চাল যে শুধু ভেঙে গেছে তা নয়, তার ওপর উপুর হয়ে পড়ে গেছে পাশের বিশালাকৃতি নিমগাছটি।যারা রান্না করতো কিচেনে , তাদের মধ্যে দুজনের পক্ষে আসা সম্ভব নয়।ঘরদোর একেবারে ভেঙে গ্যাছে। বাকি দুজন এসে সাফসুতরোর কাজে লেগেছে।কবে থেকে কিচেনের কাজ আবার শুরু করা যাবে কিছুই বলা যাচ্ছে না।অথচ এইসময়টাতেই সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন ছিল।অন্তত চারপাঁচদিন কম্যুনিটি কিচেন বন্ধ রাখতেই হচ্ছে। জাহির টুপুরকে বলেছিলো, তুই একটা বড় করে পোস্টার লিখে রাখিস। ছ' দিন বন্ধ ।তারপর মনে হয় আবার একটা সিস্টেমে ফিরে আসা যাবে।

    ওদের বেছে নেওয়া অঞ্চলটাতে জমির ধাঁচ ঐরকম। মাছের সময় মাছ। ধানের সময় ধান। ঝড়ের পর খেতে না পাওয়াটা নতুন কথা নয় এই এলাকায় লোকজনের কাছে। খেতে পাচ্ছিল না আগে থেকেই। এখন ঘর বলে যেটুকু ছিল তাও নেই। প্রায় শ'খানেক লোক আশ্রয় নিয়েছে মসজিদের ছাতে। স্কুলে যাবার কথা বলেছিল অঞ্চল প্রধান। কিন্তু সেলিমা খাতুন, বি এ পাশ মেয়ে ।সে আপত্তি করে। ইস্কুলবাড়িতে কোরাইন্টাইন সেন্টার। করোনারোগীর সঙ্গে থাকা যাবে না।
    যারা জিনিসপত্র দিতে এসেছে, তাদের ঘিরে একটা জমায়েত হয়। ছোট মোল্লাখালির এপারে কালিদাসপুর।ওপারে মরিচঝাঁপি ।টুপুর টের পাচ্ছে কেমন একটা নোণা গরম ঘিরে ধরছে তাকে।টপ টপ করে ঘাম ঝরছে। কড়া রোদে খুব করে কেউ যেন সেঁকে নিয়েছে তাকে। বাকিদের অবস্থাও একইরকম । টুপুর প্রথম বেরিয়েছে এদের সঙ্গে । আপাতত বাড়িতে তাকে না বলার মত অবস্থাতে কেউ নেই। তাছাড়া একটা অন্তত পজিটিভ ব্যাপার ঘটে গেছে। হ্যাঁ ।এটাকে পজিটিভই বলবে সে। ইন্স্পাইট অব অল দ্য ইভিলস দ্যাট হ্যাভ টেকন প্লেস।
    মালবিকা সামান্য নড়াচড়া করছে। ক্লিনিক্যাল ডিপ্রেশনের কেস সেরে উঠতে সময় নেয়। টুপুর মা' কে এভাবে দেখেনি কখনো। এত প্রাণহীন। এত নির্বাক। এত পাথরপ্রতিমা । রান্নাঘরে মালবিকাকে যেতে দেওয়া হচ্ছে না খুব একটা।টুকটাক গেলেও ত্রিদিব আটকে দিচ্ছেন। ঈশান মজুমদার বললেন, অতটা ডিসকারেজ আবার করবেন না কিন্তু । কিছু কাজ করতে দেবেন। মেক হার ফিল অ্যাট ইজ।কোনোভাবেই প্রেশার দেবেন না।
    স্নানটানগুলো ফিরে এসেছে খানিকটা। আগের মত ইলাবোরেট না হলেও নিয়মিত হয়েছে। মালবিকার দীর্ঘ চুল অযত্নলালিত দেখতে ত্রিদিবের এখনো পীড়া হয়। কিন্তু তিনি কিছুই বলেননি।টুপুর একদিন বলেছিল।মা, শ্যাম্পু করবে? এটা একটা নতুন ব্র্যান্ড। কন্ডিশনারটা ভালো। মালবিকা একমনে নখ কাটছিল।কোনো উত্তর দেয়নি।
    গভীর অভিমান জমাট বেঁধে আছে মুখচোখে।
    টুপুর ভাবে।কার ওপর অভিমান? দিদুন? বাবা? ফর বিনগ ইন টাচ উইদ রিনা যোশী?
    ড্যাম সিলি।
    ইদানীং বাইরে যেতে হচ্ছে ।টিকটিকির সঙ্গে সময় কাটছে না বিশেষ। মনমরা হয়ে বসে আছে নীল সবুজ ড্রাগনেরা।

    বেল বেজেছিল তখন। বেলা দশটা হবে। ও স্যালাড কাটছিল মন দিয়ে ।ছুরি দিয়ে কুচিকুচি করে শসা, পেঁয়াজ, ক্যাপসিকাম কাটতে বেশ লাগে।এইরকম কুচি কুচি করে সিস্টেমকে কাটতে ইচ্ছে করে ওর। এর মধ্যে আবার রক্তিম একদিন লং ড্রাইভে যাবার তাড়া দিয়েছে। ও দাঁতে দাঁত চাপে।মাই ফুট!
    ইদানিং বাড়িতে বেল বাজার পাট নেই। এমনকি মাছ বিক্রি করতে আমির বশিররাও আসে না ঝড়ের পরে। খবরের কাগজ বন্ধ । লোক সমাগম নেই। টুপুর নেমে দরজা খোলে।হাতে তখনো ছুরি এবং তারপরেই একটা জোরে চিৎকার দেয়, মা!
    এটা আনন্দের চিৎকার । জানে না কেন। কিন্তু ঝড়ের পাঁচ দিন পরে, তখনো ইলেকট্রিসিটি ফেরেনি। বাজার নেই। প্রচন্ড গরম। টুপুরের মনে হয়েছিল দিজ ইজ দ্য মোস্ট পজিটিভ থিংগ দ্যাট কুড হ্যাপেন টু দ্য হাউজহোল্ড অ্যাট দ্যাট পয়েন্ট অব টাইম।
    দরজার সামনে দাঁড়িয়ে । শুকিয়ে গেছে অনেক আগের চেয়ে । চোখ কোটরে। চুল অবিন্যস্ত । শ্যামা। শ্যামাদি। একহাতে ছেলের হাত। আরেক হাতে একটা পুঁটলি। দ্য মোস্ট পজিটিভ থিংগ দ্যাট হ্যাপেন্ড। টুপুর চেঁচিয়ে উঠেছিল।
    শ্যামা। রোগা।ক্লান্ত। কিছুটা অসুস্থ ।থপ করে বসেছিল বাড়ির সামনে।এইরকম একটা মানুষকে দেখেও যে মনের জোর পাওয়া যায়, ভাবতে পারেনি আগে। ত্রিদিব এসেও চমকে গেছেন।

    কী যেন খুব দরকার ছিল এই বাড়িতে ।ফাঁকা। শূন্য।গাছপালা ঝড়ে বিধ্বস্ত । শেষ হয়ে যাওয়া মাধবীলতার ঝাড়।হাত পায়ে ক্ষত নিয়ে বাবা আর মেয়ে । ভাঙা কাঁচ এখনো ইতস্তত পড়ে আছে।শুকনো গুমোট হাওয়া ঘুরে বেড়ায় ঘরে।

    শ্যামাদিইই বলে জড়িয়ে ধরেছিল। সোশ্যাল ডিস্ট্যানসিং ভুলে গেছে তখন। মানুষ খুঁজছে ওরা।মানুষ।যার হাত ধরা যায় ।যার কাঁধে মাথা রেখে হুহু করে কেঁদে ওঠা যায় । ভাইরাস দূরে সরে যাচ্ছে ।দূরে সরে যাচ্ছে গভীর অরণ্যে বাদুড়ের কলরব।

    ছয়
    বাড়িটার গঠন বেশ আকর্ষণীয় । ঠাকুর্দার আমলের বাড়ি ভেঙে চুরে অনিল এবং পলি নিজেদের পছন্দে বাড়ি বানিয়েছেন।একবার ইনসাইড আউটসাইড পত্রিকাটি তাঁদের এই গৃহটি ফিচার করেছিল।
    পলি খোলামেলা পছন্দ করেন।তাই এই দোতলা গৃহের অন্তর্বর্তী একটি নালুকেতু রয়েছে।নালুকেতু অবশ্য আগে থেকেই ছিল।পলি বাড়িটির অনেক আধুনিকীকরণ করেছেন।বাড়ির মধ্যে খোলামেলা হাওয়া চলাচল করবে।নালুকেতু হল খোলা উঠোন।অনিলের পূর্বসূরি এই গৃহটি এক হিন্দু পরিবারের কাছ থেকে কিনেছিলেন।এই অঞ্চলটি মূলত কিছু উচ্চবর্ণ ও অধিকাংশ নিম্নবর্ণ হিন্দু অধ্যুষিত ছিল।খ্রিষ্টধর্ম প্রসার শুরু হলে প্রথমে নিম্নবর্ণের হিন্দুরা ধর্মান্তরিত হতে শুরু করেন।উচ্চবর্ণের হিন্দুরা বাড়ি বিক্রি করে কোচি বা অন্যান্য জায়গায় চলে যেতে শুরু করলেন।অনিলের প্রপিতামহ সেই সময় একটি সম্পন্ন হিন্দুপরিবারের বাড়ি এবং প্রচুর ভূসম্পত্তি কিনে নিতে সমর্থ হন।তিনি একজন দক্ষ মেকানিক ছিলেন, ফলে মিশনারিরা তাঁকে এই ব্যাপারে প্রভূত সাহায্য করেছিল।
    এই পূর্ব ইতিহাসের কারণে কিছু কিছু তছুশাস্ত্র অনুযায়ী গঠন এই বাড়িটিতে আছে। ওঁরা সেটা নষ্ট করেন নি।তছু বা কাঠ এই গৃহনির্মাণের মূল উপাদান।তাছাড়া গ্রানাইটও আছে।আছে এই নালুকেতুটি। এটিকে ওপর থেকে ঢেকে দেওয়াই যেতো কিন্তু তাহলে বাড়ির সৌন্দর্যহানি ঘটবে বলে পলি সেটা করেন নি।কেরলের প্রাচীন স্থাপত্যশিল্প তছুসূত্র নিয়ে পলি অনেক পড়াশোনা করেছেন।সেই শাস্ত্র অনুসারে প্রাকৃতিক উপাদান যেমন কাঠ, পাথর, মাটি দিয়ে তৈরি গৃহের মানুষ চমৎকার স্বাস্থ্য সম্মত জীবন যাপন করতে পারে।এতদিন পর্যন্ত এই সংসারে কোনো বিপর্যয় নেমে আসেওনি।নালুকেতুর মধ্যে একটি চৌকোণ জলাধার রয়েছে।সেটি যথেষ্ট বড়।তাতে বিশেষ যত্ন নিয়ে পদ্ম ফুটিয়েছেন পলি।জলাশয়ের ঠিক মাঝখানে একটি অতিক্ষুদ্র ভূমিভাগ। দ্বীপেরমত। পলি এই মিনি দ্বীপে তাঁর শখের গাছগুলি রেখেছেন।বড় এরিকা পাম। ক্যাকটাই ইত্যাদি শক্তপোক্ত গাছ যেগুলো গৃহের অভ্যন্তরে সুন্দর বেড়ে ওঠে।এই নালুকেতুর মধ্যে জলাশয়টির একটা নেচারাল ওভারফ্লো সিস্টেম আছে। সিলিংএর পাইপলাইনগুলি এখানে বৃষ্টির জল নিয়ে আসে। নালুকেতু ঘিরে, এর চারধারে অনিল ও পলি তাঁদের বাড়ির পাবলিক স্পেসগুলো রেখেছেন।একদিকে প্রশস্ত লিভিং এরিয়া।ডাইনিং এরিয়া।পড়ার জায়গা। ফ্রেঞ্চ উইন্ডোর পাশে একটা চেরি গাছে অজস্র পাখি আসে।
    আউটহাউসে আটাশদিন কাটিয়ে অনিলের কেমন একটা লাগছে। বেডরুমের বদ্ধ স্পেস তাঁর ভালো লাগছে না।খোলা জায়গায় থাকলে একটা অভ্যেস হয়ে যায় । তাই তিনি নালুকেতুর পাশে তাঁর ঠাকুর্দার আমলের মস্ত কাঠের রিক্লাইনিং চেয়ারটিতে গা ডুবিয়ে বসে আছেন। শরীরে কেমন একটা ছাড়া ছাড়া ভাব। রিংগো তাঁর কোলে উঠে বসে আছে।কিছুতেই ছাড়বে না। অনিল তাঁর প্রিয় একটি হলুদ রঙের শার্ট আর সাদা ধুতি লুঙ্গির মত করে পরে বসে দেখছেন পলি নালুকেতুর ধারে ধারে পিতলের প্রদীপগুলি সাজিয়ে দিয়েছেন। মাজা হয়েছে ঝকঝকে করে তাই আরো চমৎকার লাগছে। প্রদীপগুলির মধ্যে ভারি একটা শ্রী আছে।যেন গৃহের মঙ্গলকামনা করছে তারা।সব শুভ হোক।প্রদীপ সাধারণত হিন্দু বাড়িতে দেওয়া হয়, কিন্তু পলি তাঁর সেক্যুলার ইসথেটিক্সকে সদা জাগ্রত রাখেন।বিশেষ করে আজকের শুভদিনে তিনি হৃদয়ে কোনো কার্পণ্য রাখেননি। অল্টারে মোমবাতি দিয়েছেন। উঠোনে প্রদীপ।

    পলি, তাঁর মেয়ে ও মা, বোন সবাই কিচেনটি আলোকিত করে গল্পগাছা করছেন। পার্কোলেটরে কফি চাপানো হয়েছে।সেই গন্ধে ম'ম' করছে সারা একতলা।কুকিজ নামানো হচ্ছে আভেন থেকে সদ্য। সেই গন্ধও একটা পজিটিভ ভাইভ দেয়।অনিল তীব্রভাবে সেই পজিটিভিটিকে অন্তরে গ্রহণ করতে চাইছেন।এখন সেটা তাঁর ভীষণ ভীষণ দরকার ।
    বাড়িতে প্রবেশ করার আগেই যে খবরটা তাঁর মন ভেঙে দিয়েছে সেটা হল তাঁর সহকর্মী এবং সহযাত্রী ভিনু মুথালালাইয়ের মৃত্যু সংবাদ।ভিনু কোভিডের কাছে হেরে গেছেন। ভিনুর বাড়িতে তাঁর বৃদ্ধা মা, স্ত্রী এবং দুটি অল্পবয়সী মেয়ে আছে। অনিলের মনে বারবার এই মৃত্যুটি একটা ধূসর ছায়া ফেলে যাচ্ছে। ফ্লাইটে তাঁরা পাশাপাশি বসে এসেছেন। কত গল্প হয়েছে ছেলেমেয়েদের ভবিষ্যত নিয়ে ।
    এই যে রিংগো তাঁর কোলে বসে সমানে দোল খেয়ে চলেছে, যেন তিনি একটি রকিং চেয়ার এবং রিংগো পূর্ণ বিশ্বাসে নিজের শরীরকে তাঁর কাছে ছেড়ে দিয়েছে, এতে তাঁর ভয় হচ্ছে খুব।টেনশন বাড়ছে।ঘামছেন অনিল।
    বুকের মধ্যে স্পটটা ঠিকমত ডায়োগনাইজড না হলে শান্তি পাচ্ছেন না তিনি।
    যদি ক্যানসার হয়, তবে তাঁর সমস্ত প্ল্যানিং পাল্টাতে হবে। নতুন করে স্কেজিউল সাজাতে হবে। টাকা পয়সার ব্যাপার গোছাতে হবে।গুটিয়ে আনতে হবে ঠাকুর্দার আমলের ল্যান্ড প্রপার্টি। পলির পক্ষে এসব কিছুই হ্যান্ডল করা সম্ভব হবে না।ইন ফ্যাক্ট, পলি জানেনও না তাঁর কোথায় কী জমিজমা আছে ।সমস্তটা বিক্রিবাটা করে ক্যাশে পরিণত করা বেশ সময় সাপেক্ষ হবে।বিশেষ করে এই লকডাউন পিরিয়ডে। এবং লকডাউন উঠে গেলেও সমস্যা থেকেই যাবে।কোর্ট কাছারি কবে খুলবে কোনো ঠিক নেই ।
    অনিল ঈষৎ ঘামছেন। সাদা চুল এবং দাড়ি বেরিয়েছে অনেক।মেয়ে দৌড়ে এসে তাঁর খোঁচা দাড়ির ওপর চুমু খেল।মেয়ে অনিলের মুখশ্রী পেয়েছে।তার সরল চোখের দিকে তাকিয়ে থাকলেন অনিল। আর কতদিন তিনি এই অশান্তি ভোগ করবেন লাংগসের স্পটটা নিয়ে ?
    প্রদীপের শিখা তিরতির করে কাঁপছে।কী অপরূপ মায়া তার। সন্ধেবেলাটাকে একেবারে রূপকথা করে তুলেছে।অথচ অনিল কিছুতেই এই রূপকথাতে ভেসে যেতে পারছেন না। তিনি কি আজ পলিকে বলবেন তাঁর সংশয়ের কথা? একদিন না একদিন তো বলতেই হবে।তবে আজ নয় কেন?আবার ভাবলেন, দু একটি দিন যাক।পলি একটু হাঁপ ছেড়ে বেঁচেছে আজ।এতদিনের প্রতীক্ষার অবসান।টেনশন।ধৈর্য্য ।ভয়। একটু রিল্যাক্সড থাকুক।
    মুরুগন ঢুকল সদর দরজা দিয়ে । একটা ধবধবে সাদা লম্বা শার্ট পরেছে।হাতে ব্যাগও আছে। নিশ্চয়ই পলি কিছু অর্ডার করেছিলেন। বাড়িতে একটা উৎসব আমেজ ।কিন্তু বাইরের পরিবেশ ঠিক নেই।ফাদার ম্যাথ্যু সকালে বলছিলেন, করোনা ছড়াচ্ছে। এই ছোট জায়গাতেও আরো ছ' টি কেস ধরা পড়েছে । কোমর্বিডিটি না থাকলে তেমন ভয়ের কিছু নেই।ডাক্তারদের সঙ্গে কথাতে এবং এই আঠাশ দিনের কথোপকথনে অনিল এই সারমর্মটি উপলব্ধি করেছেন। হ্যাঁ ।ফাইব্রোসিস হয়ে গেলে অবশ্য মুশকিল।ফুসফুস ক্লিয়ার রাখা দরকার । কিন্তু অনিল কিছুতেই টিভি দেখতে পারছেন না। আউটহাউসে টিভি ছিল না।ইচ্ছে করেই রাখেন নি।ঝামেলা ছিল না। টিভি দেখলেই টেনশন বেড়ে যাবে।তিনি জানেন।
    এখানে শাশুড়ি টিভি চালিয়ে রেখেছেন ডাইনিং হলে। নালুকেতুতে বসে সব কিছুই কানে আসছে অনিলের।উঠে দোতলাতে চলে যেতেই পারেন ।কিন্তু এই মুহূর্তে বদ্ধ ঘর কাম্য নয় তাঁর কাছে।
    নিউজ রিডার মৃত্যু মিছিলের কথা বলে চলেছে স্টিলের মত শীতল, ধাতব কন্ঠে ।
    বিশাল এল ই ডি টি ডাইনিং এশিয়াতে এমন করে সেট করা আছে যে নালুকেতুতে বসেও স্ক্রিন চোখে পড়ে।
    অনিচ্ছাসত্ত্বেও অনিলের চোখ বারবার চলে যাচ্ছে টিভির দিকে।
    ইতালিতে মৃত্যুমিছিল দেখানো হচ্ছে।একের পর এক শবদেহ নামছে। ডাক্তাররা ভেঙে পড়ছেন কান্নায় ।দিনরাত হাসপাতালে পড়ে আছেন কোভিড যুদ্ধের ফ্রন্টলাইন যোদ্ধরা। বেশ কিছু ডাক্তার নিজেরাও আক্রান্ত।
    অনিলের তীব্র বিবমিষা হচ্ছে এই দৃশ্য দেখে। একটু রাগও হচ্ছে। এরা কেন মানুষের সাইকোলজি বোঝে না? একজন সদ্য ফিজিক্যাল আইসোলেশন থেকে মুক্তি পাওয়া মানুষ কখনো এইসব খবর সহ্য করতে পারে?
    আর না পেরে, অনিল একটু উঁচু গলায় বললেন, প্লিজ চেঞ্জ দ্য চ্যানেল পলি। অর রাদার অ্যারেন্জ সাম মিউজিক!
    কন্যা পিংকি ভাইকে ঠেলে বাবার কোলে উঠে বসল।পলি কিচেন থেকে এসে চ্যানেল পরিবর্তন করার আগেই অনিল টিভিতে দেখলেন এক ঐতিহাসিক দৃশ্য।পুনরাবৃত্তি অবশ্য।তখন অনিল এইসব দেখেননি ।সেইসময় বিপর্যস্ত ছিলেন দেহে মনে। দেখার মত মানসিক অবস্থাই ছিল না।

    কিউবা ডাক্তার পাঠিয়েছে ইতালিতে।কোভিড যুদ্ধে ফিদেল কাস্ত্রোর দেশ বাড়িয়ে দিয়েছে মানবিকতার হাত।এটা ছিল বাইশে মার্চের খবর। সংবাদ পাঠিকা রেট্রোস্পেকশনের ক্লিপ দেখাচ্ছেন।

    একদল ঝকঝকে প্রাণবন্ত ডাক্তার বিমান থেকে নামছিলেন ইতালিতে কোভিড নাইন্টিনের মোকাবিলায় ।বিশ্ব ভ্রাতৃত্বের এক বিরল দৃশ্য।
    অনিলের ভাল লাগল। দিস ইজ আ পজিটিভ সাইন।প্রাণের ভয় করে না কেউ কেউ আজো।
    ওয়ার্ক মাস্ট গো অন।

