এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • হরিদাস পাল  ধারাবাহিক

  • করোনাকালীন (এক) (সম্পূর্ণ)

    Anuradha Kunda লেখকের গ্রাহক হোন
    ধারাবাহিক | ২১ জুন ২০২০ | ১২৭৮৭ বার পঠিত | রেটিং ৫ (১ জন)
  • পর্ব এক

    ✨সে, করোনা ও লারা দত্তা

    বিকেলে কখন সে ঘুমিয়ে পড়েছিল। যখন ঘুম ভাঙল তখন সন্ধে নেমে গেছে। ঘরে আলো বেশ কম। ভারী পর্দা। একটা বিশ্রী গুমোট। পাশের ঘর থেকে টিভির শব্দ আসছিল। কোনো হিন্দি ছবি চলছে। সে কোনোমতে পা দিয়ে চটিজোড়া টেনে নিয়ে হাউসকোটের ফিতে আঁটল। এটা আমিশা প্যানেলের গলা। কহো না প্যায়র হ্যায়, গদর, এক প্রেমকথা আর ভুলভুলাইয়া ছাড়া আমিশাকে আর কোথাও দেখেনি সে। বোধহয় তেমন উঠতেও পারেনি মেয়েটা।

    অথচ গলাটা স্পষ্ট মনে আছে। বা এটাকে কি মনে থাকা বলে আদৌ। প্রথমে সে হাতড়াচ্ছিল। গলার টোনাল কোয়ালিটি, ফ্রিকোয়েন্সি, শার্পনেস মাপছিল আর মনে করার চেষ্টা করছিল বিভিন্ন নায়িকার মুখ। পাশের ঘরে ঢোকার আগে ঠিক ক্লিক করল আমিশা প্যাটেলের নামটা। মেঝেতে হরপ্রীত আর শ্যামা হাঁ করে বসে টিভি দেখছে। হরপ্রীতের মুখটা হাঁ হয়ে আছে। নাকে একটা সবুজ ফুল। অফফ হোয়াইট কুর্তাটা কেচে কেচে খ্যাসটা হয়ে গেছে। সবুজ সালওয়ার। পায়ের আঙুলে আংটি কিন্তু নেলপালিশ খাপচাখাপচা। দেখেই ওর বিরক্তি এল কিন্তু নিজের পায়ের দিকে তাকিয়ে দেখল ওর নিজের নেলপালিশ ও অর্ধেক উঠে গেছে। আধুনিক সচেতন নারীর সংজ্ঞার সঙ্গে এটা যায় না। ফ্রিজ থেকে ঠান্ডা জলের বোতল নিয়ে ঢকঢক করে গলাতে ঢেলে ও সোফাতে বসে পড়ল। আমিশা প্যাটেলের গলা অনুসরণ করে নায়িকার মুখের দিকে তাকিয়ে দেখল মেয়েটা আদৌ আমিশা নয়। টাইট একটা টপ আর কেপ্রি পরে মেয়েটা লারা দত্ত। লারার মুখে আমিশার গলা কতটা বেখাপ্পা এটা ভাবতে পারার আগেই শ্যামা খকখক করে কেশে উঠল। ও ভ্রূ কুঁচকে বলল, কাশছ সেই সাতদিন হল, ডাক্তার দেখাচ্ছ না কেন? ও প্রায়ই এরকম বলে এবং শ্যামার প্রায়ই এরকম হয়, মানে কাশি। তাই কেউ এরপর আর কিছু বলল না। শ্যামা ওর নকল বাটিক ছাপ শাড়ির আঁচলে মুখ চেপে রান্নাঘরে চা করতে গেল। ডাইনিং টেবিলে গুচ্ছের খাতা। একটা মাঝারি ফুলদানিতে কাগজের ফুল। দুটো ক্যাসারোল। চিনির শিশি। চায়ের কাপ। দুতিনটে রিমোট। সবচেয়ে বিরক্তিকর হল চেয়ারের ওপর একটা তোয়ালে রাখা। নিশ্চয়ই বর বা মেয়ে কেউ ফেলে রেখেছে এবং শ্যামা সেটা তোলার প্রয়োজন বোধ করেনি। হরপ্রীত একটা ফ্যাকাশে হাসি দিয়ে আবার টিভি দেখছিল । পেছনের পাড়াতে একটা অবাঙালি ব্যবসায়ী বাড়ির হোলটাইমার। একা দশজনের কাজ সামলায়। পাশের বাড়িতে কিছু খুচরো কাজ, বাসন মাজা এইসব করতে আসে । কিন্তু টিভি দেখতে এখানে আসে। চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে চ্যানেল পাল্টালো ও। আমি একটু খবর শুনে নেই। তারপর দেখিস। হরপ্রীত একটি সিনেমাপত্রিকা এবং শ্যামা পেঁয়াজের ঝুড়ি নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ল।

    টিভি সংবাদপাঠিকার চোখে নিখুঁত আইলাইনার ও মাস্কারা। তিনি ঈষৎ চোখ বড়বড় করে বললেন যে ভাইরাসটি ইতিমধ্যে চোদ্দটি দেশে প্রবলভাবে ছড়িয়ে পড়েছে। বিদেশে প্রায় আশি হাজার মৃত এবং মৃতের সংখ্যা ক্রমশ বেড়ে যাবে অনিবার্যভাবেই । এদেশে মুম্বাই শহরে ভাইরাসটি চলে এসেছে বিদেশ ফেরত যাত্রী মারফত এবং সবাই যেন মাস্ক ও স্যানিটাইজার ব্যবহার করেন। সংবাদপাঠিকা এও বললেন দেশে অচিরেই লকডাউন আসতে চলেছে এবং মুম্বাই শহরে শ্যারন মেহরা নামক গায়িকা ভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে ফিরেছেন ইউরোপ থেকে। ফিরে তিনি গৃহবন্দি থাকেননি। বিস্তর পার্টি করেছেন এবং মুম্বাই এর বস্তি এলাকাতে রোগ ছড়াতে শুরু করলে চরম বিপদ। সংবাদপাঠিকার ঠোঁটে একটা চমৎকার কমলা লিপস্টিক । কী শেড হতে পারে ও ভাবছিল। তখনি হরপ্রীতকে পাশের বাড়ির থেকে জোরে হাঁক দিল। হরপ্রীতের ফোন আছে। তবু ওর মালকিন নিছক প্রভুত্বের খাতিরেই হাঁক পেড়ে ওকে ডাকেন এবং ঐ লম্বা চওড়া মুখফোঁড় মেয়ে দৌড়ে ছুটে যায় । শ্যামাকে বলে দিল আলুপেঁয়াজের তরকারি বানাতে রাতের জন্য। আর পরোটা। চাল কিনে রাখা দরকার। এবং প্রয়োজনীয় গ্রসারি। চ্যানেল পাল্টানোর সঙ্গে সঙ্গে লারা দত্ত আবার চলে এলেন। এবার তিনি সাদা টি এবং ব্লু জিনস পরেছেন। ফেডেড। মরিচ রঙের চুল।

    ও চায়ে চুমুক দিল। চিনি কম।
    -তুমি কি মাস্ক পরছো লারা? স্যানিটাইজার দিয়ে হাত পরিষ্কার করছো?
    লাল লিপস্টিকের ফাঁকে লারা বিপন্ন বিষন্ন হাসলেন।
    তারপর আমিশার গলা বলল, আমাকে কুক করতে হচ্ছে, জানো? মাই কুক ইজ অন লিভ।
    -তাই? তুমি ঘর ঝাড়ুপোছা করছো লারা?
    -ও ইয়েস। লারা একটা মোহময়ী ভঙ্গি করলেন। ইউ ক্যান সি মি ক্লিনিং রুম অন ইন্স্টা।
    - আমাদের এখানে মাস্ক পাওয়া যাচ্ছে না। স্যানিটাইজারও পাচ্ছি না। আজকেই কি লকডাউন ডিক্লেয়ার হবে লারা?
    - প্রবাবলি। আমার সব শুটিং ক্যানসেল । আই ওয়জ সাপোজেড টু শুট ইন মালডিভস ।
    - আমার ছেলেটা তো পুনেতে আছে লারা। মেয়ের কলেজ ছুটি দিয়ে দিয়েছে বলে ও চলে এসেছে কাল। এলে কি হবে। সবসময় নিজের ঘরে দরজা বন্ধ করে পড়ে থাকে । কানে হেডফোন গুঁজে। লকডাউন হয়ে গেলে তো সবার বাড়িতে চলে আসা দরকার , বলো?
    লারা দত্ত নীল নখরন্জনী লাগানো লম্বা আঙুল দিয়ে টিভি থেকে হাত বের করে দিলেন। ওর থুৎনি ধরে আমিশা বলল, দ্যাট ইউ শুড নো। নিজের সব গুছিয়ে নাও। বাইরে যেও না। লারার চোখে গাঢ় মেকাপ। সর্দি কাশি বাঁধিও না। বা জ্বর। ব্রিথিং ট্রাবল। একদম না। তোমার ক্যান্সার হলে হোক। কিন্তু এইসব একদম না। তুমি তাহলে সোসাল আইসোলেশনে। বুঝেছ? লারা হি হি করে হাসতে লাগলেন আর ওর চা ক্রমশ অতিরিক্ত মিষ্টি বোধ হতে লাগলো। স্মোকি আইজ মেকাপে লারা পর্দাতেই মিশে গেলে অন্ধকার ভ্যাপসা হয়।
    শ্যামা চায়ের কাপ নিতে এল। ওকে দেখল সে। তারপর বলল, কাল থেকে তোর ছুটি। বাড়িতে থাকবি। মাস পড়লে এসে টাকা নিবি।
    শ্যামা ভাইরাস বোঝে না। মাস্স্ক চেনে না। স্যানিটাইজারও বোঝে না। ছুটি বোঝে। আর টাকা। চায়ের কাপ নিয়ে চলে গেল। রান্না শেষ। এবার বাড়ি যাবে।
    টিভি বন্ধ করে দিয়েই মনে হল, শ্যামার বর যেন কোথায় কাজ করতে গেছে? মুম্বাই বলেছিল না দিল্লি? ঠিক কোথায়? কিছুতেই মনে পড়ছে না । আবার হাতড়ানো শুরু করতেই প্রচন্ড ঘাম দিতে শুরু করল এবং ও দেখল মেয়ের ঘরের দরজা যথারীতি বন্ধ।

    ✨শ্যামাসুন্দরী

    কাজের বাড়ির বাইরে পা দিয়ে শ্যামা এক সম্পূর্ণ অন্য মানুষ হয়ে যায় । বন্দির দশা কাটলে যেমন হয়। ও জানে বৌদিরা ঠিক কী চায়। তাই কাজের বাড়িতে প্রবেশের আগে শ্যামা গায়ে আঁচল দিয়ে নেয়। সেই সঙ্গে খুলে রাখে পায়জোড়। ছমছম শব্দ করে বাড়ির মধ্যে চলাফেরা করা কোনো বৌদিই পছন্দ করে না। এবং পায়জোড়ের সঙ্গে সঙ্গে ও খুলে রাখে ওর যাবতীয় ছমকছল্লোপন, ছয়ল ছবিলি চলন, ভ্রূভঙ্গিমা, নখরাবাজি। বাসন মাজতে মাজতে ছেলের স্কুলের কথা বলে । ছেলের মাস্টারের কথা বলে। সবজি ধুতে ধুতে শাশুড়ির পিন্ডি চটকায়। ঘর মুছতে মুছতে পাশের বাড়ির বৌদি বা কাকিমার কিপটেমি বা বেহুদা হরকত আলোচিত হয়। ও জানে বৌদিরা ঠিক কোন কোন কথায় পুলকিত বা ক্রুদ্ধ হবে।
    কাজ শেষে বাড়ি ফেরার পথে শ্যামা তার সমস্ত অস্ত্র বিকশিত করে পথ চলে। নকল বাটিকের শাড়িতে হলুদ খয়েরি মিশেছে ওর চাপা রঙের দোসর হয়ে । বেরোনোর আগে পায়জোড় পরে নিয়েছে । শব্দ হচ্ছে ছমছম। আগাম ছুটি এবং হাতে আগাম পয়সা, এই সমস্তই ওর চলনকে খুব শ্রীময়ী করে রাখে। মুদির দোকানি সুফল বা সবজি বিক্রেতা দশরথ , মাছের ব্যাপারি সাজিদ এবং অনেকেই শ্যামা এবং শ্যামাদের এই মস্তানি চাল এবং আঁখোকি মস্তির সমঝদার। দুনিয়াতে সমঝদারি কে না চায় । কাজেই ডগডগে করে মেটে সিঁদূর পরা, মঙ্গলচন্ডী , শিবরাত্রি, ছয়ষষ্ঠী, নীলের উপোস , হালে নবরাত্রি ও করোয়া চৌথ সবিস্তারে পালন করা শ্যামা কোমর দুলিয়ে চোখ ঘুরিয়ে তার সমঝদারদের সঙ্গে দুটো রসালাপ করার মধ্যে কোনো দোষ দেখে না। শ্যামার বর সুখন। সুখনলাল মার্বেল মিস্ত্রি । বেশ ভালো রোজগার। উপরন্তু শ্যামার দুবাড়ি মিলে আটহাজার। একটা ছেলে। শ্যামার অপারেশন হয়ে গেছে। সবমিলিয়ে শ্যামা মন্দ ছিল না। সুখনলাল কোনোদিন মারধোর করেনি। নেশা করেছে মাপ রেখে। কিন্তু দু'বছর আগে সুখনলাল একটা প্রেমে পড়ে গেল। মেয়েটা শ্যামার মাসতুতো বোন। মাধ্যমিক দিয়ে দিদির বাড়ি বেড়াতে এসেছিল। হুবহু দিব্যা ভারতীর মত মুখ। ঝলমলে হাসি । ঢলঢলে চেহারা। শ্যামা সকালে কাজে বেরোয় ভাত নামিয়ে, সন্ধ্যায় ফেরে বাজার করে। ছেলে স্কুলে যায় । হেডমিস্তিরি সুখন দেরি করেই কাজে যেত। ঝলমলে শালীর সঙ্গে প্রেম হবারই ছিল। সেটাও শ্যামা সামলে নিতে পারতো। কিন্তু সুখন এই প্রেমে মজনু হয়ে আরো রোজগারের নেশাতে দিল্লি চলে গেল। বোনটাকেও ভাগিয়ে নিয়ে গেল। বা সে স্বেচ্ছায় ভাগল। শোনা গেছে তারা বিয়ে করেছে এবং বর্তমানে মুম্বাই নিবাসী। বড় কাজের কন্ট্রাক্ট পেয়েছে সুখন। শ্যামা কেঁদে কেটে কিছু করতে পারেনি। অতএব শ্যামা ও ছেলে। পাশের ঘরে শাশুড়ি । শ্যামা দু চারটে টুকটাক ইশক করে বেড়ায় । তার তো শরীর মন বলে কিছু আছে! সেইরকম একজন আশিক দশরথ। কাজের বাড়ি, ছেলে, শাশুড়ি, আশিককুল নিয়ে সে দিব্য আছে প্রথমদিকের কান্নাকাটিকে অবহেলায় তিনথাপ্পড় মেরে। এখন আর মনেও পড়ে না। ফোন করা তো দূরের কথা।
    দশরথ এখন সবজি এবং কাপড়ের মাস্ক বিক্রি করে। ফিরতি পথে দুটো বেগুন, মূলো, আলু নিল শ্যামা। ফ্রি তে একটা মাস্ক।
    - খুব খতরনাক রোগ নাকি গো?
    - চোখে দেখা যায় না ভাইরাস। খবরের কাগজে লিখছে। ই লে। মুখ বেঁধে থাকবি।
    মাস্ক পরে নেয় শ্যামা। মাস্কের ওপর দিয়ে ওর কুচকুচে কালো চোখ চকচক করে। চোখে হাসি।
    -তালে তো হাসি দেখা যাবে না গো। শ্যামার কোমর নাচে।
    - তোর চোখেই কয়ামত আছে । দাঁত দেখে কি হবে। দোকান গোছায় দশরথ।
    লকডাউন আসছে। ওরা শুনেছে। লকডাউন কি কেউ বলতে পারছে না ঠিকঠাক। কিভাবে আসে তাও জানে না। শুনলে মনে হচ্ছে ছোটকালে দেখা কুঝিকঝিক রেলগাড়ির মত ঝমঝম করে চলে আসছে। লকডাউন। লকডাউন শব্দ করতে করতে।
    কাল বৌদিকে ভাল করে জিজ্ঞেস করতে হবে। ভেবেই জিভ কাটল।
    কাজে তো যেতে পারবে না। ছুটি। তাহলে ফোন করে জানতে হবে।
    দশরথ ফ্রিতে দুগাছা ধনেপাতাও দিল। মাছের ঝোলে কাঁচালঙ্কা কালোজিরে ধনেপাতা। সানলাইটে কাচা বিছানার চাদর। দশরথের সঙ্গে ধামাকাদার ইশক কখনোসখনো। সুখ বলতে শ্যামা এখন এটাই বোঝে। অবশ্যই দশরথের বৌ ডিউটিতে গেলে। ঝাড়াঝাপটা জীবনে মাঝে মধ্যে শাশুড়ির সঙ্গে বেদম ঝগড়া । বেশ লাগে শ্যামার। পাশে ঘুমন্ত ছেলের কপালে হাত দিয়ে দেখে ফের জ্বর এলো কিনা।
    আজ রাতে কষে ফিতে দিয়ে চুল বাঁধতে বাঁধতে শ্যামার চোঁয়া ঢেক উঠলো। বুকটা ছ্যাঁত করে উঠল। মুম্বাইতে রোগটা নাকি বস্তিতে বস্তিতে ছড়াচ্ছে । সে মানুষটা তো ওখানেই আছে সোহাগী বউ নিয়ে!অনেকদিন বাদে ঝিম ধরে বসে থাকল শ্যামা। ফোন খুলে নম্বরটা দেখল। অনেকক্ষণ।

    ✨তার কথা

    সে দেওয়ালের দিকে মুখ করে শুয়েছিল। এবার চিৎ হয়ে শুল। চোখের সামনে সাদা সিলিং। জানলা পর্দা টানা। হ্যান্ডলুমের পর্দা। হলুদ লাল স্ট্রাইপ। বিছানার চাদর হলুদ। টেবিল ঠাসা বইপত্র। যার অধিকাংশই সে আজকাল খোলে না। কম্পিউটারে সব কাজ হয়ে যায় । বা ফোনে। একটা মলিন মানিপ্ল্যান্টলতা । ছবি। হেডফোন দুতিনটে। দরজা বন্ধ । বেশির ভাগ সময় সে দরজা বন্ধ রাখে মা অনেক চেঁচিয়ে এখন হাল ছেড়ে দিয়েছে। তার পরনে একটা হাতকাটা সাদা ফতুয়া টাইপের জামা। সংক্ষিপ্ততম একটি কটন শর্টস। ফলে তার ওয়াক্সিং করা পদযুগল ইচ্ছেমত নড়াচড়া করছে । ডান হাতে একটি ট্যাটু। কানে চারটি ফুটোতে নানারকম মাকড়ি । তার মা তার এই পোশাকে সর্বত্র ঘুরে বেড়ানো নিয়ে বহুত ঝামেলা করেছে। তাই সে ঘর থেকে বেরোনোর পাট চুকিয়ে দিয়েছে। তার মতে পাশবালিশের খোলের মত নাইটি পরে তার মা যে সারাদিন বিচরণ করে সেটা তার বেশ অপছন্দ এবং যথাসম্ভব চিৎকার করে সেটা সে জানিয়েও দিয়েছে। ওয়েট লিফ্ট করার যন্ত্র মেঝেতে রাখা। শ্যামা ব্রেকফাস্ট ঘরে দিয়ে গেলে সে বাথরুমে ঢোকে। স্মোক না করলে পেট পরিষ্কার হয় না। লকডাউন হচ্ছে এটা শিওর। সে জানত। কাজেই মেস জবাব দিয়ে দিল। নাহলে সে থেকে যেত। বাড়ি আসত না। ইউনিভার্সিটি বন্ধ । পরীক্ষার ঠিক নেই। এইসময়গুলো কোন বন্ধুর বাড়িতে গিয়ে থাকাও সম্ভব নয়। নেহাত এই সমস্ত কারনে সে বাড়ি ফিরেছে। এবং নিজের ঘরে। পর্যাপ্ত সিগারেট এনেছে।
    একদম একা।
    বন্দি। নিজেকেই বন্দি রেখেছে। ব্রেকফাস্ট যথেষ্ট হেভি থাকে বলে সে লাঞ্চ খায় না। মা চারবার নক করে গেছে আছ। কারন শ্যামা ছুটিতে। সে দরজা খোলেনি। শুয়ে আছে চিৎ হয়ে ।
    সিলিং থেকে একটি ধূসর টিকটিকি দেখছিল দুজোড়া চমৎকার চোখ। বাসি কাজল লেগে আছে বলে মোহময়। অসম্ভব মিষ্টি একটা মুখ। চুলে হাইলাইট।
    বহুদিন ধরে মানুষের দেওয়াল, সিলিং, জানলা, বাথরুমের নিভৃতে, রান্নাঘরের আড়ালে থেকে থেকে টিকটিকি সব জানে। সব বোঝে। সে মেয়েটির দিকে চেয়ে ফ্যাকাশে হাসলো। সদ্য ডিম পেড়েছে ওর বইয়ের ফাঁকে। সে দেখেছে। চিৎকার করেনি। ফেলে দেয়নি। মেয়েটি হাসি ফিরিয়ে দিল চমৎকার রিফ্লেক্সে।
    টিকটিকি বলল- আর কতক্ষণ?
    - দেখি। উঠতে ইচ্ছে করছে না।
    - ব্রেকফাস্টে ফ্রেঞ্চ টোস্ট করেছে। ফলের রস। কলা। তরমুজ।
    - জানো, অতিমারী আসছে?এসব বলতে নেই।
    টিকটিকি স্থান পরিবর্তন করল।
    - তাতে ব্রেকফাস্টের কি?
    - ইউ নো, অসুখে যত মরবে তার চেয়ে অনেক বেশি মরবে না খেয়ে ।
    - তাই তুমি খাবে না নাকি!
    - না। আমি খাবো। কিন্তু এখন ঐ মহিলার মুখোমুখি হতে ইচ্ছে নেই। কম খাব।
    - ওরকম বলে না। তোমার মা তো!
    - ইয়েস। মম। সারাক্ষণ কিটির কিটির করছে। তারপর এইসময় খাওয়া নিয়ে এমন শুরু করেছে যে মনে হচ্ছে না কোনো সেন্স আছে। এত ইলাবোরেট ব্রেকফাস্ট কেউ করে!তারপর আবার লাঞ্চে এককাঁড়ি খাবার করবে।
    - কী জানি। করেছে তাই বললাম। টিকটিকি উদাস হয়ে গেল।
    - তুমি ব্রেকফাস্ট করেছো?
    - আমি খুব বেশি খাই না। ভোররাতে পোকা খেয়েছি কিছু। ব্যস ।
    - ইনট্যাক্ট একধরনের মানুষ তো পেটের খিদেতে খায় না। লোভের খিদেতে খায়। লাইক মাই পেরেন্টস। যাচ্ছেতাই।
    - বলছো?
    - বলছি। মানুষের স্টম্যাক কতটুকু বলো? কতটা ধরতে পারে? অথচ ঠেসে ঠেসে স্টম্যাকের ছগুণ বেশি খাবে। তারপর নড়বে না। নো মেটাবলিজম। ওয়েস্টেজ।
    - আহা! যে যেভাবে ভালো থাকে থাকতে দাও না। এত খারাপ সময়ে ভালো থাকতে হবে তো।
    - তুমি কিছু বোঝো না। এদের শুধু আহার, নিদ্রা, মৈথুন। তাতেও ভন্ডামি ।
    টিকটিকি ঈষৎ বিষন্ন হল। কাছাকাছি পোকা একটি। সেদিকে তাকাল।
    - আমি অনেকক্ষণ না খেয়ে থাকতে পারি, জানো?
    সে হাসল।
    - জানি। লেপিডসরিয়া বা হেমিড্যাকটিলাস টার্কিকাস স্পিসিস পারে। অনেক মানুষ প্রয়োজনের অতিরিক্ত বেশি খায় বলে অনেক মানুষ খেতে পায় না।
    - তোমার মায়ের বন্ধুরা ডায়েট করে না?কম খায় তো?
    সে গলা ফাটিয়ে হাসল এবার। ও শুনতে পেল ডাইনিং থেকে।
    - এই পৃথিবীর একটা অতিমারী দরকার ছিল , জানো। বড্ড ফাস্ট হয়ে যাচ্ছিল সব । আমার মায়ের বন্ধু! সবাই সবাইকে দেখা হলে হাগ করে, চুমু খায় আর দেন দে স্টার্ট বিচিং অ্যান্ড শোয়িং অফফ । ইন ডিফারেন্ট ডিগনিফায়েড ওয়েজ। ডায়েট ফুডের দাম জানো? কিটো?দেখে দেখে ঘেন্না ধরে গেছে। দেখো। একটু পর ঝগড়া শুনতে পাবে। মাই ডিয়ার ফাদার অ্যান্ড মম উইল স্টার্ট ফাইটিং। দুজনে বাড়িতে আটক যে!
    - স্বামী স্ত্রীতে অমন হয়।
    - দ্যুসা! স্বামী স্ত্রী! দে আর টায়ার্ড অব ইচ আদার। স্বাভাবিক । বাবা ক্যান্ট মিট হিজ লেডিলাভ। রিয়া আন্টি। মা ক্যান নট মিট হার বাডিজ। চ্যাট করে দুধের স্বাদ ঘোলে মেটাচ্ছে।
    - অত ইংরিজি বোলো না।
    - ওকে। বাংলা। আসলে এরা না, উপায় নেই বলে একসঙ্গে আছে। নেহাত বাইরের লাইফ আছে বলে টিকে আছে। লকডাউনে দেখো বিগড়ে যাবে সব।
    - কতদিন লকডাউন?
    - যতদিন রাজনীতি চাইবে। মানে ওদের তো দেখাতে হবে কনসার্ন। জনদরদ দেখাতে হয়। না হলে পিছিয়ে পড়তে হয়।
    - ভাইরাস মরবে না?
    - নাহ্। ভাইরাস হ্যাজ এভরি রাইট টু লিভ। সরি। ভাইরাসের বাঁচার অধিকার আছে তো। মানুষ কেন যে ভাবে তারাই শুধু বেঁচে থাকার অধিকারী!
    দরজায় পঞ্চম নক হতে সে উঠে পড়ে। মহিলাকে ফেস করতে হবে। অথচ এই মা তার ছোটবেলাতে কত অন্যরকম ছিল। এখন ভীষণ উগ্র। আগ্রাসী।
    - চলি। পরে আবার।
    - এসো। আর শোনো । বিচিং শব্দটা ঠিক না। মেয়ে কুকুর কে খামোখা অপমান করো কেন? টিকটিকির চোখে জল।
    না। কষ্ট পেয়ে কাঁদে না টিকটিকি । চোখে জল এলে চোখ পরিষ্কার হয় ।
    - মনে রাখবো।
    দরজা খুলে সে মায়ের মুখোমুখি হয়। নীল সাদা হাউসকোটে ঝলমল। কালকেই ফেশিয়াল করিয়ে নিয়েছে লকডাউন হবে বলে। সেটা অ্যাপ্রিশিয়েবল। কিন্তু হাসি দেখে মনে হচ্ছে অষ্টমীর সকাল। আজ নির্ঘাত গুগলে পার্টি করবে। অতিমারীতে একলক্ষ মৃত। লাখ লাখ লোক কাজ হারাচ্ছে। শি ইজ এনজয়িং ছুটি। প্ল্যানিং গুগল মিট টু সেলিব্রেট ছুটি। মনে হল খুব রাফ কিছু বলে। বলল না। পাশ কাটাল।
    - কীরে। কি করছিলি এতক্ষণ? এতবার ডাকছি। ঝাঁঝিয়ে উঠল নীল রং।
    শি নিডস সাম শক। ও মুখ ঘোরালো।
    শান্ত স্বরে বলল, মাস্টারবেশন। এনি প্রবলেম?
    নীল সাদা হাউসকোট থেকে হাজার হাজার ভাইরাস নির্গত হতে থাকল। লাখ লাখ। ভাইরাস প্রিভেসি মানে না। তারা ওকে আক্রমণ করতে লাগল। চুলে। মুখে। নাকে। আটকাতে আটকাতে ও বলল,
    শ্যামাদি কে অ্যাডভান্স দিয়েছ?

    ✨ইয়ে হ্যায় মুম্বাই নগরিয়া। জুহি।

    অনেক জ্বরের মধ্যে ঘুম ভাঙলে একটা ঘোর থাকে। হাত পায়ে বিড়বিড় করে অসংখ্য পিঁপড়ে উঠছে। হাড়গুলো যেন কামড়ে খাচ্ছে কামঠ। মাঝরাতে উঠে হড়হড় করে বমি করে ফেলল জুহি। তারপর কোনোমতে পা টানতে টানতে এসে শুয়ে পরলো কাঁথার ওপরে। একটা স্যুটকেস সম্বল। সেখানে থেকে জ্বরের ওষুধ বের করে গিলল একটা। তারপর আবার নেতিয়ে গেল।
    একটা টিনের ছাউনির বাড়ির নিচে দুখানা ঘর। স্টোভ জ্বলে সকাল থেকে। কেটলিভরা চা হয়। ছোট ছোট কাঁচের গ্লাস টিউকলের জলে ধোয় তিনভাইবোন। তারপর কেটলি আর চা নিয়ে মোড়ের মাথায় বেঞ্চিতে বসে বাপ। চা ফুরিয়ে গেলে আবার কেটলি ভরে চা দিয়ে আসে বেলি বা জুহি। ভাই ইশকুল যায় । কোনোকোনোদিন মিডডে মিলের ডিম নিয়ে আসে বাড়িতে । যেদিন মর্জি। বোনেরা সেদিন ডিমের ভাগ পায়। অ্যালুমিনিয়ামের বড় থালাতে সর্ষের তেল দিয়ে ভাত আর আলু সিদ্ধ মাখে মা। মাছ থাকলে জোটে বাপ আর ভাইয়ের পাতে। আলু সিদ্ধ ভাত আর ডাল রুটি খেয়ে জুহি কেমন তরতর করে বেড়ে উঠল আর ইশকুলেও ভর্তি হল যখন বাপের দোকান বড় হল। ক্লাস সেভেনে পাড়ার বিনুকাকু বলল, তোর মুখখানা তো অবিকল দিব্যা ভারতী রে! ফিলিমে চান্স পেয়ে যাবি!সেই যে মাথায় ঢুকল সিনেমা সে আর নামল না। টায়ে টায়ে পাশ এক সাব্জেক্টে ফেল করতে করতে জুহি মাধ্যমিক দিল। বিনুকাকু ততদিনে ওর আশিক হয়ে গেছে। এই কথাটা পাড়ার নবযুবকরা, যারা জুহির রূপমুগ্ধ তারা বাপের কানে দিতেই বাপ ওকে দিদির বাড়িতে চালান করে দিল। শ্যামাদিদি মানুষটা ভাল। সকালে কাজে যাবার আগে সবার জন্য ফ্যানাভাতে ডিম সিদ্ধ দেয়। ভালো খাওয়া দাওয়া । ঘরে টিভি । ফ্রিজ। শ্যামাদিদি মাইনে পেয়ে দুটো নতুন কুর্তা এনে দিয়েছিল। কিন্তু বেলা এগারোটার সময় ঘুম ভেঙে নেশা নেশা চোখে জাম্বু যেদিন জুহির হাত থেকে চায়ের কাপ নিতে গিয়ে হাত ধরেই টেনে নিল, সেদিন জুহি সত্যি বুঝল যে তার মুখ দিব্যা ভারতীর এবং শরীর নারীর। এরপর নদীতে বাণ এলো। দু মাসের মাথাতে মুম্বাই রওনা দিল ওরা। বেরোনোর আগে মন্দিরে জাম্বু সিঁদূর পরিয়ে বর হয়ে গেল জুহির।
    মুম্বাই শহর দেখে তাক লেগে গেছিল জুহির। সুখন ওকে প্রথম তিনদিন রেখেছিল দাদারে এক হোটেলে। চোদ্দতলাতে মানুষ কেমন করে থাকে জুহি বুঝে পায় না। হোটেলটা প্রকান্ড। ওদের ঘরটা খুপরি। তাই নাকি অনেক ভাড়া। হোটেলের জানলা দিয়ে আকাশ দেখা যায় না। শুধু লম্বা লম্বা বাড়ি। জানলা কাঁচের। সেখানে মাথা নিচু করে লোকজন মেশিনে কি দেখে। সুখন বলে হীরে কাটে সব। হীরের বিজনেস। সুখন কাজে বেরোলে হোটেল ঘুরে ঘুরে দেখে জুহি। একটা কাঁচের ঘরে আরব লোকেরা নমাজ পড়ে। জুহি সিনেমাতে দেখেছে। ঘোর লেগে যায় । নিজের সবচেয়ে ভালো চুড়িদার পরে ও সাতমহলা হোটেলের আনাচেকাণাচে ঘোরে। ও শুনেছে এ হোটেলের মালিক সুনীল শেট্টি। যদি কপাল ফেরে । যদি ওর ঢলঢলে মুখ দেখে ডিরেক্টর ডাকে। এইসব ভেবে হলুদ প্রজাপতির মত নাচে ও। দুদিন জুহু বিচ। পাও ভাজি। বড়া পাও। টাঙা। উদ্দাম সুখ। কিন্তু সুনীল শেট্টির দেখা মেলে না। জুহি ভেবেছিল নিজের হোটেলে এক আধবার তো আসবে লোকটা! কাঁচের দরজার পিছনেই জুহি।
    সুনীল শেট্টি এখন বুড়ো হয়েছে। তবু ফিল্মস্টার তো!
    - তুমি কে? অবিকল দিব্যা ভারতীর মুখ? কৌন হো তুম?
    -জুহি হুঁ সাব।
    - বেলি চামেলি নহি?
    - নই সাব। স্রিফ জুহি।
    - সিনেমা করোগে? হিরোইন?ম্যায় প্রডিউসার হুঁ।
    -বিলকুল সাব।
    -পপকর্ণ বিনোদনমে সোয়াগত হ্যায় তুমহারা।
    জুহি কুলকুল করে হাসে। সুনীল শেট্টি বাতাসে মিশে যান। সুখন ওকে নিয়ে হোটেল ছাড়ে তিনদিন পর। এবার বস্তি। সংসার। চুলা। রোটি। চাওল। সুখন নতুন কনস্ট্রাকশনে কাজ পেয়েছে। ভোরবেলা ট্রেন ধরে। তার আগে রুটি সবজি পাকাতে হয়। ঘরে শুধু একটা চৌকি রাখার জায়গা । তিন মাসের মধ্যে জুহি পালায়। বস্তির দালাল ফিল্মিস্তান নিয়ে যায় ওকে। এক্সট্রা । জুহি নাচতে শুরু করে অচিরে বুঝতে পারে যে ওর দিব্যার মত মুখ, ঈষৎ ভারি শরীর, খসখসে চামড়া সবই এখানে অচল। কেউ ফিরেও দেখে না। ছমাস নেচেও কোনো হিরো বা ডিরেক্টরের সন্ধান পেল না জুহি। টাকা সামান্য। কেউ ওকে বলল না- হিরোইন বনোগি? যার সঙ্গে পালিয়েছিল সেই দালাল শিফু মালিক নিত্যনতুন মেয়ে আনে। জুহিকে সে মারধোর করেনি। তবে খদ্দের এনেছে। যে বাড়িতে জুহিকে তুলেছিল সেখানে একঘরে জুহির মত ছজন। ক্লায়েন্ট বাইরে নিয়ে যায় । খাওয়া দাওয়া সব। নাইট হলে চার্জ বেশি । কমিশন শিফুর। তার ওপরে আছে শিফুর লাভার গোকুল। জুহি মেনে নিল এবং বুঝে গেল হিরোইন হওয়া ওর কপালে নেই। তবে ক্লায়েন্ট ভালো হলে মজা খুব। জুহি রিসর্ট চিনল। ককটেল চিনল। মকটেল চিনল। দামি পার্লার গেল ক্লায়েন্টের পয়সায়। চামড়া চিকণ হল। চুল স্ট্রেট ও সিল্কসম। ডোনাল্ড ট্রাম্প যেদিন ভারতবিজয় করতে এলেন, শিফু ওর জন্য বিলেতফেরত ক্লায়েন্ট এনে দিল। তার সুগন্ধে দিওয়ানা বনে গেল জুহি। আর কী ভদ্র! নাক ঝাড়তে একটা খুশবুদার কাপড় বের করছিল । জুহি জানে এটা টিশ্যু। গাড়ির দরজা পর্যন্ত খুলে দিল। জুহির মনে হল ঐ সন্ধের জন্য ও সত্যি হিরোইন । গা শিরশির করে উঠল আনন্দে । হিরোইনদের মত কাঁধখোলা ড্রেস পরেছিল সেদিন। নিজেই কেটেছিল ম্যাক্সির ওপরটা ।
    চারদিন বাদে জ্বর এল জুহির। ধূম জ্বর। কাশি। বমি। পায়খানা।
    শিফু মালিক রিস্ক নেবার পাত্র না । অবিলম্বে বিতাড়িত হল জুহি। হসপিটালে যাবার জোর নেই। অসমাপ্ত কনস্ট্রাকশনের নিচে এক গা জ্বর নিয়ে পড়ে থাকল। অসুস্থ জ্বরো শরীরের ওপরেও লোভের থাবা পড়ে। জুহি কঁকিয়ে কাঁদে। এখানে আরো কিছুজন আছে তার মত। কাশি কমলে খিদে । খিদে কমলে বমি। এর মধ্যে কতগুলো হাসপাতালের লোক এসে লালা নিয়ে গেল। দুদিন পর এসে পজিটিভ বলে নিয়ে চলে গেল কোথায় জুহি জানে না।
    এখানে আয়া অনেক দূরে একটা টেবিলে ফয়েলপ্যাকে রুটি সবজি রাখে। জ্বর সামান্য কমলে বাড়িতে যেতে ইচ্ছে করে ওর। তারপর আবার জ্বর বেশি । শ্বাস আটকে আসে।
    ওর শুধু জ্বরে হাত পা কাঁপে। ঘোরের মধ্যে ভাত আর সর্ষের তেলের গন্ধ পায়। কাউকে ফোন করার কথা মনে পড়ে না। শুধু মায়ের গন্ধ পায়। মায়ের চোখদুটো শ্যামাদিদির মত। সুনীল শেট্টি এসে মাথাতে হাত বুলিয়ে দেন। করুণাঘন চোখ তাঁর।
    - হিরোইনকো ইয়ে ক্যা হুয়া?
    - বুখার স্যর। এখন আর সাব বলে না ও।
    - ঠিক হো যাও জলদি। শুট হ্যায় না?
    -বিলকুল স্যর। হিরো কৌন বনেগা স্যর?
    সুনীল শেট্টি পিপিই পরিহিত । ফেস মাস্ক পরে নেন। স্বচ্ছ পলিথিন সদৃশ আবরণ নীল কুয়াশা ছড়ায়।
    নার্স এসে নল খুলে নেয়।
    কদম কদম বাঢ়ায়ে যা।

    ✨সুখনলাল

    জুহি যেদিন মারা যায় সেদিন মুম্বাইতে বন্ধ হয়ে যাওয়া মেরিকো কন্স্ট্রাকশনের মিস্ত্রিরা ঠিক করে তারা বাড়ি ফিরবে। এদের মধ্যে অনেকেই ছুট্টা কাম করে। সুখনলালের হাতে পয়সা শেষ। কলকাতার শহরতলির রাজমিস্ত্রির মুম্বইতে হালে পানি পেতে সময় লাগে। হেড মিস্ত্রি হতে পারেনি সুখন এখানে। বিল্ডার খুব কড়া । তারপর জুহি ভেগে গেল। ভালো করে আর জুহির মুখ মনে পড়ে না সুখনের। ওর সঙ্গে যারা কাজকাম করে তারা বাড়ি থেকে কিছু টাকা আনিয়েছে। সুখন কার কাছ থেকে টাকা আনাবে? শ্যামাকে ফোন করবে আড়াই বছর বাদে?
    মুম্বই থেকে থানে হয়ে পয়দল চলেছিল ওরা। সুখন তাদের মধ্যে একজন । কত দিনের পথ কেউ জানে না। রাস্তাতে কেউ কেউ খাবার দেয়। জল দেয়। সুখন গোগ্রাসে খায়। শ্যামার রান্না করা ফ্যানাভাতে ডিমসেদ্ধর গন্ধ বুকে নিয়ে পথ চলতে চলতে হাঁপায় সুখনলাল। আর কদ্দূর!এতদিনে শ্যামার কাছ থেকে এত দূরে চলে এসেছিল বোঝেনি আগে। রাস্তায় হাঁটতে হাঁটতে একদিন ওরা শোনে প্রধানমন্ত্রী দ্বিতীয় দফার লকডাউন ঘোষণা করেছেন। এন জি ও র ছেলেমেয়ে এসে ছবি তোলে ওদের। সুখনলালের মাস্ক পরা মুখ খবরের কাগজে ছড়ায়। সুখন হাঁটতে থাকে।
    বাংলা, বিহার , ইউপি থেকে যে সমস্ত শ্রমিক মুম্বাইতে কাজ করতে আসে তাদের বেশির ভাগ শাস্ত্রীনগর এলাকাতে থাকে। সুখনলাল তিনদিন হোটেলে অনেকটা রেস্ত খরচ করে ফেলবার পর জুহিকে নিয়ে এই শাস্ত্রীনগরে এসে উঠেছিল। একটা ঘর ভাড়া নেওয়া মুম্বাইতে কম কথা না। সুখনের চাপ হয়ে যাচ্ছিল। তাছাড়া জুহির সংসার অভিজ্ঞতা কম। ইচ্ছাও অন্যরকম। ফিল্মিস্তানের দালালের সঙ্গে জুহি ভেগে যাওয়াতে সুখন হাঁপ ছেড়ে বেঁচেছিল। বাপরে। ঐ আঠারো বছরের ছলবলে মেয়ের দাপানি সহ্য করা কম ঝামেলা নাকি। নেশা কেটে গেছে ততদিনে। একদিন জুহুবিচ একদিন সিনেমা এইসব করতে সুখনের মাস খানেকের মধ্যেই অবস্থা কাহিল । সারাদিন খেটে এসে সে চাইত সংসারের সোহাগ আর জুহি সারাদিন ঘরে বসে থেকে থেকে চাইত বাইরে ঘোরাঘুরি। কাজেই জুহি যাওয়াতে সুখনের সুবিধা হল এই যে ঘরটা ভাগাভাগি করে নিল চারজনের সঙ্গে । খরচ কম। এখানে এরকমই চলে। একটা খুপরি ঘরে চার বা পাঁচজন থেকে যায়। বান্দ্রা ইস্টের পাশেই যে মসজিদ সেখান থেকে শুরু হচ্ছে শাস্ত্রীনগরের পহলা গেট। ঢুকতেই যে চওল সেখানে মুসলমান আর দলিত শ্রমিকদের বাস। তারপর দো আর তিন নম্বর চওল। একেবারে জয় ভীম চওল থেকে শুরু। এ অন্চলে বেশির ভাগ শ্রমিক কন্স্ট্রাকশনের কাজ করে। অথবা কাঠমিস্ত্রী। কিছু মুসলমান দরজি আছে । মোটমাট ভোর পাঁচটা থেকে সকাল আটটার মধ্যেই শাস্ত্রীনগর খালি হয়ে যায়। সব শ্রমিক বেরিয়ে যায় কাজে।
    রোগটার কথা ওরা কেউই জানত না। সুখনলালের ঘর ভাগ ছিল তুলেন, দিবাকর আর সূরযের সঙ্গে । লোকাল ট্রেনে ঘরে ফিরতে ফিরতে রাত আটটা। তারপর পালা করে খানা বানানো। এর মধ্যে কারু একটু সর্দি কাশি জ্বর , এ তো হবেই। তবে ওদের চওলে রুটি সবজির দোকানও আছে। মাংসের কিমা। মাটন। শস্তার মদ। যেদিন রাঁধতে ইচ্ছে নেই সেদিন কিনে নেয় ওরা। একনম্বর চওলে হেকিমের দাওয়া খায় শরীর খারাপ হলে। কামার্ত হলে ছুটির দিনে মেয়েমানুষও মেলে। এখানে প্রচুর মেয়ে রাস্তার মধ্যে লাইন দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে রাত দশটার পর। কলকাতায় এমন দেখেনি সুখন। এত কাতারে কাতারে মেয়েমানুষ লাইন দিয়ে কাস্টমারদের অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে!জুহিকে কোনোদিন দেখা যাবে নাকি এদের মধ্যে, সুখন ভাবতো। দেখেনি। একজনের সঙ্গে সুখনের ভাব হয়েছে। মেয়েটা দামী ঝলমলে পোষাক পরে আসে না। দেখে বোঝা যেত খুব গরীব। শস্তা শাড়ি । কপালে কালো টিপ একটা। দামী গাড়ি বা বাইক ওকে তুলত না কখনো। রাস্তার এক কোণে দাঁড়িয়ে থাকত। সুখন ওর সঙ্গে বেশ কয়েকদিন গেছে। কিন্তু তারপর আর নিছক শরীর থাকল না। দু বছরের মাপে একটা দেওয়া নেওয়া। মেয়েটা ভাঙা হিন্দিতে ওর গ্রামের কথা বলে। বাচ্চাদুটো আছে বাড়িতে । বর ছেড়ে দিয়ে গেছে এখানে। টাকা নিতে আসে দু মাস বাদে বাদে। সুখন শ্যামার কথা বলে। ছেলের কথা বলে । আশ্চর্য । জুহির নাম করে না। মেয়েটা গোলারুটি নিয়ে আসে সুখনের জন্য। কখনো বেসনের নাড়ু। সুখন চোখ বুঁজে কলকাতার কথা বলে। বান্দ্রা ইস্টে রাত ঘন হয়। ঘরে ফিরে তুলেনের বানানো তেঁতুলের সবজি খেয়ে চিৎ হয় সুখন।
    সুলেমান শেখ যেদিন বলল যে সব কাম কাজ বন্ধ, রোগ ছড়াচ্ছে, লকডাউন হবে, তখন সুখনরা কেউই ব্যাপারটা বুঝে ওঠেনি। জ্বরজারি কার না হয়। আর তার জন্য কাম কতদিন বন্ধ থাকবে? কাম বন্ধ হলে খাবে কি? ওদের দিনগত রোজগার। সামান্য জমে। সুখনরা শেঠের সঙ্গে দেখা করতে গেছিল। দেখা মেলেনি। শেঠ দেশে নাই। ম্যানেজার বলে দিল কাম কবে হবে ঠিক নাই। কোনো অ্যাডভান্স বেতন দেওয়া যাবে না শেঠ না ফিরলে। ওরা ফিরে আসতে আসতে বলাবলি করছিল, ইয়ে লকডাউন কিঁউ। বুখারমে তো আদমি ইঁউহি মরতে হ্যায়। আশপাশের দোকানের মাল ফুরিয়ে যাচ্ছিল দ্রুত। সুলেমান বলেছিল বাড়িতে ফেরাই ভাল। মুম্বাইতে অসুখ খুব বেশি ছড়াচ্ছে ।
    মেডিকেল ক্লিনিকে সারাদিন লাইন দিয়ে দাঁড়িয়েছিল ওরা। সার্টিফিকেট লাগবে। বর্ডার বন্ধ হয়ে যাবে। রাত দশটায় সার্টিফিকেট পেল সুখন। পরদিন পুলিশ স্টেশন গেছিল জমা দিতে।
    অফসর বলল, ছবিও লাগবে। ডাগদর যেন সই করে দেয় সাঁটা ছবিতে। ফোটোর দোকান খুঁজে খুঁজে জেরবার ওরা। লকডাউনে সব লক্ড। ছবি কোথায় তুলবে। সুলেমান ব্যবস্থা করলো শেষে । ছবি হলে সই হতে আরো দুদিন লাইন। পয়সা ফুরাচ্ছে দ্রুত। বর্ডার বন্ধ হয়ে গেছে শুনল। পাটনা হয়ে যদি ফেরা যায় । তুলেনরা পাটনা যাবে।
    কপালে কালো টিপের সঙ্গে আর দেখা হল না সুখনের। মুখটা মনে থাকল। বান্দ্রাতে যেদিন নাকা হল, সুখন তার আগেই বেরিয়ে গেছে হাঁটাপথে।
    একনম্বর চওলে এক বুড়ি নানী আছে। নব্বই পার। হালিমা খাতুন। শীর্ণকায়। একটা সূতীর সারারা আর উদ্ধাঙ্গে শিফনের কুর্তা। মুখে অজস্র বলিরেখা এক একটা গল্প বলে। এমনকি দাঙ্গায় ছেলে মরে যাবার গল্পও। চালের রুটি আর একটা শুকনো তরকারি করে দিচ্ছিল সব শ্রমিককে । যারা হাঁটা পথ ধরবে। দিনে বিশ্রাম নেবে কোনো গাছের তলায় । বা স্টেশনে। বিকেল থেকে হাঁটবে আবার। সামান্য চাল নিতে পেরেছে সঙ্গে । মুড়ির প্যাকেট। সামনে রাস্তা । কঠিন পিচ। কোনো ম্যাপ নাই। সুলেমান বলেছে থানে হয়ে যেতে।

    ✨মালবিকা

    দুপুরে রোদ বেশ কড়া। ঘন নীল পর্দা টেনে দিয়েছে ও। একটা শান্তির ভাব আসে। আর নিতে পারছে না মানসিক চাপ। ওয়র্ক ফ্রম হোম এত টিডিয়াস কে জানত! জুম। না। চিন। গুগল মিট। টিম লিংক। লিংক ফেইলিওর। মিটিং । অ্যাপ। সিম্পলি টায়ারিং। আজ পাবদা করেছে দুপুরে । ধনেপাতা দিয়ে । মুসুর ডাল পেঁয়াজ দিয়ে । আলু পোস্ত। ফুলকপি রোস্ট। চাটনি। ব্যস। আর কিছু না। মেয়ের মেজাজ ভালো না। বর ওয়র্ক ফ্রম হোম কিন্তু স্যালারি কাট হবে জানতে পেরে খিঁচড়ে আছে। এত পরিশ্রমের পর স্যালারি কাট হলে চলে! তারপর তিনটে মোটা প্রিমিয়াম আছে এইসময়েই। মেইড দুজনকেই বসিয়ে মাইনে দিতে হবে। এত ঝামেলার ঝড় ও সংসারের গায়ে লাগতে দিতে চায় না। নিজের হাতে যত্ন করে রাঁধে। কম তেল , ঝাল। একটা ছবিও তুলে ফেলে ফোন ক্যামেরাতে। এর নাম ভালোবাসা । সংসারকে ভালোবাসা দিয়ে মুড়ে রাখতে চায় । তাও মেয়ে আর বর চটে থাকে। খাবার সময় ফট করে টিভি খুলে দিল। খবর শুনবে। সেই এক খবর। খাড়া বড়ি থোড়। রোগ ছড়াচ্ছে । মাস্ক পরো। হাত ধোও। একবারও বলল না মাছটা কেমন হয়েছে। এই সংসারে খেটে মরছে ও। বাসন মেজে হাত খড়খড়ে হ্যান্ডলোশন ফুরিয়েছে। মেয়ে শুধু নিজের প্লেট ধুয়ে রেখে চলে যায় । বর খাবার না। খবর গিলছে। ও যত্ন করে ভাতে মাছের ঝোল মাখতে লাগল। অ্যাকুয়ারিয়ামে লাল মাছ , নীল মাছ খেলা করে । বুড়বুড়ি উঠছে ব্যাঙ থেকে।
    - দ্যাখ। আমাদের খাচ্ছে। লাল মাছ বলল।
    - কোথায় । আমরা তো এখানে। নীল মাছ ফিচেল হাসে। তুইও যেমন।
    - আমাদের মানে আমাদের প্রজাতি।
    - পাবদা?
    - হুম। দ্যাখ। কেমন কাঁটা ধরে মাছের মাংসটা টেনে নিচ্ছে।
    - আমাদের? আমাদেরও খাবে?
    - মানুষ সব খায় । মায় বাদুড়ও। তবে যতদিন আমাদের গায়ে লাল নীল রং আছে ততদিন খাবে না।
    নীলমাছের গা শিরশির করে উঠল। ও চলে গেল গাছের পেছনে। যাতে দেখা না যায়।
    টিভির খবর তখন বলছিল, পায়ে হেঁটে আসা একদল শ্রমিক ট্রেন চাপা পড়ে মারা গেছে কাল রাতে। ষোলোজন ছিল তারা।
    ওর গা গুলিয়ে উঠল। শান্তিতে খেতেও দেবে না এরা। চিৎকার করে উঠল। রেল লাইনে শোয় কেন এরা!'উজবুক। গাছের তলা ছিল না? স্টেশন, স্কুলবাড়ি ছিল না?
    বর চমকে ওর দিকে তাকাল । ভল্যুম কমিয়ে দিল টিভির।
    চেঁচিও না। জল খাও।
    সবুজ ড্রাগনের ট্যাটু করা হাত নীল পর্দা সরিয়ে দেয়। সে টেবিলে বসেনি। খবর শুনতে এসেছিল।
    -খটখট করে হাসে।
    - লুক মা। বাইরে রোদটা দ্যাখো। এই রোদে হাঁটছিল। যেখান দিয়ে হাঁটছিল তার আসে পাশে কোনো গাছ নেই। স্কুলবাড়ি নেই। শুধু রেললাইন । কারণ ওটাই ম্যাপ। আর সারাদিন কোনো ট্রেন চলেনি। মালগাড়ি চলবে রাতে সেটা ওরা জানত না। ওরা পাঁচ দিন ধরে হাঁটছিল। শুধু হাঁটছিল। তুমি বলছিলে না, ইভনিং ওয়াক হচ্ছে না তোমার, তাই ঘুম আসছে না? হাঁটলে ভালো ঘুম হয়। ইওর ডক্টর সেইজ। ওরা পাঁচ দিন ধরে হাঁটছিল ডিয়ার মম। তাই খুব ভালো করে ঘুম এসেছিল । কোনো লোকাল গ্রামে ঢুকতে সাহস পায়নি। কারন ওরা মেইনলি দলিত ছিল। আশপাশের গ্রামে গেলে পিটিয়ে মারতো দলিত বলে। বডি ফেলে দিত কোভিড বলে। ইউ গেট ইট?

    ✨পয়দল

    প্রণয় অশোক। ডিসিপি। পি আর ও। মুম্বাই পুলিশ রিপোর্ট করেছিলেন, প্রায় দেড় হাজার শ্রমিক বান্দ্রা ইস্টে জড়ো হয়েছিল লকডাউনের প্রতিবাদে। চব্বিশে মার্চ থেকে তাদের রুটি রুজি বন্ধ। সামান্য খাবার পাচ্ছে। তবে আপাতত তারা খাদ্য বা আশ্র চায় না। বাড়িতে ফিরে যেতে চায়।
    সুখনলাল, তুলেন বা শংকরা কেউই প্রতিবাদে বা নাকা তে যায়নি। ইচ্ছেই করেনি।
    প্রণয় অশোক আরো বলেন যে শ্রমিকরা অনেকেই উত্তেজিত হয়ে যাবার ফলে " হাল্কা বলপ্রয়োগ " করতে হয়। তারপর সব মিটে গেছে।
    সুখনলাল নাকা হবার আগের দিন রওনা দিয়েছিল বাড়ির পথে। ওরা প্রায় দুশোজনের একটি দল। মেয়ে পুরুষ। বাচ্চা।
    তার পরের দিন মহারাষ্ট্রের ক্যাবিনেট মন্ত্রী আদিত্য ঠাকরে টুইট করেন। " আগাম জানান না দিয়ে লকডাউনের ফলে বিপর্যস্ত শ্রমিকরা । আমরা অনুরোধ করেছিলাম অন্তত চব্বিশ ঘন্টা ট্রেন চালু রাখার জন্য। সেই অনুরোধ রাখা হয়নি। শ্রমিকরা কেউ বাড়িতে ফিরতে পারছেন না ইউনিয়ন গভমেন্টের এই সিদ্ধান্তের ফলে। "
    সুখনলাল , তুলেন ও জগন্নাথ একসঙ্গে হাঁটছিল। ওদের আগে আগে হাঁটছিল একটি তরুণ দম্পতি । একটি চার বছরের শিশু। মেয়েটি অন্তঃসত্ত্বা । ফলে ওরা মাঝে মাঝেই বসে পড়ছিল। যতক্ষণ শহর দিয়ে চলেছে, তেমন অসুবিধে হয় নি। টিউকলের পানি, পাঁউরুটি, শুকনো বড়া, পোহা জুটেছে। এন জিও র ছেলেমেয়ে এসে ফয়েলে মোড়া খাবার দিয়ে গেছে। শহর পার হয়ে আসল সমস্যা শুরু হল। খাবার ফুরাচ্ছে ক্রমশ। পোয়াতি মেয়েটাকে দেখে সুখনের শ্যামাকে মনে পড়ে। যখন মুম্বাই ছুটে এসেছিল তখন মাথাতে শুধু অনেক টাকা ছিল। জুহির নেশা ছিল। আরবসাগরের তীরে সর্বাধিক আলোকোজ্জ্বল বিলাসনগরী সুখনের দিমাগ ঠান্ডা করে দিয়েছে। এখানে হাজার হাজার মজদুর শাস্ত্রীনগরের পাশে বাঁধানো রাস্তার ওপরেও শুয়ে থাকে। তার কপালে তবু একখানা খুপরি জুটেছিল। সোনারপুরে তার দুকামরার ঘরে মা, শ্যামা আর ব্যাটা কি খায় কে জানে । লজ্জিত সুখন একদিন ফোনও করতে পারেনি শ্যামাকে। পোয়াতি বউটা গাছের তলায় বসে পড়েছে। চার বছরের বাচ্চাটা সুখনের দিকে এগিয়ে এলো নিশ্চিন্তে । ওরা কেউ কাউকে চেনে না। শুধু হাঁটতে হাঁটতে একটা দল হয়ে গেছে যেটা যেকোনো সময় বিচ্ছিন্ন হয়ে যেতে পারে।
    কয়েকটি সারমেয় বন্ধ দোকানের সামনে নির্জীব হয়ে পড়েছিল। দোকানগুলি হঠাৎ বন্ধ হয়ে যাবার ফলে তাদের পেটে খাবার নেই। মানুষের এই দলটি দেখে তারা উজ্জীবিত হয়ে ওঠে খাদ্যের আশায়। লালা ঝরে পড়ে মুখ দিয়ে । কেউ কেউ ঢিল ছুঁড়ে মারে ওদের দিকে। কেউ কেউ না তাকিয়ে চলে যায় । সুখনলাল বাচ্চাটাকে নিয়ে বসেছিল। একটি কুকুর তাদের কাছে এসে দাঁড়ায় । বাচ্চাটা মজা পায়। কুকুরকে খাবার দিতে চায় । মায়ের দিকে তাকিয়ে থাকে। মা থেবড়ে বসে আছে মাটিতে। হুশ নেই । হাঁপাচ্ছে। বাপ গেছে কলের থেকে জল নিতে। সুখনলাল নিজের পুঁটলি হাতড়ে দুটো বিস্কুট বের করে দেয় বাচ্চার হাতে। বাচ্চাটার নাকের সিকনি গড়াচ্ছে। ডান হাতের জামাতে মুছে বিস্কুট এগিয়ে দেয় কুকুরের দিকে। তারপর আবার হাত বাড়িয়ে দেয় সুখনলালের দিকে। উল্লসিত হয়ে আরো কিছু সারমেয় এগিয়ে এলে সুখনলাল বলে হঠ্ হঠ্।
    রোদ কড়া হতে থাকে। আপাতত হাঁটবে না দলটা। যে যার পুঁটলি খুলে সামান্য খাবার খাবে। বাচ্চাদের খিলাবে। কাছাকাছি পুকুরে নেয়ে আসবে । হালিমা খাতুনের শেষ চারটা রুটি আছে। এই ভরসাতেই সুখন পুকুরে নেমে গেল। পাড়ে দাঁড়িয়ে থাকল শিশুটি ও সারমেয়র দল।

    ✨পুনে। দেবরূপ।

    বহুদূরে পুনে শহরে একটি বহুতলের এক কামরার ফ্ল্যাটে একটি তরুণ তার মা' কে ফোন করছিল। সে অনেক কষ্টে তার মা' কে বোঝাতে পেরেছে যে লকডাউনে তার তেমন কোনো অসুবিধে হচ্ছেনা। সে মোটামুটি পরিমাণ মত চাল , ডাল, আটা সংগ্রহে রেখেছে। দিন দশেক বাদে আবার নেবে। সকালে চা খেয়ে সে চালে, ডালে চাপিয়ে দেয়। দুটো আলু টোম্যাটো ফেলে দেয় । এক চামচ মাখন দিয়ে চমৎকার একটা ব্রেকফাস্ট কাম লাঞ্চ হয়ে যায় সাড়ে দশটা নাগাদ। সকালেই সে কাপড়জামা কেচে এক কামরার ঘরটি পরিষ্কার করে ফেলে। দুপুর থেকে তার কাজ শুরু হয়। একজন মাইক্রো বায়োলজিস্ট হিসেবে গবেষণার ছকের বাইরেও সে অনেক কাজের সঙ্গে যুক্ত । কাজেই কখন বিকেল গড়িয়ে সন্ধে হয় তার মনে থাকে না। সন্ধের পর তারা কয়েক বন্ধু মিলে একটি যৌথ কাজ করে। কুণাল আডবাণীর গ্যারাজে পথপশুদের জন্য রান্না হয় দুপুর থেকে। সন্ধের পর বড় বড় ডেকচি নিয়ে কয়েকটি যুবক একটি বিস্তীর্ণ এলাকা পরিভ্রমণ করে। এইরকম বেশ কিছু সংস্থা আছে যারা করোনাকালে পথপশুদের খেতে দিচ্ছে। টাঙ্গা বা টোটো বাঁধা আছে কাজের জন্য। ফিরে সে নিজের জন্য দুটো রুটি ভেজে নেয়। দুধ কলা রুটি বা সময় থাকলে কোনো সবজি। তার ডিনার। জননী শুনলে অস্থির হয়ে যাবেন। তাই কলকাতার ফোন এলে সে সতর্ক হয়ে যায় । মা' কে বাড়িয়ে চাড়িয়ে একটা খাদ্য তালিকা বলে দেয় । তার মা সুগৃহিণী । সুপাচিকা। এই লকডাউন কালে ছেলের জন্য আকুল । সে জানে মায়ের স্টেট অব মাইন্ড এখন নড়বড়ে। বয়সোচিত কারণে হরমোনাল ডিসব্যালান্স চলছে। তারপর এই বন্দিদশা। বোন বাড়িতে এসেছে তবে মা' কে নিয়ে তার মাথাব্যথা নেই। ঘরে দরজা বন্ধ করে পড়ে থাকবে ল্যাপটপে মুখ গুঁজে।
    শেষ সারমেয়র দলটা সংখ্যায় চোদ্দ। আপাতত রাস্তা নির্জন। খাবার নামিয়ে দিয়ে ফুটপাতে বসে পড়ল যুবকটি। কুণাল ও তার সহযোগীরা পরিবেশন করছে। কাগজ ছিঁড়ে দেওয়া হচ্ছে মাংসের ছাঁট মিশ্রিত খিচড়ি।
    পুণের আকাশ এমনিতেই পরিষ্কার । এখন আরো ঘন প্রুশিয়ান ব্লু। এইরকম আকাশ দেখলে নিজেকে অতি ক্ষুদ্র বলে মনে হয়। কুকুর, বেড়াল, হাঁস , মুরগী দের মতোই। আর এইসব প্রাণীদের ওপর পরীক্ষা নিরীক্ষা চালাতে চালাতে মানুষ কখন নিজেকে ঈশ্বর ভাবতে শুরু করে দিয়েছে। বন জঙ্গল কেটে সাফ করেছে নিজেদের সম্পদ বৃদ্ধি করবে বলে। বাদুড় নিয়ে পরীক্ষা করতে করতে প্রায় অবলুপ্ত করে ফেলেছে প্রজাতিটি। আর বাদুড়ের অবিচ্ছেদ্য প্রাকৃতিক সঙ্গী করোনা ভাইরাস বাদুড় না পেয়ে এখন অন্য জীবদেহ খুঁজছে বাঁচবার জন্য । ডেসপারেটলি খুঁজছে। তাই বারবার নিজেকে পাল্টাচ্ছে। হন্যে হয়ে বেঁচে থাকতে চাইছে ভাইরাসটা। শেল্টার খুঁজছে মানুষের শরীরে। ঠিক হন্যে হয়ে মানুষ যেমন সেফ জোন খোঁজে। হয়তো এখন এখানেই কোথাও আছে ভাইরাসটা। রাস্তার ওপর। বা জামার হাতায়। অনেক ওপর থেকে যদি কেউ দেখত , তবে তার কাছে মনে হত এ একটা খেলা। ভাইরাস খুঁজছে মানুষের শরীর আর মানুষ খুঁজছে পালানোর জায়গা । ঘরে গিয়ে দরজা বন্ধ করছে আততায়ীর হাত থেকে বাঁচতে । আর কে জানে, আততায়ী হয়তো আগে থেকেই বন্ধ ঘরে বসে আছে। প্ল্যাস্টিকের প্যাকেটে বা সবজির খোসায় । এইসব সাত পাঁচ ভাবছিল যুবকটি যখন ফোন এল। এটি তার সহপাঠীর ফোন। কলকাতায় কোভিড আক্রান্ত ছড়াচ্ছে । তার ডাক্তার বন্ধুর গলা খুব ফেইন্টলি আসছিল। ক্রিটিক্যাল অর্জুন। ভেরি ক্রিটিক্যাল । কোভিড অ্যান্ড নট কোভিড। ফিড দ্য পুওর। জাস্ট ফিড দ্য পুওর। ইট ইজ সামথিং মোর দ্যান কোভিড ।
    ফুটপাথ থেকে উঠে পড়ল যুবকটি। সে বুঝতে পারছে রোগটা ভয়ংকর। এবং এই ভয়ংকর রোগটা নিয়ে ব্যবসা হচ্ছে। রাজনীতি হচ্ছে। এই বিশাল আকাশের নিচে, এই প্রকান্ড সৌরমন্ডলের পৃথিবী নামক একটা গ্রহে কিছু প্রাণী একটা ভাইরাসকে ব্যবহার করে মুনাফা লুঠ করতে চাইছে। অ্যাট দ্য কস্ট অব হিউম্যান লাইভস।

    ✨পুল্লিচালিল নুহ্। কেরল।

    পুল্লিচালিল বাভা নুহ্ এক সুদর্শন চল্লিশ বছরের মানুষ। যাঁকে পরিপূর্ণ মানুষ বলা চলে। ফেব্রুয়ারি মাসের উনত্রিশ তারিখে তাঁর বস, স্টেট হেল্থ সেক্রেটারি তাঁকে ফোন করে জানান, যে কেরালার রান্নিতে তিনজন কোভিড নাইন্টিন আক্রান্ত ঢুকে পড়েছেন। ইতালি থেকে বিমানবন্দরে নেমে পরিবারটি, মা, বাবা, ছেলে একশ পঁচিশ কিমি গাড়ি চালিয়ে বাড়িতে ফেরে। এরপর তাদের রোগলক্ষণ দেখা দেয় । শুধু তারা নয়, বাড়ির আরো দুজন বয়স্ক মানুষও আক্রান্ত।
    নুহ্ বরাবর কাজের মানুষ। দু হাজার আঠারো সালে যখন কেরলে নিপা ভাইরাস আক্রমণ করে , তখন এই বাদুড় বাহিত ভাইরাসটি, যা কিনা মানুষের মস্তিষ্কে আশ্রয় নেয়, তাড়ানো সম্ভব হয়নি ডিটেকশন এবং দ্রুতগতিতে কাজের অভাবজনিত কারনে। কোনো আরোগ্য সম্ভব ছিল না ভ্যাকসিন নেই বলে।
    ভারতবর্ষে প্রথম কোভিড আক্রান্ত কেরলের এক যুবা মেডিক্যাল ছাত্র। সে পড়াশোনা করত চিনের উহান শহরে। ধূম জ্বর, কাশি ও শ্বাসকষ্ট নিয়ে সে ভারতে ফেরে জানুয়ারির শেষে। পি বি নুহ্ তখন থেকেই এই ব্যাপারে চিন্তিত ছিলেন । ঘটনাটা তিনি জানতে পারেন মেডিক্যাল পাঠরতা তাঁর স্ত্রীর কাছে। ফেব্রুয়ারিতে তিনি তৎপর হতে দেরি বা দ্বিধা করলেন না। সঙ্গে সঙ্গে স্টেট হেল্থ সেক্রেটারির সঙ্গে বসে তৈরি হল কাজের স্ট্র্যাটেজি। তিন ধাপে কাজ হবে। ট্রেসিং। আইসোলেশন। সারভেইলান্স। এমনিতেই কেরলে নুহ্ তাঁর কাজের জন্য প্রসিদ্ধ। দুহাজার আঠারোর বন্যাতে প্রচুর কাজ করেছেন। রান্নিতে" নুহ্ র আর্ক" কথাটা প্রচলিত। অনেক ক্ষয়ক্ষতি বাঁচিয়েছেন। তার কাজ পুরোনো ধাঁচের ডিটেকটিভের মতো । ওল্ড স্টাইল। টু রিড দ্য ক্রাইসিস। প্রযুক্তি সহায়।
    প্রায় ডিটেকটিভের মত কাজ শুরু করলেন নুহ্। পঞ্চাশ জন পুলিশ অফিসার, প্যারামেডিক ও ভলান্টিয়ার নিয়ে শুরু হল তাঁর কাজ। এঁরা ছোট ছোট দলে বিভক্ত হয়ে ছড়িয়ে পড়লেন। মোবাইলে জিপিএস ফলো করে শুরু হল সারভেইলান্স ফুটেজ নেওয়া। দেখা গেল একসপ্তাহের মধ্যে ইতালি ফেরত ঐ পরিবারটি বিমানবন্দরে, রাস্তায়, ব্যাঙ্কে, বেকারিতে, গহনার দোকানে , হোটেলে, বাজারে গেছেন। এমনকি একটা কাজে পুলিশ ফাঁড়িতেও গেছেন। নুহ্ এবং তার পন্চাশজনের বাহিনী তন্ন তন্ন করে খুঁজতে লাগলেন সেইসব মানুষদের যাঁদের এরা সংস্পর্শে এসেছিলেন। প্রযুক্তি সহায়। ঐ পরিবারের সকলের মোবাইল থেকে জিপিএস ও সারভেইলান্স ফুটেজ। সংক্রামণ থামাতেই হবে। নুহ্ র কাজের পিছনে পর্বতপ্রতিম সহায়তা ও সমর্থন দিয়ে গেলেন স্বাস্থ্যমন্ত্রী কে কে শৈলজা । ইতিমধ্যেই যাঁর খ্যাতি হয়েছে "করোনা কিলার" নামে। জ্বর, শুকনো কাশি আর শ্বাসকষ্টের খোঁজে কেরালাতে দৈনিক কুড়িঘন্টার তল্লাশি চালাতে লাগল নুহ্ র দল।

    ✨ শ্যামার সংসার

    দু' বাড়ি থেকে অ্যাডভান্স টাকা পেয়েছে শ্যামা। সবমিলে হাতে এখন দশ। আরেকটা বাড়িতে সন্ধেবেলা রুটি করে দিত। সে কাজটা গেছে। দিব্যি বলে দিল , আর আসতে হবে না। বসিয়ে মাইনে দেবেই বা কেন, এই ভেবে নিজেকে বোঝালো শ্যামা। তার তো তবু দুটো কাজ আছে । লতিফার একটাও নেই। সন্ধ্যার নেই। অণিমার দুটো গেছে। একটা আছে। সব বলছে নিজেদের কাজ নিজেরা করে নেবে, পরকে পয়সা দেবে কেন। আর এরাও তো পারে বাপু। এ বাড়িতে চারমাস। ও বাড়িতে ছ' মাস। ঝপাঝপ ঢুকছে। একটু এদিক ওদিক হলে ঝপাঝপ ছাড়ছে। কোথাও মন টেকে না। বাড়িগুলোও তেমনি। কিটির কিটির করে। মাইনে কাটে কামাই বেশি হলে।
    শ্যামার শাশুড়ির কাজটা আছে। বুড়ি দশ বছর ধরে এক বাড়িতে লেগে আছে। বাচ্চা দেখার কাজ নিয়ে ঢুকেছিল। সে বাচ্চা এখন বড় হয়ে গেছে। বুড়ি কিন্তু কাজ ছাড়েনি। ওরাও ছাড়ায়নি। মায়া পড়ে গেছে। যেমন শ্যামার এ বাড়িতে মায়া পড়ে মন বসে গেছে। বউদি মানুষটা খারাপ না। সাজগোজ করতে ভালবাসে। শ্যামাকে এটা ওটা দেয়। এই লকডাউন হবে বলে পাঁচ কেজি চাল ড্রাইভারকে দিয়ে পৌঁছে দিয়েছে শ্যামার বাড়িতে । কী সব শখের উল্টো পাল্টা রান্না করে। খেতে খারাপ হয় না। শ্যামাকে টিফিনবাটি ভরে দিয়ে দেয় ছেলেটার জন্য। হাফপেন্টুল পরা মেয়েটাও দরাজ হাতের। গা খোলা জামাকাপড় পরে নিজের ঘরে বসে থাকে বটে কিন্তু দরাজ হাত। শ্যামাকে দিয়ে এটা ওটা আনালে পয়সা ফেরত চায় না। দোষের মধ্যে বড্ড বিড়ি সিগারেট খায়। আর শ্যামাকেই আনতে হয় সব। সুখনলাল জুহিকে নিয়ে ভেগে যাবার পর
    সবমিলিয়ে হাতে তেমন কিছু ছিলনা। সুখন ব্যাঙ্ক থেকে তুলে নিয়ে গিয়েছিল সব। আড়াই বছর বেদম খেটে কিছুটা জমিয়েছে শ্যামা। ছেলেকে প্রাইভেট দিয়েছে। তা এই রোগের জন্য নাকি সব বন্ধ । স্কুল। প্রাইভেট । সব। অনলাইন বলে কিসে পড়াশোনা হবে। অনলাইন কি বাজারে কিনতে পাওয়া যায় । শ্যামার জানে না। যদি অনেক দাম হয় তবে তো হবে না। না হোক । ছেলেটাকে বাড়িতে ধরে রাখতে হবে। এমনিতেই জ্বর জ্বর করছে গা। সুখনের কথা এমনিতে ভাবার সময় থাকে না শ্যামার। কিন্তু এই রোগের কথা ছড়িয়েছে পর থেকে মনটা আনচান করছে। বেলা বাড়লে গলা শুকিয়ে আসে। রোদের বড় তেজ। শ্যামার শরীর মন জ্বলে পুড়ে যায়। কাজ থাকলে সব আপদ বালাই ভুলে থাকে। এখন বড় জ্বালা। শাশুড়িটাও মিইয়ে গেছে। কাজ ছাড়া বাড়িতে বসে দিন কাটছে না। এখন সিরিয়ালে মহাভারত দেখার জন্য বসে থাকে। আর ঝগড়াও করছে না তেমন। আগে শ্যামার সঙ্গে শাশুড়ির ঝগড়ার একটা রুটিন ছিল। সেটা সকালে। দু'জনে কাজে বের হবার আগে। কলের জলে কে আগে স্নান করবে, কাপড় কাচবে সেই নিয়ে চিল চিৎকার। বাপান্ত। এখন কাজ নেই। ঝগড়া নেই। ম্যাদামারা সকাল। তবে সন্ধে হলে একসঙ্গে বসে টিভি দেখে ওরা। নাগিন কন্যা। সাঁঝের বাতি। রামায়ণ। তারপর জম্পেশ করে ঝাল ঝাল চুণোমাছের ঝোল দিয়ে সাপটে ভাত খায়। ছেলেও ঝাল খেতে শিখেছে খুব। পেটে গরম ভাত পড়লে কোনো দুঃখই তেমন দুঃখ নয়। এমনকি বর ভেগে গেলেও গরম ভাত ভালো লাগে। এইসব জেনেছে শ্যামা। রোগটা কতদিনে যাবে কে জানে এইভাবে ঘরবন্দি থেকে গায়ে হাত পায়ে ব্যথা । বৌদিকে ফোন করলে বলে, সারা ভারতে রোগ। পৃথিবীতে রোগ। পৃথিবী বা ভারত কাকে বলে জানে না শ্যামা। কতদূর, কত বড়ো তাও বোঝে না। কাজ ছাড়া পাগল পাগল লাগে ঘরবন্দি । শেষে বিকেলে কয়েকজন বউ ঝি মিলে স্কুলের মাঠে গপ্পো করতে যায় । মাস্ক কিনেছে দশ টাকা দিয়ে । কথা বলার সময় গলাতে নামায়। ভারি ভালো গপ্পোগাছা হয় কিছুসময়। এও নাকি বারণ। পুলিশে ধরবে। তা পুলিশ আসছে আগাম জানান দিয়ে দেয় পাড়ার বাচ্চারা। তখন দুদ্দাড় নিজেদের ঘরে। শ্যামা দেখে ছেলেটার বেশ জ্বর। তেমনি শুকনো কাশি। ডাক্তারের চেম্বার খোলা নেই একটাও। শ্যামার চোখে জল এল। অনেকদিন বাদে।

    ✨যেতে যেতে একলা পথে

    সুখনলাল ও তার দল যখন হাঁটছিল তখন ভারতে কোভিডের দ্বিতীয় স্টেজ। রোগ ছড়াচ্ছে । গোষ্ঠী সংক্রমণের আশংকাতে মিডিয়া তটস্থ। ওদের বাথরুম নাই। রাস্তায় থুতু ফেলা অভ্যাস। দল বেঁধে থাকা অভ্যেস। একা বাঁচা যায়!
    আ স্টিচ ইন টাইম সেভস নাইন।
    জানুয়ারি মাস ভারতবর্ষে উৎসবের সময় । জাঁকিয়ে শীত পড়লে রংচঙে মেলাগুলো সেজে ওঠে। পিকনিক , বইমেলা, হস্তশিল্পমেলা, চলচ্চিত্র উৎসব, কবিতা উৎসবের উচ্ছাসে দেশ যখন মাতোয়ারা, কেরালাতে ঠিক সেই সময় চারটি আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর বন্ধ করে দেওয়া হল। বিদেশ ফেরত যাত্রীদের পরীক্ষা শুরু হল আর কোভিড পজিটিভদের নিয়ে যাওয়া হচ্ছিল আইসোলেশন সেন্টারে। তাঁদের লালারসের নমুনা সোজা পাঠিয়ে দেওয়া হচ্ছিল সাতশ মাইল দূরে ন্যাশনাল ইন্সটিটিউট অব ভাইরোলজিতে।
    পুল্লিচালিল নুহ্ ইতালি ফেরত পরিবারটির গতিবিধি তন্নতন্ন করে খোঁজা শুরু করলেন। ইতিমধ্যেই তাঁর টাস্ক ফোর্সের ছোটছোট দলগুলির সদস্যসংখ্যা বাড়িয়ে ছয় থেকে পনেরো করেছে স্টেট। দেখা গেল ইতিমধ্যেই মানে ফিরে আসার সাতদিনের মধ্যে পরিবারটি প্রায় তিনশ মানুষের সংস্পর্শে এসেছেন। । এর পরের কাজ ঐ তিনশ মানুষকে খুঁজে বের করে তাঁদের রোগলক্ষণ সধাক্তকরণ। ব্যাপারটা খুব সোজা নয়। অনেকেই আগ বাড়িয়ে নিজের রোগের ফিরিস্তি দিতে চায় না। প্রায় ষাঠজন মেডিক্যাল ছাত্রকে নিয়ে নুহ্ তৈরি করলেন কল সেন্টার, তারা ফোন করে সমস্ত অনুসন্ধান চালাবে। যদি কেউ তথ্য দিতে অসম্মত হয়, আছে পুলিশ, প্রশাসন এবং পঞ্চায়েতের চাপ। ফেব্রুয়ারির আগেই কেরালাতে তৈরি হয়ে গেছে চব্বিশ সদস্যের একটি কার্যকরী সমিতি, কারণ সেখানে কোভিড আক্রান্তের সংখ্যা তখন বারোশো। নুহ্ এবং তাঁর সঙ্গীরা মাস্ক পরা শুরু করে দিয়েছেন। শুরু করেছেন হ্যান্ড স্যানিটাইজার ব্যবহার। বাকি ভারতবর্ষ তখন আত্মমদগর্বে আচ্ছন্ন। কোভিড ক্যা চিজ হ্যায়?

