আজকাল চারপাশে বেকড রসগোল্লা, বেকড সন্দেশ, চকোলেট মিষ্টি ইত্যাদি চোদ্দরকম হাবিজাবি দেখতে দেখতে মাঝে-মাঝে যখন বড় অবসন্ন লাগে তখন মনে পড়ে যায় লীলা মজুমদারের কথা। সাধারণ মধ্যবিত্ত বাড়ির রান্নাবান্না নিয়ে তাঁর মন্তব্য: "মন্দ জিনিস যে উপভোগ করে, তার চাইতেও শতগুনে অভাগা হল সেই মানুষ যে ভালো জিনিস উপভোগ করতে পারে না।" প্রাক-করোনাকালের অফিস-ফেরতা কোনও বিষণ্ণ বিকেলে হঠাতই তাই মনে পড়ে যায় আমার ঠাকুমার কথা। যাঁকে আমরা আদর করে ডাকতাম 'বাবুমা' বলে। অসাধারণ ছিল তাঁর নিরামিষ রান্নার হাত। আর দুধ, ছানা, ক্ষীর, সুজি, ময়দা, নারকেলের উপকরণে এমন সব খাবার-দাবার বানাতেন যার স্বাদ ছিল অমৃতসম। সে সবের নামও ছিল বাহারি। হরেক রকম পিঠে-পায়েস, নারকেলের নাড়ু-বড়ি, তক্তি, খইয়ের মুড়কি, মুড়ির মোয়া, কুচো নিমকি, জিবে গজা এসব তো ছিলই তার সঙ্গে ছিল এলো-ঝেলো, ভাজা বরফি, প্যারাকি, নারকেলের খাজা আরও যে কত কী! সব কিছুর নাম এই মুহূর্তে মনেও পড়ছে না। মায়ের কাছে শুনেছিলাম তাঁদের পিসিমার কথা যিনি বিজয়া দশমী ও কোজাগরী লক্ষ্মী পুজোর সময় নারকেল দিয়ে বানাতেন চিঁড়াজিরা -- ধবধবে সাদা সরু, সুগন্ধী ধানের চিঁড়ের মতোই ফিনফিনে পাতলা। অপূর্ব ছিল নাকি তার স্বাদ। ছোটবেলায় মায়েদের পুজোর পরে সেই পিসিমার বাড়ি যাওয়ার অন্যতম আকর্ষণ ছিল সেই চিঁড়াজিরা। সেই সময়ে ঠাকুমা, দিদিমা, মা-মাসি-পিসিরা যে গেরস্থালির কত কী জানতেন! তাঁদের একেকজনের স্নেহ-ভালোবাসা, মধুর ব্যবহার আর রান্নাবান্নার হাতের গুনের জন্যেই যেন একেকটি বাড়ির আলাদা একটা পরিচয় তৈরি হত আর সকলের কাছে। আচার, কাসুন্দি বা আম-কাসুন্দির জন্যেও বিশেষ খ্যাতি ছিল কোনও, কোনও বাড়ির। সে সময়ে বাড়িতে আত্মীয়-স্বজন, অতিথি এলে বাড়ির রান্না, বাড়ির খাবার দিয়ে আপ্যায়ন করাই ছিল আন্তরিকতার নিদর্শন। অন্য অর্থে তার মাধ্যমেই প্রচ্ছন্ন ভাবে ফুটে উঠত পারিবারিক সংস্কৃতি ও আভিজাত্যের নমুনা। পুরনো দিনের মানুষেরা সার সত্যটি বুঝেছিলেন, "খেতে যখন হবেই তখন ভালো করেই খাওয়া যাক না!" সকলে মিলে বাড়িতে একসঙ্গে বসে গল্প-গুজবের মধ্যে দিয়ে ভালো খাবার খাওয়া এবং খাওয়ানোর যে আনন্দ ও আন্তরিকতা তার থেকে কত দূরেই না আজ আমরা সরে এসেছি। আগেকার সময়ে বাড়িতে পারতপক্ষে 'দোকানের খাবার' আনানোর চল ছিল না। সাধারণ সব উপকরণ দিয়েই কত যে সুখাদ্য প্রস্তুত হত তার ইয়ত্তা ছিল না আর এখন "ইটিং আউট" আর "হোম ডেলিভারি" আমাদের বর্তমান সমাজ জীবনের সঙ্গে ওতপ্রোত ভাবে জড়িয়ে গেছে। বাইরের খাবারের মান যে কী হতে পারে তার নমুনা তো কলকাতাবাসী দেখেছেন। আর শুধু কলকাতা কেন, আত্মঘাতী মার্কিন রন্ধন-বিশারদ Anthony Bourdain ও তাঁর একটি লেখায় রেস্তোঁরার খাবার সম্পর্কে হাটে হাঁড়ি ভেঙে দিয়েছেন। এসব কথা ভাবতে ভাবতেই মনে পড়ল, বাবুমা খোয়া ক্ষীর এবং ছানা দিয়ে এক স্বর্গীয় মিষ্টি বানাতেন যার নাম ছিল, 'ভাজা বরফি'। ছোটবেলায় বাবুমার তৈরি সেই খাবারের স্বাদ এখনও ভুলিনি। আমার মা-কাকিমা-জেঠিমারা বাবুমার সঙ্গে হাতে হাতে বা তাঁর অবর্তমানে নিজেরা নাড়ু-বড়ি-মোয়া-মুড়কি-পিঠে-পায়েস-সন্দেশ-তক্তি সহ অন্যান্য সুখাদ্য প্রস্তুত করলেও বিশেষ করে এই খাবারটি আর কখনও করেছেন বলে মনে পড়ে না। অর্থাৎ এমন একটি অনন্য খাবার সৃষ্টির পারিবারিক ঐতিহ্য একটি মানুষের চলে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই হারিয়ে যাবে? এই প্রশ্ন আমাকে মাঝে মাঝেই আলোড়িত করেছে বিশেষত কলকাতায় বেশ কিছু বছর ধরে ক্রমেই মিষ্টির গুণগত অধঃপতন দেখে। অবশেষে স্মৃতির সরণি বেয়ে বাবুমার সেই মিষ্টান্নপাকের দৃশ্য মনে মনে চিন্তা করে নিয়ে একদিন নিজেই সেই 'ভাজা বরফি' বানিয়ে ফেলেছিলাম।
ভাজা বরফি
আশ্চর্য ঘটনা ঘটল এবারের বইমেলায়। অন্যান্য বই কেনার ফাঁকে চমকে উঠেছিলাম হঠাৎ একটি হার্ডবাউন্ড চটি বই নজরে আসায়। বইটির নাম "সুখাদ্যের সন্ধানে"। লিখেছেন সমীর দাশগুপ্ত। বইটি ইতস্তত ওল্টাতেই পাতায় পাতায় চমক। নিপাট বাঙালি এক কৃতবিদ্য সফল মানুষ পেশাগত প্রয়োজনে বিশ্বের বিভিন্ন দেশ ভ্রমণ করেছেন। আর নানা দেশের খাবার নিয়ে রয়েছে তাঁর অত্যন্ত সুরসিক এবং তথ্যপূর্ণ আলোচনা। বইয়ের মুখবন্ধে তিনি লিখছেন, "এই বইটিকে বলা চলে আমার বিস্তৃত ভ্রমণ-অভিজ্ঞতার এক সাংস্কৃতিক দলিল। কারণ আমার সর্বদাই মনে হয়েছে কোন দেশ কিংবা সমাজের একটি বিশ্বাসযোগ্য দর্পণ তার হেঁশেল। ...ভারতবর্ষের বহুবর্ণ হেঁশেলসংস্কৃতির পশ্চাদ্পটে রয়েছে তার সুদীর্ঘ ও বর্ণাঢ্য সাংস্কৃতিক সংশ্লেষণ।" বইয়ের গোড়াতেই এক অধ্যায়ে তিনি লিখছেন, "পৃথিবীতে আমার পরিচিত সব হেঁশেলের মধ্যে শ্রেষ্ঠ হচ্ছে ফরাসি, এবং তার পরেই সম্ভবত বাঙালি। এখানে অবশ্য হেঁশেল কথাটা শুধু কুইসিন-এর প্রকৃত অর্থেই বলছি, অর্থাৎ পাকপ্রণালীর সূক্ষ্ম ও পরিশীলিত দিকটি। এক প্লেট ফরাসি ধরণে কমলালেবু দিয়ে রান্না করা হাঁসের রোস্ট, কিংবা বাঙালি নিরামিষ ঘরের শুক্ত, আমার বিচারে সফিস্টিকেশনের আরেক নাম।"