    সাত
    কোভিড নাইন্টিন তাহলে এতটাই দুর্বল করে দেয়! শরীরে একেবারে জোর পাচ্ছে না দেবরূপ। পরপর দুটো রিপোর্ট নেগেটিভ আসা মানে তো রোগমুক্তি।
    কুঁড়েমি আর আলসেমি রোগের অবিচ্ছেদ্য অংশ।অভ্যেস হয়ে যায় । অদিতি বারবার বলছে, কিছুটা সময় উঠে ফ্রিহ্যান্ডগুলো করতে।কিন্তু ওর ইচ্ছে চলে গেছে। ন'টা নাগাদ ব্রেকফাস্ট করে খবরের কাগজ, ল্যাপটপ নিয়ে বিছানাতে চলে যায় । দুটো আড়াইটের সময় অদিতি ফিরলে একসঙ্গে লাঞ্চ । তারপর একটা অদ্ভুত ঘুম পায়। আগে কখনো এরকম হয়নি।নিশান্ত বলছে এটা দুর্বলতাজনিত কারনে।ঠিক হতে সময় লাগবে। কিছুটা হাঁটতে পারলে ভালো হত। কিন্তু লকডাউন সেটা আটকে দিয়েছে। একদিন নিচে নেমে খানিকটা এগোতেই মাথা টলে উঠল।তারপর আর রিস্ক নেয়নি।
    বাড়িতে জানিয়েছে, ভালো আছি আমি। একদম ফিট।
    অথচ সে জানে যে সে ভালো নেই। শরীর ঠিক না থাকলে মন ঠিক থাকে না।
    একটা গাঢ় অভিমানে মালবিকা যেন মুখ ফিরিয়ে নিয়েছেন। একবারও ফোন করেননি। টুপুর জানিয়েছে।দাদা, মা হ্যাজ গান টু ডিপ ডিপ্রেশন।
    ডিপ্রেশনে ভুগেছে বঙ্গোপসাগর। তারপর সাইক্লোন হয়ে উড়িয়ে দিয়ে গেছে অনেকগুলো উপকূলবর্তী অঞ্চল ।
    ইওর পেরেন্টস মাস্ট বি সেফ। আরন'ট দে?
    এইরকম ফোনের উত্তরে কীই বা বলা চলে।
    সেফটি।সিকিউরিটি ।এগুলো ভীষণ শিমেরিক টার্ম।ভীষণ আপেক্ষিক। যে মানুষগুলো বাড়িঘর মাটিতে মিশে গেল, পেটে ভাত নেই , তাদের তুলনায় তার বাবা মা দিব্যি ভালো আছে।অথচ সে জানে তারা ভালো নেই। তাদের অন্যরকম অসুখ আছে।সেগুলোকে শৌখিন অসুখ বলাটাও অন্যায় ইনসিকিউরিটি বিভিন্ন লেভেলে বিভিন্ন ভাবে এক্সিস্ট করে।সেফটিও।
    অস্থিরতা কাটানোর জন্য এখন সে খুব মন দিয়ে খবরের কাগজ পড়ছে। নতুন ।পুরনো।ফেসবুক ফলো করছে। ইয়েসটারডে ওয়জ গ্রেট। কী মনে হল , একটা গান গেয়ে ফেলল ফেসবুকে। অদিতি অবাক। তুই আগে কখনো এরকম করিসনি তো।
    অদিতি জানে দেবরূপ গান গায়।ভালো গান গায় ।মালবিকা ছোটবেলায় ছেলেকে ধরে বেঁধে গানে বসাতেন। তারপর সে নিজেই সুরের নেশাতে ঢুকে পড়ল। বাইরে কোথাও শেখেনি কখনো। কিন্তু সুরে গায়। বন্ধু বান্ধবের জন্মদিন। অ্যানিভার্সারি। পিকনিক ।বাট ইন ফেসবুক ফর দ্য ফার্স্ট টাইম
    জগজিত্ সিং এর গজল। মালবিকার পছন্দ ।উও কাগজ কি কশকি।
    গানটা শুনলেই একটা পুরনো গলি।এক শীর্ণকায় বৃদ্ধা। কাগজের নৌকা। ছবি ভাসে।
    দিস প্যান্ডেমিক হ্যাজ মেড ইউ ক্রেজি।
    অদিতি টোস্টে মাখন লাগাচ্ছিল।এই কাজগুলো ও দিব্যি ফোনে কথা বলতে বলতে সেরে ফেলে।মানে কান আর কাঁধ দিয়ে ফোন চেপে ধরে ঘাড় কাৎ করে, কথা বলে আর মাখন কাটে। মাল্টি টাস্কিং।
    কাগজের নৌকা উঠছে।নামছে। জগজিত্ সিং এর কী মাখন মাখন গলা। অথচ উনি নাকি গলার রেঞ্জ কম বলে ফিল্মে প্লেব্যাকের সুযোগ পাননি তেমন। উও বচপনকি ইয়াদে। মগর মুঝকো লওটা দো।
    মা নিশ্চয়ই এখন সেই ছোটবেলার স্মৃতি আঁকড়ে ধরে আছে। শি টুক দিদুন অ্যাজ আ শেল্টার। শেল্টারটা সরে যাওয়ার ফলে প্রচন্ড ইনসিকিউরিটিতে পড়ে গেছে। ট্রমাটাইজড। অ্যান্ড দেন দ্য প্যান্ডেমিক । লক ডাউন। আইসোলেশন। অ্যান্ড ফাইনালি আম্ফান।
    শেল্টার খুঁজছে।লক্ষ লক্ষ মানুষ শেল্টার খুঁজছে।শারীরিক ।মানসিক।যারা একটু ভরসা পেয়েছিল এ এম আই কাটবে না বলে, তারা আবার মুষড়ে পড়েছে।সিম্পটোম্যাটিক ।অ্যাসিম্পটোম্যাটিক । কে কোনটা বুঝতে পারছে না।দিল্লিতে বিশাল একটা জমায়েত শ্রমিকদের । কমপ্লিট কেওস। ওরা কে? পরিযায়ী না অভিবাসী? মাইগ্রেটরি শব্দটার মধ্যে একটা আলগা আদর লেগে থাকে।শীতের পরিযায়ী পাখি।উড়ে চলে যাবে। কিন্তু এরা কোথায় যাবে? হোয়ের ইজ দেয়ার ফাইনাল ডেস্টিনেশন?
    কলকাতার বন্ধুরা ছবি আপলোড করছে ফেসবুকে। বড়বড় সব গাছ পড়ে আছে রাস্তা জুড়ে ইলেকট্রিকের তার পেঁচিয়ে গেছে গাছের গায়ে।সবমিলিয়ে কেলেঙ্কারির একশেষ।
    এত গাছ ছিল বুঝি শহরটাতে? বোঝা যেত না তো!গাছ পড়ে যাবার পরে মনে হচ্ছে, শহরে তবে গাছ ছিল।ইঁটকাঠের জঞ্জালের সঙ্গে মিশে ছিল।ও স্ক্রোল করে যেতে থাকে।এত গাছ পড়ে যাবার ছবি আপলোড হয়েছে! টুপুর জানিয়েছে তাদের পাড়ার বড় দুটো গাছ ভেঙে পড়ে গেছে। ছাতের বাগান শেষ। কিচ্ছু নেই। মাধবীলতার ঝাড়টা পুরো মাটিতে লুটোচ্ছে।কী জানি।ঐ ন্যাড়া ছাতটা কিছুতেই ভিশুয়ালাইজ করতে পারছে না। মা আর তছনছ হয়ে যাওয়া ছাতবাগান কেমন সিনোনিমাস হয়ে গেল !
    মুমতাজ আন্টিকে ফোন করেছে ও।বলেছে, পারলে মায়ের সঙ্গে দেখা করবেন। ইফ ইট ইজ পসিবল ইন দ্য টাইম অব লকডাউন ।
    অনেকসময় একদম অপরিচিত মানুষের উপস্থিতি একটা পজিটিভ এফেক্ট দেয়। একটু নড়ে চড়ে বসে বিষন্ন মানুষ। পরিচিত ফর্মালিটির ঘেরাটোপে ফিরতে চায়। মা নিজের বৃত্তে ফিরে আসুক। এতদূর থেকে তার আর কীই বা করার আছে।

    একেক সময় মাথাটা ব্ল্যাংক হয়ে যাচ্ছে।অনেক মেইল এসে পড়ে আছে। নিচে গিয়ে হাঁটতে ইচ্ছে করে কিন্তু শরীরে শক্তি নেই। ও উঠে আস্তে আস্তে ব্যালকনিতে গিয়ে দাঁড়াল।
    একটা বড় পিপুল গাছ ।ঠিক ব্যালকনির পাশেই।পাতা উড়ে এসে পড়ে।নিচে তাকিয়ে দেখল অদিতি স্কুটি নিয়ে ঢুকছে ।পেছনের সিটে নিশান্ত। স্কুটি পার্ক করাতে করাতে অদিতি কথা বলছে নিশান্তের সঙ্গে । হাসছে খুব দুজনেই। কী প্রাণবন্ত দেখাচ্ছে ওদের।
    মাথাটা টলমল করে উঠল। সে কতদিন বাইরে যায় না। কতদিন দুর্বল শরীর নিয়ে ঘ্যাষটাচ্ছে। ওরা এত হাসছে কেন? কী নিয়ে হাসছে? তাকে নিয়ে? শরীর দুর্বল থাকলে হাসির কী আছে? তাছাড়া নিশান্ত ডাক্তার না! ইডিয়ট। হাসতে হাসতে এ ওর গায়ে লুটিয়ে পড়ছে! ওর মাথা দপ দপ করছে। হোয়াটস রং? কী ? অদিতি আর নিশান্ত কী এত গল্প করছে? ইস ইট পসিবল?এত হাসাহাসির কী আছে? রাগে গা জ্বলে উঠল।সচরাচর এরকম হয় না তো ওর! কোথায় সোশ্যাল ডিস্ট্যানসিং? অদিতি কী এরকম করতে পারে তার সঙ্গে? এটাও সম্ভব?এরকম বোধ কখনো আগে হয়নি তার।মাথাটা ভোঁ ভোঁ করছে। ইদানীং প্রায়ই অদিতি তার স্কুটিতে নিশান্তকে নিয়ে আসে ।প্রেটি নর্মাল। কিন্তু ওরা এত স্বাভাবিক ভাবে হাসছে দেখে ভয়ানক রাগ কেন হচ্ছে ওর?
    অ্যাম আই ফিলিং জেলাস? নিজেকে জিজ্ঞেস করলো।
    ছ'ফুট উচ্চতার নিশান্ত, যাকে অনেকটাই শরমাণ যোশির মত দেখতে তাকে মনে হত লাগল ঢ্যাঙা। শুঁটকো। ইডিওটিক। অদিতিকে মনে হচ্ছিল বড্ড বেশি নির্লজ্জ ।রোদে পোড়া । বিশ্রী। লাউড।খুব চেঁচিয়ে ওদের গাল দিতে ইচ্ছে করছিল।কিন্তু পারল না।
    অদিতি ওপর দিকে তাকিয়ে দেখতে পেল ওকে। হাসল ।হাত নাড়ল।
    নিশান্ত বলল , হাই।
    ও দাঁড়িয়ে থাকল।চুপ।
    তীব্র ঈর্ষা হচ্ছে এখন। নিশান্তের ডিভোর্সের ক্রাইসিস পিরিয়ড শেষ মনে হচ্ছে।হি ইজ কামিং ব্যাক টু লাইফ। সেটা তো ভালো কথা। কিন্তু অদিতি কেন এত ফ্রিলি হাসছে ওর সঙ্গে?
    ও নিজেও অবাক ফিল করছে।
    এইরকম আগে কখনো ফিল করেনি তো।অদিতি প্রচুর লোকজনের সঙ্গে মেশে। শি ইজ বর্ণ অ্যান্ড ব্রট আপ ইন পুনে। যথেষ্ট সপ্রতিভ ।
    সেসব তো'ও জানে।
    তবু একটা বিষাক্ত ঈর্ষা বোধ এখন ওকে শীতল করে দিচ্ছে।
    ওরা দু'জন ওপরের দিকে তাকিয়ে হাসছে।
    দেবরূপ কিছুতেই হাসতে পারল না।

    আট
    রেস্ট্রিক্টেড এলাকার বাইরে মৃত্যু দন্ডনীয় অপরাধ

    কাদা মাটিতে পা দিতেই থ্যাস করে একটা শব্দ হল আর ওর পা ডুবে গেল নরম থসথসে মাটিতে।এতটা নরম হবে , কাদাকাদা, ও'ভাবতেই পারেনি।বেশকিছু জায়গাতে ভাল পরিমাণে জল জমে আছে। কোলাপুরি একেবারে কাদা মেখে শেষ।পা টেনে তোলাই দায়।কোনোমতে টেনে তুলল তো চলা মুশকিল।সামনে অনেকটা রাস্তাই এইরকম কাদাজলের ।ও কী করে যাবে বুঝে পাচ্ছিল না।জাহির হো হো করে হেসে ফেলল ওর অবস্থা দেখে। বাকিরাও দু একজন মুচকি মুচকি হাসছে।জিনিসগুলো নামানো হচ্ছে ছোটা হাতি থেকে। গ্রামের লোক আসতে শুরু করেছে চার পাঁচজন করে। চাল, ডাল, আলু আর সয়াবিন এনেছে ওরা
    আলাদা করে প্যাকেট করা। সাবান আর মাস্ক রয়েছে।ওষুধপত্রও আছে।
    সারা পায়ে কাদা।ও চারদিকে তাকিয়ে গাছ দেখছিল।একটাও গাছের নাম জানা নেই। সো অকওয়র্ড।