    ✨সুখনলাল

    সুখনলালের শেষ কয়েকটি বিস্কুট তখন ফুরিয়ে গেছে। তার উচ্চতা বেশ ভাল। দীর্ঘ সুঠাম চেহারা। কিন্তু খাদ্যের স্বল্পতা একজন হাট্টা কাট্টা মানুষকেও কাহিল করে। দলটি এগিয়ে গেছে বেশ কিছুদূর । শুধু আসন্নপ্রসবা বধূটিকে নিয়ে গাছতলায় বসে আছে তার নিরুপায় স্বামী। একটি অল্পবয়সী মেয়ে। হয়তো বোন । চার বছরের শিশুটি শক্ত করে ধরে রেখেছে সুখনলালের একটা অঙুল। যেন একটা বিরাট ভরসা। গর্ভিণীর প্রসবযন্ত্রণা শুরু হলে অল্পবয়সী মেয়েটি তৎপর হয়। এখানে কোনো গরম জলের ব্যবস্থা নেই। পুরুষটি
    তৎপরতায় পুকুরে ছুটলে সুখন শিশুটিকে নিয়ে একটু দূরে বসে।
    সারমেয়দের দলটি অনেকক্ষণ অপসৃয়মান দলটিকে দেখল।
    - হ্যাঁ রে। এরা তো কিছুই খেতে দিল না।
    - খেতে দেবে কি! এদের নিজেদেরই খাবার নেই।
    - বিস্কুট, পাঁউরুটিও নেই?
    - নেই বোধহয় । থাকলে এক আধটুকরো দিত।
    - তা বটে।
    - হাই ওয়ের দোকানগুলো বন্ধ কেন রে?
    - জানি না। কবে থেকে বন্ধ । খিদেতে পেট জ্বলছে।
    - আমাদের কেউ খেতে দেবে না?
    - মনে হয় না।
    - খিদেতে কান্না পাচ্ছে।
    সারমেয়দের মধ্যে বলিষ্ঠতম কুকুরটিও খিদেতে দুর্বল হয়ে গেছে। সে মাথা নেড়ে বলল
    - আমরা সবাই মরে যাব।
    গর্ভিণী মেয়েটি কাতরাচ্ছিল। এই খটখটে ভরদুপুরে হাওয়া নেই। অল্পবয়সী মেয়েটি প্রাণপণ চেষ্টা করছিল দিদি বা বৌদিকে সামাল দেবার। পুরুষটি বিড়ি খাচ্ছে।
    একটি সারমেয়ী গত তিনদিন আগে প্রসব করেছে চারটি শিশু। সে সজল চোখে এই আসন্ন মানবজন্মকে প্রত্যক্ষ করছিল।
    সুখনলাল নিজের পুঁটলি হাতড়ে রুটি গুলি বের করলো। হালিমা খাতুনের বানানো রুটি। হাতে নিয়ে বসে থাকল অনেকক্ষণ ।
    চিৎকার, যন্ত্রণার ও প্রশমনের। সুখনলাল ঘাড় ফিরিয়ে দেখল একটি শিশুর জন্ম হল। মাটি শুষে নিচ্ছে রক্তস্রোত। চার বছরেরটি তার দিকে অবাক হয়ে তাকালো। তার হাতে একটা রুটি দিল সুখন। আর একটা দিল সদ্য মা হওয়া কুকুরীটিকে। নিজের জন্য রুটিটা আপাতত তোলা থাক। হে ভগওয়ান। আপাতত তোমার দয়াতে একটা নান্হা প্রাণ জন্মালো। ফোন বার করে সুখনলাল দেখলো চার্জ নাই।

    ✨আজি এ আঁধারে

    অন্ধকার একেবারে জমাট বেঁধে আছে এখানে। কিছুটা নীলচে আলো চুঁইয়ে চুঁইয়ে প্রবেশ করার বৃথা চেষ্টা করেছিল। ফলে একটা নীলচে অন্ধকারে দেখা যায় রাশি রাশি কালো বাদুড় ঝুলে আছে এই গভীরতম অরণ্য প্রদেশের কন্দরে কন্দরে। অন্ধকার থেকে নির্গত হচ্ছে এক প্রকারের গন্ধ । যেখানে বাদুড়ের সমাগম বেশি, সেখানেই এরকম গন্ধ হয়। মনুষ্যকুল একে বোঁটকাগন্ধ বলে থাকে বটে। এই নিসর্গ একটা ছবির ক্যানভাসের মত,যেখানে গুচ্ছ গুচ্ছ বাদুড় নিরাপদে ঝুলে আছে, কারণ অরণ্যের এই নিভৃত নীলাভ সুষমায় এখনও মানুষ এসে পৌঁছাতে পারেনি। টি এস এলিয়ট তাঁর কবিতায় এক ডাচ চিত্রকরের আঁকা অয়েল পেইন্টিংএর কথা উল্লেখ করেছিলেন। সেই অন্ধকারের ছবিতে বাদুড়গুলির মুখ ছিল মানব শিশুর মত। পঞ্চদশ শতকের ডাচ চিত্রশিল্পী হাইরোনিমাস বশ " নরক" নামে এই ছবিটি এঁকেছিলেন। পৃথিবীর ভয়াবহতা বোঝানোর জন্য মানুষ যে কেন বাদুড়ের উপমা দেয় কে জানে। মানুষ নির্বিচারে নিজেদের ভয়ানক ও ভয়াবহ কর্মকাণ্ডগুলিকে পাশবিক বলে। সরীসৃপের মত বলে নিন্দাবাদ করে। যা কিছু নিজের মত নয়, সেটাকেই মানুষ " আদার" বলে সরিয়ে রাখে। যেন তার নিজের অস্তিত্বটাই সব। বাকি সব না থাকলেও কিছু না। কিছু না।
    আজ সে পরে আছে লালের ওপর চিত্রবিচিত্র করা একটি বারমুডা এবং ঢোলা একটা টি। তার বিছানার মধ্যে গড়াগড়ি খাচ্ছে ল্যাপটপ, ফোন, ডায়রি, অ্যাশট্রে , সিগারেটের প্যাকেট । সে একটা দামী ব্র্যান্ড খায় , যাতে গলার ক্ষতি না হয়। ঘরে দরজা বন্ধ করে বসে থেকে থেকে সে এবং তার কিছু সঙ্গী সাথী একটি ফান্ড রেইজার তৈরি করেছে। তার নিজস্ব এবং বন্ধু বান্ধবদের যৌথ সোর্সে একটা মোটামুটি অর্থ জোগাড় হয়েছে পথচারী শ্রমিকদের দুটি দলকে পাঠানোর মত। অনলাইনে টাকা পয়সার হিসেব করে দেখেছে যে প্রায় দু' লক্ষ টাকা ফান্ডিং হয়েছে আপাতত। সেইজন্য তার মন মেজাজ কিছুটা ভাল আছে। সে সিলিং এর বিষন্ন টিকটিকিটির দিকে তাকিয়ে বলল,আ উওম্যান ড্রিউ হার লঙ ব্ল্যাক হেয়ার আউট টাইট/ অ্যান্ড ফিডলড হুইসপার মিউজিক অন দোজ স্ট্রিংগ্স/ অ্যান্ড ব্যাটস উইদ বেবি ফেসেস ইন দ্য ভায়োলেট লাইট / হুইসল্ড অ্যান্ড বিট দেয়ার উইংগস/ অ্যান্ড ক্রল্ড হেড ডাউনওয়ার্ড ডাউন আ ব্ল্যাকেন্ড ওয়াল"।
    চারদিকে লক্ষ বাদুড় ডানা মেলে ফড়ফড় করল। যেন এই উড়ে যাবে। ঘন্টাধ্বনি হল ঢং ঢং করে। অরণ্যের গভীরে কোনো প্রাচীন গির্জা জেগে উঠল। নেমে এলেন গথিক পুরোহিত। অন্ধকারে সাদা তারাফুল ফুটছে এখন। এই এক্সোটিক নবজীবন রোগের আধার। বাদুড়ের স্বাভাবিক সহবাসী করোনা ভাইরাস । বাদুড়ের ইমিউনিটি প্রবল শক্তিশালী । সে করোনাভাইরাসকে দেহে ধারণ করে এই তমসাময় কালকে অতিক্রম করে আসছে।
    টিকটিকি ডেকে উঠলো টকটক করে।
    - কি ভাবছ বলো তো। বাথরুমে বসেও ভাবছিলে।
    - তুমি বাথরুমেও উঁকি দাও? ভয়্যুরিস্টিক!
    - কমোডে বসে বিড়ি খেতে খেতেও ভাবছিলে।
    - তুমি খেয়াল করেছো।
    - সব খেয়াল করি। এই যেমন আজ তোমার মন ভালো আছে। মুখটা গোমড়া নেই। ভাইরাস গেল?
    - ভাইরাস যাবে না তো। । সব প্রাণীর দেহে কোনো না কোনো ভাইরাস থাকে। যেমন কিছু কিছু বাদুড়ের মধ্যে কোভিড নাইন্টিন।
    - ওদের অসুখ করে না?
    - নাহ্। ওদের ইমিউনিটি খুব স্ট্রংগ।
    ও উঠে বসে মরিচ রঙের স্ট্রেট চুলগুলি চূড়ার মত বাঁধল।
    - ইন্টারস্পিসিস ট্রান্সমিশন হলে বিপদ । বাদুড়ের কাছে যেটা কিছু না, মানুষের কাছে সেটা ভয়ংকর। বুঝলে? ওর মসৃণ ত্বক ছলছল করছে লাল আভাতে। টিকটিকি সজাগ হল।
    - শ্বাসকষ্ট হয়?
    - হয়। মানুষের । যদি কোভিড নাইন্টিন অ্যাটাক করে।
    - আমারও শ্বাসকষ্ট হয় আজকাল। খুব শ্বাসকষ্ট হয়।
    - কেন বলোতো?
    - তোমরা তিনটে মানুষ তিন ঘরে বসে থাকো। ফোন নয় ল্যাপটপ মুখে করে। কেউ কারো সঙ্গে কথা বলো না। তুমি তোমার মায়ের সঙ্গে খ্যাঁচখ্যাঁচ করো। তোমার মা তোমার বাবাকে সন্দেহ করে। প্রায়ই তোমার বাবার ফোন ঘাঁটে জানো। লক্ড থাকে বলে চটে যায় । তোমার বাবা জানলার পাশে মাধবীলতার ঝাড়টা কেমন কেটে ফেলল। গুলন্চ গাছটাও কেটে দিল হুড়মুড় করে। পাখির বাসা ভেঙে দিল। তোমার মা কতদিন আমার ডিম ভেঙে ফেলেছে। আমার শ্বাসকষ্ট হয় আজকাল ।
    - হবারই কথা। আমারো হয়।
    -,ভাইরাস খুব ছড়াচ্ছে?
    - ভাইরাস হয়তো আমাদের মধ্যেই আছে। স্ট্রংগ ইমিউনিটি বলে কিছু অসুবিধে হচ্ছে না। আই মে বি কোভিড পজিটিভ । আই মেট মেনি ফ্রেন্ডস ফ্রম স্টেটস। আমি ভাবছি একটা টেস্ট করাবো। ইফ আই অ্যাম পজিটিভ আই উইল গো টু দ্য কোয়ারেন্টাইন সেন্টার। এ বাড়ির চেয়ে ভালো।
    - আমাকেও নিয়ে যেও। এখানে ভালো লাগে না আর। আই মে বি অ্যাসিম্পটোম্যাটিক পজিটিভ।

    অন্ধকারে হুড়োহুড়ি করে উড়ে গেল বাদুড়ের দল। প্রাচীন গির্জা ভাঙার শব্দে জেগে উঠছে ভ্যাম্পায়ারের দল। একটা একটা করে কাটা পড়ছে মহীরুহ। পাইন। ওক। বার্চ। বট। অশ্বথ। জারুল। তরল । শাবল আর গাইতির শব্দে কান বন্ধ হয়ে যায় । নাকে কোনো ঘ্রাণ নেই আর। দেহে সাড় নেই। কেউ কাউকে এক ইঞ্চি জমি ছেড়ে দেবে না বলে অরণ্যের মধ্যে দিয়ে সড়ক হবে। তফাত যাও। তফাত যাও। লর্ড ভ্যাম্পায়ার জেগে উঠছেন। কাউন্টের শ্বদন্ত বিকশিত । রাজ্যহারা ভ্যাম্পায়ার এখন ডানা বিস্তার করেছেন। তার ডানা থেকে উড়ে যাচ্ছে লক্ষ লক্ষ ভাইরাস। তারা আশ্রয় চায় । তাদের নীল অন্ধকার শেষ হয়ে গেছে।
    ঘরে নক করে সে এল। আজ গোলাপি রাত্রিবাসের ওপর সাদা হাউসকোট। সে সবসময় ডেলিকেসি সচেতন।
    - উঠবি না? চল খাবি চল। চিকেন পকোড়া । মেয়োনিজ বানালাম ইউ টিউব দেখে।
    - ফাক ইট!
    - তুই আমার সঙ্গে ভদ্রভাবে কথা বলতে পারিস অন্তত। আমি তো বুঝতে পারি না কি দোষ করলাম ...
    প্রায় জল এসে গেছে চোখে। ও উঠে পড়ে। আজ মুড ভালো। এতটা না করলেও চলতো ।
    লাফ দিয়ে উঠে জড়িয়ে ধরে। তার গায়ে কী সুন্দর গন্ধ! সে গভীর শ্বাস নেয় । গন্ধ পাচ্ছে এখনো। কতদিন হল পৃথিবী সুগন্ধের আস্বাদন ভুলে গেছে।
    কাঁধে মুখ ডুবিয়ে বলে
    - আমাদের ফান্ডে তুমি কিছু ডোনেট করবে? ইউ ক্যান ডু ইট। তোমাকে তো বলা হয়নি ফান্ড রেইজারের কথা। বলছি । ডোনেট করবে মা?

    ✨জননী , জন্মভূমি

    প্রসবের দুঘন্টা বাদে বধূটি উঠে দাঁড়ায় । শরীরের সমস্ত দুর্বলতা, অনাহারজনিত এবং প্রসবজনিত, এখন নগণ্য। নিজেকে গুছিয়ে নিতে নিতে সদ্যপ্রসূতি মেয়েটি চারপাশ দেখে নেয় ওরা চলতে শুরু করে। ঈষৎ খুঁড়িয়ে হাঁটছে । অগোছালো শরীর। কিন্তু হাঁটছে। খাদ্য বলতে শুকনো পাঁউরুটি । তাও সামান্য। একটা ছেঁড়া পুরনো কাপড়ে শিশুটি জড়ানো। একবার দুবার তার কান্না শোনা গ্যাছে। সুখনলাল গাছের নিচে এসে দাঁড়াল। ঐ দম্পতির বড় ছেলেটি তার হাতের আঙুল ধরে আছে। বিশাল গাছ। শাখা প্রশাখা বিস্তার করে দাঁড়িয়ে একটি মানবপ্রাণের জন্মের সাক্ষী হয় থাকল অজস্র পাখির কলকাকলির মায়া জড়িয়ে । যেকোনো সময় পুলিশ আসতে পারে। তাই খুব দ্রুত হাঁটার চেষ্টা করছিল ওরা। যত তাড়াতাড়ি হাঁটা যায় । সুখনলাল গাছের নিচে দাঁড়িয়ে দেখল । পড়ে আছে কিছু রক্তমাখা কাপড়। শিশুর নাড়ি কাটা হয়েছে ব্লেড দিয়ে । নাড়ি ও ফুলটি পড়ে আছে গাছের তলায়। নিতান্ত অপাংক্তেয় । জন্মের চিহ্ন। যদি ঐ শিশু বেঁচে থাকে, যদি কথা কয়, সে জানবে না কোথায় সে জন্মেছিল। এই সব রক্ত, নাড়ি, ফুল , যাবতীয় জন্মচিহ্ন মাটিতে মিশে যাবে মৃত্যুর অমোঘ ইঙ্গিত দিয়ে । সবকো মরনা হ্যায়। কিসি না কিস দিন। করোনা হো ইয়া না হো। ফির কিঁউ ইতনা ডর। সুখনলাল হা হা করে হেসে শিশুটির হাত ধরে পথ চলে। বাড়ি যাচ্ছে সে। আপনি শ্যামাকে পাস!

    ✨যশবন্ত কুমার ইউ কে থেকে কেরলে ফিরেছিলেন জানুয়ারির শেষে । এয়ারপোর্টে তাঁর জ্বর পরীক্ষাজ করে কোভিডের সম্ভাবনা দেখা যেতেই তাঁকে আর বাড়িতে যেতে দেওয়া হয়নি। বিমানবন্দর থেকে তাঁকে সোজা নিয়ে যাওয়া হয় তাঁর বাড়িতে । না। কোনো কোয়ারেন্টাইন সেন্টারে নয়। তাঁর বাড়িতে যেখানে তাঁকে আইসোলেশনে রাখা হয় আটাশদিন। মধ্যবর্তী সময়ে ডাক্তার তাঁকে নিয়মিত পরীক্ষা করেছেন। তাঁর শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্য সম্পর্কে বিভিন্ন প্রশ্ন করেছেন এবং তাঁর যাবতীয় প্রয়োজনের সামগ্রী সরবরাহ করেছে সরকার। আঠাশ দিন পর মুক্তি পেয়ে যশবন্ত জানান যে এই আইসোলেশনে তাঁর কিছুমাত্র অসুবিধে হয়নি। হু অতিমারী ঘোষণা করার একদিন আগেই কেরলে সমস্ত স্কুল কলেজ বন্ধ করে দেওয়া হয়। বন্ধ হয়ে যায় বিনোদনভবনগুলি । সমস্তরকম অনুষ্ঠান এমনকি ধর্মীয় অনুষ্ঠানও বন্ধ। যেখানেই জনসমাগম হবার সম্ভাবনা,সেখানেই কাজ বন্ধ করে দেওয়া হয়। অতিমারীর মোকাবিলা করার জন্য কেরল কেন্দ্রের মুখাপেক্খী হয়নি। যা সিদ্ধান্ত নেবার নিয়েছে ফ্রন্ট। ভারতবর্ষের অন্যান্য প্রদেশগুলি কি যখন জানত, কোভিড নাইন্টিন কি? অতিমারীই বা কি?বিদেশ থেকে কেউ ফেরামাত্রই তাকে হোম কোয়ারেন্টাইনে পাঠানো হয়েছে আঠাশ দিনের জন্য। চিরশ্যামল প্রকৃতি , ব্যাকওয়াটার ইত্যাদির জন্য কেরলে পর্যটকের আনাগোণা খুব বেশি। তার ওপর শিক্ষিতের সংখ্যা বেশি হওয়ায় কেরালার চারটি বিমানবন্দরে প্রকান্ড ভিড় । এখানকার বহু ছেলেমেয়ে বিদেশে পড়াশোনা করতে বা চাকরি করতে চলে যায় । বিদেশের সঙ্গে সংযোগ বেশি থাকার ফলে কোভিড আক্রমণ ও সংক্রামণের সম্ভাবনা যে বেশি, সেটা কেরল সরকার বুঝে যায় অনেক আগেই।

    টমাস অনিল। চেঙ্গালা। কেরল।
    টমাস অনিল তাঁর বাড়ি সংলগ্ন একটি ছোট আউটহাউসে একা বসেছিলেন। ভারি নিঝুম এই বসন্তের দুপুরগুলো। সামনে ক্যাজুরিনা গাছের সারি। তার পিছনে তাঁর নিজের হাতে লাগানো জবা গাছ। মাসুন্ডা। ডালিয়া। গাছগাছালির ফাঁক দিয়ে তাঁর বাড়িটি দেখা যায় । ছোট দোতলা বাড়ি । ছিমছাম। দোতলার স্টাডি সংলগ্ন বারান্দায় তাঁর মেয়ে দাঁড়িয়ে আছে। হলুদ ফ্রক দেখা যাচ্ছে দূর থেকে ।
    আর কি কোনোদিন অনিল ছেলেমেয়েদের কাছে যেতে পারবেন? কোলে নিতে পারবেন? চুমুতে ভরিয়ে দিতে পারবেন কচি মুখগুলি? ভাবতেই কেমন গা হাত পা ঠান্ডা হয়ে আসে তাঁর। শরীর বেশ দুর্বল । দুবাইতে জ্বর এসে গেছিল। বেশ জ্বর। টমাস অনিল সেলসে আছেন। দুবাইতে বিজনেসট্রিপ ছিল জানুয়ারিতে। ত্রিবান্দ্রাম বিমানবন্দরে নেমে অবাক অনিল। চারদিকে একটা আশ্চর্য থমথমে ভাব। স্বাভাবিকের চেয়ে অনেক বেশি কড়াকড়ি । ফ্লাইটে শ্বাসকষ্ট শুরু হয়েছিল। শুকনো কাশি । কত তাড়াতাড়ি বাড়ি ফিরবেন ভাবছিলেন। । প্রায় কুড়িদিন বাদে বাড়ি ফেরা। পলি আর ছেলেমেয়েরা ব্যস্ত হয়ে আছে চেঙ্গালাতে। কিন্তু অনিলের কপাল খারাপ । বিমানবন্দরে তাঁকে কোভিড সাসপেক্ট হিসেবে সনাক্ত করা হল। ত্রিবান্দ্রাম হসপিটালে নিয়ে যাওয়া হল সোজা সোয়াব পরীক্ষার জন্য। সেখান থেকে তিনি বাড়ি যাবার ছাড়পত্র পেলেন বটে কিন্তু পঞ্চায়েত ও লোকাল কমিটির কাছে খবর গেল যে তাঁকে আলাদা থাকতে হবে। আইসোলেশনে। স্ত্রী ছেলেমেয়েদের সঙ্গে দেখাও করা যাবে না। কাজেই ফিরে এসে আউটহাউসে আছেন তিনি। বাড়িতে রেশন ও নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিষ পঞ্চায়েত পাঠিয়ে দিচ্ছে। তাই কোনো অসুবিধে নেই। জ্বর কমেছে এখন। তবু আরো পনেরো দিন আইসোলেশনে থাকতে হবে তাঁকে। মাঝেমাঝেই খুব ভেঙে পড়ছেন টমাস। ছেলেমেয়েদের এদিকে আসতে দেওয়া হয় না। কিন্তু পলি এসে দূর থেকে দেখা করে যান। খাবার রেখে যান। পলির হাতে গ্লাভস ও মুখে মাস্ক থাকে। অনিলের থাকে না।
    দুপুরে ছিল কার্ডরাইস , সবজি আর ছাঁচ। আজ শ্বাসকষ্ট কিছুটা কম। লাঞ্চের পর কিছু কাজের মেইল করলেন অনিল। আর কিছু সামাজিক। পুনেতে তাঁর মাইক্রোবায়োলজিস্ট বন্ধুপুত্র কোভিডআক্রান্তদের নিয়ে কাজ করছে। তাকেই নিজের কথা জানালেন অনিল। হাই দেবরূপ। আই অ্যাম কোভিড অ্যাফেক্টেড অ্যান্ড হোমকোয়ারেন্টাইন্ড। গাছের ফাঁক দিয়ে ঝিকমিক করে আলো আসছে । পলির সাদা শার্ট আর গোলাপি লং স্কার্ট দেখা গেল। কফি নিয়ে এসেছেন। দূরে টেবিলে রেখে চলে যাবেন। পরে অনিল গিয়ে নিয়ে আসবেন কফি। এতটাই দূরত্ব রাখতে হবে বাঁচার জন্য। পলির স্কার্ট ফিরে যাচ্ছে ঢেউ তুলে। সেদিকে তাকিয়ে অস্থির বোধ করলেন অনিল। কতদিন পলিকে স্পর্শ করেন নি তিনি। আদৌ কি পারবেন কোনোদিন?
    ✨মাঝেমাঝেই সে অন্যমনস্ক থাকে। আত্মহত্যাপ্রবণতা ঠিক নয়। কিন্তু এক্সিসটেনশিয়াল ক্রাইসিস ঘটে তার। সে তার বাবা মায়ের একমাত্র ছেলে। বোন যথেষ্ট মেধাবী। বাবা মা এখনো শক্তপোক্ত । দুজনেই চাকরিজীবী । বাইরে থেকে দেখলে কোনো সমস্যাই নেই। তার বান্ধবী তার সহপাঠিণী । তাকে বিয়ে করতে চাইলেও ভবিষ্যতে দুতরফে কোনো অসুবিধে হবে না। তবু তার বেঁচে থাকা অর্থহীন বলে মনে হয় মাঝে মাঝে। এই গবেষণার শেষে সে একটা মোটা মাইনের চাকরি পাবে। তারপর বিয়ে । বাচ্চা । স্কুল। সামাজিকতা। একটা ইঁদুরদৌড়ের মধ্যে ঢুকে যাবে
    তারপর নিজের অজান্তেই তার বাবার মত গোমড়ামুখো মাঝবয়সী ভদ্দরলোক হয়ে রবিবার সন্ধ্যায় হুইস্কি উড়িয়ে রাজনীতির শ্রাদ্ধ করবে। এই চক্রে ঢোকা কি খুব দরকার? মালবিকা । তার মা এক নিপুণ সংসারী। প্রতিটি দিন তার কাছে নতুন। প্রতিদিন সকালে উঠে যেভাবে শ্যামাদিকে নিয়ে লেগে পড়ে, তাতে মনে হয় কোনো চিন্তাভাবনা নেই। পর্দা পাল্টায়। কুশন কাভার চেঞ্জ করে। গান চালিয়ে দেয় স্টিরিওতে। তারপর স্নান করে রান্নাঘরের
    সুপারভাইজেশনে যায় । নিজের হাতে অন্তত একটা পদ । তার মা শান্তিনিকেতনের ছাত্রী। একেবারে উঠতে বসতে সেটা মনে রাখার চেষ্টা করে। মনে করিয়ে দেয় । নীলিমা সেন বাচ্চুদি। মোহন সিং মোহনদা। রমাদি। রাজেশ্বরদা। তারা বোর হয়ে যায় । বোন বিদ্রোহ করে। সে খুব কঠোর হতে পারে না। কেমন স্নেহের দৃষ্টিতে মায়ের দিকে তাকায়। তারপর উঠে চলে যায় তার স্বল্প ক' দিন ছুটির মায়াকে প্রাণে বাঁচাতে। লকডাউনে বাড়িতে যায়নি এবং সম্ভব ছিল না। ভাগ্যিস ছিল না। প্রাণে মরে যেত। ইদানীং কাউকেই খুব বেশিক্ষণ সহ্য করতে পারে না সে। ফোন বাজল।
    অদিতি । সে দেখতে পেল ফোনের ওপারে অদিতি একটা নীল কুর্তা পরে আছে। নীল রঙ ছেয়ে যাচ্ছে ঘরময়। অদিতি শিবরামণ। ভাঙা বাংলা বলে।
    - কি করছিস?
    - অ্যাজ ইউজুয়াল।
    -ডিড ইউ কুক?
    - নট ইয়েট।
    - লিসন। আই ক্যান কাম অ্যান্ড স্টে উইদ ইউ।
    - কেন?
    - যাতে তুই বোর ফিল না করিস।
    - হু সেইড আই অ্যাম বোর্ড?
    - ইওর ভয়েজ। শোন। আমি আসব?
    - একদম আসবি না।
    - তুই এত ডিফিকাল্ট কেন? ইন দিস ওয়ে, হাও ক্যান উই সেটল?
    - কে বলেছে সেটল করতেই হবে?
    - স্টপ ইওর ননসেন্স।
    - ছেলেমেয়ে হলে স্কুলে পাঠাতে পারবি না। খেলার মাঠ দিতে পারবি না। বৃষ্টিতে ভেজা দিতে পারবি না। করোনা ডেজ উইল চেঞ্জ এভরিথিং।
    - স্টপ ইওর শিট। যখন স্ট্রে ফিড করতে বেরোবি, পিক মি আপ।
    - নো ওয়ে। একদম আসবি না। মাঝেমাঝে আমার তোকে ও অসহ্য লাগে অদিতি। আনবেয়ারেবল।
    ওপাশে রেগে ফোন রেখে দেবার শব্দ হল।
    ও গ্যাস ধরিয়ে গরম জল বসালো। কফি খাবে। কড়া। তখনি ঢুকল মেসেজ ।
    টমাস অনিল। ফ্রম চেঙ্গালা।
    আই অ্যাম কোভিড পজিটিভ।
    ------

    ✨✨পর্ব দুই

    ✨ভয়। কলতলায় করোনা

    শ্যামার হাতে কিছু নগদ টাকা আছে। খুব করে গা ঘষে ঘষে টিউকলের জলে স্নান সারল শ্যামা। পায়ের ফাটা অংশগুলো ঘষলো অনেকক্ষণ ধরে। একখানা ঝামাপাথর দিয়েছিল বউদি তাকে। সেটার সদ্ব্যবহার করলো। বস্তিতে মাইকে করে বলে গেছে আজ । সবাইকে মুখে মাস্ক পরতে হবে। নয় ওড়না দিয়ে মুখ বাঁধতে হবে। আর সাবান দিয়ে হাত ধুতে হবে ঘনঘন। সাবান দিয়ে হাত ধোয়ার অভ্যাস আছে শ্যামার। পিতপিতে শাশুড়ি আর ছুঁচিবাই বউদির পাল্লায় পড়ে যে কোনো কাজ করেই সাবান দিয়ে হাত ধুতে হয় তাকে। চুলে রিঠা দিল বেশ করে। এও আরেক বউদির দান। ছুটির সঙ্গে বোনাস। " ভাল করে দিস মাথাতে। " শ্যামা কবে এমন সুযোগ পায়। রিঠার অনেক দাম। বউঅংইর মন ভালো। দুটাকার পাতা শ্যাম্পুর বদলে রিঠার তাজা গন্ধ। এগুলো ফেলবে না শ্যামা। চিপে রেখে দেবে। আরেক দিন হয়ে যাবে । ছেলেটার জ্বর নেমেছে বলে বেশ নিশ্চিন্ত লাগছে আজ। ছোটো রায়খর মাছের পাতলা ঝোল করেছে কাঁচালঙ্কা , কালোজিরে দিয়ে । আলু সিদ্ধ মেখেছে আয়েশ করে। এত ছুটি তো মেলে না সহজে। এই সুযোগে শরীরটাকে একটু যত্ন করে নিচ্ছে শ্যামা। পায়ের ফাটার মধ্যেও লেগে আছে আলতার দাগ। প্রায় উঠে যাওয়া আলতাচিহ্নের দিকে তাকিয়ে থাকল শ্যামা। বলে কিনা আলতা হল এয়োতির সোহাগচিহ্ন। তার সেই কপাল বটে। লোকটা তো মন্দ ছিল না। চোদ্দ বছরের সংসারে কেমন করে যে জুহি এসে ভাঙন ধরালো , শ্যামা বুঝতেই পারেনি। জুহির ঢলঢলে চেহারাই কি টানলো লোকটাকে না শ্যামারই কোনো গলতি ছিল, বুঝে পায় না সে। প্রথম দিকে উথাল পাথাল ভাবতো। চিৎকার করে কাঁদতো। শাশুড়ি দুষলে ঝগড়া করত চুটিয়ে। এখন কান্নাকাটি গেছে। শুধু বুড়ির সঙ্গে ঝগড়াটা থেকে গেছে। আড়াই বছরে অনেককিছু গা সহা হয়ে যায় সুখনকে ভুলে ভুলে থাকতে চাইত শ্যামা । কিন্তু সিঁদূর পরে ও ডগডগে করে। সেটা কিছু সুখনলালকে মনে করে পরে না। সিঁদূর জ্বলজ্বল করলে অনেক উটকো উৎপাত থেকে বাঁচা যায় । এদিক ওদিক কত জায়গায় যেতে হয় আর কত আপদ যে ওৎ পেতে থাকে, সে শ্যামাই জানে । সে নিজে থেকে যাদের সঙ্গে রঙ ঢঙ করে, সে আলাদা। কিন্তু বিরক্তির লোকজন তো কম না। তাদের এড়াতে সিঁদূর বড় ঢাল। মাথায় গামছা জড়িয়ে ভিজা কাপড়ে ঘরে ঢোকে শ্যামা। শাশুড়ি চিল চিৎকার করতে থাকে, বদমাইশ মেয়েছেলে। সংসার ধরে রাখতে পারে না। ব্যাটাটাকে তাড়াইল আমার। এখন তিন ঘন্টা ধইরা গায়ে সাবান ঘষে আবাগীর বেটি। হারামজাদি চা দিলি না এখনো... শ্যামা এসব শুনেও শোনে না। রোজকার অভ্যেস। কাপড় ছেড়ে আয়নায় মুখ দেখে। নোয়াতে সিঁদূর ঠেকাতে গিয়ে আড়াই বছরের সব রাগ দুঃখ ভুলে যায় শ্যামা। জুহির কথা মনে থাকে না। সব অপমান, প্রতারণা ছাপিয়ে কুলকুল করে ওঠে এক অদ্ভুত আশঙ্কা । এই মারণরোগছড়ানোর কালে সে মানুষটা ভালো আছে তো! মুখ ঢাকছে! হাত ধুচ্ছে ঠিকমত?
    শ্যামার ঘর ভর্তি সংসার। চোদ্দবছর কি কম কথা হল! দেওয়াল গেঁথেছিল সুখনলাল নিজের হাতে। ছোট ঘর। একখানা বড় খাট রেখে তেমন জায়গা নেই। খাটের পায়ার নিচে চারখানা করে ইঁট। বৃষ্টি বেশি হলে জল ঢুকে যায় ঘরে। খাটে বউদির দেওয়া ফুলছাপ বেডকাভার। ছেলেটা শুয়ে শুয়ে ফোন ঘাঁটছে। ফোনটাও বউদি দিয়েছে। বউদি মানুষ ভালো। দেওয়া থোওয়াতে কমতি নেই। খাটের ধারে ফ্রিজটাও তো সেই দিল। নতুন ফ্রিজ নিল যখন বউদি , পুরোনোটা আর দোকানে দিল না। দিলে কিছু টাকা ছাড় পেত। শ্যামার শখ ছিল ফ্রিজের। শ্যামাকে ই দিল। ফ্রিজে সকালের রান্না তুলে রাখে শ্যামা। দু একটা ফল রাখে ছেলের জন্য। ফ্রিজের পাশে আলনা ঠাসা কাপড়জামা। শ্যামার । ছেলের। বুড়ির। তার পাশে টেবিলে শ্যামার সংসারের হাঁড়ি কুড়ি। বাসনপত্র। বিস্কুটের টিন। চানাচুর। আচার। একটা ইমারজেন্সি আলো। দুটো চেয়ার। টেবিলের ওপর সুখনের সাধের টিভি। খাটের তলায় ট্রাঙ্কে পুরোনো কাপড় রাখে । একটা ছোটো স্টিলের আলমারি রেখেছে পাশে শাশুড়ির ঘরে। সেটা আরো ছোট ঘর। একপাশে ঠাকুরের আসন। তারপর আর জায়গা নেই। বুড়ি বিছানাতেই থাকে লকডাউনে। শ্যামাকে গাল পাড়ে। শ্যামা এদিক থেকে ঝাড়ে। আবার চা করে দিয়েও আসে। সন্ধ্যাকালে শ্যামার ঘরে টুকটুক করে ঢোকে বুড়ি। বলে টিভি খুলবি না? খাটের পাশে একচিলতে জানলা দিয়ে বাতাস বয়। শ্যামার ঘরে এক এক করে মাধবী, অচলা,বেবি, সবাই জড়ো হয়। সুখ দুঃখের কথা চলে টিভি দেখতে দেখতে। লকডাউনে আড্ডা ছাড়া থাকবে ক্যাম্নে? দম বন্ধ করে থাকা যায়? আবার কারু ঘরে নাকি যাওয়া যাবে না। মাধবী শুনে হেসে গড়ায় । এ আবার কোনো কথা হল?ওরা লকডাউনে সন্ধ্যাকালে জমিয়ে মুড়ি মাখে শসাকুচি লঙ্কাকুচি দিয়ে । কোনোদিন চপ বা সিঙ্গারা নিয়ে আসে কেউ। লকডাউনে এপাড়াতে মেয়ে বউরা অনেকেই আগাম বেতন পেয়েছে। কাজের বাড়ির শখের রান্না নিজের বাড়িতে করতে সাধ হয়। নিজের হাতে খোসা দিয়ে চপ গড়ে। হাসি মশকরা চাটনি। বলতে নেই চুপেচাপে বিককিরি করে দুচার পয়সা আসছেও ঘরে। একটু রাত বাড়লে পুলিশ টহল মেরে চলে যায় । ওয়ার্ডের কাউন্সিলরের ছেলেরা পাক দিয়ে যায় দুএকদিন। তারপর ওরা সামনে স্কুলের মাঠে গিয়ে বসে সকলে। প্রাণ ভরে হাওয়া খায় ঘুপচি ঘরগুলো থেকে বেরিয়ে । মাস্ক কারু গলায় ঝোলে। কারু কোমরে বাঁধা। শ্যামলী কাল বলেছে , কাপড় দিয়ে মাস্ক বানিয়ে বিক্রি করবে । এখন খুব ডিম্যান্ড। শ্যামা ও করবে ভাবছে। হরপ্রীত ফোন করেছিল। ভালো মাস্ক বানাতে জানে ও। শেখাবে বলেছে। নরম কাপড় লাগবে। কাজের বাড়ি না গেলে হরপ্রীতের সঙ্গে জমিয়ে গল্পগাছাও হচ্ছে না। পুরোনো কাপড়ের খোঁজে আলনার নিচে রাখা বাক্স হাতড়ে একখান নরম কিছু হাতে এল। হাতে নিয়ে চুপ করে বসে থাকল শ্যামা। আজ যেন কিসে লেগেছে । শাশুড়ি কুঁজো হয়ে ও ঘর থেকে এঘরে এসে দাঁড়িয়েছে । ডাকলে শুনিস না আবাগীর বেটি? ও কি? সুখনের পাঞ্জাবী হাতে কইরা বইয়া আছিস ক্যান? ছিড়বি নাকি ?
    বলতে বলতে কাশি ওঠে বুড়ির। সঙ্গে শ্বাসকষ্ট। ।
    ভোর হবার সঙ্গে সঙ্গে এ পাড়াতে সবাই উঠে যায় । কলের জল ধরা একটা প্রধান কাজ। পাঁচটায় জল আসে। তারপর আবার সাতটায় । কিন্তু সাতটার আগেই মেয়ে বউরা কাজে বেরিয়ে যায় বলে সকাল পাঁচটার জল ধরার তাড়া থাকে খুব বেশি। স্নান। কাপড় কাচা । রান্নার জল ধরা । লকডাউন শুরু হয়েছে পর থেকে সব তাড়াহুড়ো খতম। ধীরে সুস্থে উঠলেও চলবে। সব কাজকাম বন্ধ। বেশ কিছু মেয়েদের কাজ গেছে। লকডাউনে কেউ বসিয়ে মাইনে দিতে চাইছে না। ছোট ব্যবসা বন্ধ হলে বড় বিপদ। সামান্য জমানো পুঁজিতে হাত পড়ে। কাজেই লোক ছাঁটাই । শ্যামা ভোরে ওঠার অভ্যেস বজায় রাখে। জল ভরে রাখে খুব সকালে। বস্তির মাথার ওপর দিয়ে নীলচে ভোর দেখা যায় । কপালগুণে ওর কাজ যায়নি । শুধু বড়লোকের বাড়ি কাজ করলে হয় না। বড় মন থাকতে হয়। মাধবী, বেলা, অনিমা তো কম বড়লোকবাড়িতে কাজ করে না। কিন্তু যেই শুনলো রোগ ছোঁয়াচে, সরকার থেকে সব বাইরে বেরোনো নিষেধ, তখনি দুরদুর করে কাজ ছাড়িয়ে দিল। পুজোর আগে হারগিস এরা লোক নেবে না। বোনাস আর বেতনের টাকা বাঁচাবে। তারপর এরাও আবার দর বাড়াবে। কেউ কেউ তো বলছে লোক রাখবেই না আর। এভাবেই চালাবে। দিন যাক। দেখা যাবে কত ধানে কত চাল। শ্যামা বউদিকে মনে মনে পেন্নাম ঠোকে। মানুষটা ভালো। একটু ছুঁচিবাই বেশি। মেয়ের কাছে মুখঝামটাও খায়। তবে দেয় থোয় ভালো। কলের পাড় পিচ্ছিল। একটা ভাঙা থান ইঁট দিয়ে ঘষে শ্যামা । ছোট ছোট বালতি, কলসি উপচে পড়ে যায় । আগে বউদির বাড়ি থেকে ছেলেটার জন্য অ্যাকোয়া গার্ডের জল আনতো বড় জারে। এখন সব বন্ধ । কলসি উপচানো জল দেখতে দেখতে শ্যামা অন্যমনস্ক হয়ে যায় । ওর পুষ্যি আছে কয়েকটি । সাদা, কালো , ছাই রঙা বেড়াল মা ও ছা। তাদের একজন গুটি গুটি কাঁচা ড্রেন পার হয়ে ওর কাছে এসে বলে ম্যাও। শ্যামা বাজার ফেরত এদের জন্য চুণোমাছ আনতো। বেড়াল ও ষষ্ঠীর অমোঘ সংযোগ থাকাতে শাশুড়ি কিছু বলে না। এখনও নিজেদের যদি জোটে ওদেরও জুটবে এই মন নিয়ে চলছে। এখনো পর্যন্ত ঘাটতি হয়নি। তাই তার মুখের দিকে তাকিয়ে শ্যামা হাসে। চা খাবা? বিড়াল শিশু কাছে এসে পায়ে মাথা ঘষে । গরগর করে। বেশ পরিষ্কার আকাশ এখন। বিড়ালটির নাম রেখেছে মঞ্জু । তার নরম শরীরের ওমটুকু পায়ে মাখতে মাখতে শ্যামা দুপাশের খুপরিগুলির মধ্যে দিয়ে বহির্পানে চলে যাওয়া রাস্তা অভিমুখে চেয়ে থাকে। গলির মুখটা অন্ধকার । কি জানি ঐ অন্ধকার ফুঁড়ে লম্বা , সুঠাম চেহারার মানুষটা যদি কোনোদিন ফিরে আসে!আবার সকালবেলা ফ্যানাভাত রেঁধে কাজে বেরিয়ে যাবে শ্যামা! বাপ ছেলেতে জড়াজড়ি করে খাবে। না কি বলবে দূর হ। যে চুলোতে গেছিলি সেখানে যা ফিরলি কেন? কিল চড় মারবে বুকে পিঠে মাথায়? তারপর খুব কাঁদবে? কান্না আর পায় না শ্যামার। তবে সে অস্থিরতা টের পায়। মাথা টিপটিপ করে। মেজাজ তিরিক্ষি । চ্যাটচ্যাট শরীরে প্রবল বিবমিষার । বাড়ি থাক আর না থাক, প্রচুর খাটনি যায় তার। লকডাউনে মাস্ক তৈরি শুরু করেছে। সমস্ত বাসন নিজের হাতে মেজে ঝকঝকে। শাশুড়িকে তোয়াজ। ছেলেকে তোয়াজ। এরপর তার কামবোধ মরে যায় প্রায়ই । তবে এই ভোরবেলাতে জলবেষ্টিত হয়ে তার যুধিষ্ঠিরকে মনে পড়ে না। সুখনকেই মনে পড়ে। মুখে , ঘাড়ে , মাথায় জল ছিটিয়ে নিজের কামভাবকে প্রশমিত করার চেষ্টা করে শ্যামা। ছিঃ। ভোরবেলা এমন মনে কত্তে আছে! মঙ্গলচন্ডীর উপোস আজ। ছেলের জ্বর গেছে। শাশুড়িটা সেরে উঠুক বাবা। গলির মাথা থেকে একটা ছায়ামূর্তি বেরিয়ে এল। না। সুখনলাল নয়। বেলির বর। রতন। একটু বাদে বেলি। কলের দিকে আসছে। চোখের নিচে , গালে কালশিরে। লকডাউনে বরের টোটো বন্ধ । বাইরের মেয়েমানুষ বন্ধ । কাজেই বেলির সারা গায়ে কালশিরে। সেদিকে তাকিয়ে শিউরে ওঠে শ্যামা। ফাঁকা ঘরে ছেলে আর শাশুড়ি নিয়ে দিব্যি আছে সে।

    ✨তার ঘর বন্ধ

    টেলিভিশনে সমানে বলে চলেছে পঙ্গপালের দল ধেয়ে আসছে। সমস্ত শস্য খেয়ে যাবে তারা। সব ছারখার করে চলে যাবে। একটি আদিগন্ত বিস্তৃত শস্যক্ষেত্র করুণ মরুভূমিবৎ পড়ে থাকে। অলজ্জভাবে ধেয়ে আসে কারা। ওরাই কি পঙ্গপাল?না। বুঝি লক্ষ লক্ষ বাদুড় । ছোটো বড়। নানা আকৃতির । উড়ে আসছে প্রকান্ড বেগে পক্ষ বিস্তার করে। কুটিল মুখে প্রতিহিংসা । এই বুঝি ঘাড়ে এসে পড়বে। মুহূর্তে ফুটো করে নেবে গলায়। বা ঘাড়ে । তারপর রক্ত চুষে খাবে। শস্যের অথবা মানুষের। ভাইরাস ঢেলে দেবে শরীরে। কাউন্ট ড্রাকুলা হাসছেন শ্বদন্ত বিকশিত করে। হাজার হাজার বছরের রক্তধারা গড়িয়ে পড়ছে ঠোঁট বেয়ে গলাতে। গাছ কাটার শব্দে কান বধির। ভেঙে যাওয়া প্রাচীন গির্জা থেকে উঠে আসছে শবদেহ। পলিথিন মোড়া। অস্পৃশ্য। কেউ ছোঁবে না। কেউ ছোঁয়নি তাদের। ভালোবাসাহীন জীবনের ভালোবাসাহীন মৃত্যু । ভাইরাস এমনি নির্দয়। আর কেই বা নির্দয় নয়। যে যার মত সারভাইভাল স্ট্র্যাটেজি তৈরি করে যাচ্ছে। ইভলভ করছে। জেমস বন্ডের ছবির যন্ত্রদানব যেমন। রাস্তায় চললে গাড়ি। যেই সামনে জল দেখল গাড়ি নৌকা হয়ে গেল। জলে বিপদ দেখলে নৌকার পাখা গজায়। সে ডানা বিস্তার করে উড়তে থাকে। উড়তেই থাকে। যেমন এই বাদুড়মুখো পঙ্গপাল উড়ে আসছে দূরান্তর থেকে। ইমিউনিটি বাড়ানোর জন্য লেবুর জল পড়ে আছে গ্লাসে। সে তার হটপ্যান্ট পরিহিত পা দিয়ে গ্লাসটি সরিয়ে দেয় । গ্লাস পড়ে গিয়ে ভেঙে যেতে পারত । কিন্তু যায় না। এই ব্যালান্স আয়ত্ত্ব করতে পেরে সে হাসে। এখন সামান্য গলা ব্যথা করলেও টেনশন করে তার মা। গার্গলের জল রেখে যায় । সে ফেলে রাখে। জল ঠান্ডা হয়। ভারতবর্ষের কটাই বা লোক গার্গল করে। তারা কি সবাই মরে যাবে? সে জানে এভাবে ইমিউনিটি তৈরি হয়না। করোনা ইজ নট ফেটাল ইফ ইমিউনিটি ইজ স্ট্রংগ। অ্যান্ড টেস্টিং ইজ ইম্পরট্যান্ট। কাগজে লিখছে। টিভিতে বলছে। কাতারে কাতারে পরিযায়ী শ্রমিক ফিরছে নিজের প্রদেশে। তাদের পরীক্ষা কোথায় হবে কে জানে। সে পাশ ফিরে শোয়। বইয়ের আড়াল থেকে টিকটিকি তাকে দেখে। সেও দ্যাখে। অপলক। পঙ্গপাল ও বাদুড়ের দল আপাতত ফিরে যাচ্ছে অন্ধকারের দিকে। সে উঠে বসে ফস করে একটা সিগারেট ধরায় । ফান্ডে টাকা কমছে। এরপর কি করা যায় । ফোনে সমানে বলে যাচ্ছে ভয়ানক ঘূর্ণিঝড় আসছে। আসছেই।

    ✨স্পট ইন লাংগস

    পার্লস্পট মাছ খুব পছন্দ করেন অনিল। পলি গতকাল হঠাৎ কিছু পার্লস্পট মাছ পেয়ে গেছেন। হালকা করে একটা ফিশকারি বানিয়েছেন। সঙ্গে পুত্তু আর কদলীকারি। এই হল লাঞ্চ । ক্যাসারোলে ভরছেন পলি। হালকা হলুদ আর সাদা কম্বিনেশনের ক্যাসারোলের ওপর পলির গোলাপি নখপালিশ করা আঙুল। রাতে আপ্পম আর স্ট্যু বানাবেন ঠিক করে রেখেছেন। ছেলেমেয়েরাও খুব ভালবাসে। মাছের কারিটাকে কলাপাতাতে মুড়ে ক্যাসারোলের একপাশে রাখলেন পলি। তাঁদের নিজেদের বাগানে বেশ কয়েকটি কলাগাছ আছে। ফ্লাস্কে কফি। জাগে জল। একটা বাক্সে অ্যান্টাসিড রাখলেন। কাল অনিলের অ্যাসিডিটি হয়েছিল। সমস্তকিছু নিয়ে আউটহাউস থেকে কিছুটা তফাতে গার্ডেনশেডে রেখে এলেন পলি। অনিলকে ফোন করে জানিয়ে দিলেন লান্চ রাখা আছে। তাঁর খুব ইচ্ছে হয় খাবার সময় অন্তত অসুস্থ মানুষটির কাছে গিয়ে দাঁড়াতে। কিন্তু ডাক্তারের কড়া নিষেধ । একদম কন্ট্যাক্ট নয়। অনিল যেন যথাসম্ভব ফ্রি থাকেন। তাঁর জামাকাপড় তিনি নিজেই কাচাকুচি করে নিচ্ছেন। আউটহাউসের পিছনে দড়ি টাঙানো হয়েছে তাঁর জামাকাপড় শুকানোর জন্য। পলির মনে পড়ল কাল একটা সার্ফ এবং ডেটলের শিশিও এনে দিতে হবে অনিলকে। কিছু বিস্কিট। না। এসব কেনার জন্য পলিকে বাইরে যেতে হবে না আদৌ। চেলেঙ্গার ভলান্টিয়ার ছেলেরা ফোন করে জেনে নেয় কি রেশন প্রয়োজন। অথবা তাদের জানিয়ে দিতে হয়। বিকেলের মধ্যে জিনিষ চলে আসে।
    অনিল নিজের বাগানটির দিকে তাকিয়ে বসেছিলেন একটা ইজিচেয়ারে । বেশ কিছু মাভু ও পাভু মানে আম ও কাঁঠালের গাছ আছে তাঁর ঠাকুরদার আমলের। চাঁপা গাছ আছে। পলি শখ করে লাগিয়েছেন সীতাআপাজ্জম গাছ। কাস্টার্ড আপেল। ফুলগাছ আছে অনেক। ছোট একটি নকল পুল আম্বালা মানে ওয়াটার লিলি ফুটেছে। সবুজে ছয়লাপ চারিদিক। বিভিন্ন রকম সবুজ। ব্লেডের মত ফলার লম্বা কচি ঘাসের ওপর দিয়ে দৌড়ে যায় গিরগিটি। চোখ জুড়িয়ে যায় । অনিল সারা দুপুর বসে এই রহস্যময় পান্না সবুজ আকণ্ঠ পান করেন। এত সবুজ, এই মমতাময়ী স্ত্রী, ফুটফুটে ছেলেমেয়ে ফেলে মরে যাবার কথা ভাবতেই একটু শ্বাসকষ্ট শুরু হয় অনিলের। সামান্য । কিন্তু তিনি ভয় পাচ্ছেন। একটা রিপোর্ট আসার কথা আজকালের মধ্যেই। দেবরূপ , তাঁর বন্ধু পুত্র পুনে থেকে জানিয়েছে যে সে তার ডাক্তার বন্ধুদের সব রিপোর্ট দেখাবে। এই তরুণটির ওপর বড় ভরসা করেন অনিল। পলি স্ক্যান করে সমস্ত রিপোর্ট পাঠিয়েছে। ওদিকে ত্রিবান্দ্রাম হাসপাতাল থেকেও নিয়মিত খোঁজ রাখা হচ্ছে। পুল্লিচালিল নুহ্ নিজে দু তিনবার ফোন করেছেন। জ্বর আপাতত নেই বলে একটু আশ্বস্ত বটে অনিল কিন্তু কিছুটা শ্বাসকষ্ট আছে। আর সেটাতেই ভয়। অনিল টমাস অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছেন ফুসফুসে ফাইব্রোসিস হল কিনা জানার জন্য। অনিল অপলকে তাঁর প্রিয় কৃষ্নকিরীডম গাছের দিকে তাকিয়ে থাকলেন। তাঁর ছ বছরের কন্যা গাছটিকে খুব ভালবাসে। বলে, ও পাপা, দিস প্যাগোডা প্ল্যান্ট ইজ মাইন! কুঁড়ি এসেছে গাছে। ফুল ফোটা কি দেখতে পাবেন অনিল?

    ✨ইস রাতকা কোই সুবহা নহি

    সুখনলালদের দলটা দুভাগে ভাগ হয়ে গেছে.। এ এইচ ফর্টি সিক্স ন্যাশনাল হাইওয়ে দিয়ে টানা হাঁটা। এই দলের প্রায় আটশো লোক চলে গেছে দক্ষিণের দিকে। সুখনলালের কাজ ছিল নভি মুম্বাইতে । ওদের দলটা চলেছে কলকাতার দিকে। মুখে চোখে দীর্ঘদিনের স্বল্পাহার, অনাহার ও দীনতার কালি। খাদ্য শেষ। এমনো যায় যে দুদিন আহার্য জোটে না। পা টলে। মাথা ঘোরে জোয়ান পুরুষদেরও। মেয়েরা হাঁটে সদ্যোজাত সন্তান পুঁটলি করে নিয়ে, ঋতুস্রাবের যন্ত্রণা সহ্য করে ও খিদে পেতে পেতে অবশেষে মরে যাওয়া পেট নিয়ে । ঘামে পা ভিজে ন্যাতানো, ছেঁড়া শাড়ি আটকে যায় । গুলাবনগরের পর খানিকটা ট্রাকে আসতে পারলো পঞ্চাশজনের একটি দল। ঠেসাঠেসি করে রোদ ও ঘাম মেখে ট্রাকের পিছনে ভিড়। মুখের বাঁধন গলায়। কেউ কেউ মাস্ক নামক কাপড়ের ফালি ভিজিয়ে কপালে দিল। জলের অভাব খুব। এনজিও গুলি আছে বলে বেঁচে গেছে। শুকনো খাবার আর পলিথিন প্যাকেটে জল নিয়ে পেট্রল পাম্প বা ট্রাফিক সিগন্যালে থাকে ওরা। ট্রাকে শেষ উঠল সুখন। পিছনে পড়ে থাকল সদ্যোজাত মেয়ে কোলে মা, চার বছরের শিশুটি যার নাম গণেশ। যার আঙুল ধরে এতটা পথ হেঁটে এসেছে সুখন। অথবা সে হেঁটেছে সুখনের হাত ধরে। এদের সঙ্গে জীবনেও দেখা হবে না আর। ক্লিষ্ট বধূটি হাঁটতে হাঁটতে হাঁপিয়ে বসে আছে গাছতলায় । পুরুষটি হতক্লান্ত। অল্পবয়সী মেয়েটির হাত ধরে দাঁড়িয়ে ট্রাকটির নির্গমন দেখল গণেশ। যতদূর দেখা যায় । এই পৃথিবীতে কেউ কাউকে ঠিকঠাক চিনে ওঠার সুযোগ পায় না। ট্রাকের একেবারে শেষে বসেছে সুখন। হুহু করে ট্রাক ছুটছে ন্যাশনাল হাইওয়ে ধরে। পেটে যে খাবার নেই দুদিন, শুধু জল খেয়ে আছে, ভুলে গেছে যেন ওরা। তুমুল বাতাসে উড়ে যাচ্ছে উড়োখুড়ো চুল। অকালবার্ধক্য এসেছে মুখগুলিতে। তবু খানিক সোয়াস্তি। ক্ষতবিক্ষত পা এবার একটু বসতে সময় পেয়েছে। বাতাসের খর উত্তাপ বেশিক্ষণ আরামে থাকতে দেয় না। ক্লান্তি ও খিদে দুই মিলে পেটে মোচড় দেয়। বিশ পঁচিশ বছরের জোয়ান ছেলেটা বমি করতে থাকে। শুধু জল বেরিয়ে যায় । ওকে ট্রাকের কিনারাতে বসিয়ে দেয় কেউ। বোধহয় মা। এদের মধ্যে অনেকেই বমি করতে শুরু করেছে।

    দক্ষিণে সমুদ্রমুখী সূর্যালোকিত দুপ্লেতে একটা টি শার্ট ও বারমুডা পরে ঘর ঝাড়ু দেবার ছবি পোস্ট করলেন ক্যাটরিনা কাইফ। তাঁর গমের মত ত্বক থেকে ঝরে পড়ল মুক্তো। মাথার চুল চুড়ো করে বাঁধা। সামান্য স্যুপ ও সালাদ তাঁর খাদ্য। তৈরি আছে। এবার তিনি টুইট করলেন। মন ভালো নেই। কাজ বন্ধ হয়ে যাওয়ার ফলে আত্মহত্যা করেছে দুই তরুণী অভিনেত্রী। নাতাশা জৈন ও পালক মেহতা। দু' জনেই পিজি থাকত আন্ধেরিতে। সিরিয়াল অভিনেত্রী । কাজ বন্ধ হবার পরে প্রডিউসার একটি পয়সাও দেয়নি। ক্যাটরিনার সঙ্গে তারা একটি ছবিতে পাঁচ সেকেন্ডের একটি দৃশ্যে কাজ করেছিল। ক্যাটরিনার ঠিক মনে নেই। কিন্তু খবরটা খারাপ।

    ✨মালবিকা অনিমিখে

    সে ফোনে এই সব ছবি ফেবুতে স্ক্রোল করে যাচ্ছিল। নীল চা। বেগুনি চা। ডালগোণা কফি। সুরিতা। জয়ন্তী। মধুমিতা। চান্দ্রেয়ী। এবং আরো অনেকে। অপরিচিত বন্ধুসমুহ। সবাই বানায়। নিচে সাদা। ওপরে বাদামি । ঘন ফেনাদার কফি। মুখের ভিতরে পুরো টইটুম্বুর কফিস্বাদ। সে বানাবে বলেছিল। মেয়ে এক ধমক দিয়েছে। মম। দ্যাট ইজ এজ ওল্ড বিটন কফি। ডোন্ট বি অ্যাবসার্ড!
    সে সুরিতাকে লিখল, তোর বাড়ি আসছি কফি খেতে। ডালগোণা। পাঁচ মিনিট পর সুরিতা লিখল, কি করে আসবি? লকডাউন তো।
    উপুর হয়ে শুল। লিখল- কোনো কিছু হবে না। এই তো পাশের পাড়া। হেঁটে চলে যাব। কতজন তো বেরোচ্ছে।
    সুরিতার জবাব এল দুমিনিটে। আজ আসিস না। সকালে শ্বশুর মারা গেছে। আজ খুব ব্যস্ত।
    খুব একচোট হেসে নিল সে। অনেকদিন বাদে।
    তারপর নিঃশ্বাস ফেলে চিৎ হয়ে শুল। এ সংসারে কেউই কি বন্ধু নেই? কেউ? একজনও না?
    অনিল টমাস
    জুলাইয়ের শেষে শুধুমাত্র দিল্লিতে পাঁচ লাখ পঞ্চাশ হাজার কোভিড কেস হবে। উপ মুখ্যমন্ত্রী মণীশ শিশোদিয়া বললেন। তখন শুধুমাত্র দিল্লিতে প্রয়োজন হবে আশি হাজার বেড। জুনের পনের তারিখের মধ্যে শিশোদিয়া আশঙ্কা করছেন কোভিড রোগীর সংখ্যা দাঁড়াবে চুয়াল্লিশ হাজার। বেড লাগবে ছহাজার ছ'শো। জুনের মাঝামাঝি একলাখ এবং জুলাইয়ের মাঝামাঝি সেটা আড়াই লাখ হয়ে যাবে। ন্যাশনাল ডিজাস্টার ম্যানেজমেন্টের সঙ্গে আলোচনার পর শিশোদিয়া এই পরিসংখ্যান পেশ করেন।
    দুধে আলতা ওয়াটার লিলি এবং তার অনতিদূরে মেটেসিঁদূর রঙের কৃষ্ণকিরীডম এক চমৎকার কনট্রাস্ট তৈরি করেছে। এই নয়নমনোহর দৃশ্যও অনিলের মনকে উৎফুল্ল করতে পারছেন না। তিনি ফোনে শিশোদিয়ার প্রেসমিট পড়ছিলেন। প্রতিমুহূর্তে হতাশা বেড়ে চলেছে। এই যে অতীব সুস্বাদু পুত্তু তৈরি করে দিয়ে গেছেন পলি, এ তাঁর খুব প্রিয় খাদ্য। গতদুমাস ঘোরাঘুরির ফলে এ জাতীয় ঘরোয়া খাদ্য জোটেনি। এখন যখন পলি অতি যত্নে খাদ্য তৈরি করে দিয়ে গেছেন, তাও মুখে দিতে ইচ্ছে করছে না। হাঁপ ধরছে। তাঁর ছোটবেলায় পুত্তু তৈরি হত বাঁশের স্ট্যান্ডে। তার একটা অদ্ভূত সুঘ্রাণ হত। স্টিলের স্ট্যান্ডে সেই পোড়া বাঁশের অপূর্ব গন্ধ কোথায়! কদলাকারি অতি উপাদেয় হয়েছে। এই ছোলার সঙ্গে পলি ব্যবহার করেন ঘরে তৈরি মশলা। অনিল কোনো কিছুই খুব মন দিয়ে খেতে পারছিলেন না। কোনোমতে খেয়ে , ব্রাশ করে এক কাপ কফি নিয়ে বসলেন। যত নিউসফিড আসছে তত বেশি বিভ্রান্ত লাগছে। চাঁপাগাছে ফুল ফুটেছে। সন্ধেবেলা অপূর্ব মাদকতাময় গন্ধ ভেসে আসে। সেই গাছের নিচে দাঁড়ালেন অনিল। দোতলার প্রশস্ত বারান্দাতেই তাঁর পুত্র সাইকেল চালাচ্ছে। অনিলের আইসোলেশনের কারনে তাকে বাড়িতে আটকে রাখা হয়েছে। দুরন্ত বালকটির তাতে ঘোর আপত্তি। পলি তাই মেইন ডোরে তালা দিয়ে রেখেছেন। বাড়ির কাছে সহায়তা করে যে মেয়েটি তাকেও আসতে না করে দেওয়া হয়েছে। অনিল টমাস সতৃষ্ন দৃষ্টিতে ছেলের দিকে তাকিয়ে থাকলেন। কেউ যদি কারু দিকে অনেকক্ষণ গভীর মনোযোগ দিয়ে তাকিয়ে থাকে তবে যার দিকে তাকিয়ে থাকে , সে ঠিক একটা না একটা সময়ে টের পায়। রিংগো নামক বালকটি সাইকেল থেকে নেমে বাগানের দিকে তাকালো। এদিক ওদিক তাকানোর পর সে চাঁপা গাছের নিচে তার বাবাকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখল। আজকাল বাবা ছেলেতে এভাবেই দেখা হয়। রিংগো হাত নাড়িয়ে হাসল। অনিলের খুব কান্না পাচ্ছিল। মনে হচ্ছিল এখনি রিংগোকে বুকে চেপে তার চুলের সুঘ্রাণ নেন। বালকটি কেমন করে তার বাবার মন খারাপের কথা বুঝল কে জানে। সূর্যালোকের মত উষ্ন হাসিতে চারদিক আলোকিত করে সে চেঁচিয়ে উঠল। ডোন্ট ওরি পাপা। ইউ উইল গেট ওয়েল। লুক
    আই হ্যাভ ডান দিস ফর ইউ। তারপর দৌড়ে ঘরের ভেতর থেকে একটা ছবি নিয়ে এল। ছবিতে তার বাবা , মা, দিদি আর সে হাত ধরে গোল করে দাঁড়িয়ে । অনিল একটা জোরে শ্বাস ফেলে আউটহাউসের দিকে চলে গেলেন। পরবর্তী রিপোর্টটি না আসা পর্যন্ত কোনো মতেই শান্তি পাচ্ছেন না তিনি।

    ✨বধূ বেশ্যারা

    ট্রাক থেকে নেমে সুখনলালদের দলটি গেল একটি পেট্রল পাম্পের দিকে। বেশ কিছু অল্প বয়সী ছেলেমেয়ে এসেছে শুকনো খাবারের প্যাকেট ও জল নিয়ে । ট্রাকের পঞ্চাশজনের দলটি ইতস্তত ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে। পেট্রল পাম্পের টয়লেটের কাছে ভিড়। এই একটি ট্রাক নয়। বেশ কিছু ট্রাক এসে দাঁড়িয়েছে । প্যাকেটের মধ্যে পাঁউরুটি । গুড়। মুড়ি। অভুক্ত মানুষের কাছে এ অমৃত। খাদ্যবস্তু ছাড়া মাস্কও নিয়ে এসেছে এরা। নিজেরাও পরেছে। ফুটফুটে ছেলেমেয়ে সব। হাতে গ্লাভস। সুখনলাল নিজের বরাদ্দের প্যাকেটটি নিয়ে হাঁটতে হাঁটতে অনেকটা দূরে গিয়ে বসল। ট্রাকের মধ্যে গাদাগাদি করে এসেছে সবাই। রোদে পুড়ে কয়লা। পাম্পের অফিসের মধ্যে টিভি চ্যানেলে বলছে, সবাই দূরে দূরে থাকুন। এক মিটার দূরে থাকতে বলছে টিভিতে। মার্বেল মিস্ত্রি সুখনলাল দিব্যি জানে এই মিটার দূর কাকে বলে। ঘাম মুছে সুখন কালভার্টের ওপর গিয়ে বসল। এই জায়গাটি বেশ ফাঁকা । পাশে একটা বড় গাছ। বাতাস দিচ্ছে। সুখন পাঁউরুটি চিবোতে শুরু করল। পিছনে দিগন্ত বিস্তৃত গেহুর ক্ষেত । আরো পেছনে একটা গ্রাম আছে। সুখনলালের ছেলের বয়সী দুটো ছেলে ট্রাক থেকে নেমে ক্ষেতে চলে গেল।
    ড্রাইভাররা এদিক ওদিক হাত পা খেলাচ্ছে। ওরা ধাবাতে খাবে পয়সা ফেলে। পেটে দানাপানি পড়লে চোখে ঘুম আসে। তারপর সন্ধের বাতাস
    বেগুনপোড়া ত্বক ফুটিফাটা গালিচা মেলে দেয় হাওয়ায় স্রোতের নিচে। সুখনলালের কাঁধে কেউ হাত রাখে। কে? শ্যামা নাকি? সুখন হাতের ওপর হাত রাখে। কাঁচের চুড়িতে শব্দ হয় টুং টাং। সুখন তাকিয়ে দেখে খয়েরি সালোয়ার কামিজ। মাথায় জড়ানো দুপাট্টা। ক্লিষ্ট মুখ। বধূটি ইশারায় তাকে ডাকে। গ্রাম্যতা জড়ানো। অনভ্যস্ত ডাক। সুখন চোখ মেলে দেখে এ একা নয়। বেশ কিছু মেয়ে বসে আছে আড়ালে আবডালে। এদের লক্ষ্য ড্রাইভার বা ক্লীনার। পঞ্চাশ বা দু'শো। একবেলার চাল বা দুদিনের। কিছু তো পেটে দিতে হবে। পরিবারে আয় বন্ধ । কমিউনিটি কিচেন নেই এই এলাকায়। মেয়েটির চোখে উপবাসের ক্লান্তি । সুখন পকেট অনুভব করে। ফাঁকা।

    ✨তর চাকরি আসে?

    ছাতে জগিং করার সুবিধা এই যে বাড়ির বাইরে যেতে হয় না। ঝট করে ঘুম থেকে উঠে ছাতে চলে আসা যায় চায়ের কাপ নিয়ে । সকালে নিজের চা তিনি নিজেই বানান। দীর্ঘদিনের অভ্যেস। সামান্য চিনি দিয়ে পার্ফেক্ট একটা গোল্ডেন লিকিওর। দিনের শুরুয়াত। সাধারণত সেকেন্ড ফ্লাশ পছন্দ তাঁর। একটু কড়া। ঘুম ঘুম ভাবটা কেটে যায় । ছাতে অনেক গাছ। বুগনভোলিয়া তিন চার রকমের। তিন চার রঙের । গাঁদা। হলুদ এবং কমলা। বারোমাস ফুল দেয়। ছাতে মাটি ফেলে গাছ করেছেন গৃহিণী তিনি শান্তিনিকেতনের ছাত্রী। এত ইঁট কাঠের জংগলে তাঁর হাঁপ ধরে। তাই ছাতটিকে আঁকড়ে ধরেছেন। কারন বাকি যে দুজন আঁকড়ে ধরার মত ছিল তারা এখন নাগালের বাইরে। ছেলে পুণেতে। মাইক্রোবায়োলজিস্ট। মেয়ে খড়গপুর। আইআইটি।
    তিনি সফল এক্সিকিউটিভ । কলকাতা শহরে একটি পূর্ণাঙ্গ দোতলা, সুচরিতা স্ত্রী এবং বলার মত রেজাল্ট ইত্যাদি করা ছেলেমেয়েকে যদি সফল বলা যায়, তিনি সফল। এবং সেইজন্য যখন ছাতে আসেন , স্পোর্টস শু বগলে ও হাতে চায়ের কাপ। ছাতের ডান পাশে সারিবদ্ধ লাল ছিটছিট সবুজ কচিপাতা তাঁকে অক্সিজেন দেয়। বুক ভরে দম নিয়ে তিনি ওয়র্ক আউট শুরু করেন। এক । দুই। তিন। স্ত্রী ঘুমাচ্ছেন। ইদানীং তাঁর রাতে ঘুম আসে না। প্রচুর টেনশন। স্বামীকে নিয়ে । ছেলেকে নিয়ে । মেয়েকে নিয়ে । মেয়ে খড়গপুর থেকে ফিরে বেশির ভাগ সময় নিজের ঘরে লক্ড আপ। স্বেচ্ছা নির্বাসনে থাকে। মায়ের সঙ্গে বনে না। তাঁর সঙ্গে কথা বলার সময় নেই। শী ইজ যাস্ট লাইক পিকু। ফিনান্সিয়ালি ইনডিপেন্ডেন্ট। স্কলারশিপে ভালো অ্যামাউন্ট পায়। যদিও তার অনেকটাই বিড়ি ফুঁকে শেষ করে বলে তাঁর ধারণা। সোশ্যালি ইনডিপেন্ডেন্ট। সেক্সুয়ালি ইনডিপেন্ডেন্ট। তাঁর স্ত্রী এতটা সহ্য করতে পারেন না। এই যে উঠবেন, উঠেই একটা পরিপাটি করে স্নান। পদ্মগন্ধ টন্ধ ছড়িয়ে বেরোবেন। হেল্পার নেই। তাই ঘরটা পরে মুছবেন। রসিয়ে রসিয়ে রান্না করবেন চা খেতে খেতে। ইউটিউব দেখে নতুন রান্না। ডাস্টিং। স্কুলের কাজ ল্যাপটপে। গুছিয়ে কাজ। মেয়ে মূর্তিমতী তালভঙ্গ।
    তিনি কিছুই বলেন না। চা একটু বেশি কড়া হয়ে গেছে আজকে। দশ বছর আগেও দুধ চিনি চা খেতেন গ্লাসে। কড়া। সিটিসি। পদোন্নতি হয়েছে চা দিয়ে বোঝা যায় । জুতোর ব্র্যান্ড দিয়ে বোঝা যায় । এখন তিন ঘরে তিনটি এসি বসেছে। সব তাঁর পদোন্নতির চিহ্ন। জগিং টাও। আগে ঘুম থেকে উঠে দুধ আনতে যেতেন। এখন প্যাকেটে দুধ আসে। সিনেমার মত কাঁচের জারে দুধ ও কমলালেবুর রস রাখা থাকে। জগিং থামিয়ে ছাত থেকে ঝুঁকে পড়লেন। বেডরুমে এসি চলছে গোঁগোঁ শব্দ করে। জল পড়ছে টুপটাপ। মালবিকা ঘুমুচ্ছেন। সাদা রাত্রিবাস। সাদা ফুলতোলা বিছানার চাদর। এখানে কোভিড নেই। তবু ভয় আছে। তাঁর এই ভোরবেলা কারু সঙ্গে খুব কথা বলতে ইচ্ছে করে। কাকে বলবেন? বউ , মেয়ে ঘুম। ছেলে পুণেতে। সেও লেট রাইজার। ঠাকমা বেঁচে থাকতে তাঁর সঙ্গে কথা হত। এখন কারু সঙ্গে কথা বলতে না পারলে তাঁর খুব হাঁপ ধরবে। স্যানিটাইজার বেরোয় পকেট থেকে। হাত মুছে রিনাকে ফোন করেন। তাঁর ক্লাসমেট। ফেবুতে খুঁজে পেয়েছেন। রিনাকে নিয়ে মালবিকার একটা খোঁচা আছে। তিনি রিনাকে ফোন করলেন। সেও সকালে ওঠে। শরীরচর্চা করে। রিনা ডিভোর্সি। ছেলেকে নিয়ে থাকে। তাঁর বলতে ইচ্ছে করছিল অনেক কথা। কিন্তু রিনা ফোন ধরল না। হয়ত ব্যস্ত।
    আরেক বন্ধু অনিল টমাসের কোভিড পজিটিভ এসেছে। খবরটা শোনা অবধি বাড়তি টেনশন। অফিসে স্যালারি কাট হবে টোয়েন্টি পার্সেন্ট। দুটো বড় প্রিমিয়াম দিতে হবে সামনের মাসে। দুটো এনজিও কে টাকা পাঠাবেন । খুব কম দেওয়া যাবে না। ইলেকট্রিক বিল আসবে ভারি অংকের। দুটো এসি টানা কম কথা না।
    আগে কি এত গরম ছিল?তাঁর আটান্ন চলছে। বয়সে বোধহয় সহ্যশক্তি কমে। তাঁর জীবনের প্রথম চল্লিশ বছর এসি ছাড়াই কেটেছে। খালি গায়ে ঘুমাতেন। পাশে গামছা রাখা থাকতো। এখন তোয়ালে। অসমীয়া গামোসা। হাসনাবাদের শৌখিন গামছা। সব থরে থরে। তাও ঘামেন। এসিতেও।
    - এত ঘামস ক্যান বাপধন?
    মাধবীলতার ঝাড়টা বিশাল। তার ওপাশে কে দাঁড়িয়ে? সাদা থান। ও কি? তুমি কখন এলে?
    - আইসি অনেকক্ষণ । দাঁড়াইয়া দ্যাখাতাসিলাম তর কান্ড। সক্কালবেলা লাফাইস ক্যান?
    - জগিং ঠাকমা। লাফানো না।
    - ঐ হইল। ঘামছিস কত দ্যাখ দেহি। মুখটা মুইছ্যা ফ্যাল।
    - জানো ঠাকমা। ভাগ্যিস তুমি এলে। খুব কথা বলতে ইচ্ছে করছিল। না হলে দম ফেটে মরেই যেতাম গো।
    - বালাই ষাট। মরবি ক্যান ?
    - পৃথিবীতে কাতারে কাতারে লোক মরে যাচ্ছে ঠাকমা ।
    - ক্যান গো বাপধন? গোপাল আমার।
    কতদিন বাদে এমন ডাক শুনলেন। শরীর জুড়িয়ে গেল। ঠাকমার গায়ে আতপচালের মিষ্টি গন্ধ। হাতে কাঁচা ছানা। সাদা আঁচলে কপ্পুর আর এলাচ।
    - পৃথিবীর খুব অসুখ গো ঠাকমা। ভাগ্যিস তুমি বেঁচে নেই। মা বাবা বেঁচে নেই। তোমরা বেঁচে থাকলে টেনশনে পড়ে যেতাম গো।
    - কিসের টেনশন?
    - ভাইরাস গো। তুমি বুঝবে না। চোখে দেখা যায় না। সেই মারণ ভাইরাস হাজার হাজার লোককে মেরে ফেলছে। পৃথিবী খালি হয়ে গেল ঠাকমা।
    - রোগ ব্যাধি কবে না আসে? তর ঠাকুর্দা সন্ন্যাস রোগে মরে নাই? আমি নিউমনিয়াতে মরি নাই? দ্যাশে তখন কতজন নিউমনিয়াতে মরসিল। শ্যাষে য্যান কি হইসিল আমার? কি কয়?
    - সেপ্টেমেসিয়া ঠাকমা। রোগ ছড়িয়ে পড়েছিল।
    - এহন তো বলিস তাই হইত্যাসে।
    - কিন্তু একসঙ্গে অনেক লোক যে। একে বলে অতিমারী।
    - মহামারী শুনছি বাপধন। ইয়া তো শুনি নাই।
    - ইওরোপ আমেরিকা খালি হয়ে গেল ঠাকমা।
    - তগো খালি আমেরিকা। দ্যাশে কজন মরসে?
    - মরবে। মরবে।
    - দূর। হ্যা তো এমনিতেই মরবে। না খাইয়া কতজন মরে হিসাব আসে?
    - কোটি কোটি লোকের চাকরি চলে যাচ্ছে জানো।
    - তর চাকরি আসে তো?
    - এখনো আছে। তিনি হাসেন। ঠাকমা মুখ মোছেন আঁচলে।
    - কী গরম!
    - তোমাকে এসির হাওয়া খাওয়াতে পারিনি ঠাকমা।
    - খুব ঠান্ডা?
    -খুব।
    - তয় থাক। এমনিতেই নিউমনিয়াতে মরসি। তুই কি বড়লোক ?
    - বলতে পারো। উচ্চ মধ্যবিত্ত।
    - অত শক্ত কথা বুঝি না। ঠাকমা অবিকল অপরাজিত ছবির শর্মিলা হয়ে গেলেন। কিশোরীর মত।
    - এত কিসু ক্যান লাগে?
    - লাগে ঠাকমা।
    - গ্রামের বাড়ি ঠিক করতে পারস না? ঐহানে গরম নাই।
    - আর চাকরি?
    - চাকরি কর আর হাঁপা।
    - আমার বন্ধু জানো গ্রামে বাড়ি করেছে।
    - ক্যাডা?
    - মণিময়। চিনতে পারলে?
    - নাহ্। দাঁত উঁচু ছ্যামড়াডা?
    - না গো। মণিময় রোদে পোড়া ইঁট আর বাঁশ , খড় চূণ, বালি , মাটি দিয়ে বাড়ি বানিয়েছে। দিব্য ঠান্ডা। বৃষ্টির জল আর শিশিরের জল ধরে রাখে চাষবাসের জন্য। সৌরশক্তি ব্যবহার করে।
    - সেডা কি?
    - সূর্য রশ্মি ঠাকমা। তা দিয়ে ইলেকট্রিসিটি তৈরি হয়। মণিময় ওর বাড়িতে ঐ দিয়ে বাতি জ্বালায়।
    মণির টেনশন নেই ঠাকমা। ও তো কোন ইনডাসট্রিয়াল প্রডাক্টের ধার ধারে না।
    - অত শক্ত কথা বুঝি না। ঠাকমা আবার শর্মিলা হয়ে গেলেন।
    - পোলাডারে ফোন কর। বেটি তো দশটা অবধি ঘুমায়। হ্যাপ প্যান্ট পইরা থাকে। তবে মেয়েডা ভালো। দয়ামায়া আসে।
    - থামোতো। একটু খোকা হয়ে থাকতে দাও তোমার কাছে।
    ঠাকমা ফিকফিক করে হাসতে হাসতে মাধবী লতার ঝাড়ে মিলিয়ে যান। আজ আর শরীরচর্চা হবে না। মন অনিলের জন্য বড় ব্যস্ত হয়ে আছে। দেখা যাক ছেলে যদি ফোনটা ধরে।

    ✨পুনেতে একা ও অদিতি

    পুনে শহর এমনিতেই ঝকঝকে । লকডাউনে একেবারে লেপাপোঁছা হয়ে গেছে। নিঃশ্বাস নিতে আরাম। দেবরূপ জেগে ছিল। সারারাত ঘুম হয়নি । প্রজেক্টের কাজ । খবর শুনছিল । কলকাতার ইস্টার্ন বাইপাসে বেজি দেখা গেছে। হরিদ্বারের রাস্তায় বেরিয়ে এসেছে হরিণ। ভেনিসে গন্ডোলা বন্ধ। ডলফিন নাচছে। কলকাতার রাতের আকাশে আকাশগঙ্গা দেখা যাচ্ছে। খুব ছোটবেলাতে গ্রামের বাড়ি গেলে বাবা তাকে আকাশগঙ্গা দেখাত। সে কফিমেকারে জল ও কফি চাপাল। দাড়ি বেড়েছে অনেকটা। অদিতি বলে ; ইউ লুক লাইক আ সেইন্ট। নাহ্। সে আদৌ সেইন্টলি না। বিশ্বাসও করে না। সে জানে লকডাউন উঠে গেলে দূষণ দ্বিগুণ তিনুগুণ হয়ে ফিরবে । মে ডে'র দিন ঘোষণা হয়েছে শ্রমিকদের দশঘন্টা কাজ। কী প্রহসন! সাসটেইনেবল ডেভেলপমেন্টের নামে সব শেষ হয়ে যাচ্ছে। আবার মানুষ এইসব প্রাণীদের মেরে তাড়াবে। ওরা সরল বিশ্বাসে এগোলে লাঠি মারবে মাথাতে। মাটি খুঁড়ে জল বের করবে। মল বানাবে। মাটির তলা দিয়ে ট্রেন যাবে। দূষণ ফিরবে। আবার। আরো বড় আকারে। ওর দমবন্ধ হয়ে আসছিল । অ্যাটলিস্ট অনিল টমাস শুড সারভাইভ।
    রাত জাগলে সকালে একটা স্নান খুব জরুরি। কফি খেয়ে সোজা শাওয়ারের তলায় দাঁড়ালো। কম্পিউটার । ল্যাপটপ । ফোন। বই। জার্নাল। চোখের গতিবিধি যদি এর মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকে তাহলে একসময় গা গোলায়। মাথা দপ দপ করে। চোখের নার্ভ কেউ টেনে ধরে ভেতরে। প্রতিটি জলকণা শুষে নিচ্ছিল সে। মস্তিষ্ক ও শরীরের কোষে কোষে ছড়িয়ে পড়ছে জল। শীতল প্রবাহ নেমে যাচ্ছে শরীরে। এরকম সময় বারিধারাকে মাতৃজ্ঞান হয়। অভ্যস্ত রাতজাগাও এইসময়ে চরম বিভ্রান্তির। যেহেতু আপাতত কেউ দেখছে না তাকে, বাথরুমের দরজা খুলে রেখেছে খবর শোনার জন্য। সংবাদপাঠিকা বলছেন,রাজস্থান থেকে বিহার, ঝাড়খন্ড, বাংলায় যেসব শ্রমিকরা ফিরছিলেন , এতোয়ার কাছে মিহাউলিতে একটি ডিসিএমের সঙ্গে ট্রাকের সংঘর্ষে তাঁদের মধ্যে পঁচিশজন মৃত এবং তেত্রিশজন আহত। সতেরোজনের অবস্থা আশংকাজনক।
    সংবাদপাঠিকার মুখে একটি নির্লিপ্ত পেশাদার বিষন্নতা। ম্যাট লিপস্টিক । চোখে স্মোকি আই মেকাপ। টিভি একেবারে বাথরুমের দরজার মুখোমুখি । সে সংবাদপাঠিকার দিকে পিছন ফিরে সাবানের ফেনা তুলতে লাগল। প্রক্খালন প্রক্রিয়া দীর্ঘতর করতে করতে সেখানেই ঘুম পেল তার। লকডাউনে কার্বন ফুটপ্রিন্ট কমছে। পৃথিবীর প্রকৃতির মালিন্য নাকি এখন অনেক কম। ওজোন স্তরের গর্তগুলি রিপেয়ার্ড হয়ে গেছে। এই সবই পৃথিবীর পক্ষে শুভ সংবাদ যেমন যমুনার জল পুনরায় নীল, স্বচ্ছ টেমস, রাস্তায় নেমে আসা হাতীর মতন রাজকীয় । কিন্তু এইসব দূষনবিহীনতা অতিশয় ক্ষণস্থায়ী, দুর্বল পুঁজির প্রবল ক্ষমতার কাজে। অতএব আনন্দিত হবার কিছু নেই গোছের মুখ করে সে মাথা নাড়ায় । মাথা মুছে টোস্টারে পাঁউরুটি চাপায়। মাখন মাখায় দ্রুত হাতে। ঠিক সেই সময় ফোন বেজে ওঠে। বাবা। মাথার ভেতর মধ্যবিত্ত স্নায়ুতন্ত্র দ্রুত কাজ করে। বিছানার দিকে তাকিয়ে ও ব্যালকনিতে চলে যায় মাখন লাগানো ছেড়ে ।
    অদিতি পাশ ফিরে ঘুমাচ্ছে। ওর মুখে এক অদ্ভুত শিশুসুলভ সারল্য। পর্দা সরানোতে সকালের হালকা রোদ ওর পায়ের বাদামি গোছের ওপর। গায়ে হলুদ টি। সূতির প্যান্ট। উপুর হয়ে ঘুমাচ্ছে। অদিতির ঘুমন্ত মুখের দিকে একবার তাকিয়ে ও ফোন ধরল। হ্যাঁ বাবা।
    অদিতি পুণে ফিল্ম ইনস্টিটিউটে পড়ে। ডকুমেন্টারি বানায়। প্রেস কার্ড জোগাড় করে রেখেছে। গতরাতে অদিতি জয়েন করে ওদের স্ট্রে ফিডে। তারপর আর বাড়িতে ফেরেনি। স্ট্রেইট এখানে এসেছে। ওর বাড়িতে বোনকে বলে এসেছে প্রেসের কাজ। বাবা আটকে আছেন ব্যাংগালোরে। মা কলকাতা। লকডাউনে দুজনেই আটকা।
    তুই সোশ্যাল ডিস্ট্যান্সিং ভায়োলেট করছিস।
    অদিতি ঠোঁট উলটে ভেংচে দিল।
    স্টপ ইওর বুলশিট। গিভ মি আ টি। মাইন ইজ ডার্টি। সত্যি খুব শ্যাবি ওর শার্ট।
    আই হ্যাভ ওয়াশড মাই হ্যান্ডস। উইল বেদ নাউ। গার্গল। তোর চে বেশি ক্লিন।
    সকালে ডাকিস না। হ্যাভিং লেট নাইটস ফর ডেজ।
    অদিতির গায়ে ওর হলুদ টি। অদিতি শিবরামণ। ফিল্মমেকার । সুশ্রী। বাদামি রঙ। কোঁকড়া চুল। অলওয়েজ ইন শার্টস অ্যান্ড ট্রাউজারস।
    এর কথা দেবরূপ বাড়িতে বলতেই পারে। খুব সহজেই বলা যায় যে হি ইজ ইন লাভ উইদ দিস গার্ল। অ্যান্ড লিভিং পার্টনার্স ওকেশনালি। পেরেন্টস উইল বি প্লিজড। কিন্তু বলা হয়নি। বলা হয়নি কারণ অদিতি এখানে ঘুমিয়ে আছে। অদিতি শিবরামণ। ডটার অব ত্রিলোকেশ শিবরামণ অ্যান্ড মুমতাজ আহমেদ।
    -ইভন ইন টাইমস অব ক্রাইসিস ইউ ক্যাননট ফরগেট দ্যাট আ হিন্দু ইজ আ হিন্দু অ্যান্ড আ মুসলিম ইজ আ মুসলিম।
    - ওয়াটস দ্যাট টু ডু উইদ ক্রাইসিস?
    - তুই বলতে পারিস না বাড়িতে। কজ মাই মম ইজ মুসলিম অ্যান্ড শি ডিডন্ট চেঞ্জ হার রিলিজিয়ন অর মেইডেন নেইম।
    - মাই পেরেন্টস আর নট দ্যাট লিবেরাল। তোকে বলেছি তো।
    - ওহ। অ্যান্ড ইফ মাই মম রিজেক্টস ইউ ফর বিংগ আ হিন্দু?
    - শি হারসেল্ফ ম্যারেড ওয়ান।
    - নাউ হু টেকস আপারহ্যান্ড?
    - আপারহ্যান্ডের কথা আসছে কেন?
    - আসে। মেজরিটি মাইনরিটি যেমন আসে । মনে হচ্ছে আমাকে অ্যালাউ করে ইওর মম উইল ডু মার্সি অন মি। আই অ্যাম নট অ্যাট হার মার্সি। ইওর কালচার্ড মম।
    - সার্টেইনলি নট। এখন খা।
    কাল রাতে ভাতেভাত আলুসেদ্ধ ডিমসেদ্ধ খেয়েছিল ওরা। উইথ ঘি।
    - ঢুকলি যখন ওয়াচম্যান কিছু বলল?
    - নোহ। হি নোজ মি। তুই তো ছিলি পেছনেই। ডু ইউ রিয়েলি কেয়ার।
    অদিতির গাঢ় হেজেলনাট চোখে চোখ রেখে ও বলেছিল নো। অ্যান্ড দে ডিডন্ট কেয়ার। অন্তত কিছু সময়ের জন্য। বৃষ্টি নেমেছিল গাঢ় হয়ে সেই বৃষ্টির রঙ রামধনুর মত। ইনস্পাইট অব লকডাউন।
    কিন্তু এই সকালে বাবার ফোনটা । অস্বস্তি ঝেড়ে ফেলে শিকনির মত।
    - এত সকালে?
    - অনিলের সঙ্গে কথা বলেছিস? কি বলছে ? ফার্দার টেস্ট?
    - তুমি বলোনি কথা? বাবা?
    - খারাপ লাগছে। তুই কথা বল না।
    ও জানে। বাবা খানিকটা এস্কেপিস্ট। ভীতু।
    - ফোনের মধ্যে দিয়ে কোভিড ইনফেকশন হবে না বাবা। ইউ ক্যান স্পিক। আর রিপোর্টে ফাইব্রোসিস নেই। কিন্তু লাংগ্সে স্পট আছে। সেটার জন্য অন্য ইনভেস্টিগেশন করতে হবে।
    - অন্য ইনভেস্টিগেশন মানে?
    - মানে ইউ নো। মা ওঠেনি?
    অদিতি বিছানায় উঠে বসল। আড়মোড়া ভাঙছে। ওর কোঁকড়ানো চুল আছড়ে পরছে সুগঠিত পিঠে। এখন ও যদি জোরে কথা বলে মুশকিল আছে।
    - রাখছি বাবা। উইল কল ইউ লেটার।
    সঙ্গে সঙ্গে অদিতি বলে উঠল- টিভি এত জোরে চালিয়ে রেখেছিস কেন এত সকালে? ইউ স্পয়েল্ড মাই স্লিপ ম্যান।
    ভাগ্যিস কথা শেষ করেই ফোন কেটে দিয়েছিল।
    -ওয়াট ইজ ফর ব্রেকফাস্ট? অদিতি চেঁচাল।
    - বাসি মুখেই খাবি নাকি?
    - তুই মায়ের মত কথা বলিস। গাড়ল।
    নিউজ রিডার চলে গেছেন। লোকাল খবর। চ্যানেল পাল্টালো। নিউজ ফিড।
    এরশাদ হোসেন। বয়স তিরিশ। ওয়াদালা ন্যাশনাল মার্কেট থেকে শেওরি বাস স্ট্যান্ড পর্যন্ত তিনঘন্টা হেঁটে এসে চার ঘন্টা লাইন দিয়ে দাঁড়িয়ে থেকেছে। এগারোই এপ্রিল। রেশন ফুরিয়ে গেছে বলে চাল ও ডাল দেওয়া হয়নি। পরদিন আবার হাঁটা। আবার লাইন। আরো আগে। এবার অনেক চেষ্টার পর রেশন। ভিড়ের মধ্যে চিৎকার উঠেছে। ওরা বাংলাদেশী। লাইনে বলেছে, এই রেশন তোদের জন্য না। সেই একদিন রেশন। সেই প্রথম। সেই শেষ।
    আবদুল শেখ ও সঙ্গে তিরিশজন। সুরাটে কাপড় কারখানার কর্মী। দৈনিক বারো থেকে চোদ্দ ঘন্টা কাজ। সেলাই। কাটিং। কাঁচ। এম্ব্রয়ডারি। দৈনিক আয় আড়াইশো থেকে তিনশো। লকডাউনের পর মালিকপক্ষ এক সপ্তাহ একবেলা খাবার দিয়েছে। ডালচাওল। তারপর বলেছে আপনা দেখো। যেখানে রেশন নিতে গেছে শুনেছে ইয়ে হিন্দুয়ো কে রেশন হ্যায়। এদেশে মুসলমান হয়ে জন্মাবার চেয়ে গরীব হওয়া ভালো। আবদুল ও এরশাদের লকডাউন উপলব্ধি । এটা প্রাইভেট চ্যানেল। মেয়েটির হাতে লালসুতো বাঁধা। ও বলছে লোকাল এম এল এ কি কি বলেছেন। ভল্যুম কমালো।
    পুনেতে বৃষ্টি হচ্ছে আজ। এমনি সবুজ এদিকটা। আজকে সবুজ যেন উপচে পড়ছে।
    অদিতি বলল। রং। বিইংগ মুসলিম অ্যান্ড পুওর ইজ ডেঞ্জারাস। পিপল উইল কল ইউ বাংলাদেশি।
    - চা খাবি আর?
    অদিতি শিবরামণ ,বর্ণ অ্যান্ড ব্রট আপ ইন পুনে। চুলটা টাইট করে বাঁধল ব্যাকক্লিপে। গলায় একটা সোনার চেইন। আর কোনো আভরণ নেই।
    - ইউ আর মিসিং মাই পয়েন্ট। শোন । আমার মা কিন্তু কলকাতায়। শি ওয়ান্টেড টু গো টু মুর্শিদাবাদ । হার বার্থপ্লেস। মা' কে কি ওখানে বাংলাদেশি বলবে?