ভাজা বরফি
যে লেখক সফিস্টিকেশনের নিরিখে ফরাসি হাঁসের রোস্টের সঙ্গে বাঙালি নিরামিষ রান্নাঘরের শুক্তোর মোক্ষম তুলনা টানতে পারেন তাঁকে কাল্টিভেট না করে উপায় আছে? তাই তখনই বইটি কিনে ফেলি। পরে পড়তে গিয়ে দেখেছি, রান্না ও খাওয়া দাওয়া নিয়ে এমন মজলিশি বই কমই আছে। চমকে গেলাম যখন দেখলাম, বইয়ের একদম শেষ দিকে তিনি যে "রাঘবশাহী সন্দেশ" এর কথা উল্লেখ করেছেন সেটি আদতে একেবারে আমার বাবুমার সেই "ভাজা বরফি।" বাবুমা কোন রান্নার খাতা রেখে যান নি। সৌভাগ্যের কথা, লেখক তাঁর মায়ের পুরনো চিঠির ঝাঁপি থেকে এই সন্দেশের কথা এবং তার প্রস্তুত-প্রণালী উদ্ধার করেছেন। এখানে আমি বইয়ের সেই অংশটিই তুলে ধরছি।
রাঘবশাহী সন্দেশ
"পাটিসাপটারই মতো আরেক রুচিকর মিষ্টি খাবার রাঘবশাহী সন্দেশ, যা মূলত উত্তরবঙ্গের প্রতিভাপ্রসূত। দীর্ঘকাল যাবৎ আমার মায়ের হাতে লিখে রেখে যাওয়া একখন্ড কাগজে রাঘবশাহী সন্দেশের প্রস্তুতপ্রণালী পুরনো চিঠির ঝাঁপিতে ছিল। আমার অল্পবয়সে যখনই ছুটিছাটায় বাড়িতে গেছি, মা মনে মনে এই রেসিপি অনুসরণ করে রাঘবশাহী সন্দেশ বানিয়ে খাইয়েছেন। এই সন্দেশটি এখন এনডেঞ্জার্ড স্পিসিজ বলা চলে, কাজেই মায়ের রেখে যাওয়া জীর্ণপ্রায় কাগজটি একেবারে লুপ্ত হয়ে যাবার আগে ওটিকে এভাবে বাঁচিয়ে রাখতে চাই।" এরপর লেখক তাঁর মায়ের চিঠির ওই অংশটুকু হুবহু লিখে দিয়েছেন -- "মাস কয়েক আগে বহরমপুর বেড়িয়ে ফিরে আসার পথে খাগড়াঘাট লাইনে রওনা হই। ট্রেনের গদিতে চাদর বালিশ পেতে একখানা বই নিয়ে শুয়ে পড়ি। নবদ্বীপ অবধি মাঝে মাঝে উঠে স্টেশনগুলো এবং চারপাশটা দেখছিলাম। ওই লাইনে প্রথম যাচ্ছিলাম বলে দেখার আগ্রহ ছিল। তারপর একসময় ঘুমিয়ে পড়ি। হঠাৎ বাইরে ফেরিওয়ালার ডাকে ঘুমটা পাতলা হয়ে যায়। সে ঘুরে ঘুরে ডেকে যাচ্ছে: রা - ঘ - বা - শা - হী স - ন্দে - শ। শুনেই মনটা অতীতে চলে গেল। সেই রাঘবশাহী। আজকাল তো কোন দোকানে দেখতে পাই না সেই লালচে আভার চৌকো, সাদা ক্ষীর ও ছানামিশ্রিত, ওপরে শুকনো বাদামি ক্ষীরের কুচি ছড়ানো সন্দেশ, ভেঙে খাবার সময় খাঁটি গরুর দুধের গন্ধ! সেই রাঘবশাহী সন্দেশ তো আর দেখি না! বহু বৎসর আগে পাবনায় আমার মা নিজের হাতে তৈরি করতেন।"