    জাহির দেখছিল। বলল , চটি খুলে খালি পায়ে হাঁট। নাহলে এক পাও চলতে পারবি না।
    জীনসটা প্রায় হাঁটু পর্যন্ত গুটিয়ে নিল।স্ট্রেচেবলগুলো গোটানো খুব মুশকিল। টাইট হয়ে থাকে।

    মাথায় ঘোমটা। পুরু ঠোঁট। চোখ কুঁচকে কথা বলে।
    অনিমা সর্দার।
    বরের নাম বরেন সর্দার।
    বাঘে টেনে নিয়েছিল চার বছর আগে। সঙ্গে অনিমার মেয়ে ছিল।
    - চোখের সামনে টেনে নিয়ে গেল?
    - মেয়ে নৌকায় আছিল। ওর বাপ নামছিল মধু কাটতে । তখন বাঘে টানি নিল।
    - মেয়ে?
    - মেয়ে নৌকাত আছিল। অরে কিছু করে নাই।
    - মেয়ে ফিরল কেমন করে?
    - অন্য নৌকাত মাঝি দেখিছিল।
    - টাকা পেয়েছো সরকার থেকে? কোনো কমপেনসেশন মানে ক্ষতিপূরণ?
    - সরকার টাকা দিবে না। সরকারি ইলাকার বাইরে বাঘে টানি নিলে সরকার ট্যাহা দেয় না।
    - মানে?
    - সরকারি ইলাকা আছে।তারি মধ্যে মাছ ধরতি হবে।মধু কাটতি হবে। ইলাকার বাহিরে গিয়া মাছ ধরা, মধু কাটা নিষেধ। উমার বাপ ইলাকার বাহিরে গিয়া মধু কাটছিল।
    - কেন? এলাকার বাইরে কেন গেছিল?
    - সামনের দিকে জঙ্গলে গাছ কাটা গিছে। মধু নাই। সামনের দিকে মাছও নাই। তাই উয়ারা ভিতরে যাইত। ইলাকার বাইরে বাঘে কুমিরে নিলে ট্যাহা মিলে না।
    - তাহলে তোমার চলে কী করে? কয় ছেলে মেয়ে?
    - দুই মেয়া।এক ছেলে।ছেলে মাছ ধরে। আমি মাছ ধরি।
    - করোনার কথা শুনেছো? অতিমারী?
    - ঐ যে রোগ আইছে?
    - হ্যাঁ । বাড়ির বাইরে যাওয়া বারণ। মাস্ক পরতে হবে।
    - কী ?কী পরতে হইবে?
    - মাস্ক।
    - মুখে কাপড় দিছি তো। বলে ছেঁড়া ঘামে ভেজা আঁচলে মুখ মোছে।
    - বাড়ির বাইরে যাচ্ছো?
    - এই তো আইছি । ত্রাণ ধরতে।
    - না না। এমনিতে।
    - বাইরে না গেলে খাব কী? মাছ তো ধইরতে হইব।
    - ঝড়ের পর বেরোচ্ছে?
    - আইজ কাল যাই নাই। পরশো থনে যাতে হইব।
    - বাড়িঘর?
    - সব ভাঙি গিছে। ঝড়ে ভাঙিছে।
    - কোথায় আছো তবে এখন?
    - অপিসে।এনজিও অপিসে।
    বিধবা গ্রামের বাঘ বিধবা অনিমা সর্দার।বয়স পঁয়তাল্লিশ । নির্বিকার মুখে কথাগুলো বলে গেল।টুপুর ভালো করে দেখল।ওর মুখে কোথাও ডিপ্রেশন নেই।

    একটা রূপোলি আলোতে গোটা সুন্দরবন ঢাকা থাকে মা। অল্প অল্প চাঁদের আলো গাছের ফাঁক দিয়ে মাটিতে এসে পড়ে।কোনো গাছের তলায় গর্ভিণী হরিণ বিশ্রাম নেয়। বাঘের তাড়া খেয়ে সে ছুটেছে অনেকটা । হয়তো খুব বেশিদিন ছুটতে পারবে না।বাঘ গতিময়তায় হারিয়ে দেবে তাকে।হামলে পড়বে তার কোমল ঘাড়ের ওপর। এও প্রাকৃতিক নিয়ম। বাঘটি তখন কোনো হরিণশিশুকে খেয়ে জিরিয়ে নিচ্ছে গরাণের ছাতার তলায় ।কুমির শুয়ে আছে নিথর হয়ে ক্যানেলের পাড়ে।জলে কিলবিল করে খেলে বেড়ায় সাপ।নিঝুম হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে সুন্দরী, গরাণ।টি টি শব্দে ডেকে যায় কোনো পাখি। চৈএএএএএ ।জঙ্গলের শব্দ শোনা যায় কান পাতলে।তিনদিনের সুন্দরবন ট্যুওরে গিয়ে, ইকো কটেজের নিরাপদ , উষ্ন, পাঁচতারা আরামে থেকে সে শব্দ পাওয়া যাবে না।
    তার মধ্যে দিয়ে ওরা মাছ ধরতে যায় মা।অন্ধকার জলে বড় মায়া।ওরা মা ব্যাটা রাত্রিবেলা চলে যায় দ্বীপে। সারারাত জাল ফেলে বসে থাকে অণিমা মন্ডল আর তার ব্যাটা।বুঝতে পারছো মা?জঙ্গলের রাত। নিস্তব্ধ ।নিশুতি। ক্যানেলের ধারে ধারে বাঘের আনাগোণা। প্রকৃতি কখন অতিপ্রাকৃত হয়ে ওঠে কেউ বলতে পারে না। তখন প্যাঁচারা জাগে। তখন বাদুড়ের গান শোনা যায়। ওরা উল্টো হয়ে ঝুলে পৃথিবীর ন্যাংটো চেহারা দেখে। তোমরা শীতকালে সুন্দরবন বেড়াতে যাও।তোমাদের ইকো হাটে গরম কফি । ওয়াইন ।সন্ধেবেলা এথনিক নাচ।
    স্পিডবোটে সকালে সদ্য আভেনজাত' কেক। বাটার টোস্ট। ওমলেট।ফলের রসের কমলা রঙে ডুবে যেতে যেতে তোমরা " বাঘ" " বাঘ" করে চিৎকার করে ওঠো। অথবা কুমির । কিন্তু সেটা ওদের আসল জায়গা না । ওরা ঘুরে বেড়ায় বনের গভীরে।যখন মধু কাটতে বা মাছ ধরতে মানুষ ক্যানেলের ধার ছেড়ে রেস্ট্রিক্টেড এরিয়ার বাইরে চলে যায়, কারণে বাইরে কিছু পাওয়া যায় না, বাঘ দেখে এই আশ্চর্য অনুপ্রবেশকারীকে।তন্ময় হয়ে দেখে। দুটো হাত কাজ করে চলেছে।একটা মাথা নড়ছে। তার এলাকাকে লুটে নিয়ে যায় কে? তারপর সে গন্ধে মাতাল হয়ে এগিয়ে আসে। নরম মাটিতে বসে যায় তার ভারি থাবার দাগ। ঝাঁপ দেবার আগে পর্যন্ত চলে বাঘে মানুষে এক প্রাগৈতিহাসিক দ্বন্দ্ব । যখন ঘাড় ভেঙে নিয়ে চলে যায় রক্তচিহ্ন রেখে, এক বিশাল অজগর সড় সড় করে চলে যায় ।যেন কিছুই হয়নি।
    এরপরেও ওরা মা ব্যাটা জাল ফেলে বসে থাকে সারারাত। কার ভরসাতে জানো? বনবিবি। বনবিবি রক্ষা করবে বিধবা গ্রামের অণিমাকে। করোনা কী করবে তার? আম্ফানে ঘর ভেঙে গেছে। ওরা মাস্ক পেয়েছে। পরে না। স্যানিটাইজার ফেলে রেখে দেয় । নৌকা বাওয়া বইতে হাতে কড়া পরে যায় ।ও'হাতে স্যানিটাইজার লাগে না মা।
    বাঘ বিধবাদের অনেকে শহরে চলে আসে ।দুটো পয়সা।কাজ ।লোকের বাড়ির কাজ। অণিমারা আসে না । মাটি কামড়ে পড়ে থাকে। ওদের সন্ধ্যা কেন, রাতেও আর বাঘের ভয় নেই।
    যদিও যে কোন মুহূর্তে সব শেষ হতে পারে।বাঘ।কুমির।সাপ ।করোনা। আম্ফান। ঝড়ের পর এনজিও অফিসের একতলাতে গাদাগাদি করে চল্লিশ জন মেয়ে পুরুষ শিশু। কবে ত্রাণ, কবে বাড়িঘর , কবে টাকা কেউ জানে না।

    অণিমা সর্দার কী তাই বলে বেঁচে নেই?মা। প্লিজ। জেগে ওঠো। এই দ্যাখো।শ্যামাদি তোমার চুল বেঁধে দেবে বলে তেল গরম করে এনেছে। (

    নয়

    পুনের বিকেলে গোলাপি আকাশ। একটা ক্যালাইডোস্কোপিক ভিউ।আকাশের দিকে তাকালে কেউ ভাবচটতেই পারবে না যে এখন প্রায় পাঁচশ কোভিড রোগী এই শহরের বিভিন্ন হাসপাতালে , নাকে নল নিয়ে শুয়ে আছে।তাদের পরিবারগুলি আছে মারাত্মক রকম আইসোলেশনে ।ইতিমধ্যেই মারা গেছেন আটত্রিশ জন।গোটা জেলাতে করোনা ভাইরাস রোগী প্রায় সাড়ে পাঁচহাজার। মোটেই ভালো অবস্থায় নেই শহর।এমনকি গ্রাম।কেউ নিরাপদ নয়।কোথাও নিরাপদ নয়। একটা ঝলমলে রবিবার, যখন কোথাও কোনো খাদ নেই প্রকৃতিতে, গাছের পাতা চকচক করছে সবুজে, আটজন পেশেন্ট মরে গেল। দ্যাট ওয়জ নিউজ।
    দেবরূপ বাড়িতে ফোন করেছিল সকালে। বাবা।
    - বাড়িটা কেমন ঠান্ডা হয়ে গেছে রে।
    - কোনো ইমপ্রুভমেন্ট নেই?
    - স্লাইট। অ্যাট লিস্ট ওয়ান পজিটিভ থিংগ।শ্যামা এসেছে।থাকছে এখানে।
    - ও গুড। শ্যামাদি এসেছে?দ্যাটস ভেরি গুড।
    - ও তো কোয়ারেন্টাইন সেন্টারে ছিল।পজিটিভ হয়েছিল।তারপর আম্ফানে ওর ঘর একেবারে পড়ে গেছে।
    - সবসময় আছে?
    - কোথায় যাবে আর? ছেলে নিয়ে এখানেই আছে। গুড ফর ইওর মম।ও জানে তোর মায়ের নিডগুলো।
    - সাউন্ডস সেলফিশ বাবা। তুমি কেন জানো না?
    - বাদ দে।কোনোমতে চলে যাচ্ছে। তুই শরীরের যত্ন নিচ্ছিস তো?
    - ডোন্ট ওরি। ঠিকাছি।কাজ শুরু করব।
    - চেক আপ করাচ্ছিস তো?
    - করাচ্ছি।রাখলাম।
    কট করে ফোন কেটে দিল।