    ✨শ্যামা ও কলপাড়

    কলপাড়ে এখন ভালো জটলা হয়। কাজের বাড়িতে দৌড়োনার কোনো তাড়া নেই। এমনি ভোর পাঁচটায় বেরিয়ে দুপুর দেড়টা দুটোতে ঢোকে সব। এসে সংসারের ঝাড়াঝাড়ি করতে করতে রান্না বসায়। নদীতে যায় কাপড় কাচতে, স্নান করতে। ভাত খেতে খেতে বেলা গড়িয়ে সাড়ে চারটে পাঁচটা। এই পাড়ার এটাই গড় রুটিন। পুরুষরা একটু বেলা করে বাইরে যায়। মেয়ে বউরা ঐ ভোরেই ফ্যানাভাত বা রুটি তরকারি করে রেখে যায় বর আর ছেলেপুলের জন্য । ঘরে যদি বড় মেয়ে থাকে তবে মায়েদের একটু সুবিধে। হাতে হাতে জোগাড় দেয়। চাইকি একটা সবজি করে রাখে দুপুরেই। বা একটা ভাজা। লকডাউন শুরু হয়েছে পর থেকে সব পাল্টে গেছে। শ্যামা অভ্যেস ছাড়েনি। সকালেই ওঠে। ছেলেকে টেনে তোলে। পড়তে বসায়। জ্বর সেরে উঠে কাহিল ছেলেটা। এখন আর তেমন ডাকাডাকি করছে না শ্যামা। এমনিতে কাজের আছে ছেলে তার। ভাত, মাছের ঝোল নামিয়ে নিতে পারে দরকার হলে। নিজের জামাপ্যান্ট নিজে কাচে। বাপ গেছে পর থেকে একটু শান্ত হয়ে আছে। সামনে ইশকুল মাঠে বলপেটানো বন্ধ । শ্যামার ফোন নিয়ে ঘুটুরঘুটুর করে সারাদিন। তারচেয়ে থাক। ঘুমোচ্ছে বেলা করে ঘুমাক। ভেবে কাজ সারে শ্যামা। লকডাউনে ঘরটা তকতকে করে পরিষ্কার করে ফেলেছে। তক্তপোষের পায়ার ইঁট পাল্টেছে। পুরোনো দু চারটে পিতলের হাড়িকলসী মেজেছে ঝকঝকে করে। টিনের ট্রাঙ্ক আছে তিনখানা ঘরের এককোণে। একটা শাশুড়ির। তাতে লেপকাঁথা তোলা থাকে। দ্বিতীয়টা শ্যামার। বিয়েতে বাপ দিয়েছিল। শ্যামার শাড়ি, গলার একটা চেন। নাক কানের ফুল। এইসব থাকে। আরেকটা সুখনলালের। তার পোশাকি খানকয়েক জামাপ্যান্ট । শীতের পোশাক বলতে সোয়েটার। চাদর। সব ঝেড়েপুছে রোদে দিয়েছে শ্যামা। তারপর পুরোনো শাড়ি কেটে ট্রাংকের ঢাকনা বানিয়েছে। পাড় দিয়ে কুঁচি হয়েছে। দুটো বাড়ি পরে রিনিবৌদির বাড়িতে সেলাই মেশিন আছে। বিকেলবিকেল গিয়ে সেলাই করে এনেছে। ওয়ার্ডের ছেলেরা রোজ বলে যাচ্ছে বটে। কেউ বাইরে যাবেন না। কারু বাড়িতে যাওয়া চলবে না। পুলিশ এসে এক চক্কর মেরে যাচ্ছে। তারপর নিশ্চিন্তি। বেলির বর রাতভর ওকে পিটেছে। তাই নিয়ে একটা সভা । মাধুরীর বরও পেটাচ্ছে। কেউ বাইরে বেরোতে পাচ্ছে না। পছন্দের মেয়ে মানুষের কাছে যেতে পাচ্ছে না। পেটাবে না তো করবে কি। তা সনকাবউদি দেখিয়েছে বটে। যেই বর একঘা মেরেছে, সনকা দুঘা দিয়ে দিয়েছে। বর খানিক তড়পিয়ে থেমে গেছে। স্বামীর গায়ে হাত তোলার অনৈতিকতা নিয়ে শ্যামার শাশুড়ি খানিক বিড়বিড় করেছিল বটে কিন্তু সম্মিলিত প্রতিবাদে চুপ করে গেছে। মোটামুটি সবাই এই সিদ্ধান্তে এসেছে যে বেলির উচিত উল্টে মার দেওয়া । ফিনফিনে রোগা । প্রায় জিরো ফিগারের বেলি। মাথার ঘাম পায়ে ফেলে করিনা কাপুর এত রোগা হতে পারেনি। বেলির সাতচড়ে রা নেই। তিনটে ছানা পরপর। কাজের বাড়িতে বেতন দেয়নি। লকডাউন কাটলে দেখা করতে বলেছে আর বেশি সুড়সুড় করে চলে এসেছে। শুনেই টেনে চড়। কিল। ঘুষি। বেলির দ্বারা বর পেটানো হবে না।
    কলতলার সালিশি সভা শেষ হলে শ্যামা টিভি খোলে। খবর শোনে। মুম্বাই থেকে সব লেবাররা ঘরে ফিরছে। চাপা উদ্বেগ নিয়ে তাকিয়ে থাকে। টিভিতে দেখাচ্ছে কাতারে কাতারে লোক হেঁটে ফিরছে। ওই ভিড়ে তার লোকটাও আছে কিনা কে জানে। সাউন্ড দেয় না। শাশুড়ি খুঁচিয়ে মারবে। সুখন ফোন করল কিনা। কোথায় ঘুরে মরছে। শ্যামার মত বউ থাকলে পুরুষমানুষ আর কিই বা করতে পারে। জ্বরে নেতিয়ে পড়ে আছে বুড়ি। সকালে চা মুড়ি দিয়েছিল। ওমনি পড়ে আছে। ছ্যাঁৎ করে ওঠে। শ্যামা হাত দিয়ে শাড়ি পাট করতে করতে ভাবে, বুড়ি যদি মরে যায় । নেই নেই করে মাথার ওপর একটা বুড়োমানুষ থাকার বড় সুবিধে। সাত ভূতে জ্বালাতে আসার আগে দশবার ভাবে। সুখন নেই। ছেলে ছোট। ঘামতে থাকে শ্যামা। শাড়িটা ডান হাতে তোষক তুলে সাট করে ঠেলে দেয়। ইস্তিরি হয়ে থাকবে এমনিতেই।
    পাশের খুপড়ির জানালা খুলে যায় । চুলবুলি টুসিবৌদি পর্দা সরিয়ে উঁকি মারে। হাসছে কুলকুল করে।
    - কি হল গো?
    - ঐ টিভিতে কি দেখাচ্ছে শোন।
    - কি দেখাচ্ছে গো? ছেলের শার্ট । প্যান্ট। হাত দিয়ে পাটপাট । ঘাম নামছে কুলকুল করে।
    - ঐ দ্যাখ অনামিকা বলছে একটা নতুন রান্না শেখাবে আজ।
    - তো হাসির কি হল গো? ছেলের শার্টের পকেট ছেঁড়া ।
    - আরে নতুন রান্না কি বলতো? পটল আর লাউয়ের চোখাবাটা। কাঁচালঙ্কা । রসুন। কালোজিরে। টুসি খলখল করে হাসতে থাকে।
    - ও তো আমরা মায়ের পেট থেকে পড়েই খাচ্ছি। বলে কিনা লকডাউনে খরচ বাঁচানোর জন্য নতুন রান্না শিখুন। একথালা ভাত উঠে যাবে। কি কায়দা মাইরি। তা আবার কত রঙঢঙ করে বলছে অনামিকা।
    - তুমি কি রাঁধলা আজ?
    চুল মোড়াতে মোড়াতে জিগ্যেস করে শ্যামা।
    পর্দা সরানো আছে। টুসির কোমর পর্যন্ত দেখা যায়। শাড়ি এলোমেলো। টিভি চলছে । বিছানাতে লুঙ্গি পরে আধশোয়া টুসির বর। ঈষৎ চোখ নাচিয়ে টুসি বলল। ঐ তোর দাদার পছন্দ। কাতলার ঝোল। আলু দিয়ে পাটশাক ভাজা। আমের টক। টুসির বাড়ির পাশেই আমগাছ। ভালো আম ধরে আছে।
    শ্যামার গায়ে জ্বালা করে ওঠে। জল ঢালতে হবে এখনি। অনেক জল।
    - তুমি দ্যাখো টিভি। আমি স্নানে যাই। বলে সাবানের বাটি হাতে নেয় শ্যামা । পর্দা নামিয়ে দেয়। টুসির যদি কোন আক্কেল থাকে। পরের বাড়ির জানালা দিয়ে আদুলগায়ে পুরুষমানুষ দেখলে গা গুলোয় শ্যামার ইদানিং । শ্যামা ন্যাপথালিনের কথা ভাবে । বৌদি কী সুন্দর গন্ধ দেয় আলমারিতে। ন্যাপথালিন। চেয়ে এক প্যাকেট এনেছে । সন্ধেবেলা ট্রাংকে দেবে। ফোন আসে তখনি। এখন ফোন এলেই বুক কাঁপে শ্যামার। যদি সেই লোকটা ফোন করে! এতদিন বাদে। কি বলবে শ্যামা এপার থেকে? বলবে যা হয়েছে যেতে দাও। বাড়ি ফিরে এসো। তাই বলবে?
    টেবিলের ওপর তাকে নারকেল তেলের শিশি নিয়ে ফোন ধরল। সুখন নয়। হরপ্রীত। আবার। ডাকছে। বলছে- তুই না আসবি তো আমি যাব। মাস্ক বানাবো দুজন মিলে। ম্যায়নে সিখ লিয়া। রোজগার হবে। হেভি ডিমান্ড বাজারে । বাইরে থেকে সাপ্লাই আসছে না তো। তু হাঁ কর ইয়া না কর ম্যয় তো আ রহিঁ হু।
    না করলো না শ্যামা। আসুক হরপ্রীত । খুব শক্তপোক্ত । কাজের মেয়ে । ওর মালিকের কাপড়ের ব্যবসা । হোলসেল । তারাই প্রথমে কাপড় দেবে বলেছে। লকডাউনে লোক চলাচল পুরোপুরি বন্ধ নয়। হরপ্রীত ঠিক ম্যানেজ করে চলে আসবে। একটা লাইফবয় সাবান কেটে দুটুকরো করে নিয়েছে শ্যামা। হাতে ঘষতে ঘষতে ভাবে। ভালোই হবে। কাজের মধ্যে থাকা ভালো। বিক্রি বাটা হরপ্রীত দেখবে। দুটো পয়সা আসুক।
    ঘরের ভেতর বুড়ি কঁকিয়ে উঠল। শ্যামা গায়ে জল ঢালতে ঢালতে চেঁচিয়ে ছেলেকে বলল দ্যাখ ঠাকুমা কি বলছে।
    দুপুরে খেয়ে একটু ঘুম এসেছিল শ্যামার । আলগা ঘুম। আলুপেঁয়াজ ভাজা। কাঁচালঙ্কা কালোজিরে ফোড়ন আর মুসুরডালের ভরপুর গন্ধে মাতোয়ারা ঘুমে শ্যামা দেখল সে মাস্ক বানাচ্ছে। একটা। দুটো। দুশো। লাল। সাদা । নীল। ঘুড়ির মত মাস্ক উড়ে যাচ্ছে আকাশে। কে একজন খপ করে একটা নীল মাস্ক ধরে ফেলল। বাঁধছে মুখে। কে ও? সুখনলাল বুঝি?

    ✨ফির লে আয়া দিল

    সুখনলাল হাঁটতে হাঁটতে থকে গেছে। লম্বা চওড়া শরীর একেবারে বিপর্যস্ত । একটা পেট্রলপাম্পে ফোন চার্জ করেছে খানিকটা। কুড়ি টাকা চেয়েছিল চার্জ করতে। দেয়নি সুখন। পকেটে পঞ্চাশ টাকা আছে। যেতে হবে কলকাতা। খানিকক্ষণ চার্জ হবার পর টেনে সরিয়ে দিল ওরা। শ্যামার নম্বরটা বার করে তাকিয়ে থাকল। যদি ভুল করেও শ্যামা ফোন করে একবার। দুদিন খাওয়া নেই। সোলাপুর পার হয়ে এসেছে ওরা। মতিলাল নামে একটা বুড়োমানুষ মরে গেছে রাস্তাতে। তার লাশ পড়েছিল বৃক্ষতলে। যদি কেউ দেখে তো সৎকার হবে। নয়তো শেয়াল কুকুর টেনে নিয়ে যাবে। যাক। দল দাঁড়িয়ে থাকবে না কারু জন্য। পুলিশ এসে পরতে পারে যেকোনো সময়ে । যতটা যাওয়া যায় রাত করে। দুপুরে বিশ্রাম। এনজিও র পথ চেয়ে থাকা। এর চেয়ে মরে যাওয়া ভালো। বাবুরাম বলে। একটা ধাবার পাশে বসেছিল দলটা। জল পাওয়া যাবে অন্তত। এই ধাবার মালিক আগেরটার মত খচ্চর না। জল দিল। মেয়েদের জন্য খুলে দিল টয়লেট। কিছু খাদ্যও দিল । রুটি। তড়কা। পরিমাণে খুব বেশি না। কিন্তু এই অমৃত। এক মিনিটে গোগ্রাসে খায় সুখন। ধাবাতে টিভি চলছে। প্রধানমন্ত্রীজী আজ সন্ধ্যায় থালি বাজাতে বলেছে। সারা দেশ একসঙ্গে থালি বাজাবে। একসঙ্গে কোটি কোটি থালি বাজবে। সুখনলাল তাজ্জব বনে যায়। মতিন জিজ্ঞেস করে, বাজনা শুনে করোনা ভেগে যাবে কি? ভাগ যায়গা ক্যা? সুখনলাল জানে না। বাবুরাম জানে না। ফতিমা , লছমি, কেউ জানে না। কিন্তু মন্ত্রীজি বলেছে। সন্ধ্যাকালে ছেঁড়া ফাটা পুঁটলি থেকে ভাঙা, আস্ত ট্যারা ব্যাঁকা থালি বার হয়। ধাবার ঘড়িতে সাতটা বাজলে সমস্ত থালা বাজতে থাকে। খাদ্যহীন থালা । ভাঙা থালা। শব্দে কান ফেটে যায় । সুখনলাল বলে, বহুত হুয়া। অব চলো। রাতভর চলনা হ্যায়। করোনামাঈকি জয়। বলে নমস্কার করে উঠে পড়ে লছমি। আর তারপরেই ঠাস করে পড়ে যায় । তিন ঘন্টা বেঁচেছিল তারপরে। বমি ও পায়খানাসহ। তারপর নেই হয়ে যায় । দলের বেশির ভাগ তখন এগিয়ে গেছে। জন্ম হোক বা মরণ। কিছুর জন্যই দাঁড়িয়ে থাকা যায় না।
    ওরা জানে।
    কেরলের সঙ্গে চিনের উহান শহরের সম্পর্ক বেশ ঘনিষ্ঠ । তার কারণ কেরলের উচ্চশিক্ষার হার এবং উহানে চিকিৎসাবিজ্ঞান ও তৎসংক্রান্ত শিক্ষাব্যবস্থার উন্নত মান। কেরলের প্রথম তিনজন কোভিড আক্রান্ত রোগীই ছিল উহান ফেরত। দু হাজার আঠারোতে নিপা ভাইরাস আক্রমণের সময় গোদের ওপর বিষফোঁড়া ছিল বন্যা। তারপর হাজার হাজার এন আর আই মধ্যপ্রাচ্য থেকে কাজ হারিয়ে ফিরছিল দেশে। এইসমস্তকিছুকে মোকাবিলা করার জন্য কেরলে সরকারের হাতে ছিল এক অমোঘ স্ট্রাটেজি। কনসিসটেন্সি। কো অরডিনেশন। কমিউনিকেশন। এবারেও তার ব্যতিক্রম ঘটল না। প্রতি সন্ধেবেলা বসতে লাগল আঠারো সদস্যের কমিটির। যেভাবেই হোক সংক্রামণ আটকাতে হবে। ধর্মীয় গুরু, আঞ্চলিক কমিটি এবং নাগরিক সংগঠনগুলোকে দায়িত্ব দেওয়া হল। শিক্ষাহার বেশি হবার ফলেই হোক আর অসম্ভব শক্তিশালী প্রাইভেট ও পাবলিক চিকিৎসা সেক্টর থাকার কারণেই হোক, সারা দেশ যখন কোভিডের ব্যাপারে কিছুই না জেনে , হাত পা তুলে বসে আছে বা উদ্বাহু নৃত্য করছে, তখন কেরলে মারাত্মক রকম সতর্কতা, বিধিনিষেধ এবং চিকিৎসা স্ট্র্যাটেজি, কোয়ারেন্টাইন ইত্যাদি শুরু হয়ে গেছে।
    অনিল টমাস হোম কোয়ারেন্টাইনে আছেন। কিন্তু তার দুই বন্ধু সন্তোষ মেনন এবং ভিনু মুথালালাই আছেন হাসপাতালে। এঁদের মধ্যে ভিনুর অবস্থা খুব খারাপ। বিমানবন্দরেই তাঁর প্রচন্ড জ্বর এবং শ্বাসকষ্ট ছিল। লোকাল কমিটি নিয়মিত অনিলকে ফোন করছে বটে, সমস্ত রেশন বাড়িতে চলেও আসছে কিন্তু তাদের কাছ থেকে বন্ধুদের কোনো খবর পাচ্ছেন না অনিল। শ্বাসকষ্ট ভোগাচ্ছে তাঁকেও। নেবুলাইজার ব্যবহার করে চলেছেন। জ্বরটা সেরে গেছে বলে শান্তি। অনিল বসে বসে ঝকঝকে বৃষ্টিস্নাত বাগানটির ঘ্রাণ নিচ্ছিলেন। ওম্মায়িকা গাছগুলো বেশ পুরনো। পেঁপে ধরে আছে অনেক। সামনে ঝোঁপের মধ্যে বেশ কিছু বৈচি ফল। কী সুন্দর তাদের রঙ। তাঁর ছেলেমেয়েদুটি বৈচি ফল খেতে বড় ভালবাসে। অন্য সময় হলে এখন এইসব ফল তাদের পেটে চলে যেত। এখন ঘরবন্দি বলে তারা বাগানেও আসতে পারছে না।
    আজকে বাড়িতে ছোটখাট উৎসব। ফাইব্রোসিস হয়নি। রিপোর্ট এসেছে অনিলের। তবে কোয়ারান্টাইনের আঠাশ দিন পূর্ণ করতেই হবে। কিন্তু রিপোর্টে পলি উজ্জীবিত । একটু কিছু করতেই হবে। ছেলেমেয়েদের জন্য। নিজেদের জন্য। সকাল সকাল স্নান সেরে একটা সিম্পল ব্রেকফাস্ট। টোস্ট । মাখন। জ্যাম। কলা। দুধ। তৈরি করে দিয়েছেন পলি। লাঞ্চের প্রস্তুতি জোরতার। অনিল সেরে উঠছেন। ফাইব্রোসিস হয়নি। কোয়ারেন্টাইনের দিনগুলি কাটেনা। তবু একটু তো হাঁপ ছাড়া গেছে। এ সুযোগ হাতছাড়া করতে পলি রাজি না। সবার জন্য লাঞ্চে আজ । ঘি রোস্ট দোসা। সঙ্গে মিষ্টি। পলাদা পায়সম আর কজুকতা। ছেলেমেয়ে চেটেপুটে খাবে। অনেকদিন বাদে এত ইলাবোরেট রান্না করেছেন পলি। অনিলের জন্য আছে এরিসারি। সবজি দিয়ে স্ট্যু। টোম্যাটো । কুমড়ো। বেগুন সব দিয়ে । আর তেলাপিয়া মাছের কারি। প্রোটিন খাওয়া খুব জরুরি অনিলের জন্য। পলি অতি যত্নবতী গৃহিণী। তাঁর ঝকঝকে কাঠের ডাইনিং টেবিলে তিনি ফুল রেখেছেন আজ। সাদার ওপর ব্লু চেক। স্টিলের চামচ হাতা ঝকঝকে। অনিলের খাবার শেডে রেখে এসেছেন। পাশে সাজিয়ে দিয়েছেন ফুলের গুচ্ছ। সুস্থতার দিন আসছে। খুশি উপচে পড়ছে তাঁর। একটা ঘন নীল কুর্তা পরেছেন। ভারি সুন্দর দেখাচ্ছে তাকে। চন্দনের ধূপ জ্বেলেছেন। করোনার থাবা পড়েনি সংসারে। এর চেয়ে আনন্দের কি আছে।
    অনিল একচুমুকে ডাবের জলটা শেষ করলেন। তিনি ভারমুক্ত বটে । কিন্তু আংশিক। লাংসে স্পট আছে একটা। সেটা কি? পলিকে ফোনে বলেছেন কিছু না। কিন্তু বন্ধুপুত্র তাঁকে ফোন করেছিল। দেবরূপ বলেছে লাংসে তিন সেন্টিমিটারের চেয়েও ছোট একটা নুডল আছে। এটা ফাংগাল ইনফেকশন হতে পারে। ব্যাকটেরিয়াল ইনফেকশন হতে পারে। আবার মাইকোব্যাকটেরিয়াল ইনফেকশনও হতে পারে। মানে টিবি। সেটা পর্যন্ত ঠিক আছে। অনিল সামলে নিতে পারবেন। কিন্তু এই পালমোনারি নুডল যদি ক্যানসারাস হয়!
    প্রথমেই নিজের ছেলেমেয়েদুটির মুখ ভেসে আসে অনিলের চোখে। তারপর পলির মুখ। সামনে সবুজ বাগান ধূসর। বর্ণহীন ফল । ফুল। অথচ তিনি ননস্মোকার। তবে? তবে? কিছুতেই মানতে পারেন না অনিল। মুখ ঢেকে বসে থাকেন অনেকক্ষণ । এখানে কেউ দেখতে পাচ্ছে না তাঁকে। ফোন বেজে ওঠে। যেসুদাসের একটি গান তাঁর রিংটোন। সুরমাই আঁখিয়োমে। পলি। জিজ্ঞেস করছেন এরিসারি ঠিকঠাক ছিল কিনা। মাছ খেয়েছেন তো!
    এত প্রেম। এত মায়া! মৃত্যু কি এসবের চেয়ে বড় নাকি। অনিল টমাস মাথা ঝাড়া দিয়ে উঠে বসেন। ক্যাসারোলের ঢাকনি খুলতেই এরিসারির সুগন্ধ। ঝকঝকে আকাশ। পাতার ফাঁক দিয়ে রোদ ঝিকমিক করে নামছে তাঁর বাগানে। ওয়াটার লিলির গোড়া থেকে একটা সবুজ ব্যাঙ ঝপ করে লাফ দিয়ে পড়ল পাড়ে। ঠিক ঐরকম লাফ দিয়ে মৃত্যুভয় পার হয়ে যাবেন অনিল। ঠিক যাবেন।

    ✨চেলুভি

    হাওয়া অতি মৃদুমন্দ। গোধূলিবেলা। আরেকটু পরে অন্ধকার নামবে অরণ্য। এ সময়ে মন ভার হয়ে আসে। আলো কমে আসছিল যত, তত মেয়েটি গাছ হয়ে যাচ্ছিল। হ্যাঁ । একটা গোটা মেয়ে গাছ হয়ে যাচ্ছিল। ওর পা, হাত, বুক সমস্ত মিশে গেল গাছের সঙ্গে । মুখটি জেগে ছিল খানিকক্ষণ । তারপর আস্তে আস্তে মুখও ডুবে গেল কান্ডের গভীরে। আরো গভীরে। পরমসুখে তলিয়ে যাচ্ছিল মেয়েটা। আর তারপর গাছটা ডালপালা বিস্তৃত করতে শুরু করল। ডাইনে। বাঁয়ে। উপরে। একটি অশ্রুত বাঁশি যেন বেজে চলেছে। গাছে ফুল ফুটতে শুরু করল। ছোট ছোট সাদা ফুল। কী তীব্র সুগন্ধি ফুল! মেয়ে যেন ফুলের মধ্যে দিয়ে মুখ তুলে চাইছে। সঙ্গের মেয়ে আনন্দে হাততালি দিয়ে উঠল। দিদি গাছ হয়ে গেছে! দিদি গাছ হয়ে গেছে! এবার আমরা ফুল বিক্রি করতে পারবো। অনেক সাদা সাদা ছোট ফুল। মিষ্টি গন্ধ!মন্দিরের সামনে ফুল বিক্রি করবো আমরা। বাজারের সামনে ফুল বিক্রি করবো! মেয়েরা সাদা ফুলের গজরা জড়াবে মাথাতে। বলতে বলতে হাততালি দিয়ে নাচছিল ও। আর গাছ থেকে ঝরে পড়ছিল আশ্চর্য সুগন্ধি কিছু সাদা ফুল।
    ওর সারা মুখে ফুল ঝরে পড়ছে যেন। সিগারেটের কটু গন্ধ, যেটা ও ভীষণ রেলিশ করে, সেটা চাপা পড়ে যাচ্ছিল। হাতের ওপর যে ট্যাটু তাতে ড্র্যাগন । বাদুড় । পেঁচা। তারা কোলাহল করতে শুরু করল। ড্র্যাগনের লেগে, পেঁচার চোখে, বাদুড়ের ডানাতে কেবল সাদা ফুল পড়ে যাচ্ছে । নীল ট্যাটু। সাদা ফুল। ও ঘুমের মধ্যে পাশ ফিরল। মরিচ রঙা চুল এলোমেলো হয়ে ছড়িয়ে আছে বালিশে। ফিল্মে যেমন দেখায়। টিকটিকি ওকে দেখছিল আশ্চর্য হয়ে। কেমন করে একটা মানুষ দিনরাত ঘরে বন্ধ থাকে বা নিজেকে বন্ধ করে রাখে , টিকটিকি বুঝতে পারে না। এ বারান্দায় যায় না। ছাতে যায় না। অ্যাটাচড বাথ। খাবার বেশির ভাগ সময় ঘরে এনে একা খায়। কচিৎ মনে হলে হয়তো ডাইনিং টেবিলে গিয়ে বসল।
    টিকটিকি দেখল ঘুমের মধ্যে মেয়েটা হাসছে। মেয়েটা গাছ হয়ে যাচ্ছে । গাছ খুব চেনে টিকটিকি। ও বুঝতে পারছিল মেয়েটা এবার ফুল হয়ে ফুটবে। কিন্তু মেয়ে ইজ ইকুয়ালটু ফুল এই ইকোয়েশন যে বিশ্বাস করে না তার স্বপ্ন সে নিজেই ভাঙে। মেয়েটা ঘুম ভেঙে উঠে বসল। টিকটিকি দেখল , ওর ডালপালাগুলো গুটিয়ে যাচ্ছে। ও যেন সাপের মত গাছের খোলশ ছেড়ে মানুষ হয়ে বেরোচ্ছে। ওর সবুজ টি শার্টে চে গেভারা। টিকটিক শব্দ করে বলে উঠল
    - এই যে গাছ হয়ে গেছিলে, ব্যাপারটা কি?
    - কাল রাতে চেলুভি দেখছিলাম। খেয়াল করোনা? ঐ যে মেয়েটা গাছ হয়ে যাচ্ছিল ? এই ফিল্মটা দেখলে আমিও গাছ হয়ে যাই। গিরিশজির লেখা ।
    - দেখছিলাম। তুমি ঘুমের মধ্যে গাছ হয়ে যাচ্ছো। ডালপালা ছড়াচ্ছো। কিন্তু ফুল ফোটার আগেই তোমার ঘুম ভেঙে গেল। তুমি উঠে পড়লে। আর ফুল ফুটল না।
    - তুমি কি ফুল ভালোবাসো?
    - না। আমি বস্তুত কিছুই ভালোবাসি না।
    - তাহলে শোনো। চেলুভি দেখলে আমি গাছ হয়ে যাই। কিন্তু আমি ফুল হতে চাই না। আমাকে ফুল হতে বলবে না কখনো।
    - কেন?
    - মেয়েদের সবসময় ফুলের সঙ্গে তুলনা করলে বিশ্রী লাগে। গা গুলিয়ে ওঠে। তারপর দ্যাখো। ঐ ফুলগুলো বিক্রি করে সংসার চলে। সবসময় সেল্ফ স্যাক্রিফাইস। দাফনে গাছ হয়ে গেছিল। মেয়েগুলো খালি গাছ আর ফুল হয়। তারপর ঝরে যাওয়া নিয়ে কবিরা দুঃখ লেখে। আই অ্যাম নট দ্যাট টাইপ। আই ওয়ান্ট টু বি গাছ। শুধু গাছ। দেখছো না আমার ঘরে শুধু ক্যাকটাই। পাতাবাহার। কোনো ফুলটুল নেই। ন্যাকা লাগে। ইনসিপিড।
    টিকটিকি শ্বাস ফেলে। খপ করে পোকা ধরে খায়।
    - এই দ্যাখো। নিউজ । লকডাউন পিরিয়ডে অরুণাচলে আশি হাজার গাছ কেটে ফেলেছে। ইন্ডাস্ট্রি হবে। পুরো জায়গাটা নষ্ট হয়ে যাবে জানো। ইট উইল বি নো মোর প্রিস্টাইন। সব ধ্বংস করে ছেড়ে দেবে উন্নয়নের নামে।
    ও উঠে বসে সিগারেট ধরায় । ফসসস করে টানে। ওর গায়ে ফুলের গন্ধ ঝরে যেতে থাকে। পুরোপুরি অবয়ব হয়ে যেতে যেতে ও খবর পড়ে।
    - তোমার মা গাছ লাগায়। ঐ যে গেল সেদিন।
    - ফেবুতে দেবে বলে যায়। ফালতু। সেজেগুজে ফ্যাশন শো করে ছবি তুলবে বলে।
    - ছাতে কত গাছ।
    - বাড়ি সাজায়। গাছ না রাখলে বাড়ির শোভা থাকে না। বুঝেছো?
    - ফোনে কি পড়ছো?
    - নিউজ। কাগজ তো আসছে না!
    - জানি। খবরের কাগজ এলে আগে তোমার বাবা। তারপর তুমি। কমোডে।
    - সব জানো দেখছি।
    - আমি এ বাড়ির আদি বাসিন্দা । আদিবাসী ।
    - উড়িষ্যার লান্জিগড়ে দুটো আদিবাসী গ্রাম উচ্ছেদ করে দিল জানো। ওড়িশা মাইনিং করপোরেশন অ্যালুমিনিয়ামের কারখানার কোম্পানির কাছে দিয়ে দিল। কালাহান্ডির কাছে। ওখানে এমনিতেই লোকে খেতে পায়না। বছরভর দুর্ভিক্ষ ।
    - তুমি এত লোকের ভাবনা ভাবো কেন?
    - না। খুব যে ভাবি তা নয়। দিজ আর ফ্যাক্টস । জানো। এত এত গাছ কেটে ফেলছে উন্নয়নের নামে। আরেকটা মল হবে। আরো আইনক্স। মা আগে শাড়িমহল থেকে শাড়ি কিনত। বা রূপবাতি। আমি সঙ্গে যেতাম। গদির ওপর শাড়ি বিছিয়ে দেখাত। আমাকে কোল্ড ড্রিংক দিত। নববর্ষে ক্যালেন্ডার । এখন মা মলে শাড়ি কেনে। অনলাইনে। মায়ের মত অনেকে। আচ্ছা দোকানগুলোতে কারা যায় বলো তো?
    - যাবার লোক আছে। তোমার গায়ে ফুলের গন্ধটা চলে গেল।
    - তুমি গন্ধ টের পাও? আমি পাই না। আমি বহুদিন হল কোনো গন্ধ টের পাই না। কোভিডের লক্ষণ। গন্ধ বোঝা যাবে না। আমি তো তার কতদিন আগে থেকেই কোনো গন্ধ পাই না। কোনো পার্ফ্যুম ইউজ করি না তাই। নো ডিও। ছোটবেলায় মায়ের গায়ের গন্ধ পেতাম। কি একটা পাউডার মাখতো। এখন তাও পাই না। আমি কোভিড আসার অনেক আগেই আস্ত ভাইরাসটাকে গিলে বসে আছি। আমার মধ্যে গাছটার সঙ্গে ভাইরাসের একটা যুদ্ধ চলে জানো। ভাইরাস গাছটাকে মেরে ফেলতে চায়। তাই আমি কোনো গন্ধ পাই না। যদি কোনোদিন ভাইরাসটা মরে যায় তবে আমি আবার গন্ধ পাবো। তাই না?
    ও কেমন করে কাঁদতে থাকে যেন আর টিকটিকি ভয় পেয়ে যায় । খুব ভয়। এক লক্ষ আশি হাজার হেক্টর বনভূমি ড নোটিফায়েড। টিকটিকি কোথায় যাবে বুঝতে পারে না। মেয়েটা হামাগুড়ি দিয়ে কাঁদতে থাকে। ও কাঁদছে কেন? কাঁদছে আর বলছে আমি কোনো গন্ধ পাই না।
    হুড়মুড় করে অন্য কেউ ঢুকে পড়ে ঘরে। ও কান্না থামিয়ে বলতে যাচ্ছিল, আবার তুমি নক না করে ঘরে ঢুকে পড়েছো মা? দিস ইজ আনফেয়ার! বলার আগেই মা বলে ওঠে। ঈষৎ কনফিউজড। রাদার পের্ট্রাব্ড।
    - তুই কাঁদছিস? দেখেছিস বুঝি? ইরফান মারা গেছে!
    ঠিক সেই মুহূর্তে ওর কান্না থেমে যায় । ইরফান খান ইজ ডেড। এখনি ওর গাছ হয়ে যাওয়া দরকার। খুব দরকার ।
    ✨প্রথম কদম ফুল
    কদম ফুলের মত দেখতে। আসলে ভাইরাসের গায়ে ওগুলো প্রোটিন স্পাইকস। স্পাইকসগুলোর জন্য এই ভাইরাসের মারণ ক্ষমতা অনেক বেশি। সংক্রামণ ক্ষমতা অনেক বেশি। তোমার বয়েস ষাটের কাছাকাছি । কাজেই তুমি সাবধানে থাকবে। খুব সাবধানে। অনিল আংকল ইজ মাচ ইয়াংগার দ্যান ইউ। হি হ্যাজ লেস রিস্ক।
    বাবাকে এইভাবেই বুঝিয়েছিল দেবরূপ। বাবা একটু খামখেয়ালি টাইপ আছে। হুটহাট করে বেরিয়ে যেতে পারে। ওয়র্ক ফ্রম হোম এমনিতেই খুব ক্লান্তিকর । কাজের এরিয়া আর বাড়ির এরিয়া আলাদা থাকার সুবিধে এই যে কাজের চাপটাকে অনেকটা বাইরে ফেলে আসা যায়। লকডাউন হয়ে বাড়ি আর কাজ ঘেঁটে গেছে। তার বাবার মত লোকের সমস্যা হবার কথা। দেবরূপ জানে।
    -লাঞ্চ করে যা। খুব ভাল একটা সবজি বানিয়েছি। তোর ভাল লাগবে।
    ঝাঁকড়া চুল শক্ত করে মাথার পিছনে পোনিটেইল করল অদিতি। ফিরে তাকাল। এই ঘরে কোনো ড্রেসিংটেবল নেই। মাঝারি আয়না বাথরুমে। অদিতি ফোনের সেলফি মোড অন করে নিজের মুখের ত্বক সার্ভে করছিল। দু একটা ব্রণ।
    - ডোন্ট সে দ্যাট। তুই বানিয়েছিস। খেয়ে দেখব। কিন্তু স্টপ ফোরটেলিং যে আমার ভালো লাগবেই।
    দ্যাট ইজ মিয়ের ইমপোজিশন। ভালো লাগে না।
    ও জানে লকডাউনে অদিতি একটু বেশি সেনসিটিভ হয়ে গেছে। ইন্সটিটিউট বন্ধ থাকার ফলে কোর্সের কাজ বন্ধ । ও কিছু ইনডিপেন্ডেন্ট কাজ করছে দুটো এন জি ওর সঙ্গে । কোভিড আক্রান্তদের সঙ্গে ইন্টারভিউ । এটা ভীষণ ঝামেলার কাজ। কারন প্রশাসন থেকে কোভিড আক্রান্তদের সঙ্গে দেখা করতে দেওয়া হচ্ছে না। ডকু ফিল্ম মেকার হিসেবে অদিতির কিছু নাম ডাক হয়েছে। সেই সূত্রে ও দু চারটে কেস ফলো করতে পেরেছে পারমিশন নিয়ে । কাঁচের ঘরের বাইরে বসে ফোনে কথাবার্তা। কিন্তু এইভাবে ডকুমেন্টারি বানানো মুশকিল।
    আলু আর করলার একটা সবজি। সর্ষেবাটা দিয়ে । মায়ের কাছে শেখা। অদিতি তিতকুটে স্বাদ ভালবাসে। কড়া। তেতো কালো কফি খায়। তারিয়ে তারিয়ে রুটি আর আলু করলা খেয়ে উঠে পড়লো পিঠে ব্যাগ নিয়ে । জল ভরে নিল অ্যাকোয়া গার্ড থেকে।
    দরজার বাইরে গিয়ে অবশ্য বললো। ভালো ছিল সবজি। ইউ আর টার্নিং টু অ্যান এক্সেলেন্ট কুক!
    মুখে মাস্ক । মাথায় হেলমেট। স্কুটি চালিয়ে বেরিয়ে গেল অদিতি শিবরামণ। প্রায় সারাদিন বিভিন্ন হাসপাতাল আর নার্সিংহোমে দৌড়ে বেড়াবে। ডেটা কালেক্ট করবে। মুলা নদী পার হয়ে চলে যাবে ওপারে। স্কুটি নিয়ে সারা শহর ঘুরে বেড়ায় ও । লকডাউনে মাথা গরম থাকবে বৈকি।
    ও এখন বেরোবে না। বসবে নিজের কাজ নিয়ে । কাজ মানে ল্যাপটপ। ডেস্কটপ। ডেটা। ইনফরমেশন। অন্য সময় হলে বেরিয়ে যেত অদিতির সঙ্গেই। ডেকান জিমখানার দিকটা খুব পছন্দ করে ওরা। সাদামাটা পরিচ্ছন্ন রেস্তরাঁর খাওয়া । স্কুটি বা বাইক পার্ক করে হাঁটাহাঁটি। সেসবের কোনো সম্ভাবনা নেই। তবে আজ ঘরেই ওদের প্রিয় রেস্তরাঁর মত মুখোমুখি বসেছিল দুজনে খেতে।
    - মা কলকাতায় আটকে গেছে জানিস?
    - শি ইজ ইন হোটেল?
    - নাহ্। ফুফুর বাড়ি।
    - দেন শি মাস্ট বি ফাইন।
    - ইয়াপ! আচ্ছা লকডাউন উঠলে আমার মা যদি একদিন তোদের বাড়িতে যায়?
    - যেতেই পারেন। জল খায় ও। ভালো তো।
    - তোর আর আমার কথা যদি বলেন।
    চশমার পেছনে দুটো চোখ অদিতিকে দেখতে থাকে।
    - কিছু বলবি না?
    - ইয়ার্কি মারিস না। ইটস টু আর্লি ।
    - হোয়েন ইউ আর ইন বেড ইট ইজ নট টু আর্লি।
    - আগে আমি বলি । তারপর।
    - কলকাতায় মিষ্টি তৈরি হচ্ছে জানিস ? যাস্ট লাইক দিস ভাইরাস?
    ইঃ! ব্যাড টেস্ট। মুখ কুঁচকায় অদিতি। ও জানে দেবরূপ বাউন্সার ছেড়ে দেয়। কথা ঘোরায়। আবার দেওয়া যেত। কিন্তু এখন পিচ খারাপ।
    অদিতি কথা না বলে খেয়ে যায় ।
    তার মা মুমতাজ আহমেদ মারাত্মক সুন্দরী। সোফিস্টিকেটেড । রসিকা। অধ্যাপনা করেন। তিনি বাড়িতে গেলে মা বাবা পর্যাপ্ত আপ্যায়ন করবে। ও জানে। কিন্তু ব্যস ঐ পর্যন্ত। তার বেশি কিছু দেবরূপের বাবা মায়ের এস্টিমেশনের বাইরে। শকটা বাইরের লোকের কাছ থেকে যাওয়া ঠিক নয়। অদিতি স্কুটির গতি বৃদ্ধি করে।
    ও ল্যাপটপ খোলে। লগ ইন করে। এই এক বৃত্ত। লগ ইন আর লগ আউট। ইনফরমেশন চক্রে একবার ঢুকে পড়া। বায়োঅ্যানালিটিক্স আর অ্যানিম্যাল টিস্যু কালচারের ব্যূহতে ঢুকে পড়ার আগে ওর মনে পড়ে অনিল টমাসকে ফোন করতে হবে। বাবা মাস্ট বি ইন ট্রমা। বড় বেশি ভাবে ঐ জেনেরেশনটা। অ্যাজ ইফ ভেবে কিছু হবে। কোন কালে বাংলাদেশে সব ছেড়ে ছুড়ে এসেছে, সেই ট্রমা এখনো এদের কাজ করে। আরে বাবা এসেছিল তো বাবার ঠাকুর্দা। তাদের কষ্ট থাকা স্বাভাবিক ছিল। জেনারেশনের পর জেনারেশন কষ্ট বয়ে বেড়ায় নাকি! ওর নিজের কোনো হ্যাং ওভার নেই। বৃষ্টি শুরু হল আবার। পুনের বৃষ্টি মনোরম থেকে ভয়ংকর হতে সময় লাগে না। অদিতিটা ভিজবে। সাধারণ ভাইরাল ফিভার হলেও এই সময়ে খুব সমস্যা।
    ভিজতে ইচ্ছে করছে খুব । দরজা খুলেই একটা ওপেন টেরাস আছে। আপাতত বি সেল আর টি সেল ছেড়ে বৃষ্টির ফোঁটা চাইছে মস্তিষ্ক । শরীর অ্যান্টিবডি বানাবে। কিন্তু অচেনা কিছু দেখলেই অযথা অ্যান্টিবডি তৈরি করে কি লাভ! দেবরূপ ল্যাপটপ ছেড়ে দরজা খুলল।
    অঝোর বৃষ্টিতে ভিজছে। খুব ছোটবেলায় ভাই বোন বাবা মিলে ভিজতো। সিমবায়োসিস জয়েন করার পর থেকে বাড়ির সঙ্গে যোগাযোগ কত কম। বছরে দুবার। একবার। সাতদিন। শাওয়ারে স্নান টানে কিছু হয় না। শরীর বৃষ্টি খুঁজছিল। কার্নিশ ধরে দাঁড়িয়ে ভিজে চলেছে। রক্তকোষে ইমিউনিটি তৈরি করছে সমস্ত স্নায়ুর শক্তি দিয়ে যেন । বাংলাদেশ থেকে উচ্ছেদ । উদ্বাস্তু হয়ে চলে এসেছিল বাবার ঠাকুর্দা। ভিটেমাটি ছেড়ে । এখনো বাবা শোনা গল্প করে তার ঠাকুরদা সগরিগলি ঘাট দিয়ে আসার সময় লুঙ্গি পরে নিত। দাড়ি রাখত। দ্যাট ইজ পার্ট অব দ্য পাস্ট। কোথায় বিটার ট্রুথ নেই। তোমরা ছোঁয়া বাঁচিয়ে চলোনি? দুর যাহ্ করোনি?শুধুমাত্র ঐ ভাইরাল অতীত। পারিবারিক অতীত যখন দেশের অতীতের সঙ্গে মিলেমিশে যায় তখন কমপ্লেক্স সেন্টিমেন্ট তৈরি হয়ে যায় । আর তাইজন্য সে অদিতির কথা বলতে পারে না। কিন্তু উপায় নেই। অ্যান্টিবডি তৈরি হোক। আরো। আরো বেশি ইমিউনিটি চাই। বুদ্ধি আর যুক্তি দিয়ে সেন্টিমেন্টের সঙ্গে লড়াই করা যায় না। সেন্টিমেন্টকে বাগে আনতে হয় সেন্টিমেন্ট দিয়ে । তার জন্য সময় দিতে হয়। অনেক সময় । তীরের মত বৃষ্টির ফলা বিঁধছে শরীরে। কোষগুলি রোমাঞ্চিত । এই পুলকে অ্যান্টিবডি তৈরি হয়। হোক। সে তৈরি হচ্ছে মুখোমুখি হবার। কোভিড ডেজ। যদি বেঁচে থাকে তবে মনে থাকবে।
    অদিতি শিবরামণ । আই অ্যাম নট অ্যান এসকেপিস্ট। আই নিড টাইম। হয়তো কিছু বেশি সময় । তবু। আই উইল গ্রো ইমিউনিটি । বৃষ্টিধারা আছড়ে পড়ছে শরীরে। পিঠ পেতে মার নিচ্ছে। সহজাত ইমিউনিটি দিয়ে যদি না হয় তবে অ্যাডাপ্টেড ইমিউনিটি চাই। অনেক ভাইরাস । বাদুড় শরীর থেকে উচ্ছেদ হওয়া উদ্বাস্তু । ওরা কোথায় যাবে? আয়। আমার শরীর প্রস্তুত করছি। লেট দ্যা ফাইট বিগিন। আয়!
    ✨এক ম্যায় আউর এক তু
    টিভির দিকে অপলকে তাকিয়েছিল শ্যামা। হরপ্রীত কাউর একরাশ রঙিন কাপড় নিয়ে এসেছে। ট্রিপল লেয়ারড মাস্ক তৈরি করতে শিখেছে। শ্যামাকে শেখাবে আজ থেকে। কাপড়, ছুঁচ, সুতো, কাঁচি সব রেডি। হরপ্রীত উবু হয়ে কাপড়ে কাঁচি চালাতে চালাতে দেখল ঘর দোর, বিছানা, বালিশ, তক্তপোশ, ট্রাংক সব ছাড়িয়ে শ্যামা উড়ছে বাতাসে। চোখ দিয়ে হুহু করে জল পড়ছে। বাতাসে উড়ছে ওর আঁচল। শ্যামার শরীর হাল্কা হয়ে গেছে। সম্পূর্ণ নির্ভার। হরর ফিল্ম নয়। শ্যামা যেন আঁচল ছড়িয়ে পরী হয়ে গেছে। ওর বাসী প্যাতপ্যাতে হলুদের ওপর খয়েরি ছাপ শাড়ির আঁচল ওড়ে পাখার মত। পায়ে যেন পায়েল। ঋষি কাপুর কী সুন্দর হাসে! শ্যামার ঘোর লেগে যায় । গান হয়। তেরা ফুলো য্যায়সা রঙ তেরা য্যায়সা তেরা শীষে য্যায়সা অঙ্গ পড়তেহি যো নজর ম্যায় তো হো গয়ি হ্যায় তঙ্গ! ঋষি কাপুর সাদা সোয়েটার পরে লাল টুকটুকে ঠোঁটে মোহন হাসি হেসে চলেছেন। টিভিতে দেখাচ্ছে তাঁর নিথর দেহ। ক্যানসারে আক্রান্ত ঋষির বেদনার্ত পরিবার সাদা পোশাকে দাঁড়িয়ে । মুখে মাস্ক। হাতে গ্লাভস। কয়েকজন হাসপাতাল কর্মী নতমস্তকে। পাশের বাড়ি থেকে পর্দা সরিয়ে টুসিবৌদি হাঁক দিল। দেখেছিস রে টিভিতে দেখাচ্ছে ঋষি কাপুর মরে গেল। করোনাতে মরেছে নাকি রে? হরপ্রীত ছুঁচে নিপুণভাবে সুতো পরাতে পরাতে চেঁচিয়ে জবাব দিল, আরে নহি রে। করোনা নহি। ক্যানসার হুয়া থা। যো কোই মরতা হ্যায় করোনাকে নাম পর যাতে হ্যায়। ছোট্ট গ্লাসে কড়া করে চা। অনেকটা চিনি। হরপ্রীত সুড়ুৎ করে চুমুক দিল। ঋষি কাপুরের নাচ হলেই শ্যামার দিল খুশ হয়ে যায় একথা হরপ্রীতের চেয়ে বেশি কে জানে। দাদা বৌদি যখন কাজে যায়, ফাঁকা বাড়িতে শ্যামা একা। বা হরপ্রীত এসে হাজির। ইক ম্যায় আউর ইক তু। রোগা পাতলা শ্যামলা মেয়ে হিরোইন বনে নাচতে থাকে। ডাইনিং টেবল ঘুরে ঘুরে নাচ। কোমরে আঁচল। শ্যামার খুব ইচ্ছে ছিল নিতু সিংয়ের মত সালোয়ার কুর্তা পরে নাচে। টিভিতে যেমন আগের দিনের নায়িকারা পরে। কিন্তু সুখনলালের কড়া হুকুম ছিল। শাড়ি পরবি। লোকের বাড়ি কাজ করে দুপয়সা কামিয়ে সাপের পাঁচ পা দেখতে হবে না। তারপর শাশুড়ি তো আছেই । সালোয়ার কুর্তা কোনোদিন পরা হয়নি শ্যামার। হরপ্রীতের জামাকাপড় দেখে সাধ হত। সাধ আছে কিন্তু সাহস নেই। তাহলে যা হয় শ্যামার তাই হয়েছে আর কাজের বাড়ি ফাঁকা পেলে নেচে কুঁদে সাধ মিটিয়েছে। ঋষি কাপুর হাসছেন। দুর্দান্ত নাচ্ছেন একটা মস্ত রেকর্ডের ওপর। পয়সা হি পয়সা। শ্যামাও নাচ্ছে । খুল্লম খুল্লা প্যার করেঙ্গে হামদোনো। যে নাচ কোনোদিন নাচতে পারেনি সেই নাচ নাচছে শ্যামা। পা যেন মাটিতে পরে না। সমস্ত অর্গল খুলে যায়। কানে এসে যায় কখনো না পরা ঝুমকো। শ্যামা একদম নিতু সিং হয়ে নাচে। হাম দোনো দো প্রেমিক দুনিয়া ছোড় চলে। শুকনো হাতে ঢলঢলে শাঁখা পলা। শ্যামা হিল্লোল তুলে নাচে। পাশের খুপড়ি থেকে কাশির শব্দ। বুড়ির জ্বর নামে না। তেমনি হিক্কা তুলে কাশি। শ্যামার ছেলে বাইরে গেছিল। দৌড়ে ঘরে ঢোকে। পুলিশ এসেছে পাড়াতে। দাবড়ানি দিয়ে ঘরে ঢোকাচ্ছে সবাইকে। এসে আশ্চর্য হয়ে দ্যাখে। হরপ্রীত কাপড় ভাঁজ করে সেলাই শুরু করেছে। সময় নষ্ট করা পছন্দ করে না। পুলিশকে মিথ্যে বলে পাড়াতে ঢুকেছে।
    শ্যামার ছেলে ওর কাপড় ধরে টানে। ওমা! মা! কি হল? সম্বিত ফিরে পেয়ে শাঁখা থেকে সেফটিপিন খুলে ছেলের জামায় ছেঁড়া বোতামের জায়গায় লাগাতে গিয়ে থেমে যায় শ্যামা। বলে, জামাটা খুলে দে। ছুঁচ সুতো বাইরে আছে। টেকে দেই বোতামটা। তুই ঐ জামাটা পর। চোখভরা জল মুছে শ্যামা বাক্স হাতড়ে বোতাম খোঁজে। ঋষি কাপুর টিভিতে নেই তখন আর। পরিযায়ী শ্রমিকদের দেখানো শুরু হয়েছে। খাদ্য না পেয়ে গন্ডগোল । লাঠি চার্জ। আজ টিভিতে শ্রমিকমিছিলে সুখনের মুখ খুঁজল না শ্যামা। বোতাম সেলাই করতে করতে বলল, রণবীর কাপুরের বিয়ে দেখে যেতে পারল না রে মানুষটা। ইশশ! হরপ্রীত মাস্কে ইলাস্টিক লাগাচ্ছে। বলল , ক্যায়া দেখনা। উও তো রহতে হ্যায় আলিয়া কে সাথ। উ আয়ি থি।
    মাস্ক তৈরি করতে করতে শ্যামা ভাবছিল ফিলিমের স্টারদের এক সেট করে সাদাজামাকাপড় বোধহয় সঙ্গেই থাকে। কেউ মরলেই, সে বাপ ভাই যেই হোক। সঙ্গে সঙ্গে সাদা পরে চলে আসে। কী তুরন্ত! বাপরে।

    ফার্স্ট জানুয়ারি দু হাজার কুড়ি। হু। ইনসিডেন্ট ম্যানেজমেন্ট সাপোর্ট টিম তৈরি হল। চিন থেকে খবর এসেছে নিউমোনিয়ায় আক্রান্তের সংখ্যা বাড়ছে। ইমারজেন্সি ফুটিং চাই। ফোর্থ জ্যান। নিউমোনিয়া । আরো আরো নিউমোনিয়া কেস। পাঁচ তারিখে প্রথম ডিজিজ আউটব্রেকের খবর। তখনো কোভিড নাইন্টিন তার অস্তিত্ব জাহির করেনি। টেন্থ। জানুয়ারি । হু সমস্ত দেশকে সতর্ক করে। রোগনির্ণয় । পরীক্ষা । নির্দিষ্ট নিউমোনিয়া কেসগুলি খতিয়ে দেখে ম্যানেজ করা। শ্বাসনালীঘটিত ভাইরাস কি ট্রান্সমিটেড হচ্ছে? বড় প্রশ্ন। চোদ্দই জানুয়ারি । মানুষ থেকে মানুষে সংক্রামণ ছড়াচ্ছে কিনা ভাইরাস পরীক্ষা করতে হবে। কুড়ি তারিখে বিশেষজ্ঞ দল গেলেন উহান। এটা পাবলিক হেল্থ ইমারজেন্সি ইস্যু হতে চলেছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন। ইসি মিটিং। একের পর এক। পাবলিক হেল্থ ইমারজেন্সি অব ইন্টারন্যাশনাল কনসার্ন হিসেবে চিহ্নিত হল রোগটি। ফেব্রুয়ারির তিন। পরপর স্ক্রোল করে দেখে যাচ্ছে ও।
    ফ্রম সিম্পল কেসেস অব নিউমোনিয়া টু প্যান্ডেমিক। এগারোই মার্চ হু ঘোষণা করেছিল অতিমারী। এখন কোভিড নাইন্টিন সলিডারিটি রেসপন্স ফান্ড চাই। তেসরা ফেব্রুয়ারি ওদের সেমিস্টার শেষের পার্টি ছিল। লেট নাইট।
    ও মাথার পিছনে হাত রেখে শুয়ে পড়ে। উৎপাটিত বৃক্ষসমূহ কাঁদছে। ওর হাত পা মাথা সব ভেঙে গেছে। নিঃসাড়। প্রায় অচেতন। ফোন বাজছে মৃদুস্বরে। ঘর অন্ধকার । চোখে আলো ভালো লাগছে না। টানা ল্যাপটপ দেখলে জ্বালা করে চোখ। ফোন ধরে। ভিকি। ছোটবেলা। স্কুল। তারপর একজন আই আই টি। একজন দীনবন্ধু ।
    - খবর?
    - আমি অল ইন্ডিয়া রেডিও না। ন্যাশনাল দূরদর্শনও না।
    - দুঃশালা। কি করছিস?
    - কিছু না। বোর করতে ফোন করলি?
    - না মাইরি। শোন। কিছু টাকা হবে? টিউশন ফি একটাও দেয়নি। খুব দরকার ।
    এ পৃথিবীতে কি দরকার ছাড়া কোনো ফোনই আসতে নেই? ইরফান। তুমি আমাকে ড্রাইভ করে নিয়ে যাও সেখানে যেখানে ফালতু বকওয়াস দরকার ছাড়াও ফোন আসে। তোমার পাশেই বসবো আমি। ফ্রন্ট সিট । অ্যান্ড মাই বাবা ইজ নট অ্যাজ বদমেজাজি অ্যাজ ভাস্কর ব্যানার্জি ।
    নিঃশ্বাস হোল্ড করে জোরে ফেলল।
    - কত লাগবে বল। দুই দিচ্ছি। তার বেশি হবে না। গুগল পে।

    ✨মরণা ইঁহা

    সুখনলাল তিনজন মানুষকে চোখের সামনে মরে যেতে দেখল। কাল অবধি টেনে টেনে হাঁটছিল। পেটে কিছু নেই। রাস্তার কল পেলে জল। বুড়োটার জ্বর এসেছিল তিনদিন হল। জল এনে দিতে গিয়ে হাতে হাত ঠেকে যায় । বেশ জ্বর। বসিরহাটে বাড়ি। বয়স যা তার চেয়ে বুড়ো দেখায় বেশি। জ্বরে হলদেটে চোখ। খোঁচা সাদা দাড়ি। জোয়ান ছেলে মরে গেছে অ্যাক্সিডেন্টে। ঘরে তিন বেটি আর বিবি। না খাটলে চলবে কেমন করে? বুড়ো হাঁপায় আর এক দু ঢোক জল খায়। সুখন একমুঠ শুকনো মুড়ি এনে বলে খাবা? বুড়ো ফ্যালফ্যাল করে মুড়ির দিকে তাকিয়ে থাকে। ঢোক গিলতে ব্যথা। কোমরে ব্যথা। সারা গায়ে হাতে পায়ে অজস্র পিঁপড়ে কিলবিল করছে যেন। জ্বরজারি হয়েছে শুনলে দলের লোকজন এড়িয়েই যাচ্ছে এখন। রোগটা নাকি ছোঁয়াচে। সুখনও এড়িয়ে যাচ্ছিল। ক্যাতরানি শুনে কল থেকে জলটুকু দেওয়া। বুড়ো ঘাড় কাৎ করে চেয়ে রইল। শুকিয়ে তুবড়ে যাওয়া মুখে ঘোলাটে চোখ। হাতের বড় বড় নখে ময়লা। পুঁটুলিটা পেটের সঙ্গে ঠেসে ধরা। যেন ওটা দিয়ে বেরিয়ে যেতে চাওয়া দমটা আটকে রেখেছে। এ লোকটাও খাটতে গেছিল মাইরি! সুখন ভাবে। নির্ঘাৎ জোগান দিত। দেড়শো থেকে বেশি পাবার কথা না দিনে। এরা মুম্বাইতে কোনো খুপরি, বস্তি পায় না। বান্দ্রা ইস্টে বাঁধানো সমুদ্রপারে রাত কাটায়। বুড়োর চামড়া ফেটে রক্ত । সুখন খুব শক্ত মানুষ। একমাস কুড়িদিনের পিরীতে বারো বছরের সংসার ছেড়েছে। অবশ্য,মুম্বাইতে টাকা কামানোর মতলব বরাবর ছিল। জুহি শুধু ধুনোটুকু দিয়েছিল মাত্র। সুখন নিজের বাপকে চোখের সামনে মরতে দেখেছে। বিছানায় শুয়ে । পায়ের কাছে মা বসে মড়াকান্না কেঁদেছিল। বাপকে পুড়িয়ে সুখন শ্মশানে বসে ইয়ার দোস্তদের সঙ্গে মদ খেয়ে বাড়িতে ফিরে টেনে ঘুমিয়েছিল। মা আর বোন ঘরের দাওয়াতে বসে ঘিনঘিন করে কাঁদছিল সারারাত। কিন্তু এই বুড়োটা এমন করে কুঁৎছিল যে মনে হচ্ছিল হৃদপিন্ডটা বেরিয়ে আসবে মুখ দিয়ে । মুখ দিয়ে অনবরত লালা ঝরতে ঝরতে লোকটা মরে গেল। সুখন ততক্ষণে অনেকটা দূরে। লাশের কাছে কেউ যায়নি। পড়ে থাকল বুড়ো। ঝিমঝিমে রোদে একটা লাশ হয়ে পড়ে থাকল। মাছি ভন ভন করছিল পায়ের ওপর ঘায়ে। চামড়া ফেটে বেরিয়ে আসা শুকনো রক্তে। বছর পনেরোর একটা ছেলে, ঢ্যালঢ্যালে প্যান্ট খয়েরি রঙের। আঙুল তুলে বলল, মর গয়া বুডঢা। পিসাব নিকাল আয়া।
    একটা হলদেটে গিরগিটি ঝোঁপ থেকে বেরিয়ে এসে দেখল। তারপর তরতর করে মৃত পায়ের ওপর দিয়ে চলে গেল কালভার্টের নিচে। টুকটাক শুকনো পাতা ঝরে পড়লো লাশের ওপর। হিন্দি ছবিতে ভিখিরি বা পার্শ্বচরিত্র এইভাবে মরে যায় ।
    কেউ ছোঁবে না। শেয়াল কুকুর টেনে নিলে নিক। যদি ঐ রোগে মরে থাকে? দল চলে গেল নিজেদের মত। কেউ পেছন ফিরে তাকাল না। দুটো কুকুর এসে শুঁকছিলো বুড়োকে। তারপর টেনে খুলে ফেলল পুঁটুলিটা। দু চারখানা কাপড়, কাগজ কিসের টানাটানি করলো। পুঁটলিতে কোনো খাদ্যবস্তু না পেয়ে একটা লুঙ্গি টেনে ছিঁড়ে খেলতে লাগল কুকুরদুটো। মাঝে দু একবার আবার শুঁকে এল লোকটাকে। কালভার্টের নিচে বয়ে যাচ্ছে কালো জল। গিরগিটিটি একবার মাথা তুলে দেখল অপসৃয়মান দলটিকে। মৃতদেহটি ততক্ষণ ঐ চিত্রার্পিত গাছ, শুকনো পাতা, ধুলো, কাদা, পাথরের মতোই অনিবার্য হয়ে গেছে।
    একটা চিরুণী। মাদুলি। লুঙ্গিটা টানাটানিতে ছিঁড়ে অদ্ভূত ভাবে বিছিয়ে। সুখনলাল ছেলের বইতে দেখেছে। একটা ম্যাপের মত। একটা দেশের ম্যাপ।
    একটা গোটা ভারতবর্ষ নেতিয়ে শুয়ে থাকল রাস্তার ওপর। ছোট ছোট হলুদ প্রজাপতি নেচে গেল বাতাসে।
    লছমির মরা খুব আচম্বিতে। তুমুলভাবে থালি বাজাচ্ছিল মেয়েটা। উড়োখুড়ো চুল। চোখ ঠিকরে আসছিল যেন। হঠাৎ মুখ থুবড়ে পড়ে রক্তবমি করল। আর মরেও গেল টপ করে। মা ছিল লছমির । বলল হার্টের দোষ ছিল মেয়ের ছোটবেলা থেকে। সামনের দাঁত একটু উঁচু। উলোঝুলো রোগা মেয়ে । তারপরেও বডি নিয়ে ঝামেলা । কেউ ছুঁতে চায় না। এন জি ও'র ছেলেরা ছিল বলে একটা গতি করা গেছে। ওরা হাসপাতালে বডি দিতে বলছিল । কে যাবে বডি নিয়ে হাসপাতালে । লছমির লাশ কোথায় চলে গেল কেউ জানে না। যারা নিয়ে গেল তারা কি আদৌ পুড়িয়েছিল না ফেলে দিয়েছিল কোথাও, লছমির মাও জানে না।
    তিন নম্বর মরাটা বুধনের । খুব ভোর তখন । রাত থেকে চলা শুরু ওদের। গুণা টাউনের কাছে প্রায় পৌঁছে গেছে। একটা ট্রাক আর বাসের ধাক্কায় বুধন কেমন করে মাঝখানে ফেঁসে গিয়ে মরে গেল। চলতে চলতে ঘুম ধরেছিল বোধহয়। চাঙা ছিল ছেলেটা। হুড়হুড় করে পথ চলত। কথা একটু জড়ানো। সুখন যে এরিয়াতে খাটত সেদিকের কন্স্ট্রাকশনের কাজেই ছিল ছেলেটা। ভোরবেলা সবাই খুব ব্যস্ত ছিল টাউনে ঢোকার জন্য। টাউনে ঢুকলে খাদ্য পাওয়া যাবে কিছু না কিছু। হয় ত্রাণ। নয় এন জি ও। পাঁউরুটি । চাল। ডাল। তাই বুধনের থেৎলে যাওয়া লাশ নিয়ে মাথা ঘামানোর সময় নেই কারো। তাড়াতাড়ি খাবার নিয়ে পুলিশের নজর থেকে ভাগতে হবে। সবাই ব্যস্ত ছিল। টাউন থেকে খাবার জোগাড় করে পালাতে হবে তাড়াতাড়ি । বাড়ি যেতে হবে। বাড়ি ।

    নেই নেই করেও গোটা আষ্টেক নতুন রেসিপি। নিরামিষ মুড়িঘন্ট। পেঁয়াজের পায়েস। ইউটিউব ও ফেসবুকের দৌলতে শিখেছে। রেঁধে টেবল সাজিয়েছে সুন্দর করে। স্কুল থাকলে সময় পায়না। এই অঢেল সময় । অনলাইন ক্লাস বারোটা থেকে। তার আগে পরিপাটি টেবিল। সুদৃশ্য বাসন। সুস্বাদু খাদ্য। ও জানতো বা ওকে ছোট থেকে জানানো হয়েছিল এভাবেই অন্যের মন পেতে হয়। ও টেবিলে চেক টেবিলক্লথ তুলে লেস বসানো সাদা চাদর পাতে। কোবাল্ট ব্লু ম্যাটে সাদা ধবধবে পোর্সিলিনের,প্লেট। জুঁইফুল সদৃশ বাটি উপুর ভাত। এক কোণে লেবু লঙ্কা। দুরকম ভাজা। মগডালে লাউ। সর্ষেবাটা পাবদা। আমের টক। আয়েসের দুপুর। কিন্তু ততটা আয়েস নয় যতটা দেখা যায় । বর এসে শেয়ার মার্কেটের খবরে মুখ গুঁজে খাবে। নুন বেশি কম নিয়ে কিছুই বলবে না। পাবদা না বাঁধাকপি তাই নিয়েও মাথাব্যথা নেই। এখন টেনশনে খাওয়া বেড়ে গেছে বলে ভাতটা বেশি খাচ্ছে। ডালের জল বা মাংসের ঝোল সব সমান প্রায়। মেয়ে কোনোদিন টেবিলে বসবে। কোনোদিন বসবে না। বসলেও নাকশিঁটকে মাছ খাবে। বেশিরভাগ দিন টক দই আর স্যালাড খেয়ে উঠে যায় । যদি বসে বই বা ফোনে মুখ গুঁজে থাকে। সে হাঁসফাঁস করে। এরা বাড়িতে থেকেও নেই। তার অত যত্ন করে রাঁধা পোস্তনারকেল চিংড়ি কেঁদে ফেরে। এসব কি একা খাওয়া যায় । মেয়ের বাবার তো কোনো হেলদোল নেই। মেয়ে চরম। বারবার মনে করাবে করোনাতে লোকে না খেতে পেয়ে মরছে। সে ভেবে পাচ্ছে না সে কি করবে। পি এম ফান্ডে টাকা। বন্ধু এন জি ও তে টাকা। দিয়েছে তো। কাজের মেয়েদের ছুটি। অ্যাডভান্স দিয়েছে। তারপর একটু স্বস্তিতে থাকবে না? সংসার সাজাবে না? সে যদি এসব না করে তাহলে করোনা থেমে যাবে বুঝি! অতিমারী শেষ? নাকি সব না খেতে পাওয়া লোক খেতে পাবে? ভেবে ভেবে ঘেমে যায় । বেরসিক বর আর রগচটা মেয়ে নিয়ে বিরক্ত লাগে। এর চেয়ে স্কুল খোলা থাকলে শাড়িগুলো পরা যায় লেডিস ক্লাব আছে। নাচ। গান। রান্না। সেসব বন্ধ থাকাতে ফাঁকা লাগে। ছেলেটা পুনেতে একা একা কি ছাইভস্ম রেঁধে খাচ্ছে কে জানে। হট ফ্লাশেজ আসে তার ঘন ঘন। মেনোপজাল ডেজ আর হার্ড। কেউ বোঝে না। না বর। না মেয়ে । বলে ঘ্যান ঘ্যান করছো। সে যে যত্ন করে মাটির কলসিতে সাদা ফুল এঁকে লাল টেবিলক্লথ পেতে বসিয়েছে, সেটা এরা কেউ খেয়াল করে না। সুজাতা বা মীরা । রুপালি বা তিয়াসা হলে খেয়াল করতো ঠিক। ওর কোলিগ। এমনকি শ্যামা। শ্যামা থাকলে ঠিক বলতো, কি সুন্দর এঁকেছো গো বৌদি। আমাকে শেখাবে? এইটুকুতে ওর হট ফ্লাশ কমে যায় । শরীর মন আশ্বস্ত হয়। শ্যামা বলে , আজ পোস্তটা কি ভালো রেঁধেছো গো। একেবারে ঝরঝরে । কি করে পারো বউদি? আমাদের তো হয় না। এইসব দরকার হয়। জীবনে দরকার হয়। নইলে শরীর ভারি লাগে। মন ফাঁকা। শ্যামাটা কেমন আছে কে জানে। বরটা তো শালীকে নিয়ে মুম্বাই ভেগেছে। দিব্যি আছে হয়তো।
    শ্যামার যদি কোনো আক্কেল থাকে। ঐরকম উঠতি বয়সের বোন বাড়িতে রাখে কেউ? তারপর আবার নিজে বাড়িতে থাকিস না। ভাবতে ভাবতে আরেকটু ভাত মাখে মুগ ডাল দিয়ে । ঘীয়ের গন্ধটা বেশ।
    বনলক্ষ্মীর ঘী। যখন ইলামবাজার যায়, দুকৌটো নিয়ে আসে। আবার কবে বেরোতে পারবে কে জানে। দম আটকে যায়। শান্তিনিকেতনে দুপুর। ডোকরার গয়না ওর কানে। হাতে। গলাতে। মাছটা ভালো। এখন পাড়াতে প্রচুর মাছ আসছে। বাজার বন্ধ। সবজি। মাছ। সব পাড়াতে হেঁকে যাচ্ছে। দাম বেশ বেশি। কিছু করার নেই। বললে বলছে, কত ঝ্যামেলা করে আনতে হচ্ছে দ্যাখেন। ও কেনে। বেছেবুছে কাগচি, কুচো চিংড়ি, বাটা। এ সময় ট্যাংরা আসছে খুব। আলু বেগুন বড়ি দিয়ে চচ্চড়ি । কিনলে ওই লোকগুলোরও তো দুপয়সা ঘরে যায় । যায় কিনা। আমের টক চাটে টকাস টকাস করে। বর উঠে গেছে। মেয়েও। টেবিল থেকে প্লেট তোলে। এঁটো। সিঙ্কে রাখতে রাখতে ভাবে, শ্যামাকে ফোন করবে একটা। খোঁজ নিতে হয় কেমন আছে পাগলীটা।