রাঘবশাহী সন্দেশ
মজার ব্যাপার হল, আমার পিতামহও ছিলেন পাবনার। কাজেই এই খাবার বানানোর ঘরানায় আমার বাবুমার তৈরি "ভাজা বরফি" খাবার সৌভাগ্য যে আমার হয়েছিল সে কথা আগেই বলেছি। স্মৃতি রোমন্থন করে তা আমিও বানিয়েছিলাম। প্রণালীতে সামান্য হেরফের ছিল। এতদিনে তার লিখিত ডকুমেন্টেশন পাওয়া গেল। কাজেই এই প্রণালী অনুসরণ করে আবার বানিয়েছিলাম। তবে আমার নিজস্ব অভিজ্ঞতায় মনে হয়েছে, বাবুমা যে ভাজা বরফি বানাতেন তার স্বাদ অনন্য। পুজো করার মতো নিষ্ঠার সঙ্গেই বাবুমা প্রতিদিনের রান্না বা খাবার বানাতেন। মনে পড়ে, সকালে স্নানের পর পরিষ্কার সাদা থান পরে পুজো সেরে এসে নিরামিষ রান্নার পাট চুকলে কয়লার আঁচে খাবার বানাতে বসতেন বাবুমা। পেতলের ডো-তে একটু ঘি গরম করতেন। তার মধ্যে দিতেন আগেই হাত দিয়ে ঝুরো করে রাখা খোয়া ক্ষীর। একটু ভাজার পর ভালো করে পাক দিয়ে ক্ষীর যখন নরম হয়ে গাঢ় বাদামি রঙ ধরত, তাতে দেওয়া হত পরিমাণ মতো চিনি। এরপর ক্ষীরের প্রায় সম পরিমাণ ছানা বাবুমা হাত দিয়ে ভেঙে মিশিয়ে দিতেন। মিনিট দু-তিন নাড়াচাড়ার পর উনান থেকে নামাবার আগে তার ওপর ছড়িয়ে দিতেন কিছু ছোট এলাচের গুঁড়ো আর খুব সামান্য কর্পূর। একটা বড় ঘি-মাখানো পরাতে এরপর সেটা ঢেলে খুন্তি দিয়ে চেপে সমান করে দিতেন। ঠাণ্ডা হয়ে এলে বরফি বা চৌকো সন্দেশের আকারে কেটে নিলেই তৈরি হয়ে যেত সকলের প্রাণহরা ভাজা বরফি। রাঘবশাহী সন্দেশে কিছুটা ভেজে রাখা খোয়া ক্ষীর ওপর থেকে ছড়িয়ে দেওয়ার রীতি।
ছোটবেলায় থাকতাম বাবার কর্মস্থল উত্তরবঙ্গে। কলকাতা থেকে বাবা-মায়ের সঙ্গে ফিরে যাওয়ার সময় যখন খুব মন খারাপ হত তখন আমার বাবুমা ভাজা বরফি, নারকোলের খাজা আর এক শিশি গুড়ের বাতাসা সঙ্গে দিয়ে দিতেন আমার মন ভোলানোর জন্যে। গুড়ের লাল বাতাসাও ছিল আমার কাছে আকর্ষণীয় কারণ সেটা উত্তরবঙ্গের মফস্বল শহরে দেখিনি। কোথায় গেল আজ সেই সব স্নেহ আর সেই সব মানুষজন?
ভাজা বরফি
লেখার সঙ্গে যে ছবিগুলি দিয়েছিলাম হঠাৎ দেখি সে সব উধাও হয়ে গেছে। আবার ছবি দিলাম। বন্ধুরা দেখুন তো ভাজা বরফি আর রাঘবশাহী সন্দেশের ছবি দেখা যাচ্ছে?
হ্যাঁ দেখা যাচ্ছে তো
হ্যাঁ, দিব্বি আসছে। লেখা পড়ে আর ছবি দেখে খিদেও পেয়ে গেল। এখন উপায়!