    ঠিক একমাস আগে অসুস্থ হয়েছিল। নির্মাল্য সামন্তর আত্মহত্যার খবর এসেছিল ফোনে।

    নির্মাল্য এসেছিল ওর কাছে ফেব্রুয়ারিতে। মার্চে। তখন ওদের ফুল ফর্মে নিউজ কাভারের কাজ চলছে।রাত্রে ফিরত। ডিনারে বসতো দুজনে মুখোমুখি ।তখন কোভিড না।আগুন।
    অস্ট্রলিয়া তখন পুড়ছে। বুশ ফায়ার। ছড়িয়ে পড়ছে চারদিকে ।

    দুহাজার উনিশের জুন অস্ট্রলিয়ার কুইনসল্যান্ড ফায়ার অ্যান্ড এমারজেন্সি সার্ভিসের অ্যাক্টিংঙ ডিরেক্টর একটি সাবধানবার্তা দিয়েছিলেন। উত্তর অস্ট্রেলিয়াতে বুশফায়ার আসতে চলছে। সাবধান।
    প্রকৃতি সাবধানবার্তা দিয়ে চলে। আমরা অনুসরণ করতে পারিনা।
    অসম্ভব শুষ্কতা।মাটিতে বিন্দুমাত্র আর্দ্রতা নেই।সেন্ট্রাল কুইনসল্যান্ড আগুন আগেই সাবধানবার্তা দিয়েছিল। দুহাজার কুড়ির মার্চ মাসের নয় তারিখে আগুন ছড়ালো।টিভিতে দেখেছিলি, কীভাবে পুড়ে যাচ্ছে জঙ্গল ।কোয়ালাগুলো আধপোড়া হয়ে পড়ে আছে।জল চাইছে। ষাঠহাজার বিল্ডিং শেষ। প্রায় তিন হাজার বাড়ি পুড়ে ছাই।
    ব্ল্যাক স্যাটারডে ফায়ার।মাল্টিপল স্টেট অব এমারজেন্সি ডিক্লেয়ার করে অস্ট্রেলিয়ান ডিফেন্স ফোর্স নামানো হয়েছিল।
    তখনো আমরা কেউ কোভিডের কথা জানিনা।
    বাতাস ভয়ানক উত্তপ্ত ছিল অস্ট্রেলিয়াতে। তার সঙ্গে বজ্রপাত।আগুন ধরে যাবার সহজতম উপায় একে কী প্রাকৃতিক আগুন বলা যায় না মনুষ্যকৃত?
    তুই উত্তর খুঁজে যা নির্মাল্য ।অ্যাকচুয়ালি হি ওয়জ মাচ কনসার্নড।
    দেবরূপের চোখে শুধু ভাসে ক্যাঙ্গারু আর কোয়ালা। পুড়ে যাচ্ছে। ছটফট করছে।হাত বাড়িয়ে দিচ্ছে মানুষের দিকে।
    মিডিয়া তর্ক চালাচ্ছে। ইজ দিস ফায়ার নেচারাল অর ম্যানমেইড?
    ইজ কোভিড ভাইরাস নেচারাল অর ম্যান মেইড?
    নির্মাল্যর সঙ্গে শেষ দেখা। ভোরে বেরিয়ে গেছিল । তখন দেবরূপ ঘুমিয়ে । নোট রেখে গেছিল।বাই।

    নিশান্তকে দেখলেই কেমন ইরিটেশান হচ্ছে ইদানীং কিন্তু এরকম তো হবার কথা নয়।নিশান্ত এত যত্ন করে ট্রিটমেন্ট করেছে ওকে! হসপিটালে পর্যন্ত নেয়নি নিজের রিস্কে। অসম্ভব মেধাবী ডাক্তার ।অদিতি ব্লাইন্ডলি নিশান্ত ঠাকরেকে বিশ্বাস করে । রেগুলার নিজে দুবেলা এসেছে।ডায়েট চার্ট করে দিয়েছে।বেশি কথা বলে না। তবু কেন ওর এই ফিলিংগটা হচ্ছে? অ্যাম আই গেটিং পজেসিভ অ্যাবাউট অদিতি? অদিতি যে এত,ডিপেন্ড করছে নিশান্তের ওপর, এটা অসহ্য লাগছে।এমনিতে অদিতি ভীষণ কমপিটেন্ট ও কনফিডেন্ট।কিন্তু এখন কী ভয়ানক ভাবে নিশান্তকে মেনে চলছে! অ্যাজ ইফ ভগবান। শি ইজ স্পেন্ডিং টু মাচ টাইম উইদ দ্যাট গাই।
    দেবরূপ কেমন অস্থির বোধ করতে লাগল। নিজের শার্টের ঘেমো গন্ধ অসহ্য' লাগছিল। গন্ধবোধ ফিরে এসেছে বটে কিন্তু অনেক গন্ধই বিরক্তিকর লাগছে ওর।যখন গন্ধবোধ ছিল না, বেশ ছিল।ল্যাবে ফিরবে দু চার দিনের মধ্যেই । এমনিতে ল্যাব বন্ধ । পাঁচ , ছ জন অল্টারনেটিভ দিনে কাজ করছে।
    পুণে কোভিডকে আলিঙ্গন করেছে ।অথবা কোভিড পুনেকে।গোলাপি রঙটাকেও বিরক্তিকর লাগছে। অ্যাম আই ইনহেরিটিং ডিপ্রেশন ফ্রম মাই মাদার?
    অদিতি রুম ফ্রেশনার ব্যবহার করে না। তেজপাতা পোড়াচ্ছিল। এসেনশিয়াল অয়েল, টি ট্রি বা রোজমারি আরো কী সব দেয়।কর্পৃরটর্পূর। একটা ভেষজ সুগন্ধ খেলা করে ঘরের মধ্যে। এইসব নাকী মনের জন্য ভালো ।মন মাই ফুট!
    নিশান্ত আর অদিতি ঘরে ঢুকতেই ও স্টিফ বোধ করেছে ।পোড়া কোয়ালার মত।শুকনো।
    নিশান্ত এসেই সোজা ওয়াশরুমে চলে যায় ।অদিতির হাতে পেপারব্যাগে বেশ কিছু জিনিসপত্র।সবজি।কমপ্ল্যান।বিস্কিট।ম্যাগি।
    ম্যাগি ওর তীব্র অপছন্দের । খেলেই পেটে কেমন অস্বস্তি হয়। চাও অনেক বেটার।কিন্তু অনেক তরিবত করে চাও করার সময় অদিতির হাতে নেই। কাজেই সে ম্যাগি আনে। নিশান্তের বাথরুমে থাকার সময়টুকু ও ঘাড় গুঁজে খবরের কাগজে কাটায়।যাতে অদিতির চোখে চোখ না পড়ে।ওর রাগ, ঈর্ষা সব ও খবরের কাগজে ডুবিয়ে দিচ্ছে।
    অদিতি জিনিসপত্র তুলতে তুলতে আড় চোখে ওকে দেখল।মেপে নিল এবং বুঝে গেল গন্ডগোল হয়েছে কিছু।
    অচ্যুত শিবরামণ এবং মুমতাজ আহমেদের কন্যা অদিতি এইসব আলপটকা মন খারাপ বা মেজাজ বিগড়ে গুম হয়ে বসে থাকাকে মোটেই পাত্তা দেয় না।আবার মাতৃকূল বাঙালি হওয়া বশত সে ঠিক গুমড়ে থাকার সেন্টিমেন্ট ঠিকঠাক ধরে ফেলে। অদিতি একটা মেজেন্টা কুর্তা পরেছে আজ। সামনে শর্ট।পিছনে লম্বা। সঙ্গে কালো চুড়ি পা। সাধারণত ও জিন্স টপে চলে। আজ এই সাজের কারণ কি নিশান্ত ঠাকরে?
    খবরের কাগজের একটা শব্দঽও মাথায় ঢুকছে না। আর অদিতি সেটা খুব ভালো করে বুঝে গুণগুণ করে গান গাইতে গাইতে তেজপাতা পোড়ানো শেষ করে বিস্কিট তুলছে কাঁচের জারে। ও কোনো প্লাস্টিক কনটেইনার নিজেও ব্যবহার করে না। দেবরূপকেও করতে দেয় না।দেবরূপের বিগড়ে থাকা একেবারে বিপন্ন করে তছনছ করে দিচ্ছে সপ্রতিভ চলাফেরাতে, গুণগুণ গানে , কাঁচের জারে টুকটাক শব্দে ।কফির জলও বসিয়ে ফেলেছে দ্রুত হাতে। মেজেন্টা রঙের আভা ওর বাদামি ত্বকে। ঈষৎ চ্যাপ্টা নাকে।
    নিশান্ত বেরিয়ে এল ওয়াশরুম থেকে।ওর মধ্যে সবসময় একটা ঝকঝকে ভাব থাকে। অসম্ভব ফর্সা বলেই ফ্রেশনেসটা মেইনটেইন করতে পারে বলে দেবরূপের ধারণা। সাবানের একটা হাল্কা পরিচ্ছন্ন গন্ধও নিশান্তকে ঘিরে বেরিয়ে এল। হাইটের জন্য ওকে একটু ঝুঁকে টুলটা টেনে বসতে হয়। অক্সিমিটার হাতে তুলে নিতেই দেবরূপ বলল, আই হ্যাভ চেকড।ইটস ফাইন।
    ওর গলাতে স্পষ্ট অপছন্দ । খুব বোকা বোকা।নিশান্ত ওর চিকিৎসক। সে স্টেথো বসালো। এবং অক্সিমিটার রেডি করল। পুরো আপত্তিকে উড়িয়ে দিয়ে ।
    অদিতি তিনটে কফি মাগ রেডি করছিলো। দুটো লাল।একটা হলুদ। আধ শোয়া অবস্থাতে দেখল দেবরূপ।
    দুটো লাল মানে কে কে? অদিতি আর নিশান্ত? দেবরূপ হলুদ? শিশুসুলভ রিফিউজাল গলগল করে উঠে আসছে।
    তীব্র খ্যানখ্যানে সুরে বলল, আমি কফি খাব না।ম্যাগিও না।
    নিশান্ত ঘন নীল একটা শার্ট পরেছে।ও সবসময় শার্ট পরে। হাত গোটানো।ফর্সা হাতে নীল শিরা। এরপর চেকাপ খুব যান্ত্রিক ভাবে সম্পন্ন হল ।
    অদিতির হাতে লাল কফি মাগ। নিশান্তের হাতে হলুদ। একটা লাল মাগ পড়ে আছে। ফাঁকা।কিচেন টেবিলের ওপরে রাখা।কফির তলানি নেই। গদগদ চিনির চিহ্ন নেই।ফাঁকা।শূন্য।
    ও মোটামুটি ঘাড়ঘোঁজ করেই থাকল আজ। নিশান্ত টুকটাক কথা বলে চলে গেল । অদিতি কি থাকবে না থাকবে না?