    ✨পদায়নী

    উডালি নেচে চলেছিল আশ্চর্য অনায়াস ছন্দে। কী নিবেদিত সেই নাচ। ঘুঙুরের শব্দে উত্তাল মন্দিরপ্রাঙ্গণে সে নেচে চলেছে তো চলেইছে। মারার এসেছিলেন তাঁর পবিত্র প্রদীপখানি জ্বেলে। এই নাচ ঘূর্ণাবর্তের মত। জ্যামিতিক পদ্ধতিতে প্রতিটি পদক্ষেপ পড়ে চলেছিল। পুরোহিতের হাতে বাহিত থিডাম্বুতে দেবী আবির্ভূত হয়েছেন। শস্যদেবীর মুখ কী প্রসন্ন। এই নাচ তো তাঁর প্রসন্নতাপ্রাপ্তির জন্যেই!মকরম। কুম্ভম। মীনম। মেডাম। এভাদাম। এই কয়েকমাস জুড়ে দেবীর আবাহন। জানুয়ারি থেকে মে মাস। পাদায়নী। দেবীর পানপাতাসদৃশ মুখে দীঘল চোখ। এইবার পারায়েদেপ্পু অনুষ্ঠিত হবে। পুরোহিতের হস্তবাহিত থিডাম্বুতে আরোহণ করে দেবী যাবেন গ্রামের প্রতিটি ঘরে। বাজনা বাদ্যি সঙ্গে যাবে। কী মধুর নিক্কন! বাঁশি! গৃহবাসী শস্য,বা অর্থ দেবেন দেবীর কোঁচড়ে। শস্যগন্ধে ভরপুর গ্রামে খুশির জোয়ার। পাদায়নী শুরু হয়েছে। দেবী হাসছেন ফসলের মুখে। চেলেঙ্গার পুরোনো সার্কিট হাউসের পিছনের মন্দিরের কালো পাথরের গা বেয়ে গড়িয়ে পড়ছে শস্যসমৃদ্ধি। মস্ত চাতালে ঘি, কর্পূর, ফুল, ফল ও শস্যের গন্ধ ম' ম' করছে।
    পলি ঘুমের মধ্যে হাসছিলেন। তাঁর কোঁকড়ানো চুলে , মুখে হালকা আলো এসে পড়েছে। ঘুম ভেঙে প্রথমেই পলির মনে পড়ল , এই বছর পদায়নী হয়নি। দেবী কোথায় অদৃশ্য হয়েছেন। হিন্দু রিচুয়াল হলেও পলি ছোটবেলা থেকে পদায়নী দেখে আসছেন । এই আচরণ তাঁর কাছে চার্চে যাবার মতোই স্বাভাবিক । বিছানায় অনেকক্ষণ চুপ করে বসে থাকলেন পলি। সরকারী নির্দেশে কোনো জমায়েত হবে না। এমনকি সব ধর্মাচরণ নিষিদ্ধ । পদায়নীর সময় যে উর্বর খুশি ব্যাপারটা থাকে সেটা উধাও। চারদিকে থমথমে ভাব। অনিল কোয়ারেন্টাইনে আছেন যখন থেকে তখন থেকে প্রতিবেশীদের সঙ্গে যাতায়াত নেই। শুধু ভলান্টিয়ার ছেলেদুটির মুখ দেখা যায় মাঝে মাঝে। ফাইব্রোসিস নেই শুনে খুব হালকা হয়েছেন পলি। কিন্তু কোয়ারেন্টাইনের আঠাশ দিনের কোটা পূর্ণ করতেই হবে। সেকেন্ড রিপোর্ট নেগেটিভ আসুক। মনে মনে শুধু তাই ভাবছেন পলি। ছেলে মেয়ের স্কুল বন্ধ । বাগানেও যেতে পারছে না বেচারারা। বাগানে ছাড়লে ঠিক আউটহাউসে বাবার কাছে চলে যাবে! বাড়ির মধ্যে আটক দুটো বাচ্চাকে ম্যানেজ করা খুব কঠিন। নানারকম খাবার বানিয়ে, ছবি আঁকতে দিয়ে ওদের এনগেজড রাখার চেষ্টা করেন পলি। কিন্তু খাবার বানাতেও ডিপ্রেসড লাগে তাঁর। চাপা একটা দমবন্ধ করা পরিবেশ। ফাইব্রোসিস নেগেটিভ শুনে একটু হাল্কা হয়েছেন ঠিকই কিন্তু সেকেন্ড রিপোর্ট না আসা পর্যন্ত শান্তি নেই। এখন সকালে উঠেই খবর শোনা অভ্যেস হয়ে গেছে। কফিমেকারে কফি দিয়ে টেলিভিশন চালিয়ে দিলেন পলি। একশোজন কনফার্মড কোভিড কেস কেরালাতে। দুজন মারা গেছেন। বাকি আটানব্বইয়ের মধ্যে অনিল একজন। পলি দম চেপে বাথরুমে গেলেন। অনিলকে ফোন করবেন একটু পরে। ব্রেকফাস্ট কি হবে ঠিক করে নেবেন। আপাতত স্বাস্থ্যকর খাদ্য প্রস্তুত করা, হাইজিন বজায় রাখা আর বাচ্চাদের সামলে রাখা ছাড়া তাঁর আর কোনো কাজ নেই।
    অনিল খুব ভোরে উঠে বাগানে হাঁটছিলেন। ঘুম ভালো হয়নি রাতে। দেবরূপ হ্যাজ রিটেন অ্যাবাউট দ্য স্পট। ইট ক্যান বি ম্যালিগন্যান্ট । ফাইব্রোসিস কি এর চাইতে ভালো ছিল! কিছু বুঝতে পারছেন না অনিল । ফ্রম ফায়ার টু ফ্রাইং প্যান হল কি? পলিকে এখন কোনোমতেই স্পটটার কথা বলা চলবে না। ভেঙে পড়বে একেবারে। দেবরূপকে বলে দিতে হবে এটা নিয়ে পলির সঙ্গে যেন কোনো আলোচনা না করে। বাড়ির পিছনের দেওয়ালের ওপারে প্রচুর কলা গাছ। সবুজ ভাসিয়ে নিয়ে যাচ্ছে চারদিক। আগে বাদুড় আসতো কলা খেতে। এখন আসে কি? চোখ কুঁচকে অনিল সবুজ সমুদ্রে একটা দুটো কালো ঝুলন্ত শরীর খুঁজতে চাইলেন। চোখ বেশ খারাপ হয়েছে। এবার বোধহয় বাই ফোকাল প্রয়োজন। বুঝতে পারছিলেন। শরীর আর মনের সমস্ত শক্তি দিয়ে একটি ভাইরাসের সঙ্গে লড়ছিলেন অনিল। প্রোটিন সেনাবাহিনী সংহত হচ্ছিল শরীরে। ডিফেন্স মেকানিজম অ্যাক্টিভেটেড। ইন্টারফেরন আর সাইটোকন সক্রিয় হচ্ছে। আইসোলেশনে। যত্নে। সেবায়। সতর্কতায় । সাইটোকন স্টর্ম শুরু হয়েছে শরীরে। টের পাচ্ছেন অনিল। সমস্ত শরীর মন একত্রিত করে। ফুসফুস কি বলে? এপিথেলিয়াল স্তর এত চাপ নিতে পারবে তো? অনেক খুঁজেও একটি বাদুড় পেলেন না অনিল। পদায়নীর সময় বয়ে যাচ্ছে। কিন্তু শস্যের মিষ্টি গন্ধ উধাও। ডিসিনফ্যাকট্যান্টের গন্ধ ছড়িয়ে আছে সারা বাড়িতে । অনিল কোথাও এতটুকু শান্তি পাচ্ছিলেন না।
    শ্যামা আর হরপ্রীত মুখোমুখি বসে মাস্ক তৈরি করছিল। ফেসশিল্ড বানাতেও শুরু করেছে ওরা। হোলসেল বিক্রি হচ্ছে। প্রচুর ডিম্যান্ড। ম্যাচিং মাস্ক বানাচ্ছে ওরা। বাটিকের । ইক্কতের । বেলিও চলে এসেছে মাস্ক বানাতে । বাড়িতে বসে বরের মার খাওয়ার চেয়ে মাস্ক বানিয়ে দুটো পয়সা আনা ভালো। ঘরে তক্তপোশ আর টেবিল রেখে মাটিতে সামান্য জায়গা। তার মধ্যেই ছেঁড়া মাদুর পেতে রাশি রাশি কাপড় নিয়ে বসেছে । হরপ্রীতের মুখে ওর নিজের বানানো মাস্ক। ওর এতটুকু এদিক ওদিক হয় না। ভীষণ সতর্ক। লম্বাটে গড়ন। টকটক করে সেলাই মারছে। মাস্কের আড়াল থেকেই বলল, আগর এক মেশিন হোতা তো কিতনা আচ্ছা হোতা। আউর ভি জলদি বানা লেতি। বেলির কচি মুখ ছেঁড়া কাপড়ের ফালিতে ঢাকা। কেটে যাওয়া ঠোঁট আর,গালের কালশিরে ঢাকা পড়েছে অন্তত। হরপ্রীত বলে, তু হরওয়ক্ত মাস্ক পহেনকে রহনা। উও মার কি দাগ দিখ নহি যাতা।
    শ্যামা মাস্ক পরে থাকতে পারে না। ভীষণ ঘামতে থাকে। সে বড় জ্বালা। চোদ্দবার মাস্ক খুলে ঘাম মোছে। শেষে খুলে রেখে দেয়। টিভিতে বলছিল, বেশি করে দুধ, মাছ, মশলা খেতে । ওরা মাস্ক বানাতে বানাতে হেসে বাঁচে না। মোটে মায় ভাত দেয় না। তার তপ্ত আর পান্তো! মশলা! ধনে, জিরে! এখানে আছে দাম! আবার বলে বাইরে যাবে না। কাজ বন্ধ । তো খাবে কি? টিভিওয়ালারা রেশন দিয়ে যাবে ঘরে? হাতে ছুঁচ ফুটে যেতে শ্যামা অস্ফুটে বলে, দুঃশালা। তখনি ফোন আসে। বুক ধক করে ওঠে শ্যামার । কে করে ফোন? সেই লোক? ঠোঁট দিয়ে আঙুল চুষতে চুষতে হ্যালো বলে। মাস্ক ঝুলছে গলায়। ওপার থেকে যুধিষ্ঠির বলে, জনধন অ্যাকাউন্টে টাকা ঢুকেছে কিনা খোঁজ নিলা? না বাড়ি বসে ঘুমাও।
    আনমনা হয়ে গেল শ্যামা। যুধিষ্ঠিরের সঙ্গে দেখা হয়না। অনেকদিন।

    ✨ত্রিদিব। একা।

    সকালবেলাগুলো কেমন গুমোট হয়ে থাকে। ত্রিদিব ঘুম থেকে উঠেই এসি বন্ধ করে জানলা খুলে দিলেন। মালবিকা অনেক রাত জাগেন। নেটফ্লিক্স। আমাজন প্রাইম। হৈচৈ। আরো কিসব ডাউনলোড করা আছে। রাতে খেয়ে উঠে শুরু হয় ফিল্ম দেখা। কাজেই উঠতে বেলা বয়ে যায় । আটটার আগে ওঠেন না। নিঃশব্দে দরজা বন্ধ করে বেরিয়ে এলেন।
    ত্রিদিব উঠে চা বানাচ্ছেন। আগের রাতেই সব গুছিয়ে রেডি করা থাকে। টিভিতে খুব বলছে , আদা খাও। রসুন খাও। তেজপাতা ব্যবহার করো। ছাতে যাবার আগে চা করেন তিনি। চায়ের কাপ নিয়ে ছাতে যাবেন। বয়স বাড়ছে। মধ্যপ্রদেশ স্ফীত হচ্ছে। কোভিড নাইন্টিন ধরে ফেললেও ফেলতে পারে। আজ কি খেয়াল হল, জলে বেশ করে তেজপাতা, লবঙ্গ, গোলমরিচ দিয়ে ফোটাতে লাগলেন। মালবিকা দেখলে হাহাকার করতো। ডলিজ থেকে আনা সেকেন্ড ফ্লাশ তুমি এইভাবে নষ্ট করছো! মালবিকার কাছে এইসব খুব ম্যাটার করে। ফার্স্ট ফ্লাশ। সেকেন্ড ফ্লাস। হোয়াইট। জেসমিন। কোনটার সঙ্গে কি কুকিজ। কোনটার সঙ্গে ওয়েফার। তিনি এইসব একেবারে বোঝেন না। বাংলা মিডিয়াম। অংকে মাথা পরিষ্কার ছিল। যার জন্য অন্য বিষয়গুলো উতরে যেত। হস্টেলে মেসে থেকে নিজের কাজ নিজে করার দিব্য অভ্যেস আছে। কোভিড আসার পর সজাগ মস্তিষ্ক এবং অংককষা অভ্যেস দিয়ে একটা ছক করতে চাইছেন। এটা পরিষ্কার যে ভাইরাস পাঁজি দেখে দিন তারিখ মেনে বিদেয় হবে না। ভ্যাকসিন অনেকদিন গল্প হয়ে থাকবে। তবে
    পেট্রলের দাম বাড়বেই আর ট্যাক্সের কোপ ঘাড়ে পড়বে। ইমিউনিটি ঠিক রাখা ছাড়া কোনো উপায় নেই। কঠিন দিন আসছে। তাঁরা দুজনে রোজগার করেন। ছেলে দাঁড়িয়ে গেছে। মেয়ে ভালো স্কলারশিপ পায়। কোনো দায়দায়িত্ব নেই। তবু। ডেজ আর হার্ড। তেজপাতা, লবঙ্গ, দারচিনি, এলাচ থেঁতো করছেন হামানদিস্তায়। বেনারস থেকে কেনা মালবিকার শখের হামানদিস্তা। চা পাতা। আধ চামচ চিনি। তাঁর সুগার নেই। পাশ থেকে মিহি গলা ভেসে এল।
    - পোড়া কপাল আমার। চা চাও বউ তরে বানায়ে দেয় না?
    - ওহ ঠাকমা। এ কোনো কথা হল? তোমাকে কত চা বানিয়ে খাইয়েছি আমি বলোতো?
    -তহনের কথা আয়লেদা। তহন তুমি বিয়া করো নাই। ব্যাসিলর আসিলা।
    - বাপরে তুমি ইংরিজি কপচাচ্ছো ঠাকমা? তা বিয়া করলে নিজের কাজ নিজে করা যাবে না কে কইল।
    - কেউ কয় নাই। বউ এত বেলা অবধি পইড়া পইড়া ঘুমায় ক্যান? লজ্জা হায়া নাই?
    - বুঝতে পারছো না। বাড়ি থেকে অনলাইনে ইশকুলের কাজ করতে হয়। তারপর রান্না। বাসনমাজা। ঘরদোর পরিষ্কার করা। সব নিজে করছে। শ্যামা তো আসছে না। বুলকিও না।
    - ক্যান? আহে না ক্যান?
    - অতিমারী চলছে ঠাকমা। সবাইকে ঘরে থাকতে হবে। দেখছো না ঘরে বসে আপিস করছি?
    - তাই কও। আমি ভাবি তর বুঝি চাকরি গেসে। কিংবা রিটায়ার হইছিস!
    - চাকরি গেলে গলায় দড়ি দিতে হবে ঠাকমা। এমনিতেই কোম্পানিগুলোতে ছাঁটাই শুরু হয়ে গেছে। ইকুইটি মার্কেটে তিরিশ পার্সেন্ট কমতি চলছে এখনি। ব্যাংক সুদ কমাচ্ছে।
    - বালাই ষাট! দড়ি দিক তর শত্তুর। তুমি বাঁইচ্যা থাকো গোপাল। আট্টু চিনি লও চায়ে। অত কম খাইলে হয়?
    - এইটুকু চিনি খাই দেখলেও তোমার নাতবউ রেগে যাবে গো। আজকাল চিনি কেউ খায়না।
    তিনি উদাস হয়ে যান।
    - ভালো। বউয়ের ভয়ে কাঠ হইয়া থাকো। তাও যদি সকালে উইঠ্যা চা দিতো। সে তো নাক ডাইকা ঘুমায়।
    - টিপিক্যাল খুঁতখুঁতে ঠাকমাশাশুড়ি হয়ো না তো। চলো ছাতে যাই।
    - ছাতে গিয়া দৌড়াইবি?
    - নাহ্। আজ আর দৌড়াবো না। বসবো। তোমার বউমা কেমন সুন্দর ছাত বাগান বানিয়েছে দেখেছো?
    - দেখসি। তাও বলি মেয়েমানসের এত বেলা কইরা শুইয়া থাকা ভাল না। সংসারের অমঙ্গল হয়। সংসারের কাজ কি আমরা কম করসি?রান্না করসি। কাপড় কাচা। ঘর ঝাড়ু । মোছা। বাচ্চা সামলান। তাও তো এখন একডা দুইডা বাচ্চা। আমার ছয়ডা আসিল। আমরা এত শুইয়া থাকি নাই । চা কেমন বানাইছস?
    তিনি অন্যমনস্ক মাথা নাড়লেন।
    ছাতবাগান দেখে অতিমারীর কথা বোঝা যায় না। বুগনভোলিয়ার সবুজলতা ঝাড় বেঁধে উঠেছে। রাণী রঙের ফুল। পেয়ারা। মাসুন্ডা অনেক। বিভিন্ন রঙের। দু চারটে পাখি আসে এসময়। বেশ লাগে। লকডাউনের কথা মনেও থাকে না। রাস্তা দিয়ে ফেরি করে সবজি, মাছ যাচ্ছে। এরা মাছ কেটেও দেয়। মালবিকা মাছ কাটতে পছন্দ করেন না। রাঁধতেন ভালো। চায়ের কাপ রেখে ঝুঁকে পড়লেন । তাঁর গেটের সামনে সবজিওয়ালা। মালবিকা উঠে পড়েছেন। বেছে বেছে পটল দেখছেন। ঝিঙে। মালবিকার ষষ্ঠেন্দ্রিয় অতি প্রখর। তাঁর মনে হল ত্রিদিব ছাতে। ঠিক টক করে ওপরে তাকালেন।
    - অত পটল নিচ্ছো কেন?
    - দোরমা করবো। মাংসের পুর দিয়ে । শোনো। কুমড়ো নেবো? মাছের মাথা দিয়ে খাবে আজ?
    - বউডা খাউকি আসে। বলে ঠাকমা অদৃশ্য হলেন। গোপাল দশা কাটিয়ে ত্রিদিব দায়িত্বশীল স্বামী, অভিভাবকের দশায় এলেন।
    - নাও। কম করে। গ্যাস হচ্ছে মিষ্টি কুমড়োতে।
    সবজিবিক্রেতা আগে রিক্সা, তারপর টোটো চালাতো। এখন সবজি আনছে।
    - তুমি নিচে নামো। আমার কাছে খুচরো নেই। পাঁচশো।
    - কাকিমা চারশ সত্তর হয়েছে।
    - বলো কি? মাথা খারাপ? এই কটা গাজর। আলু। পটল। ঝিঙে। ফুলকপি ....মোচাটা কত ধরেছো?
    - খুব কষ্ট করে আসছি কাকিমা। তাও পাচ্ছি না রোজ। ঠকাচ্ছি না আপনাকে।
    মালবিকা বালতি নিয়ে এসেছেন। ব্যাগে নয়। বালতিতে সবজি যাচ্ছে। সোজা কলের তলায় ফেলবেন। সোডি বাই কার্ব দিয়ে ধোবার পালা। মালবিকার এক হাতে বালতি। অন্য হাতে রাতপোশাক সামান্য উঁচু করে ধরেছেন। পাশবালিশের খোল পরে কেন যে বাইরে যায়!এই অভ্যাসটা গেল না মহিলার। বাকি সব মোটের ওপর মন্দ না। ভাবতে ভাবতে নামলেন ত্রিদিব।
    একটা টিকটিকি নামল তাঁর সঙ্গে । সিলিং বেয়ে। তারপর সুড়ুৎ করে ঢুকে গেল মেয়ের ঘরে। যেন নিজের ঘরেই যাচ্ছে। মনে হল। ভালো। জীব জন্তু পোকা মাকড়ের আপন আপন ভাব থাকা ভালো। ওতে প্রাণে শান্তি থাকে। তবে লকডাউনে মিষ্টির দোকান খুলে গেছে বলেও ত্রিদিব বড় শান্তি পেয়েছেন।

    ✨পরকীয়া করোনায়

    দশরথ নামেও দশরথ, কামেও দশরথ। শ্যামাকে ভালোই বাসে মনে হয় । কোনোদিন এক কেজি আলু। কখনো কিছু পেঁয়াজ । লঙ্কা । মানে যেদিন ওর নিজের বিক্রিবাটা ভালো হয় , সেদিন শ্যামার জন্য তুলে রাখে। অবশ্যই দশরথের বউ জানে না। জানলে তুলকালাম করবে। কাজের বাড়ি ফেরত শ্যামা ব্যাগ ভর্তি করে নিয়ে আসে। লকডাউন হয়েছে পর থেকে বাজার বন্ধ । দশরথ রেললাইনের দিকে কোথায় একটা বসছে। করপোরেশন থেকে ঠিক করে দিয়েছে। কাজেই দেখা সাক্ষাত্ নেই। তাও যে ডেকে পাঠালো তাতে শ্যামার মনটা ফুরফুরেই হয়ে উঠল। আগে তো কখনো লোকটাকে তেমন পোঁছেনি । সুখনলাল চলে যাবার পরে মন যেন কেমন ছটফটে হয়ে উঠল। সুখনলালের সঙ্গে সংসার বড় মন দিয়ে করছিল শ্যামা। এই যে ভোরবেলা উঠে ফ্যানাভাত , সিদ্ধ করে টেবিলে চাপা দিয়ে কাজের বাড়ি বেরিয়ে যেত সারাদিনের জন্য, সে তো সংসারের সুখের জন্যেই। যাবার আগে শাশুড়ির সবজিও কেটে রেখে যেত। কোনোদিন পরপুরুষের দিকে ফিরে তাকাত না। দশরথ কত রঙ্গ করে কথা বলতো আসতে যেতে । শ্যামা থোড়াই গ্রাহ্য করতো। সিঁথি ভরতি করে সিঁদূর শ্যামা তখনো পরতো। এখনো পরে। কিন্তু সেই সময়কার শ্যামাতে আর এখনকার শ্যামাতে আকাশ পাতাল ফারাক। এখন তার মনের মধ্যে ধিকিধিকি আগুন জ্বলে। যখনই জুহির মুখটা মনে পড়ে, মনে মনে সেই মুখে সপাটে চড় মারে শ্যামা। মেরেই যায় । যতক্ষণ না জুহির মুখ দিয়ে রক্ত নির্গত হয়। আর সুখনলালের হাসিমুখ মনে পড়লে এখন শ্যামা মুখ ফিরিয়ে মনে মনে দশরথের রঙ ঢঙে সাড়া দেয় । সুখনলালের দিকে মনেমনে ফিরেও তাকায় না। সুখনলালের সমস্ত সুখে বিষ ঢালে। থুতু দেয়। নিজের মাথার চুল নিজে ছিঁড়ে ফেলে ভর সন্ধ্যাবেলা। সুখনের মা তার দিকে তাকিয়ে বিড়বিড় করতে থাকে। মর, মর, মর আবাগীর বেটি। প্রেতিনীর মত বিধ্বস্ত আলুলায়িত চুল শ্যামা কলপাড়ে দাঁড়িয়ে হাঁপায় । তারপর বালতি করে জল ঢালে শরীরে। আবার সেই শ্যামাই একচিলতে ঘরের এককোণে ঠাকুরের আসনে দাঁড়িয়ে শাঁখাতে সিঁদূর ছোঁয়ায়। সুখনের আয়ু কামনা করে । করতে হয় বলেই করে। বউয়ের লেবেল সেঁটে গেছে যে কপালে। আর সেটা দিয়েই তো আত্মরক্ষা করে সে। আবার কোনোদিন মন ভার করে বসে থাকে। ছেলেটা এসে ম্যা ম্যা করলে বিরক্ত হয়। কাজের বাড়িতে ভালো থাকে এরচেয়ে বেশি। মন উথালপাতাল করে না। হরপ্রীত আসছে বলে বেঁচে গেছে শ্যামা। মেয়েটাকে দেখলে মনে জোর আসে। বেশ কয়েকজায়গাতে মাস্ক সাপ্লাই করছে হোলসেলে। লকডাউন হয়ে ওষুধের দোকান তো সাপ্লাই দিতে পারছে না।
    বুড়ির জ্বর কমে না কিছুতে। পুরোনো শাড়ি ছিঁড়ে কপালে পটি দিয়েছে সারা বিকেল। গরম চিড়বিড় করছে। দুপুরবেলাটা হাঁসফাঁস লাগে। বিকেলে আরো কঠিন । মাটি তাপ ছাড়ে। মাটি তাপ ছাড়লে কি হয় তা শ্যামা খুব জানে। ওর কুচকুচে কালো চুলে তেল দিয়ে খুব শক্ত করে বাঁধলো। হরপ্রীত তখনো সেলাই করে যাচ্ছে। ছেলের সামনে মুড়ি আর চানাচুরের বাটি ধরে দিয়ে বলল ঠাকুমার খেয়াল রাখ। বাইরে যাবি না। হরপ্রীতকে বলল, শাশুড়ির ওষুধ নিয়ে আসছি। বলে হনহন করে রওনা দিল। কি বলে দশরথ। অ্যাকাউন্টে টাকা ঢুকবে । কোন টাকা। কিসের টাকা ।
    রাস্তাঘাট ফাঁকাই বলতে গেলে। মোড়ের মাথার মিষ্টির দোকান বন্ধ । ফলে জটলা নেই। কুকুরগুলো নির্জীব হয়ে শুয়ে আছে এদিক ওদিক। দোকানগুলো খোলা থাকলে তবু কিছু খেতে পায়। রেললাইনের ধারে দশরথ বসেছে সবজি নিয়ে । পাঁচটা বাজল। এখন উঠে যাবে। শ্যামাকে দেখে উঠে দাঁড়ায় । আরো পাঁচ ছয়জন সবজি নিয়ে বসেছে। সবাই উঠে উঠি করছে । এখন শ্যামাকে কেউ অত নজর করবে না। আর করলেও শ্যামা কেয়ার করে না। সুখনের কীর্তির পাল্টা জবাব দিলে ক্ষতি কি। দশরথ কি তাকে দেখে গললো আগের মতো? না লকডাউনে বউয়ের আঁচলধরা হয়ে গেছে?মাঝেমাঝেই বিধ্বংসী হয়ে ওঠে শ্যামা। অন্যের সংসার ভেঙে গুঁড়িয়ে দিতে ইচ্ছে করে। ছেলেটার কথাও মনে থাকে না।
    দশরথ কাজের কথাই বলল । ব্যাংক থেকে টাকা তুলতে পারছে না শ্যামা। প্যানকার্ড নেই। দশরথ বলেছিল ওর চেনা লোক দিয়ে আধারকার্ড করিয়ে দেবে। কিন্তু আধারকার্ড ভুল আছে শ্যামার। জন্মতারিখ নেই। শ্যামা বাড়িতে জন্মেছিল। তিন বোন এক ভাইয়ের পর পাঁচনম্বর। সার্টিফিকেট কোত্থেকে পাবে? আধারকার্ড না হলে তোকে ভাগাবে দেশ থেকে। দশরথ চোখে মজা, ঠোঁটে গম্ভীর ভাব রেখে বলল। শ্যামার মাথায় আকাশ ভাঙে। এসব কি বলছে দশরথ?
    ইরফান, টেক মি আউট অব লকডাউন
    অনন্ত জলস্রোতের মধ্যে দিয়ে সে ভেসে যাচ্ছিল। চেতনা অবলুপ্ত নয়। মাথার মধ্যে স্পষ্ট এক কুলকুল শব্দ। যেন জলধারা মস্তিষ্কের কোষে কোষে প্রবেশ করে তাকে আচ্ছন্ন করে ফেলছে এবং পরমুহূর্তেই জাগিয়ে তুলছে এক অন্তর্লীন শারীরবৃত্তীয় প্রক্রিয়াতে। সে শুধু শরীর নয়। সে মন নয়। তারও অধিক কিছু। বইয়ের স্তূপের মাঝে ওয়াইনের বোতলে মানিপ্ল্যান্টলতার সবুজ চোখে আসছে। কালো কলম। খোলা ডায়রি। আধবোঁজা চোখে অস্ফুট কথা । জল বইছে তার ট্যাটু করা হাতের ওপর দিয়ে । তৃষিত ড্র্যাগন জলপান করছে। জলপান করছে বাদুড় ও টিকটিকি । তার মসৃণ বাদামি উরুতে জলস্রোত। অবিন্যস্ত চুল ভিজে। যেন মাতৃগর্ভ থেকে জন্ম হচ্ছে আবার। সে হাঁটুদুটি বুকের কাছে জড়ো করে শুয়ে আছে। যেন মাতৃগর্ভে ভ্রূণ । কোনো নিরাপত্তা বলয়ে ঘুমিয়ে থাকার চিরকালীন সাধ পূর্ণ করছে। রেজারেকশন। এসো। এসো ইরফান। তোমার সেই সুন্দর নির্মোহ হাসি হেসে এসো। একটু একটু করে আলো স্পষ্ট হচ্ছে। সে বুঝতে পারছে সে জেগে উঠছে। তখনি জোর করে ঘুমের অতলে তলিয়ে যাবার চেষ্টা। রাশি রাশি জলস্রোত এসে ঢেকে দিক। ইরফান। আমাকে এমন কোথাও নিয়ে যাও যেখানে বোরডম নেই। হোয়াই ডু আই গেট বোর্ড সো ইজিলি বলো তো? কিছু ভালো না লাগা একটা রোগ। বাবা সেইড । আমার মা রোজ কিছু না কিছু নতুন পদ রাঁধে। এই লকডাউনেও মা সুন্দর করে সাজে । নিজে ভ্রূ প্লাক করে। ফেশিয়াল বা পেডিকিওর যেটা মা পার্লারে গিয়ে করে সেটাও লকডাউনে বাড়িতে করছে। গতপরশুই তো। নিজেও চুল কালার করলো। বাবাকেও করে দিল। পার্টিকুলারলি সব কিছু করে। ডাস্টিং থেকে শুরু করে বাথরুম পরিষ্কার। এইসব দেখে সে বোরডম ফিল করে। আবারো একটা দিন। আবার ডাস্টিং। আবার গ্যাস রাইটার। সে এইভাবে সংসার করতে পারবে না। ইরফান আর সে ব্যাডমিন্টন খেলছিল। কিছুতেই কারু ফেদার পড়ছে না। যার ফেদার পড়বে সে হাইরাইজের ওপরে গিয়ে চিৎকার করবে। যত জোরে পারবে চিৎকার করবে। যত ভেতরে কষ্ট আছে। গ্লানি আছে । সব দিয়ে চিৎকার । সো লেট ভাই ফেদার ফল। জলপ্রপাতের নিচে দাঁড়িয়ে এই ব্যাডমিন্টন খেলা। কিন্তু তার পা এক মস আচ্ছাদিত পাথরের ওপরে। যেকোনো সময় পিছলে যেতে পারে পা। অ্যান্ডারসন ক্লাবে সাঁতার শেখা বিদ্যেতে এখানে কিছু হবে না । স্রেফ তলিয়ে যাবে। কিন্তু খেলে যাওয়া খুব জরুরি। পায়ের পাতার নিচে অসম্ভব পিছল। প্রতিমুহূর্তে ব্যালান্স করতে হচ্ছে। যন্ত্রণা হচ্ছে একধরনের । কিন্তু নার্ভগুলো আরাম পাচ্ছে। এখানে, এই অগণিত জলধারার নিচে কোনো ভাইরাস নেই। সাবানের ফেনাসদৃশ জলের ফেনা ওকে স্নাত করছে। ওর হাতে অদৃশ্য র্যাকেট। অদৃশ্য ফেদারকে মারছে ও । পাঠিয়ে দিচ্ছে অইপারে। ইরফান একটা শক্ত জমিতে দাঁড়িয়ে আছেন। পায়ে কেডস। তার খালি পায়ের নিচে পিছল পাথর। সে দেখতে পাচ্ছে সে একটা প্রাচীন গহ্বরের মধ্যে ঢুকে যাচ্ছে। অন্ধকার আদিম। একটাই সুরঙ্গপথ। তার মা অতি যত্নে সেই সুরঙ্গপথকে সাজিয়ে তুলছেন। ট্রুসো তৈরি করছেন তার জন্য। পুরোনো আমলের গয়না ভেঙে নতুন ডিজাইন তৈরি হচ্ছে। বসন্তবৌরি পাখি ডাকছে কোথাও। থাকে থাকে প্রাদেশিক শাড়ি সাজিয়ে রাখছে মা। মেয়ের বিয়েতে ভারতবর্ষের প্রত্যেক প্রদেশের একটি শাড়ি আর বি এম ডাবল্উর চাবি। চাবিটা হাতে করে কে নাচাচ্ছে ঠিক বোঝা যাচ্ছে না। সুড়ঙ্গের শেষে তার হাসিমুখ। ও কি রক্তিম না মায়ের বন্ধু জবামাসির এন আর আই ছেলেটা? হাসিটা কি বোরিং। কি ঘ্যানঘেনে। জলের মধ্যে পা ছুঁড়লো সে। জোরে। ফেদার উড়ে আসছে জলের মধ্যে দিয়ে । রক্তিম বলছে একটা ছেলে আর একটা মেয়ের মধ্যে পিওর বন্ধুত্ব হয় না। একটা ম্যান উওম্যান রিলেশন তৈরি হয় আর ওর ঠাস করে একটা চড় লাগাতে ইচ্ছে করছে রক্তিমের গালে। কার কাছে যাবে। কাকে গিয়ে বলবে যে ওর কষ্ট হচ্ছে খুব?ইরফান ইরফান এখনি খেলা ছেড়ে চলে যেও না প্লিজ। রক্তিম । রক্তিম যে আমার ছোটবেলার বন্ধু, যার টুথপেস্টের ব্র্যান্ড থেকে শুরু করে জুতোর মাপ, চুলের ঘ্রাণ সব তার জানা , সেও আজকাল মাঝেমাঝে প্রভু হয়ে যাচ্ছে। তাকে ফোন করলে সে অনেক সময় ধরে না। এবং পাঁ ঘন্টা বাদে মেসেজ পাঠায় ব্যস্ত ছিলাম। অথচ সে ফোন ধরে। জরুরি কাজের মধ্যে। ঘুমের মধ্যে । স্বপ্নের মধ্যে। নাহলে রক্তিম অশান্ত। এত অসময়ে খেলা খেলতে খেলতে আমি পাগল হয়ে যাচ্ছি ইরফান। প্লিজ কনটিনিউ দ্য গেম। আই ডোন্ট ওয়ান্ট টু গেট ইনসাইড দ্যাট প্রিমিটিভ ডানজিওন। আই প্রেফার দ্য স্লিপারি স্টোন আন্ডার মাই ফিট। ঐ সুরঙভর্তি ভাইরাস। অজস্র স্পাইক্স ওদের গায়ে ওরা শরীর খোঁজে। ওরা ওবলিগেটারি প্যারাসাইটস। ওল ভাইরাস। মেটাবলিক মেকানিজম তৈরি করতে পারে না। প্রোটিন স্পাইক্স, এনার্জি কিচ্ছু তৈরি করতে পারে না নিজেরা। ওরা তার শরীর খুঁজছে। সুরঙ্গময় থিকথিক করছে ভাইরাস। সে কিছুতেই ঢুকবে না। কিছুতেই না। আই নিড ফ্রেশ এয়ার। লেট মি ব্রিদ।

    ব্রিদ ইন। ব্রিদ আউট। ব্রিদ ইন। ব্রিদ আউট। গুণে গুণে পঞ্চাশবার। নাউ ডু ইউ ফিল বেটার? ইরফান আর সে বসেছিল কুড়িতলার ছাতের ওপর। যতদূর দেখা যায় সব শুনশান। মাঝেমাঝে এক আধটা গাড়ি। এত ভোরে লকডাউন কিছু আলাদা নয়।
    - ডু ইউ নো ইরফান, লেবারস আর ওয়াকিং ব্যাক হোম?
    - জানি। জানতা হুঁ। পয়দল চলনা পড়তা হ্যায়।
    - ইজ ইট পসিবল? দে উইল ডাই। ইফ নট ফ্রম কোভিড বাট ফ্রম হাংগার। ফ্রম মুম্বাই টু কলকাতা!
    - ও ইয়েস। মেনি উইল ডাই।
    - দে আর কলড মাইগ্রান্টস!
    - কুছ না কুছ তো কহেংগে। লোগো কা কাম হ্যায় কহনা।
    - সো ডিরোগেটরি!
    - দেয়েরজ নাথিং ডিরোগেটরি ইন লাইফ। কুছ ডিরোগেটরি নহি হ্যায় জিন্দগিমে। সিবায়ে এক চিজ।
    পেটমে খানা জরুর হোনা চাহিয়ে। উসকে সিবা সব ঝুট হ্যায়।
    - অ্যান্ড হুজ রেসপনসিবিলিটি? কারু কোনো দায়িত্ব নেই?
    ইরফান তাঁর আশ্চর্য অনুভূতিময় চোখ দিয়ে মেয়েটিকে দেখলেন। পূর্ণভাবে।
    - কিসিকা কোই রেসপন্সিবিলিটি নহি হ্যায় । ইট ইজ ইওর ওন রেসপনসিবিলিটি টু ফিড ইওরসেল্ফ।
    পেটমে খানা জরুর হোনা চাহিয়ে।
    ✨পুনে আগেইন
    পুনে শহরে অনেক পুরোনো বাড়ি। বিশেষ করে ডেকান জিমখানার দিকে। অদিতি , দেবরূপ দুজনেই ঐ অঞ্চলটা ঘুরে বেড়াতে ভালোবাসে। পাথরের তৈরি প্রাচীন বাড়ি সব। উনিশশো কুড়ি থেকে উনিশশো পঞ্চাশের মধ্যে তৈরি। আশ্চর্য চেহারা বাড়িগুলোর। কফির কাপ হাতে নিয়ে ব্যালকনিতে। অনেকদিন যাওয়া হয়না ওদিকে। লকডাউনের আগে শেষ গেছিল অদিতির জন্মদিনে। আপাচে রেস্তরাঁতে। খুব পরিচ্ছন্ন ব্যবস্থা একটা ওল্ড স্কুল টাচ আছে। ও পছন্দ করে। অদিতিও। অনেক সময় এসে শুধু ব্রেড টোস্ট আর কফি নেয়। এখানে প্রচুর রিটায়ার্ড , বৃদ্ধ মানুষদের বসবাস। বাড়িগুলো অতীতের স্মৃতিচিহ্ন নিয়ে দাঁড়িয়ে । কলোনিয়াল স্টাইল। গথিক স্টাইল। আর্কিটেকচারের খনি একটা। ভাগ্যিস পুরোনো বাড়িগুলো ভাঙেনি এরা। কলকাতা হলে কবে উড়িয়ে মাল্টি স্টোরিড করে নিত। টিপিক্যাল মহারাষ্ট্রিয়ান স্থাপত্যও আছে কিছু। এলিটিস্ট অঞ্চল । বুড়োবুড়ি থাকে। ছেলেপুলে বিদেশে। প্রভাত রোড থেকে ভান্ডারকার রোড। বেমালুম ঘুরে বেড়ানো ছিল। লকডাউনে স্বপ্নসম। প্রভাত রোডে পনেরোটা লেন। ভান্ডারকারে বারোটা। মাঝে আবার ইন্টারকানেক্টিং লেন আছে। সবকটা ঘুরে দেখতে প্রায় চার পাঁচ ঘন্টা , হাওয়ায় ভর করে উড়ে যেত যখন প্রথম ও পুনে আসে। কার্ভে রোড পর্যন্ত চলে আসতো ওরা। স্কুটি পার্ক করে হাঁটত। অনেক বাড়ি ডেকান কাঠ আর ট্র্যাপ স্টোনে তৈরি বা ব্যাসিল্টিক স্টোনে। আশ্চর্য পাথর সব। তিলক ট্যাঙ্ক এক্সক্যাভেট করার সময় এইসব পাথর তোলা হয়েছিল। তিলক ট্যাঙ্ক এখানে নেচারাল সুইমিং পুল। এই এতবড় অন্চলে মন্দিরের আতিশয্য নেই। মাত্র দুটো মন্দির। একটা বলভীম মন্দির আরেকটা শংকর মন্দির। খাবার দোকান , ইটারি তো আগে খুব কম ছিল। এখন গজিয়েছে কিছু। ভালো খাবার পাওয়া যায় । একটু দাম বেশি। কতদিন ভান্ডারকর রোড ধরে টানা হাঁটা হয়না। সারাদিন ল্যাপটপে বসে থাকার বিপন্নতা অনেক। ও হাড়ে হাড়ে জানে। কার্ভে রোডে একটা বাইলেনে সুহাস পরান্জপের বাড়ি। পুরোনো একটা বাগান। ঝুলা। ওদের বাড়িতে কাঠের সিঁড়ি ব্রিটিশ আমলের। কাঠের রেলিং দেওয়া বারান্দা। সুহাস ফিল্ম ইন্সটিটিউট । নাটক করে। উইক এন্ডে ওদের রিহার্সালে চলে আসত অনেকদিন। খুব ইচ্ছে করল সুহাসকে একটা ফোন করে।

    ফোন আসছে।
    - হ্যাঁ মা। খেয়েছি। কিন্তু তুমি এত চিন্তা করছো কেন? যাস্ট চিল।
    - বাবাকে বলো। বেশি স্ট্রেস নিলে ইমিউনিটি কমে যাবে মা।
    - উফফফ। সাঁতার কাটলেও আমার কিছু হত না। সুইমিং পুলে জলে যে ক্লোরিন দেয়, তাতে ভাইরাস মরে যায় । বুঝেছ? ইউ টেক কেয়ার অব ইওরসেল্ফ। আয়াম ফাইন।
    ফোন নামিয়ে একটা বড় করে নিঃশ্বাস ফেলল। নিচে সবজির ভেন্ডর যাচ্ছেন একজন। মুখে মাস্ক। করেলা। ভেন্ডি। টমাটর। আলু। দাম বেড়েছে অনেক। মা যে কেন এত স্ট্রেস নেয়। ভাবে ছেলেকে সবকিছু গুছিয়ে না দিলে ছেলে পারবে না কিছু। অথচ ও সেল্ফ সাফিশিয়েন্ট। গুছিয়ে কাজ করে। অদিতিও অত গোছানো নয়।
    মেইল এসেছে। দুটো। একটা করেছেন জুডিথ কুরিয়র। ইউ সি সি এ ' র প্রফেসর অব মেডিসিন। ডিভিশন অব ইনফেকশস ডিজিজের সঙ্গে কোলাবরেশনে একটা কাজ করছে ও। পেপার পাঠিয়েছে ইমিউন সিস্টেমের ওপর। বি সেলস ওর বিষয় । বারো চোদ্দ ঘন্টা ল্যাপটপে চোখ। জুডিথ পেপার চেক করে পাঠিয়েছেন। আরেকটা মেইল ডি এল সি এ এস, দেরাদুন থেকে করেছেন ড. নকুল শ্রীবাস্তব । বায়োইনফরম্যাটিকসের জন্য শ্রীবাস্তবের সঙ্গে যোগাযোগ দরকারি। পোটেনশিয়ালি ইনফেকশাস ভাইরাস নিয়ে ওঁর কমেন্টস পাঠিয়েছেন। একবার চোখ বোলালো। এরপর আবার ল্যাপটপে বসতে হবে। মাঝে মাঝেই অতল ক্লান্তি চলে আসে। অ্যাডভান্সড ভাইরোলজি কোর্সে ক্লাস নিচ্ছে ও এখন অনলাইন। মা' কে ও প্রায় তেমন করে বোঝাতে হয়। স্টুডেন্টদের যেমন বোঝায়।
    - ইমিউন সিস্টেম স্বাভাবিক ভাবে এস এ আর এস কোভিডকে শেষ করে দিতে পারে, কিন্তু একশোতে একটা কেসে। আর এইজন্য ভ্যাকসিন আবিষ্কার হবার সম্ভাবনা আছে!
    ছাত্ররা অনলাইনে মাইক্রোফোন অফফ করে শুনে যায় ।
    -শোনো মা। দুনিয়ার সব ভাইরাস তোমার ছেলেকে ক্যাঁক করে ধরবে বলে বসে নেই। কোভিডে যে সংখ্যক মানুষ মারা যাচ্ছে তার চেয়ে ঢের বেশি লোক এইচ আই ভি তে বা হেপাটাইটিসে মরে। টেক ইট ফ্রম মি। অত চিন্তা কোরো না।
    - আমরা অ্যান্টিবডি টেস্ট করাবো, বাবু? আমাদের তো বয়স বাড়ছে। লো ইমিউনিটি তারওপর।
    - অ্যান্টিবডি টেস্ট করলে বেশির ভাগ ফলস পজিটিভ কেস আসে। ফালতু টেনশন নিও না তো। খাও, দাও। আরামে থাকো। অ্যান্ড প্লিজ ডোনেট।
    - তুই কিছু বুঝিস না বাবু। একা একা থাকিস। এইসময়গুলো । আমার ভালো লাগে না ।
    সমস্ত অ্যান্টিবডি সমান কার্যকারিতাসম্পন্ন হয় না। নট ইচ অ্যান্টিবডি ইজ ইকুয়াল।
    ইট ডিপেন্ডস অন রিসেপ্টর বিল্ডিং ডোমেইন। আর বি ডি।
    অনলাইনে ছাত্রছাত্রীদের মাইক্রোফোন অফফ। ভিডিও অফফফ। জেগে না ঘুমিয়ে বোঝা যায় না।
    ও দেখতে পায় এই অনন্তমহাবিশ্বে কদম ফুলের আকৃতির ভাইরাস ঘুরছে। চোখে দেখা যায় না। তাদের প্রোটিন স্পাইক্স তাদের আরো বেশি কদম ফুলের মত করে তুলেছে । স্পাইকগুলো দিয়ে তারা হোস্ট সেলের এ সি ই রিসেপ্টর খুঁজে চলেছে। এক অদ্ভুত ধরনের ছোঁয়াছুঁয়ি খেলা। কানামাছি ভোঁ ভোঁ। যাকে পাবি তাকে ছোঁ। স্টুডেন্টস । আর ইউ দেয়ার? আর ইউ অ্যালাইভ? বেঁচে আছো? কোভিড প্রোটিন স্পাইক্স কি ছুঁয়ে গেল তোমাদের? কোথায় তোমরা? সাড়া দাও। স্পিক আউট। শাউট। এই স্ক্রিনে আমি তোমাদের দেখতে পাই না। ইজ দেয়ার এনিবডি দেয়ার? ওয়ালটার দে লা মেয়ার। এই কোভিড দিনের শেষে কি অসীম নীরবতা থাকবে শুধু? ছায়ারা সাড়া দেবে না? প্লিজ কথা বলো। সে চিৎকার করতে থাকে। পুরোনো গথিক প্যাটার্ণের বাড়ির ভিতর , বাগানে , বিশাল আকৃতির ঘরে শূন্যতা ছোটাছুটি করে।

    ফোন আসে আবার।
    - বাবু।
    ওপাশ থেকে হুহু করে কান্না। মা। মা।
    - কী হল মা?মা হাউহাউ করে কাঁদছে।
    - কাঁদছো কেন মা? কী হয়েছে? প্লিজ। কেঁদো না। বলো। কী? কী হয়েছে?
    - শ্যামার শাশুড়ি মারা গেছে বাবু। এখনি ফোন করেছিল। অনেকদিন ধরে ভুগছিল। শেষে সোয়াব টেস্টে কোভিড পজিটিভ এসেছিল।

    ✨পায়ের ছবি

    সুখনলাল পায়ের দিকে তাকালো । কি বলছে? সামনে ধুমসো ক্যামেরা নিয়ে একটা ফোটোগ্রাফার। পেছনে আরো কয়েকজন। সকলেরই হাতে ক্যামেরা । আরো কিছু লোকজন এসেছে। সবার হাতে লম্বা কিছু যন্ত্র। মুখের ওপর ঝুঁকে পড়ে লোকগুলো কিছু বলছে।
    ক্লান্তিতে , খিদেতে ওরা বসে পড়েছে রাস্তার ধারে। শুয়েও পড়েছে কেউ কেউ। লোকগুলো কী বলছে সুখনলালের ঠাহর হচ্ছিল না। চোখেও ঝাপসা লাগছে। সিকিপেট খাওয়া । তাও একবেলা। কত টানবে শরীর। সারা গায়ে, হাতে, পায়ে অসম্ভব যন্ত্রণা। পেট গোলাচ্ছে। খুব কষ্ট করে আধশোয়া সুখনলাল উঠে বসলো। বুধন শুয়েই আছে। কী বলছে লোকগুলো। ক্যা বোল রহে হ্যায়?
    কেমন আশ্চর্য হয়ে গেল ওরা। সকলেই । যারা বসে ছিল । এত কষ্টের মধ্যেও হাসি পাচ্ছিল । তাজ্জব কী বাত। লোকগুলো খবরের কাগজ আর টিভি থেকে এসেছে। বলে কিনা ওদের ফাটা পায়ের ছবি তুলবে!
    পা তুলে দেখল সুখনলাল। ফেটেফুটে চৌচির। রক্ত গড়াচ্ছে পা দিয়ে । এই পায়ের ছবি তুলবে? সব পায়ে মোটা মোটা কেডস পরা বাবুরা? হাঁ। ছেলে চেয়েছিল বটে এরকম জুতো। সব টিভি দেখে দেখে বায়না। দোকানে চলে গেছিল সুখন। জুতার দাম শুনে ভেগে এষেছিল। তারপর পোস্ট অফিসের সামনে ফুটপাথ থেকে নগদ পাঁচশো টাকা দিয়ে জুতা কিনে দিয়েছিল ছেলেকে। সে ছেলেটার মুখ মনে করতে করতে সামনের দিকে পা এগিয়ে দিল সুখন। বুধন। হিরালাল। রাকেশ। ইফতিকার। গোরি। চম্পা। রবি। জোড়া জোড়া ফাটা পা। অনেক বছর বৃষ্টি না হলে ধরতি যেমন শুকিয়ে ফুটিফাটা হয়ে যায়, ঠিক তেমনি। উড়িষার ছেলেটা জানে। কালাহান্ডি মিট্টি য্যায়সা।
    যে ছেলেটি আগে ছবি তুলছিল , সে লং শট নিল প্রথমে। তারপর লেন্স চেঞ্জ । ক্লোজ আপ চাই। ফ্রন্ট পেজে যাবে। ছবি তোলার হিড়িক লেগে গেছে। যত বেশি ফাটা পা , তত বেশি ফুটেজ। তত বেশি ফ্রন্টপেজ। যারা ছবি নিচ্ছে, তারা মরিয়া। হাউস বলে দিয়েছে , সেনসেশানাল ছবি চাই। রিয়েল স্টোরি রিয়েল ইন্ডিয়া । ছবি ঠিকঠাক না হলে পে প্যাকেটে টান তো পড়বেই, চাকরি ও থাকবে না। অনেক ফ্রিল্যান্সার আছে। তারাও মরিয়া হয়ে ছবি তুলছে। কোভিডের বাজারে পটাপট চাকরি চলে যাচ্ছে। মিডিয়া তাকেই রাখবে , যে কভার করতে পারবে ইন থিংগস।
    সুখনলাল পা জোড়া মেলে ধরলো ডজন খানিক ক্যামেরার সামনে। ছবি উঠতে লাগলো। ক্লিক ক্লিক । সুখনের রক্তপড়া পায়ের দিকে বেশি ক্যামেরা তাক করছে। পেটে অসহ্য কামড়ানি। পায়ের ছবি তুলতে দিলে কি এরা টাকা দেবে? বা খাবার? তাহলে সামনের পাথরে ঠুকে ঠুকে নাহয় আরো খানিক রক্ত বের করত সুখন। যে করেই হোক। পেটে খাবার চাই। খেতে না পেলে আর চোখে দেখতে পাচ্ছে না সুখন। কিন্তু যারা ছবি তুলছে, প্রশ্ন করছে, তারা কেউ টাকা বা খাবার দেবার কথা বলছে না। নানা রকমের ক্যামেরা চোখের সামনে নাচছে । ওরা কত কী কথা বলছে নিজেদের মধ্যে । কিছুই বুঝতে পারছে না সুখন।
    ক্যামেরার উজ্জ্বল ফ্ল্যাশের সামনে নিজের পা দুটি মেলে , শুয়ে পড়লো সুখন। ছবির পর ছবি হচ্ছে। ছবি। কেবল ছবি।
    উল্টো দিক থেকে রামদীন এলো দৌড়াতে দৌড়াতে। পুলিশ আসবার আগেই ভাগো সব। ভাগোওওও। ফোন চার্জ করেছে আসলাম। ওর কাছে টাকাপয়সা আছে কিছু। কে নাকি বলেছে ইউ পি' র দিকে সব পয়দল চলা লেবারকে লাইন করে বসিয়ে, গায়ে পোকামারা ওষুধ স্প্রে করে দিয়েছে পুলিশ। ইউ পি এখান থেকে কতদূর, কোনদিক কেউ জানে না ওরা। কিন্তু গায়ে পোকামারা ওষুধ স্প্রে করে দিলে খুব জ্বলুনি হবে। চামড়া খসে যাবে। তাই পা ফেটে চৌচির হোক বা পেট গুলিয়ে বমি হোক, চলনা তো পড়েগাই । চোখে ঝাপসা দেখতে দেখতে উঠল সুখনলাল। চলো ভাই। দের কিস কি?
    একটা ভারি অল্পবয়সী ছেলে ক্যামেরা নিয়ে ঝুঁকে পড়লো।
    ইক আউর তসবির ভাইসাব। স্রিফ ইক।
    ছেলেটার মুখ শুকনো। চুল এলোমেলো।
    সুখন গলা কড়া করে বলল, নহি। আউর নহি। চলনা হ্যায় আব।
    মুখ ফ্যাকাশে হয়ে গেল ছেলেটার। ছবি না নিতে পারলে রিপোর্টার গাল দেবে। বস গাল দেবে।
    মুখটা দেখে মায়া হল সুখনের। তারও তবে দেবার মত কিছু আছে দুনিয়াকে এখনো।
    ফেটে রুখা খরাক্লিষ্ট মাটির মত চৌচির হয়ে যাওয়া পায়ের তলা সুখন তুলে ধরল। শরীরের সমস্ত শক্তি দিয়ে ।
    লে। লে বেটা। তসবির লে। আচ্ছি তরাসে লে লো।

    ✨করোনা না ক্যানসার

    ন্যূনতম ঘাটতিতেও মানুষ কেমন চমকে ওঠে। একটু এদিক ওদিক হবার আশঙ্কাতে ছটফট করে। কোনটা ন্যূনতম কেই বা বলে দেবে। অনিল টমাস তাঁর ফুসফুসের স্পট নিয়ে ভাবছিলেন। আপাতত এইটাই সবচেয়ে বড় চিন্তা। কোভিড নাইন্টিন ইজ নট ফেটাল ইন ইওর কেস। যেদিন এটা শুনেছেন, সেদিন কিছুটা আশ্বস্ত ছিলেন। অক্সিমিটার হাতের কাছেই রয়েছে। তিনি অত্যন্ত সংযমী মানুষ। সতর্কও বটে। স্মোকিং ছেড়ে দিয়েছেন বেশ কিছুদিন হল। পৈতৃক সম্পত্তি এই বাড়ি। একতলা ছিল। তিনি দোতলা করেছেন। তাঁর ভাইয়েরা চেঙ্গালা ছেড়ে বেরিয়ে গেছেন বটে কিন্তু অনিল যাননি। ঠিক এই মুহূর্তে ক্রেডিট স্প্রেড লাফ দিয়ে বেড়ে যাওয়ায় একটু টেনশনে আছেন। কিন্তু তার থেকেও বড় টেনশন। দ্য স্পট। ইফ ইট ইজ ম্যালিগন্যান্ট ? ছেলেমেয়ে দুটো বড় ছোট যে এখনো! পলি একটি বায়ো- ফার্টিলাইজারের সঙ্গে যুক্ত। সে খুব কর্মঠও বটে। কিন্তু অনিলের যদি ফেটাল কিছু হয়, তাহলে বাচ্চাদের নিয়ে পলি কিভাবে সারভাইভ করবে? এত ভবিষ্যত প্ল্যানিং আছে তাঁর ওদের নিয়ে? যদি ক্যানসার হয় শেষ পর্যন্ত? এই কোয়োরান্টাইন পিরিয়ড শেষ না হলে সেটা নিয়ে কিছু করাও যাচ্ছে না।
    পলি আজ শরবত করে পাঠিয়েছেন। হালকা হলুদ রঙের জুস। ফুল অব ভিটামিন সি। এই প্যাশন ফ্রুট তাঁর নিজের বাগানের। তামিলে পেসম পালাম। অনিলের বিস্তৃত পৈত্রিক বাগানের প্রচুর ফল ও ফুল লোকাল নার্সারিগুলোতে যায় । গ্রিন আর্ট নার্সারি। পোমেগ্রেনেট নার্সারি। আলম নার্সারি। অনিল যেহেতু ট্যুরে থাকেন বেশির ভাগ সময়, পলি এবং অনিলের দুজন কর্মচারী আকাশ ও জনি মিলে সাপ্লাইয়ের কাজ দেখে। এখন সব বন্ধ । প্রচুর ফল পচে যাচ্ছে। অনিল মুগ্ধ হয়ে হলুদ রঙা শরবতের দিকে তাকিয়ে থাকলেন। কী অপূর্ব রঙ। এই রঙ দেখলে নতুন করে বাঁচতে ইচ্ছে করে। ভালোবাসতে ইচ্ছে করে। প্যাশন অব ক্রাইস্ট। এই ফুলের নামকরণের পেছনে আছে যিশুর আত্মত্যাগের ইতিহাস। মানুষকে ভালোবাসার গল্প। মাথায় কাঁটার মুকুট পরেও মানুষকে ভালোবাসা । কতদিন চার্চে যান না অনিল। পলি জানিয়েছেন চার্চ বন্ধও রাখা হয়েছে। কোনো জমায়েত হচ্ছে না। অ্যান্ড্রয়েড ফোনটা না থাকলে এই সময় পার
    হওয়া কঠিন হত অনিলের। শেষ একটা বড় জমায়েত হয়েছিল শুনেছেন জানুয়ারির পঁচিশে। মানবশৃঙ্খল তৈরী হয়েছিল কাসারাগাদ থেকে তিরুভানন্তপুরম পর্যন্ত । মানুষ মানুষের হাত ধরে দাঁড়িয়েছিল সি এ এ' র প্রতিবাদে । আর এখন হাত ধরা কেন! ছোঁয়া মাড়ানোও চলবে না। করোনা। এই প্যাশন ফ্লাওয়ারের করোনাটি ঠিক যেন ক্রাউন অব থর্নস। ভাইরাসটা এরকমই দেখতে তো!,কে জানে কোন সময়ে তাঁর শরীরে থাবা বসিয়েছিল!ব্রাজিলে জন্ম নেওয়া এই ফুল স্প্যানিশ ক্রিশ্চিয়ান মিশনারিরা মনে করেছিল যিশুর মৃত্যুর প্রতীক। টলটলে হলুদ রঙে সেই হর্ষ, সেই বিষাদ, সেই অনন্ত দুঃখ মিশে আছে যেন। আমাকে ধৈর্য্য দাও প্রভু। অনিল টমাস গভীরভাবে ভক্তিবাদী। চার্চ যেতে পারছেন না কিন্তু ঘুম থেকে উঠে ও শুতে যাবার আগে তিনি প্রথামত প্রার্থনা করেন। কিন্তু আজকের এই উজ্জ্বল আলোকিত সকালবেলার ঝিমধরা আবেশে প্যাশনফ্রুটের শরবত তাঁর কাছে একটা অন্য বার্তা নিয়ে এল। তাঁর শরীর তাঁকে , তাঁর পরিবারকে কোথায় নিয়ে যাবে তা তিনি জানেন না। নিরাপত্তা নামক মিথ্যাবোধ এখন তাঁকে ভেতরে ভেতরে কুরে কুরে খাচ্ছে।
    ন্যূনতম সংস্থান অন্তত রেখে যেতে হবে পলি ও সন্তানদের জন্য। ওরা একটা লাইফ স্টাইলে অভ্যস্ত সেটা যথেষ্ট আরামদায়ক জীবনশৈলী। দুরারোগ্য ব্যাধি হলে প্রচুর খরচ হয়ে যাবে অসুখের পেছনেই। সবদিক সামলাতে পারবেন কী করে? প্রভু! আমার প্রয়োজনকে সীমিত করো। আমার প্রয়োজনবোধকে সংযত করো। আমার পরিবারের মধ্যেও সেই সংযম, সেই পরিমিতিবোধ সংক্রামিত করো প্রভু। হলুদ রঙের শরবতের গ্লাসের সামনে করজোড়ে টমাস কথা বলে যাচ্ছিলেন। তাঁর দুই চোখ বন্ধ । চোখ দিয়ে দরদর করে জল পড়ে যাচ্ছে। প্রভু, আমার লিপ্সাকে সীমিত করো। এত প্রয়োজনে আমার যেন মন না থাকে!আমার বিলাসিতার চাহিদা অপসারণ করো ইষ্ট, আমাকে করুণা করো।
    ফোনে টিং করে মেসেজ এল একটা। সিন্ডিকেট ব্যাঙ্ক থেকে মেসেজ এসেছে। ফিক্সড ভাঙাতে হবে কিছু।
    তাকিয়ে দেখলেন, গেট খুলে মুরুগন আসছে। তার কুচকুচে কালো রঙে সাদা শার্ট, সাদা মাস্ক মানিয়েছে বড় ভালো। মুরুগন লোকাল ছেলে। প্যারামেডিক্যাল স্টাফ। এখন রেশন ডেলিভারি করছে। বিস্কিট, সাবান নিয়ে এলো বোধহয়। ওর হাসিটা বড় সুন্দর। দেখলেই মন ভালো হয়ে যায় । দূর থেকে অনিলকে দেখে হাত নাড়ল মুরুগন। ওর হাসিটা দেখা গেল না। মাস্কে ঢাকা। অনিল পাল্টা হাত নাড়লেন। মুরুগন ওর ঢাউস ব্যাগ থেকে জিনিষ বের করছে। সারা সকাল ও সাইকেলে গোটা চেঙ্গালা ঘুরবে।
    দোরে দোরে পৌঁছবে,
    ওর ভয় নেই বুঝি! কী সাবলীল ভাবে হেঁটে যাচ্ছে ওর কৃশ শরীর। ওই বুঝি প্রকৃত ঈশ্বরের বরপুত্র! মনে হল অনিলের। ওর প্রয়োজনবোধ অতি সীমিত। ভাগ্যবান! ও কোভিডকে ভয় পায় না।

    ✨কোয়ারেন্টাইন সেন্টার

    সকালবেলা ঘুম ভেঙে যায় তাড়াতাড়ি । চোখ মেলে সিলিঙের দিকে তাকিয়ে শুয়ে থাকে শ্যামা। সবকিছু কেমন ঘোরের মত লাগে। এরকম ঘরে থাকেনি কখনো।
    বেশ কিছুটা দুরে দুরে এক একটা বেড। লম্বা মত ঘরটাতে বারোটা বেড আছে। বারোজন মেয়ে কোভিড পেশেন্ট স্কুলবাড়ির হলঘরে। এটা তিনতলা। দোতলায় ছেলেরা আছে।
    শ্যামা বুঝেই উঠে পায় না যে তাকে কেন এরা ধরে নিয়ে এলো। তার জ্বরজারি নেই। কাশি নেই। শাশুড়ির মত অমন হাপর হাপর শ্বাসকষ্ট নেই। শুধুমুধু থুতু পরীক্ষা করল আর এখানে এনে তুলল। সে নাকি পজিটিভ। তাও ঐ বেডে শুয়ে থাকতে হবে। শুধু বাথরুম যাবার সময় উঠতে পারবে। পাড়া নাকি বন্ধ করে দিয়েছে টিনের বেড়া দিয়ে ।
    শাশুড়ি যে মরল, তারপর নিয়মককানুন, কাজ কর্ম শ্রাদ্ধ, কিছুই করতে পারল না শ্যামা। হাসপাতালে এনেছিল। নিঃশ্বাস নিতে পারছিল না মানুষটা। অক্সিজেন পড়ল কিন্তু আর টানতে পারলো না সে। হাত পা ছটফট করতে করতে মরে গেল। ওরা বললো হার্ট ফেল। বডি নিয়ে যাও। তো হার্টফেল হলে বডি প্ল্যাস্টিক মোড়া কেন। কাকে বলবে শ্যামা। কথা শোনার কেউ নেই।
    লালারস পরীক্ষার কাগজ এল পরদিন। ততক্ষণে দাহ হয়ে গেছে।
    তাতে নাকি পজিটিভ লেখা ছিল। আর তাই শ্যামা আর ছেলেরও লারারস নিল ওরা। ভাগ্যিস ছেলেটার কিছু খারাপ আসে নি। ভয়ে ভয়ে শ্যামার হাত ঠান্ডা। পা অবশ। মুখে কিছু ওঠে না। শাশুড়ির বডি রেখে দিয়েছিল করিডোরে। প্ল্যাস্টিকে বাঁধা। মুখ দেখা যায় না। অনেক জ্বালিয়েছে শ্যামাকে বুড়ি। ব্যাঁকা ত্যাড়া কথা শোনাতো শুয়ে থেকেও। কাচা কাপড় দু' বার করে কাচাত। সুখন যাবার পর তো আরো খিটখিটে। বদমেজাজি । প্ল্যাস্টিকে মোড়া মানুষটাকে দেখে তবু কষ্ট হচ্ছিল শ্যামার। কেউ তুলেও দেবে না। ছোঁয়া তো দূরস্থান । বেড থেকে নামিয়ে খালাশ। শ্যামা কুল কিনারা পাচ্ছিল না ভেবে ভেবে। কাঁদতেও ভুলে গেছিল। আর কাঁদবে বা কী করে। বডিটা পোড়াবে কী করে সেই চিন্তাতেই তো পাগল। ছেলেটা বাড়িতে একা।
    পাড়ার লোক কেউ এল না। দশরথকে ফোন করে ডেকেছিল শ্যামা। সুফলকেও। তারা কেউ আসতে পারেনি। দশরথের মেয়ের হাত ভেঙেছে । সুফলকে তো ফোনে পাওয়াই গেল না। শ্যামার মাথায় বাজ পড়েছিল। ওয়ার্ড বয় আর একটা কে যেন বারবার এসে তাড়া দিয়ে যাচ্ছিল বডি সরাতে। শ্যামা দেখছিল প্ল্যাস্টিকে মোড়া একটা চার ফিট আট ইঞ্চি কাঠ। ফিনাইল আর ডিসিনফ্যাকট্যান্টের কড়া গন্ধ । মেট্রন এসে বলেছিলেন, কী হল? বডি কখন সরাবে তোমরা?
    তোমরা। শ্যামা সেই প্রথম বুঝল ও একা। তোমরা বলে কেউ নেই। বস্তির কেউ আসা তো দূরের কথা, ফোন পর্যন্ত করেনি। হাসপাতালে করিডোরের মেঝেতে থেবড়ে বসে পড়া শ্যামাকে টেনে তুলেছিল হরপ্রীত কাউর। ভয়ডর নেই। বাপদাদা লাহোর সে পঞ্জাব আয়া থা। ম্যায় পঞ্জাব সে কলকাত্তা আয়ী। ভাগ কর শাদী কীই। আদমি আচ্ছা থা। পর একদিন আচানক হার্ট অ্যাটাক আয়ি। দম নিকলা আউর সশুরালসে ম্যায় নিকলি। বাঙালি থে না! মুঝে পসন্দ নহি করতি শাস, দেওর। তো ম্যায় নিকল গয়ি।
    কাজ খুঁজতে খুঁজতে, ধরতে ধরতে, ছাড়তে ছাড়তে এখন এক সম্পন্ন মাড়োয়ারি পরিবারে জায়গা পেয়েছে হরপ্রীত । একা দশজনের কাজ করতে পারে। শ্যামাকে বাঁচিয়েছিল সেই। হাসপাতালের ডোমকে বেশি পয়সা দিয়ে বডি বার করেছিল। শ্যামার তখন বোধবুদ্ধি নেই। কোনো মরদকে পাওয়া গেল না শ্মশান যেতে। সিবায়ে বিরজু । রিক্সা টানে। হরপ্রীতের সঙ্গে ভালো খাতির। কিন্তু চারটে মেয়ে জুটে গেল। হরপ্রীতের চেনা ওরা। পিঠ দেওয়ালে ঠেকলে যারা দেওয়াল ভাঙে, এরা সেই জাতের মেয়ে । রুক্মিণী সাতবাড়ি ঠিকে কাজ করে তিন মেয়ে আর পা কেটে বিছানায় শুয়ে থাকা বরের পেট চালায়। হরপ্রীত ডাকতেই বেরিয়ে এসেছে। লকডাউনে কাজ নেই। সে সবজি বিক্রি করছে। ভয় পেলে চলবে কী করে? পেট ভরবে ক্যামনে। রুক্মিণীর বোন দেবলা আর নমিতা । বডি নেবার ম্যাটাডোর পেতেও অনেকটা বেশি খরচ হল। যা আছে কুড়িয়ে বাড়িয়ে দিয়ে দিল শ্যামা। শ্মশানে বডি যখন পুড়ছে, তখন হঠাৎ সম্বিত এল। সুখন কী বলবে যদি ফিরে আসে। মুখে আগুনটাও দিতে পারল না লোকটা।
    হুহু করে কেঁদে উঠল শ্যামা । নমিতা দু হাত দিয়ে তাকে টেনে ধরে বললো, কান্দিস কেন? মুখ কোথায় যে ব্যাটা আগুন দিব? মুখ তো প্ল্যাস্টিকে বান্ধা। কোনটা আগা কোনটা পিছা বোঝবা? ছাড়ান দ্যাও।
    মেয়েমানুষ শ্মশান যায় না। শাশুড়ি বলতো। শ্যামার মা যখন মারা গেল, শ্যামাকে শ্মশানে যেতে দেয়নি বুড়ি। পুড়তে বেশি সময় লাগল না। বডি শুকিয়ে গেছিল। পাঁচজন মেয়েমানুষ জল ছিটিয়ে মাথায় দিল। ফিরে এসে আগুন ছুঁয়ে নিমপাতা দাঁতে কাটল। সেই একটা রাত। শ্যামা দেখল আশেপাশে সবার জানলা বন্ধ । যে টুসিবৌদি চারবেলা জানলার পর্দা তুলে হাঁকাহাঁকি করে, হাঁড়ির খবর নেয়, তার জানলাও বন্ধ । ছেলেকে জলমুড়ি খাইয়ে শুইয়ে দিল শ্যামা। হরপ্রীত চলে গেল রাত করে। সুখনলাল যাবার পর শ্যামার মনে হয়নি। পাশের খুপড়ি ফাঁকা। তোষক বালিশ পোড়াতে বলেছে। শ্যামার মনে হল সে অনাথ। তার কেউ নেই।
    পরদিন সকালে তার লালারস নিতে লোক এসেছিল। শ্যামাকে যখন কোয়ারেন্টাইনে নিয়ে এল, কেউ আষেনি। দু একটা জানলা খুলেছিল বটে। ছেলেকে নিয়ে গেল হরপ্রীত । মালকিনকে বলে এসেছে । শ্যামার শাশুড়ি করোনাতে মরেছে তা অবশ্য বলেনি। বলেছে বোনের ছেলে। ছেলেকে
    শ্যামা সঙ্গে নিতে চেয়েছিল। কিন্তু সে নাকি হবার না। মিনমিন করে বলেছিল , শাশুড়ির কাজটা হোক নম নম করে। তারপর নাহয় যাবে। কেউ শুনল না। শ্রাদ্ধ শান্তি হল না বুড়ির। শ্যামার মনটা খিঁচড়ে থাকল। যেন বেঘোরে চলে গেল। ট্রাংক ঘেঁটে সোনাদানা কিছু রেখে গেল কিনা দেখার সময় দিল না কেউ।
    মর্জিনা বিবি পাশের বেড থেকে শ্যামার দিকে তাকিয়ে হাসল। সেও বাড়িতে দুই ছেলে রেখে এসেছে। তার বরও গেছে রাজমিস্ত্রির কাজ করতে দিল্লি। এক ছেলেও গেছে। তারা হেঁটে রওনা দিয়েছে। বিড়ি বাঁধে মর্জিনা বিবি। হাজার বিড়িতে একশোদশ। কে জানতো তাকে করোনা ধরবে। বাজার হাট করেছে যেটুকু করার। সেটুকু না করলে হয়! ফোন আসাতে ব্যস্ত হয়ে গেল মর্জিনা।
    ছেলে , বর ফোন করে। জানায় আর কত দূর। মর্জিনা শ্যামার দিকে তাকিয়ে বলে, ব্যাটা ফোন দিছে।
    মর্জিনার একটা পা ভাঙা। খুঁড়িয়ে হাঁটে। শ্যামা জিগ্যেস করেছিল, জন্মখোঁড়া নাকি?
    ডানগালে টোল। মর্জিনা হাসে। নাহ্। জন্ম থেকে ঠিক ছিল। বর মেরেছিল খুব। কাঠ দিয়ে । তারপর ফ্রাক্টরির সিঁড়ি থেকে ঠেলে ফেলে দিয়েছিল।
    বর দিল্লি যাবে কাজে। একটা গোটা দল যাবে পঁচিশজনের। নিয়ে যাবার সময় ভাড়া নেবে জালাল। মর্জিনাকেও নেবে। মর্জিনার শরীরকেও। মর্জিনার মত সোমত্ত মেয়েমানুষের বরেরা যদি দিল্লি যায় তবে জালাল তাদের কাছ থেকে আলাদা করে হিসেবনিকেশ বুঝে নেয়। তা সে বর ঠেঙাক আর যাই করুক, হল তো খসম। তার জন্য ওটুকু করতেই হয় । ধরে ফেলেছিল বর। তারপর দিল ঠ্যাঙ খোঁড়া করে। যাইর জন্য,চুরি , সেই বলে চোর। মেয়েতে মেয়েতে দুদিনের আলাপে কত কথা। কত গল্প। রাখঢাক থাকে না দুঃখের দিনে। শ্যামা ভাবে , মুসলমান মেয়ে আর হিঁদু মেয়েতে ফারাক নেই। দুজনেই মেয়েশরীরের , মেয়েজীবনের জ্বালা যন্ত্রণার গল্প করে বেডে শুয়ে। ফারাক পায় না। তখন হাসি পায়। সেন্টারে দুপুরে মাছ রাতে মাংস। প্রোটিন । ভিটামিন সি। লেবু একটা করে। ছেলেটা কী খাচ্ছে কে জানে। অশৌচ আর মানেনি শ্যামা। বাঁচে কি মরে ঠিক নেই তার অশৌচ। হরপ্রীত ফোন দেয়। ব্যাটা ঠিক আছে।
    দুপুর কাটতে চায় না। পাঁচখানা ফ্যান ঘোরে একসঙ্গে ।
    ঘরটার সাদা দেওয়ালে ছোপ ছোপ। ফিনাইলের গন্ধ । উঠে বসল শ্যামা। ঘোর কাটেনি এখনো। তার ঘরে তালা মারা। কবে যাবে বাড়িতে? ছেলেকে নিয়ে? কত দেরি? আর তার মধ্যে যদি সুখন ফেরে? যদি ফিরে দেখে শ্যামা নেই? অত দূর থেকে ফিরে ঘরে তালা দেখবে মানুষটা? জুহিকে সঙ্গে নিয়ে আসবে নাকি?তবে তার না আসাই ভালো।

    ✨সে ও ইরফান

    স্তূপীকৃত বইয়ের নিচের থেকে একটা হাতে লেখা কার্ড বেরোলো। অনেকদিন আগেকার। ওপরে একটা হাতে আঁকা ছবি। গাছ। বড়। ছোট। নানারকমের। সবুজ হয়ে আছে কার্ডের প্রথম পৃষ্ঠা। ভিকি। জাহির। জাহিরের আঁকার হাত বরাবর ভালো। কোনো এক জন্মদিনে ওকে এঁকে দিয়েছিল কার্ডটি। ফোন পে তে দু হাজার টাকা পাঠিয়ে দিয়েছে জাহিরকে। মেটিরিয়ালস কিনবে। কার্ডে ছবি আঁকবে। একটু বেশি দাম হবে। কোভিড তহবিলে যাবে টাকাটা।
    সিগারেট ধরিয়ে একটা দীর্ঘ টান। বাহুতে বাদুড় থিরথির করে কেঁপে উঠল যেন। একরাশ ধোঁয়া গিলে নিল ড্র্যাগন । ইদানীং শুয়ে বসে থেকে থেকে মেজাজ খিটখিটে । সকালে ওয়র্ক আউট করে অবশ্য। ম্যাট পাতাই থাকে। ফ্রি হ্যান্ড। ইয়োগা। ওয়েট লিফটিং। সব মজুত আছে বাড়িতে । ঘন্টা দেড়েক শরীর ঘামানোর পর একটু ফ্রেশ লাগে। তখন একটা সিগারেট ।
    জাহিরের আঁকা কার্ড দেখতে দেখতে একটা বাসি কথা মনে পড়লো। তখন ক্লাস নাইন। ও। লং স্কার্ট । তিশা। মিডি। জাহিরের বাড়িতে গেছে বিকেলে। কোনো খাতা নেবার জন্য,বোধহয় । জাহিরের মা আদর করে বসালেন। একটু পরে বললেন, ভাত দেই। খাও? ও স্কুলফেরত কোনোদিন ভাত খায় না। পরোটা। স্যান্ডউইচ । সুজি। যাহোক কিছু অমন। তখন সে সদ্য ফিগার সচেতন কিশোরী। পলিটিক্যালি কারেক্ট হতে শেখেনি।
    হাঁ হাঁ করে উঠল, না না। আমি ভাত খাবো না।
    জাহির আহমেদের মা ইলিনা বেগম তার এই আর্তনাদের অন্য অর্থ করেছিলেন। এবং ভয়ানক মনোকষ্ট পেয়েছিলেন। তিশাও খায়নি ও খেল না বলে। কাজেই যেভাবে আগমন হল সেইভাবে নির্গমন হল না। ভেতরে একটা খোঁচা থেকে গেল। একটা ছুঁচের মত ভুলেও যে কত বড় ক্ষতি হয়ে যায়! ইলিনা আন্টি ব্যাপারটা কোনোদিন ভুলতে পারলেন না। এবং জাহিরকে সরতে হল । কিছুদিনের জন্য। জাহির বুদ্ধিমান ছেলে। মাকে শোধরাতে চেষ্টা করেনি। এইচ এসের পর নিজস্ব পরিসর তৈরি করে আবার বন্ধুবৃত্তে ফিরে এসেছে। সে মূলত স্পোর্টসম্যান। স্পোর্টস কোটাতে তার পড়াশোনা। ছবি আঁকা তার প্যাশন। ওর সঙ্গে জাহিরের বন্ধুত্ব যেমন পুরুষের সঙ্গে পুরুষের। নারীর সঙ্গে নারীর। অনায়াস। সাবলীল। জাহির রাত বারোটা বা ভোর চারটের সময় ওকে ফোন করে বলতেই পারে, কিছু টাকা ছাড়। মাল কিনতে হবে। সে মাল হুইস্কিও হতে পারে, রঙ তুলিও হতে পারে।
    ওরা কোভিডের মধ্যেও বাইরে কাজ করছে। অনেকটাই করছে। ও যেতে পারছে না। বাড়িতে প্রচন্ড অশান্তি হবে। মা নাওয়া খাওয়া ছেড়ে কান্নাকাটি শুরু করবে। বাবা উইল রিঅ্যাক্ট। সিন ক্রিয়েট করার মানে নেই কোনো। কিছুই লাভ হবে না। ও তাই দরজা বন্ধ করে নিজের ঘরে। একা। খুব দরকার ছাড়া দরজা খোলে না। রক্তিম ফোন করে। ইচ্ছেমত। সুবিধা ও সময়মতো। তাই সে রক্তিমকে ফোন করে না। সে গাছের কথা ভাবে। শিকড়ের কথা ভাবে । পাতার কথা ভাবে। হাতের শিরা উপশিরা যেন গাছের পাতা। কত জালিকা। সূক্ষ্ম জালিকা সমূহ। নীল প্রান্তরে গা বিছিয়ে সে শুয়ে থাকে। ইন মাই প্যাসিভিটি ইজ মাই অ্যাকশন। শ্যামাদির শাশুড়ি মারা যাবার পর মা ভয়ানক ডিপ্রেসড হয়ে আছে। চেনাশোনা কেউ এই প্রথম কোভিডে মারা গেল। আশ্চর্য । অচেনা কেউ মারা গেছে শুনলে এরকম রিয়্যাকশন হয় না তো! আসলে চেনা মানুষ মারা গেলে মনে হয় মৃত্যু কাছে এসে গেল। এই বুঝি ভাতের থালায়। গ্লাসের কিনারে। বাথরুমের শাওয়ারের জলে। টিস্যু পেপারে। কিলবিল করে ভাইরাস ঢুকছে। জিনিসপত্রে। বাড়িঘরে। টেবিলচেয়ারে। সম্পর্কের মধ্যে অগুন্তি ভাইরাস ঢুকে যাচ্ছে কেবল। মা খুব আপসেট হয়ে আছে। শ্যামাও পজিটিভ। আজব।
    মা যথেষ্ট কেয়ারিং শ্যামার প্রতি । কিন্তু সোফাতে বসা আলাউ করে না। যা যা রান্না হবে বাড়িতে, সব শ্যামাকে দেবে মা। কিন্তু ডাইনিং টেবিলে বসে খাওয়া অ্যালাউ করবে না। দ্যাট জেনারেশন ইজ প্রেটি কনফিউজড। কোনোটার সঙ্গে কোনোটা মেলে না। নট দ্যাট দে আর ব্লাডি হিপোক্রিটস। একটু একটু হিপোক্রিসি আছে। বাট মোর কনফিউজড। দরজা জানলা বন্ধ করে ভাবছে ভাইরাস দিনক্ষণ ঘোষণা করে এক্জিট করবে।
    ফোন করলো জাহিরকে। সিগারেট শেষ। এখানে অন্তত ভণিতাহীনভাবে কথা বলা যায় । দাদার সঙ্গেও সেটা হয়। বাট মে বি হি ইজ উইদ অদিতি। অদিতিকে ভালো লাগে। দাদা হ্যাজ ইনট্রোডিউজড। অ্যান্ড দ্য রেডি ইজ নট ন্যাম্বি প্যাম্বি।
    - তুই কোথায় জাহির?
    - নাগের বাজার। কেন?
    - হোয়াট দ্য হেল ইউ আর ডুইং দেয়ার?
    - হোয়াট দ্য হলে ইউ আর ডুইং ইওর ব্লাডি বেডরুম।
    - স্টপ স্পিকিং ননসেন্স। শোন। শ্যামাদি বিজয়গড়ের দিকে একটা কোয়ারেন্টাইন সেন্টারে আছে।
    - আমার ডানা নেই।
    - জানি। আজ না। কাল একটা খবর নিবি? ওর রিপোর্ট ঠিকঠাক আছে কিনা?
    - খবর নেবার কি আছে? যা রিপোর্ট তাই আসবে।
    - তুই কিসু জানিস না। গরিব মানুষ। লেখাপড়া জানে না। উদোর পিন্ডি বুধোর ঘাড়ে চেপে যাচ্ছে সব সেন্টারে।
    - তোর একটা শ্যামাদির খবর রাখা আমার কাজ না।
    - প্লিজ। মা খুব আপসেট ।
    - ইমোশনাল অত্যাচার। জাহির হ্যা হ্যা করে হাসলো। আমার পঞ্চাশটা কার্ড বিক্রি কর। নতুন সিরিজ। গাছ। গাছ সিরিজ। মাত্র পঁচিশ টাকা। তোর সব বড়লোকের বেটি বন্ধুদের বল। একটা করে সেট সবাই নিক।
    - কটা রেখেছিস একটা সেটে?
    ছ'টা। ছয় পঁচিশে একশ পঞ্চাশ একটা সেট।
    - ঠিক আছে। বলব। আরেকটা কাজ।
    - মাইরি তুই হ্যাজাতে ফোন করেছিস?
    - না । শোন। তুই রক্তিমকে একটা ফোন করবি?
    - কেন?
    - বলবি যে আই অ্যাম হাভিং অ্যান অ্যাফেয়ার উইদ ইউ। হি শুড স্টেপ ডাউন।
    জাহির দম ফাটিয়ে হাসল।
    - তোর সঙ্গে আমার প্রেম? জোক অব দ্য ডেকেড।
    - সেই জন্যেই তো বলতে বললাম। আই ওয়ান্ট টু গেট রিড অব হিম।
    - তো নিজে বল।
    - আমি বললে বিশ্বাস করবে না। প্রচুর চালু।
    - আমি বললে আরো বিশ্বাস করবে না। এখন ফোন রাখ। বাজার যাব।
    - কী খাওয়াচ্ছিস কম্যুনিটি কিচেনে?
    - ডাল ভাত। এখন ফুটে যা।
    - বলবি তো রক্তিমকে? বলিস যে উই আর গোইং স্টেডি।
    - তোর মাথাতে পোকা ঢুকেছে কেন বে?
    - আই ক্যান্ট স্ট্যান্ড হিম। জানিস, পি এম ফান্ডে দু হাজার টাকা দিয়ে ফেসবুকে স্টেটাস দিয়েছে। অ্যান্ড হি ট্রাইজ টু স্টপ মাই ভয়েস। ব্লাডি পেট্রিয়ার্ক। আমি বলেছিলাম পি এম ফান্ডে দিস না। এন জিও তে দে। ঠিক জায়গাতে পৌঁছবে। বলল, হি ওয়ান্টেড টু ফ্লাউট হিজ কন্ট্রিবিউশন। সো দ্যাট ইজ ডান। হি লাভস টু শো অফফ। অসহ্য।
    - শুধু এইজন্য ছেড়ে দিবি মালটাকে?
    - না। আরো আছে।
    - সেটা কী?
    - সব তোকে বলতে হবে?
    - না বললে কাজটা করবো কী করে?
    খানিকক্ষণ চুপ করে থাকল। ড্র্যাগন হিসহিসাল কানের কাছে। বাদুড় পাখা নাড়াল। কিন্তু গাছের তাতে কীই বা এসে যায় । পাতা খসে পড়বে নিজের মনে। নতুন পাতা জন্মাবে আবার। ডালপালা যত বড় হবে, শিকড় চলে যাবে তত গভীরে। ডালপালা কেউ ছাঁটতে এলে শিকড়ের কষ্ট হয়। মাটির তলার কষ্ট চোখে দেখা যায় না।
    - হি ইজ আ ট্রাবল মেকার। টেরিবল সেক্সুয়াল পার্টনার। আ মন্স্টার। আই কুইট।
    ঝপ ঝপ করে বৃষ্টি শুরু হল। ফোন রেখে দেবার আগে জাহির বলল ও ভিজে যাচ্ছে।
    ফোন স্ক্রোল করতেই প্রধানমন্ত্রীর আবেদন ভেসে এল। দেশবাসীকে প্রদীপ জ্বালাতে অনুরোধ করছেন। একদিন সন্ধেতে। সারা ভারতবর্ষ কিছুক্ষণের জন্য আলোকিত হোক।
    গাছটি তার ডালপালা বিস্তৃত করলে পাখপাখালি এসে বসে। উড়ে গেলেও সন্ধেবেলা ফিরে আসে। বাসা বাঁধে। গাছ ভাবে ঐ তার নিজের বাসা। বাতাস বয়। পাতা দোলে। পাতার ঠান্ডা লাগে। একটা আশ্চর্য সুন্দর পাখি উড়ে যায়। বৃক্ষ হয়ে যেতে যেতে সে জল হয়। মাটি ও হয়। গাছের ভিতর কত কিছু থাকে।
    -মানুষ কী এক্সটিংক্ট হতে চলেছে ইরফান?
    - হয়তো। ইরফানের চোখে অদ্ভুত ঔদাসীন্য । অথচ উষ্ন।
    - মানুষ কেবল নিজের নিয়ে ভাবল। নিজের অস্তিত্বকে ভুঁড়ি বাগিয়ে টিকিয়ে রাখার জন্য নিশ্চিহ্ন করে দিল উড়ানহীন পাখিকুল। ডোডো পাখি। মানুষকে ভয় পেত না। কাছে চলে আসতো মানুষকে নিরাপদ ভেবে। যারাই মানুষকে নিরাপদ ভেবেছে তারাই ঠকেছে। মরিশাসের ডোডো, নিউজিল্যান্ডের মোয়া, লাফিং আউল, আমেরিকাতে ল্যাব্রাডর ডাক, অস্ট্রেলিয়াতে প্যারাডাইস প্যারট । সব নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে জানো। আরো কত পাখি। কত প্রাণী। গন্ডার। জঙ্গল কেটে ফেলেছে। মাংস খাবে বলে মেরেছে।
    ইরফান একটা লম্বা শ্বাস নিলেন। আজিব সি বাত হ্যায়। আদমি কিসিকে বারিমে নই সোচতা।
    অব উসকে বারিমে সোচেগা কৌন?

    ✨কে আবার বাজায় বাঁশি

    কিছু পোশাক মানে টি শার্ট , বার্মুডা কেনা দরকার। আসলে ও খুব বেশি জামাকাপড় জমায় না। জন্মদিন। পয়লা বৈশাখ। পূজো। যা পায় তাতে দিব্যি চলে যায় । মা অনলাইনে পাঠায়। অদিতি কিনে ফেলে দুমদাম। জানুয়ারিতে শেষ কিনেছিল। এখন খুব দরকার । সাধারণত হংকং লেন থেকে এসব কেনে। শস্তা পড়ে। ছাত্রছাত্রীদের ভিড় থাকে জায়গাটাতে। ঘষটে হলুদ রঙের টি উড়ছে ব্যালকনিতে। কালো শর্টস। অ্যামেরিকান সোসাইটি ফর মাইক্রোবায়োলজি থেকে দুটো মেইল। আজ ক্লাস আছে বারোটা থেকে। পড়াবে ভাইরাসের প্যাথোজেনেটিক, এপিডেমিওলজিকাল, আর,ক্লিনিকাল ফিচারগুলো। একটা ওয়ান পট মিল বানিয়ে নেওয়া ভালো। দশটার দিকে ও সেটা নামিয়ে নেয়। ভাতটা করে নেয় আগে। সাদা তেলে কাঁচা লঙ্কা । পেঁয়াজ, রসুন, আদা কুচি। এই গন্ধটাই সব। বাড়ির কথা মনে পড়িয়ে দেয়। মা। হাল্কা নীল টাইলস বসানো রান্নঘর। পুরোনো সেই ঢাউস ফ্রিজটা। গুচ্ছের ম্যাগনেট লাগানো। মা রেগে যেত।
    পেঁয়াজ রসুন বাদামি হলে ও মাংস আর আলু কুচি ছেড়ে দেয় । ভাজতে ভাজতে গন্ধটা নেয় । তারপর হয়ে এলে ভাতটা দিয়ে দেয়। একসঙ্গে ভেজে নেয়। নামানোর,আগে এক চামচ ঘি। বা মাখন। ঘরটা মোলায়েম মাখন গন্ধে ম' ম' করে। এই ওয়ান পট আর কফি। ও সারাবেলা চালিয়ে নেয়। ল্যাপটপ খুলছে। বৃত্তাকারে ঘুরছে চিহ্ন। এখন ও ঢুকে যাবে নেট দুনিয়ার অন্তর্জালে।
    পড়াবে। এবার অ্যাসাইনমেন্ট হবে কোভিড ওরিয়েন্টেড। ও বোঝাবে যে কোভিডের উপসর্গ ঠিক নিউমোনিয়ার মতন। সিভিয়ার অ্যাকিউট রেসপিরেটরি সিন্ড্রোম। আতঙ্কে ভুগছে সবাই । কেমন বেঢপ হয়ে আছে জীবনযাত্রা। অথচ এস এ আর এস কোভিডের মারণক্ষমতা এম ই আর এস বা মিডল ইস্ট রেসপিরেটরি সিন্ড্রোমের চেয়ে অনেক কম। শুধু কোভিডের প্রজনন ক্ষমতা বেশি। অনেকটা বেশি তবে অ্যাকচুয়াল সংখ্যাটা কন্ট্রোভার্শিয়াল।
    ওপার থেকে স্টুডেন্ট মাইক্রোফোন অন করে। স্যর। ইজ দেয়ার এনি গ্যাসট্রোইনটেসটাইনাল রুট অব ট্রান্সমিশন?
    এটা এখনো প্রিঅ্যানালিটিক্যাল স্টেজে আছে। রেসপিরেটরি ট্র্যাক্ট কালেক্ট করা যাচ্ছে না। ইট ইজ নট ইয়েট পসিবল। স্পেসিমেন। রাইট অ্যানাটমিক সাইট।
    ফোন বেজে ওঠে।
    ওর রিং টোনে যেসুদাস।
    সুরমাই আঁখি অদিতির। মুখের অর্ধেক মাস্কে ঢাকা। ভিডিও কল। সহ্যাদ্রি সুপার ফেসিলিটি হসপিটালের সামনে আছি। কুড ইউ কাম? মকরন্দ'স ফাদার হ্যাজ বিন অ্যাডমিটেড। হি ইজ ব্রোকেন। আই ক্যাননট হ্যান্ডল। খুব ভেঙে পড়েছে।

    মকরন্দ যোশি। বন্ধু। ফার্গুসন কলেজের পেছনে বাড়ি। নিজে রিপোর্টার। ফ্রি লান্সার। ডেকান টাইমস । শুড হ্যাভ বিন কেয়ারফুল। ওর বাবা সত্তরের ওপরে। মকরন্দ ইজ দ্য ইয়ংগেস্ট সন। ল্যাপটপ বন্ধ করে ও একটা সাদা কুর্তা গলিয়ে নেয়। পার্স । ফোন। স্যানিটাইজার । পেন। ঘড়ি পরতে পরতে ঘরটা চোখ বুলিয়ে নেয়। নোংরা হয়ে আছে। আজ ক্লিনিং হয়নি সকাল থেকে। বিছানা এলোমেলো। মা দেখলে কী ইরিটেটেড হত!হেলমেট , চাবি নিয়ে নেমে এল নিচে।
    ওয়াচম্যান ঢুলছে। অসম্ভব টিডিয়াস কাজ। সারাদিন বসে থাকো। বসে থাকো। লক ডাউন মেকস নো ডিফারেন্স ইন হিজ কেস।
    বাইরেটা ফাঁকা। সুনসান রাস্তা। এমনিতেই এই অঞ্চল নিরিবিলি। এখন খাঁ খাঁ করছে। এত শূন্যতা কী পৃথিবী ডিজার্ভ করে? বোধহয় করে। বড় বেশি ভিড় হয়ে যাচ্ছিল। বড় বেশি দ্রুত যাচ্ছিল সবকিছু।
    বাইক স্টার্ট করতে গিয়ে মনে পড়ল। সামথিং মিসিং। সামথিং ইমপরট্যান্ট।
    মাস্ক নিতে ভুলে গেছে।
    আবার ওঠা। অনন্ত সিঁড়ি বেয়ে । লিফ্ট খারাপ হয়েছে লকডাউনে । মেকানিক ডাকা যাবে না। ওপরে বয়স্কদের ভয়ানক অসুবিধে হচ্ছে।
    সিঁড়ি বেয়ে উঠতে গিয়ে লকডাউনোচিত শূন্যতা গ্রাস করে। কতবার। কতবার এই উঠে যাওয়া আর নেমে আসা। ক্রমাগত । দিনের পর দিন।
    অন্য সময় ও, অদিতি, মকরন্দ। চলে যেতে পারতো কোনো ইটারিতে। পরিচ্ছন্ন সাদা টেবল ক্লথ। চিকেন চিজ স্যান্ডউইচ আর শেক। দুতিনঘন্টা কেটে যেত। মকরন্দ চলে যেত রিপোর্টিং এ। অদিতি ওকে নিয়ে যেত পার্ল হাউসে। ওখানে স্ক্রিনিং হয়। ডাবিং। এডিট। রাফেজ দেখাত নতুন কাজের। আ মিনিংফুল ডে।
    এখন ওরা কোথাও যাবে না। তিনজন চুপ করে বসে থাকবে। কিছু বলার নেই। শুধু যাওয়া । গিয়ে পাশে দাঁড়ানো।
    হোয়াট ইজ মিনিংফুল? মিনিংফুল বলে আদৌ কিছু হয়? এভরিথিং ইজ ম্যানমেইড । এটার মানে আছে। এটার মানে নেই। বুলশীট।
    মাস্ক নিয়ে নিচে নামল।
    ওয়াচম্যানের ঢুলুনি ভেঙেছে। ওকে দেখে উঠে দাঁড়াল।
    মুখোমুখি দাঁড়িয়ে মাস্ক পরা দুই মানুষ। অনেকটা দূরত্বে। মুখবন্ধনীর আড়াল থেকে প্রশ্ন এল। কাঁহা যা রহে হো সাব?
    হসপিটাল। ফ্রেইন্ডকি ফাদার অ্যাডমিটেড হ্যায়।
    জলদি লওটনা। গেট লাগানা হ্যায়। সোসাইটিকা নয়া কানুন। দের মত করনা সাব।
    দেরি নয়। দেরি নয়। তাড়াতাড়ি । যত তাড়াতাড়ি পারো। ডেডলাইন। ফাস্ট। সুপারফাস্ট। এফিশিয়েন্সি। স্মার্টনেস । এইসব চক্করে দুনিয়া ভোঁতা হয়ে গেল। একেবারে ভোঁতা । আনিনটেরেস্টিং। এই স্মার্টনেস মাটিতে পড়ে থাকা পিচ্ছিল ময়ালের মত সর্বগ্রাসী ও সুযোগের অপেক্ষায় । জোরে স্টার্ট দিয়ে তাকে আহত করে চলে গেল দ্বিচক্রযান।

    ✨কোভিডের কালে প্রেম

    অদিতি প্রেস কার্ড রাখে। প্রেসের সঙ্গে যুক্ত অনেকদিন হল। সহ্যাদ্রি ডেকান হসপিটালের সামনে দাঁড়িয়েছিল। মুখে মাস্ক। চোখে রোদ চশমা। মাথায় ওড়না টাইট করে বাঁধা। মকরন্দ একটু দুরে ফোনে। দেবরূপ অদিতির কাছে গিয়ে দাঁড়িয়ে । তোকে ব্যান্ডিট কুইনের মত লাগছে। পুতলিবাই। অদিতি গ্রাহ্য করল না। স্যানিটাইজার দিয়ে হাত কচলালো। ওর দিকে এগিয়ে দিল শিশি। কড়া রোদ। ফোন শেষ করে ফিরে আসছে মকরন্দ। বিধ্বস্ত দেখাচ্ছে। ওর বাবার কিডনি এইলমেন্ট আছে এমনিতেই।
    তিনজন মুখবাঁধা মানুষ বেশ খানিকটা দূরত্ব দাঁড়িয়ে । বেশিক্ষণ থাকা যাবে না এখানে। সিকিউরিটি সাবধান বার্তা শুনিয়ে গেছে। মকরন্দের বাবাকে নিয়ে যাওয়া হয়েছে আই সি ইউতে। প্রচন্ড শ্বাসকষ্ট গতকাল থেকে।
    তিনজন এক মিটার করে দূরত্ব বজায় রেখে যেটুকু কথা বলা যায় । ততটুকু। আসা জরুরি। নইলে মানবিক দূরত্ব তৈরি হয়।
    মকরন্দ এরপর হোম কোয়ারেন্টাইনে ঢুকে যাবে। বিল্ডিং সিল করে দেওয়া হয়েছে এরমধ্যেই। ভলান্টিয়ার্স সাপ্লাই দেবে গ্রসারি ও মেডিসিন। সকাল থেকে কিছুই খায়নি মকরন্দ। হসপিটাল ক্যান্টিনে তিনজন চুপচাপ। এক প্লেট করে ইডলি। কফি। দেবরূপ খেল না। ওয়ান পট ইজ হেভি। সন্ধে পর্যন্ত টেনে দেবে। টুকটাক কথা। কিছুই বলার নেই আপাতত। অদিতির এক আত্মীয় আছেন এই হাসপাতালে। নিউরোসার্জন। বিশেষ অনুরোধ করা হয়েছে রোগীকে দেখার জন্য।
    আজকাল হাসি পায়। সবাই। প্রত্যেকটা মানুষ বিশেষ হতে চায়। আমারটা আগে। আমারটা স্পেশাল।
    বাইকে বেরিয়ে গেল মকরন্দ।
    প্রায় সাতদিন বাদে ওরা দু'জন। অদিতি সানগ্লাস খুললে বোঝা যায় প্রচুর ট্যান। গাঢ় বাদামি ত্বক ঝিকমিক করছে। কানে কেবল একটা লম্বা মেটালের কিছু।
    পেল্লায় একটা ঘড়ি পরে অদিতি। অনেক কায়দা কানুন আছে। ঘড়ি দেখে বলল, ডু ইউ হ্যাভ টাইম?
    ক্লাস ছেড়ে এসেছে। পরে সন্ধেতে নিলেও হবে। ও মাথা নাড়ল।
    ফাঁকা শহরের রাস্তায় একটা বাইক ও একটি স্কুটি ছুটে গেল আগা খান প্যালেসের দিকে। এখন কিছুটা সময় ফাঁকা আছে। দুজনেরই । ইশানিয়া মলের রাস্তা ধরল। বন্ধ মল দৈত্যের মত দাঁড়িয়ে । মুখে মাস্ক প্রহরীরা ঘুরে বেড়ায় ফাঁকা চত্বরে। হলিউডি ছবির মত স্টিল। শান্ত অথচ ভয়ংকর।
    আগা খান প্যালেসের পেছনের রাস্তায় বিশাল পিপুল গাছটির নিচে বসলো দুজনে। হেলমেট খুলে পাশে । নিস্তব্ধ দুপুরের একটা খাঁ খাঁ করা সৌন্দর্য আছে। ঘাম, বিরক্তি ও ধৈর্য মাখা। তবে এই রাস্তাটি ছায়াময়। গাছের অপ্রতুলতা নেই। একটা হাল্কা বাতাস আছে। অদিতি রোদচশমা খুলে চোখ মুছল।
    - অ্যালার্জি । খুব প্রবলেম হচ্ছে।
    - সেই ওষুধটা? যেটা নিস্ অ্যালার্জি হলে?
    - কাজ হচ্ছে না। প্রব্যাবলি আই 'ল হ্যাভ টু চেঞ্জ দ্য মেডিসিন।
    - চোখ দেখে মনে হচ্ছে তোর জ্বর এসেছে?
    - মি? ও নোহ্! নো ফিভার! হাসল অদিতি।
    আমার সহজে জ্বরটর হয় না। স্ট্রংগ ইনাফ। ইউ নো।
    ও মাথা নাড়ে।
    ভালো। এই সময়ে কোনোরকম জ্বরজারি না হওয়াই ভালো। কীসের থেকে কী টার্ণ করবে কে বলতে পারে। তবে অদিতি সাবধানে চলে। বড় বেশি ঘোরাঘুরি করে বলে চিন্তা। শী লাভস হার ওয়র্ক। ভীষণ ডেডিকেটেড।
    নিঃশব্দে বসে থাকলো দু'জনে। অনেকক্ষণ । সিগারেট খেল না কেউ।
    কোনও কথাও বললো না। প্রকৃতিকে মাঝে মাঝে ছাড় দিতে হয়। ও ভাবে। মানবপ্রকৃতিকেও। রাস্তার দুপাশে ঘন গাছপালা। হয়তো সেইজন্য । অথবা জনসমাগম এখন নেই, তাই। পাখির ডাক শোনা যায় । তীব্র। হুইসল বার্ড ।
    খানিকটা আনমনাভাবেই বলল।
    -তোর পেরেন্টস? ঠিকঠাক?
    -আছে। তোর? কাকিমা স্টিল স্টাক আপ ইন কলকাতা !
    - ইয়াপ। অ্যান্ড ড্যাড ইন ব্যাঙ্গালোর।
    আবার চুপ। গাছের পাতা পড়ে উড়ে যায় ।
    - ইউ নো? দে আর কিলিং ব্যাটস ইন ব্যাংগালোর। অ্যান্ড ইন সাম প্লেসেস অব পুনে অ্যাস ওয়েল।
    - পড়েছি। এটাই তো হবার ছিল। এটাই মানুষের স্বভাব। একবার শুনেছে। বেড়ালের থেকে রোগ ছড়াচ্ছে । বেড়াল মারো। কুকুরের থেকে রোগ ছড়াচ্ছে । কুকুর মারো। বাদুড় থেকে রোগ ছড়াচ্ছে । বাদুড় মারো। আ ট্যারা রং কনসেপ্ট। পুরো ভুল।
    - কী? বাদুড়?
    - হ্যাঁ । ইট ইজ নট অ্যাজ সিম্পল অ্যাজ দ্যাট। বাদুড় আর কোভিড নাইন্টিন কানেক্টেড নয় ঐভাবে। দু' হাজার ব্যাট স্পিশিসের মধ্যে একটা মাত্র প্রজাতি একটা ভাইরাস ক্যারি করে। আর এ টি জি থার্টিন । যার নাইন্টিন টু পার্ফেক্ট ফিচার কোভিডের সঙ্গে যায়। এই বাদুড়গুলো শহর গ্রামে মানুষের ধারেকাছে থাকে না। আর এখানে শালা সব বাদুড় মারো অভিযান শুরু করেছে।
    অদিতি পা মুড়ে বসে। গাছে হেলান দিয়ে । চোখে জল পড়া কমেছে কিছুটা।
    - আই লাইক ব্যাটস। বাচ্চা গুলোর মুখ খুব সুইট।
    - জানি। তোর ইঁদুর বাদুড় পছন্দ।
    - ইয়েস। দে আর সুইট। লাইক ইউ। অদিতি ফিচেল হাসে। তুই বাদুড়মুখো।
    - ফালতু বাদুড় মেরে যাচ্ছে। সো ইনসিপিড। দেবরূপের চোখে ঘোর।
    - জানিস? বাদুড় আসলে ফুল টুল ছিঁড়ে নষ্ট করে না। মশা, মাছি। মথ। এইসব খায়। আসলে ওরা
    ফুলকে পলিনেট করে। যেসব ফুল রঙে একটু ডাল, মানে ধর তোর মত , রাতে তারা আশ্চর্য সব সুগন্ধ দেয়।
    - কী দেয়?
    - সুগন্ধ। ফ্রেগরান্স। স্ট্রংগলি ফ্রেগরান্ট ফ্লাওয়ারস। সেই সুগন্ধের জন্যে বাদুড় ফুলের কাছে যায় ।

    এই পৃথিবীতেই । অনেক দূরে কোথাও। সভ্যতার থেকে বিচ্ছিন্ন কোনো আদিম অরণ্যে রাত ঘনিয়ে আসে। কোবাল্ট ব্লু আর জেট ব্ল্যাক মেশানো অন্ধকারে নিষ্প্রভ রঙের সতেজ অরণ্যফুলেরা তীব্র তীব্রতর সুগন্ধ ছড়ালে বাদুড়ের দল নেমে আসে তাদের কাছে। পরাগমিলন ঘটে।

    আগে খান প্যালেসের ধূসর পরিসর, লাল টাইলসের কনট্রাস্ট আর চারদিকের সবুজে এক রৌদ্রস্নাত মায়াময় আবহ তৈরি হয়। এই সেই প্রাসাদ যেখানে দুর্ভিক্ষপীড়িত মানুষকে দান দেওয়া হত। নিজারি ইসমায়েলি মুসলমানরা দানছত্র করতেন। গাঁধী গৃহবন্দি ছিলেন এখানে। কস্তুরবাও। তাঁর সমাধি এই প্যালেসেই। মুসলিম লীগের আকণ্ঠ সমর্থক আগা খান।
    বড় বড় গাছের সমারোহ। টুরিস্টে ভরে থাকে জায়গাটা। এখন শান্ত। যেমন হওয়া উচিত। সবুজ কিছু বনটিয়া উড়ে গেল মাথার ওপর দিয়ে । বসন্তবৌরি ফাঁকফোঁকরে উড়ে যায় ।

    দুটি তরুণ ওষ্ঠ ও অধর সংযুক্ত হলে বনটিয়ার ডাক কানে পৌঁছায় না। এ মুহূর্তে সোশ্যাল ডিসট্যান্সিং শূন্যে তোলা থাকে।

    ✨মালবিকা। একা।

    রান্নাঘর নিজের হাতে এসেছে পর থেকে একেবারে ঝকঝকে তকতকে। শ্যামা আর বুলকিও পরিষ্কার করে বটে। কিন্তু মালবিকার নিজের হাত যখন জগন্নাথ , তখন একেবারে টেলিভিশনের বিজ্ঞাপনের রান্নাঘর হয়ে গেছে। চিমনি নিজের হাতে মুছে দিচ্ছেন রোজ। এতটুকু তেলচিটে নেই। প্রত্যেকটা শেল্ফ ডিসিনফ্যাকট্যান্টের বর্ষণ পাচ্ছে। বর বলছে বাতিক। মালবিকা থোড়াই পরোয়া করে। একটা সমস্যা হচ্ছে। অনলাইনে জিনিস কেনার অভ্যেসটা বাধাপ্রাপ্ত এখন। ক্যুরিয়ার হচ্ছে না। বেশ লাগে মালবিকার । ঐ যে স্কুল থেকে ফিরে দেখে একটা ব্রাউন পেপারে মোড়া বাক্স এসেছে। ওপরে লেবেল সাঁটা। অনেকসময় বাক্সটা না খুলেই রেখে দেয় সে। একটা অদ্ভূত রোমাঞ্চ থাকে। আছে। নতুন কিছু একটা আছে। অকারণের জিনিস। হয়তো একটা পটারি। চায়ের সেট। একটা নতুন রকমের ব্লেন্ডার। একটা নেকপিস। বরের বা ছেলের টি শার্ট। মেয়ের জন্য কিছু কিনতে সাহস পায় না। তার মুড পেন্ডুলামসম দোদুল্যমান । বেশির ভাগ সময় উত্তুঙ্গে । গ্রে , ব্ল্যাক বা প্রুশিয়ান ব্লু।
    রান্নাঘরে গোলাপি বা হালকা হলুদ মুড রাখে মালবিকা । হাল্কা। লেমন ইয়েলো টাইলস। তাতে রান্না করতে ভালো লাগে। অনেক রকম ন্যাপকিন আনিয়েছে অনলাইনে। রান্নাঘর ওর প্যাশন বলা যেতে পারে। এখন ইউ টিউব ভীষণ বন্ধু । ফেসবুকেও নতুন ধরনের রান্না সব। আজ বাড়ির ওপর বড় বড় সরপুঁটি এসেছিল। খুব আনন্দ করে কিনে ফেলল। সরপুঁটির ঝাল। একদম কালোজিরে কাঁচালঙ্কা কম্বিনেশনে। ঝোলটা একটু ঘন। রান্নাঘর সংলগ্ন একচিলতে বারান্দা ওর কিচেন গার্ডেন। লেবু। লংকা। পুঁইশাক। ওপরে ছাতের গাছে পেঁপে ধরেছে। বর , মেয়ে দুজনেই বাড়িতে । এক ছেলেটা বাইরে । একা। তা নইলে এমন সুখ আর কী হতে পারে। কাজের চাপটা খুব বেশি। সেটাই এক নেগেটিভ পয়েন্ট।
    শুতে অনেক রাত হয় তার। রাতের খাবার দশটা। তারপর রান্নাঘরের কাজ শেষ করে, এঁটো বাসন ধুয়ে বিছানায় উঠতে সাড়ে এগারো। এরপর সে একটু ফিল্ম দেখে। নেটফ্লিক্স। আমাজন প্রাইম। ঘুমোতে প্রায় দুটো। এরপর আটটার আগে ঘুম ভাঙে না। উঠেই ব্রেকফাস্ট । বেশ হেভি বানায়। ঘর মুছে স্নান করে অনলাইন ক্লাস দুটো। দুপুরের রান্না । বাসন ধোয়া । আবার দুটো ক্লাস। লেসন প্ল্যান। কেন যে লোকে ভাবে ঘরে বসে মাইনে পাচ্ছে!বিকেলে একটু গড়ায় । কোমরে একটা ব্যথা। ঘর মুছে ব্যথাটা বেড়েছে। কোমর বয়স জানান দেয় আগে। আর হাঁটু। তারও আগে চোখ।
    মাছের ঝাল নামিয়ে টুক করে একটা ছবি তুলে রাখলো ফোনে। বন্ধু গ্রুপে দেবে। ফেবুতে হারগিস নয়। ওখানে দিলেই নীতিপুলিশরা তেড়ে আসবে। করোনার সময় খাবারের ছবি। ! নির্লজ্জ! চরিত্রহীন!এইসব বলবে। আহারে। নিজেরা যেন সব না খেয়ে আছে। দেখোগে ঠিক খাসির মাংসের দোকানে লাইন দিচ্ছে মাস্ক পরে। আর ছবি দিলেই দোষ। তার নিজের মেয়েটাও ঐ পদের। খুঁত ধরছে সবসময় । জ্ঞান দিচ্ছে মুখটা সবজান্তার মত করে।
    মালবিকা মেয়েদের গ্রুপে পোস্টাবে বাপু। ঝামেলা নেই। অনেকেই লকডাউনে শস্তায় পুষ্টিকর নানারকম খাবারের রেসিপি আর ছবি দিচ্ছে। এসব না থাকলে ল্যাপটপে ঘাড়গোঁজা বর আর ঘরবন্দি হয়ে থাকা মেয়ে নিয়ে পাগল হয়ে যেত মালবিকা। কাঁচখোলার খোসা খুব যত্ন করে শিলে বাটলো। মিক্সিতে নয়। শিলে বাটলে একটা কচকচে ব্যাপার মুখে লেগে থাকে। ওটা মিক্সিতে দিলে একেবারে লেই হয়ে যায় । বিশ্রী । রসুন ছাড়াতে ছাড়াতে তেল গরম হচ্ছে। লেমন ইয়েলো টাইলসে তেলের ধোঁয়া । চিমনি টেনে নেয় শোঁ করে।
    মালবিকার বাপের বাড়িতে একটা বিশাল রান্নাঘরের কারবার ছিল। একদিকে উনুন। স্টোভ। অন্যদিকে গ্যাস। অনেকটা রান্না উনুনে । উনুন ধরানোর একটা প্রস্তুতিপর্ব। ধোঁয়া। গুল। হাতপাখা। মালবিকার ছোটবেলার স্মৃতির সঙ্গে এসব জড়িয়ে পাল্টিয়ে মিশে আছে। অতজনের বাড়ি। মায়ের এক ছোটোদাদুও থাকতেন। সেইসব বিস্তৃত রান্নাঘরে তাকে থাক থাক কাঁসার থালা, বাটি, গ্লাস থাকত।
    এ বাড়ির কাঁসার দ্রব্য মালবিকা পালিশ করে তুলে রেখেছে।
    লকডাউনে স্রেফ লা ওপালা।
    মেয়ে ঠোঁট উলটে বলেছে, ওটা চিনে।
    এক্সস্ট ফ্যানটা খারাপ। চিমনি চললেও ওটা লাগে। মালবিকা বোঝে প্রেশার ফ্লাকচুয়েট করছে। হরমোন ব্যালান্সড নয় এখন। এটা মেনোপজাল ডিসঅর্ডার । সময় লাগবে। হঠাৎ হঠাৎ ভীষণ কান্না পায় তাঁর। তখনি বাপের বাড়ির পুরনো রান্নাঘরে বিশাল উনুনের পাশে বড়জ্যেঠিমা বা গ্যাসে বড় লোহার কড়াইতে ঠাকুমার জন্য দুধ জ্বাল দেওয়া মায়ের আঁচলের তলায় গিয়ে লুকিয়ে পড়তে ইচ্ছে করে। এইসব ছেলেমানুষি কার কাছে বলবে সে। লোকে হাসবে।
    মাজা প্রদীপটা ডাইনিং এ ঝকঝক করছে। এপ্রিলের পাঁচ তারিখে খুব যত্ন করে প্রদীপ জ্বালিয়েছিল সে। ছাতেও প্রদীপ দিয়েছিল। মনে হচ্ছিল অকাল দিপাবলী।
    হাতগুলো বিশ্রী খরখরে হয়ে আছে। ম্যানিকিউর, পেডিকিউর হচ্ছে না কতদিন! নখপালিশ তুলে ফেলেছে। নতুন করে আর লাগানো হয়নি আলসেমিতে। সারাদিন বাসন মেজে , হাত ধুয়ে যা অবস্থা ।
    মাছের ঝোলটা দেখতে অতি চমৎকার । বাওলটা ডাইনিং টেবলের মাঝখানে রাখল। মৌরির গন্ধটা চমৎকার লাগছে। ছোট পোর্সিলিনের বাটিতে কাঁচকলার খোসা বাটা। মুগের ডাল। আলু ফুলকপি দিয়ে । ঝিঙে পোস্ত। আমের চাটনি। মেয়ে শুধু ডাল আর ঝিঙে পোস্ত খাবে। ড্রাই টোস্ট দিয়ে । খাওয়া দেখলে পিত্তি জ্বলে।
    টিভি খুলে দিয়ে, ভাতটা আনার জন্য পা বাড়াল। তুলাইপান্জি । সেন্টেড। এবার বর ও মেয়েকে ডাকতে হবে।
    খবরের চ্যানেল ধরাই ছিল।
    মারা গেছে। বারো বছরের জামালো মাদকম। তেলেঙ্গানার লঙ্কা কারখানাতে কাজ করতে গেছিল আনদাও ও সুকামতি মদকমের একমাত্র মেয়ে জামালো। শুকনো কাঠ কুড়িয়ে যা রোজগার।
    বাড়ি ফিরতে মাত্র এগারো কিমি বাকি। তিনটি শিশু ও আটজন মহিলা শ্রমিকের পায়ে হাঁটা দল।
    ডিহাইড্রেটেড। অভুক্ত শরীর।
    জামালো মরে গেল।
    হঠাৎ ভীষণ গা গুলিয়ে উঠল মালবিকার । বমি। টক জলে ভর্তি হয়ে গেল মুখ।
    সকালে পরোটা তরকারি । উঠে এল সবটা।
    দৌড়ে বেসিনে গেল।
    আর কখনো খাবার সময় টিভি খুলবে না মালবিকা। কখনো না।

    ✨তা বলে কী প্রেম দেব না

    কোয়ারেন্টাইন সেন্টারে আজ সকালেই খুব খানিকটা হুড়োহুড়ি হাসাহাসি হল। ইসকুলবাড়িটা শহর থেকে বেশ খানিকটা দুরে। মোটামুটি ফাঁকা জায়গা। অনেকটা দূরে ইতস্তত কিছু বাড়িঘর দেখা যায় । মেয়েরা আছে তিনতলার দুটো ঘরে। পুরুষরা আছে দোতলায়। তিনতলায় চারটে বাথরুম। দোতলাতে তিনটে। সকালবেলা পায়খানা যাওয়া নিয়ে বেশ খানিকটা হুড়োহুড়ি লাগে। তবে এই লাইন দেওয়াটা খানিকটা বস্তির মতই ব্যাপার। তাই গা সহা। শ্যামার অবশ্য নিজের বাথরুম পায়খানা আছে। সুখনলাল নিজের হাতে ইঁট গেঁথেছিল। কিন্তু মর্জিনার নেই। শাকিলাবানুর নেই। বহ্নিকুমারীর নেই। ওরা রেল লাইনে যায়।

    আজ সকালে ছেলেদের বাথরুম সব বন্ধ ছিল বলে সূরয বাইরের ঝোপে চলে গেছিল। কদিন ধরে ও নাকি তাই যায়। যখন চাপতে পারে না। যাবি তো যা, যে ঝোপে গেছে তার পাশেই আবার গ্রামের দুটো বউ এসেছিল । তাদের গ্রামে পাকা বাথরুম পায়খানা নেই। সূরযকে দেখে তারা তো চেঁচিয়ে মেচিয়ে অস্থির। আশপাশের লোক এসে সূরযকে পিটিয়েই মারত। সূরয " হাম করোনা পেশেন্ট হ্যায় " বলে চেঁচাতে সব ভেগে গেছে আর সূরয সেই সুযোগে দৌড়ে ফিরেছে সেন্টারে। সেই নিয়ে খুব একচোট হাসি । ইয়ার্কি হল। ডাক্তার আসাতে ঠান্ডা হল সবাই। ডাক্তারের মুখ তো দেখেনি কেউ। পিপিই সব ঢেকে রেখেছে। তবে মানুষটি ভালো। প্রত্যেক বেডে যান । আলাদা করে চেক করেন।
    শ্যামার জ্বর আসেনি আর। শাশুড়ি মরার সময় খেয়ালই করতে পারেনি যে তার নিজের গায়ে জ্বর এসেছে, এমন টেনশন ছিল। বুড়িকে হসপিটালে যখন এনেছিল তখন তো আর জানত না যে কী হয়েছে। জ্বর, বমি বেশি হয়ে গেল, তো হাসপাতালে না এনে করবে কী?
    মর্জিনার পেট খারাপ । সকাল থেকে কাঁথা মুড়ি দিয়ে শুয়ে আছে। দুটো বেড পরে একটা বছর কুড়ির মেয়ে আছে। শ্যামা প্রথমে শুনেছিল করোনা নাকি কম বয়সীদের ধরে না। তা এখন দেখছে করোনা বয়স টয়স মানছেই না। বাচ্চা মেয়েটাকেও ধরেছে। মেয়েটা নাকি প্লেয়ার। কাবাডি খেলে খুব অনেক জায়গা ঘুরেছে। বলে ন্যাশনাল খেলেছে। দিল্লি, মুম্বাই । সব ঘুরেছে। খুব স্মার্ট মেয়ে । বেশ লাগে শ্যামার । কাবাডি খেলে এত জায়গা ঘোরা যায় সে তো আর ও জানতো না। মর্জিনার পাশের বেডে ইসমাতারা । সেও ঘুমায়। বাড়িতে চারখানা বাচ্চা রেখে এসেছে ইসমাতারা। একটা আবার ছ' মাসের। খালি কাঁদে । আর ঘুমায়। খাবার এলে উঠে বসে খায়। খেতে খেতে এদিক ওদিক দেখে ভাসা ভাসা চোখে। তার খসম তো রাঁধতে জানে না। তাহলে এই কদিন কী হবে। তাই ভেবে কাঁদে। যদি পাশের বাড়ির নিলি খাবার করে নিয়ে আসে তবে তো ইসমাতারার সংসারে আগুন ধরবেই। সে নেই বাড়িতে আর তার বরকে খাবার দিয়ে যাবে নিলি! হয়তো গিয়ে দেখবে নিকাই করে নিয়েছে। এই ভেবে কাঁদে। সর্দি মোছে। শ্যামা রেগে যায় । অত কান্নার আছে কী রে বাবা। ইসমাতারা খেয়ে মুখ ধুয়েই আবার শুয়ে পড়ে। ওপাশের বেডে প্লেয়ার মেয়েটা। জ্যোতি। এই বেড থেকে ঐ বেড গল্প হয়। মর্জিনা অঘোরে ঘুমায় । ইসমাতারা ফোঁপায়। জ্যোতি জানতে চায়, শ্যামার বর কোথায়, ছেলে কোথায় । হরপ্রীতের কাছে ছেলে ভাল আছে। ফোনে দুবেলা কথা হয়। নিজের একঢাল চুল টাইট করে বাঁধতে বাঁধতে শ্যামা বলে, বর কাজ করে । মুম্বাইতে । হেডমিস্তিরি । প্রচ্ছন্ন গর্ব থাকে ভঙ্গিতে । শ্যামাকে আড়চোখে দেখে বাকি মেয়েরা।

    কোয়ারেন্টাইন সেন্টারে সব কিছু টাইমমাফিক। এত সময় কাটতে চায় না। শ্যামার মোবাইলে অত কিছু নেই যে সবসময় মোবাইল ঘাঁটবে। শ্যামা গলা বাড়িয়ে গল্প জোড়ে। পিপিই পরা নার্স ধমক দেয়। সে সরে গেলেই আবার কথা। ইশকুলের মত। দিদিমণি সরলেই হল। সুখদুঃখের কাঁথা বোনা চলে। শকিলাবানু মজুর খাটত। হেল্পার। ঝুড়ি করে সিমেন্ট বালু টানার কাজ। সুড়কি টানার কাজ। বর অন্য মেয়ে ধরেছিল। একটা না। দুটো। মদ খেত খুব। রোজার সময় মদ খেয়ে এসে হল্লা । ইফতারের খাবার লাথি মেরে ফেলে অন্য আওরতের কাছে চলে যেত। ঐ বেশরম আওরতগুলোর করোনা হল না। হল শকিলাবানুর। এমনি উপরআলার মেহেরবানি। মাস্ক পারা মুখে ঠোঁটের অভিব্যক্তি বোঝা যায় না। চোখে জল নেই। ঘেন্না আর বিরক্তি। ঠিক শ্যামার মত। ওপাশ থেকে জ্যোতি চেঁচায়, আর আমার কোচটা যে ইশক লড়ালো আমার সঙ্গে, বুঝতেই দেয়নি হারামি বিয়েওয়ালা আছে। ক্যাম্পে গিয়ে শুয়ে টুয়ে তবে শালা বলে, বউয়ের বাচ্চা হবে। ফাইনাল খেলার সময় থাকতে পারবে না। জ্যোতির চোখের তলায় নিবিড় কালি। পালিয়ে যাওয়া কোচের উদ্দেশ্যে ঝেড়ে গাল দেয় । কোচের করোনা হোক, বলে শাপান্ত করে।
    মেয়েদের সুখদুঃখের কাহিনী সুতোর মত বোনা হতে থাকে। কত রকম ফোঁড়। কত রঙের সুতো। ঘরের কোণের বেড থেকে অতসী-মা বেগুনি রঙের সুতো ছাড়ে তো আরেক কোণ থেকে সাদা সুতো ছাড়ে মজিলা। অতসীর চোদ্দ বছরে বিয়ে । শ্বশুরঘরে গিয়ে দেখে সতীন আছে। বিয়ের আগে কিচ্ছু বলেনি। ছেলেপুলে হয়নি। তাই অতসীকে বিয়ে করেছে । অতসীরও ছেলেপুলে হল না। এই বউটাও পেটে ধরতে পারল না , কাজেই মারতে তো হবে। মার খেতে খেতে পিঠ শক্ত হয়ে গেছিল। বড় বৌ পিঠে ওষুধ লাগিয়ে দিত। তারপর একদিন গুরুর আশ্রমে পাঠাল আঠারো বছরের অতসীকে। গুরুই সন্তান দেবে। ছেলেটাকে ওদের বাড়িতে দিয়ে দিয়েছে অতসী। তারপর অতসী মা হয়ে থেকে গেছে আশ্রমে। মার খেতে হয় না। অতসী মায়ের মুখে বিচিত্র হাসি। অজস্র রঙবাহারি সুতো। ঝিলমিল করে। নারীকণ্ঠগুলি মাঝেমাঝেই উত্তাল। আবার শৈত্য। শব্দের শৈত্যে জানলার ওপারে শালিখ ঠোকা দেয়। ওঠ ! ওঠ! নার্স বলে, যে যার বেডে থাকো। নাম্বার এইট- শ্যামা মিস্ত্রি ।
    শ্যামা নীল সুতো ছড়িয়ে দ্যাখে কেমন মানালো। শকিলার হলুদ সুতোর ওপর জ্যোতি ছুঁড়ে দেয় টকটকে লাল সুতো। সব মিলিয়ে একটি বর্ণময় কাঁথা। উষ্ন। উত্তাপবান। রাত্রে সবকটি নারীশরীরের ওপর ঐ মায়াকাঁথা বিস্তৃত । ওরা ঘুমায় । এখানে ভাত মেলে। নিশ্চিন্ত।

    ✨খিদে

    শহরের মূল রাস্তা দিয়ে হাঁটে নি ওরা। অনেকটা বাইরে দিয়ে । জলজঙ্গলের মধ্যে দিয়ে । পুলিশ দেখতে পেলে গায়ে পোকামারা ওষুধ দিয়ে দেবে। পোকামারা ওষুধে বিষ। গায়ের চামড়া খসে খসে পড়ে যাবে। জ্বালা ধরবে। একে পেটে ক্ষিধা । পেট ভিতর থেকে জ্বালা করে। গা গুলিয়ে ওঠে। যেন নাড়িভুঁড়ি বেরিয়ে আসবে। হাঁটতে হাঁটতে গলা শুকিয়ে কাঠ। জঙ্গলের মধ্যে জল পায় না। সাপখোপের ভয়। ইটারসি এসে দলটা শুনল, নাগপুর থেকে শ্রমিক টেরেইন ছাড়বে। কলকাতা পর্যন্ত যাবে । এনজিও থেকে এবার কিছু চাল, ডাল আর আলু পাওয়া গেছে । যারা ছবি তুলেছিল টুটাফুটা পায়ের, তাদের দু' জন পয়সা দিয়েছে। জনপ্রতি দুশো টাকা। ওদের বড় চ্যানেল। ওদের সঙ্গে এনজিও এসেছিল। এই চাল ডাল তারা দিয়েছে। মাস্ক দিয়েছে। কাপড়ের মাস্ক। ধুয়ে পরতে বলেছে। হাত ধুতে বলেছে। সাবান দিয়েছে জনে জনে। কিন্তু রাস্তাতে জল কোথা যে হাত ধোবে। সাবান পুঁটলিতে। খিচড়ি ফোটানোর জল জোগাড় করতে হল চুপিচুপি । গ্রামের টিউকল থেকে। লেবার দেখলে হৈচৈ লেগে যাবে। পিটাতেও পারে।
    নাগপুরসে টেরেইন মিলেগা! ভাবলেও শরীর। জল আনতে গিয়েছিল দেওকি। কুসুম। দিনকর। হিন্দু মন্দির আছে। জমিলা, আরসাদ যায় নি। কী কাজ ঝামেলা বাড়িয়ে। এখন সাবধান থাকতে হবে। কোনদিক থেকে কী বিপদ আসে কোনো ঠিক নাই।

    নাগপুরসে টেরেইন মিলেগা। ভাবতেও শরীর জুড়িয়ে আসে। জঙ্গলের প্রান্তে কাঠ কুড়িয়ে আগুন জ্বলল আজ। শ্রান্ত শরীরগুলো মাটিতে লুটিয়ে । আসমানিয়া ওর মধ্যেই আগুন জ্বেলেছে। ভাত রাঁধবে কীসে। বর্তন নাই। আসমানিয়ার সঙ্গে একটা ছোট হাঁড়ি আছে। দেওকির আছে। জামিলাবিবির আছে। রামদেওর আছে একটা ছোট ডেকচি। ঠিক হল ঐ ছোট ছোট হাঁড়ি ডেকচিতে বারে বারে বসাবে। ভাত না। খিচড়ি। চালে ডালে মিশিয়ে । আলু ফেলে দেবে। কোনোমতে গিলতে পারলেই হল। আধকাঁচা। আনোনা।
    কতদিন বাদে চালের গন্ধ । ডালের গন্ধ । ছোটামোটা ডাল পাতা কুড়িয়ে আনছে বাচ্চাকাচ্চা। আগুন জ্বলছে ধিকিধিকি করে।
    রামদেও ভাবে , একটু চা পেলে গায়ে হাতে পায়ে ব্যথা কমতো। খুব চায়ের নেশা চাগাড় দেয় । এক গ্লাস চা পেলে দুই দিন হেঁটে মেরে দেবে রামদেও। শরীরে এখনো তাকত আছে। কিন্তু এন জি ও চায়ের পাতা দেয় নাই।
    ভাত ডাল ফোটার গন্ধের চেয়ে সুখের গন্ধ কিছু নাই। সুখনলাল পুঁটলি মাথায় দিয়ে শুয়ে পড়ে। ক্লান্তিতে চোখ বুঁজে আসে। আধখোলা চোখে আকাশ দেখে। আগুন দেখে।
    উনানের সামনে কে বসে আছে? মা নাকি? মা বুড়ি হয়েছে অনেক। গায়ে, মুখে চামড়া কুঁচকে চেহারা ছোটো হয়ে গেছে।
    আসমানিয়ার পরনে নীল শাড়ি । রঙ উঠে উঠে ফ্যাকসা হয়ে ধূসর প্রায় । পায়ে হাজা। খড়ি জ্বালাতে জ্বালাতে আসমানিয়ার হাই ওঠে। সেই কবে থেকে মুম্বাইতে আসা যাওয়া । খসমের সঙ্গে এসেছিল যখন বয়স কম। খসম মরে গেল একদিন । হার্ট অ্যাটাক করেছিল । তখন যুবতী আসমানিয়া। কোলে দুটো বাচ্চা। কন্স্ট্রাকশনের কাজে কেউ নিতে চায় না। বাচ্চার জন্য। মুম্বাইতে বাইয়ের কাজ পাওয়া অত সোজা না। ট্রেনিং লাগে। আসমানিয়ার কোথায় সেসব। তারপর আবার কোলে দুটো গ্যাঁদা বাচ্চা। খসমের দোস্ত রুস্তম আর বশির রোজগারের রাস্তা দেখাল। কন্স্ট্রাকশনের মিস্ত্রিরা তো বেশি টাকা দিতে পারবে না। ওদের যাবার জায়গা নেই। বউ দেশে বেশির ভাগের। ওদের খুশি করে দিতে হবে। খাওয়া ফ্রি। কমিশন ওদের। হাতে যা পেত তাই দিয়ে ছেলে দুটোকে বড় করলো আসমানিয়া। সতেরো বছর। দেশে ফেরেনি। বড় ছেলেটা বুদ্ধি কম। লোকে বলে আগড়ম। আগে খুব রাগ হত । এখন রাগ টাগ ভুলে গেছে আসমানিয়া। ব্যাটা বেঁচে থাকলেই হল। ছোটটা কবে চলে গেছে সুরাট। কোন খোঁজ দেয় না। আসমানিয়ার বয়স হয়েছে। এখন আর কারু জন্য চিন্তা করতে ভালো লাগে না। শুধু বড়টার দিকে তাকিয়ে খেটে যায় । এখন তো আর শরীর দিয়ে কাজ হয় না। শরীর বুড়িয়ে গেছে। এখন জন খাটে। ছেলেটার জন্য চিন্তা যত। আসমানিয়ার গালে হাত। সুখন আধখোলা চোখে দেখে।
    মা বুড়ির পায়ে ঐরকম হাজা। ঐরকম কালো কুঁচকানো হাত। কে খিচডি রাঁধে ? মা না শ্যামা? ছোট বাচ্চাটা। কি যেন নাম?আরসাদ। শুকনা ছোট ডাল টানতে টানতে নিয়ে আসছে কোথ্থেকে। চোখ বুজে আসে সুখনের। ভাত ডালের গন্ধে কত আরাম! কত সুখ কিতনাদিন বাদ!
    শুলেই ঘুম আসে না। কেমন একটা ঘোর আসে শুধু। ঘরে থাকতে এমন গায়ে হাতে ব্যথা হলে সুখন ছেলেকে বলত , উঠ। পিঠের উপর হাঁট। পায়ের উপর হাঁট। তুরতুর করে হাঁটত ছেলেটা। পিঠের ব্যথাতে বড় আরাম। একবার পা থেকে পিঠে ওঠে। আরেকবার পিঠ থেকে পায়ে নামে। বলে দশবার উঠানামা। দশটাকা। বাবা দশটাকা দিবা। কুড়কুড়ে নিব। শ্যামার হাসির শব্দ শোনা যায় কলপাড়ে।

    খিচড়ি নামল একবার। বাচ্চারা খাবে। আরো পাঁচ ছয়বার হাড়ি চড়বে। সুখন পাশ ফিরে শোয়। গোপীর কথা ভাবে। ভেবে মজা পায়। কী কান্ড করলো ছোঁড়াটা মজাদার ছিল। লাফিয়ে লাফিয়ে চলত। বছর পঁচিশের ছোঁড়া। রঙমিস্তিরি। সেবাগ্রাম পর্যন্ত এসে ছোঁড়া কাশতে শুরু করলো। সে কী কাশি বাপরে! শুকনা কাশি। বলে জ্বর এসেছে।
    সেবাগ্রামের এনজিও ডাক্তার এনেছিল সঙ্গে । করোনা হয়েছে মনে করে ছোঁড়াটাকে হাসপাতালে ধরে নিয়ে গেল। টেস্ট ফেস্ট করে দেখে কিছু নাই। করোনা নাই। ছেড়ে দিয়েছে নাকি চ্যাংড়াকে। ও বলেছে হাসপাতাল গেলে খেতে পাবে চারবেলা । তাই মিছামিছি কেশেছে ।
    পেট বড় জ্বালা। সুখনলাল ভাবল, এখন যদি কেউ তাকে হাসপাতাল নিয়ে যেত!পেট বড় গোলায় যে!একপেট ভাত আর ঘুমাবার জন্য একটা বিছানা। আর কিছু দরকার নেই এ জীবনে। তবে ছেলেটার মুখ মনে আসছে খুব। কেমন আছে সেটা কে জানে!

    ✨মেয়েদের মন

    এখানে কেউ কাউকে ছুঁতে পারবে না। বেডগুলোর দূরে দূরে অবস্থান। যদি ছুঁতে পারতাম,অতসী- মা বলে , তবে তোর চুল টেনে বেঁধে দিতাম। শ্যামার মাথা ভরা ঘন কালো চুল। কোমর পর্যন্ত । সর্ষের তেল দেয় মাথায় । বউদি আগে বকত। কী যে মাথায় সর্ষের তেল দিস! গন্ধ হয়।
    লকডাউনের দুতিন মাস আগে সে কী কান্ড! শ্যামা হেসে বাঁচে না। হাবিব না কে বলে একটা লোক আছে, চুল কেটে খুব নাম, সে বলেছে চুলের জন্য মাথায় সর্ষের তেল দেওয়া সবচেয়ে ভালো। বউদি, যে নাক শিঁটকাতো , সে পর্যন্ত বলেছিল, জানি থেকে ভাঙিয়ে আনবি তো সর্ষেটা। তেল মাথায় দেব। জাভেদ হাবিব বলেছে!
    তো শ্যামার সেই একঢাল চুল দেখে , মেজাজ ভালো থাকলে সুখন বেসুরে গেয়ে উঠত, " তেরি রেশমি জুলফে। " সেইসব দিন এখন গতজন্মের বলে মনে হয় শ্যামার। স্পষ্ট করে কিছুই ভাবে না । তাও শ্যাওলার মত ভেসে ভেসে আসে। যায়। শ্যামা পিছনে একটু এলিয়ে চুল আঁচড়ে যায় । যার চুল তার। যার ভাগ্য তার। আঁচড়াতে আঁচড়াতে বলে, তোমার ছেলে খোঁজ খবর করে গো, অতসী মা?বলেই জিভ কাটল। অতসী মা বেডে বসে নাম জপ করছিল। জপ শেষ করে পাঁচ মিনিট বাদে তাকালো। জপের মাঝখানে বাধা পড়তে নেই।
    রাগ করেনি। জল খেল একঢোক।
    - বছরে দুই বার বাড়ির সবাই আসে আশ্রমে। তখন আসে। যাকে বাপ বলে ডাকে সেও আসে। বাপের নতুন বউকে মা বলে ছেলে। ছেলে মানুষ করার জন্য, বে করেছে তাকে। বড় বউ নাকি বিছানায় । কোমর পড়ে গেছে।
    - ছেলে তোমাকে মা বলে?
    - বাড়িশুদ্ধ সবাই মা বলে। অতসী মা হাসে।
    গুরুদেবের সাধনসঙ্গিনী । সেকি চাট্টিখানি কথা। পাঁচ ছয় জন সাধনসঙ্গিনী আছে আশ্রমে। একটু বেশি বয়স হলে তাদের ছুটি। নতুন , অল্পবয়সী সঙ্গিনী আসে। বয়স্কা যে তার আশ্রমে একটা জায়গা থাকে বটে। সে বলার মত না। এককোণে পড়ে থাকে। যতক্ষণ শরীর , ততক্ষণ সাধনা। তাই অতসী মা কারু জন্য কাঁদে না। দুঃখও করে না। ছেলে এসে প্রণাম করে বছরে দুবার। তখন মুখের দিকে তাকিয়ে দেখত আগে। দেখত থুৎনিতে , কপালে তার নিজের কোনো আদল আছে কিনা কোথাও। এখন আর দেখেনা।
    সবাইকে তুই করেই কথা বলে অতসী মা। আশ্রমের অভ্যেস। হাতে জপের মালা। অতসী- মা সবসময় মুখে মাস্ক রাখে।
    আশ্রম জীবন ভালো রে। বুঝলি শ্যামা । বেশ্যা জীবনও ভালো। যদি শরীরে রোগ না ধরে আর টাকা জমাতে পারিস, বুদ্ধি করে চলতে পারিস। কোনো টান নাই। আপদ বালাই নাই। সবার ভালো হোক, বলে মাথায় হাত রাখলেই সংসার তুষ্ট। তবে হ্যাঁ । শরীরটা তাজা রাখতে হবে। শাশুড়ি ননদের গাল নাই। বরের মার নাই । কায়দামত চলতে পারলে শুধু সোহাগ। কেবল ঐ 'আমার আমার' করা চলবে না রে। আমার বর আর আমার ছেলে করলেই মরেছিস।
    শ্যামার পছন্দ হয় না কথাগুলো। মুখে কিছু বলে না। চুল বেঁধে শুয়ে পড়ে।
    অতসী মা ফিক ফিক করে হাসে।
    কথা মনে ধরল না,? ওরে। আমি যখন আঠারো বছরেরটি গেলাম আশ্রমে , তখন তো জানি না গুরুর কৃপা কাকে বলে । স্নান করালো । চন্দন মাখালো সারা অঙ্গে। অঙ্গ বুঝিস তো? শরীর। বেনারসি পরিয়ে সেবা করতে পাঠাল। গুরু বলল, এখন থেকে কৃষ্ণ তোর পতি। আর কৃষ্ন তো নিজে আসবে না। আমার মধ্যে দেখ, কৃষ্ণ পাবি। তোকে আমি গ্রহণ করলাম ।
    বরের মার আর অত্যাচার সহ্য করে অভ্যেস । দেখলাম বরের চেয়ে গুরু ঢের ভালো। রসিক মানুষ। তাই বেশি ন্যাকা কান্না কাঁদি নি। দেখলাম শ্বশুরঘরের চেয়ে আশ্রম ভালো। সকালে ফলাহার। লুচি তরকারি। দুপুরে আতপচালের ভাত। ডাল। সবজি । ঘি। পায়েস। বিকেলে চা সিঙ্গারা । রাতে পোলাও। ছানার তরকারি। অন্য গুরুদেব যারা বাইরে থেকে আসে, দু একজন ছাড়া লোক মন্দ না। সেবা দিতে পারলে জগত খুশি। সংসারে হাজার সেবা দিয়ে তুই অমন সুখ পাবি না রে। দুঃখে সংসার ছাড়িনি। সুখে ছেড়েছি।
    ওইদিকের বেড থেকে জ্যোতি সিং ফোন থেকে মাথা তুলে শ্যামার দিকে তাকিয়ে চোখ টেপে।
    - আমাদের একটু সেবা করা শিখিয়ো গো।
    আতপচালের কথায় শ্যামার মরা শাশুড়ির কথা মনে পড়ে। এখনো আতপচাল ধরা আছে কৌটাতে। পোকা না ধরে। ফিরে একদিন পোলাও রেঁধে দেবে ছেলেটাকে। ঘরদোর সাফ করবে ভালো করে।
    জ্যোতি বলে, কী ভাবো শ্যামাদি। সিলিং ফ্যানের দিকে চোখ স্থির। শ্যামা চুপ।
    নার্স এলে সবাই চুপ। পিপিই তে মুখ দেখা যায় না। জ্বর দেখা চলে। ট্যাবলেট । কড়া স্বর।
    - বেশি বকবক করবে না কেউ। রেস্ট নেবে চুপচাপ।
    খটখট শব্দে নার্স চলে গেলে এরা আড়মোড়া ভাঙে।
    জ্যোতি বলে, বিলকুল শালা আমার কোচ আশিকটার মত। বলত। সবাই তাড়াতাড়ি শুয়ে পড়ো। কেউ বকবক করবে না। রেস্ট নাও। ভোরে প্র্যাকটিস । তারপর শালা আমাকে মেসেজ করে ডাকতো। সবাই ঘুমালে টয়লেটে যাবার নাম করে আসবি। দরজা খোলা থাকবে। তোকে চ্যাম্পিয়ন বানাবো। আমিও শালা হাবলি। চলে যেতাম । লোকটার ক্যালি ছিল মাইরি। বুঝতেই পারিনি এইটে পড়া ছেলে আছে। গ্রুপের কেউ জানতোও না। নতুন ব্যাচ তো। আর হেভি স্মার্ট । জ্যোতি কি সাধে মজেছিল!
    শাকিলাবানু পাশ ফিরে শোয়।
    - এ করোনা কবে যাবে রে? শুয়ে আমার গতরে বেদ্না হয়ে গেল।
    শ্যামা বলে
    - মে মাসে চলে যাবে। খবরে বলেছে।
    - হাঁ। পাঁজি দেখে যাবে। জ্যোতি ঠোঁট উল্টায়। ওর জ্বর আসছে। গলাও ব্যথা। জ্যোতি পাত্তা দেয় না।
    শাকিলাবিবি বলে
    - আমার ঘরেরর লোক ঘরেআটকে আছে। ছেলেটাকে মারছে ঠিক। মাথা তো গরম থাকবেই। বাইরে বেরোতে পারছে না। বাইরের মেয়েছেলের কাছে যেতে না পারলেই মাথা গরম। ছেলেটার ওপর সব চোট পরবে। ওরে আমাকে ছেড়ে দাও গো।
    শাকিলা বিবি ডুকরে কেঁদে ওঠে।
    সন্ধের পর বড় বিবর্ণ হলঘর। আলো গুলো টিমটিমে। চুপচাপ ডিমভাত খেয়ে যায় ওরা।
    নিচের তলায় আবার চিৎকার চেঁচামেচি। আয়া এসে বলল, তিনজনের ডিম পচা এসেছে নিচে । বহুত চেঁচাচ্ছে সবাই । নার্স বলেছে ডাল ভাত খেয়ে নাও। বাড়িতে কত ডিম খাও জানা আছে।
    আগুনে ঘি পড়েছে। সরকারি নির্দেশ ডিম দিতে হবে। কোন দাদারা শালারা টাকা মারছে?
    এত টাকা দিচ্ছে সরকার সেন্টারের জন্য, কোথায় যাচ্ছে টাকা?

    ✨মা ও বাবু
    ইউরিন থেকে করোনা স্প্রেড করে না

    - তুই সাবধানে আছিস তো বাবু? বাইরে যাচ্ছিস না তো?
    - না। রুমে আছি। তুমি চিন্তা কোরো না। টেক কেয়ার অব ইওরসেল্ভস।
    - নিচ্ছি । কিন্তু পাবলিক খুব অসচেতন বাবু। স্টিল নাও। রাস্তায় হিসি করছে।
    - অভ্যেস। চিন্তা করো না। ইউরিন থেকে করোনা স্প্রেড করে না। থাইরয়েডের যত্ন নিও।
    -কত যত্ন নেব। তোর বাবা সারাক্ষণ ল্যাপটপ । নয় টিভি।
    - বাড়িতে তো আছে।
    - হ্যাঁ । বাড়িতে আছে। খাওয়ার সময় খায়। ভোরে ছাতে গিয়ে জগিং করে। হাসছিস কেন?
    - তোমরা প্রেম করে বিয়ে করেছিলে না মা?
    - বাঁদর ছেলে। করেছিলাম তো!
    - দশ বছরের প্রেম।
    -ওফিশিয়ালি।
    - ওরে বাবা। আনওফিশিয়ালি আছে নাকি?
    - সেসব তোমার জেনে কাজ নেই। হ্যাঁ রে, তুই ঠিকমত খাওয়া দাওয়া করছিস বাবা?
    - কথা ঘুরিও না মা। আচ্ছা । ধরো দশ বছরের প্রেম। প্লাস সাতাশ বছরের সংসার। মানে সাঁইত্রিশ । আরিব্বাস! তিন বছর বাদেই ইউ উইল কমপ্লিট ফর্টি ইয়ারস অব হোলি ম্যারেজ! সেলিব্রেশন মাংগতা হ্যায়।
    - হাতির মাথা মাংগতা হ্যায়। তোমার বাবার ওসব মনে নেই।
    - তুমি মনে করাবে! আরে বাবা সাঁইত্রিশ বছর একত্রে কাটাবার পর প্রেম নিডস নো আউটওয়ার্ড এক্সপ্রেসন।
    - তুই এত জানলি কী করে? বাবু, তুই প্রেম ট্রেম করছিস?
    - তুমি তোমার বুড়োকে সামলাও। আমার প্রেম নিয়ে চিন্তা কোরো না। সব ঠিক আছে
    - ঠিক আছে মানে?
    - মানে এখন বেরোবো। ফোনটা রাখো।
    - বলবি না। না? মেয়েটা ভালো?
    - লাভ ইন দ্য টাইম অব করোনা। সেসব তোমার জেনে কাজ নেই। ছাড়লাম।
    - দাঁড়া। রাখিস না। বোনের সঙ্গে ফোনে কথা হয়?
    - তেমন নয়। কেন গো?
    - সবসময় ঘর বন্ধ করে থাকে। কী করে জানি না ।
    তোর এটা দায়িত্ব না, ছোট বোন কী করছে খোঁজ নেওয়া ?
    - মধ্যযুগীয় পিসিমা হয়ে যাচ্ছো মা। শী ইজ অ্যাডাল্ট । অ্যান্ড ইনটেলিজেন্ট।
    - মোস্ট আনসোশ্যাল।
    - হে হে। তোমাদের যা সোসাইটি তাতে আনসোশ্যাল হওয়াই ভালো। রাখলাম । সাবধানে থেকো । ভিটামিন ডি টা নিও ঠিকঠাক। আরেকটা ফোন আসছে।

    ফোন রেখে দিয়ে একটা মিন্ট মুখে দিল দেবরূপ। এখন না রাখলে মা এক কথা ন্যাগ করেই যেত। শী ফিলস টেরিবলি লোনলি। মা' দের একটা ফ্রেইন্ড সার্কল আছে। এমনি সময়ে মিট করে এ ওর বাড়িতে। সমাজসেবাটেবা করে। শৌখিন আর কি। এখন সব বন্ধ । বাবা ওয়ার্কোহলিক। কেয়ারিং না এমন নয়। বাট লেস এক্সপ্রেসিভ। বোন ভীষণ একগুঁয়ে । নিজের মত। মা পেরে ওঠে না। কিন্তু এইসব ন্যাগিং বেশি পাত্তা দিলে অসুখ হয়ে যাবে। কোনো ফোন আসেনি। আসবে। ব্যালকনিতে অন্ধকারে দাঁড়িয়ে । কাছাকাছি একটা বড় লেবুফুলের গাছ আছে। লেবুফুলের তীক্ষ্ম, মিষ্টি একটা গন্ধ আছে। চারতলার ব্যালকনিতে এই নির্জন সন্ধ্যা । সামনে একটা ফাঁকা পিচ রাস্তা। ওয়ান রুম ফ্ল্যাটে পর্যাপ্ত বিস্কিট। চাও মিন। আলাদা কনটেইনারে চাল। ডাল । ফ্রিজে ডিম। চিকেন। সবজি । এই মুহূর্তে তার মনে হচ্ছিল না পৃথিবীর কোথাও অতিমারী আছে। মৃত্যু ও অনাহার আছে। নিজেদের ঘাড়ে এসব এসে না পড়লে কিছুই বোঝা যায় না। একবার ফোনে হু' র লেটেস্ট আপডেট দেখে নিল। দুর্লভ মেরহোত্রা ফোন করবে। একটু পরে স্ট্রে ফিড করতে বেরোবে ওরা।
    হোয়াই ডোন্ট ইউ ফিড দ্য পুওর?
    সিমবায়োসিসের অধ্যাপক প্রফেসর গুপ্তা ঝুঁকে বসে কথা বলছিলেন।
    পুনেতে এসেছে পরের থেকে সিমবায়োসিসের সঙ্গে যোগাযোগ । প্রফেসর গুপ্তা দেবরূপকে নিকটজন মনে করেন। কফিতে চুমুক দিলেন।
    ইয়েস ইয়ং ম্যান । ওয়াটস ইওর ভিউ অব ইট? মেনি পুওর রিমেইন আনফেড।
    - ইউ নো ইট ভেরি ওয়েল স্যর। এন জি ও' স আর দেয়ার, গভমেন্ট ইজ দেয়ার টু লুক আফটার দি আনফেড। সাম পিপল শুভ লুক আফটার অ্যানিম্যালস। আই অ্যাম ওয়ান অব দেম।
    প্রফেসর গুপ্তা তাঁর দীর্ঘ, শীর্ণ দেহ সামনে ঈষৎ ঝুঁকিয়ে কথা বলেন।
    - ইউ কনসিডার অ্যানিম্যাল লাইফ ইজ প্রেশাস?
    - সার্টেইনলি স্যর। অ্যাজ ইমপরট্যান্ট অ্যাজ হিউম্যান বিইংগস। অ্যাট টাইমস মোর ইমপরট্যান্ট।

    এই সাধারণ কথাটা অনেক পন্ডিত মানুষও বোঝেন না। মানুষকে এত গুরুত্বপূর্ণ একটা জায়গা দিয়ে দেন যে বাকি সব তুচ্ছ হয়ে যায় । বাবার কাছে গল্প শুনেছে দেবরূপ। একান্নবর্তী পরিবারে বড় ছেলে বা বেশি রোজগেরে ছেলেকে এত অতিরিক্ত গুরুত্ব দেওয়া হত যে বেকার ছোটছেলে, বিধবা পিসি, বয়স্ক ছোটকাকা একেবারে মার্জিনাল হয়ে যেত। ওভার ইমপরট্যান্স পেয়ে গেছে যে সে ক্ষমতাবান। ঐশ্বর্যবান। বাকিরা নগণ্য। কুকুর। বেড়াল। বিলুপ্ত হয়ে যাক নির্জনে। কাঠদুপুরে একা একা মরে যাওয়া রাঙাদিদুর মত। পিঁপড়ে উঠে যাক মুখে।
    কোভিড নাইন্টিন তাই কাউকে ছাড়ছে না। পশুপাখিদের ছাড়া । কোভিড একটা সাম্যাবস্থা এনেছে। ধনী দরিদ্র নির্বিশেষে সবাই আতংকে ভুগছে। একটা ক্ষুদ্র ভাইরাস সবাইকে থামিয়ে রেখেছে। তফাত একটাই। একটা শ্রেণী গান্ডপিন্ডে খাচ্ছে। আরেকটা শ্রেণী খেতে পাচ্ছে না। না খেতে পেয়ে মরে যাচ্ছে।
    পুনে - মুম্বাই রোড এত ফাঁকা থাকে না সচরাচর। ওরা বেরিয়েছে ছ' জন। হাইওয়েতে কুকুররা খুব খারাপ আছে। খুব খারাপ। মানুষও ওদের মত খারাপ আছে অনেক জায়গায় । হয়তো আরো খারাপ। কুচকুচে কালো একটা কুকুরের মায়াময় চোখের দিকে তাকিয়ে দেবরূপ ওর অনুভূতি মাপার চেষ্টা করছিল।
    -----------

    ✨পর্ব তিন

    ✨ পার্বতী হিল থেকে পুনেশহর

    ত্বরিতগতিতে ছুটে যাচ্ছিল সারমেয়কুল। এদের একটা স্বভাব আছে। খাদ্যের সামান্য আভাস এবং আদরের সামান্যতম আভাস পেলেও এরা লেজ নাড়াতে নাড়াতে দৌড়ে আসে। যেন বহুদিনের পরিচয়। একেক জনের একেক রকম স্বভাব । কেউ এসেই হামলে পড়ে খায়। কেউ কেউ এসে সলজ্জভাবে দূরে দাঁড়িয়ে থাকে। পেটে খিদে। অথচ আসে না। দূরে দাঁড়িয়ে লেজ নাড়াতে থাকে। এরা খেতে আসলে, সবলরা গর্জন করে তেড়ে আসে। দুর্বল ও স্বভাব লাজুকরা দূরে সরে যায় । কিছুতেই অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে পারে না। অনেকটা গার্ড দিয়ে খাওয়াতে হয় ওদের। এটি ঠিক মেটিং সিজন নয়। তবু স্বাভাবিক নিয়মে দুটি পুরুষ ও নারী কুকুর খাবার দেখেও দৌড়ে এল না। তারা সঙ্গমে লিপ্ত হয়ে দেখছিল বাকিদের হুড়োহুড়ি । অতুল ডাকছিল ওদের। দেবরূপ নিষেধ করলো। ডোন্ট ডিস্টার্ব । অতুল হেসে অন্যদিকে চলে গেল। টমাস হার্ডির একটা কবিতা পড়েছিল ওরা স্কুলে। ইন টাইম অব ব্রেকিং অব দ্য নেশনস। যুদ্ধে সব তছনছ হয়ে গেছে। ভেঙে গেছে দুর্গ, কীর্তিস্তম্ভ। শুধু কৃষি, আগুন ও প্রেম জেগে আছে। রাত প্রায় দশটা। লকডাউনের ফলে ছত্রপতি শিবাজি রোড সাধারণ দিনের তুলনায় আরো নির্জন। একেবারে নির্জন। প্রাণীমাত্রের বেসিক নিড মেটানোর একটা নির্ভেজাল আনন্দ থাকে। ছ'টি তরুণ এই ফাঁকা রাস্তায় সারমেয়গুলির সঙ্গে এক অপার্থিব আনন্দ যাপন করছিল। । ওরা লাফিয়ে উঠছিল গায়ে। গড়িয়ে পড়ছিল রাস্তায় । বড় নির্ভেজাল আনন্দে কোভিডকাল মুছে যাচ্ছিল ঐটুকু সময় থেকে। এর কোনো ডিজিটাল সাক্ষী নেই। মাথার ওপরে পরিচ্ছন্ন নীল আকাশ। অগণিত তারা। রাস্তার দুপাশে ঘননিবদ্ধ গাছপালা। সব মিলেমিশে একাকার।
    অনতিকাল পরে বাইকগুলি গর্জন করে ছুটে গেল পার্বতীহিলের দিকে । লকডাউন শুরু হয়েছে পর থেকে সবাই গৃহবন্দি, এই রাত্রিকালীন ছাড়টুকু বাদে। সবাই উন্মুখ ভেসে যেতে। কুকুরগুলি তাকিয়ে রইল অপসৃয়মান বাইকের দিকে। আগামীকালের প্রত্যাশায়। আপাতত পেট ভর্তি।
    পুনের কেন্দ্র থেকে পার্বতীহিল মাত্র সতেরোমিনিটের পথ। প্রাচীনতম হেরিটেজ। ওরা লাফিয়ে লাফিয়ে উঠছিল। একশোতিনটি সিঁড়ি।
    ওপরে উঠে হাঁপাচ্ছে যশবিন্দার। তাগড়া পাঞ্জাবী অথচ হাঁপাচ্ছে। রণি বসে পড়েছে। দেবরূপ সিঁড়ির শেষ ধাপে বসে। সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে একুশশো ফিট ওপরে এই জায়গা থেকে , ওদের সামনে পুনের প্যানোর্যামিক ভিউ। প্রায় ঘুমন্ত।
    অবন কুলকার্নি নেট চেক করলো । নেই। আজ ভোরে মুম্বাইতে মারা গেছে ওদের মুম্বাই ব্র্যান্চের ম্যানেজার সুভাষ মেহতা।
    - পাপানে মানি ভেজা উসকে ফ্যামিলিকে লিয়ে। বডিতক নহি দেখনে পায়া।
    - কোন দেগা বডি? কোভিড কেসমে
    - অ্যান্ড হোয়াট ইজ ইওর ফাদার ডুইং অ্যাবাউট দ্য মাইগ্রান্ট লেবারস? ওয়াকিং ফোকস? পেয়িং ফর ওল অব দেম?
    অবনের মুখ লাল হয়ে গেছিল। লক আউট ডিক্লেয়ার হওয়া মাত্র পাপা সমস্ত শ্রমিকদের আধামাসের স্যালারি দিয়ে ডিসমিস করে দিয়েছে। ইট ইজ নট পসিবল টু পে ফর ওল অব দেম। বন্ধুরা জানে। তবু দীপক খোঁচালো। অবন কুলকার্নির বাবা ইনডাসট্রিয়ালিস্ট। বাট হি ইজ নট রেসপনসিবল ফর এভরি ড্যাম থিংগ দ্যাট হ্যাপেনস টু দ্য লেবারস । অবন শ্রাগ করল।
    সামনে প্রায়ান্ধকার পুনে শহর এলিয়ে পড়ে আছে। কিছু আলো হীরকদ্যুতিতে ঠিকরে আসছে।
    দেবরূপ সিগারেট খায় না। এখন একটা ধরালো। অদিতির জন্য থাকে পকেটে।
    মাইগ্রান্ট লেবারস। পরিযায়ী শ্রমিক । কম পয়সা দাও। বেশি খাটাও। কারণ ওরা লোকাল শ্রমিকদের মত ঘাড়তেঁড়া করতে সাহস পাবে না। অনেক নমনীয় । আন্ডারপেইড অ্যান্ড ওভারওয়র্কড। প্রান্তিক। যতদিন যাচ্ছে লেবার লেজিসলেশন ঝুলিয়ে দিচ্ছে। সব চলে যাচ্ছে ব্যবসা আর পুঁজির ফেভারে।
    পায়ে হাঁটছে। লক্ষ লক্ষ শ্রমিক।
    শস্তা। কন্ট্রোল্ড। ইউজ অ্যান্ড থ্রো। ছুঁড়ে ফেলে দেওয়া যায় । এরা কোনোদিন কোনো প্রতিবাদ করে না। প্রতিরোধ করে না। এমন একটা অন্তর্বর্তী অপ্রেসিভ স্ট্রাকচারে বড় হয় , যে প্রতিবাদ করতে পারে না। ওদের কাজ করিয়ে ছুঁড়ে ফেলা হবে। এটাই স্বাভাবিক ।
    ছ' টি যুবক পার্বতী হিলের সিঁড়ির ধাপে ধাপে বসে। মাথার ওপরে নক্ষত্র খচিত আকাশে কোনো কোভিডের ছায়াপথ দেখা যায় না। কিংবা হয়তো আছে। ওরা দেখতে পাচ্ছে না।
    দেবরূপ দেখছে। পয়দল বাড়িতে যাচ্ছে সব । কেরলের চা বাগান থেকে। তামিলনাড়ুর কেমিক্যাল ইনডাসট্রিয়াল ফ্যাকট্রি থেকে। হিমাচলের রাস্তা তৈরি ছেড়ে শ্রমিকরা বাড়িতে ফিরছে। ঐতিহাসিক ভাবে শোষিত সংখ্যালঘুর দল। জনসংখ্যার পঁচিশ শতাংশ। শ্রমিকশ্রেণীর চল্লিশ শতাংশ। দলিত আর আদিবাসী। ব্যবহার করো। ছুঁড়ে ফেলে দাও।
    অবন বললো, ওদের একটা ইনভিজিবল ইকোনমি আছে দেশের বাড়িতে । ঠিক সাপোর্ট পেয়ে যায় । ইভন ইন দ্য টাইম অব কোভিড।
    - ইয়া । দ্যাট ইজ দ্য সিলভার লাইনিং। কাঠ কুড়িয়ে, ধান বুনে, মাটি কুপিয়ে একটা সাপোর্ট সিস্টেম রাখে। অ্যান্ড ইট ইজ টেকন ফর গ্রান্টেড।
    - অ্যান্ড দ্য গভমেন্ট গোজ স্কট ফ্রি, সো ডু দ্য বিজনেস ম্যাগনেটস।
    অবনের রাগ হয়েছে। অবন, অতুলের বাবার ফ্যাক্ট্রিতেই রাতে এখন কুকুরদের খাবার রান্না হয়। কুণাল আডবাণীর গ্যারাজে শুধু দুপুরে। গ্যাসের পয়সা দিতে হয় না।

    আলো জ্বলে উঠল দেবরূপের ফোনে।
    মেসেজ ওয়াপে। অদিতি।
    - মকরন্দ'স ফাদার পাসড আওয়ে।

    ✨ তার আর পর নেই

    অনেকদিন বাদে আজ ছাতে উঠেছে ও। ছাতে এত সুন্দর বাগান করেছে মা! দেখে অবাক হয়ে গেছিল। আইআইটি জয়েন করেছে পরের থেকে খুব কম বাড়িতে আসে। এলেও ছাতে ওঠা হয়না। ওর গৃহবন্দিত্ব না। ঘরবন্দিত্ব চলছে । স্বেচ্ছানির্বাসন। সারা পৃথিবী থেকে নিজেকে বিচ্ছিন্ন করে নিতে হয় মাঝে মাঝে। একেবারে একটা দ্বীপের মধ্যে। খুব বেশিই ছুটছিল যেন!একটার পর একটা সেমেস্টার। টপ করে যাওয়া। না করতে পারলেই ফ্রাস্ট্রেশন। বাড়িতে এখন আর কিছু বলে না। কিন্তু ছোটবেলা থেকে ও একটা অদৃশ্য চাপ অনুভব করে। দাদা ফার্স্ট হয়েছে। তোমাকেও হতে হবে। দাদা এটা পারে। তোমাকেও পারতে হবে। দাদা এত অ্যালার্ট । তোমাকেও হতে হবে। অ্যান্ড দেন শী ডিসাইডেড টু বি ডিফারেন্ট।
    খুব লাজুক ছিল। ঘরকুনো। শান্ত। সবাই খোঁচাতো। ইনক্লুডিং মা। দ্যাট লেডি ডিড এভরিথিং টু গ্রুম হার কিডস। কী কষ্ট হত। কেন পারবে না তুমি দাদার মত? ক্যাবলা হয়ে থাকবে? লোকে কিন্তু বলবে, দাদা পারে, তুমি পারো না।
    ভাইরাস। সব ভাইরাস মস্তিষ্কের অলিতে গলিতে ঘুরে বেড়ায় । ছড়িয়ে দিতে চায় অন্যদের মধ্যে। জ্যেঠু বললো, ওকে ওরকম করে বলছো কেন মালবিকা? ও মেয়ে। ও কী করে রূপের মত পারবে?মাথার মধ্যে আগুন। ক্লাস সেভেন পর্যন্ত অঙ্কে ভীষণ কাঁচা। দাদা এইচ এসে র্যাঙ্ক করে সিমবায়োসিস চলে যাচ্ছে। গোটা পরিবারে কী আনন্দ । দাদা চলে যাবার কষ্টটা কেউ পেলোই না। এই যে বাড়িতে ও একা হয়ে গেলো। দাদার ঘর বন্ধ শুধু খুলে ঝাড়ু পোছা । মা মাঝেমাঝে ঢুকে বালিশের ওয়াড় বিছানার চাদর পাল্টে দিতে দিতে কেঁদে ফেলত অবশ্য। কিন্তু তাতে গ্যাসলাইটিং কম পড়ে না। টুপুর কী করবে? ও অংকে কাঁচা। আর্টস পড়বে। চুলটা কী সুন্দর তোমার মেয়ের মালবিকা । এই চুল দেখেই ছেলের বাড়ি ফিদা হয়ে যাবে। ভাইরাসের প্রোটিন স্পাইক্স কী তীক্ষ্ম! চুল কেটে ফেলল একদিন নিজেই। এবড়োখেবড়ো করে। প্রায় কোমর ছাপানো চুল কেটে কানের কাছে। মা মেরেছিল সেদিন। সেই প্রথম সেই শেষ মায়ের হাতের মার। স্রোতের অভিমুখ ঘুরে গেল। নিজে খোঁজ করে অংকের টিউশনে ভর্তি হল। মিসেস গোম্স। কাজের বাইরে একটি কথাও বলতেন না। অংকটা গুলে খাইয়ে দিলেন। আর তাকাতে হয়নি কোনোদিকে। এইচ এসে নাইন্টি ফোর পার্সেন্ট। আইআইটি। চুলে মরিচ রঙ ধরিয়ে নিল। সেকেন্ড সেমেস্টারে চলে গেল ট্যাটু পার্লার। গেট মি ঘোস্টলি অ্যান্ড ঘ্যাস্টলি ট্যাটুজ। যত রক্তক্ষরণ ভেতরে তত রক্তখেকো প্রাণী। ট্যাটু করো । ট্যাটু। হোক যন্ত্রণা । জ্বর আসুক। এর চেয়ে ঢের বেশি যন্ত্রণা ছিল যখন শুনতে হত, টুপুর রূপের মত পারে না। রূপ অনেক বেশি ট্যালেন্টেড। মায়ের মুখে পুত্রগর্বে কী হাসি। টুপুর তো আদরের মেয়ে । ইংলিশ অনার্স। লোরেটো। বা ব্রেবোর্ণ। পোস্ট গ্রাজুয়েট। তারপর বিয়ে । শখ করে চাকরি করলে করবে । মালবিকার মত। রেণু মাসির কী খিলখিল হাসি। তোর মেয়েকে আমার ছেলের জন্য,ঠিক করে রাখলাম মালবিকা! দেখে শুনে রাখিস।

    গা গুলিয়ে যেত। সারা হাতে , পিঠে ট্যাটু নিয়ে ফিরল। মায়ের থমথমে মুখ। এই ফেটে পড়বে। বাবা হতভম্ব । বিদ্রোহের শুরু। প্রথমে বাথরুমে। তারপর সামনে। সুখটান সিগারেটে। যত না পরিতৃপ্তির জন্য তারচেয়ে বেশি আঘাত করার জন্য। একটা ভাইরাস অধ্যুষিত সিস্টেম। প্রকান্ড রিপ্রোডাকটিভ ক্ষমতা । ফসফস করে ছড়িয়ে যায় । মা নিজের বন্ধুর ছেলেকে বাড়িতে ডাকে। রক্তিম। ভালো না । প্রচন্ড ভালো প্রসপেক্ট। এন আর আই হয়ে মেয়ে ইউ এস এ তে থাকবে। শীতকালে হোমে আসবে। নাক শিঁটকে বাচ্চাদের মিনারেল ওয়াটার খাওয়াবে আর বলবে, এখনো ট্র্যাফিক জ্যাম কমল না? সটান একটা চড় সিস্টেমের গালে। রক্তিমকে সিগারেট অফার। সে হল ওভারস্মার্ট! কিছুই রিঅ্যাক্ট করে নি। পরে বুঝেছে। লিবারেল নয়। শেয়ানা। তারপর শুধু ক্যালকুলেশন। ডালে ডালে পাতায় পাতায় কোর্টশিপ। জঘন্য।
    ছাত থেকে দেখল পাশের রাস্তায় একটা লোক ড্রেনে হিসি করছে। সিটি দিল। বেশ জোরে। লোকটা চমকে ওপরে তাকাতেই দাঁত বার করে হাসল। পালালো লোকটা। পোশাক ভদ্রলোকের মত। দুতিনজন পাড়ার লোক ঘোরাফেরা করছে। অকারণে। দেখেই বোঝা যায় । মাস্ক থুৎনিতে ঝুলছে। ছড়াক। তারপর আরো ছড়াবে। ডক্টরস সে ইন জুন জুলাই ইনফেকশন উইল রিচ অ্যান অ্যাবনরম্যাল হাইট। হোক। তাই হোক। এদের মরা দরকার। মাঝেমাঝেই বীভৎস নিষ্ঠুর হয়ে ওঠে ও। নিজের এবং অন্যের প্রতি। দিব্যি ঘুরে বেড়াচ্ছে। জোরে সিটি দিল ও। লোকগুলো অবাক হয়ে ছাতের দিকে তাকাল । দাদা। মাস্কগুলো গলাতে টাই করে পরেছেন? হাসতে হাসতে বলল।
    এরা মোটামুটি নির্লজ্জ । ফ্যাঁচফ্যাঁচ করে হাসল। একজন টেনেটুনে মাস্ক পরে নিল মুখে। নিচে বারান্দায় জননী। মুখ তুলে বলল- ওপরে কি অসভ্যতা করতে উঠেছো?
    - অসভ্যতা ওপরে হচ্ছে না। নিচে। দেখো। মাস্ক কোথায় থাকার কথা আর কোথায় আছে।
    - আমি কিচ্ছু দেখতে চাই না। বেয়াদব মেয়ে । নিচে নামো।
    মাথা ঝাঁকিয়ে চলে গেল ছাতের ওধারে। এখন মোটেই নিচে নামবে না। মহিলাকে অত পাত্তা দেবার কিছু নেই। চোখের সামনে যে বেয়াদবি হচ্ছে সেগুলো দেখতে পায় না। শুধু মেয়ের পেছনে টিকটিক। ছোটবেলা থেকে। অলওয়েজ ন্যাগিং।

    টুপুর , পা ছড়িয়ে বসবে না। টুপুর , চেঁচিয়ে কথা বলবে না। টুপুর, মাসিরা আসবে, বিকেলে কোথাও যাবে না। টুপুর , দাদা দ্যাখো ম্যাথসে নাইন্টি এইট পার্সেন্ট । আর তুমি? আরন্ট ইউ অ্যাশেমেড?টুপুর, বীথিরা এলে ভদ্রভাবে কথা বলবে। চা দিতে শেখো।
    গা চিড়বিড় করে। ভেঙেছে। মায়ের ঐ ডেইন্টি ডেলিকেসি অনেকটা ভেঙেছে। এখন আর বেশি কিছু বলার সাহস পায় না। কেমন একটা মুখ ফুলিয়ে থাকে। খুব সেন্টি। থাক। রান্নাটান্না নিয়ে ভালোই থাকে। শী ইজ লিস্ট বদার্ড অ্যাবাউট হোয়াট ইজ গোইং অ্যারাউন্ড। কয়েকটা জায়গাতে ডোনেশন দিয়ে নিজের পিঠ নিজে চাপড়াচ্ছে। মায়ের বন্ধু সার্কেলটাও একইরকম। মিউমিউ টাইপ। এক্সেপ্ট নীলম। হ্যাঁ । শুধু নীলম। মাসি না। বরাবর নীলম বলে। মা অনেক বকেছে। কিছু হয়নি। নীলম ইজ আ ডক্টর। নাউ ওয়র্কিং ইন হসপিটাল। তাছাড়া অনেক সোশ্যাল অ্যাক্টিভিটি আছে ওর। শী স্পিকস সেন্স অ্যাটলিস্ট।
    মাধবীলতার ঝাড়টা অসম্ভব সুন্দর । টিকটিক করে কে ডেকে উঠল।
    - তুমি এখানেও?
    - রোজ আসি। গাছে পোকামাকড় থাকে।
    - আছো বেশ।
    - সিটি মারতে তো ভালোই পারো।
    - শিখতে হয়। এইসব লোকজন গিজগিজ করছে। লকডাউন কে বলবে! সকালে দেখেছো , থলি হাতে বাজারে ছুটছে যেন গান্ডেপিন্ডে না খেলে চলছে না। মাস্কটা নামিয়ে কথা বলছে। দ্যাখো। ঐ যে।
    - ওদের হার্ড ইমিউনিটি তৈরি হয়ে গেছে।
    - ছাই হয়েছে। রাস্তায় থুতু ফেলছে। লটস অব পিপল।
    - কত কাজ থাকে লোকের । কাজ থাকলে না বেরিয়ে কী করবে? কেরলের মতো ঘরে ঘরে রেশন পৌঁছে দিলে নাহয় কথা ছিল!
    - বাপরে। তুমি তো অনেক খবর রাখো ! কেরলে ডোর টু ডোর কি হচ্ছে তাও জানো!
    - ইতালিতেও দিচ্ছে। কাউকে বেরোতে হচ্ছে না। তেল সাবান, খাবার, ওষুধ সব বাড়িতে পৌঁছে যাচ্ছে।
    - কে বলল?
    - তোমাদের টিভির পেছনে থাকি অনেকটা সময় । সবই কানে আসে। টিকটিকি উদাস হয়ে গেল।
    ও হাসল।
    - এখানে ঘরে ঘরে রেশন পৌঁছালেও হবে না। লোকে মাছের মাথা দিয়ে কচুশাক খাবার জন্য বাজারে যাবে। অতিমারী অর নো অতিমারী। বুঝলে?