    #করোনাকালীন (দুই)
    নয়
    পুনের বিকেলে গোলাপি আকাশ। একটা ক্যালাইডোস্কোপিক ভিউ।আকাশের দিকে তাকালে কেউ ভাবচটতেই পারবে না যে এখন প্রায় পাঁচশ কোভিড রোগী এই শহরের বিভিন্ন হাসপাতালে , নাকে নল নিয়ে শুয়ে আছে।তাদের পরিবারগুলি আছে মারাত্মক রকম আইসোলেশনে ।ইতিমধ্যেই মারা গেছেন আটত্রিশ জন।গোটা জেলাতে করোনা ভাইরাস রোগী প্রায় সাড়ে পাঁচহাজার। মোটেই ভালো অবস্থায় নেই শহর।এমনকি গ্রাম।কেউ নিরাপদ নয়।কোথাও নিরাপদ নয়। একটা ঝলমলে রবিবার, যখন কোথাও কোনো খাদ নেই প্রকৃতিতে, গাছের পাতা চকচক করছে সবুজে, আটজন পেশেন্ট মরে গেল। দ্যাট ওয়জ নিউজ।
    দেবরূপ বাড়িতে ফোন করেছিল সকালে। বাবা।
    - বাড়িটা কেমন ঠান্ডা হয়ে গেছে রে।
    - কোনো ইমপ্রুভমেন্ট নেই?
    - স্লাইট। অ্যাট লিস্ট ওয়ান পজিটিভ থিংগ।শ্যামা এসেছে।থাকছে এখানে।
    - ও গুড। শ্যামাদি এসেছে?দ্যাটস ভেরি গুড।
    - ও তো কোয়ারেন্টাইন সেন্টারে ছিল।পজিটিভ হয়েছিল।তারপর আম্ফানে ওর ঘর একেবারে পড়ে গেছে।
    - সবসময় আছে?
    - কোথায় যাবে আর? ছেলে নিয়ে এখানেই আছে। গুড ফর ইওর মম।ও জানে তোর মায়ের নিডগুলো।
    - সাউন্ডস সেলফিশ বাবা। তুমি কেন জানো না?
    - বাদ দে।কোনোমতে চলে যাচ্ছে। তুই শরীরের যত্ন নিচ্ছিস তো?
    - ডোন্ট ওরি। ঠিকাছি।কাজ শুরু করব।
    - চেক আপ করাচ্ছিস তো?
    - করাচ্ছি।রাখলাম।
    কট করে ফোন কেটে দিল।

    ঠিক একমাস আগে অসুস্থ হয়েছিল। নির্মাল্য সামন্তর আত্মহত্যার খবর এসেছিল ফোনে।

    নির্মাল্য এসেছিল ওর কাছে ফেব্রুয়ারিতে। মার্চে। তখন ওদের ফুল ফর্মে নিউজ কাভারের কাজ চলছে।রাত্রে ফিরত। ডিনারে বসতো দুজনে মুখোমুখি ।তখন কোভিড না।আগুন।
    অস্ট্রলিয়া তখন পুড়ছে। বুশ ফায়ার। ছড়িয়ে পড়ছে চারদিকে ।

    দুহাজার উনিশের জুন অস্ট্রলিয়ার কুইনসল্যান্ড ফায়ার অ্যান্ড এমারজেন্সি সার্ভিসের অ্যাক্টিংঙ ডিরেক্টর একটি সাবধানবার্তা দিয়েছিলেন। উত্তর অস্ট্রেলিয়াতে বুশফায়ার আসতে চলছে। সাবধান।
    প্রকৃতি সাবধানবার্তা দিয়ে চলে। আমরা অনুসরণ করতে পারিনা।
    অসম্ভব শুষ্কতা।মাটিতে বিন্দুমাত্র আর্দ্রতা নেই।সেন্ট্রাল কুইনসল্যান্ড আগুন আগেই সাবধানবার্তা দিয়েছিল। দুহাজার কুড়ির মার্চ মাসের নয় তারিখে আগুন ছড়ালো।টিভিতে দেখেছিলি, কীভাবে পুড়ে যাচ্ছে জঙ্গল ।কোয়ালাগুলো আধপোড়া হয়ে পড়ে আছে।জল চাইছে। ষাঠহাজার বিল্ডিং শেষ। প্রায় তিন হাজার বাড়ি পুড়ে ছাই।
    ব্ল্যাক স্যাটারডে ফায়ার।মাল্টিপল স্টেট অব এমারজেন্সি ডিক্লেয়ার করে অস্ট্রেলিয়ান ডিফেন্স ফোর্স নামানো হয়েছিল।
    তখনো আমরা কেউ কোভিডের কথা জানিনা।
    বাতাস ভয়ানক উত্তপ্ত ছিল অস্ট্রেলিয়াতে। তার সঙ্গে বজ্রপাত।আগুন ধরে যাবার সহজতম উপায় একে কী প্রাকৃতিক আগুন বলা যায় না মনুষ্যকৃত?
    তুই উত্তর খুঁজে যা নির্মাল্য ।অ্যাকচুয়ালি হি ওয়জ মাচ কনসার্নড।
    দেবরূপের চোখে শুধু ভাসে ক্যাঙ্গারু আর কোয়ালা। পুড়ে যাচ্ছে। ছটফট করছে।হাত বাড়িয়ে দিচ্ছে মানুষের দিকে।
    মিডিয়া তর্ক চালাচ্ছে। ইজ দিস ফায়ার নেচারাল অর ম্যানমেইড?
    ইজ কোভিড ভাইরাস নেচারাল অর ম্যান মেইড?
    নির্মাল্যর সঙ্গে শেষ দেখা। ভোরে বেরিয়ে গেছিল । তখন দেবরূপ ঘুমিয়ে । নোট রেখে গেছিল।বাই।

    নিশান্তকে দেখলেই কেমন ইরিটেশান হচ্ছে ইদানীং কিন্তু এরকম তো হবার কথা নয়।নিশান্ত এত যত্ন করে ট্রিটমেন্ট করেছে ওকে! হসপিটালে পর্যন্ত নেয়নি নিজের রিস্কে। অসম্ভব মেধাবী ডাক্তার ।অদিতি ব্লাইন্ডলি নিশান্ত ঠাকরেকে বিশ্বাস করে । রেগুলার নিজে দুবেলা এসেছে।ডায়েট চার্ট করে দিয়েছে।বেশি কথা বলে না। তবু কেন ওর এই ফিলিংগটা হচ্ছে? অ্যাম আই গেটিং পজেসিভ অ্যাবাউট অদিতি? অদিতি যে এত,ডিপেন্ড করছে নিশান্তের ওপর, এটা অসহ্য লাগছে।এমনিতে অদিতি ভীষণ কমপিটেন্ট ও কনফিডেন্ট।কিন্তু এখন কী ভয়ানক ভাবে নিশান্তকে মেনে চলছে! অ্যাজ ইফ ভগবান। শি ইজ স্পেন্ডিং টু মাচ টাইম উইদ দ্যাট গাই।
    দেবরূপ কেমন অস্থির বোধ করতে লাগল। নিজের শার্টের ঘেমো গন্ধ অসহ্য' লাগছিল। গন্ধবোধ ফিরে এসেছে বটে কিন্তু অনেক গন্ধই বিরক্তিকর লাগছে ওর।যখন গন্ধবোধ ছিল না, বেশ ছিল।ল্যাবে ফিরবে দু চার দিনের মধ্যেই । এমনিতে ল্যাব বন্ধ । পাঁচ , ছ জন অল্টারনেটিভ দিনে কাজ করছে।
    পুণে কোভিডকে আলিঙ্গন করেছে ।অথবা কোভিড পুনেকে।গোলাপি রঙটাকেও বিরক্তিকর লাগছে। অ্যাম আই ইনহেরিটিং ডিপ্রেশন ফ্রম মাই মাদার?
    অদিতি রুম ফ্রেশনার ব্যবহার করে না। তেজপাতা পোড়াচ্ছিল। এসেনশিয়াল অয়েল, টি ট্রি বা রোজমারি আরো কী সব দেয়।কর্পৃরটর্পূর। একটা ভেষজ সুগন্ধ খেলা করে ঘরের মধ্যে। এইসব নাকী মনের জন্য ভালো ।মন মাই ফুট!
    নিশান্ত আর অদিতি ঘরে ঢুকতেই ও স্টিফ বোধ করেছে ।পোড়া কোয়ালার মত।শুকনো।
    নিশান্ত এসেই সোজা ওয়াশরুমে চলে যায় ।অদিতির হাতে পেপারব্যাগে বেশ কিছু জিনিসপত্র।সবজি।কমপ্ল্যান।বিস্কিট।ম্যাগি।
    ম্যাগি ওর তীব্র অপছন্দের । খেলেই পেটে কেমন অস্বস্তি হয়। চাও অনেক বেটার।কিন্তু অনেক তরিবত করে চাও করার সময় অদিতির হাতে নেই। কাজেই সে ম্যাগি আনে। নিশান্তের বাথরুমে থাকার সময়টুকু ও ঘাড় গুঁজে খবরের কাগজে কাটায়।যাতে অদিতির চোখে চোখ না পড়ে।ওর রাগ, ঈর্ষা সব ও খবরের কাগজে ডুবিয়ে দিচ্ছে।
    অদিতি জিনিসপত্র তুলতে তুলতে আড় চোখে ওকে দেখল।মেপে নিল এবং বুঝে গেল গন্ডগোল হয়েছে কিছু।
    অচ্যুত শিবরামণ এবং মুমতাজ আহমেদের কন্যা অদিতি এইসব আলপটকা মন খারাপ বা মেজাজ বিগড়ে গুম হয়ে বসে থাকাকে মোটেই পাত্তা দেয় না।আবার মাতৃকূল বাঙালি হওয়া বশত সে ঠিক গুমড়ে থাকার সেন্টিমেন্ট ঠিকঠাক ধরে ফেলে। অদিতি একটা মেজেন্টা কুর্তা পরেছে আজ। সামনে শর্ট।পিছনে লম্বা। সঙ্গে কালো চুড়ি পা। সাধারণত ও জিন্স টপে চলে। আজ এই সাজের কারণ কি নিশান্ত ঠাকরে?
    খবরের কাগজের একটা শব্দঽও মাথায় ঢুকছে না। আর অদিতি সেটা খুব ভালো করে বুঝে গুণগুণ করে গান গাইতে গাইতে তেজপাতা পোড়ানো শেষ করে বিস্কিট তুলছে কাঁচের জারে। ও কোনো প্লাস্টিক কনটেইনার নিজেও ব্যবহার করে না। দেবরূপকেও করতে দেয় না।দেবরূপের বিগড়ে থাকা একেবারে বিপন্ন করে তছনছ করে দিচ্ছে সপ্রতিভ চলাফেরাতে, গুণগুণ গানে , কাঁচের জারে টুকটাক শব্দে ।কফির জলও বসিয়ে ফেলেছে দ্রুত হাতে। মেজেন্টা রঙের আভা ওর বাদামি ত্বকে। ঈষৎ চ্যাপ্টা নাকে।
    নিশান্ত বেরিয়ে এল ওয়াশরুম থেকে।ওর মধ্যে সবসময় একটা ঝকঝকে ভাব থাকে। অসম্ভব ফর্সা বলেই ফ্রেশনেসটা মেইনটেইন করতে পারে বলে দেবরূপের ধারণা। সাবানের একটা হাল্কা পরিচ্ছন্ন গন্ধও নিশান্তকে ঘিরে বেরিয়ে এল। হাইটের জন্য ওকে একটু ঝুঁকে টুলটা টেনে বসতে হয়। অক্সিমিটার হাতে তুলে নিতেই দেবরূপ বলল, আই হ্যাভ চেকড।ইটস ফাইন।
    ওর গলাতে স্পষ্ট অপছন্দ । খুব বোকা বোকা।নিশান্ত ওর চিকিৎসক। সে স্টেথো বসালো। এবং অক্সিমিটার রেডি করল। পুরো আপত্তিকে উড়িয়ে দিয়ে ।
    অদিতি তিনটে কফি মাগ রেডি করছিলো। দুটো লাল।একটা হলুদ। আধ শোয়া অবস্থাতে দেখল দেবরূপ।
    দুটো লাল মানে কে কে? অদিতি আর নিশান্ত? দেবরূপ হলুদ? শিশুসুলভ রিফিউজাল গলগল করে উঠে আসছে।
    তীব্র খ্যানখ্যানে সুরে বলল, আমি কফি খাব না।ম্যাগিও না।
    নিশান্ত ঘন নীল একটা শার্ট পরেছে।ও সবসময় শার্ট পরে। হাত গোটানো।ফর্সা হাতে নীল শিরা। এরপর চেকাপ খুব যান্ত্রিক ভাবে সম্পন্ন হল ।
    অদিতির হাতে লাল কফি মাগ। নিশান্তের হাতে হলুদ। একটা লাল মাগ পড়ে আছে। ফাঁকা।কিচেন টেবিলের ওপরে রাখা।কফির তলানি নেই। গদগদ চিনির চিহ্ন নেই।ফাঁকা।শূন্য।
    ও মোটামুটি ঘাড়ঘোঁজ করেই থাকল আজ। নিশান্ত টুকটাক কথা বলে চলে গেল । অদিতি কি থাকবে না থাকবে না?