    ✨ শ্রমিক টেরেইন

    ইটারসি থেকে দলটা একটু ছোট হয়েছে। ভাগ হয়েছে। প্রায় কুড়ি জনের একটা দল চলে গেছে দক্ষিণের দিকে। সুখনলালরা এখন আটজন। আটজন চলেছে নাগপুর স্টেশনের দিকে। দুই পায়ে দপদপে ব্যথা। দিনে নয়ঘন্টা হাঁটছে এখন ওরা। ভোর তিনটের সময় চলা শুরু । দিনে পঁয়তাল্লিশ কিলোমিটার হাঁটতেই হবে। বাড়ি যেতে হবে। বাড়ি । এক একেক দিন পেটে ব্যথা ওঠে। এত ব্যথা করে যে পেটে গামছা বেঁধে শুয়ে পড়ে। সুখনলালের একদিন খুব ব্যথা উঠেছিল। মনে হয়েছিল আর বাঁচবে না। সে কী গোলানি পেটে। সেদিন ওকে বাঁচিয়েছিল এক ট্রাক ড্রাইভার। রাস্তার একটা বেখাপ্পা জায়গাতে বেদ্না উঠল। সেটা ন্যাশনাল হাইওয়ে । দলের বড় অংশটা বেরিয়ে গেছে তখন। সুখনের সঙ্গে সাতারিয়া হেমব্রম, সহিল কুমার গৌড, তার বউ বাচ্চা, বাসরাও মুণীশ আর তিন চারজন। ওরা সবাই নভি মুম্বাইতে পূরণপানি পঞ্চায়েতে কাজ করতো। প্রাণপণে দলটা ছুটছে তখন নাগপুরের দিকে। পয়লা মে থেকে নাকি চালু হয়েছে শ্রমিক টেরেইন। মুম্বাই থেকে ছেড়েছে আগের দিন সকাল সোয়া আটটায় । নাগপুরে যদি টেরেইন ধরা যায় তো পরেসানি অর্ধেক হয়ে যাবে। সরকার বলেছে টেরেইনে শুধু সেকেন ক্লাসের ভাড়া। ওই দিয়ে খাবার, ওষুধ,খাবার জল, কাপড়, জুতা সব পাওয়া যাবে। এ যেন হাতে চাঁদ পাওয়া। কতদিন হল কাপড় ছাড়া নাই। পায়ে চটি ছিঁড়ে গেছে। খাবার নাই রোজ। গত দুদিন কিছুই জোটে নি। পেট কামড়ায়। বমি হলে শুধু জল।
    ভোর রাতে পেট যেন কে টেনে ধরলো। সুখন ভাবল মাঠে গেলে ঠিক হয়ে যাবে। কিন্তু হল না। কামঠ যেন ছিঁড়ে খাচ্ছে নাড়িভুঁড়ি । সুখন মাটিতে পড়ে হাউ হাউ করে কেঁদে উঠল। নাগপুরে টেরেইন ধরা বুঝি হল না আর।
    ট্রাক ড্রাইভার গুরবংশ সিং। গোটা দলটাকে তুলে নিয়েছিল ট্রাকে। সুখন যন্ত্রণাকে গিলছিল। কিছু নাই। খাবার নাই। শুধু বেদ্না আছে। তাই খাই। সুখন ঠোঁটে ঠোঁট চেপে যন্ত্রণাকে গিলে খায়। একটা একটা করে ঘাই আসে পেটে। সুখন কাতরায় আর বলে, আয়, আয় শালা বেজন্মা বেদ্না। তোকে গিলে খাব। তোর গুষ্টি গিলে খাব। সুখনলাল বাঁচবে। পৌঁছাতে হবে ছেলেটার কাছে। ট্রাক চলেছে দুরন্ত বেগে। সুখনলালের যন্ত্রণা ফিরে ফিরে আসছে। দরদর করে জল পড়ছে চোখ দিয়ে । আরে মারে। বাঁচা লিয়ো। সহিলের বউ বলেছিল ট্রাক ড্রাইভারকে, ভাইয়াজি গাড়ি রোকো। ইয়ে আদমি মর যায়েগা।

    অনেকক্ষণ বাদে জ্ঞান ফিরেছিল সুখনের। শরীর হাল্কা লাগছে কিছুটা। পেট গোলাচ্ছে। কিন্তু বেদ্না কম। একটা ধাবাতে খাটিয়ার উপর শুয়ে সুখনলাল। পেটের উপর ভিজা কাপড়। পেটে হাত দিয়ে সুখন বোঝে পেট তেলতেল করছে। গন্ধ শোঁকে। সর্ষের তেল। কেউ আচ্ছা করে সর্ষের তেল দিয়েছে তার পেটে। জল দিয়েছে। তারপর ভিজা কাপড় দিয়ে দিয়েছে । সহিলের বউ ঐদিকে গাছের তলার খাটিয়াতে বসে বাচ্চাদের রুটি খাওয়াচ্ছে। গুরবংশ সিং হাত ধুতে গিয়েছিল। মুছতে মুছতে ফিরে আসছে।
    - ক্যা ভাইয়া। ঠিক হো আমি? আচ্ছা খাসা হট্টা কট্টা আদমি,ক্যা হালত বানা লিয়া। চলো রোটি শোটি খাও।
    রুটি না। সুখনের প্রাণ তখন দুমুঠো ভাত চাইছে। দুদিন পেটে কিছু নাই।
    গুরবংশ সিং পেটে তেল আর জল মালিশ করে দিয়েছে । গুরবংশ সিং খাদ্যের খোঁজও দিয়েছে। বাড়ি থেকে টিফিন বাক্সে এনেছিল চাউল, কালি দাল। সবজি। সামান্য খেতে পারল সুখন। সর্দার ধাবার রুটি তরকা খেয়েছে। অ্যাসিডিটির ওষুধ গুরবংশের কাছে সবসময় থাকে। লম্বা রাস্তা চলে ট্রাক নিয়ে । ওষুধ রাখতে হয়। গমের ট্রাক নিয়ে বেরিয়েছে। নাগপুর পর্যন্ত ওদের ছেড়ে দেওয়াই যায় ।
    দুদিন তিনদিন বাদে বাদে পেটে কিছু পড়ে। তারপর আবার চলা। সুখন বুঝল শরীর খুব দুর্বল। চলার শক্তি নাই। সামান্য ভাত ডাল পেটে পড়েছে। ওষুধ । সুখনলাল ট্রাকের পিছনে গমের বস্তার ফাঁকে শুয়ে পড়ে। কী আরাম। ব্যথা কমল অনেক। এত আরামে অনেকদিন শোয়া হয়নি সুখনলালের। বস্তা বস্তা গম যাচ্ছে। কোথায় যাচ্ছে কে জানে। সুখনলাল জানতেও চায়না। বস্তার ফাঁকে ফাঁকে নিজের শরীরগুলো ঢুকিয়ে নিয়ে চলেছে হতক্লান্ত মানুষগুলো। চলোরে চলো। শ্রমিক টেরেইন পকড়না হ্যায়
    পা খসে পড়ে যেন। কতদিন বাদে এই গতিময় শোয়াটুকু। ঘর আউর কিতনা দূর?

    ✨তবু বিহঙ্গ ওরে বিহঙ্গ মোর

    মকরন্দ'স ফাদার ডায়েড বিকজ অফ কিডনি ফেইলিওর। হসপিটাল রিপোর্ট তাই বলেছে। অ্যান্ড অ্যাডেড টু দ্যাট হি ওয়াজ কোভিড পজিটিভ। হসপিটাল বডি দিতে পারেনি। মকরন্দ, তার মা এবং মকরন্দের দিদি ও জামাইবাবু হোম কোয়ারেন্টাইনে । তারা শেষবারের মত মকরন্দের বাবার মৃতদেহ দেখতেও পায়নি। কোনোমতেই অ্যালাউ করা হয়নি। অদিতি প্রেস লেভেল থেকে অনেক চেষ্টা করেছে।
    মৃত্যু এত আড়ালে আবডালে ঘটে গেলে, কী হল তা ঝট করে বোঝা যায় না। শুধু ডেথ সার্টিফিকেট ধরিয়ে দেওয়া হল । কোনো শোক জ্ঞাপনের জায়গা নেই। সময় মানুষকে একেবারে কোণঠাসা করে ফেলেছে । মকরন্দের বাড়িতে সবাই প্রচন্ড ভয়ে ভয়ে আছে। বিশেষ করে ওর মা। ওঁর হাতের পুরনপুরি খাবার জন্য ওরা বহুদিন যখন তখন কাজের ফাঁকফোঁকরে চলে যেত ওদের বাড়িতে । ফার্গুসন রোডে ওদের তিনতলা বাড়িতে এখন কেমন এক আচ্ছন্ন শোক। জানলা দরজা আষ্টেপিষ্টে বন্ধ । খুব সাবধানে থাকতেন ওঁরা। তবু কোন ফাঁকে লখিন্দরের লোহার বাসরঘরেও সাপ ঢোকে। ড্রপলেট। এখনো পর্যন্ত হু বলছে ভাইরাসটি ড্রপলেট বাহিত। মকরন্দ বাইরে যেত একমাত্র। কাজের জন্য শুধুমাত্র । ও ভীষণ আপসেট। ফোনেই বোঝা যায় । সামহাউ হি ফিলস দ্যাট হি ইজ রেসপনসিবল ফর ব্রিংগিং ইন করোনা ইন হিজ হাউজহোল্ড হুইচ ফাইনালি এন্ডেড আপ ইন দ্য ডেথ অফ হিজ ফাদার। ওরা সবাই এত আতঙ্কে আছে যে ঠিকমত মৃত্যুশোকটাও ফিল করতে পারছে না। বাড়ির দরজা সিলড। একটা লালের ওপর সাদা দিয়ে কোভিড নাইন্টিন লেখা পোস্টার যেন একটা স্টিগমা। সমস্ত পাড়া থমথমে। এত অভিজাত পুরোনো পাড়া একটা। মকরন্দের পাঁচপুরুষের বসবাস। অথচ এই সময়ে সবাই মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে । কোভিড পেশেন্টদের পরিবার মানে অচ্ছ্যুত। তারা হাওয়ায় দূষণ ছড়ায়। রোগের চাইতেও বড় হয়ে যাচ্ছে এই এলিয়েনেশনের আতঙ্ক । মৃত্যু অধিক যন্ত্রণা । অদিতি , দেবরূপ এবং আরো দু চারজন বন্ধু বান্ধব প্রয়োজনীয় খাবার, গ্রসারি, ওষুধ পত্র পৌঁছে দিচ্ছে। দোতলা থেকে একটি বাস্কেট নামিয়ে দেওয়া হয় দড়ি দিয়ে । নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্যাদি ওপরে উঠে যায় । কী আশ্চর্য । একটি ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র ভাইরাস কিভাবে মানুষকে বিপর্যস্ত করে ফেলেছে ! মকরন্দ যোশির পরিবার ফার্গুসন রোডের অভিজাততম পরিবারগুলির একটি। মকরন্দ একজন আধুনিক মানুষ। কিন্তু ওর ঠাকুর্দা বা বাবা মা যথেষ্ট গোঁড়া। ওর ঠাকুর্দার আমলে কোনো অন্য জাতের লোক বাড়িতে ঢোকার অনুমতি পেত না। ভয়ানক ছুঁত মার্গ। একধরনের প্রচ্ছন্ন উন্নাসিকতা দেখেছে মকরন্দের বাবার মধ্যেও। অধ্যাপক ছিলেন বিজ্ঞানের । কিন্তু ভারতীয় ব্যক্তিগত জীবন এখনো
    অবশ্যই কোনো দর্শনের ধার ধারে না। মকরন্দ তার পূর্বপুরুষের কৃতকর্মের ফলভোগ করছে কি? বা তার বাবা? যে শরীর অচ্ছুত মনে করে অনেকের প্রণাম গ্রহণ করেনি, খাদ্য গ্রহণ করেনি, বিবাহসম্পর্কে উন্নাসিকতা বজায় রেখেছে, সেই শরীর কোথায়, কার হাতে , কিভাবে গেল কেউ জানে না। লক্ষ লক্ষ কোভিড পেশেন্টদের পরিণতি।
    দেবরূপের সঙ্গে প্রথম আলাপ মকরন্দের বাবার। হেলো ইয়ং ম্যান। সো ইউ আর ফ্রম ক্যালকাটা?
    মকরন্দের বাবা সুপুরুষ। দীর্ঘকায়। কৃশ শরীর। পিওর ভেজ। খুব ভালো লাগছিল। পুনেতে নতুন তখন দেবরূপ । মনে হচ্ছিল একজন গার্জিয়ান।
    - আ মাইক্রোবায়োলজিস্ট ইন মেকিং? গুড। সো, দেবরূপ, হোয়াট?
    - হোয়াট স্যর?
    - নো। নট স্যর। আঙ্কল। আই মিন , দেবরূপ হোয়াট।
    - ও! আধসেকেন্ড সময় লাগল বুঝতে।
    - সেনগুপ্তা। দেবরূপ সেনগুপ্তা।
    বেশ খুশি খুশি দেখালো প্রফেসর যোশিকে। পুনে ইউনিভার্সিটির পদার্থবিজ্ঞানের সিনিয়র অধ্যাপক। সাদা চুল। প্রশস্ত কপাল।
    সাদা মার্বেলের মেঝের ওপর দুটি অভিজাত পা।
    -গুড। সেনগুপ্তা। সেনগুপ্তাস আর ভৈইদস! হাইয়ার কাস্ট। অ্যান্ড ইওর পেরেন্টস?
    মকরন্দের মা প্লেটে করে পুরনপুরি নিয়ে এসেছেন। মিষ্টি চেহারা । নাকে একটা বড়সড় গয়না। দুঘন্টা । ওদের তিনতলাবাড়ির দোতলার বারান্দায় বসে। বড় বড় গাছ। দোতলায় উপচে এসে পড়েছে গাছের ডালপালা। বেশ হাওয়া , পুনের সেই শরতকালীন পরিচ্ছন্ন বিকেলে। ও বুঝতে পারছিল। সকল আপাত পরিচ্ছন্নতার পিছনেই এক অপরিচ্ছন্ন স্কীম থাকে। ছক।
    প্রফেসর যোশি জেনে নিচ্ছেন দেবরূপ সেনগুপ্তর প্রসপেক্ট। পরিবার। ব্যাকগ্রাউন্ড । ক্লাস।
    হসপিটালের বাইরে দাঁড়িয়ে অদিতি আর দেবরূপ । অতুল। রকি। মুখে মাস্ক । মাথায় আবরণ। কেউ কারু মুখের দিকে তাকায় না। কিছু করার নেই। কোনো শবদেহ নেই শেষকৃত্যের জন্য। বা শবদেহের জন্য কোনো শেষকৃত্য নেই । ও নিজে শেষকৃত্যে বিশ্বাসী নয়। নাথিং রিমেইনস আফটার ডেথ। পার্সিরা শকুন চিলকে খাওয়ায় শবদেহ। সেনসিবল।
    অদিতি দেখল একটু দুরে মাথা থেকে হেলমেট খুলে দেবরূপ।
    বিড়বিড় করছে।
    জেন্টাইল অর জ্যু/ ও ইউ হু টার্ণ দ্য হুইল অ্যান্ড লুক টু উইন্ডওয়ার্ড/ কনসিডার ফ্লেবাস,হু ওয়াজ ওয়ান্স হ্যান্ডসাম অ্যান্ড টল অ্যাজ ইউ।

    ফ্লেবাস, ফিনিশিয়ান বণিক হে! ভুলে গেছে সমুদ্রপাখিদের ডাক/তার লাভ ক্ষতির হিসেব ডুবে গেছে সমুদ্রতলে/
    তার শরীরের হাড়ে সমুদ্রতরঙ্গ। মৃত শরীর উঠছে নামছে ঢেউয়ের তালে/
    তুমি যেই হও , ভেবেছিলে তোমার হাতে রথচক্র/
    ভেবে দেখো। সেও ছিল দীর্ঘ, সুদর্শন।

    অতুল কুলকার্ণি অবাক হয়ে অদিতিকে জিজ্ঞেস করল, হোয়াটস রং উইদ হিম? হোয়াট ডাজ হি সে?
    অদিতি মাথা ঝাঁকাল।
    ডোন্ট ওরি। ইটস টি এস এলিয়ট হু স্পিকস। হি ইজ ফাইন।

    ✨জ্বরের রাতে একার অভিসার

    কমোডে বসে ঠক ঠক করে কাঁপছিলো। ফোন পাওয়া মাত্র পেট গুলিয়ে প্রচন্ড দাস্তবোধ। প্ল্যাস্টিক পেইন্ট করা দেওয়াল। হাল্কা পেস্তারঙ বেয়ে চুঁইয়ে পড়ছে মোমমসৃণ পালিশ করা আহ্লাদিপনা। ফ্রিজে পর্যাপ্ত খাদ্য মজুত। বাথরুমে ওয়াশিং মেশিনে ধোয়া হচ্ছে ছাড়া কাপড়জামা। প্রচন্ড বৃষ্টি পড়ছে বাইরে । ও কেঁপে যাচ্ছে। ফোন পড়ে আছে বিছানার ওপর। কাটতেও ভুলে গেছে।

    নির্মাল্য সামন্ত। ক্লাস ফোর। টাই বাঁধতে পারে না। ওর বাড়িতেও কেউ টাই বাঁধতে পারে না। অথচ স্কুলে টাই বাঁধতে হবে। বন্ধুরা হাসবে। টিচার বকবে। নির্মাল্য সামন্ত তাই আগে এসেছে। বাথরুমের স্বল্প পরিসরে দেবরূপ সেনগুপ্ত ও নির্মাল্য সামন্ত। দেবরূপ টাই বেঁধে দিচ্ছে। এইভাবে ঘুরিয়ে সিঙ্গারা বানাতে হয়। তারপর এইভাবে টানতে হয়। দেবরূপের মা শিখিয়ে দিয়েছে। নির্মাল্যর মা জানে না। বাবাও জানেনা। দেবরূপের মা স্কুলে পড়ায়। নির্মাল্যর মা বাড়িতেই থাকে। দেবরূপের বাবা নিজের গাড়িতে অফিস যায় । নির্মাল্যর বাবা সাইকেলে। নির্মাল্যর মাথাতে সর্ষের তেলের গন্ধ । ও ইংলিশে উইক। ম্যাম বলেছে। কিন্তু ম্যাথসে ভালো। নির্মাল্যর নাকে সর্দি।
    আন্টি আন্টি সি দেবরূপ অ্যান্ড নির্মাল্য আর ডুইং ন্যাস্টি থিংগস ইন টয়লেট।
    না ম্যাম। আমরা তো কিছু করিনি। আই ওয়াজ যাস্ট টিচিং হিম টু মেক দ্য টাই নট।
    আন্টি কিছু শুনলো না। পানিশমেন্ট। ডিটেনশন আফটার স্কুল। গার্ডিয়ান কল।
    দুজনের সেকশন আলাদা।
    টাই বাঁধা হয়ে গেলে ওরা দুজনে একসঙ্গে হিসু করে নিচ্ছিল। ফার্সটবয় দেখে চেঁচায় ।

    সেকশন আলাদা হলেই বন্ধুত্বে ব্যাগড়া দেওয়া যায়না। টিফিন টাইম। স্কুলের পরে। কমিকস। পরীক্ষা বয়ঃসন্ধি । রাগ। বিরক্তি। ভাল লাগা ও না লাগা। পরীক্ষা । ক্লাসটেস্ট। পূজো। একলা লাগা। পরীক্ষা ।
    কোচিং। ফুটবল। ক্রিকেট। ডেজ অব গ্রোয়িং আপ।
    মেয়েরা। মাস্টারবেশন। পর্ণফিল্মস। সিগারেট। পরীক্ষা । ল্যাব। ফিল্ম ফেস্টিভ্যাল । তাড়া তাড়া কাগজ ও ল্যাপটপ। দীর্ঘদিন দীর্ঘরাত। অ্যাপ। অ্যাপ। অ্যাপ। চল দীঘা যাই।
    উঁচু ক্লাসে উঠলে পরিধি ও পরিসর দুটোই বৃদ্ধি পায় । নির্মাল্য ইংরিজি ভালো পিক আপ করেছে । একসঙ্গে মাধ্যমিক । উচ্চমাধ্যমিকে দেবরূপ সায়ান্স । নির্মাল্য আর্টস। দেবরূপ সিমবায়োসিস। পুনে। নির্মাল্য ইন্টারন্যাশনাল রিলেশনস। যাদবপুর। গ্রাজুয়েশনের পরেই ও যোগ দিয়েছে
    " দি ইন্ডিয়ান রিভিউ" তে। প্রমিসিং জার্ণালিস্ট। এন্টারটেইমেন্ট কাভার করতো। তাছাড়া মিসেলেনিয়াস। পুনে ঘুরে গেছে ফেব্রুয়ারিতেও। কেরল কোভিড রেসিসট্যান্স কাভার করেছিল প্রথমদিকে।

    এপ্রিলের প্রথম থেকেই চিফ এডিটরের কাছে খবর আসতে থাকে , খারাপ সময় আসছে। থিংগস আর ডিটিরিওরেটিং। লোক কমাতে হবে। টাইট করতে হবে অফিস। ছাঁটাই হবে।
    অ্যান্ড দ্য সিনিওরস আর মোর ডিপেন্ডেবল । ইনফ্লুয়েনশিয়াল। নির্মাল্য সামন্ত। যতীন সাকসেনা। মৃদুলা পন্ডিত । আকাশ শ্রীবাস্তব । রোহন চতুর্ভেদি। ওর নিউকামার্স ফায়ার্ড। স্যাকড। প্রবেশনারি পিরিয়ড সদ্য পার হয়ে গেছিল ওদের।

    নির্মাল্য সামন্তর বাবা অবসরপ্রাপ্ত করণিক। মা গৃহবধূ । বাড়িতে দিদি। যে একটি অসুখী বিবাহকে মানিয়ে নিতে নিতে , ক্লান্ত হয়ে একটি নির্বাক কাষ্ঠদন্ডে পরিণত। ছত্রিশ বছর বয়সে অনিয়মিত ঋতুস্রাব ক্যানসারের কারন হতে পারে কারণ জরায়ুর টিউমার বেশ বড় । তাই কেটে বাদ , জরায়ুসহ। জরায়ুবিহীন স্ত্রীকে নিয়ে একজন পুরুষ কি করেই বা সুখী হতে পারে, তাই ডিভোর্স কেস করতেই হয় নির্মাল্যর জামাইবাবুকে। বেচারা অসহায় জামাইবাবু।
    এখন নির্মাল্যর ডিভোর্সি দিদি একটি আটবছরের ছেলে সহ বাবার বাড়িতে । রোগা। পাংশুমুখের মেয়েটি। সুতনুকা। বাড়িতে কাজ করে সংসারের। পাঁচজনের রুটি। আলুভাজা। বা তরকারি।

    নির্মাল্যর দিদিই প্রথম দেখে। চোখ বিস্ফারিত হয়ে আছে। মোড়া পড়ে আছে ঘরের কোণে। দিদির শাড়িই নিয়েছিল। নীলরঙ। সুতি। হলুদ পাড়। খৈতান সিলিং ফ্যান।

    সকাল সাড়ে সাতটা। পুলিশ আসতে আসতে সাড়ে আট। ডাক্তার বলেছেন রাত তিনটে নাগাদ ঘটেছে ।
    নির্মাল্য সামন্ত। চব্বিশ বছর বয়স। মাধ্যমিক বিরাশি পার্সেন্ট। উচ্চ মাধ্যমিক আশি পার্সেন্ট । অনার্স ফার্সটক্লাস। ম্যাস কম ফার্স্ট ক্লাস। এক্স এমপ্লয়ি । দি ইন্ডিয়ান রিভিউ। উচ্চতা পাঁচ সাত। ওজন পঁয়ষট্টি কেজি। অবিবাহিত । কমিটেড সুইসাইড । আগের রাতে রুটি ও গুড় খেয়েছিল।

    কমোডে বসে দেবরূপ কেঁপে যাচ্ছে। ও বুঝতে পারছে। জ্বর আসছে ওর। খুব জ্বর। মাথা দপ দপ করছে। কাকে বলবে? মা' কে বলা যাবে না। অদিতি? আর ইউ দেয়ার?

    ✨ওয়র্ক ফ্রম হোম

    ল্যাপটপের ওপর ঝুঁকে পড়ে কাজ করছিলেন ত্রিদিব। লকডাউনে ওয়ার্ক ফ্রম হোম মানে কাজ অনেক বৃদ্ধি পেয়েছে । মালবিকা অতিমারীকে ছুটি মেনে ঠেসে খাইয়ে খাইয়ে মধ্যপ্রদেশেরও বৃদ্ধি ঘটিয়েছে । সব মিলিয়ে করুণ অবস্থা । এত দীর্ঘ লকডাউনে সমস্ত মার্কেটিং স্ট্রাটেজি চেঞ্জ করতে হচ্ছে। ঘন্টায় ঘন্টায় মিটিং। প্রথমদিকে জুমে কাজ করছিলেন। তারপর গুগল মিট। নয় টিম লিংক। কোম্পানিগুলো সব ওয়র্ক ফ্রম হোমের স্পেশাল
    নেট প্যাক দিচ্ছে। অতএব কাজের কমতি নেই। কিন্তু শরীরে তো খামতি আছে!চোখ জ্বালা করে ঘন্টার পর ল্যাপিতে বসে। ডাক্তার বলেছেন চোখের নার্ভ ড্রাই হয়েছে। অয়েন্টমেন্ট দিয়ে চোখ বুঁজে আধঘন্টা বিশ্রাম কাজের ফাঁকে। ত্রিদিব এই নিউ নরম্যালকে বুঝতে এবং অ্যাডজাস্ট করতে হিমশিম । মালবিকা বুঝেও বুঝছেন না কেন বর হুমড়ি খেয়ে কাজ করে। বেচারির ইমপালসিভ শপিং বন্ধ । আগে তো মন খারাপ হলেই পাঁচটি শাড়ি কেনা। কোভিড নাইনটিন বাদ সেধেছে।
    ত্রিদিবের কোম্পানিতে বি টু বি সেলস । বিজনেস টু বিজনেস। কাজেই কোম্পানি ক্লায়েন্টকে ডিজিটালি যোগাযোগ করে ইনভল্ড রাখতে হচ্ছে। খুব চাপের কাজ। কম্যুনিকেশন পার্সোনালাইজ করা চাপ এবং আনপ্রেডিক্টিবল। প্রতিযোগিতামূলক তো বটেই। সার্ভে বেসড।
    ত্রিদিব অনলাইন মার্কেট সার্ভে করেন দিনে দু' বার। অনেক অনেক ব্র্যান্ড স্টেপ ব্যাক করছে। কনসিউমারকে শিক্ষিত করতে হবে। মানে ডিজিটালি অ্যায়ার করতে হবে। কখনো ইনডিভিজুয়ালি। কখনো টিমে। আরো কম্যুনিকেশন চাই । আরো। কোম্পানির একটা ডিজিটালি অর্ডারড পরিকাঠামো তৈরি করে ফেলতে হব এই লকডাউনে। সমরেশ তাঁর আন্ডারে আছে। খুব কাজের ছেলে। একটা নতুন অ্যাপ তৈরী করার প্রোপোজাল এনেছে অতিমারীর রিয়ালিটি বজায় রেখে। অ্যাকোমোডেট নিউ কনসিউমার নিডস। ওঁদের নতুন প্রজেক্ট।
    মালবিকা পর্দা সরিয়ে দেখা দিল। বেশ দেখাচ্ছে।
    - চা খাবে? মালবিকার ডাস্টিং চলছে। কোমরে একটা অ্যাপ্রন। মানে গ্যাসে কিছু একটা চাপিয়ে এসেছে।
    ত্রিদিব হ্যাঁ আর না' র মাঝামাঝি একটা শব্দ করে কাস্টমার অ্যান্ড ক্লায়েন্ট আই ডি লিস্ট চেক করছেন।
    - হ্যাঁ কি না স্পষ্ট করে বলো। ওরকম শুয়োরের মত ঘোঁত ঘোঁত আওয়াজ করছো কেন?
    হায়রে। এই মহিলা নাকি শান্তিনিকেতনে পড়াশুনো করেছে। নৃত্যনাট্য করতো।
    - কফি। কালো।
    মালবিকা মুখ বেঁকিয়ে চলে গেল। কী বেরসিক। কালো কফি খাবে। কি করে খায় কে জানে। অবশ্য,সকালের চা নিজেই করে খায়। তরিবত করে। মালবিকা এখন রান্না বসানোর আগে জম্পেশ করে নিজের জন্য দুধ চিনি দিয়ে একটা চা বানাবেন। জলটা ফোটাবেন তেজপাতা, লবঙ্গ, আদা, দিয়ে । এই চা খেয়ে রান্নার মুড আসবে।
    ত্রিদিব সুরেশকে ফোন করছেন। শোনো। ডিজিটাল মার্কেটিং এর অনলাইন ওয়র্কশপ রাখো তিনদিনের । তিনটে স্টেপ। ফার্স্ট। করোনাস্প্রেড প্রিভেনশন। সেকেন্ড। অ্যাডাপ্টিং টু লকডাউন । থ্রি। নিউ নর্মাল স্ট্রাটেজি। কী মিনিমাইজ করবে আর কী ইনক্রিজ করবে তার একটা কমপ্লিট চার্ট করো। তারপর ক্লায়েন্ট মিট গুগলে।
    ফোনটা রেখে ত্রিদিব ভাবছিলেন প্রায়োরিটি পাল্টে গেলে কত কী ঘটে যায় । কোভিড নাইন্টিন। দ্য গ্রেট লেভেলার।
    ক্লায়েন্ট কে অনলাইনে দেখাতে হবে যে তাদের কোম্পানির অফিস, ফ্যাক্টরি, গুদাম কতটা হাইজিনিক। ভিডিও করে নিতে হবে দ্রুত। এসব ব্যাপারে দেরি না। প্রত্যেকটা কম্পানি লড়ে যাচ্ছে।
    জানালার পর্দা উড়লে বাইরে ক্রোটন বাহার। মালবিকা কফি আর বিস্কুট দিয়ে গেল।
    ব্যালান্স শিটে চোখ বোলাতে বোলাতে ত্রিদিবের মনে পড়ল এই সময় তাঁর মুম্বাইতে থাকার কথা। বা কোচিতে। নিটোল সুখদায়ক সব সফর। তখনি আলাপ হয়েছিল অনিল টমাসের সঙ্গে । বছর আটেক আগে।
    -হেলো অনিল। এভরিথিং ওলরাইট? বেটার নাউ?
    ওপাশ থেকে একটি স্তিমিত গলা ভেসে আসে।
    ত্রিদিব মনে মনে জিভ কাটেন। কয়েকদিন কাজের চাপে কোনো খোঁজ নেন নি।
    - কোভিড নাইন্টিন হ্যাজ স্পেয়ার্ড মি দাদা। বাট ক্যানসার মাইট নট। ডোন্ট নো ওয়াট টু ডু। কনফিউসড। টোটালি ব্রোকন। কেউ নেই শেয়ার করার মত।
    ফোন হাতে চুপ করে বসে থাকেন ত্রিদিব। একটা দুর্দান্ত রান্নার খুশবু আসছে তাঁর মডিউলার কিচেন থেকে। সর্ষে ফোড়ন টোড়ন দিয়েছে বোধহয় মালবিকা।
    - থিংক অ্যাবাউট মাই ফ্যামিলি দাদা। ইট উইল গো রুইন্ড ইফ ক্যানসার ইজ ডিটেক্টেড। মাই কিডস আর স্মল।
    অনিল ভাঙছেন। বড় শান্ত মানুষটা। মার্কেটিং এ এমন মানুষ বিরল।
    ত্রিদিব কী বলবেন খুঁজে পাচ্ছেন না। মালবিকা দৌড়ে এসে বলল
    শুনছো , একটা নাকি ভীষণ ঝড় হবে এর মধ্যেই । গ্রসারি একটু বেশি করে এনে রাখতে হবে। বুঝেছো?কোঅপারেটিভ খোলা থাকছে না দুটো পর্যন্ত? পোস্ত। সর্ষে। কালোজিরে। তেজপাতা। একটু বেশি করে। চলে গেল ঝড়ের মত। ও ঐরকম। ইম্পালসিভ।
    ঝড় আসছে আর একটা। একটা তো এসেই গেছে। তাণ্ডব চালাচ্ছে। তছনছ করে দিচ্ছে। মার্কেটিং স্ট্র্যাটেজি এখনি পুরো না পাল্টালে কোম্পানিতে তালা পড়বে।
    ব্যালকনি থেকে মালবিকা । আবার।
    - শুনছো! পুলিশ এসছে। ঐ ফ্ল্যাটবাড়িটায়।
    -কেন?
    - জানিনা। খুব চেঁচামেচি। শুনছো না? দেখে যাও। ওঠো দয়া করে ল্যাপটপ ছেড়ে ।

    উর্বশী অ্যাপার্টমেন্ট। তিনতলা। মহিলা একা ছেলে নিয়ে ভাড়া থাকেন। ব্যাংক অফিসার। বর নর্থ বেঙ্গলে পোস্টেড। এলে মাঝে মাঝে দেখা হয় ত্রিদিবের সঙ্গে ।
    ব্যাঙ্কে বেশ কিছু কোভিড নাইন্টিন কেস। টেস্ট করার সময় মহিলার পজিটিভ এসেছে।
    ফ্ল্যাটের লোক ঢুকতে দেবে না।
    - আপনি অন্য ব্যবস্থা করুন। আপনার করোনা আছে। এখানে থাকা চলবে না।

    ✨দ্য স্পট

    অনিল গত দু'রাত জেগে আছেন। প্রাথমিক ধাক্কা কাটিয়ে উঠতে সময় লাগছে। কষ্ট হচ্ছে খুব। মেডিক্যাল কলেজের রিপোর্ট, হেলথ কেয়ার সেন্টারের রিপোর্ট এসে গেছে। দেবরূপও পুনে থেকে রিপোর্ট পাঠিয়েছে। প্রথমে তিনি নিজেকে কনভিন্স করাবার চেষ্টা করেছিলেন। রিপোর্ট ভুল তো হতেই পারে। কিন্তু পরপর তিনটি রিপোর্ট একই কথা বলছে। দ্য স্পট অন দ্য রাইট লাংস ইজ নট আ স্পট বাট আ পালমোনারী নুডল।
    কী আশ্চর্য । এই রিপোর্টটা পেয়ে তাঁর হৃদপিন্ড ধক করে লাফিয়ে উঠেছিল বুকের কাছে। প্রায় তিন সেন্টিমিটার ডায়ামিটারের একটা নুডল চুপ করে বসে আছে তাঁর ডান ফুসফুসে। সেটা ম্যালিগন্যান্ট হতেই পারে যদিও দেবরূপ বলছে ক্যানসারাস হবার সম্ভাবনা খুব কম। মাত্র, ফাইভ পারসেন্ট। টিবি হতে পারে। ফাংগাল ইনফেকশন হতে পারে। এমনকি রিউমাটয়েড আর্থ্রাইটিস থেকেও এরকম নুডল তৈরি হয়। ঈশ্বর করুন যেন তাই হয়। অনিল টমাসের হাত পা কাঁপছে। এই মুহূর্তে তিনি কোভিড নাইন্টিনের কথা একেবারে ভুলে গেছেন। প্রভু যিশুকে স্মরণ করে ক্রস আঁকছেন বুকে। সেভ মাই চিল্ড্রেন লর্ড। পলিকে তিনি এই স্পট সংক্রান্ত ব্যাপারে কিছুই বলেননি। পলিও জানতে চায়নি কারন ফাইব্রোসিস হয়নি, অনিল সেরে উঠছেন কোভিডের আক্রমণ থেকে এটাই পলির কাছে মস্ত ব্যাপার। অনিল বারবার কর্তৃপক্ষের কাছে অনুরোধ করেছেন যে রিপোর্ট যেন তাঁর কাছে মেইল করা হয়। পলি একা সমস্ত দিক সামলাচ্ছে। এই নুডল সংক্রান্ত দুঃসংবাদ সে সহ্য করবে কেমন করে? একেবারে ভেঙে পড়বে।
    ঝমঝম করে বৃষ্টি পড়ছে আজ সকাল থেকে। বলা যায় মাঝরাত থেকেই এই বারিধারা। অনিল ঠায় জেগে বসে আছেন। পলিকে ফোন করেননি। আদ্যন্ত ঈশ্বরভক্ত পরিবার তাঁর।
    সিরিয়ান খ্রিষ্টান। সেইন্ট টমাস তাঁদের আরাধ্য। বারবার সন্তদের কথা মনে করছেন অনিল। সেইসঙ্গে এই পৃথিবীতে নম্বর শরীর নিয়ে আশ্চর্য সব অনুভূতি হচ্ছে তাঁর মনে। কী বিচিত্র মানুষের শরীর। কয়েকদিন আগেও তাঁর চিন্তা ছিল কোভিড নিয়ে । ফাইব্রোসিস হল কিনা। আর আজ তিনি ক্যানসারের আতংকে ধুঁকছেন। চেঙ্গালার বৃষ্টি অতি অপূর্ব । ঘন সবুজের আস্তরণ অনিলের চারদিকে। এত কাছে তাঁর প্রাণ প্রিয় পরিবার। অথচ তিনি কারু কাছে যেতে পারছেন না। কাউকে স্পর্শ করতে পারছেন না। একটি ভাইরাস এবং সেই সম্পর্কিত আতংক তাঁর সমূহ মানবিক বৃত্তি, তাঁর স্নেহ, প্রেম, প্রীতি, যৌনতা , সঙ্গকাতরতাকে থামিয়ে রেখেছে। কোনোরকম কোনো অনুভূতি প্রকাশ করতে পারছেন না তিনি। পলির সামনে খুব শান্ত হয়ে থাকছেন। যেন কিছুই হয়নি। সব ঠিক আছে। সব ঠিক হয়ে যাবে আগের মতোই ।
    তাঁর চারদিকে কচি কলাপাতা সবুজ। বটল গ্রিন অনেকটা। কলাপাতাগুলো আশ্চর্য সতেজ ও উন্মুখ। বৃষ্টির সব জল শুষে নিচ্ছে । জায়েন্ট ফার্ণ নিয়ে এসেছিলেন কোদাইকানাল থেকে। সেগুলো যত্ন পেয়ে বেশ ফনফনে হয়েছে। ক্রোটনে জলের ফোঁটা পড়ে আরো রঙিন দেখায়। হলুদ আর লালের ভ্যারিয়েশন। ফোঁটা ফোঁটা সবুজের ওপর। অনিল একান্তভাবে একাগ্রতায় এই ঘন সবুজের দিকে মনোনিবেশ করেন। যেন সবুজ বৃষ্টিস্নাত পাতার থেকে সতেজতা শুষে নেবেন চোখ দিয়ে । তিনি স্মোক করা ছেড়ে দিয়েছেন । কিন্তু এইসময়গুলো মনে হচ্ছে সিগারেট খেতে পারলে টেনশন কমতো। যদিও এই পালমোনারী নুডলের রিপোর্ট আসার পরে সেটা ভাবাও পাপ।
    পাপ পুণ্য বোধ সম্পর্কে অনিল টমাস খুব সচেতন। তিনি তো জ্ঞানত কোনো পাপকাজ করেন নি। তবু এই কঠিন সময় তাঁকে অতিক্রম করতে হচ্ছে। নিশ্চয়ই কিছু কারণ আছে। গতজন্মে কিছু ত্রুটি থেকে গেছিল। কোনো পাপ কাজ করেছিলেন হয়তো। ভাবেন অনিল। বার্ড অব প্যারাডাইস । ফুলটি নত হয়ে আছে। কী অপূর্ব রঙ। অনিল ভাবেন, তবে কী সারা পৃথিবীই কোনো পাপকাজ করেছিল? যার জন্য এই অতিমারী? এত মৃত্যু? গতকাল তাঁর সহপাঠী আইজাক মারা গেছেন কোভিডে। আইজাক ইউ এস এ তে থাকতেন দীর্ঘদিন। আইজাকের স্ত্রী হাসপাতালে। মন কিছুতেই স্থির রাখতে পারছেন না অনিল। তবে কী ধ্বংসের দিন সমাগত প্রায়?ভাইরাস তার অগ্রদূত?
    এবার ইস্টার পালিত হয়নি। অন্যান্য বার তাঁরা এই বাগানে ইস্টারের পার্টি দেন। বড় চম্পক গাছটির নিচে সাজানো হয় টেবল। পাড়া প্রতিবেশী ,বন্ধু বান্ধব, বাচ্চাদের বন্ধুরা। সবাই আসে। পলির নিজের হাতে তৈরি কোজুকাট্টা থাকে। থাকে মাপ্পাস। সবজি দিয়ে চমৎকার চিকেন স্ট্যু। সবজি আর শুকনো নারকোল কুচি দিয়ে থোরান। পিডি খুব ভালো বানান অনিল নিচে। ঘন গ্রেভির মধ্যে রাইস ডাম্পলিং। মীন মোলি। ঝালদার মাছ।
    এইবছরেও ধূমধাম করে ইস্টার সেলিব্রেট করবেন ভেবেই ফিরছিলেন অনিল। সব থেমে গেল। আর এখন আরো চিন্তা। কঠিন। তিনি না থাকলে আর কখনো ঐ চম্পক গাছতলা আলোকোজ্জ্বল হয়ে উঠবে না। লোকজনের কলহাস্য শোনা যাবে না। অন্ধকার হয়ে পড়ে থাকবে এই বাড়ি। এই বাগান। ছেলে মেয়ে কী শুকনো মুখে ঘুরে বেড়াবে? পলি? না পলি বিয়ে করবে আবার?
    এই মুহূর্তে অনিলের কাছে কোভিড নাইন্টিন কাম্য। সেরে ওঠার সম্ভাবনা ছিল। আর যদি মারাই যেতেন , তাহলে সেটা দ্রুত হত। উইদিন আ মান্থ। অর ফিফটিন ডেজ। সব যন্ত্রণা শেষ।
    কিন্তু এই পালমোনারী নুডল যদি ক্যানসারাস হয় তাহলে দীর্ঘদিন যন্ত্রণা সহ্য করতে হবে। অবর্ণনীয় যন্ত্রণা। শারীরিক । মানসিক। আর্থিক ভাবে দুর্বল হয়ে যাবেন। তাঁর দৌড়োদৌড়ি করে মার্কেটিং এর কাজ। বাড়িতে কতটুকুই বা থাকেন। অনবরত মাথা দুলিয়ে যাওয়া বার্ড অব প্যারাডাইস বলে, না, না, না। কি করবেন যদি ক্যান্সার হয়? পলি এখনো জানে না কিছু। শি উইল সিম্পল ব্রেক আফটার দিজ।
    ক্যানসার চিকিৎসা করাতে সর্বস্বান্ত হয়ে যায় মানুষ। আর,পলি তো শেষ না দেখে ছাড়বে না। অ্যান্টিসিপেশন ইজ সিকেনিং।
    ভাবতে ভাবতে অনিল ঘামছিলেন। অঝোরে বৃষ্টিতে চারপাশ অনেকটা ঠান্ডা। তার ওপর এত গাছপালা। সবমিলিয়ে অসম্ভব একটা শান্ত সৌম্য পরিবেশ। দূষণের চিহ্নমাত্র নেই। তবু ঘামছিলেন। কোভিড ভার্সাস ক্যানসার। ঈশ্বর তাঁকে এ কোন পরীক্ষার সামনে দাঁড় করিয়ে দিলেন!(চলছে)

    ✨নিউ রিয়েলিটি

    জাহির সকাল থেকে রঙতুলি নিয়ে বসেছিল। একটা ছবিও আঁকা হয়নি। বেশ কিছু ছবি এঁকে ও প্রিন্ট করিয়েছে। সেগুলি বিক্রিও হচ্ছে । টাকা যাচ্ছে কোভিড রিলিফ ফান্ডে। শুধু এভাবে হবে না। জানলা দিয়ে টানা বৃষ্টি দেখতে দেখতে জাহির ভাবছিল। অন্যকিছু করা দরকার। ড্র্যাগনট্যাটুকে ফোন করা যেতে পারে। ঘড়ি দেখল জাহির। ন'টা। ড্র্যাগনট্যাটু ঘুমাচ্ছে। দশটার আগে উঠবে না। উঠে ওয়ার্ক আউট করবে। ওটাকে বাইরে বের করা দরকার। দিনরাত পড়ে পড়ে ঘুমাচ্ছে আর মায়ের ওপর মেজাজ করছে।
    ইলিনা দেখলেন ছেলে রঙ, তুলি, ক্যানভাস নিয়ে চুপ করে বসে আছে। তার মানে কিছু ভাবছে। চুপচাপ চা আর লুচি তরকারি রেখে চলে গেলেন ইলিনা। তাঁর শরীর তেমন ভালো যাচ্ছে না। গা ম্যাজম্যাজ করছে। একটা প্যারাসিটামল খেয়ে নিলেন চুপচাপ। অন্যদিন সেলাই নিয়ে বসেন একটু জলখাবারের পরে। প্লেন কিছু পুরোনো অরগ্যান্জা আছে। তার ওপর এমব্রয়ডারি করছেন এই লকডাউনের অবসরে। আজ আর ইচ্ছে করল না।
    জাহির ওকে ফোনে পেল সাড়ে এগারোটার দিকে।
    - কি বে? উঠলি?
    - কেন? আমার ওঠা দিয়ে তোর কী? টাকা লাগবে?
    - টাকা তো সবসময় লাগে। সব কাজে।
    - এখন দিতে পারবো না। ফুটে যা।
    - এখন টাকা চাইছি না। অন্য কথা আছে।
    - বলে ফেল। তাড়াতাড়ি । খিদে পাচ্ছে।
    - অ্যাপ মার্কেট দেখেছিস?
    - না। কেন?
    - চল না। কিছু করি। প্যান্ডেমিক সিচুয়েশনে সবথেকে বেশি ডিম্যান্ড কিসের বলতো? অনলাইন এজুকেশনের। স্কুল। কলেজ। ইউনিভার্সিটি । ইভন কিন্ডারগার্টেন স্কুল। সবখানে অনলাইন এডুকেশন ইজ ইন ডিম্যান্ড।
    - হুঁ। জানি। পেট থেকে পড়ে অনলাইনে পড়ছে।
    - শোন না। আমি একটা সার্ভে করেছি। ধর এস এল পি। এই কোম্পানিটা মার্চে অনলাইন এজুকেশন অ্যাপ বের করেছিল। মার্চে লার্ণার ছিল চারহাজার। এপ্রিলে জাস্ট ডাবল। আটহাজার। এখন ওদের ডাউনলোড জানিস? ছ লাখ।
    - তুই কি অনলাইন এজুকেশনের অ্যাপ খুলবি নাকি?
    - স্টপ বকবক। লেট মি ফিনিশ। শোন। চব্বিশে মার্চের পর থেকে সমস্ত অ্যাপ ডাউনলোড পঁচাত্তর পার্সেন্ট বেড়ে গেছে। ইট ইজ গুড সাইন।
    - হুঁ। নিউ রিয়ালিটি।
    - অনলাইন এজুকশনের জন্য স্পেশাল নেট প্যাকেজ দিচ্ছে। কতটা ডিম্যান্ড বোঝ।
    - বুঝেছি। মানে জানি। আমার খিদে পেয়েছে । এবার রাখি।
    - না। দাঁড়া । আর দশমিনিট। এই ব্যাপারটা আমরা কাজে লাগিয়ে কিছু করতেই পারি।
    - মানে?
    - ঘরবন্দি হয়ে খিটখিটেপনা করছিস সারাক্ষণ । কাজ শুরু কর। একটা অ্যাপে প্রডাক্ট ম্যানেজমেন্ট, ডেটা সায়েন্স, মেশিন লার্নিং, ডিজিটাল মার্কেটিং সব থাকবে। আমরা এক্সপার্টদের ইনভল্ভ করবো। কয়েকটা ফ্রি পুরো প্রোগ্রাম , বাকিগুলো পেইড। রেকর্ডেড সেশনস থাকবে। কুইজ। লাইভ লেকচার্স। প্রোজেক্টস।
    ভেবে দ্যাখ। ক্রাউড ফাউন্ডিং এর ঝামেলা থাকবে না। ইনভল্ভড থাকবি।
    - সার্টিফিকেট?
    - ওগুলো আমি দেখে নিচ্ছি।
    - অত সোজা না।
    - অত কঠিনও না। বলছি। এটা পসিবল।
    - দ্যাখ। চেষ্টা কর। আছি। এখন খিদে।
    - সিরিয়াস। অ্যাপ হচ্ছে। নাম ঠিক কর। কোর্স ফি দশহাজার। ফিফটি পার্সেন্ট উইল গো ফর কোভিড এফেক্টেডস। আমি অফিশিয়াল টেকনিক্যাল, অ্যাফিলিয়েশনের দিকগুলো শুরু করছি। তুই মেধা আর দিগন্তকে নিয়ে অ্যাপ মেকিং। মেধা হ্যাজ আ ফাইন ল্যাব অ্যাট হার প্লেস। ইউ হ্যাভ দ্য গাটস।
    প্লিজ। লেট আস গিভ ইট আ ট্রাই।
    - ঠিক হ্যায় । করবো। এখন রাখছি। বাইরে একটা গন্ডগোল হচ্ছে। লেট মি সি ওয়াট হ্যাপেন্ড।
    - ওকে বাই । বাই ড্র্যাগনবেবি।
    ইলিনা ডাকছেন।
    - ভিকি। হটওয়াটার ব্যাগটা দে বেটা।
    জাহির ওপরে ছুটল।

    এপ্রান্তে ও জানলা খুলে দেখল বিস্তর ভিড় নিচে। উর্বশী অ্যাপার্টমেন্টের ঐ মহিলা। চাকরি করেন। রোজ দেখা যায় । ওকে ঘিরে একটা জনতা। বেশ গালিগালাজ। ইঁটপাটকেলের মত ছিটকে ছিটকে এসে লাগে। পুলিশ?
    গায়ে একটা চেক শার্ট চাপালো ইনারের ওপর। দৌড়ে গেল নিচে।

    মালবিকা জানলা থেকে দেখছিলেন। খুব বিপাকে পড়েছেন ভদ্রমহিলা। ত্রিদিবকে ডেকেছেন। ত্রিদিব যাবেন কিনা ভাবছিলেন। মালবিকা হাত টেনে ধরলেন। বেশ ভিড়। কোনো দরকার নেই যাবার ।

    ঝগড়া উত্তাল। প্রায় হাতাহাতি । এটাকে তো ভদ্রপাড়া বলা হয়। মানে বেশ পশ এরিয়া। এখানে মহিলারা জঙ্গী হয়ে আরেকজন মহিলাকে এইভাবে অ্যাটাক করছে মালবিকা ভাবতেই পারছেন না। ঘেমে যাচ্ছেন। যেহেতু মহিলারা অ্যাগ্রেসিভ, পুলিশ তেমন এগোচ্ছে না। মেয়ে পুলিশ নেই সঙ্গে।
    মালবিকা হঠাৎ দেখলেন , কালো শর্টসের ওপর সাদা কালো চেক শার্ট। রোগা । মাথার চুল পোনিটেইল করে বাঁধা। তীক্ষ্ম চিৎকার করে ঐ অ্যাগ্রেসিভ মহিলাদের সরাচ্ছে। পুলিশকে বলছে, আপনারা আটকান ওদের। আমি ওকে নিয়ে যাচ্ছি বাড়িতে । দেখছি কে আটকায় । জড়োসড়ো মহিলাটির হাত ধরে নিয়ে যাচ্ছে ফ্ল্যাটের দিকে। বাচ্চাটা কে সামনে রেখেছে।
    মালবিকা থপ্ করে বসে পড়লেন।
    টুপুর!তাঁর টুপুর!

    ✨সেন্টারে

    শ্যামার দিন গোণা দেখে কেউ কেউ হাসে। শকিলাবিবির হাসলে গালে টোল। মাস্ক খুলে দেয় সুযোগ পেলেই । দম আটকে যায় নাকী ওর। এক অতসী- মা মুখ থেকে মাস্ক সরায় না। কোমর পর্যন্ত কোঁকড়ানো ঘন কালো চুল। ফোনে আশ্রমের সবার সঙ্গে কথা বলে। ভুলেও বাড়ির কথা নেই। অতসী মা একদিন বললো ডায়নার বরের করোনা হয়েছে। শ্যামা ডায়নার ছবি দেখেছে। বৌদি দেখিয়েছে। কী সুন্দর দেখতে!বিলেতে থাকত। অ্যাক্সিডেন্টে মরে গেছে দুটো ছেলে রেখে। তার বরের কী করে রোগ হয় ওরা ভেবে কূল পায় না। সে তো নাকী রাজার ছেলে। তাদের কেন এ রোগ হয়। তারা তো শুনেছে কারু সঙ্গে হাতও মেলায় না। এসি ঘরে থাকে। পরিষ্কার থাকে। হাত দিয়ে খায় না পর্যন্ত । শ্যামা শুনে পর্যন্ত নিজের ছেলেটার কথা ভেবে যায় । সে যদি মরে, ছেলেটার কী হবে। তার বাপ তো কোন চুলোয় আছে কে জানে।
    সেন্টারে সার্ফের পাতা দেয় । পরিষ্কার থাকাই নাকি রোগের ওষুধ। শ্যামা এক বালতি ফ্যানা তুলে বসে থাকে স্নানঘরে। বস্তিতে ফিরে কী হাল হবে কে জানে। লোকজন যদি একঘরে করে রাখে! এই সেন্টারের দোতলাতে যে পুরুষরা আছে তারা সব ভিন রাজ্য থেকে ফিরেছে। বিহার। ইউপি। শুনেই শ্যামার মন হাঁকুপাকু করে উঠেছিল। সেই লোকটা মুম্বাই থেকে ফিরে যদি এখানে এসে থাকে। নাহা। ভাগ্যে এখানে নাই। মুম্বাই থেকে ফিরতে সময়ও তো কম লাগবে না। যদি ফেরে অবশ্য। জুহির মুখ যেন না দেখতে হয়। মনে মনে দেবতার পায়ে মাথা ঠুকে যায় শ্যামা। পুরুষরা যেমন সবাই ভিন রাজ্যের লেবার, মেয়েরা তা নয়। লোকাল দুচারজনকেও এখানে ঢুকিয়ে দিয়েছে। যেমন শ্যামা । জ্যোতি খেলতে গেছিল মীরাটে। লকডাউন হয়ে গেল। ফিরেই সেন্টার। অতসী মা গেছিল গয়া। কার পিন্ডি দিতে গেছিল কে জানে। সেকথা বলে না। আশ্রমে ঢুকতেই পারেনি ফিরে। এখানে পাঠিয়ে দিয়েছে। তাও অতসী মা আছে বলে অনেক কিছু জানা হয় মেয়েদের। রোগটা নাকি জলের ফোঁটা থেকে ছড়ায়। নাক, মুখ ঢেকে রাখতে হবে তাই। কেউ হাঁচলে, কাশলে তার থেকে দূরে থাকতে হবে অনেক। শ্যামার একটা শুকনো কাশি ছিল। সেটা অনেক সেরে এসেছে। কিন্তু বুকে একটা হাঁপ ধরছে। সে কথা তো শ্যামা সাহস করে ডাক্তারকে বলেনি। যদি আরো বেশিদিন এখানে রেখে দেয়।
    এখানে যখন ঢুকেছিল শ্যামা বা তাকে ঢুকিয়েছিল পুলিশ , তখন তার নাম লেখা, ঠিকানা লেখার কাজ করেছিল এক দিদি। কী যত্ন করে সব দেখাশোনা করছিলেন। দিদি নাকি ডেপটি ম্যাজিসট্রেট। অনেক বড়চাকরি। অতসী মা বলেছে। অনেক পরীক্ষা টরীক্ষা দিয়ে তবে শেষে এসব চাকরি পাওয়া যায় । প্রত্যেকের নাম ধরে ধরে ডাক দিয়ে দেখছিল দিদি। হাতে কার্ড। কার্ডে জনপ্রতি নাম, ঠিকানা সব লেখা। সেই যে ঢুকেছে, দিন নড়ে না।
    বৌদি ফোন করে শ্যামাকে। কোন লোক নেই কাজের। বৌদির কষ্ট হচ্ছে খুব । মেয়েটা তো কুটোটা নাড়ে না। হাফপ্যান্ট পরে ঘরে বসে থাকে। পড়াশুনাতে খুব ভাল নাকি। তা মনটা দরদী বটে। এটা সেটা দেওয়া, শ্যামাকে মনে করে দেয়। ছেলের জন্য খাতাটা, পেনটা। কিন্তু ঘরের কাজে লবডঙ্কা। সেই কবে থেকে দেখছে শ্যামা।
    কোয়ারেন্টাইন সেন্টারে নতুন একটা মেয়ে এসেছে। চোদ্দ পনেরো বছর বয়স হবে। ভাসা ভাসা চোখে একটা ফ্যালফেলে। বয়স আন্দাজে বুদ্ধি একটু কম মনে হয়। লম্বা একটা ফ্রক পরে এসেছে। সঙ্গে জিনিসপত্র কিছুই নেই। এসে বিছানার ওপর গ্যাঁট হয়ে বসে থাকল মেয়ে । নড়েও না। চড়েও না।
    একসঙ্গে তিনদিন থাকলেই মেয়েতে মেয়েতে মনের কথা চালাচালি। কেউ খুব পেট আলগা তো কেউ খুব চাপা। শ্যামা দেখল মেয়েটা খেলোও না কিছু। সকালে পাউরুটি, চা। লেবু। সব পড়ে থাকলো।
    নার্সদিদি এসে বকাবকি করে গেল ওষুধ দেবার সময়। মাস্কে নাক পর্যন্ত ঢাকা। নার্সদিদির কাজল পরা চোখ। সে আবার চোখ দিয়ে বকে। মেয়েটা ঝিম মেরে শুয়ে থাকল। লাল কালো রঙের লম্বা ফ্রকটা গোড়ালি ছোঁয়া । কুঁকড়ে শুয়ে আছে। যেন কিছু খোয়া যাবে। তাকে বুকে চেপে ধরে। মায়াতে বুক ভরে এলো শ্যামার। মেয়েটার মুখে যেন কী আছে।
    শরীর এখন অনেক সুস্থ শ্যামার। শাশুড়ি মরার আচমকা ধাক্কাও সামলে নিয়েছে। বৌদি ফোন করলে বললো, ছেলে দিব্যি আছে হরপ্রীতের কাছে।

    মাঝদুপুর বড় বিরক্তির। ইস্কুল বাড়িটা একটা মাঠের মধ্যে । খেলার মাঠ বোঝা যায় । এখন কেউই খেলতে আসছে না। কেমন ধু ধু করা একটা মনখারাপ। এখান থেকে বেরিয়ে বৌদির টাকাটা পাবে। কিন্তু আরেক বাড়িতে বলেই দিয়েছে যে তারা আর রাখবে না। এই সময়ে কোনো নতুন বাড়িতে কাজ পাওয়া যাবে না। টুকটাক সাহায্য বৌদি করেই থাকে এমনিতে। কত আর চাওয়া যায় আর হরপ্রীত ভরসা। সে যদি কোনো কাজ জুগিয়ে দিতে পারে তো শ্যামা বেঁচে যায় ছেলেটাকে নিয়ে । শাশুড়ির খরচটা কমে গেছে। একদিক থেকে বাঁচোয়া। নেই নেই করে আতপ চাল, মুগ- মটর, সবজিপাতি , ওষুধে তো কম যেত না খুব। একটু সাশ্রয় হবে। আবার ওদিকে ছেলেটাকে একটু ডিম, ফল, এইসব দিতে পারলে ভাল হয়। কী যে করবে শ্যামা!সাত পাঁচ ভেবে পায় না।
    জ্যোতির জ্বর এসে গেল এরমধ্যে। সেই সঙ্গে প্রচন্ড পেটখারাপ। প্রায় ডায়রিয়া মত। জ্যোতিকে হাসপাতালে নিয়ে চলে গেল এক সন্ধ্যাবেলা। খুব গল্প করতো মেয়েটা। হা হা করে হাসতো। ও যাবার পর মস্ত হলঘরটা
    ফ্যানগুলো ঢিকঢিক করে চলে। গরমে ঘেমে নেয়ে উঠছে শ্যামা। আয়া এল সাড়ে তিনটের দিকে। সবাই তখন ভাত ঘুম । আয়া পর্দা দিয়ে ঘিরে নিল মেয়েটাকে । কী করল কে জানে। বললো ড্রেসিং করতে হবে। কিছু বুঝল না শ্যামা । ওকে বস থাকতে দেখে আয়া এল। শ্যামার চোখে কৌতূহল। স্পষ্ট বোঝা যায়। আয়া ফিসফিস করে বললো "রেপ কেস"।
    বিহার বাংলা বর্ডার পার হচ্ছিল দলটা। এরা বিহারে কাজ করতে যায় পশ্চিমবঙ্গ থেকে। ইটভাটার কাজ করে প্রধানত। সুখিরাণী গেছিল টাকা রোজগার করতে। বুদ্ধি কম মেয়ে । লোকের বাড়িতে কাজ জুটবে না। বাপ মা পাশের বাড়ির কাকির সঙ্গে কাজে পাঠিয়েছিল। ভোররাতে ঘুমিয়েছিল ওরা। সুখিরাণীর মুখে কাপড় গুঁজে টেনে নিয়ে গিয়েছিল ওরা। চারজন ছিল। পরে ধান ক্ষেতে পাওয়া যায় সুখিরাণীকে। জ্ঞান ছিল না। শরীরে পোশাকও ছিল না।
    কে হাসপাতালে নেবে, কে থানাতে নেবে। কেউ কোনো দায়িত্ব নিতে চায় না। দলের মেয়েদের একজন একটা পুরোনো জামা পরিয়ে কলের তলায় ফেলল সুখিকে। কইমাছের প্রাণ। সন্ধের মধ্যে চোখ খুলল সুখি। এন জিও'র মেয়ে ডাক্তার দেখে । ব্রুটালি রেপড। সেভেরাল ইনজুরি। দেখেই চমকে উঠেছিল। ইট হ্যাজ টু বি রিপোর্টেড টু দ্য পোলিস। এন জি ও ওকে থানাতে নিয়ে যায়। রেপকেস। কোনো সাক্ষী নেই। গার্জিয়ান নেই। পুলিশ হসপিটালে দেয়। হসপিটাল থেকে এখানে। সুখিরাণী বুঝেই পেল না কোথা থেকে কী হল। শরীরে অসহ্য ব্যথা নিয়ে সুখি মুখ বুঁজে পড়ে থাকে। আয়াদিদি মুখে মাস্ক বেঁধে দিয়ে যায় । মুখ খুলিস না রে মেয়ে । চুপ করে থাক । চুপ। রেপ হয়নি। চুপ। কোভিড নাইন্টিনে মরেনি। চুপ। রেশন পাওয়া যায়নি। চুপ। চুপ। চুপ।

    ✨কোভিড ওয়ার্ডে কেউ যায় না

    ঝিনঝিন শব্দ করে ফোন বাজছে। কেউ ধরছে না কেন? পায়ে একটা টান ধরেছে। আজকাল সটান বিছানা থেকে উঠতে পারে না। ডাক্তার নিষেধও করেছেন বটে। একটু বসে ধীরেসুস্থে নামতে বলেছেন। আশ্চর্য । ফোনটা কেউ ধরছে না কেন। শ্যামা, বুলকি সব কি করছে? দুপুরের ভাতঘুম আজ বেশি হয়ে গেছে। আলুবেগুন দিয়ে ট্যাংরা মাছের একটা চচ্চড়ি করেছিলেন। মুসুরডাল। গন্ধলেবু। ভেন্ডি ভাজা বেসন দিয়ে । মেয়ের জন্য ভেজ স্যান্ডউইচ । ত্রিদিব খেয়ে উঠে যাবার পর আয়েস করে অনেকক্ষণ ধরে মাছের মাথা , কাঁটা চিবিয়েছেন। বৃষ্টি পড়ছিল বাইরে। মাছের কাঁটা। বিশেষ করে ট্যাংরা। খুব সাবধানে চিবোতে হয়। আজ রবিবার। ক্লাস বন্ধ । চিবোতে চিবোতে দেখল, একটা টিকটিকি কেমন অদ্ভুত দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে তার দিকে। গা শিরশির করলো।
    ডাইনিং এর একপাশে একটা কর্ণার স্ট্যান্ডে এখনো একটা ল্যান্ডফোন। ত্রিদিব বলেছিলেন ওটা বিদেয় করে দেবেন। মালবিকা রাজি হয় নি। আছে, থাক। কতসময় মোবাইলে নেটওয়ার্ক থাকে না। ছেলেটা মেয়েটা দূরে থাকে। কে ফোন করল? বাবু? উঠবার আগেই ত্রিদিব গিয়ে ফোন ধরেছেন।

    মালবিকা জল খাচ্ছিল। বিছানার পাশেই কাঁচের জগ। যেমন থাকতে হয়। ঢাকনা দেওয়া জলের গ্লাস। যেমন রাখতে হয়। ফোটোফ্রেমে স্বামী স্ত্রী। ছেলেমেয়ে । যেমন সাজাতে হয়। ত্রিদিব এসে দাঁড়িয়েছেন। মুখটা একটু ফ্যাকাশে যেন। গায়ে একটা সাদা টিশার্ট। পাজামা।
    - কী হয়েছে? কার ফোন?
    - শোনো । নার্ভাস হবে না। মা ইজ হসপিটালাইজড। একটু আগে ।
    - মানে?
    খেয়াল করেনি। ল্যান্ডফোনে সাধারণত তার বাবার বাড়ির লোকজন ফোন করেন। মা বিশেষ করে। মায়ের ছোট ডায়রিতে সব ফোন নম্বর লেখা।
    - সকাল থেকে জ্বর । কাশি।
    - কি বলছো?
    - যা বললো ফোনে। ব্রত।
    - মায়ের করোনা হয়েছে?
    - লালা নিয়েছে। টেস্ট হবে। রিপোর্ট আসুক। দুদিন সময় তো লাগবে।
    - আমাকে বলেনি কেন?
    - ডোন্ট বি অ্যাবসার্ড । হঠাত্ হয়েছে ।
    - সকাল থেকে মায়ের জ্বর। আমাকে ফোন করবে না?
    মালবিকা একদিন অন্তর মা' কে ফোন করেন। অথবা মা তাঁকে।
    উঠে পড়ল। ড্রেসিংটেবলের ড্রয়ার থেকে পার্স বার করে দেখছে। ঘড়ি পরছে তাড়াতাড়ি করে। ত্রিদিব আশ্চর্য হয়ে গেলেন।
    - কী করছো?
    মালবিকা ততোধিক আশ্চর্য ।
    - কী করছি মানে? যেতে হবে না হসপিটালে? তুমি যাবে না?
    ত্রিদিব দাঁড়িয়ে । স্থির। ফ্যান ঘুরছে ফুলস্পিডে। দুপুরে বৃষ্টি হয়েছে একচোট । কিন্তু গরম কমে নি কিছুমাত্র।
    - দাঁড়িয়ে আছো কেন লাইক আ জোম্বি? যাবে না? তাহলে আমি একা যাচ্ছি ।
    ত্রিদিব খাটে এসে বসলেন। গা পিত্তি জ্বলে গেল। মালবিকার মাথা টাল খাচ্ছে একটু একটু। চোখ ঝাপসা যেন। অস্থির লাগছে ।
    - বলো। ফ্যান যেন খুব আস্তে চলছে। স্পিড বাড়াচ্ছে না কেন কেউ?
    তীক্ষ্ম গলায় চিৎকার। শ্যামাআআআ।
    কোথায় শ্যামা? কোথ্থাও নেই। ছুটিতে।

    - মায়ের কাছে কাউকেই যেতে দেওয়া হবে না। মানে ইট ইজন্ট পসিবল। ওঁর প্রচন্ড শ্বাসকষ্ট । ওল কোভিড নাইন্টিন সিম্প্টমস। বাঙুরে নিয়ে গেছে। ব্রতর বন্ধু আছে যে , ঐ ডাক্তার ছেলেটি, হি হ্যাজ অ্যারেন্জেড আ সিট সামহাউ।
    - আমরা যাবো না?
    - বাচ্চাদের মত করো না। কাউকে ঢুকতে দেবে না। দেখতেও দেবে না। হসপিটালের বাইরে দাঁড়িয়ে থাকবে? চারদিকে থিকথিক করছে ভাইরাস । কতক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকবে?
    - বাড়ির কেউ নেই ওখানে?
    - মালবী। বোঝার চেষ্টা করো। মা হ্যাজ ওল দ্য সিম্পটমস অব কোভিড নাইন্টিন । টেস্ট হবে আজকেই। ব্রতর বন্ধুর জন্য বেডটা পাওয়া গেছে। পাওয়া গেছে যে এটাই বেশি। দুপুর থেকে ওরা বেড পাওয়া নিয়েই ব্যস্ত ছিল। প্রচন্ড হেকটিক।
    -তোমাকে জানিয়েছিল?
    - আরে না। তাহলে তো বলতাম। ব্রত। যতীন। শুভ। ওরাই যা দৌড়োদৌড়ি করার করেছে।
    - একবার জানাল না? যেতে পারতাম।
    - রিস্ক নিয়ে লাভ নেই মা। গিয়ে কিছু করতে পারতাম না আমরা। যা করার ডাক্তার করবেন। তুমি , আমি , আমরা গিয়ে ভিড় বাড়তে দিলে কন্টামিনেশন বাড়ানো ছাড়া কোনো কাজ হবে না। আমাদেরও ইনফেকশন হয়ে যেতে পারে।
    স্টিলের মত হিমশীতল গলা। আবেগহীন
    - তোরা হার্টলেস।
    - ইউ মে থিংক সো। বাট ট্রুথ ইজ ট্রুথ। কোনো লাভ নেই গিয়ে । তাতে যদি ভাবো দিদুনের জন্য কোনো কনসার্ন নেই আমাদের, ভাবতে পারো।
    চলে গেল ড্র্যাগনের হাওয়ায় । বাদুড়ের ডানা। গিরগিটির লেজ। ডুমো ডুমো আঙুর। চুলটা ঝুঁটি করে ওপরে বাঁধা।
    মালবিকা বসে আছে। ভীষণ একা লাগছে ওর। মা কোথায় ?শৌখিন মধ্যবয়সিনী গৃহিণী মালবিকা কোথায় হারিয়ে যাচ্ছেন যেন। ভেতর থেকে ছোট বালিকার মত কেউ হাহাকার করছে! মা! মা!
    কোন হসপিটালের বেডে। একা। হয়তো খুব জ্বর। কেউ নেই মাথায় হাত বুলিয়ে দেবার। জলপটি দেবার কোনো হাত নেই। হয়তো শ্বাস নিতে পারছেন না।
    মালবিকার দমবন্ধ হয়ে আসছে। তিনি শুধু একবার পাশে গিয়ে দাঁড়িয়ে মায়ের মাথায় হাত রাখতে চান।
    কোভিড তাও দেবে না?
    এত নিষ্ঠুর সে?

    ✨ভাইরাস ভাইরাস

    টিকটিকি দেখলো । মেয়েটা ল্যাপটপের সামনে। ওর দিকে তাকাচ্ছে না একবারও। অভিমান হল টিকটিকির। মানুষ বড় স্বার্থপর। ভেবে নিল।
    ডে ওয়ান । সকাল।
    উওলগ্যাংগ প্যাটেরসনের ছবি। আউটব্রেক। মেডিক্যাল থ্রিলার। জাস্টিন হফম্যান। মর্গান ফ্রিম্যান। রেঁনে রুশো। ইবোলার ধরনের ভাইরাস ছড়িয়ে পড়েছে আফ্রিকার কোনো অন্চলে আর তারপর ইউ এস এর একটি ছোটো শহরে দাপিয়ে বেড়াচ্ছে সেটা। উনিশশো পঁচানব্বুই।
    ও দেখতে দেখতে টানটান হয়ে বসলো। তবে তো মানুষ ভেবেছে। ইন ফ্যাক্ট অ্যান্টিসিপেশন আছে। এতদিন আগে মানুষ ভাইরাসের এই বিধ্বংসী আচরণের কথা ভেবেছিল তবে?
    ডে ওয়ান। রাত।
    রাতে খেয়েছে অল্প ভাত। আলুসেদ্ধ। ঘি। অনেকদিন বাদে এরকম খাওয়া । মা অবাক হয়ে গেছে। মায়ের চোখের নিচে কালি। বোধহয় ঘুমোতে পারছে না রাতে। মা' কে খুব বেচারা মনে হচ্ছে। একটা প্যাটার্ন অব লাইফ ফলো করে তো। সেটা এমনিতেই লকডাউনে বারোটা বেজে গেছে। তারপর দিদুনের হসপিটালাইজেশন। দেখতে পর্যন্ত যেতে পারছে না। মা খুব পার্টকুলার এসব ব্যাপারে ঠাম্মি যখন নার্সিংহোমে ছিল, তখন গুছিয়ে বাড়ির কাজ, স্কুলের কাজ সেরে, নিজে হাতে ঠাম্মির খাবার নিয়ে বিকেলে নার্সিংহোমে চলে যেত। একেবারে খাইয়ে ফিরত।
    দিদুনের বেলা এইসব কিছু করতে পারছে না। কান পেতে আছে কখন ফোন আসবে। কিছু জানতে পারবে।
    রাতের ফিল্ম।
    টুয়েন্টি এইটা ডেজ লেটার। হঠাৎ একটি সংক্রামক ভাইরাস সভ্যতাকে ধ্বংস করার জন্য সক্রিয় হয়ে
    উঠেছে। দু হাজারদুই।
    চোখ জ্বলছে। কী ধ্বংসচিত্র ।
    ডে টু। আজ দুপুরের ফিল্ম। একের পর এক ছবি।
    আই অ্যাম লেজেন্ড। উইল স্মিথ। দু হাজার সাত। আর্মি ভাইরোলজিস্ট উপশম খুঁজছেন ধ্বংসের। মানবসভ্যতা ধ্বংস হয়ে গেছে। যারা বেঁচে আছে তারা দানবপ্রায়। শুকনো, অনুর্বর শূন্য পৃথিবীতে তারাই বেঁচে আছে , যারা মানুষ নয়।
    এই পৃথিবীতে প্রকৃত মানুষ ক'জন?
    লাঞ্চ আজ রুটি সবজি দিয়ে । মা হ্যাজ সাইলেন্সড হারসেল্ফ। রান্না মায়ের প্যাশন। চুপ করে গেছে। খাচ্ছে না তেমন।
    ডে টু। রাতের ছবি।
    ব্লাইন্ডনেস। সারামাগোর অমর অনন্ত উপন্যাস অবলম্বনে ছবি। জুলিয়ান মোরে। মার্ডক রাফালো। ব্যাক্তি অসুখ প্রসারিত হচ্ছে পারিপার্শ্বিকে। হঠাৎ শহরে আসছে এক অদ্ভূত অসুখ। সবাই অন্ধ হয়ে যাচ্ছে। ডাক্তার, তাঁর সঙ্গে জড়িত এক দল লোক। সবাই। অন্ধত্ব ছড়াচ্ছে চারদিকে। সরকার চেষ্টা করছে আইন শৃঙ্খলা বজায় রাখার। কিন্তু বারবার ব্যর্থ। খাদ্যাভাব। সৈনিকদের রাগ বাড়ছে । আস্তে আস্তে তাদের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ছে অসুখ। মিলিটারি টেক ওভার। সম্পূর্ণ বিশৃঙ্খলার মধ্যে দিয়ে ধ্বংস, ধর্ষণ। একটা অসুখ একটা দেশকে কোয়ারেন্টাইন্ড করে রাখছে। অ্যাসাইলামগুলো নোংরা। কদর্য পরিবেশ। নীতিবিহীন। চেনা লাগছে খুব।
    সারামাগো অবশ্যই আশার আলো দিচ্ছেন। ডাক্তার আর তাঁর সদ্য গঠিত নতুন পরিবার, যার অনেকেই রক্ত সম্পর্কিত নয়, তাঁরা সরকারী পরিমণ্ডল থেকে পালিয়ে তৈরি করছেন এক নতুন কাঠামো। নতুন করে বাঁচা। ডাক্তার পত্নী একমাত্র,যিনি চোখে দেখতে পান। তাঁকে কেন্দ্র করে তৈরি হচ্ছে এক নতুন পরিবার।
    আজ ভোর থেকে ছবি দেখা। বাড়িতে চাপা টেনশন দিদুন ইজ ইন ভেন্টিলেশন। মা জানে না এখনো। ত্রিদিব মেয়েকে বলেছেন । মালবিকা জানলে ভয়ানক পাগলামি করবে যাবার জন্য। এখন কিছু বলা যাবে না।
    ইট ইজ অবভিয়াস দিদুন ইজ ডিটিরিওরেটিং।
    ডে থ্রি । দুপুর। দিদুন ভালো নেই। সে ডিসটার্বড। দিদুন তেল মাখাতো। ঘুম পাড়িয়ে দিত মা স্কুলে গেলে। মা কে জানানো দরকার। নইলে আচমকা শক নিতে পারবে না। শী ইজ ভেরি টেন্ডার।
    ছবিতে নিজেকে ডুবিয়ে রাখা ছাড়া কোনো রাস্তা নেই। ভুলে থাকতে হবে। ভুলে থাকতে হয়। ভুলে থাকতে হয় শাড়ির আঁচলের ঘ্রাণ। চুলের তেলের গন্ধ।
    রাত বারোটা । কুকুরগুলোও ডাকে না এখন আর।
    ক্লান্ত।
    ডুমসডে। দু হাজার আট। ভবিষ্যতের স্কটল্যান্ড কোয়ারেন্টাইন্ড। কারন একটি ক্ষুদ্র ভাইরাস। মানুষের প্রাণঘাতী ভাইরাস স্তব্ধ করে দিয়েছে জীবনযাত্রা।
    আজ সকালটা গুমোট।
    ডে ফোর। মাথা ব্যথা। চোখ জ্বালা। খুব বেশি ছবি দেখছে ও। এরকমই দেখে। এখন থামবে না । ও টের পাচ্ছে। দিদুন চলে যাচ্ছে। ভেন্টিলেশনে আছে। একা। হসপিটালে গিয়ে কারুর বসে থাকার উপায়টা পর্যন্ত নেই। বসে থাকলে কিছু হয়না। সবাই জানে। কিন্তু তবু। ঐ। শান্তি। একটু কাছে থাকা।

    কেরিয়ার্স। দু হাজার নয়। ক্রিস পাইন। এমিলি ভ্যানক্যাম্প। চার বন্ধু পালিয়ে বেড়াচ্ছেন এক ভয়ংকর ভাইরাসের হাত থেকে বাঁচবার জন্য।

    ডে ফোর । রাত। ডিনারে রুটি। ডাল। আলুভাজা।
    এত সংক্ষেপে ডিনার হয় না এ বাড়িতে । মা ইজ গ্লুমি। এখন বোধহয় আন্দাজ করছে কিছু। যে দিদুন হয়তো আর পারবে না। ফিরবে না।
    কোণের ঘরটা ফাঁকা থাকবে। বড় খাট? যেখানে ও আর দাদা জড়াজড়ি করে দিদুনের কোলে।
    দাদাকে ফোনে পাচ্ছে না। টেক্সট করছে। খুব ব্যস্ত ল্যাবে। মা নিডস দাদা।
    ওয়ার্ল্ড ওয়ার জেড। দু হাজার তেরো। ব্র্যাড পিট। ভয়ংকর প্লেগ আক্রান্ত পৃথিবী । কারন ভাইরাস। চিরাচরিত হলিউডি মেইনস্ট্রিম অবশ্য এখানে জোম্বি বা ভারতীয়দের রাক্ষস বানিয়ে ছেড়েছে। তবু শেষমেষ ভ্যাকসিন আসছে । আসছে পরিত্রাণ।

    শিট
    ভ্যাকসিন অত সহজে আসবে না। মেডিসিন ইজ বেটার দ্যান ভ্যাকসিন। ভ্যাকসিন আজ বেরোবে। কাল বলবে এতে কিডনি ফেইল করবে। হু উইল রিস্ক?

    ম্যাগি।
    দু হাজার পনেরো। আর্নল্ড শোয়ারজেনেগর। ভাইরাল প্যানডেমিক। আবারো । শেষে উজ্জ্বল উদ্ধার।
    এসব সিনেমাতে হয়। ক্লান্ত লাগছে রাত জেগে। ও বাথরুমে ঢুকে শাওয়ার খুলে দিল। সাড়ে তিনটে। ভোর বলো না রাত? দিদুন এই সময় উঠে পড়তো। কুটকুট করে এটা ওটা কাজ। পুজোর ফুল তোলা। পেছনের বাগানে একটা টগর গাছ। একটা দোপাটি। বাগান মানে একফালি মাটি। গাঁদাও।
    দিদুনের এটা ভোর। আজ ভোরে দিদুনের কী জ্ঞান আছে? না অচেতন হয়ে পড়ে আছে একা?
    দাদা। দাদা। উই ব্যাডলি নিড ইউ রে। তুই অনেক কুল। অনেক শান্ত। তোর ধৈর্য বেশি। আমার অত ধৈর্য্য নেই। মায়ের জন্য।
    ডোন্ট পুট দ্য ফোন ইন ফ্লাইট মোড।
    পিক ইট আপ।
    দিদুন চলে যাচ্ছে। মা ইজ ভেকান্ট।
    মানুষ কল্পবিজ্ঞান বানিয়েছে। ছবি বানিয়েছে। এমন ছবি যেখানে লম্বা কালো ওভারকোট পরা কোনো মানুষের পকেটে থাকে প্রাণঘাতী ভাইরাস সমন্বিত একটা ছোট্ট টিউব। তারপর পরিত্রাতাদের সঙ্গে শুরু হয় লড়াই । ছবি বানিয়েরা শুভ অশুভের চেনা ছকে ফেলে একটা দি এন্ড টেনে দিয়েছেন। সবখানে কোনো " মাই বাপ" থাকে , সেই সর্বশক্তিমান মহাপরাক্রমশালী পরিত্রাতা যিনি ভাইরাসটি ধ্বংস করে ফেলেন। আসলে জ্ঞানপাপী মানুষের মনে ভাইরাসের ভয় ঢুকে গেছে অনেক অনেকদিন আগে। পৃথিবী নিংড়ে মানুষ একা তাণ্ডব চালিয়েছে যবে থেকে, তবে থেকে তার ভয়। সে একা নয় । আরো কোনো শক্তিশালী প্রাণ আছে অথবা তার নিজের তৈরি ফ্রাঙ্কেনস্টাইন যে তাকে ধ্বংস করে , গিলে নেবে তার অস্তিত্ব ।
    মানুষ কি জানত না? জানতো। স্কাইস্ক্রেপার আর শপিংমল দেখে ভয় লাগেনি কখনো? খোদকিরি করতে করতে এমন জায়গাতে এসে পৌঁছানোর তো কথা ছিল যেখানে সবার গায়ে কীটনাশক স্প্রে করা হয়। প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে । টিকটিকি দেখে মানুষ প্লাস্টিক চাটে। ফর্সা হবার ক্রিম মাখে। প্ল্যাস্টিক সার্জারি করে পৃথিবীর ভোল পাল্টে দেয়। বর্ণবৈষম্যের পৃথিবী, ঘৃণার দুনিয়া তৈরি করে ঘরে কপাট দিয়ে ভাবে সে নিরাপদ।
    সেফ জোন।
    স্টে হোম। স্টে সেফ।
    টিকটিকি দেখল ল্যাপটপে মাথা গুঁজে ঘুমিয়ে আছে সে। মোবাইলটা বেজে চলেছে। বেজেই চলেছে।
    শুনতে পাচ্ছে না ও।



    সাদাটে একটা আলো ঘুরছিল। গোল করে ঘুরতে ঘুরতে মিলিয়ে যাচ্ছে। কোথা থেকে শুরু কোথা থেকে শেষ, কিছুই বোঝা যায় না। তীব্রতা মাঝেমাঝেই বেড়ে যাচ্ছে । আবার খুব কমে যাচ্ছে। একটা ঝিঁঝির ডাকের মত যেন। সামনে কী ঠিক বোঝা যাচ্ছে না। মাঝেমাঝে বিদ্যুতের চমক যেন। চিড়িক দিচ্ছে মাথার ভিতর। সঙ্গে সঙ্গে চোখে যন্ত্রণা । হাত পায়ে জোর নেই কোনো। পাশ ফেরার ক্ষমতাহীন। সামনে দরজাতে একটা গ্লাস পেইন্টিং। কার মুখ? ফ্রিডা কাহালো?ভানুমতী? প্রায় অবশ হাত পায়ে পিঁপড়ের চলাচল। ব্যালকনিতে গাছ আছে কিছু। একটা সবুজ আভা দেখা যায় ।
    কেউ মাথায় হাত দিল। কপালে। গালে। গলায় । ঠিক এইভাবেই তো মা দেখতো। মা দেখতো বাবুর জ্বর আছে কিনা। বাবু কষ্ট হচ্ছে বাবা? মা গোলাপি সালোয়ার কুর্তা পরে ঘরের মধ্যে যেন। অস্পষ্ট দেখা যাচ্ছে।
    গলা শুকিয়ে আছে। জল। অল্প কাশি। মাথা তুলে ধরে কে জল খাইয়ে দিল। গন্ধটা চেনা। গলায় জল পড়েছে। মুখিয়ে দিচ্ছে। একটা ফোনের শব্দ। কেটে দিল ফোনটা কেউ।
    খাবি কিছু? স্যুপ ? একটু উঠে বোস।
    হাতের মধ্যে হাত। অদিতি। ঘোর এসেছে একটা। ও আবার ঘুমিয়ে পড়লো। পরম নির্ভরতায়। । অদিতি আছে।
    আরো একদিন বাদে সে উঠে বসতে পারে। বিছানার মধ্যেই । অদিতি পেছনে বেশ কয়েকটা বালিশ কুশন দিয়ে ওকে হেলান দিয়ে বসিয়েছে। চাদর দিয়ে দিয়েছে গায়ে। একটা সুজনি টাইপের চাদর। ভোপাল থেকে অদিতিই নিয়ে এসেছিল। পিচ রঙা। সাদা ফুটি কাটা। এটা গায়ে দিলে খুব নরম, কোজি একটা ফিলিং হয়।
    অদিতি খানিকক্ষণ আগে ওর মাথা ধুয়ে দিয়েছে। গা স্পঞ্জ করে ফ্রেশ শর্টস আর টি শার্ট পরিয়েছে। কারণ এখন ওর নড়াচড়ার তেমন হুঁশ নেই। বাথরুমে অদিতি ধরে ধরে নিয়ে যায় ।
    হাল্কা একটা রোদ উঠেছে ন 'টা সাড়ে ন' টার দিকে। ভোররাতে বৃষ্টি হয়েছিল। অদিতি টোস্টারে পাঁউরুটি দিয়েছে । ঘটঘট করে হরলিক্স গুলছে গ্লাসে। তিনদিন বাদে জ্বর নেমেছে। উঠে বসতে পারছে । যদিও ভীষণ দুর্বল।
    হরলিক্স মানে শৈশবের গন্ধ ।
    - কেন ফালতু হরলিক্স গুলছিস? আমি খাবো না।
    - খেতে হবে বাবু।
    - হরলিক্সে কিছু নেই। ছাতু ইজ মাচ বেটার।
    - এই লকডাউনে হোয়ার শ্যাল আই গেট ছাতু ডার্লিং?
    - পাঁউরুটি খাবো না।
    - খাবি। দুপুরে ডিম। চুপচাপ যা দেব তাই খাবি। মারবো এক গাট্টা।
    পুনের এই অভিজাত বহুতলের প্ল্যাস্টিক পেইন্ট করা ফ্ল্যাটে বসে কোভিডের আঁচ টের পাওয়া যায় না। দুটো চড়াই বারান্দায় লাফালাফি করছে।
    - প্লিজ ঐ সিডি টা চালিয়ে দে। ঐ গানটা। একটা চড়াই আপনমনে এক্কা দোক্কা খেলছে ।
    - আগেইন! ইওর সুমন চ্যাটার্জি?
    - কবীর সুমন।
    - ওল দ্য সেইম। ইউটিউব দেব?
    - না। সিডি।
    ও স্টিরিওফোনিক সাউন্ড চাইছে এখন। গমগম করবে ঘর জুড়ে । কোভিড নাইন্টিন । সুইসাইড। মাইগ্রান্ট লেবার। আপাতত নয়। আপাতত শুশ্রূষা । কমপ্লিট হিলিং অব দ্য বডি অ্যান্ড মাইন্ড। আটমোস্ট নেসেসিটি। এখন ও নিজের আবর্ত চায়। আর পাঁচজনের মত।
    ভারবোধ কম। ভালো লাগছে ওর। নির্মাল্য সামন্ত এখন অতীত। মাত্র তিনদিনে একটা মানুষ অতীত হয়ে যেতে পারে না। কিন্তু এই তুমুল জ্বর। প্রায় অচেতন হয়ে তিনদিন একটা ঘোরের মধ্যে পড়ে থাকা। এইসবকিছু ওকে অনেকটাই। অনেকটাই ইনট্রোস্পেকটিভ করে তুলেছে। লেইড ব্যাক হয়ে দেখছে আজ। এবং অদিতির উপস্থিতি । ওর একটা ফুলফিলিং ব্যাপার আছে। সবকিছু ভরিয়ে রাখে। মায়ের মত।
    হরলিক্সে চুমুক দিয়ে দেবরূপ হেসে ফেললো। অদিতিকে এটা বলা যাবে না। সে নিজেও কী নাইন্টি পার্সেন্ট ভারতীয় পুরুষের মত প্রেমিকার মধ্যে মা' কে খুঁজছে? সিলি। ড্যাম সিলি। এবং অদিতি একটুও মালবিকার মতো ওকে ন্যাম্বি প্যাম্বি করে রাখে না। শী ইজ প্রেটি স্ট্রংগ। কখনো বেশ কঠিন। বাট নট কমপ্লেক্স। গোলাপি সাদা চেক শার্টে অদিতির বাদামি স্কিন মোলায়েম লাগছে। চিক বোন একটু উঁচু। কোঁকড়ানো চুলে কিছু একটা দিয়েছে। চকচক করছে। অদিতি লম্বা। স্ট্রংগ লিম্বড। পেটানো স্বাস্থ্য । শি হ্যাজ নো ন্যাকামি অ্যারাউন্ড হার। মালবিকা অন্যরকম। দেবরূপের সামান্য জ্বর মানে মায়ের সি এল। মা বাড়িতে।
    অদিতি কাজ থেকে ছুটি নেবে না। দেবরূপের জন্য যা যা করার করেছে সকাল থেকে। যখন জ্বরে অচেতন ছিল, ছুটি নিয়েছে। প্রয়োজনে বেরিয়েছে শুধু। এখন কাজে বেরিয়ে যাবে। ঠিক দুটোতে ঢুকে যাবে লাঞ্চ দিতে। ওকে এখন থাকতে বলে লাভ নেই। শুনবে না।
    - শোন। গাছগুলোতে জল দিয়েছিল?
    অদিতি ফ্লাস্কে গরম জল ভরতে ভরতে তাকাল।
    - ইয়েস। অ্যান্ড কোভিড টেস্ট ডান ফর ইউ। ফর মি ওলসো।
    দুর্বল শরীরে ছিলার মত টানটান হয়ে উঠে বসে।
    - অ্যান্ড?
    - অ্যান্ড হোয়াট?
    - কবে করালি টেস্ট?
    - অন দ্য ভেরি ফার্স্ট ডে। জ্বরে মেঝের ওপর পড়ে ছিলি। আমার ফোন রিং হয়ে যাচ্ছিল। আই গট গোভিন্দ অ্যালংগ উইদ মি টু গেট দ্য টেস্ট ডান।
    - পজিটিভ?
    - ইয়া। বাট নো নিড টু ওরি। তোর ব্রিদিং ট্রাবল নেই। তুই যখন ঘুমোতিস, আমি তোর মুখের দিকে তাকিয়ে থাকতাম। জ্বর ছিল। বাট ইউ স্লেপ্ট ওয়েল।
    আর শোন। তুই পজিটিভ এটা আমি কাউকে বলছি না। নিশান্ত তোকে দেখে যাচ্ছে দুবেলা। হি ইজ আ ট্রাস্টওয়ার্থি ডক। অসুবিধে বুঝলে তোকে হাসপাতালে শিফ্ট করে দেবে। আদারওয়াইজ ইউ আর ফাইন হিয়ার। জানাজানি হলে লোকে খামখা প্যানিক করবে। ঝামেলা হো যায়েগা। দ্যাট ইজ নট নিডেড। তোর হোম আইসোলেশন হয়ে যাচ্ছে।
    এক নিঃশ্বাসে কথা বলে গেল মেয়েটা।

    নিশান্ত ডাক্তার । সহ্যাদ্রি হসপিটালে রয়েছে। কাজেই নিশ্চিন্ত হওয়া যেতে পারে।

    শান্ত হয়ে গেল দেবরূপ। বারান্দায় মাথা নাড়ল এরিকা পাম। পাখিগুলো নেই।
    বুক ধক করে উঠল।
    - এই শোন। বাড়ি? মা তো রোজ দুবেলা ফোন করে তুই ফোন ধরেছিস নাকি?
    অদিতি শিবরামণ মিষ্টি হাসলো। ব্যাগ তুলছে পিঠে।
    - নো। রোজ রাত দশটা আর সকাল আটটা। আমি ফোন ধরলে ভালো হত?
    - দেন? মা ভীষণ চিন্তা করবে।
    - করবে না মায়ের খোকা। আই হ্যাভ টেক্সটেড ইওর মম। অন বিহাফ অব ইউ। বাবু হয়ে টেক্সট করেছি। " বিজি ইন সিরাম ল্যাব ফর আ ফিউ ডেজ। ফোন কল নট অ্যালাউড। ওনলি টেক্সট। লাভ। বাবু।
    পড়ে দ্যাখ। ঠিক আছে?
    - এত রিস্ক নিলি? যদি আমার কিছু হয়ে যেত? সব দোষ তোর ঘাড়ে ।
    অদিতি গভীর দৃষ্টিতে ওকে দেখল খানিকক্ষণ । এগিয়ে ঝপ করে চুমু খেল কপালে। কন্টামিনেশনের ভয় জানলা দিয়ে উড়ে গেছে।
    - ইন লাভ রিস্ক ইজ কম্পালশন। আদারওয়াইজ ইট ইজ নট লাভ। যাস্ট কম্প্রোমাইজ।
    এই মুহূর্তে ও প্রকৃত রিল্যাক্সড । কোনো যন্ত্রণা নেই। চিন্তা নেই। অদিতির স্পর্শ আছে। তবু যৌনকাতরতা নেই। একেই কী অনাবিল বলে?
    অদিতি হাত নেড়ে দরজা টেনে বেরোচ্ছে।
    - আর তোর রিপোর্ট?
    - ফর নাউ নেগেটিভ। বাট হু নোজ। কাল পজিটিভ হতেই পারে। কোভিড নাইন্টিন ইজ আনপ্রেডক্টিবল লাইক মারিয়া। বাই।
    দরজা বন্ধ হল ক্লিক শব্দ করে।
    পাঁচ সেকেন্ডে খুলে গেল আবার। শুধু মাথাটা উঁকি দিল।
    - হেই! কল ইওর মম। শী সিমস টু বি ভেরি আপসেট। প্লিজ কল হার।



    সিলিং এর দিকে তাকিয়ে বসেছিলেন অনিল। পিস্তা কালারের রঙ দেওয়ালে। সাদা সিলিং। হাল্কা করে ফ্যান ঘুরছে। অনিলের প্রিয় রঙ সাদা। তাঁর বাড়িটিতে সাদা রঙের প্রাধান্য । সাদার সঙ্গে মানানসই দু একটি রঙ । আউটহাউসে খুব শখ করে কাঠের কাজ করিয়েছেন। উডেন কালার। সাবাই ঘাসের ফ্লোর স্প্রেড। টিক উড ফার্ণিচার। একেবারে খাশ টিক। এক্সপোর্টেড ফ্রম ঘানা। কাঠের হাতিদুটি পলি খুব শখ করে তৈরি করিয়েছেন। একগাদা পুরোনো পত্রিকা। জার্নাল জমে আছে। অনিলের হাত দিয়ে ছুঁয়েও দেখতে ইচ্ছে করছে না। তাঁকে তাড়া করে বেড়ায় ভয়ঙ্কর এক দুশ্চিন্তা যা অতিমারীর চেয়েও ভয়াবহ। ক্যানসারের সম্ভাবনা অনিলকে তীব্র দুশ্চিন্তার মধ্যে ঠেলে দিয়েছে । গত রাত থেকে তাঁর মাথার মধ্যে ঘুরছে, বেঁচে থেকে কি লাভ হবে। যদি ক্যানসারই হয়, দীর্ঘদিন ভুগতে হবে। অনিল দেখতে পাচ্ছেন পলি এক ক্লিনিক থেকে অন্য ক্লিনিক, এক হসপিটাল থেকে অন্য হসপিটাল দৌড়ে বেড়াচ্ছে। রোদে ও দুশ্চিন্তায় পুড়ে গেছে ওর কোমলতা। বাচ্চাদের শুকনো মুখ। পড়াশোনা হচ্ছে না ঠিকমত। এই কোভিড সিচুয়েশনে কোথাও যাওয়ার সম্ভাবনা নেই। নাহলে অনিল মুম্বাইতে চলে যেতেন। অন্তত টেস্টগুলো করে নেওয়া যেত। নাউ ইট ইজ ইম্পসিবল। কোনোখানে এতটুকু জায়গা পাওয়া যাবে না।
    চেঙ্গালা এই সময়ে বেশ গরম। বৃষ্টি হলে আলাদা । কিন্তু অনিল ঘামছেন। সাধারণত ট্যুর থেকে ফিরে ওঁরা কোথাও একটু ঘুরে আসেন কাছাকাছি। এবার পলির ইচ্ছে ছিল মুন্নার যাবেন। অনিল একটা শ্বাস ফেললেন। কত কী ভাবা ছিল। মাতুপেতি ড্যামের কাছে পিকনিক করবেন। ছেলেমেয়েদের ঘুরিয়ে দেখাবেন ইরাভিকুলম ন্যাশনাল পার্ক। সারাদিনের প্ল্যান। হৈচৈ। এইসময়টাতেই বিদেশ থেকে ফেরেন তিনি প্রতিবার। বাড়িতে খুশির ঢেউ।
    কিচ্ছু হল না। কিচ্ছু না। হয়তো কোনোদিন হবেও না আর। ভেঙে যাচ্ছেন ভেতরে ভেতরে। দেবরূপকে বলেছিলেন। যদি নর্মাল সময় হত , দেবরূপ পুনে থেকে মুম্বাইতে চলে যেত। টাটা ক্যান্সার হসপিটালে । দেবরূপের মত কেউ সঙ্গে থাকলে অনিল অনেকটা জোর পেতেন মনে। এখন হাত পা বাঁধা। তাঁর কেবলি মনে হচ্ছে সামনে কেবল অন্ধকার। স্পর্শ নেই। রসাস্বাদন নেই। গন্ধ নেই।
    না। গন্ধ আছে। গন্ধ আছে তো। গন্ধ পাচ্ছেন অনিল।
    কিসের গন্ধ আসছে? চাঁপা ফুল? হ্যাঁ । এইসময়গুলো চাঁপার। বিয়েতে চাঁপাফুলের ক্রাউন পরেছিলেন পলি। বাদামি গায়ের রঙে কী চমৎকার মানিয়েছিল তাঁকে। ওয়েনাডে মধুচন্দ্রিমা । উত্তর কেরালার সেই বড় বড় স্ট্রাকচারগুলি। প্রাচীন। কালো পাথর । যুগ যুগান্তরের ঐতিহ্য ধরে রেখেছে। ইতিহাস গেঁথে রেখেছে একটা যুগকে। বিশাল। গম্ভীর । মীনামুত্তি জলপ্রপাতের সামনে তাঁদের যুগল ছবি। পলি হাসছেন। হাসলে পলির বাঁ গালে ঈষৎ টোল। টেনশন এবং হতাশা অনিলের যাবতীয় অনুভূতি কেড়ে নিয়েছে । তবু। তবু হঠাৎ একধরনের উত্তেজনা বোধ করলেন অনিল । অনেকদিন বাদে। জীবন থেকে বিচ্ছিন্নতা তাহলে তাঁকে একেবারে মেরে ফেলেনি!সামান্য কিছু সময়ের জন্য উল্লাস ফিরে এলো। ফিরো এলো আকাঙ্খা । তারপর আবার তলিয়ে যাওয়া । যেন খাবি খাচ্ছেন জলে।

    ক্রমশ উত্তেজনা থিতিয়ে গেলে আবার একটি অগাধ লিম্বো। ফোন বা এস এম এস বা হোয়াটস অ্যাপে যতটুকু জনসংযোগ হয় , বা মেইলের জন্য দীর্ঘ প্রতীক্ষা, তাতে আর আশ্বস্ত হতে পারছেন না অনিল। একটি ঘড়ির অবোধ টিকটিক শব্দ তাঁকে অনন্ত বিবমিষার দিকে ঠেলে,ঠেলে, ঠেলে, ঠেলে...

    মরে যাওয়াই ভাল। এই টেনশন আর সহ্য করতে পারছেন না অনিল। অনেকগুলো লাইফ ইনস্যুরেনস করা আছে। পলি সেই সমস্ত দিয়ে আর কিছু কাজকম্ম করে বাচ্চাদের মানুষ করে ফেলতে পারবে ঠিক। এইটাই অনিলের প্রধানতম কনসার্ন । যেভাবে হোক। বাচ্চারা যেন অসুবিধে বোধ না করে। কতজনের তো বাবা থাকে না। তারাও তো মানুষ হয়। মানি অ্যান্ড গাইডেন্স আর ইম্পরট্যান্ট।
    মাথা ব্যথা করছে অনিলের। গলা একেবারে শুকনো। নিউজ ফিড নিতে পারছেন না। ইতালিতে মৃত্যু মিছিল। ইংল্যান্ড । ফ্রান্স। জার্মানী। সব মদমত্ত জাতি মৃত্যুর সঙ্গে যুদ্ধে গোহারা হেরে যাচ্ছে। বিশপ কাঁদছেন গির্জার পালপিটে। ডাক্তার হাহাকার করে কাঁদছে হাসপাতালের করিডোরে। মন্ত্রী পদত্যাগ করছেন। সামলাতে পারছেন না কোভিডের তান্ডব। এত মৃত্যু । এত মৃত মুখ। কোনো প্রার্থনা নেই। মৃত্যুর কোনো শিষ্টতা নেই। কেবল শ্বাসরোধকারী এক ভাইরাস দাপিয়ে বেড়াচ্ছে । সারা পৃথিবী কাঁপছে ভয়ে। কোম্পানির কাজ গুটিয়ে এসেছে। মিডল ইস্ট পুরো ষাট ডাউন।
    অনিল তাঁর ফুসফুসের ঐ স্পটটি নিয়ে কোথায় যাবেন এখন? কোথাও কোনো ত্রাণের আশা নেই। এই মুহূর্তে মরে যাওয়া সবচেয়ে ভালো। ফ্যানের দিকে তাকিয়ে উর্ধমুখে। ওখানেই কি নিজেকে শেষ করে দেবেন অনিল? একটা শাড়ি বা শক্তপোক্ত ওড়না চাই শুধু। আর একবার ছেলেমেয়েদের কাছে পাওয়া । যাস্ট একবার। তারপর আর কিছু বাকি নেই। ওদের কপালে, গালে চুমু। সব টেনশন শেষ। অনিল মনস্থির করে ফেলেছেন। আজ রাতেই। সব শেষ হোক। স্লিপিং পিলস এখন পাওয়া সম্ভব নয়। তাহলে খুব শান্ত মৃত্যু হত। শিরা কাটতে অনিল পারবেন না । তাহলে একমাত্র উপায় টু হ্যাংগ হিমসেল্ফ।
    দুপুর গড়িয়ে যাচ্ছে টিকটিক শব্দে।
    একটা অচেনা পাখি ডাকছে কোথাও। রোদ পড়ে ক্রোটনগুলি অসম্ভব বর্ণময়। পুলের পাশে ব্যাঙটা চুপ করে বসে। ফড়িং টড়িং ধরার আশায়। অনিল কেমন ঘোরের মধ্যে ব্যাঙটার দিকে চেয়ে রইলেন।

    দূর থেকে একটা অস্পষ্ট চিৎকার। কে ডাকে।
    দোতলার প্রশস্ত ব্যালকনিতে দুটো কচি মুখ। পাপাআআআ। হাত নড়ছে চারখানা ।

    আর মাত্র কয়েকটা দিন। হোম আইসোলেশন শেষ। বাড়িতে ঢুকবেন অনিল। চকোলেট কেকের গন্ধে ভরে যাবে পলিজ নেস্ট। বাচ্চাদের আনন্দের শেষ নেই। পাপা উইল বি ব্যাক হোম অ্যাটলাস্ট। অনিল একদৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলেন। দুজোড়া চোখ চকচক করছে। কী মিষ্টি চাঁপা ফুলের গন্ধ!

    হাত নাড়ছে বাচ্চারা। দিন গুনছে। ট্রু হোমকামিং হয়নি তো। এবার হবে। কোয়ারেন্টাইন শেষ হলেই।
    মেয়ের মাথায় একটা গোলাপি হেয়ারব্যান্ড। হলুদ জামা। এখনো কত রঙ চারদিকে। কত আকাঙ্খা ।
    এইসব ছেড়ে কী এত সহজে যাওয়া যায়?
    যদি ক্যান্সার না হয়! বুকের মধ্যে দপ করে হাজার ওয়াটের বাতি জ্বলে উঠলো। কেন শুধু নেগেটিভ ভাবছেন তিনি। কত প্রশস্ত পথ তো অপেক্ষা করে থাকতে পারে! সামান্য চিকিৎসাতে সুস্থ হয়ে উঠতে পারেন তো। পারেন! দেয়ারজ ওলওয়েজ আ চান্স। মেয়ের চুলের গন্ধ ভেসে এলো মনে। প্রথম সন্তান।

    একটি পরিপূর্ণ গৃহচিত্র। লম্বা হলটির একপাশে ডাইনিং টেবলে পলি রাওয়া ধোসা নামিয়ে রাখছেন। কফি পার্কোলেটরে কফি। গন্ধ ছড়িয়ে পড়ছে। নতুন খবরের কাগজ এসে পড়েছে ব্যালকনিতে । তার ওপর রোদের আঁকিবুকি। বাচ্চারা বাড়িময় দৌড়ে বেড়াচ্ছে। এইরকম বিজ্ঞাপনের ছবি হয়। অথবা ছবির বিজ্ঞাপন । সে যাই হোক না কেন....
    টমাস অনিল আত্মহত্যার চিন্তা মুলতুবি রাখলেন।
    আপাতত।

    প্রথমদিকে কোনো ওষুধের দোকানেই মাস্ক পাওয়া যাচ্ছিল না। যা ছিল, সাপ্লাই আসছিল, সব চেঁছেপুঁছে মানুষ কিনে নিয়েছে। গ্লাভসও নেই হয়ে গেছিল। স্যানিটাইজারের আকাল। তারপর সব কোম্পানিগুলো স্যানিটাইজার বানাতে শুরু করল। ঘরে ঘরে ইউ টিউব দেখে স্যানিটাইজার । মাস্ক এসেছে দোকানে। এন নাইন্টিফাইভ। ঐ নাকি ঠিকঠাক মাস্ক। হেভি ডিমান্ড। তাই বলে হরপ্রীত কাউরের মাস্ক বানানো বন্ধ হয়নি। কাপড়ের। ডাবল লেয়ার। খুব খাটতে পারে ঐ মেয়ে । যেমন বাইরে, তেমন ঘরে। এখন আর শ্যামার বাড়ি যাবার গল্প নেই। ছোটি মালকিনকে ধরে একটা সেলাই মেশিন জোগাড় করেছে। ঐ বিশাল বাড়িতেই পড়েছিল। খাটের নিচে। অব্যবহৃত বহুকাল। সিঙ্গার সেলাই মেশিন। বড় মালকিন চালাত শুনেছে। দেখেনি কখনো। মেশিনটি এখন হরপ্রীতের । তেল টেল দিয়ে একেবারে চলনসই করে । ঘরর ঘরর করে মেশিন চলে। মাস্ক তৈরি হচ্ছে সারারাত। হরপ্রীতের ব্যবসাবুদ্ধি তুখোড় । ছোটি মালকিনের সঙ্গে থেকে থেকে অনেক কিছু শিখেছে। প্রথমে প্লেন কাপড়ের মাস্ক বানাচ্ছিল। বস্তিতে বস্তিতে সাপ্লাই। এখন ছিটের কাপড় ধরেছে। ম্যাচিং সব। ইক্কত। সম্বলপুরী। বাটিক। ছোটিমালকিনের অনেক ব্লাউজপিস পড়ে থাকে। শাড়ি আর পরে কোথায় । সেইসব অগণিত ব্লাউজপিসের অনেকটাই হরপ্রীত মাস্ক বানিয়েছে। ডিজাইনার মাস্ক। মেয়েরা পছন্দ করছে খুব। হরপ্রীত অর্ডার পাচ্ছে। শ্যামা থাকলে সুবিধা হত এখন খুব।
    দশটার মধ্যে বাড়ির কামকাজ সেরে , ছোটিমালকিনের হোমডেলিভারি নিয়ে বেরিয়ে যায় হরপ্রীত। সাইকেলে ঘোরে বাড়ি বাড়ি । নিজের ডিজাইনার মাস্ক বিক্রি করে। ডেলিভারিতে বেশির ভাগ শ্যাম্পু, হেয়ার কালার, কন্ডিশনার, সাবান, সার্ফ, বিস্কুট, ম্যাগি এইসব যায় । সিগারেটও যায় । শ্যামার ছেলেটা শান্ত। ঝামেলা নেই। ওকে ফ্যানাভাত করে খাইয়ে রেখে যায় । ফিরতে ফিরতে বেলা তিনটে। খাওয়া দাওয়া সেরে মেশিন নিয়ে বসে হরপ্রীত । ছেলেটাকেও ডেকে নেয়। আজা বেটা। এ বাবলুয়া। চল, আ যা কাম কর। বাবলু হরপ্রীতের হাতে হাতে কাজ করে। সারা সকাল সে এই বিশাল বাড়ির বাগানের আনাচে কানাচে ঘুরেছে। মায়ের জন্য তার কান্না পায় খুব। ঠাকুমার জন্যেও। বাবার ওপর রাগ হয়। বাবা এলেই মা সেন্টার থেকে চলে আসবে, এটাই ভাবে সে।
    ব্যবসায়ী মাড়োয়ারি পরিবারটি বাড়ির মধ্যেই থাকে। কচিৎ বেরোলে গাড়ি বা বাইক। অন্দরমহলের দিকে যাওয়া নিষেধ বাবলুর। সে যায়ও না। যতক্ষণ হরপ্রীতমাসি থাকে, সে খুব নিশ্চিন্তে থাকে। দুপুরবেলাটা সে একটু বই নাড়াচাড়া করে কিন্তু মন বসে না। মায়ের সঙ্গে ফোনে কথা হয়। দুবেলাই। মাসির ফোনে। তাও কান্না পায় । নিজেদের বাড়িতে যেতে ইচ্ছে করে। কবে ছেড়ে দেবে মাকে?কী যে অসুখ তাও বোঝে না। তবে হরপ্রীতের সঙ্গে মাস্ক বানাতে খুব ভালো লাগে ওর। মাসি যখন কাঁচি দিয়ে কাপড় কাটে, বাবলু টেনে ধরে। ভাঁজ করে। ফিতে কাটে। এখন তো রঙ মেলাতেও শিখে গেছে। বলে, মাসি ,খয়েরির সঙ্গে হলুদ দাও। ভালো লাগবে। বিকেলে হরপ্রীত চালভাজা মাখে। লঙ্কা । চানাচুর। শসাকুচি । আদাকুচি।
    বাবার কি মনেও পড়ে না তাকে? বাবলু ভাবে। মা ঠিক কতদূরে আছে তাও জানে না। নিজেদের বস্তি, ছোট খুপরি দুটো ঘর, পাশের পেয়ারা গাছ, কলতলা, সবকিছুর জন্যে খুব মন ছটফট করে। বালিশে মুখ গুঁজে কাঁদে। একদিন মাসি টের পেয়ে গেল।
    অন্ধকারে জেগে উঠে বসে থাকল দুজনে। বাগানের পাশে হরপ্রীতের ঘর। হরপ্রীত বলে
    - দেখ, তু ঘর ছোড়কে আয়া। ম্যায়ভি পঞ্জাবমে মেরি ঘর ছোড়কে আয়ি। ম্যায় ক্যা রো রহি হুঁ? বাচ্চা হ্যায় ক্যা আভিভি?রো মত। দেখ মুঝে। হিম্মতসে কাম লেনে কা হ্যায়। হ্যায় না বেটা?

    বাবলু কান্না থামায়। বাপ নেই। ঠাকুমা মরে গেল। মা নেই। ইস্কুল নেই। মাস্টার নেই। খেলা নেই। পাড়া নেই। বাড়ি নেই। সব লে লি করোনা। সব কুছ লে লিয়া। ফুঁপিয়ে কাঁদে আবার।
    সারাদিনের ক্লান্তি হরপ্রীতের । আর পারে না। পাশ ফিরে ঘুমিয়ে পড়ে। কী করা। কপালে রোনা আছে তো রো লে বেটা। কোই ক্যা করেগা!
    একচিলতে ঘর। বাবলু নেমে জানলার কাছে দাঁড়িয়ে থাকে। ঠাকুমা পুজো করত। মা পুজো করত। বাপ ফুল ছোঁয়াত কপালে। হরপ্রীতের ঘরে বাবাসাবের ছবি। হনুমানজির ছবি।
    বাবলু একমনে ডাকতে থাকে, মা চলে আসুক ভগবান। একবার শুধু মা চলে আসুক। আর কিছু লাগবে না পুজোর সময়ে । কেডস জুতো আর চাইবে না সে।
    হরপ্রীত কাউর বিছানার পড়ে আর ঘুমায় । আম্বালাতে শালের দোকান ছিল তাদের। কার্পেট ভাগেয়রা। পাঁচ ভাইবোনের মধ্যে সবচেয়ে ছোট। লম্বা হিলহিলে চেহারা। টাইট করে একটা বেণী বাঁধলেও চুল কোমর ছাপানো। তীক্ষ্ম নাক। দোকান থেকে শাল সাপ্লাই নিতে আসতো কলকাতার ছেলে। মানব কুমার। শ্যামলা। গাঁট্টাগোট্টা । হরপ্রীত দেখতে যতটা তীক্ষ্ম, স্বভাবে তত নয়। মানব কুমারের সঙ্গে ঘর ছাড়তে ছ' মাস সময় মোটে। মানবের বাপ মা মোটে খুশি হয়নি হরপ্রীতকে সংসারে ঢোকানোতে। আবার দুর যা 'ও করেনি। একটা ঘরে সংসার করেছিল হরপ্রীত । প্রায় দেড় বছর। মানবকুমার দুম করে অ্যাক্সিডেন্টে মরে গেল। হরপ্রীতের আর শ্বশুরঘর করা পোষায়নি। হরেকরকম কাজ জানা মেয়ে । দু চার জায়গাতে ঠোক্কর খেয়ে এই বাড়িতে কাজ জুটিয়ে নিয়েছে। জুতো সেলাই থেকে চণ্ডীপাঠ সব পারে। এরা খাটায় খুব কিন্তু পয়সা ভালো দেয়। হরপ্রীতের কাছে দু চারটে ইশকের হাতছানি আসে না তাও নয়। হরপ্রীত ঐ দিক আর মাড়ায় না। মানব কুমার মরে যেতে সে ভেবেছিল, ভাগ্যিস ছেলেপুলে হয়নি। আন্ডাবাচ্চা নিয়ে কাজকাম পাওয়া খুব মুশকিল। সাবরেওয়াল পরিবারের বিশাল বাড়ির চত্বরে একটি খুপরি ঘর, দিনভর কাজ, কিছুটা নিজস্ব সময় এবং আত্মরতি - অতিরিক্ত চাহিদা হরপ্রীত রাখে না। তাই সে বিছানায় পড়ে আর ঘুমায় ।
    বাবলুর ওপর তার একটি টান আছে। তাই বলে সে কখনোই ঐ ছেলের বিকল্প মা হয়ে উঠতে চায় না। সে প্রখর বাস্তববাদী। আবেগকে পকেটে রাখে।
    আজকে তার দিল খুশ আছে। স্যানিটাইজার বানানো ট্রেনিং শুরু হবে কাল থেকে। তিন দিনের ট্রেনিং । ছোটি মালকিন বলেছে, এখন স্যানিটাইজারের বহুত ডিমান্ড। সময়টাকে কাজে লাগানো চাই। টাইম ওয়েস্ট নহি করনা চাহিয়ে। টাইমকো আপনা বনাও। ফায়দা উঠাও। এটাই হরপ্রীতের পলিসি।
    খবর শুনেছে হরপ্রীত। এ বাড়ির বড় হলঘরে মার্বেলের মেঝেতে আলো পিছলে পড়ে। এককোণে বড় একটা টেলিভিশন হরওয়ক্ত চলতেই থাকে। বুড়ি আম্মি বসে বসে মালা জপে বড় একটা ঝুলাতে। কখনো কখনো সিরিয়াল দেখে। কখনো দেখে না।
    হরপ্রীত ফাঁক বুঝে খবরটা ঠিক শুনে নেয়। খবরে বলেছে শ্রমিক ট্রেন আসছে। তার মানে দলে দলে লেবার আসতে থাকবে এখন কলকাতাতে। শস্তার মাস্ক আর স্যানিটাইজার বানাতে পারলে আর কথা নেই। হরপ্রীতের বিজনেস চড়চড় করে উঠবে। টাকা কামানো দরকার এখন। বহোত সারি পয়সা। দু একজন হেল্পার চাই শুধু । শ্যামা বেরোক সেন্টার থেকে। বাবলু ভি কাম আ সাকতা হ্যয়। স্কুল তো বন্ধ হ্যয় আভি। বাস। ওয়াক্তকা ফায়দা উঠানা চাহিয়ে।

    ✨ বীরোত্তমা

    এবার বৃষ্টি খুব বেশি । কথায় কথায় আকাশ ভেঙে বৃষ্টি নামছে। নাগপুরে এসে ট্রাক যখন দলটাকে নামিয়ে দিল, তখন সুখনলালের পেট ব্যথা কমেছে। কিন্তু শরীর আর চলে না। মনে হয়, ট্রাক যেখানে নামালো সেখানেই শুয়ে পড়ে। এখানেও আবার ক্যামেরার ভিড়। ক্লিক। ক্লিক। দিখাও। আপনা পায়ের দিখাও। কাঁহাসে আ রহে হো। কিতনে দিন সে চলতে হো। অগুনতি প্রশ্ন।
    এখানে স্বেচ্ছাসেবির দল খুব সক্রিয় । গুঁড়ো দুধ, চিঁড়ে, গুড় , জল নিয়ে আসছে তারা।
    সুখনলালের শরীরে যদি তাগত থাকতো , তাহলে পায়ের ছবির জন্য এখন সে পয়সা চাইতো। দলের মেয়েদের হাল আরো খারাপ । বৃষ্টিতে পোশাক ভিজে গেলেও ছাড়াছাড়ির ব্যাপার নেই। সেই সালোয়ার কামিজ আর রাবারের স্যান্ডাল পায়ে। কোলে বাচ্চা। পিঠে বোঁচকা। সঙ্গে আরো দুটো তিনটে বাচ্চা হেঁটে চলেছে। দলের সবচেয়ে বয়স্ক মানুষটি নারী। আটান্ন বছর বয়স। বীরোত্তমা সুরেন্দ্রনাথ শুক্লা। সেলাইয়ের দক্ষ হাত। কাজ করতো বান্দ্রা ওয়েস্টে সুহানি মার্কেটে। শহরের
    সামান্য দূরে বসে আছে ওরা। এখন অভ্যেস হয়ে গেছে । জানা হয়ে গেছে। কখন পালাতে হবে পুলিশের লাঠির গুঁতোর ভয়ে। কখনো পুলিশের গাড়িই এগিয়ে দেবে খানিকটা। পুলিশ হো ইয়া মালিক। দুনিয়ার সব লোক সমান হবে না। মেয়েরা তাই বেশি কিছু আশাও করে না। কোলের বাচ্চাগুলো বাঁচলেই হল। সিরাম্মা রাস্তার ওপরেই বসে পড়ে বাচ্চাদের জন্য ছাতু মাখে। সুখনলালকেও দেয় একদলা। গলা শুকিয়ে কাঠে একেবারে।
    ঘনিরাম এসে পাশে বসে।
    - আগর ভাসাইসে টেরেইন পকড় লেতে তো আচ্ছা হোতা।
    - কিঁউ ভাই।
    ঘনিরাম থুতু গিলে গলা ভেজায়।
    - হামলোগ খুদ নিকল আয়ে না। ইস্টিশনমে উওহি লোগ টেরেইনমে উঠনে বনায়েঙ্গে, যিনকো সরকারনে লায়া। সরকারি ছাপ্পা জরুরি হ্যায় টেরেইনমে চড়নেকে লিয়ে।
    - হামকো নেই দেঙ্গে? কাগজের?
    ওপাশ থেকে লক্ষণ বলে ছটফট করে।
    - মুম্বাইমে সোনু সুদ সব লেবারকো আপনে খরচেসে ঘর ভেজ রহে হ্যায় ।
    সুখনলাল সোনু সুদকে হাতজোড় করে নমস্কার করে মনে মনে । দেওতা আদমি আছে। নাহলে সিনিমাস্টার আদমি নিজের পয়সা দিয়ে লেবারদের ঘরে ফেরত পাঠাবে কেউ? কোনো নেতা মন্ত্রী করেছে?
    শুধু ছাতু খেয়ে খেয়ে অম্বল হয়ে যাচ্ছে। ক্লান্তি ছাড়া শরীরে কোনো বোধ নেই। খুব আশা করে এসেছিল যে নাগপুরে টেরেইন পাবে। শান্তির নিঃশ্বাস ফেলবে। শরীরে তাগৎ কম। হাঁপ ধরছে।
    ঘনিরামের কথাতে বেকুব হয়ে গেল দলটা। বীরোত্তমা সুরেন্দ্রনাথ শুক্লা হাঁপাচ্ছে। ন্যুব্জ শরীর। বয়স অনুপাতে অনেকটাই বেশি বুড়িয়ে যাওয়া । ক্রমাগত চোখের কাজ করতে করতে চোখের আসে পাশে অজস্র বলিরেখা। সবচেয়ে কাহিল হয়েছে। হেঁটে এসেছে এতটা পথ। প্রায় না খেয়ে । পাঁজরসর্বস্ব শরীর নেতানো। রাস্তার ওপর। হঠাৎ করে এক পশলা বৃষ্টি এসে পড়ে ভিজিয়ে দিচ্ছিল সবাইকে।
    এই বৃষ্টিতে ভেজার আলাদা এক জমানা ছিল। শ্যামাকে নিয়ে কত যে ভিজেছে সুখন। একদম হিন্দি সিনিমার হিরো হিরোইন বনে যেত দুজনে। কী সাংঘাতিক জোশ তখন দিল আর দিমাগে। বাঁধনছেঁড়া উল্লাস। টিপটিপ বরসা পানি। সুখন অক্ষয়, শ্যামা রবিনা। হেড মিস্ত্রির সেদিন কাজে যেতে লেট। সেইসব গতজন্মের উথালপাথাল দিন সুখন আর মনে করে না। টেরেইন তাদের নেবে না। এই চিন্তা বজ্রাঘাতের মত নেমে এসে তাকে পক্ষাঘাতগ্রস্ত করে রেখেছে যেন।
    এখন বৃষ্টির শব্দে ভয় লাগছে। পায়ের তলা ঠান্ডা। হিমশীতল হয়ে পড়ে আছে বীরোত্তমার শরীর। বেঁকে বেঁকে যাচ্ছে। মায়ের পেটে ভ্রূণের মত হাঁটু দুটো চিবুকের দিকে উঠে যাচ্ছে আবার নেমে আসছে। ল্যাম্প পোস্টের সামনে বাঁধানো রেলিং দেওয়া তিনকোণা পার্ক। ঠিক তার সামনে হেঁচকি তুলে মরে গেল বীরোত্তমা। সুবেদার হরিনাথ শুক্লার নাতনি। ভারত চীন যুদ্ধ থেকে ফিরে হরিনাথ বড় নাতনির নাম রেখেছিল বীরোত্তমা। বাড়ি বিহার। কাঁচাপাকা চুল। পরনে নীল সালোয়ার কামিজ । আর হাঁটার প্রয়োজন নেই তার।
    বীরোত্তমা কাৎ হয়ে পড়ে আছে নাগপুর শহরে ঢোকার মুখে হাইওয়েতে। মুখ একটু হাঁ হয়ে আছে। চোখের কোণা দিয়ে গড়িয়ে পড়েছে জল। দীর্ঘদিন সেলাই করা ক্ষতবিক্ষত আঙুলগুলি শক্ত করে ধরে আছে একটা প্ল্যাস্টিক। যার মধ্যে আছে বীরোত্তমা সুরেন্দ্রনাথ শুক্লার আধার কার্ড ও ভোটার কার্ড।

    ✨ ডিপ্রেশন

    ভালো লাগার মত কিছু আর অবশিষ্ট নেই। মাঝেমাঝেই ঝপ ঝপ করে বৃষ্টি নামাতে কাপড়জামা কিছুই ছাতে দেওয়া যাচ্ছে না। বাড়ির বারান্দায় একরাশ ভিজে জামাকাপড় সবসময় ঝুলে থাকলে মালবিকার এমনিতেই মেজাজ খারাপ থাকে। খুঁতখুঁত করতে থাকেন। বাবুকে ফোনে পাওয়া যাচ্ছে না তিনদিন ধরে। সে নাকি ল্যাবে ব্যস্ত। এমনকী রাজকাজ থাকতে পারে ল্যাবে ভেবে পান না মালবিকা যে ফোন ধরা যায় না। খেতেও তো যাস ক্যান্টিনে। তখন ফোন করতে পারিস। তা না। টেক্সট। এরা কথায় কথায় টেক্সট করে। মালবিকাদের সময় টেক্স্ট মানে ছিল পড়ার বই। পাঠ্যপুস্তক। এখন ফোনে টেক্সট। ফোনে ঘড়ি। ফোনে ছবি। ফোনে ক্লাস। ফোনে অফিস। ছেলেটার সঙ্গে দিনে দুবার কথা না হলে মালবিকা হাঁপিয়ে যান। আর সে ছেলে দ্যাখো। দিব্যি আছে ল্যাপটপ আর ল্যাব নিয়ে । মা' কে টেক্সট করে চলেছে। ভালো আছি। ডোন্ট ওরি। ভীষণ ব্যস্ত। টেক কেয়ার।
    মালবিকার মা যে হসপিটালাইজভ, সেটা পর্যন্ত জানানো হয়নি। টেক্সট করতে পারতেন। কিন্তু ইচ্ছে হয়নি। মুখে বলা আলাদা। এত দূরে ছেলেটা। একা। দিদুনের সঙ্গে ভীষণ অ্যাটাচ্ড। দুম করে কিছু লিখতে ইচ্ছে করে না।
    এই যে মা'কে দেখতে যাওয়া যাচ্ছে না, এটা সবচেয়ে বড় অসুবিধে হয়ে গেছে মালবিকার। ফোনে খবর পাচ্ছেন। এ যে কী জ্বালা তা বলে বোঝানো যাবে না। তার সঙ্গে দুশ্চিন্তা । মায়ের বয়স পঁচাশি। সুগার আছে। অনেকদিন সুগার থাকার ফলে হার্ট, চোখ দুইই অ্যাফেক্টেড। বাড়িতে চুপচাপ নিজের ঘরেই থাকেন মা। একতলার বড় ঘরটিতে। সবাই ওখানে গিয়েই দেখা করে আসে। এখন মায়ের ঘরটা ফাঁকা। শেষ গেছিলেন তেসরা মার্চ। লাউ দিয়ে মুগ ডাল আর বড়ি দিয়ে মোচাঘন্ট করে নিয়ে গেছিলেন। ভাইবৌ এইসব রান্না করে না তেমন। সাদা মাটা কিছু করে দেয়। মালবিকা উইকএন্ডে যায় শৌখিন কিছু করে। মার্চের মাঝামাঝি থেকে তাও বন্ধ । কী অবস্থায় আছেন হসপিটালে কিছুই বোঝা যাচ্ছে না। মাথামুণ্ডু কিছু ঠিক থাকছে না। সকালে উঠেই একটা দমচাপা উৎকন্ঠা। ঘরটা মুছে ফেলছে ঝাঁট দিয়ে । অনেকটা সময় লাগছে। হাঁটুতে ব্যথা। কাঁধের জয়েন্টে ব্যথা। ঘুম থেকে উঠে শরীরে একটা বিশ্রী ভারবোধ থাকে। কাজ করতে করতে কমে। ঘরমোছার ফাঁকে সবজি কেনা। মাছ কেনা। সব বাড়ির ওপরেই। তাও সময় তো দিতে হয়। ত্রিদিব ও মেয়ে নিজেদের কাজে ব্যস্ত । কেউ ফিরেও দেখে না। তারপর একটা বিশ্রী ডিজিনেস থাকে। বারোটা একটার আগে কাটে না। সেটা নিয়েই সমস্ত কাজ মেকানিক্যালি করে যায় মালবিকা । তার সঙ্গে হট ফ্লাশেজ সামলানো। হঠাত্ সারা শরীর অস্থির করে ঘেমে নেয়ে একসা। এমনিতে ত্রিদিব যথেষ্ট রেসপনসিবল। মোটামুটি কেয়ারিং। কিন্তু এই মেনোপজাল ট্যানট্রামস সামলানোর ব্যাপারে মালবিকা একেবারে একা পড়ে গেছে। ভীষণ দুর্বল লাগে একেকসময়। তাহলে কী বুড়িয়ে যাবার পালা শুরু হল? স্কিন যেন পাল্টাতে শুরু করেছে!স্কুল খোলা থাকলে অনেকটা ফ্রি থাকেন। স্কুলের কলিগদের অনেকেই এই ফেজটা দিয়ে যাচ্ছেন। আশ্চর্য এই যে কারোরই বাড়ির লোকের সঙ্গে এই মেজর ক্রাইসিসটা নিয়ে কোনো কথা হয়না। যা কিছু কথা স্কুলে এসে। এইসময়গুলো সন্জনাকে খুব মিস করছে। কিছুটা জুনিয়র। কিন্তু স্পিরিটটা সাংঘাতিক । তরতরে মেয়ে । ওকে সব বলা যায় । তুড়ি মেরে প্রবলেম সল্ভড। রাখো তো মালবিকাদি। এখন মেনোপজ ইজ নট আ প্রবলেম। ইট ইজ নট ইভন দি এন্ড অব ইউথ। বিন্দাস থাকো। এনজয় ফুড। এনজয় টেনশন ফ্রি সেক্স। গো টু পার্লার । কুক। রিড। খতম।
    এমন করে বলে যে মালবিকা চার্জড হয়ে যায়। ভালো লাগে। ফোন করবেন নাকি একবার সন্জনাকে?
    টানটান হয়ে স্ট্রেচ করল মালবিকা । সন্জনা বলে। স্ট্রেচ ইওর বডি। অ্যান্ড ইওর স্পিরিটস। ইউ ফিল কুল।
    কিন্তু ফিল কুল হচ্ছে না। অস্থির লাগছে। ঘামছে দরদর করে।
    মা। একমাত্র মা কুড হ্যাভ সলভড দ্য প্রবলেম। পঁচাশিবছরের অভিজ্ঞতা । হাত পা ছেড়ে বসে পড়া যায় যার সামনে। তুমি বলো। আমি আর পারছি না মা।
    কোন বেডে কিভাবে আছে মা? কাপড় ছাড়া খুব বাতিক ছিল। ধবধবে সেই সাদা থান। দিনে তিনবার মা শাড়ি পাল্টাতেন। এখন কী হচ্ছে?
    এইসব ভাবতেই ভয়ানক গা গুলিয়ে উঠছে মালবিকার। তাঁর একতলার , দোতলার প্রতিটি ঘরের জানালার এক্সটেনশনে ছোট ছোট টবে গাছের ম্লান হয়ে আছে। বার্ড ফিডারে দানা নেই। কোনো শৌখিন রান্নাতে মন বসছে না। কোনোমতে পাঁউরুটি মাখন দিয়ে ব্রেকফাস্ট ধরে দিচ্ছেন। ত্রিদিব নিজে ডিমের কিছু বানিয়ে নেন সবার জন্য।
    কোভিডের সময় বার বার ডাক্তাররা বলছেন প্রোটিন ইজ মাস্ট। ইমিউনিটি শক্তিশালী করতে হবে ।
    লকডাউনের প্রথমদিকে কোমর বেঁধে বাড়িঘর পরিস্কার করছিল মালবিকা । এখন সব বন্ধ । কোনোমতে মাছের ঝোল ভাত নামিয়ে শুয়ে থাকছেন। অসুস্থ প্রিয়জনের কাছে থাকতে না পারার যন্ত্রণা বড় সাংঘাতিক । মালবিকা ভেতরে ভেতরে ডুকরে উঠছে। বারবার মনে হচ্ছে কেন তিনি রোজ মা' কে ফোন করতেন না! কেন একদিন বাদে একদিন! ছেলেকে তো রোজ দু'বেলা ফোন করেন!মায়ের বেলা একদিন বাদ কেন! তাহলে কী সত্যি স্নেহ নিম্নগামী? অথচ বাবু তো দিব্যি সেল্ফ সাফিশিয়েন্ট! প্রয়োজন মায়ের বেশি। ব্রত ব্রত' র বউ অবশ্য খুবই যত্নে রাখে। কিন্তু তাও। মালবিকা তো মেয়ে । সে যদি আগের দিন ফোন করত! নিশ্চয়ই মা বলতেন শরীর ম্যাজম্যাজ করছে!
    - বললে তুমি কী করতে মা? কুড ইউ স্টপ দি ইনফেকশন?
    মালবিকা অদ্ভূত শৃন্য দৃষ্টিতে মেয়ের দিকে তাকিয়ে থাকলেন। কী বলে এরা!
    - একবার দেখে আসতাম।
    - অ্যান্ড পসিবলি গেট ইনফেক্টেড। মা। প্লিজ ট্রাই টু বি সেনসিবল। ইটস লকডাউন। এখন কেউ কারু বাড়িতে যাওয়া ঠিক নয়। নট অ্যালাউড ইভন। ভাইরাস ইনফেকশন। নট ফেটাল। বাট ইনফেকশাস। ডু ইউ গেট ইট?
    মালবিকার শরীর ছেড়ে দেয়। সে এদের চিনতে পারে না। এরা কারা? কী ভাষায় কথা বলে? মা কোথায়? মা? বাবু?
    মায়ের ঘরে খাট খালি কেন? চাদর পাল্টে দেয় নি কেউ?
    ত্রিদিব কফি বানাচ্ছিলেন। মেয়ে, বাবা চোখাচোখি হল।
    এখন কী মালবিকাকে বলা ঠিক হবে? ভেনটিলেশনে আছেন , আশির ওপরে বয়স। শী ইজ সিংকিং। ব্রতর বন্ধু জানিয়েছে , ফেরার কোনো সম্ভাবনা নেই।

    ✨হু মেড প্যান্ডেমিক?

    ও চুলে শ্যাম্পু করেছে আজ। অবাধ্য রেশমসদৃশ চুল মুখে উড়ে উড়ে আসে। তাই চুলগুলোকে উঁচু করে বেঁধে রেখেছে। একটা লালচে মেরুন আভা চুলে। বারগ্যান্ডি কালার করালে যেমন হয়।
    হাইলাইট ডান দিকে। সাদা সোনালী স্ট্রিক। প্রথম যেবার হাইলাইট করে খড়গপুর থেকে বাড়িতে এসেছিল, মা ওয়জ ডিপলি ওফেন্ডেড।
    - কী বিশ্রী চুলের দশা করেছো টুপুর। আই যাস্ট ক্যান্ট ইম্যাজিন। হরিবল!"
    ফিরনির ওপর কেশর আর বাদাম ছড়াতে ছড়াতে বলেছিল মা। শী ওয়জ ওয়েরিং আ সাউথ কটন। ম্যাজেন্টা বডিতে ব্লু পাড়। কিছু কিছু দৃশ্য ছবির মত মনের মধ্যে গেঁথে থাকে। মা ওয়জ টেরিফায়েড।
    শ্যামাদি ঘর মুছছিল। সে এসে দাঁড়িয়েছিল। পিঠে ব্যাকপ্যাক। বার্মুডা আর টি। সামনে সাদা সোনালি হাইলাইট করা চুল। মা রেগে গেলে টুপুর বলে। অন্য সময় টুম্পাই। টুম্পুশ। টুম্পানি। সে মাথা ঝাঁকিয়ে এই আদুরেপনাগুলো ফেলে দেয় । এসব আদিখ্যেতার গায়ে আলকাতরা ঢেলে সে বলে "ফাক"।
    বলে। মানে বলতো।
    মা মুখ কালো করে সরে যেতো।

    মাছের ঝোলের রঙটা ফ্যাকাশে। কেমন গা গুলোচ্ছে দেখেই । মা যখন করে একটা দারুণ রঙ আসে। সে কিছুতেই পারছে না। বাবা এসে দু' বার উঁকি মেরে গেল। হি টু ডাজন'ট নো দ্য ট্রিক টু মেক ইট রেড।
    আশ্চর্য ।
    রোজ খায় তারা। কিন্তু ট্রিকটা জানে না।
    ফোনটা কাঁধ আর মাথা দিয়ে চেপে ধরে মাছগুলো উল্টে দিল।
    - তুই রান্না করছিস?
    - কেন? তোর অসুবিধে হচ্ছে?
    - না। বাট ইট সিমস ইনক্রেডিবল।
    - কেন? ফালতু বকবি না। রান্না একটা বেসিক স্কিল। সবার জানা উচিত । আমিও জানি। যাস্ট একটা প্রবলেম।
    - যেমন?
    - এই যে মাছের ঝোলটা লাল হচ্ছে না। কালার আসছে না। ফ্যাকাশে লাগছে।
    ওপাশে জাহির খ্যাঁকখ্যাঁক করে হাসলো। ইলিনা বেগমের ছেলে ছোটবেলা থেকে রন্ধনশিল্পী মায়ের সঙ্গে থেকে থেকে হ্যাজ বিকাম অ্যান এক্সপার্ট।
    - শোন । চিনি দে। চিনি দিয়ে মশলা কষলে রঙ হয়। ও তুই তো মাছ দিয়ে দিয়েছিস। তাহলে এক কাজ কর। খুঁজেপেতে দ্যাখ কাশ্মিরী মির্চ আছে কিনা। গরম জলে একচামচ গুলে দিয়ে দে। চিনতে পারবি তো?
    - শাটাপ। গো টু হেল।
    জাহির আরো ফ্যাঁচফ্যাঁচ করে হাসতে থাকে।
    ওর কাঁধে মাথায় চেপে ধরা ফোন। প্রাণপণে কাশ্মীরী মির্চ খুঁজছে ডানহাতে। গ্যাস কমিয়ে দিয়েছে।
    - হ্যাং উইদ ইওর মাছের ঝোল। শোন, অ্যাপ রেজিসেট্রশনের জন্য অনলাইন অ্যাপ্লাই করে দিয়েছি। নাও মেধা ইজ মেকিং দ্য আউটলাইন অব দ্য কোর্স। তুই ওকে হেল্প করছিস না কেন?
    - শিট। দিদুন ভেন্টিলেশনে । খুব খারাপ অবস্থা । মা একদম থম মেরে গেছে। অনেক কাজ করতে হচ্ছে।
    জাহির কয়েকদিন ফোন করতে পারেনি। রেজিস্ট্রেশন , ডাউনলোড নিয়ে ব্যস্ত ছিল।
    - ফোন করিস নি কেন? কোথায় আছেন?
    - মনে ছিল না ফোন করার কথা। এভরিথিং হ্যাজ গন টপসিটার্ভি।
    - শী ইজ এইটি আপ?
    - ইয়াপ। এক চামচ কাশ্মিরী মির্চ পড়লো ঝোলে। জলে না গুলেই। ধৈর্য্য নেই।
    - শোন। তোদের এই বালের অ্যাপ আর অনলাইন এজুকেশনে আমার কোনো ইন্টেরেস্ট নেই।
    - কেন?আর শোন। ঐ থার্ড ক্লাস ওয়েবসিরিজের নেটিঘেটিদের মত খিস্তি দিবি না তো। জঘন্য অভ্যেস।
    - তুই জানলি কী করে? দেখিস?
    - চাল টিপলে ভাত বোঝা যায় । যাকগে। কাজটা শুরু কর। মন ঠিক থাকবে।
    - আমার মন ঠিক আছে। মা বিগড়ে গেছে। কাল মাথা ঘুরে পড়ে গেছে। প্রেশার লো। অ্যানিমিক।
    - এই বয়সে ম্যাক্সিমাম মহিলার তাই হয়। ঠিক হয়ে যাবে।
    - শী ইজ ট্রমাটাইজড।
    মাছের ঝোল নামিয়ে ঢেকে রাখছে একহাতে।
    চিমনি বন্ধ করে নিজের ঘরে এল। ফ্যান ফুলস্পিড। ঘেমে জল হয়ে গেছে।
    - তোরা কতজনকে দিবি বলতো অনলাইন কোর্স? এদেশে লোক না খেয়ে মরছে। চাকরি চলে যাচ্ছে। তোমরা শালা অনলাইন কোর্স করছো।
    জাহির সিরিয়াস এবার। ফোনের ওপারেও বোঝা যায় । চুপ
    - জানিস জে ইউ রিফিউজ করেছে। নো ডিজিটাল ডিসক্রিমিনিশন। কটা ছেলেমেয়েদের কাছে অ্যান্ড্রয়েড ফোন আছে?
    - আছে। তুই ঐ বোকা বোকা বুকনিগুলো থামা। এইমুহূর্তে অনলাইন এজুকেশন ছাড়া কোনো উপায় নেই। কিছু তো হবে। কিছু কেন। অনেকটাই হবে। অ্যাটলিস্ট ইন হায়ার এজুকেশন। মানছি প্রাইমারিতে বা মাধ্যমিকে চলে না। তাছাড়া আমরা তো কোর্স করাবো। সার্টিফিকেট পাবে অ্যাট দি এন্ড। ওয়েল নোন রিসোর্স পার্সনস থাকবেন। স্টুডেন্টস উইল বি বেনেফিটেড।
    কিছু তো কাজে লাগাতে পারে।
    - এই সিচুয়েশনে? কাজে লাগবে?
    - লাগবে। এম্টায়ার মার্কেটিং স্ট্রাটেজি ইজ চেন্জিং। দে ক্যান এনগেজ দেমসেল্ভস আফটার দ্য কোর্স।
    ও একটা শ্বাস ফেলে ঘরটা দেখে। টিকটিকি এককোণে। ঘুমাচ্ছে কী? সাড়াশব্দ নেই। জানালার বাইরে ক্রোটনটা ফনফন করে বেড়ে উঠেছে।
    - ঘুমালি নাকি?
    - নাহ্। ভাবছি।
    - ভাবিস না। কাজ কর। ধর যদি এই গোটা কোভিড এপিসোডটা একটা গ্লোবাল ক্রাইসিস, ফেক হয়?
    - মানে?
    - মানে ভারতবর্ষে প্রতিবছর এমনিতেই লোক মারা যায় । নিউমোনিয়ায় পাঁচ লাখ লোক মরে। প্রতি বছর। তো কোভিড নিয়ে এত লকডাউন হ্যানাতানার কী আছে? সুইডেন লকডাউন করেনি। একুশটা দেশ করেনি। তারা কী মরে গেছে সব?
    - কী ফালতু বলছিস?
    - ফালতু না ম্যাম। পিপিই কিট বেচে কোটি কোটি টাকার ব্যবসা করলো চিন। এমনিতে ওদের গুগল নেই। ফেসবুক নেই । করোনার সব ছবিফবি লিক হল কেমন করে? ইটস কন্সপিরেসি । হতেই পারে।
    - কে তোর মাথায় ঢোকালো এই শিটগুলো?
    - আরে শালা। এমনি এমনি নীতা আম্বানি বলছে ঘরে ঘরে ভ্যাকসিন পৌঁছে দেবে? ফায়দা ছাড়া?
    তো আমরাও ঘরে ঘরে অনলাইন কোর্স পৌঁছাবো।
    - পৌঁছাস। এখন ফুটে যা।
    - রাখছি। কোর্সটা তৈরি কর। মানে আউটলাইন। অ্যাপ্রুভ করাতে সময় লাগবে ।
    - তোর কোনো কাজ নেই । না?
    ও খুব ভালো করে জানে জাহির কী পরিমানে ব্যস্ত । ওরা কয়েকজন মিলে একটা কম্যুনিটি কিচেন খুলেছে মাইগ্রান্ট লেবারদের জন্য। ভাত। ডাল। সবজি। প্যাকেটে জল। পনেরো টাকা। ভাত। ভাল। সবজি। ডিম। কুড়ি। বাজারহাট সব করতে হয়। ইব্রাহিম আঙ্কল মারা যাবার পর বাড়িতে ইলিনা আন্টি আর জাহির। একটা দশাসই অ্যালসেশিয়ান। নন্তু। তার পেছনে খাটনি আছে। বাড়ির বাজারহাট । আন্টির শরীর খুব ভালো নয়। জাহির বেশ চাপে থাকে।
    বলল। সব জেনেশুনেই বলল। এবং জাহির ফোন কট করে কাটল। হয়তো আবার রাতে করবে। বা কাল। বা পরশু।

    -ইজ ইট ফেক ইরফান? দ্য হোল প্যান্ডেমিক এপিসোড। ইজ ইট ট্রু দ্যাট ইট ইজ গ্লোবাল কন্সপিরেসি?এটা সম্ভব?
    আজ আকাশে ঘন মেঘ। বৃষ্টি নামেনি এখনো। আসবে আসবে করছে। মেঘ ডাকছে । দিদুন বলতো, যে মেঘ গর্জায় , সে মেঘ বর্ষায় না।

    ইরফান আজ একটা ঘন বেগুনি শার্ট পরেছেন। গলায় একটা স্কার্ফ । করিব করিব সিঙ্গলে যেমন চুল এলোমেলো ছিল, তেমন চুল। ইজি চেয়ারে ক্যাজুয়াল বসে।
    - দেখো বিজনেস তো বনানা হ্যায়। লকডাউনের আগেই রিলায়েন্স, মিষ্টি কার্লোর হাতে এন নাইন্টিফাইভ মাস্ক বানানোর অটোম্যাটিক মেশিন এসে গেলো। ইয়ে তো শোচনে কা বাত হ্যায়। ক্যা?
    - ইউ আর সাউন্ডিং লাইক জাহির।
    - জাহির কওন?
    - মাই ফ্রেইন্ড।
    - বয়ফ্রেইন্ড?
    - নো। যাস্ট ফ্রেইন্ড। বেস্ট ফ্রেইন্ড।
    ইরফানের দীর্ঘ স্লিম শরীর চেয়ারে শয়ান। মাথা হাতের পেছনে।
    - ইয়ে ভাইরাস মিউটেট করতা হ্যায়। তো আদমি ক্যা করে? বোলো?
    ও হেসে ফেলেছে ।
    - মিউটেট করে?
    - এক্জাক্টলি । আদমি কো ভি মিউটেট করনা পড়েগা। যো জিতা হ্যায় ওহি সিকান্দর। ভাইরাস কো বোলো, তুমভি চলো। হামভি চলো।
    এরপর আকাশে দুন্দুভি বেজে ওঠে। পুষ্পবৃষ্টি হয় না। কিন্তু অশ্রুত গান বাজে।
    নিষ্প্রাণ বাড়িতে একঘরে আচ্ছন্ন হয়ে পড়ে থাকা মালবিকা। আরেকঘরে মার্কেটিং স্ট্র্যাটেজি নিয়ে উপুর ত্রিদিব।
    কিন্তু ছাতে অনন্ত রঙ্গশালা। বিদ্যুত জমকালো । চমকালে দেখা যায় আপনমনে নেচে যাচ্ছে উড়ো খুড়ো চুল বাঁধা মেয়ে । আর ইরফান। তুমভি চলো। হামভি চলে। আকাশ থেকে কী দু এক ফোঁটা বর্ষণ হল?
    মাধবীলতার ফাঁক দিয়ে দেখলো এক বিমর্ষ টিকটিকি। তার কী ঈর্ষা হল ?