    দশ
    স্কুটি গ্যারাজ করে অদিতি দোতলার দিকে তাকালো। গোল বারান্দা ঘেরা বাবার বেডরুমে এখনো আলো জ্বলছে। অচ্যুত শিবরামণ অনেক রাত পর্যন্ত পড়াশোনা করেন। আবার উঠেও পড়েন ভোরে। সামনে বাগানে জল দেন। তারপর প্রাণায়াম ইত্যাদি । জগিং সেরে এসে তিনি স্টাডিতে ঢুকে যান ।সেখানেই তাঁর ব্রেকফাস্ট পৌঁছে যায় ।কিন্তু কোভিডকালে তাঁর জগিং বন্ধ। বাগানের পরিচর্যায় অনেকটা সময় কাটান তিনি।কোনো মালি নেই।একটা পরিচ্ছন্ন ঝকঝকে ফলবতী ও ফুলবন্ত বাগান রাত্রিবেলাতেও ঝকঝক করছে। অদিতি জোরে একটা শ্বাস নিল। গোলাপ ।সে শুনেছে দেবরূপের মাও বাগান করেন।ছাতে বাগান করেছেন খুব সুন্দর করে।
    সে ছবিও দেখেছে। কিন্তু তাদের বাগানের ছবি মালবিকা দেখেন নি। মালবিকা শুধু অদিতির নামটা জানেন।ওয়ান অব দ্য ফ্রেন্ডস অব দেবরূপ।এর চেয়ে বেশি কিছু নয়।
    একটা নিঃশ্বাস ফেলে ডুপ্লিকেট চাবি দিয়ে দরজা খুলে অদিতি ভেতরে ঢুকে গেল। এটাই এ বাড়ির প্রথা। কাউকেই নিচে নামতে হবে না দরজা খোলার জন্য।মুমতাজ নিচে থাকেন বাড়িতে থাকলে।অদিতি না ফেরা পর্যন্ত ।
    অচ্যুত অনেক রাত অবধি পড়বেন।তিনি একজন খ্যাতনামা অ্যাডভোকেট।কোভিডকালে কোর্ট বন্ধ বটে কিন্তু তাঁর হাতে প্রচুর পেন্ডিং কেস।কাজেই তিনি সেগুলো নিয়ে কেস স্টাডি করতে ব্যস্ত ।মুমতাজ কলকাতা গিয়ে আটকে গেছেন লকডাউনে ।সেজন্য বাড়ির কোনো বেহাল অবস্থা হয়নি তবে অচ্যুত টেনশনে আছেন। এ বাড়ির দুটি কন্যাই খুব গোছানো ও বুদ্ধিমতী। তারা বাড়ি এবং বাবাকে ঠিকঠাক দেখভাল করে। কিন্তু অদিতিকে কাজের জন্য অনেকটা সময় বাইরে থাকতে হয়।ইদানিং সে পুণেতে পরিযায়ী শ্রমিকদের ওপর একটা ডকুফিল্ম তুলছে। আসা যাওয়ার সময় ঠিক নেই।মুমতাজ বাড়িতে থাকলে অচ্যুত এসব নিয়ে চিন্তাই করেন না।সময়ও পান না।বাট দিস লকডাউন, অ্যাবসেন্স অব মুমতাজ অ্যান্ড ইরেগুলার আওয়ার্স অব অদিতি।সব মিলিয়ে তিনি কিছু বিব্রত ।ছোট মেয়ে সুনিধি বাড়িতেই থাকে।হিস্ট্রি অনার্স থার্ড ইয়ার। তার কলেজ বন্ধ ।অদিতি যেমন পিতৃমুখী মেয়ে, সুনিধি মায়ের মত কাটা কাটা সুন্দর।অদিতি বাবার বাদামি ত্বক, চ্যাপ্টা নাক উত্তরাধিকারসূত্রে বহন করছে।সেই সঙ্গে পেয়েছে উভয়ের জেদ।
    বাইরে থেকে ফিরে সে একতলার গেস্টরুমে স্নান সেরে নিচ্ছে ইদানীং ।ওপরে যাচ্ছে একদম সকালে ফ্রেশ হয়ে।রাতে মাথা ভিজিয়ে স্নান করলে আবার ড্রায়ার চালিয়ে শুকোতে হবে।ক্লান্ত শরীরে সেটা সে আর পেরে ওঠে না। তার রাতের খাবার বলতে টোস্ট বা পরোটা।সবজি।চিকেন। ডাইনিং এ ঢাকা থাকছে। আপাতত সে সুনিধিকে নিচে নামতে না করেছে রাতে।
    সুনিধির একটা অসুখ আছে। হার্টে একটা ফুটো।অ্যাট্রিয়াল সেপ্টাল ডিফেক্ট। এ এস ডি।জন্ম থেকেই আছে ছিদ্রটি। অনেকদিন কোনো কষ্ট ছিল না।ডক সেইড ইট ইজ ওকে। তারপর গত দুবছরে ছিদ্রটি বড় হয়ে ওর কষ্ট বাড়িয়েছে। প্রচন্ড যন্ত্রণা হয় মাঝেমাঝে । অপারেশন হবার কথা আছে। কাজেই এক্স্ট্রা সতর্কতা নেওয়া খুব জরুরি। কো মরবিডিটি ইজ ডেন্জারাস ফর কোভিড ইনফেকশন।
    অনেকসময় অদিতি দেবরূপের বাসা থেকেই ডিনার সেরে আসে। কিন্তু আজ ইচ্ছে করে নি।ওর স্টুপিডের মত বিহেভিয়ার দেখে অদিতি বেরিয়ে গেছে।দুটো নার্সিংহোমে কাভার করে ফিরেছে বাড়িতে ।
    গিজার অন করে পরিস্কার পাজামা আর টি শার্ট রাখলো বাথরুমে । আপাতত গেস্টরুম তার ঘর। ইউটিউবে গান চালিয়ে দিল ।ব্লু টুথ কানেক্ট করলে নতুন স্পিকারটা ভালো কাজ দিচ্ছে।আশা ভোঁসলের মাখন মসৃণ কন্ঠ পিছলে পড়ছে সারা ঘরে।মেহগনি বার্নিশ করা খাটের বাজুতে।ওয়ার্ড্রোবে। ঘন নীল পর্দাতে। ইঁয়ু সজা চাঁদ কী ঝলকা মেরে আন্দাজকা রঙ।
    কত যে আশ্চর্য সূক্ষ্ম মোচড় আছে গানটিতে! অদিতি জন্ম থেকে দেখেছে তার মা রবীন্দ্রনাথের গান শোনেন। ভারি ভারি গান। এ পরবাসে। কী ধ্বনি বাজে। রূপে তোমায় ভোলাব না। নজরুলগীতি শোনেন। পরদেশী মেঘ।
    সেও শোনে।তবে সবসময় রবীন্দ্রসঙ্গীত সে নিতে পারে না। রিল্যাক্স করতে গেলে তার পছন্দ গজল। নতুন একটা বাথ সল্ট ঢাললো। নিশান্তকে ফোন করল একবার। দেবরূপের খুঁটিনাটি জিজ্ঞেস করে নিল। কতটা সুস্থ ।কাল থেকে কী রুটিন হবে।দেবরূপের ফ্ল্যাটে বড় আড়ষ্ট কেটেছে সময় আজ।নিশান্ত পেশেন্টের সামনে সবটা হয়তো বলবে না।অদিতি ও নিশান্ত স্কুল মেটস। একটা মেচুওর আন্ডারস্ট্যান্ডিং আছে দুজনের মধ্যে ।সেটা অদিতিকে একটা ভালো সেন্স অব সিকিউরিটি দেয়।সেপারেশনের পরে এই সুদক্ষ চিকিৎসকটি আরো পরিণত হয়েছে। পুরো কনসেনেট্রশন কাজেই দেয়।সে কখনোই নিজের ভেঙে যাওয়া দাম্পত্য নিয়ে ফোঁসফাঁস করে না। অভিযোগ করে না।বড় বেশি চাপা প্রকৃতির।

    বাথটাবে গা ভাসিয়ে বড় করে একটা নিঃশ্বাস ।গজলের সুর দরজা টপকে স্নানঘরে চলে আসার ফলে গোটা স্নান একটা পেলব সুরেলা অভিজ্ঞতা হয়ে যায় । দেবরূপ সাধারনত এ সময়ে একটা ফোন করে। অদিতি ঠিকঠাক ফিরেছে কিনা জেনে নেয়। আজ ফোন আসছে না।বাদামি ত্বকে একটা কফি স্ক্রাব ঘষতে ঘষতে অদিতির কান রয়েছে ফোনের দিকে।না।কোনো কল নেই।কানের লতির পেছনে ভালো করে লুফাটা ঘষতে ঘষতে অদিতি ভাবার চেষ্টা করলো, হোয়াই ডিড শী ফল ইন লাভ উইদ দেবরূপ?হোয়াট ওয়জ দ্য কেমিস্ট্রি? বাথটাব ভরে গেছে সুগন্ধি ফেনাতে।মোস্ট প্রবাবলি বিকজ অব দিস। অনেক বাঙালি ছেলের সঙ্গে পরিচয়, বন্ধুত্ব হয়েছে অদিতির। ও শিওর, তাদের মধ্যে শতকরা নিরানব্বই জন ওকে বলবে যে এদেশে মাইগ্রান্ট লেবার নিয়ে যারা ডকু বানায় , তারা সিউডো। তাদের কেউ কস্মিনকালেও কলতলায় স্নান করেনি।বা পুকুরে। তারা লেবারদের নিয়ে ছবি বানিয়ে বাথটাবে বসে ওয়াইন খায়।অল বোগাস। বাঙালি ইন্টেলেকচুয়াল ছেলেরা এইরকম কথা বলে।ইনস্টিটিউটে দেখেছে। দেবরূপ ওরকম নয়।ও সিরিয়াস।সংযত। অদিতির কী দোষ দ্যাট শী বিলংগস টু আ ওয়েল টু ডু ফ্যামিলি? দেবরূপ টিপিক্যাল ইন্টেলেকচুয়াল কথাবার্তা বলে না।সেটাই ওর ভালো লেগেছিল।

    কী ভয়ানক রিস্ক নিয়েছে সে এবং নিশান্ত।দেবরূপকে হসপিটালে নেয়নি নিজেদের দায়িত্বে।নার্সিংহোমে নেয়নি।পুরো চিকিৎসা চলেছে হোম আইসোলেশনে। যদি কিছু খারাপ হত! সমস্ত ব্লেম আসত তাদের ওপর। টেনশন ছিল এতো যে তখন এটা ভাবেনি। এখন এই চিন্তাটা ফিরে আসছে।কী বলত সে দেবরূপের পরিবারকে? নিজেকে?বাট নিশান্ত ওয়জ প্রেটি কনফিডেন্ট।অদিতি অবাক হয়ে গেছে ওর'গাটস দেখে।কী অবলীলায় ডিসিশন নিল!দেবরূপ অকারণে ট্যানট্রাম থ্রো করছে।অদিতি ভেবেছিল সেক্সুয়াল ইন্টিমেসির পরে দুটি তরুণ তরুণীর মধ্যে ভুল বোঝাবুঝির জায়গা কম থাকে। এখন বুঝতে পারছে শী ওয়জ রং। মাইন্ড হ্যাজ ইটস ওন টার্ন। অ্যান্ড বডি ইটস ওন।মিলতেও পারে।নাও পারে।একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বাদামি ত্বকের মেয়ে উঠে এলো বাথটাব থেকে। ঠিক তার বাবার প্রতিমূর্তি । কোনো প্রাচীন দেবী।

    যতই মুড খারাপ থাক, একটা চমৎকার স্নান, ফ্রেশ পোশাক, ঢুলুঢুলু গজল মুড আপলিফ্টের জন্য যথেষ্ট আরামদায়ক । অদিতি সাদা রাতপোশাক ব্যবহার করে।অন্য কোনো রঙ পরলে ওর ঘুম আসবে না। ডিও স্প্রে করে ডাইনিং টেবিলে বসল। পরোটা আছে। শুকনো চিকেন।আর ডাল। ছোট ছোট পরোটা বানিয়েছে সুনিধি। শী লাভস টু কুক।লাইক মম। খুব বেছেবুছে সুন্দর রান্না করে।

    ল্যান্ডিংএ শব্দ হল।অচ্যুত এসে দাঁড়িয়েছেন।পেছনে একটা মস্ত পেইন্টিং ।বাই সতীশ কক্কর।ওরিজিনাল।পিতলের পাত্রে গাছ।অচ্যুত বেশ লম্বা মানুষ। কালো গায়ের রঙ।উজ্জ্বল চেহারা। অদিতির মনে হয় কোনো এক প্রাচীন দেবতা ল্যান্ডিং এ দাঁড়িয়ে কথা বলছেন তার সঙ্গে ।

    - নিচে এসো না বাবা।দো আই হ্যাভ টেকন বাথ।
    - ইজ দেবরূপ টোট্যালি কিউরড?আজ একটু বেটার পেলে?
    - ইয়াপ। অলমোস্ট। উইক আছে একটু।
    - ডু টেক কেয়ার অব ইওরসেল্ফ বাবলস। অ্যান্ড ডু স্টে অ্যাট হোম।ফর সাম ডেজ। প্লিজ।
    অদিতির ডাক নাম বাবলস। সুনিধির বার্বি। কিন্তু অদিতি ওকে সুনি বলে ডাকে।
    চিকেন খুব ভালো হয়েছে। সুনিধি বাবার পাশে দাঁড়িয়ে ।ওর টিকোলো নাকের ওপর চশমার ফ্রেম ঝকঝক করছে।
    ইফ ইউ ওয়ান্ট সাম সুইট , দই আছে ফ্রিজে ।ইউ টিউব দেখে মিষ্টি দই বানিয়েছে সুনি।

    সে জানে ।কিছুদিন বাড়িতে থাকতে পারলে ভালো। খুব চাপ যাচ্ছে।
    অচ্যুত উঠে গেলেন। সুনিধিও।ইচ্ছে থাকলেও এখন আড্ডা মারার শক্তি নেই। অচ্যুত দরজা বন্ধ করলেন স্টাডিতে ঢুকে।
    অদিতি পরোটা ছিঁড়ছিল। অচ্যুত আর মুমতাজের একটা মারকাটারি প্রেমের ইতিহাস আছে। ও মাঝেমাঝেই মুড ভালো থাকলে বাবাকে জিজ্ঞেস করে, ডিড ইউ ফলো মণিরত্নমস বম্বে ইন ইওর লাইফ অর ডিড মণিরত্নম ফলো ইওর লাইফস্টোরি ইন বম্বে?
    দুজনেই বম্বেতে তখন। অচ্যুত সদ্য বম্বে হাইকোর্টে প্র্যাকটিস করছেন।মুমতাজের বাবা এসেছিলেন প্রপার্টি কেস নিয়ে । শাহাদাত ফজিল খান। মুম্বাই তখন বম্বে। ফজিল খান শাস্ত্রীয় সঙ্গীতসাধক। মুর্শিদাবাদে দাউদ খানের ছাত্র। বম্বেতে বেশকিছু প্লেব্যাক গাইবার সুযোগ হয়েছিল। তারপর আরো অনেক ছবিতে সেমিক্ল্যাসিকাল গান গেয়েছেন।সঙ্গে ছিল টেলরিং বিজনেস। নিজের মিউজিক স্টুডিও করেছেন ।মুমতাজের মা শাহনাজ পাক্কা বোম্বাইয়া। শাহনাজকে বিয়ে করে বম্বেতেই সেটল করেছিলেন ফজিল খান।মুমতাজরা চার ভাই বোন।
    তরুণ অচ্যুত ওদের বাড়িতে যেতেন কেসের ব্যাপারে।ফজিল মিউজিক স্টুডিও কিনেছিলেন এক জালি ব্রোকারের থ্রুতে। ল্যান্ড নিয়ে ডিসপিউট ছিল।শাহনাজের বাবা ছিলেন বলে ফজিলের বম্বেতে সেটল করা সহজ হয়ে যায় ।সেই ফজিল খানের কন্যা মুমতাজ অচ্যুতকে চা দিতে এসেছিল ড্রয়িং রুমে। টেবিলে পাতা ছিল গোলাপি ক্রুশের টেবিলক্লথ ।চাঁদও বোধহয় উঠেছিল গগনে।
    তারপর একটা তুমুল প্রেম।ততোধিক তুমুল পারিবারিক আপত্তি সত্ত্বেও বিবাহ।
    আইন কানুন নখদর্পণে। তাই অচ্যুত স্টেডি ছিলেন।
    তাঁর পরিবারের আপত্তি তো ছিলই।পরবর্তীতে ঝামেলা এড়াতে সোজা পুণেতে এসে প্র্যাকটিস শুরু করেন।দুই পরিবার থেকেই দূরে।
    অদিতি অ্যাডোরস হিম।
    আর এই গাধা দেবরূপ এতদিনেও বাড়িতে কিছু বলতে পারল না। নিনকমপুপ কোথাকার।
    মাস্ট হ্যাভ লার্নট সামথিং ফ্রম অচ্যুত।কী করে ডেয়ারিং হতে হয়।কী করে নিজের মতকে প্রতিষ্ঠা দিতে হয়।ইনস্পাইট অব অল অডস।
    ডাইনিং টেবিলের সামনেই মুমতাজের কিশোরী কালের একটি সাদা কালো ছবি।অদিতি মামাবাড়িতে খুব কম গেছে।কিন্তু মুম্বাইতে ঐ কাঠের সিঁড়িওয়ালা বাড়িটা ওর খুব পছন্দ ছিল।একতলাতে টেলাররা বসে সেলাই করত মেশিনে
    বারান্দা জুড়ে ছিট কাপড়ের পিস।অদিতির পুতুলের জন্যই যেন।সবুজ একটা মিনে করা দরজা দিয়ে ঢুকে একটা উঠোন। উঠোনের মধ্যে মস্ত একটা চৌবাচ্চা।চারপাশে বেশকিছু গাছ।নানারকম পাম। ডালিম ছিল একটা। বাড়ির ভেতরে এত অলিগলি যে ছোট বাবলস কিছুতেই তার মা' কে খুঁজে পেত না।কাঠের রেলিং দেওয়া একটা বারান্দাতে মুখ বার করে বসে খট খট করে সেলাই মেশিন চলতে দেখত।কাবাবের গন্ধ উঠত বিকেলের দিকে।
    অদিতির খুব ইচ্ছে ঐ বাড়িটাকে নিয়ে একটা ডকুমেন্টারি বানায়।রেমিনিসেস অফ ওল্ড বম্বে ।কে জানে কখনো হবে কীনা!
    আপাতত চিকেনের হাড় চিবাতে চিবাতে সে ভাবে কতখানি ভালবাসা থাকলে ঐ বাড়ি, চিরকালের চেনা পরিবেশ ছেড়ে বেরিয়ে আসা যায় । মুমতাজ পেরেছিলেন। সে? সে কী পারবে? না। অদিতির বেস ক্যাম্প এই বাড়িটা। এ সুরক্ষিত না থাকলে সে কোনো অভিযানেই যেতে পারবে না।দেবরূপের সঙ্গেও নয়।

    সিংকে বাসন নামিয়ে রাখল অদিতি ।জল দিয়ে রাখল।সকালে ধোবে।
    খুব ক্লান্ত লাগছে ওর। আজ আর ফোন আসবে না দেবরূপের। অদিতি গিভস আপ।
    ধপাস করে বিছানাতে শুয়ে ফোনটা হাতে তুলে নিল ও। একটা কল করা দরকার।একটু হাল্কা হওয়া । রিলিজ করা নিজেকে। এই একটা ফোনই ওকে শক্তি দেয় অনেকটা। অনেকটা।নিজেকে মেলে দেওয়া দরকার তার সামনে।গোটানো কার্পেট যেমন রোল করা থাকলে গন্ধ হয়।

    দুর্গন্ধযুক্ত আত্মা। মালিন্যময়।
    খুলে দিচ্ছে কার্পেট।রোল গড়িয়ে যাচ্ছে অকাতরে।হাওয়া বাতাস লাগুক।
    পাকিজাতে মীনা কুমারীর পায়ের সামনে লাল পারসিক কার্পেট খুলে যাচ্ছিল ।ছোট ছোট কোমল পা পড়ছিল সেই বহুমূল্য কার্পেটে। সেটা অবশ্য ছিল বিষাক্ত কার্পেট। কদর্য কামনার কার্পেট।
    আত্মিক দমবন্ধ ছিল।হু সেইড? রবার্ট ব্রাউনিং। মা আবৃত্তি করেন। কতদিন মা বাড়িতে নেই।থাকলে বোঝা যায় কী গভীর তাঁর উপস্থিতি ।
    মাই সোল স্মুদড ইটসেল্ফ আউট।আ লঙ ক্র্যাম্প্ড সোল।ফ্রেশনিং অ্যান্ড ফ্লাটারিঙ ইন দ্য উইন্ড।

    টাচস্ক্রিন। টক টক টক টক।
    হ্যালো মা!

    রাতে ছটফট করতে করতে একটা স্বপ্ন দেখেছিল।পঙ্গপাল। লক্ষ লক্ষ পঙ্গপাল উড়ে আসছে। শস্যদানা শেষ হয়ে যাচ্ছে। খেতখামার সব শেষ।গাছের গুঁড়িতে থিকথিক করছে পঙ্গপাল। আকাশ কালো করে উড়ে আসছে সব।
    একটা বিশাল আকৃতির লোক পিছন ফিরে শুধু হাইড্রোক্সিক্লোরোকূইন উইদ অ্যাজিথ্রোমাইসিন বলে চিৎকার করছে। সাপ্লাই মোর। ইট ওয়র্কস। স্বপ্নে অদিতি লোকটার পিঠে টোকা দিতেই সে ঘুরে তাকালো।
    সে লোকটা ডোনাল্ড ট্রাম্প। বিশ্রী হাসল তার দিকে চেয়ে ।
    টুইট।টুইট।টুইট।বিশ্বে তরঙ্গ ছড়িয়ে পড়ছে।
    ঘুমের মধ্যে ছটফটিয়ে উঠল বাবলস্। পাশে হাতড়ে দেখল কেউ নেই।(চলছে)
    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।
  • ধারাবাহিক | ০১ সেপ্টেম্বর ২০২০ | ২৪৩৪ বার পঠিত
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • | ০১ সেপ্টেম্বর ২০২০ ১৮:০১96850
  • চলুক। পড়ছি।
  • মৌলিক মজুমদার | 2409:4066:29e:e940::1bd:***:*** | ০১ সেপ্টেম্বর ২০২০ ২১:৫৫96854
  • পড়ে গেলাম ।ভাললাগা 

  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : guruchandali@gmail.com ।


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। পড়তে পড়তে মতামত দিন