    রিকভারি ডেজ
    সুস্থ অবস্থায় ঘরবন্দি থাকা আর অসুস্থ শরীরে ঘরবন্দি থাকার মধ্যে আসমান জমিন ফারাক। দেবরূপ অসম্ভব দুর্বল। পেট ঠিক হয়নি পুরোপুরি। জ্বরটা গেছে।
    বিছানায় হেলান দিয়ে বসে আছে একগাদা বালিশের ওপর। অদিতি ল্যাপটপ , বইপত্র, পেন, পেন্সিল, নোটবুক বিছানাতেই, ওর হাতের কাছে দিয়ে গেছে। মাথার কাছে ছোট টেবিলে একটা চেক টেবল ক্লথ। এটা অদিতির কাজ। সে কখনো কিছু পাতেনিতো টেবলে। মভ চেকস অন হোয়াইট। ফ্লাস্কে গরম জল। ক্যাসারোলে উপমা টাইপের কিছু একটা বানিয়ে রেখে গেছে। পেঁয়াজ, কারিপাতা, চীনে বাদাম কুচি দেখা যাচ্ছে। ও এক চামচ মুখে তুলে আবার ঢেকে রেখে দিল। কোনো স্বাদ নেই মুখে এখনো। কোভিড নাইন্টিনের অন্যতম প্রধান লক্ষণ। স্বাদ ও গন্ধবোধ চলে যাবে।
    নিশান্ত ঠাকরে সকালে এসে আগাপাশতলা পরীক্ষা করে গেছে। ইট ওয়জ আ মাইল্ড অ্যাটাক অব কোভিড। জ্বরটা এসেছিল মেইনলি শক থেকে। টেরিবল শক। নাউ দ্যাট ইজ ওভার, নাথিং টু ওরি। লাংস আর ওকে। ভয়ের কিছু নেই। যাস্ট টাইম ইজ নিডেড টু হিল।
    ও নিঃশ্বাস ফেলে একটু বেশি হেলান দিল। গায়ে হাত পায়ে ব্যথা আছে। তবে সহনীয় ।
    বাড়িতে একটা ফোন করা খুব দরকার। অদিতি হ্যাজ ডান আ গ্রেট জব। মা' কে বেশ বুদ্ধি করে সামলে নিয়েছে। বাবুর নামে টেক্সট করেছে। বলেছে ল্যাবে খুব ব্যস্ত। তারপর ফোন ফ্লাইট মোডে রেখে দিয়েছে। নাথিং কুড বি ওয়াইজার দ্যান দিস।
    কিন্তু এখন যোগাযোগ করলে মা টের পেয়ে যাবে। মায়েরা টের পায়। মা ঠিক বুঝে যেত বাবুর কখন খিদে পাচ্ছে। কখন বাবুর কপাল ব্যথা করছে।
    অদিতি শুনে খুব হেসেছিল।
    গশ! ইওর মম ফিলস ওয়েন ইউ আর হাংগ্রি!
    এখন কথা বললে মা গলার স্বরে দুর্বলতা ধরে ফেলবেই। এ বেলা থাক। ও বেলা একটু ভালো লাগলে দেখা যাবে।
    ফোন ফ্লাইট মোডে যায় ।
    এই ঘরটির মধ্যে একটা মায়া আছে। পূবদিকে লম্বাটে ব্যালকনি ওর বিছানায় শুয়ে দেখা যায় । বিছানার পায়ের দিকে একটা লম্বা বেতের সোফা। অদিতি বেশকিছু লাল হলুদ কুশন টুশন ফেলে রেখে ওটাকে রঙচঙে বানিয়েছে। স্টাডি টেবলটা দেওয়াল ঘেসে। একটা হলদেটে টেবল ক্লথ । বড় একটা ক্লক।
    ও মাথার পেছনে হাত রেখে মাথা ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে নিজের ঘরটি দেখছিল অনাবাসীর মত।
    অদিতি গুছিয়ে রেখেছে স্টাডি টেবলটা। দেখেই বোঝা যাচ্ছে। বইপত্র সাজিয়ে রাখা। ডেস্কটপটার ওপর ধুলো অদৃশ্য।
    জ্বরের ঘোরে ও কিচেন টেবলটা দেখতে পেত। মিক্সিতে কিছু শব্দ টের পেতো। প্রেশার কুকারের হুইসিল। লাল একটা কনটেইনার। ওপেন কিচেনে যেহেতু , সমস্ত নড়াচড়া ও নিস্তব্ধতা অচেতনে অধীত। শুধু কোনো গন্ধ বোধ নেই। খিদে নেই। অথচ খাওয়া দরকার। দুর্বলতা কাটবে না আদারওয়াইজ । কী একটা উপমা টাইপের বানিয়ে রেখে গেছে। বিরক্ত লাগছে। মুখে কোনো স্বাদ নেই। কিছু টক বা ঝাল চাই। কাটলেট খেতে ইচ্ছে করছে।
    দুপুর। এখন ফোনে ফ্লাইট মোড তুলে দেওয়া যায় । মা এ সময় ব্যস্ত থাকে। ফোন করবে না।
    ফ্লাইট মোড তোলার এক মিনিটের মধ্যে ফোন। মকরন্দ যোশি। ভীষণ চিন্তিত গলা।
    - হাউ আর ইউ? এভরিথিং ওকে?
    - অ্যাবসলিউটলি।
    - কুডন'ট গেট ইউ ফর লাস্ট ফিউ ডেজ।
    - ইয়া। যাস্ট স্লেপ্ট।
    - টু হেল উইদ লকডাউন । ইটস কন্সপিরেসি।
    এটা মকরন্দের থিওরি। গোটা প্যান্ডেমিকটা নাকী একটা কন্সপিরেসি।
    এখন তর্ক করার মত জোর নেই শরীরে। ও শুনতে লাগল। ইভন তাতেও ক্লান্তি। মকরন্দ বকে চলেছে।
    -ইউ নো। ঐ যে লোকটা। হংকং এর ফিজিশিয়ান কওক ইওন উওভেন। ও তো গেছিল হুয়ানন ওয়াইল্ড লাইফ মার্কেটে। কোনো এভিডেন্স পায়নি। জানো? আর এক হোস্ট তো চাহিয়ে আইডেন্টিফাই করনেকে লিয়ে। কৌন সা হোস্ট ভাইরাস দে রহা হ্যায় হিউমান বডিমে। বাট নো। মার্কেট ওয়জ ফাউন্ড ক্লোজড।
    টেল মি। কন্সপিরেসি না হলে এটা কেন হবে?অ্যান্ড হোয়াটস দ্য ইউজ অব দিস ব্লাডি লকডাউন?
    - ডোন্নো।
    ওর ক্লান্ত লাগছে। কথা আসছে না। ভেতর থেকে টানছে কিছু। কাশি । অদিতি বালিশের তলায় একটা ছোট কৌটোতে লবঙ্গ, এলাচ। আস
    রেখে গেছে। কী মেটিকুলাস এই মেয়ে।
    ও আদা কুচি মুখে দিল। রোদ পড়ে কিচেনটেবলটা দারুণ দেখাচ্ছে। কমলা রঙের পট। কালো গ্লাসআভেন। তার কোভিড নাইন্টিন পজিটিভ ?পিপল আর ডাইং নট বিকজ অব দ্য ভাইরাস, বাট বিকজ অব পভার্টি।
    কিছু মনে থাকছে না।
    মকরন্দ বকে যাচ্ছে।
    - ডি ওয়েনলিয়াঙগ হ্যাড সেইড। প্রেডিকটেড। ও চিইনিজ মেডিকোকে সতর্ক করার চেষ্টা করেছিল তো। নাইন্টিনের ডিসেম্বরের এন্ডে ও সাবধান করেছিল। নোবডি লিসনড টু হিম।
    - সো?
    - ক্যান্ট ইউ সি দ্য এম্টায়ার পিকচার? ইট ওয়জ কনট্র্ইভড।
    প্রফেসর যোশী মারা যাবার পর মকরন্দ খুব টেন্সড হয়ে আছে। কথা বলছে বেশি।
    - ছেড়ে দে। আসল হচ্ছে ইন্ডিয়া শুভ হ্যাভ স্টপড ইন্টারন্যাশনাল ফ্লাইটস ইন মার্চ। সেটা তো করল না। ঝাঁকে ঝাঁকে লোক শরীরে ভাইরাস নিয়ে চলে এলো। নাউ দ্য পুওর উইল ডাই।
    ঘুমে শরীর জড়িয়ে আসছে । ও ফোন রাখার আগে ফোনটা বিছানায় পড়ে গেল। স্লিপ করে নেমে ঘুমাচ্ছ।
    ফোন বাজছে আবার। চোখ খুলতে কষ্ট। কানে নিল। একটা তীব্র মিষ্টি গলা। কিন্তু প্রচন্ড টেন্সড। ভীত। টেরিফায়েড।

    মাঝেমাঝে ঝড় আসবে জানা থাকে। নেওয়া থাকে সমস্তরকম সতর্কতা। দরজা জানালা বন্ধ থাকে। ছাত থেকে উঠিয়ে নিয়ে আসা হয় আধশুকনো কাপড়। রাস্তায় লোকজন থাকে না। ছোট দোকানপাট ঝাঁপ ফেলে দেয়।
    তবু। ঝড় যখন আসে , তার নিজের মত করেই আসে।
    বন্ধ জানালা টেনে খুলে দেয়।

    - দাদা। দাদা। মা তোকে ফোনে পাচ্ছে না। শী ইজ ভেরি আপসেট। টেন্সড।
    - দাদা। কথা বলছিস না কেন? শোন। দাদা। দিদুন হ্যাজ এক্সপায়ার্ড। শুনতে পাচ্ছিস? দিদুন নেই।
    তোকে ফোনে কেউ পাচ্ছিল না।
    আজ ভোরে। তুই কথা বলছিস না কেন? দাদা?



    ওয়ার্ক ফ্রম হোম ইজ ওভারওয়ার্ক অ্যাকচুয়ালি। সকাল। দুপুর। রাত। যেকোনো সময় মিটিং বসছে। অ্যাকাউন্টস। মার্কেটিং । ম্যানেজমেন্ট । সকাল। দুপুর । রাত। অন্তহীন মিট টু প্রোমোট কনসিউমারিজম। ক্লান্ত হয়ে যাচ্ছেন ত্রিদিব । নতুন কাস্টমার মানে ফ্রি ট্রায়াল। কিন্তু ফ্রি ট্রায়াল দিলেই যে পেইড কাস্টমার পাওয়া যাবে তা নয়। তা সত্ত্বেও কোম্পানির মার্কেটিং ম্যানেজমেন্ট জোর দেয় ফ্রি ট্রায়ালের ওপর। যত বেশি ফ্রি ট্রায়াল তত বেশি পেইড কাস্টমার পাবার সম্ভাবনা । যতীন বাজাজের সঙ্গে একটি জয়েন্ট মিটিং ডেকেছেন আজ ত্রিদিব গুগলে। রেকর্ড করে রাখা হবে। সব ট্রেইনিদের ডাকা হয়েছে। ম্যানেজমেন্ট থাকবে।
    অথচ তাঁর মাথা ধরে আছে। বেশ ভার বোধ শরীরে। সুগার কী বেড়ে গেলো! গত কয়েকদিন বড় মানসিক ধকল গেছে। শাশুড়ি মা হাসপাতালে ছিলেন যখন তখন থেকেই মালবিকা কেমন অচল হয়ে গেলেন। প্রথমদিকে তাও কোনোমতে সংসার চলে যাচ্ছিল। কিন্তু মায়ের মৃত্যুর পর মালবিকা একেবারে বিছানাতে। কেমন যেন হতভম্ব ভাব। এত প্রাণবন্ত । এত গুছিয়ে সংসার করতে ভালোবাসা মেয়ে যখন দিনের পর দিন বিছানায় পড়ে থাকে, তখন মৃত্যুর অভিঘাত ঠিকঠাক বোঝা যায়। পঁচাশি বছর হয়েছিল মায়ের। চলে গেছেন, সেটা বড় কথা নয়। ছেলে, ছেলের বউ। মেয়ে, জামাই। দু ওরফে নাতি নাতনি। যে শুনেছে সেই বলেছে, সব দেখেশুনেই গেছেন। তাও। এইসব কথার কোনো মানে খুঁজে পাওয়া যায় না।
    মানুষটাকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া মাত্র কোভিড ওয়ার্ডে অ্যাডমিট করা হল। তারপর আর তার সঙ্গে দেখা নেই। ফোনে যেটুকু খবর পাওয়া । অসুস্থ প্রিয়জনের জন্য হাসপাতাল, নার্সিং হোমের বাইরেও দাঁড়িয়ে থাকে মানুষ। অপেক্ষা করতে করতে দু কাপ চা খায়। একটু হেঁটে আসে। ডাব কিনতে দৌড়ায়। বাড়ির লোক ঘড়ির দিকে তাকিয়ে থাকে। কখন ভিজিটিং আওয়ার হবে।
    কিছু না। কিছু না। কিছু নেই।
    সব ফাঁকা। শূন্য । সব তো জানা ছিল। দিনের পর দিন টিভিতে দেখেছেন । মৃতদেহ টেনে নিয়ে পুঁতে দেওয়া হচ্ছে। একের পর এক কোভিড ভিক্টিম। কোনো বডি হ্যান্ড ওভার হবে না। তবু। তবু মালবিকা যেন ভাবতে পারছেন না । মায়ের মুখ আর দেখা যাবে না। মৃত জননীর হাত স্পর্শ করে উত্তাপ নেবার বৃথা চেষ্টাও করা যাবে না। মালবিকা বারবার মেডিক্যাল পার্সোনেলদের বলেছেন। একবার। প্লিজ একবার। একবার।
    তাঁর বিশ্বাস ছিল ব্রতর বন্ধু যখন , তখন একবার দেখা যাবে।
    কোনো ফল হয়নি। কর্তৃপক্ষ নিয়ম মেনে চলেছেন। তাঁদের উপায় নেই।
    মালবিকা চুপ। আর একটিও কথা বলেননি তারপর স্নান করেছেন অনেকক্ষণ ধরে। শেষে ত্রিদিব গিয়ে দরজায় নক করেছেন।
    জলের ধারার মত মা যেন ঝরে পড়ছেন। তৃষ্নার শান্তি। সুন্দরকান্তি। মুখে। গলায় । বুকে। নাভিতে। জননীগর্ভের উষ্ণতায় যেন ফিরে যেতে চাইছেন মালবিকা। স্নান করে একটা সাধারণ নরম তাঁতের শাড়ি পরেছেন। হাল্কা সবুজ। মাথা গুঁজে হাঁটুর কাছে। খাটের এককোণাতে। কেউ যেন না ডাকে। কেউ না। সেই তো সপ্তাহান্তে দেখা হত। বড় খাটের মাঝে বসে। এক মাথা সাদা চুল। কত সময় কত বিরক্তি। ওরা আসে না কাছে। কারু সময় নেই।
    মালবিকা একটুও কাঁদছেন না। কেবল তলিয়ে যাচ্ছেন।
    টুপুর অনেকটা এগিয়ে এসেছে। ব্রেকফাস্ট, লাঞ্চ করে নিচ্ছে । রাতের জন্য বিশ্বস্ত হোম ডেলিভারি বলা আছে একটা।
    শীতের রাতে বিস্তীর্ণ ফাঁকা নদীর চরের মত দৃষ্টি। মালবিকা দেখছেন। মা পুড়ে যাচ্ছে। একা একা।

    যতীন বাজাজ বলছেন এটি একটা ব্ল্যাক সোওয়ান ইভেন্ট। ছোট ব্যবসা থেকে বড় ব্যবসা। সব মার খাচ্ছে। সমস্ত সাপ্লাই চেইন ডিসরাপ্টেড। ত্রিদিব টের পাচ্ছেন । তাঁর গৃহের সাপ্লাই চেইন ভেঙে গেছে। আতঙ্ক ঢুকছে দরজার ফাঁক দিয়ে । ভেন্টিলেটর দিয়ে । বাথরুমের জানালা দিয়ে ।
    ত্রিদিব মার্কেটিং ট্রেইনিদের বোঝাচ্ছেন। হেল্থ অ্যান্ড সেফটি ফার্স্ট। কনসিউমারের ক্রয় অভ্যেসকে বুঝতে হবে। তাতে একটা শিফ্ট এসেছে। অনলাইন শপিং ইজ ইন। আগে যারা অনলাইন শপিং করতেন না, তারাও এখন সেটা করছেন।
    জ্যাম বোর্ড । ত্রিদিব লিখছেন। নির্ভুল ডিটেইলস।

    মালবিকা উঠে বাথরুমে যাচ্ছেন । এখন বেডরুমেই কাজ নিয়ে বসেন ত্রিদিব । কফি দরকার।
    ট্রেইনিরা অপেক্ষা করছে ।
    এক। প্রায়োরিটাইজ ব্র্যান্ড বিল্ডিং।
    দুই। কম্যুনিকেট রাইট।
    তিন। প্ল্যান ফর এফ ওয়াই টোয়েন্টি ওয়ান।
    ফোর। স্ট্র্যাটেজাইজ ফর লং টার্ম।
    এবার যতিন এক্সপ্লেইন করবেন।
    ত্রিদিব কফি করতে উঠে গেলেন। মালবিকা বাথরুম থেকে বেরিয়ে আবার বিছানাতেই ।
    - চাপ পড়সে তর ওপর। তাই নারে?
    - কী যে বলো ঠাকুমা। এ তো হবারই ছিল। কখনো না কখনো। কোনো না কোনো দিন।
    - থাম। এরপর তুই কী কবি জানা আসে। কেউ তো আর চিরকাল বাঁইচ্যা থাকে না! যত্তসব আবুদ্দেরে কথা।
    - তুমি কী বলো?
    - বউডার লগে দুডা কথা কও মানিক। শুধু যে ঐ কালা বাক্স লইয়া পইরা থাহো, উয়াতে কী হয়?
    - ওটা ল্যাপটপ ঠাকুমা। চাকরি বাঁচাচ্ছি।
    - সে বাঁচাও। বউ বেটির লগে দুডা কথা কও। শুধু ট্যাহা আইনা ফ্যালাইয়া দিবা তো উয়ারাও তোমারে ফ্যালাইয়া দিবে।
    - তাই?
    - হ। বোজো না ক্যান। শ্যাষ সময়ে মাইনসে মা বাপের মাতায় হাত বুলায়।
    তাতেও শান্তি লাগে। জল ধইরা দ্যায়। গড়াইয়া পইরা গেলেও যাক। মরা মাইনসের শরীরডারে স্নান করায়। কাপড় পরায়ে সাজায়। ঐ সকলে মনে এটডু জল ঢালে। হে তো কিসুই করবার পারলো না। তারপর তুমি এক বাক্সে মুখ গুঁইজা থাহো। তোমার বেটি আরেক বাক্সে মুখ গুঁইজা থাহে। ঐ বাক্সই যদি হকল হয় তো সংসার করলা ক্যান? উয়ারে লইয়াই থাকতা।
    - বাপরে। কী অবজারভেশন তোমার ঠাকমা!
    - তাই না ছাই। বউডা রান্ধে ভালো। কত সোন্দর ফোড়নের গন্ধ ছড়াইত বাড়িময়। সর্ষা ফোড়ন। কালা জিরা কাঁচালঙ্কা ফোড়ন। মনডা ভালো হইতো। আরে মরসি তো আমিও। কিন্তু সাইজা গুইজা মরসি। ওয়ার মায়ের তো কিসুই হইল না। তিন দিনে কী যে কাজ করলা। লোক নাই। জন নাই। বউডা ডাল সম্বরা বড় ভালো দিত। উয়ারে ঠিক করো। বেশিদিন ঐরম পইর্যা গুমড়ানো ভালো না। অব্যাস হইয়া যাইবো।
    ঠাকমা ময়দার কৌটোর পেছনে মিলিয়ে গেলেন।
    কফি নিয়ে ল্যাপটপের সামনে ত্রিদিব। মালবিকা ওষুধ খেয়ে গভীর ঘুমে।
    যতীন বাজাজ বলছেন,
    -ইট টেকস টোয়েন্টিওয়ান ডেজ টু ক্রিয়েট আ হ্যাবিট, অ্যান্ড নাইন্টি ডেজ টু ক্রিয়েট আ লাইফস্টাইল।
    জানা কথা।
    শিউরে উঠে মালবিকার দিকে তাকালেন ত্রিদিব।
    ওকে জাগাতে হবে। অভ্যেস হবার আগেই।

    ✨ সুখি

    সুখিরাণীর বিশটা সেলাই পড়েছিল। হাঁটতে এখনো অসুবিধে হয়। পা ছেতরে ছেতরে কোনোমতে বাথরুমে যায় । বাদবাকি সময় বসে থাকে বেডে। নয় শুয়ে থাকে মায়ের পেটে ভ্রূণের মত গুটিয়ে। দেখে মনে ঠিক পূর্ণাঙ্গ মানুষ না। একটা বড়সড় ভ্রূণ পড়ে আছে বেডে। যার তেমন সাড়া শব্দ নেই। কোনোমতে এলিয়ে পড়ে থাকাটুকু আছে। কপালে কাটা দাগ দেখা যায় ভালো করে লক্ষ্য করলে। চুলে জট পড়েছে কঠিন। চিরুণী চলে না । আয়াদিদি একদিন সুখির চুল আঁচড়ানোর চেষ্টা করেছিল। পারলো না। কাঁচি এনে ঘচঘচ করে কেটে দিল চুল তারপর। একেবারে ঘাড় বরাবর নেই করে দিল খাপচা খাপচা করে। কিচ্ছু বলল না সুখি। ঘাড় কাৎ করে বসে থাকল এক আশ্চর্য ফ্যালফেলে দৃষ্টি নিয়ে । ঐ আধখাপচা চুল ঘাড়ের অনেকটা অনাবৃত ঘাড়ের কাছে পড়ে থাকল। দিগন্ত বিস্তৃত শস্যক্ষেত্রে একফালি রোদ যেন।
    এখন আদিগন্ত শস্য ক্ষেত্র রৌদ্র ভারাতুর হয়ে পড়ে আছে। ট্র্যাজেডির কোনো চিহ্ন নেই। ধানগাছের শেষ শীর্ষবিন্দুটি যতদূর দেখা যায় ততদূর একটি বিষন্ন শ্যামলিমা রোদের সঙ্গে কাটাকুটি খেলে যায় কে বলবে কয়েকদিন আগে এখানে সুখিকে চারটে লোক মুখ বেঁধে নিয়ে এসেছিল? সুখি তো দলের সঙ্গেই ছিল। কাকি ঘুমাচ্ছিল কয়েকহাত ধরে। চিৎকার করার আগেই মুখে কাপড় ঠুসে দিয়েছিল। কারু মুখ দেখেনি সুখি। চেনা তো দূরের কথা। মারাত্মক দ্রুততায় ওকে টেনে নিয়ে ফেলেছিল ধানক্ষেতে। সুখিরাণীর বোধগম্যতার বাইরে এই আক্রমণ । যেহেতু ওর বুদ্ধি কম, অনেক দাদা কাকারাই ওকে নিয়ে টানাটানি করে, সুখি দাঁত মুখ খিঁচিয়ে সেইসব অবাঞ্ছিত স্পর্শ থেকে নিজেকে বাঁচাতে অভ্যস্ত হয়ে গেছে। কিন্তু ভোররাতে, যখন দলটির সবাই সারাদিন হাঁটবার পর গভীরতম ঘুমে আচ্ছন্ন , সুখি কোনোরকম অতর্কিত আক্রমণের জন্য তৈরি ছিল না। করোনার কালে সকলের মুখ বাঁধা। মাস্ক না গামছা? পুলিশ জিজ্ঞেস করেছিল। সুখিরাণী জানে না। ভোররাতে ঘুমিয়েছিল ভরা ছিল তার চোখ। ঠিকঠাক কিছু বোঝার আগেই তার আধা ঘুমন্ত শরীর হিংস্রভাবে নিস্পেষিত হতে থাকে। মাথাটা খুব জোরে কেউ ঠুকে দিয়েছিল মাটিতে। শক্ত মাটি। মাথা ফেটেছিল অনেকখানি। সুখি জ্ঞান হারাতে হারাতে বুঝেছিল যে তার শরীরের পোশাক ছিঁড়ে যাচ্ছে। যেটুকু সময় জ্ঞান ছিল , সুখি হাতড়ে হাতড়ে তার জামাটা খুঁজছিল। সেটা পরে তাকে আবার উঠে দাঁড়াতে হবে তো। যেহেতু তার শরীরের বাড়বৃদ্ধি বয়সের তুলনায় অধিক, তার মা তাকে লম্বা ঢিলা ফ্রক পরিয়ে রাখতো। বলে রাখত, ফ্রক ঠিকসে পহনা। ইধার উধার মাত হোনে দে না ইকদম। সেই ফ্রক কোথায়? এরপর তার হাত প্রবলভাবে মুচড়ে দেওয়া হয়। শরীরে হিংস্রতম অনুপ্রবেশের কালে সুখির কোনো জ্ঞান ছিল না।
    পুলিশ বারবার প্রশ্ন করেছে- মাস্ক ইয়া কাপড়া? সুখি বলতে পারেনি। সে তো একবার ক্ষীণভাবে গুঙিয়েছিল। করোনা হ্যায় । ছোড় দো। বলেছিল মুখে কাপড় দেওয়া অবস্থাতেই। লোকগুলি কিছুই বলেনি। খুব তাড়া ছিল ওদের। কষিয়ে চড় মেরেছিল সুখির গালে। দুটো দাঁত ভেঙে গেছে । ডাক্তার দিদি আঁতকে উঠেছিল তাকে দেখে। তাও সুখির কইমাছের জান। মরেনি। স্যালাইন চলেছে চারদিন। তারপরেও টেনে হিঁচড়ে বেঁচে উঠেছে।

    শ্যামা দেখে মেয়েটার চোখের নিচে গভীর কালি। এত অল্প বয়সে এত গভীর কালি দেখে শ্যামা ভাবে, এ ছুঁড়িটা তার চেয়েও অনেক বেশি দুখিয়ারী শ্যামার নিজের ক্ষতে প্রলেপ পরে। অতসী- মা বসে মালা জপছে। নাম জপ শেষ হলে চোখ খুলে বড় একটা হাই তুললো। মাস্কের তলা দিয়ে মুখব্যাদান বোঝা যায় । ওঠা নামা। প্রসারণ সংকোচ কিছুটা পরিস্কার।
    দিন যায় না যায় না করেও চলেই যায় । অতসী-মা ছাড়া পেয়ে যাবে। শ্যামা আশ্চর্য হয়ে যায় । একবারও বাড়ির কথা বলে না অতসী-মা। ছেলের কথা বলে না। কোনো দুঃখের আঁচ টের পায় না শ্যামা। মায়ের ভক্তেরা ফোন করে। কথাতে বোঝা যায় অতসী মায়ের ফেরার অপেক্ষায় আছে তারা। আশ্রম বন্ধ । তবু দু চারজন ভক্ত মাস্ক পরে চলেই যায় গুরু দর্শন করতে। মায়ের মুখ বেশ প্রসন্ন। রিপোর্ট নেগেটিভ এসেছে। স্নান সেরে এসে অতসী- মা বেশ করে ঘাড়ে গলায় পাউডার দেয়। গন্ধটা সুন্দর। অতসী- মা সেন্টারে আসার আগে তেল, সাবান, পাউডার সব গুছিয়ে নিয়ে এসেছে। শৌখিন মানুষ। সেন্টারে এসেও তার মুখে বেশ প্রসন্নতা। ফিরে তার একটি নিশ্চিন্ত জায়গা আছে। সেখানে কেউ তাকে মারবে পিটবে না। গালমন্দ করবে না। খাওয়া পরার চিন্তাও নেই।
    শ্যামা নিজের খড়ি ওঠা পা দেখে। তেলের ছোঁয়া নেই কতদিন। ছাড়া পাবার সময় হয়ে এলো। কী যে করবে শ্যামা নিজেও জানে না। বউদি আর হরপ্রীত ভরসা। এক ছেলেটার মুখ আবার দেখতে পাবে বলে মনটা ঠিকঠাক থাকে শ্যামার। সে নাকি হরপ্রীতের হাতে হাতে মাস্ক বানাতে শিখেছে।
    চোখ তুলে শ্যামা দেখে সুখিরাণীর চোখ খোলা । উপুর হয়ে শুয়ে শ্যামাকে দেখছে সে।
    মরা মাছের মত চোখ মেয়েটার। ঘোলাটে। স্থির। মূখে কথা নেই। শ্যামা উজিয়ে জিজ্ঞেস করে,
    জল খাবি নাকি রে? খাবি ? জল?
    সুখিরাণীর হেলদোল নেই।
    অতসী মা ধীরেসুস্থে পানের পিক ফেলে। একটা টিনের কৌটো জোগাড় করেছে। সেন্টারে পান খাওয়া বারণ। কিন্তু অতসীর সাত খুন মাফ। সব জায়গায় তার ভক্তকুল আছে।
    শ্যামা চুলের বেণী খোলে।
    - কোথায় যাবে বলোতো মা , এই মেয়ে ছাড়া পেয়ে? কেউ তো নিতে আসবে বলে মনে হয় না।
    - অমন কত মেয়ে রাস্তা ঘাটে ঘুরছে মা। শ্যাল কুকুরে টেনে নে যাচ্চে । পেট হচ্ছে। দুটো কাচ্চা বাচ্চাও হচ্ছে। মরছে। ঐভাবেই থাকচে। এও তাই থাকবে।
    - তোমার আশ্রমে জায়গা হয় না মা?
    অতসী মা মায়া দৃষ্টিতে শ্যামাকে দেখে। সুখিকে দেখে। মর্জিনাকেও দেখে। একটা গভীর শ্বাস নেয় ।
    - কেন হবে না মা? কিন্তু আশ্রমে তো সমথ্থ মেয়েছেলের অভাব নেই। দেখতে শুনতে সমথ্থ না হলে গুরুবাবা ভাইরা শরণ দেবে না কো। হাবা গোবাতে অবিশ্যি অসুবিধে নেই । কিন্তু এ যা চ্যায়রার ছিরি। তারপর সেবাধম্মে, কাজেকম্মে লাগতে পারবে কি না তাও জানিনে।
    শ্যামা অবাক হয়ে ভাবে, ছোট থেকে শুনে এসেছে আশ্রম হল দয়া মায়ার জায়গা। অনাথকে আশ্রমে দাও। তা মেয়েছেলের কি কপাল দ্যাখো। বিয়ে দিতেও রূপ লাগে , গুরুর চরণে দিতেও এট্টুআট্টু স্বাস্থ্য, রূপ লাগে। মেয়ে মানুষের কী জ্বালা মাগো মা!

    ✨দালালস অব দ্য ওয়র্ল্ড

    মর্জিনাবিবির বর আর ছেলে চলে এসেছে বাড়িতে সেই বর যে ঠেঙিয়ে পা খোঁড়া করেছিল মর্জিনার। ঐ পা টুকু যা খুঁতে । নয়তো চমৎকার দেখতে মর্জিনাবি। গমের মত গায়ের রঙ অভাবে কষ্টে অনটনে পুড়ে গিয়েও যা আছে , তা মন্দ না। এই ছোট ছোট সাদা দাঁত। টিকোলো নাকে একটা নাকছাবি। ঘরে ফেরার জন্য মুখিয়ে আছে। বর আর ছেলে ফিরে না জানি কী করছে। কী খাচ্ছে। স্টোভে তার তেল আছে না নাই। কচুর লতি দিয়ে পেঁয়াজ রসুন কুচো মাছ রেঁধে তাদের খাওয়াতে না পারলে মর্জিনার দিমাগে শান্তি নেই। দিল উচাটন। শকিলা শুনে তাজ্জব বনে যায়। আরে বাপরে। তোমার বর ছেলে কেমন করে বাড়িতে থাকবে এখন? দিল্লি থেকে পা রেখেই ঘরে ঢুকে যাবে? উদের কে কোরানটিনে লিবে না? উদেরো চোউদা দিন সেন্টারের ভাত কপালে । মর্জিনাবিবি শুনে ফিকফিক হাসে। নাকছাবি চমকায়। ছেলে ফোন করেছিল। ইস্টেশনে কেউ নামে নাই ওরা। ইশ্টেশনে নামলেই চেকিং হবে। সেন্টারে নেবে। বন্দি থাকতে হবে চৌউদা দিন। ইস্টিশন আসার আগেই লেভেল ক্রসিংএ নেমে গেছে প্রায় সবাই। রাতের অন্ধকারে এই গলি ঐ গলি দিয়ে বাড়িতে ঢুকেছে। কেউ খবর পায়নি সেদিন। পরদিন কাউন্সিলরের ছেলেরা এসেছিল । তো তাদের সঙ্গে রফা হয়েছে একটা। বস্তির ষোলোজন মরদ ফিরেছে একসঙ্গে । তাদের রাখার মত জায়গাও নাকি এখন নাই। ফিরেছে সবাই। সেই হারামজাদা জালালও ফিরেছে। মর্জিনার অভাবের সংসারে তখন হাঁড়ি চড়তো না। ছেলে দুটো ফ্যা ফ্যা করে ঘোরে। বর রাজমিস্ত্রির কাজ কখনো পায়। কখনো পায় না। মর্জিনার লোকের বাড়িতে কাজটুকু ভরসা।
    অফিসঘর জালালের। পাড়া জালালের । পাড়ার মেয়েছেলেদের ওপরেও জালালের অধিকার। কর্তৃত্ব। সে যেমন চালাবে তেমনি সব চলবে। জালাল মুম্বাই, দিল্লি , ইলাহাবাদ পর্যন্ত লেবার সাপ্লাই দেয়। এখানে পার ডে দেড়শো তো বাইরে তিনশো। জালাল বেসিক্যালি দালাল। সে দালালির টাকাতে বস্তির ছোটে নবাব। নিজে মিস্ত্রি খাটা ছেড়ে দিয়েছে বহুদিন। কাজেই দিল্লিফেরত লেবারদের ঘরে রাখার দায়িত্ব তার। কাউকে সেন্টার যেতে হবে না। টাকা দিলেই জালালভাই সবার মাই বাপ বনে যায়। আর ফরমাস মতো মেয়ে বউদের জালালের কাছে পাঠানো। কাজেই মর্জিনার বর ছেলে ঘরেই আছে। মর্জিনা ফিরলে হয়তো জালাল দু চারবার অফিসঘরে ডাকবে । এবার আর মর্জিনার বর কিছু বলবে না। বলেই রেখেছে। করোনা বলে কথা। জান লিয়ে বাঁচলেই হল। কোরানটিন না কি সেখানে যাবে না কেউ। গেলেই করোনা। আর করোনা হলেই মরণ। তারচেয়ে জালালকে টাকা দেওয়া ভালো। বউ দেওয়াও ভালো। এখন সবাই ঘরে থাকতে চায়। অনেক হল লেবার খাটা।
    এখন মর্জিনাবি বুঝতেই পারছে না , যে সে কী করে।
    অফিসে ডাকবে জালাল। আপাদমস্তক ঢেকে মাথায় মুখে ওড়না জড়িয়ে যাবে মর্জিনা। তাকে ডাকলেই দিনের বেলা নেশা করবে জালাল। টেবিলের সঙ্গে ঘেঁষে দাঁড় করাবে মর্জিনাকে। আর ইনিয়ে বিনিয়ে প্রেম নিবেদন করবে। কাজ নিয়ে দিল্লি না গেলে তারই তো নিকাহ করার ইচ্ছা ছিল মর্জিনাকে। নেহাত কাজ পড়ে গেল আর মর্জিনার বাপ আলমকে পাত্র ঠাওরালো। মর্জিনার এসব কথায় কোনো হেলদোল হয় না । সে জানে যাহা আলম তাহাই জালাল। সে অপেক্ষা করে থাকে কখন জালালের মানসিক ও শারীরিক ঢং ঢাং লীলাখেলা শেষ হবে এবং বাড়িতে ফিরে তাকে দিস্তে খানিক রুটি বানাতে হবে। দিল্লি যেতে হবে বলে আলম তাকে ঠেলে পাঠাবে জালালের কাছে। আবার সে গেছিল বলে আলম তাকে ঠ্যাঙাবেও। কোরানটিন থেকে ফিরেও এই এক ঘটনা চলবে। মর্জিনার করোনা নিয়ে ভাবনা নাই। পয়সা নিয়ে ভাবনা। সব তো ফিরলো। টাকা কড়ি কিছু এনেছে ? ঘর চলবে কি করে? জালাল দেবে কিছু? এতসব বোঝা মাথার ওপরে থাকা সত্ত্বেও শ্যামার ডিসচার্জ কালে মর্জিনার মন খারাপ লাগে। তার আরো তিনদিন বাকি।

    শ্যামা সেন্টার থেকে বেরিয়ে সামনে খানিকক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকল। সময়টা বিকেলবেলা। কিন্তু রোদ আছে এখনো। রোদের কড়া তাপ। সাধারণত যারা ছুটি পাচ্ছে সেন্টার থেকে ,তাদের নিতে কেউ না কেউ আসে। অতসী- মা কে নিতে তো একদল ভক্ত এসেছিলো। লকডাউন টাউন কেউ মানে নি। হৈ হৈ করে সব মা' কে নিতে চলে এসেছে। সেন্টারে মিষ্টি ও দিয়ে গেল। একটা প্যাকেটে দুটো করে লাড্ডু। একটা ক্ষীর সন্দেশ। শুকনো বোঁদে।
    শ্যামার মনটা খারাপই হয়ে গেছিল অতসী-মা চলে যেতে। কত রকম গল্প করত মা। সংসারের ঘোরপ্যাঁচের গল্প। জটিল কুটিল লোকজনের প্যাঁচাল। একেকটা মানুষ থাকে , যারা ঘরে থাকলে ঘরটা ভরা ভরা লাগে। অতসী- মা তেমনি মানুষ। স্নান সেরে কপালে চন্ননের ফোঁটা নাটা কেটে জপের মালাটি নিয়ে যখন গোল হয়ে বেডে বসতো, মন আপনি ভালো হয়ে যেতো শ্যামার । কে বলবে এই মানুষ এত দুঃখ কষ্ট সয়েছে। নিজে থেকে কাউকে জ্ঞান দিত না মা। তবে কথার পিঠে কথা উঠলে সুন্দর করে বোঝাত। গা দিয়ে কেমন সোন্দর গন্ধ মায়ের । শ্যামার মনে হত মায়ের কাছে গিয়ে একটু বসে। হাত দুটো ধরে। তা ডিসট্যান্সিং না কী আছে, তার জন্য কেউ কারু কাছে তো যেতেই পারবে না। তাই শ্যামা মায়ের মুখের দিকে তাকিয়ে বসে থাকতো। দিব্যি ময়শ্চারাইজার মাখা মুখ মায়ের। ভক্তরাই দেয়। মা নাকী ফেশিয়াল করে আশ্রমে। কোন এক মেয়ে ভক্ত এসে করে দেয় । গুরুবাবাকেও করে দেয় । পাঁচজনের সামনে আবির্ভাব হবে, ভালমন্দ কথা বলতে হবে। চামড়া বেশ চকচক না করলে চলে! অতসী - মা পই পই করে বুঝিয়ে গেছে শ্যামাসুন্দরীকে।
    সন্ধেবেলা সেদিন শ্যামার চোখে ঝরঝর জল। শকিলাবিবি হাঁকুপাকু করছে। উঠে জল মুছাবার উপায় নাই। পিঠে অসম্ভব ব্যথা। সন্ধেবেলা ঘরখানার জন্য মন আছাড়িপিছাড়ি। ফাঁকা। অন্ধকার। আরশোলা নেচে বেড়ায় । টিভি চলে না। শাশুড়ির চৌকি ফাঁকা। কে জানে তার প্রেত সেখানে আসে কিনা। শ্রাদ্ধ শান্তি কিছুই তো হল না। ছেলে ঘুরে বেড়ায় পরের বাড়িতে আনাচে কানাচে । পরের দয়াতে দুটো খাচ্ছে। সুখনলালের ছায়ামূর্তি দেখা যায় অনতিদূরে। শ্যামা আধা ঘুম ছুটে ধড়মড় করে উঠে বসে। কান্নায় ভেঙে পড়ে। ওরে বাবলু রে। এও ছিল! এত ছিল!
    কারুর কান্না দেখে মন গলে গেলে অতসী- মা হওয়া যায় না। মন শক্ত রাখতে হয়। অতসী মা মুখে ভিকো টারমেরিক মাখে। কুচকুচে কালো কোঁকড়ানো চুল পাতা কেটে আঁচড়ানো। এখন অতসী মা এক প্রাজ্ঞ নারী । আশ্রমের সব তার নখদর্পণে। গুরুবাবার পছন্দ অপছন্দ সেই জানে।

    চুল ধরে হিড়হিড় করে টেনে নিয়ে যাচ্ছে বর। তোর পেটে ছেলে আসে না কেন মাগী? পেটে লাথি। গুণে গুণে চারবার। পাঁচবার। ছ'বার। উঠোনে একগাদা লোক। বাড়ির লোক। পাড়ার লোক। টুকটুকে ফর্সা রঙ দেখে বউ এনেছিলো। সেই কুড়ি বছরের মেয়ের শাড়ি গা থেকে আলগা হয়ে খুলে গেলে, তা সে মারার জন্য হোক বা অন্য কিছু, দেখার লোকের অভাব হয় না। পেটে অসহ্য যন্ত্রণা সহ্য করেও অতসী বুকের কাছে শাড়ি চেপে ধরে রাখে। তারপর বমি শুরু হয়। মাথায় যন্ত্রণা। চুল ধরে টেনে আবার হিঁচড়ে নিয়ে যাচ্ছে বর।
    শাশুড়ি বসে আছে দালানে হেলান দিয়ে । নিশ্চিন্ত গলায় বলছে, গুরুদেবের কাচে নে যাবো সামনের হপ্তা। বুদো। মারের দাগ যেন তার আগে মেলায়ে যায় । গুরুচরণে কিন্তু দাগওয়ালা মেয়ে দরে দেব না আমি। গুরুবাবা পুণ্যের মানুষ। সাফ সুতরো থাকে যেন গা হাত। মারো কিন্তু দাগ রেকোনি।
    একঝাঁক পাখি উড়ে গেলে গাছ শূন্য, অতসীর তলপেট যন্ত্রণাতে অবসন্ন কুকুরের মত কুঁইকুঁই করে। সেই সব লাথি , মার, কালশিরে জমা করে করে অতসী অতসী- মা হয়েছে। কম জোর লাগে নাকি!
    বেশ করে চুলে গন্ধতেল। মা কে সেন্টারে কেউ কিছু বলে না। এসেছে যে, এই বড় ভাগ্যি।
    শ্যামার দিকে তাকিয়ে থাকে। শ্যামার কাহিনি মা আগেই জেনে গেছে। এখানে কেউ পেটে কথা চেপে থাকে না। শুধু সুখন যে জুহির সঙ্গে ভেগেছে, সেকথা শ্যামারাণি বলেনি। তাও অতসী মা কেমন করে বুঝে গেল।
    মা বলে গেছে, কাঁদবি কাটবি। ঝগড়া ঝাটি করবি। বরের জন্য দাপাবি। যা করবি কর। বর ফিরলে ইচ্ছে হয় ঘর করবি । ইচ্ছা না হলে করবি না। সব একই কথা। শুধু খাবারের উপর রাগ করবি না। যা রাগারাগি হবে, পেটপুরে খেয়ে। আর চুল চামড়া ঠিক রাখবি। তেল শ্যাম্পু যেন পড়ে ঠিকমত। মুখে বেসন দিবি। চামড়া ভালো থাকবে। চ্যায়রা ঠিক রাখবি শ্যামা। দুখিয়ারী সেজে ঘুরলে কেউ পুঁছে দেখবে না। মনে রাখিস। আমার দ্যাখ। চ্যায়রাখানা ছিল বলে করে কম্মে খাচ্ছি। শরীরের তাক ঝাক জানতে হবে। নইলে জগত মিথ্যে। এসব কথা অতসী মা গুরু বাবার সঙ্গে থেকে থেকে শিখেছে।

    মা যাবার আগে উর্বশী তেল আর সাবিত্রী সিঁদূর বিনি পয়সাতে দিয়ে গেছে শ্যামাকে। এ তেল মাখলে বর আর মুখের থেকে চোখ সরাতে পারবে না। আর সাবিত্রী সিঁদূরে সোহাগ বাড়বে।
    কম বড় মন! শ্যামা মনে মনে পেন্নাম করে। পরে আশ্রমে গিয়ে এ তেল সিঁদূর কিনতে হবে। বউদির জন্যেও কিনবে ভেবে রেখেছে। অবশ্য,দাদা মাটির মানুষ। কোনো বেচাল নেই। তবু। পুরুষমানুষের মতিগতিতে বিশ্বাস নেই আর তার।
    জ্যোতি তো আগেই চলে গেছে। কোন হাসপাতালে কে জানে। তার আর কোনো খোঁজ দেয়নি কেউ। নার্সদিদিও জানে না। বেশ ছিল মেয়েটা। জমিয়ে রাখতে ঘর। মাস্ক খুলে বসে থাকতো। লে। কে কী বলবি বলে যা। কত দূর দূর জায়গা ঘুরেছে এতটুকু বয়সে। শ্যামা ঐ একবার দীঘা ছাড়া কোথাও যায়নি। আর যাবেও না।
    সুখিরাণী পড়ে থাকল শরীরে একগাদা কাটাছেঁড়া নিয়ে । মূক। অবশ। তবু তার শরীর নিয়ে কত কথা চালাচালি। সে কী রেন্ডি না ঘরের মেয়ে ?ঘরের মেয়ে তো কাঁদাকাটা নেই কেন?
    শকিলা খুব কাঁদল শ্যামা আসার সময়। অতসীমায়ের থেকে তেল সিঁদূর সেও নিয়েছে। লুকিয়ে পরবে। যদি মরদের মন ফেরে। ছানাপোনাগুলোর জন্য রোজ কাঁদে সে। তারপর এক খান্ডারণী ডাঁকসাইটে শাশুড়ি আছে ঘরে তার। বর না পিটলে শাশুড়ির মন খারাপ হয়। কান্নাকাটি কিছু নতুন নয় তাই।
    মর্জিনা এসে দাঁড়িয়েছে দরজায়। তার সঙ্গে কত কথা হয়েছে শ্যামার । রাত জেগে জেগে। শেষে আয়া বকা দিত।
    গুলশন বিবি একটু আলগাই থাকতো। খুব দুবলা শরীর তার। তিরিশ বছর বয়সে পাঁচ বাচ্চা । শরীর নিয়ে নাজেহাল। তারও মুখটা কালো হল শ্যামার যাবার সময় । সবাই যে যার ঘরে ফেরার জন্য আকুল।
    সেন্টারের বাইরে স্টেশনারী দোকানে অর্ধেক ঝাঁপ খোলা। পুলিশ এলেই ফেলে দেবে পুরো ঝাঁপ। শ্যামার ব্যাগে সামান্য কাপড়জামা। উর্বশী আলতা ইত্যাদি। জলের বোতল। ভিটামিন। সেন্টারের রিপোর্ট । নেগেটিভ।
    ছেলের জন্য একটা ক্যাডবেরি কিনবে সে। তারপর। কোথায় যাবে? যাবে কোথায় শ্যামা? হরপ্রীতের কাছে? ছেলেকে নিতে না নিজের ঘরে?
    সেখানে লোকজন ঢুকতে দেবে তো তাকে?
    দোনোমোনো হয়ে দাঁড়িয়ে থাকলো। কেউ কিছু বলার নাই। গালমন্দ করার নাই। এ জীবন কী ভালো?

    ✨আড়োস পাড়োস

    বস্তির সামনে গিয়ে কেমন বোকা হয়ে গেল শ্যামা। এই ক'দিনে এত পাল্টে গেছে জায়গাটা? গলির মুখে পাড়ার ছোঁড়াগুলো দাঁড়িয়ে আড্ডা মারছিল। শ্যামাকে দেখে টেরিয়ে টেরিয়ে তাকালো। চোখের দৃষ্টিতে অসুবিধে হল শ্যামার। এইসব দৃষ্টির মানে সে জানে। সুখনলাল চলে যাবার পর কম চিত্তির তো দেখলো না! সব বদমাইশের ঝাড়। বউদি বউদি বলে আসবে। তারপর ছুঁতোনাতায় হাত ধরে টানবে। এমনকি কাকিমা বলে ডাকে যে চ্যাংড়াগুলো , তাদের চোখেও নোংরামি দেখেছে শ্যামা। দেখেছে আর সরে সরে গেছে। যতদিন মাথার ওপর শাশুড়ি ছিল, তা সে যতই বউকাটকি হোক না কেন, শ্যামার অত ডর ছিল না। ঘরে একটা বুড়োমানুষ থাকলে অনেক বুকের পাটা থাকে। কিন্তু এখন! এখন কী হবে? ঘর ফাঁকা। সুখন নাই। শাশুড়ি নাই। দশরথ বা সাজিদের কথা আলাদা। তাদের সঙ্গে শ্যামার আলাদা খাতির। ঠারেঠোরে কথা। সেও হয়তো হত না। যদি ঘরের মানুষ ঘরে ঠিকঠাক থাকতো। শ্যামা তাহলে পরপুরুষের দিকে ফিরেও চাইতো না। সুখন ভেগে যাবার পর শ্যামার ঘেন্না ধরেছিল সংসারে। আর রাগ। সুখনের ওপর। নিজের ওপর। সেই রাগেই দশরথের সঙ্গে ফষ্টিনষ্টি ধরেছিল শ্যামা। খানিকটা নিজেকেও যেন পরখ করে নেওয়া। কী কম পড়লো তার শরীরে যে জুহি ছিনিয়ে নিল তার বরখানা? নাকি ছলাকলার দাম বেশি! জুহি কেমন আহ্লাদি চোখে টেনে টেনে চাইত । গা থেকে ওড়না খসে খসে পড়ত না নিজে ইচ্ছে করে ফেলত, কে জানে। ছুঁড়ির চেকনাই ছিল ভালো! তাই তো ওরা ভাগার পর শ্যামা ভ্রূ নাচিয়ে কথা বলতে শুরু করল। সুখনের ওপর জ্বালাতে । পাড়ার ছোঁড়াগুলো সেসব খবর পেয়ে একেবারে যে ছোঁকছোঁক করেনি তা তো নয়। তা তখন শ্যামা সেসব সামলে নিয়েছিল। কিন্তু এখন?
    ওরা কী কিছু বলবে? রোদে দাঁড়িয়ে শ্যামার গা পুড়ে যাচ্ছে। ভেবেছিল ঘরে ঢুকে আগে ঝাড়ঝাঁটা দেবে। এতদিনের ধুলোবালি না ঝাড়লে চলে?
    বিছানার চাদর পর্যন্ত ধুলো পড়ে থাকবে। আর টিকটিকির গু। তারপর কলতলায় স্নান করবে আবার কচলে কচলে। আগেকার মত। ব্যাটাকে আনতে যাবে সন্ধেতে। এই অশৌচের ঘরে ঢোকাবে না তাকে। গঙ্গা জল ছিটিয়ে নিতে হবে তুলসীপাতা দিয়ে । অনেক অনেক কাজ বাকি। গুচ্ছের কাপড় কাচতে হবে আর ওদিকে বস্তির হাল পাল্টে গেল।
    শ্যামার একহাতে ব্যাগ। অন্য হাতে ফাইল। ফাইলে নেগেটিভ রিপোর্ট । ছেলেগুলো চেয়ে আছে। কিছু বলছে না। বাঁশ দিয়ে আটকানো বস্তির সামনেটা। ঘরগুলোর দরজা জানলা সব বন্ধ । লোকজন কম। মুদির দোকানে অর্ধেক ঝাঁপ ফেলে রেখেছে। সাবান , সার্ফ সেন্টার থেকেই দিয়েছে। একটু মুড়ি কেনা দরকার ছিল শ্যামার ।
    বুলন এগিয়ে এলো। পিছন পিছন কালু। সূরয।
    - ছাড়া পেলা বৌদি? এখন ছাড়লো?
    শ্যামা দোনোমোনো করে দাঁড়িয়ে । ঘামে ব্লাউজ ভিজে চপচপে। শায়াও। সেন্টার থেকে দুবার বাস বদলে আড়াইঘন্টা ধকল সয়ে এসেছে।
    - এখন তো ঘরে ঢোকা যাবে না বৌদি।
    শয়তানের মত হাসল কালু।
    - কেন? জ্বর তো সেরে গেছে। রিপোট আছে। নেগেটিভ।
    ব্যাগ দেখায় শ্যামা। যেন কাগজ টেনে বের করবে।

    ওরা কোনো কাগজপত্র দেখতে চায় না। সাফ কথা। শ্যামার শাশুড়ি করোনাতে মরেছে। শ্যামার করোনা হয়েছিল। ওই চোদ্দদিনে কী সেরেছে না সেরেছে ওরা জানে না। শ্যামা ঘরে থাকতে পারবে না। এ বস্তিতে কালুর কথা শেষ কথা।
    তবে যদি কালুর নির্দিষ্ট জায়গাতে শ্যামা কালুর সঙ্গে আলাদা দেখা করে বা কালুকে ঘরে আসতে দেয় তাহলে আলাদা কথা। সেকথা এখন উহ্য থাকে বটে কিন্তু ইশারাতে থাকে। শ্যামার বুঝতে দেরি হয় না।
    দশরথের সঙ্গে যদি দেখা করা যায়, তবে কালু, বুলেট, রতন কী দোষ করল? হেল্প করে দেবে। রেশন মিলে যাবে শ্যামার। কোনো অসুবিধা থাকবে না। কালু রাণী করে রেখে দেবে।

    শ্যামা বুঝতে পারে পায়ের নিচ থেকে মাটি সরছে। একটু একটু করে। গরমে সারা শরীর চ্যাটচ্যাট করছে। এই মুহূর্তে স্নান ছাড়া কিছু চাইবার নেই। টিউকলের তলায় সেই বহুআকাঙ্খিত স্নান। বিকেল চারটের সময় আরামের স্নানটুকু সেরে , মাথায় গামছা বেঁধে খেতে বসা। মোটা চালের ভাতের চূড়া ভেঙে ডালটুকু ঢেলে, লেবু চিপে একটা লঙ্কায় কামড়। শুধু এইটুকু পেতে কত ঝামেলাবাজি পোয়ানো। শ্যামা কাঠের মত দাঁড়িয়ে রইল। বুলন মাঝরাস্তায় চলে এসেছে। লুচ্চার মত চলন।
    এখন করোনা চলছে বউদি। তুমি পেশেন্ট ছিলা। রোগ সেরেছে কি না সেরেছে জানি না, ঘরে ঢুকতে পারবা না।
    ওদের তাকানোতে যতটা হিংস্রতা, তার চেয়ে বেশি নোংরামি । মজা করছে যেন শ্যামাকে নিয়ে । ফুটবল খেলছে। সরকারি রেশন আসে বস্তিতে । সেটাও ওদের কারবার। কে কতটা পাবে বই বা কার্ড দেখে হয় না। ওদের মর্জিতে হয়।
    পিছু হটতে হটতে রোগা বেড়াল যেমন ফ্যাঁচ করে রুখে দাঁড়ায়, ঠিক অমনি ঘুরে দাঁড়ানোর শক্তি কোথা থেকে যেন পেল শ্যামা। এতবড় দুনিয়াতে ঐটুকুই তার নিজের মাটি। ওটা ছেড়ে দেবে না সে। সপসপে ঘামে প্রায় ভিজে। দুর্বল শরীর। রুখে দাঁড়িয়ে শ্যামাসুন্দরী বললো,
    - ব্যাগে রিপোট আছে। নেগেটিভ । দু' বার নেগেটিভ কোরানটিনে থেকে আসছি। কোন বাপের ব্যাটার ক্খ্যামতা আছে আমাকে আটকায়? ডেকে লিয়ে আয় কাউনসেলারকে । কোন পুলিশ ডাকবি ডাক। আমিও দেখছি কে আমারে ঘরে ঢুকতে না দেয়।
    কালুরা পিছু হটে। এত সপাট জবাব ওরা আশা করেনি। কাঠফাটা দুপুরে রাস্তা ফাঁকা। কালুরা গুটিয়ে উল্টো ফুটে জটলা করে।
    শরীরে কোথা থেকে অদ্ভুত জোর আসে। কী ভর করে শরীরে কে জানে। পাঁচ একের রোগা হিলহিলে শ্যামা যেন প্রকান্ড হয়ে ওঠে। একরোখা। জেদী। সাহসী।
    কালুদের মুখের সামনে দিয়ে হনহন করে বস্তির ভেতর ঢুকে যায় শ্যামা। ওরা কেউ কিছু বলার আগেই তীব্র হয় তার গতি। বাঁচতেই হবে এখন। নিজেকে বাঁচাতে হবে। করোনাকে জিতে নিয়েছে সে। এরা কতদূর যাবে যাক। তার হক আছে। ষোলোআনা হক।
    ওখানে তালাবন্ধ হয়ে পড়ে আছে তার ঘর। নিজের ঘর।

    ✨সমর্পণ

    - এখনো ল্যাপটপে আছো বাবা?
    - নারে। আজ কাজ শেষ করেছি তাড়াতাড়ি । খিচুড়ি বানাচ্ছি আজ রাতে।
    - তুমি কিচেনে?
    - হ্যাঁ। মিনির শরীর তো ভালো নেই।
    - মা একেবারে ভেঙে পড়েছে। না বাবা?
    - একদম। তোকে সেই সময় অনেকবার ফোন করেছিল। মিনি। টুপুর। দুজনেই। খুব হেল্পলেস হয়ে পড়েছিল তো।
    - তুমিও করেছিলে?
    - না। দেখলাম তো । টেক্সট করেছিস। ল্যাবের কাজ কমপ্লিট হল? বাইরে যাচ্ছিস না তো?
    কথা বলতে বলতে চাল, ডাল ধোয়া শেষ। একেবারে ঠাকুমার পদ্ধতি মেনে যতটা চাল তার ডাবল ডালের প্রণালী মেনে চলেন ত্রিদিব। মেসে যখন থাকতেন, খিচুড়ি ছিল প্রধান খাদ্য রাতের দিকে। গোল, মোটা করে বেগুন কেটে রেখেছেন। হলুদ, নুন, চিনি আর অল্প চালের গুড়ো দিয়ে ভাজবেন। মুচমুচে থাকবে।
    - ডোন্ট লেট হার গেট ব্রোকন বাবা। মা' কে সামলে নিও। মা ভীষণ সফ্ট।
    বোঝো ঠেলা। মায়ের কাছে মাসির বাড়ির গল্প। মালবিকা যে নরম ধাঁচের তা যেন ত্রিদিব জানেন না।
    - নিচ্ছি তো। ট্র্যাঙ্কুলাইজার খেয়ে পড়ে থাকছে রে। ডাক্তার বললেন , কয়েকটা দিন এইভাবে যাক।
    - ডাক্তারের কাছে নিয়ে গিয়েছিলে ?
    - না না। অনলাইনে ড.বিশ্বাসের সঙ্গে কথা হল।
    - বেশি ট্র্যাঙ্কুলাইজার দিও না। পরে খারাপ হবে।
    - আই নো। কিন্তু এইমুহূর্তে কোনো উপায় নেই বাবু।
    শী নিডস রেস্ট অ্যান্ড রিল্যাক্সেশান।
    - ইজ টুপুর প্লেয়িং দ্য সেইম ডিফিকাল্ট রোল বাবা?
    - টুপুর অনেক কাজ করছে রে । লাঞ্চ বানাচ্ছে। রাতে ইউসুয়ালি হোম ডেলিভারি নিই। আজ খিচুড়ি বানাতে ইচ্ছে করলো।
    - মা খাচ্ছে ঠিকমত?
    বহুদিন বাদে ছেলের সঙ্গে এত কথা হচ্ছে। ত্রিদিবের বুকের ভার যেন হাল্কা হয়ে আসে।
    - শকটা অন্যজায়গাতে বাবু । অসুস্থ অবস্থায় কাছে যেতে পারলো না। মৃত্যুর পর বডি দেখলো না। কোথায় কোন ধাপার মাঠে কিভাবে পুড়িয়ে দেওয়া হল জানলাম না কেউ। এই ভয়ংকর ব্যাপারগুলোতে তোর মা নাম্ব হয়ে গেছে।
    ত্রিদিব একটু জোরে শ্বাস নিলেন। তেল ছেড়েছেন কড়াইতে। কানে হেড ফোন আলগা হয়ে গেছিল।
    - শোনো বাবা। আই অ্যাম ফিলিং ভেরি গিল্টি। আমি ঐ সময় ফোন ধরি নি।
    - কেন বাবু? তুই তো এখানে সিচুয়েশন জানতিস না। আর আমরা তো কেউ ভাবি নি দ্যাট থিংগস উইল ওরসেন সো কুইকলি। তুই একা থাকিস । সেইজন্য যা টেনশন।
    - বাবা আই অ্যাম কোভিড পজিটিভ।
    সবে তেজপাতা ফোড়ন দিয়েছিলেন। গন্ধটা কেমন আরামদায়ক ।
    শব্দগুলো দুম করে বুকের মধ্যে আছড়ে পড়লো। কোনো গন্ধ পাচ্ছেন না।
    - ওয়াট?বাবু?
    - টেনশন কোরো না বাবা। আই হ্যাভ সারভাইভড দ্য ক্রাইসিস। ঐ সময়টা , যখন দিদুন হসপিটালে আর মা আমাকে ফোন করে পাচ্ছে না, মা কষ্ট পাচ্ছে , তখন আসলে আমার কথা বলার ক্ষমতা ছিল না। প্রচন্ড টেম্পেরাচার ছিল। বন্ধুরা ছিল । বেঁচে গেছি। হোম আইসোলেশনে।
    ত্রিদিব থরথর করে কাঁপছেন। ঘাম হচ্ছে। গ্যাস নিভিয়ে দিলেন। কিচেনের লাগোয়া ছোটো বারান্দায় বেরিয়ে এসেছেন।
    - বাবু , এসব কী বলছিস?
    - প্লিজ বাবা। টেনশন কোরো না। এখন ভালো আছি। অক্সিজেন কাউন্ট প্রায় নর্মাল। একটা শক ফিভার হয়েছিল বাবা। নির্মাল্য সুইসাইড করেছে।

    বারান্দাতে ছোট টবে লেবু, লঙ্কা লাগিয়েছেন মালবিকা। ছোট ছোট লঙ্কা হয়েছে। কী যেন নাম এদের। ত্রিদিব মনে করতে পারছেন না।

    এসব কী হচ্ছে। শাশুড়ি মা দুম করে চলে গেলেন কদিনের জ্বরে। যেন ভ্যানিশ। শরীর আর দেখা গেল না। বাবু কোভিড পজিটিভ। বাবুর বন্ধু। ছোট্ট থেকে বাড়িতে আসা ছেলেটা। লাজুক। নম্র। সুইসাইড করেছে।

    ত্রিদিব মনের মধ্যে হাতড়াচ্ছেন। তারালঙ্কা। তারালঙ্কা। এইবার মনে পড়লো।
    - বাবু তুই কী সব বলছিস?
    - বাবা। আই অ্যাম ফাইন নাউ। নিশান্ত আমাকে দুবেলা দেখছে। বন্ধুরা আছে। দে আর টেকিং অল পসিবল কেয়ার। ভালো আছি। জ্বর নেই। বেশ ভালো।
    - তুই একা একা।
    - না বাবা। একা না। বলছি তো বন্ধুরা আছে।
    - স্টিল। রাতে ওরা কেউ থাকে?
    পাঁচসেকেন্ড অস্বস্তি। না। এখন সময় নয়।
    - থাকে পালা করে। কিছু চিন্তা নেই। আই অ্যাম ফিট । মা' কে কিছু বোলো না কিন্তু। লেট হার ওভারকাম দিদুন'স ডেথ।
    - খাওয়া দাওয়া?
    হেসে ফেলল বাবু।
    - ওভার ওয়েট হয়ে যাচ্ছি বাবা। প্রচুর খাবার খাচ্ছি। যাস্ট স্টে কুল।
    - রাতে কী খাবি?

    অদিতি ব্রাউন ব্রেড রেখেছে। কড়া করে ভাজবে। একটা চিকেন স্ট্যু। মোটা করে পেঁয়াজ, আলু ভাসবে। মাখন ফেলে দেবে। মুখের স্বাদ ফিরছে একটু একটু করে।

    - ওরা আনবে বাবা। চিকেন টিকেন কিছু। তোমরা সাবধানে থেকো। আই অ্যাম অন দ্য ওয়ে টু রিকাভারি।
    - ঠিক বলছিস? কিছু লুকোচ্ছিস না তো?

    - কার সঙ্গে কথা বলছো বাবা? কে কী লুকোবে? আর তুমি এত ঘামছো কেন বাবা? ওয়াটস রঙ?
    টুপুর। কখন এসে দাঁড়িয়েছে। সাদা টপে একটা কী যেন লেখা। কালো শর্টস।
    ত্রিদিব বললেন, ফোন রাখি। পরে করছি।

    টুপুর কাছে এসে জিজ্ঞেস করলো, কী হয়েছে বাবা? দাদার কিছু? তাড়াতাড়ি এসো। মা যেন কেমন করছে। আই ক্যান্ট ম্যানেজ। ( চলছে)

    ✨ডেথ ইন লাইফ

    ড.দেবী শেঠী বলেছেন , জুন, জুলাই, আগস্টে সংক্রামণ প্রচুর বৃদ্ধি পাবে ভারতবর্ষে । আর কত? আর কতদিন? এরকম একটা হেডলাইন ছিল। ত্রিদিব খবরের কাগজটা ভাঁজ করে রেখে দিলেন। মন মেজাজ খুব খারাপ । ছাতে যাচ্ছেন না কয়েকদিন ধরেই। জুত পাচ্ছেন না। না শরীরে , না মনে। সুগার কী বাড়ল? অনিমেষ নামে একটি ছেলে ব্লাড নিয়ে যায় প্রতিমাসে। ওকে ডাকতেও পারছেন না কোভিডের জন্য। কাঁধের জয়েন্টে, হাঁটুতে কেমন একটা ব্যথা। দৌড়োদৌড়ি না করলে এইসব ব্যথা আরো চাগিয়ে বসে। পর্দা এখনো টানা আছে। মালবিকা অকাতরে ঘুমাচ্ছে। এই ঘুম সাধারণ ঘুম না। কড়া ট্র্যাঙ্কুলাইজার আচ্ছন্ন করে ফেলে। খাটের তলদেশে তলিয়ে যাওয়া ঘুম। ঘুমের মধ্যে মায়ের গন্ধ পাচ্ছেন মালবিকা। সেই সাদা শাড়ি । পানের গন্ধ। কোল আঁচলে একটা গিঁঠ। মালবিকা হাতড়ে হাতড়ে মা' কে খুঁজছেন। কপালে কী মা হাত রাখল?
    ত্রিদিব মালবিকার মুখের ওপর ঝুঁকে পড়ে ডাকলেন, মিনি, মিনি!
    মালবিকা শুনতে পেল না। একটা পোড়া গন্ধ । ওরা মা' কে কোথায় দাহ করলো? দাহ করলো না পোড়ালো? মায়ের অমন নরম শরীর , ওরা কী নিরাবরণ করেছিল?কপালে চন্দনের ফোঁটা দেবে না কেউ? চন্দনটা নিয়ে আয় কেউ ! কে ডাকছে মিনিকে?
    ত্রিদিব কপালে হাত রাখলেন। এখন খুব ভয় হয়ে গেছে । দেখলেন গা ঠান্ডা। বাবুকে নিয়ে প্রচন্ড টেনশন হচ্ছে । সে একা আছে কোভিড পজিটিভ হয়ে। বলছে ভালো আছে। কতটা ভালো কে জানে। কারা দেখাশোনা করছে , অথচ এইমুহূর্তে ওর কাছে যাবার কোনো উপায় নেই। খবরটা শেয়ার করার উপায় নেই কারু সঙ্গে ।
    মিনি এমনিতেই কেমন হয়ে আছে। তারপর
    কাল রাতে প্রেশার ফল করে আরো অসুস্থ হয়ে যায় । বাবুর খবরটা আসার পরপর দেখলেন মিনির ওরকম অবস্থা । ঘামছে। মনে হচ্ছে কোল্যাপ্স করে যাবে। ত্রিদিব খুব অসহায় বোধ করছেন । মেয়েটা আর কত করবে। এখন বোধহয় চা করছে। কিচেনে শব্দ হচ্ছে।
    ঘুমন্ত মালবিকার মুখের দিকে তাকিয়ে ত্রিদিব । মুখ পাল্টেছে গত পঁচিশ তিরিশ বছরে। চোখের কোণে কালি। ঠোঁটের তীব্র ধার ধেবড়ে গেছে কিছুটা। গালে মাংস লেগে চোয়ালের ধার কমেছে। মেনোপজ তার যা করার করে যাচ্ছে শরীরে । মনে। বিষয়টি নিয়ে ত্রিদিব কখনোই মাথা ঘামান নি। ভেবেছেন নেহাত মেয়েলি সমস্যা, দরকার হলে মিনি নিজেই ডাক্তারের কাছে চলে যাবে। তবে টেম্পারামেন্টাল চেঞ্জ খেয়াল করেছেন। ইদানীং বেশ মুডি মালবিকা । খিটখিটে হয়েছেন খুব। রেগে যান কথায় কথায় ।
    আপনার স্ত্রীর হরমোনাল ডিসব্যালান্সটা বুঝতে হবে স্যর। ড. বিশ্বাস খুব নমনীয় সুরে বলছিলেন। ইউ মাস্ট শো ইওর কনসার্ন ত্রিদিব। এইসময়গুলো খুব ডেলিকেট মহিলাদের পক্ষে । একটা বিশাল শারীরিক চেঞ্জ । দ্যাট অ্যাফেক্টস হার মাইন্ড অ্যাজ ওয়েল। ইস্ট্রোজেন হরমোন কমে যাচ্ছে। ফিমেল বডিতে কিছু প্রোজেসটোজেন হরমোনও থাকে। যার ওপর স্কিনটোন, কমনীয়তা ডিপেন্ড করে। সেগুলো এখন বন্ধ হয়ে যাচ্ছে গ্র্যাজুয়ালি। ফলে উনি বিব্রত বোধ করবেন। অস্বাচ্ছন্দ্য থাকবে। মেজাজ হারাবেন। সেটা বুঝতে হবে তো।

    অনলাইনে ড. বিশ্বাসকে খুব উজ্জ্বল দেখাচ্ছিল। ইউ মে হ্যাভ ফেল্ট সাম চেঞ্জ ইন ইওর সেক্সুয়াল লাইফ অ্যাজ ওয়েল। তাই না?
    ত্রিদিব আমতা আমতা করে বিড়বিড় করছেন। কী বলবেন বুঝতে পারছেন না। গড় ভারতীয় পুরুষের মত তিনিও যৌনতাকে পুরুষের একচেটিয়া চাহিদা বলে ধরে নিয়ে এতদিনের দাম্পত্য নির্বাহ করেছেন। মিনি ইজ মোস্টলি আ মাদার। ওর মধ্যে মাতৃত্ব প্রবল। বাকি দিকগুলো নিয়ে ত্রিদিব ভাবেননি তেমন। এভরিথিং ওয়জ ইন প্র্যাকটিস।
    ড,বিশ্বাস বলে যাচ্ছেন
    সেক্স ইজ আ ম্যাটার অব দ্য মাইন্ড মি. সেনগুপ্ত । ইট ইজ নট অনলি বডি দ্যাট ম্যাটারস। মালবিকাকে কনফিডেন্স দিতে হবে আপনার। দ্যাট মেনোপজ ইজ দি এন্ড অব ফিমেল সেক্সুয়ালিটি, ইজ আ মিথ। উনি সম্ভবত সেই ক্রাইসিসেও ভুগছেন। ওঁর মনকে অ্যাক্টিভেট করতে হবে। দ্যাট শি ইজ স্টিল অ্যাট্রাকটিভ অ্যান্ড পাওয়ারফুল। ইন হার ওন ওয়ে। তারপর ধরুন ওঁর মা চলে যাবার শক। একমাত্র আপনি আর মেয়ে এটা ওভারকাম করাতে পারবেন। ট্রিট হার এমপ্যাথেটিক্যালি।
    ড্রাইনেস। বুঝলেন তো। ড্রাইনেস ইজ কিলিং। ইট হ্যাজ টু বি ওভারকাম । বুঝলেন তো। জীবন যখন শুকায়ে যায় করুণাধারায় এসো। আগেকার দিনে এসব কনশাসনেস ছিল না। তাই মেয়েরা সাফার করতো। এখন কেন করবে?বুঝতে পারছেন? কনসেপ্ট অব ওম্যানহুড হ্যাজ চেঞ্জড!
    ত্রিদিব বুঝতে পারছেন। একে মিনির স্কুল বন্ধ । স্কুল খোলা থাকলে হৈ চৈ করে কাটায়। বন্ধুদের সঙ্গে এদিক ওদিক। এখন ঘরে বন্দি। কোভিডের ভয়। অনলাইনে কাজ কতটা ক্লান্তিকর ত্রিদিব জানেন। অ্যাডেড টু দ্যাট বাবু দূরে। তার জন্য টেনশন। মেয়ের সঙ্গে বনে না। আর এই মেনোপজাল ডিসঅর্ডার নিয়ে ত্রিদিব একেবারে ইগনোরান্ট। অ্যান্ড দ্য ফাইনাল ব্লো। মায়ের মৃত্যু।

    কিন্তু ত্রিদিবকে কাজ করতেই হবে। এখন কোম্পানিকে না টানলে খুব বিপদ । ফিনানশিয়াল ক্রাইসিসের চেয়ে বড় কিছু নেই। তিনি কী করে সামলাবেন সবকিছু। তাঁর মা জ্যেঠিমারাও তো এই ফেজের মধ্যে দিয়ে গেছেন। কই তাদের তো এত ক্রাইসিস হয়নি।
    ড.বিশ্বাস মেধাবী হাসি হাসলেন। আসলে আপনাদের মা জেঠিমাদের সময় তাঁরা ধরেই নিতেন সন্তানজন্মের পর মেয়েরা বুড়ি হয়ে যায় । সেক্সুয়ালিটি পুরো নেগলেক্টেড থাকতো। এখন তো তা নয়। ওঁর মন চাইছে। শরীর অন্য কথা বলছে।
    অনলাইনে ড.বিশ্বাস প্রেসক্রিপশন লিখছেন। চলে আসবে সেকেন্ডের মধ্যে। মেনোপজাল মিথস আর নট ভ্যালিড মি. সেনগুপ্ত । দুটো বছর ওঁকে সাপোর্ট দিন। সব ঠিক হয়ে যাবে। অ্যান্ড ইউ হ্যাভ আ ভেরি ইনটেলিজেন্ট ডটার!
    দরজায় নক। টুপুর নক না করে বাবা মায়ের ঘরে আসে না।
    বাবা চা।
    টুপুর ট্রেতে চা, বিস্কিট রেখে গেল। এক কাপ।
    মালবিকা এখন উঠবে না। ও ঘুমাবে। অনেকক্ষণ । ক্রিম ক্রাকার সুগার ফ্রি । বিস্কুটের দিকে বিমর্ষ মুখে তাকিয়ে থাকলেন ত্রিদিব।
    তারপর বেশ জোরে ডাকলেন। টুপুর। বিস্কুট খাবো না। মুড়ি আছে? মুড়ি?

    মুড়ি এনেছে মেয়ে বড় কাঁসার বাটিতে। চা দিয়ে মুড়ি খাচ্ছেন ত্রিদিব । অনেক দিন বাদে। বাপ মেয়ে পাশাপাশি । মেয়ে কাগজ পড়ছে। মাথা বাবার কাঁধে। মালবিকা পাশ ফিরে চোখ খুলে দেখল দৃশ্যটা। আবেশ ঘনাল। হাত দিয়ে ত্রিদিবকে স্পর্শ করল মালবিকা। কী নিরাপত্তা । বাবু ভালো আছে তো! ওর সঙ্গে কথা হয়নি কতদিন। পাগল ছেলে।

    আদ্রর্তা এল হঠাৎ । ইস্ট্রোজেন কী শুধু এক শরীরী হরমোন! সে যেন এক প্রবল বারিধারা। এই পর্দাটানা ছায়াছন্ন ঘর, জানালাতে মানিপ্ল্যান্ট, ঘুমের রেশ লেগে থাকা বালিশ, বইয়ের র্যাক। পাশে ত্রিদিব । টুপুর। মায়ের দেওয়া কাঁসার বাটি। কীসের যেন গন্ধ । টুপুর কী ধূপ জ্বালিয়েছে? না রুম ফ্রেশনার? বাইরে "মাছ " বলে হাঁকছে কেউ। বাদশা হবে। ঐ বেশি আসে পাড়াতে। ত্রিদিবের হাতে হাত। মালবিকা ভিজতে লাগলেন ঝমঝম করে। আধোঘুমেই বললেন , তোমরা একটু মাছ খাও প্লিজ।

    বশির ও বাদশা দুজনে এই পাড়ার মাছবিক্রেতা। টাটকা মাছটা পাওয়া যায় । রুই। যদিও খুব পাকা নয়। কাতলা । ছোট চিংড়ি । পমফ্লেট। ট্যাংরা। আড়। ওরা সকালে পাড়াতে এবং দশটা থেকে বাজারে বসে মাছ নিয়ে । আপাতত বাজার বন্ধ এবং মাছের ক্রেতা কম। বাদশার তামাটে মুখ ও লাল চুল দেখতে দেখতে ত্রিদিব কাতলার দর জানছিলেন। মেয়ে মাছ খাবে না। মালবিকা এখন খাবেন না। মায়ের মৃত্যুর পর এখনো আমিষ মুখে দেয়নি সে। ত্রিদিব তবু মাছ কিনছেন। বাদশা বশিরের সঙ্গে আজ একটা নতুন ছেলে মনে হচ্ছে। সাধারণত মালবিকা করেন এই কাজগুলো। তবু ত্রিদিব চেনেন ওদের । মুখচেনা। নতুন ছেলেটার কালো রঙ পুড়ে আরো ঝামা হয়েছে। দাম মোটামুটি ঠিকঠাক নিল বাদশা। প্রথমে খুব চড়িয়েছিল। মৎস দপ্তরের চন্দ্রনাথ সিনহা তারপর অনলাইনে মাছ বিক্রির ব্যবস্থা করেছেন। মালবিকা কিছুতেই অনলাইনে মাছ কিনবে না। হাত দিয়ে টিপে না দেখলে তার মাছ কিনে আনন্দ নেই। তাও আড়টা পাঁচশ পড়ে গেল। সাড়ে ন'শো ওজন। নতুন ছেলেটার কাছে ট্যাংরা।
    ও কে রে? দেখিনি তো আগে?
    দাঁড়ি পাল্লা গোটাতে গোটাতে বাদশা বললো, খালার ছেলে। প্রথমে উড়িষাতে , পরে কোচিনে মাছ ধরতো। করোনার জন্য চলে এসেছে। ওর নাম সালমান।
    ত্রিদিব দেখলেন ছেলেটার মুখে ঘন কালো ছোপ। সমুদ্রের ওপর কালো মেঘ যেমন থরে থরে জমে থাকে তেমন। কালো নয়। অন্ধকার। ট্রলারে চড়ে দূরে দূর সমুদ্রে পাড়ি দেওয়া ছেলের শুকনো মুখে অনাহারের সুস্পষ্ট ছাপ। ত্রিদিব ট্যাংরা নিলেন না। মিনি বিছানায় । এখন কোনো ঝামেলার রান্না নয়

    তখনো কোনো লেবার প্রোটেকশন আইন বলবৎ হয়নি। পরিযায়ী শ্রমিকদের মতই পায়ে হেঁটে রাজ্যে ফিরে আসছে পরিযায়ী মাছ বিক্রেতারাও । করোনা র উপসর্গ। তাছাড়া তাড়াতাড়ি উপকূল খালি করে দিতে হবে।

    ✨কীটনাশক

    ও খবরের কাগজ সাধারণত পড়ে না। এখন পড়ছে। মালবিকা কাগজকে আগে রোদে ফেলে রাখতেন। তারপর সেটাকে স্যানিটাইজার দিয়ে পরিষ্কার করে ঘরে তোলা।
    ও রোদে ফেলে রাখার চ্যাপ্টার বাদ দিয়েছে। শুধু স্যানিটাইজার ছিটিয়ে নিচ্ছে। এখন স্যানিটাইজার কেনা মালবিকার একটা বাতিক হয়ে গেছিল প্রায় । নানা ধরনের স্যানিটাইজার শোভা পাচ্ছে। ড্রয়িং রুমে। শয়নকক্ষগুলিতে। রান্নাঘরে। বাথরুমে। নীল। হালকা সবুজ। সী গ্রীন। সাদা। ও খেয়াল করেছে মায়ের নীল রঙের স্যানিটাইজারের প্রতি পক্ষপাতিত্ব বেশি। হোয়াই? দ্য কালার ব্লু সিমস মোর পিওর? এক একটা স্যানিটাইজার ভীষণ খারাপ। মালবিকা সব ডাস্টিং করে সাফ সুতরো রাখেন। এখন তিনি একদম এদিকটা দেখছেন না। ও দুটো কাঠের চেয়ার ডাস্টিং করেছিল স্যানিটাইজার ছিটিয়ে । বার্ণিশ উঠে জঘন্য দশা একেবারে। মালবিকা নর্ম্যাল অবস্থায় থাকলে প্রচন্ড চেঁচামেচি করতেন। তারপর থেকে ব্র্যান্ডেড স্যানিটাইজার ছাড়া ব্যবহার করছে না। প্রচুর মাস্ক আর স্যানিটাইজারের স্টল গজিয়েছে পাড়াতে। কোনটা আসল কোনটা নকল বোঝা যাচ্ছে না। হালকা নীল স্যানিটাইজারটা সারা ঘরে ছেটাল। তারপর খেয়াল হল। ওপরের দিকে তাকাল। টিকটিকি একদৃষ্টিতে ওর দিকে তাকিয়ে । গোল চোখদুটো বিমর্ষ । বিষন্ন। ওর মন ভালো নেই বোঝা যায় ।
    - কী ব্যাপার? এত চুপচাপ । টিকটিক করছো না যে?
    - দেখছি।
    - কী?
    - শিক্ষিত লোক কত নির্বোধ হয়।
    - আমাকে মিন করলে নাকী? মায়ের শরীর খারাপ বলে আমি যাস্ট রুটিনটা ফলো করে যাচ্ছি।
    - এই যে ডিসিনফ্যাকট্যান্টের বাতিক তোমার মায়ের, তুমিও ছড়ালে ঘরের মধ্যে ভসভস করে, এ কী ভালো?
    - মোস্ট প্রোবাবলি না। হার্মফুল। ভেরি হার্মফুল অ্যাট টাইমস।
    - সারাক্ষণ হাতে স্যানিটাইজার ঘষে আর ঘরে ডিসিনফ্যাকট্যান্ট দিয়ে ভাবছো খুব সাবধানে আছো। তাই না?
    - নট নেসেসারিলি। মা দেয়। অসুস্থ মানুষ। এসবে মনটা ভালো থাকবে।
    টিকটিকি দাঁত বার করে হাসলো।
    মন ভালো রাখার কী ছিরি! জানো এই যে ডিসিনফ্যাকট্যান্ট দিচ্ছো , এগুলো আসলে কী?
    টুপুর মুচকি হাসল। ওভার ইনটেলিজেন্ট টিকটিকি।
    - এগুলো আদতে পেস্টিসাইড। কীটনাশক। কীটনাশক দিয়ে যখন উই মারো তখন তো সাতহাত কাপড়ে মুখ বাঁধো।
    একটা দীর্ঘশ্বাস । টুপুর ধপাস করে বিছানাতে শুলো। জানে বটে। পেস্ট কন্ট্রোল আর এস আর এস কোভিডের বিরুদ্ধে পাবলিক হেল্থ ক্যাম্পেইনের একটাই কমন ফ্যাক্টর। স্যানিটাইজার আর ডিসিনফ্যাকট্যান্ট দুটোই মূলত পেস্টিসাইড। ইউ এস এনভায়রনমেন্টাল প্রোটেকশন এজেন্সি ডিক্লেয়ার করেছে।
    যেকোনো অ্যান্টিমাইক্রোবায়ালসে দুশো পঁচাত্তর রকম কেমিক্যালস থাকে।
    সব পড়া । সব জানা ব্যাপারগুলো ভালো না। এখন সবজিওয়ালা, মাছওয়ালাও স্যানিটাইজার রাখছে ভ্যানে। ওদিকে থুৎনির নিচে মাস্ক। ঘামে চপচপে ভেজা মুখ মুছে নিচ্ছে মাস্কে। মালবিকা চেঁচাতে থাকেন। এই মুখে লাগা। মাস্ক মুখে লাগা।
    ঠিক যেভাবে হাত পা ছড়িয়ে শুলে মালবিকা ভয়ানক বিরক্ত হন, ঠিক সেভাবেই শুয়েছিল ও। ব্যাটা টিকটিকি সবজান্তা গামছাওয়ালা হয়ে বসে আছে।
    বিড়বিড় করে যাচ্ছে। কত জ্ঞান ! মাইরি। ও ভাবল।
    - বেশি হ্যান্ড স্যানিটাইজার ইউজ করলে চামড়া নষ্ট হয়ে যায় । যতই হ্যান্ড ক্রিম মাখো। আর ঐ বস্তু মেখে যদি ক্রেডিটকার্ড ধরো আর তারপরে খাও, তবে শরীর কিন্তু বাইসোফেনল নামে একটা কেমিক্যাল শুষে নেবে। ইমিউন চ্যালেঞ্জ হয়ে যাবে। পরে ডায়াবিটিস হবে। নার্ভাস সিস্টেম বিগড়ে যাবে।
    বিরক্ত লাগছে। বেশ জোরে একটা ধমক দিয়ে উঠল ও। চুউপ।

    একটু কী ঘাবড়ে গেল টিকটিকি? বকবক করছিল। বিড়বিড় করছিল। সে মাঝে থেকে সব স্পয়েল করে দিল।
    - রেগে গেলে?
    - নাহ্। টিকটিকি উদাস তাকালো। মানুষের ওপর নিকৃষ্ট প্রাণীর ওপর রাগ করে লাভ নেই। এরা স্বার্থ ছাড়া কিছু বোঝে না, আবার স্বার্থটাও ঠিকমত বোঝে না। বুঝলে নিজেদের সর্বনাশ নিজেরা করতো না। প্ল্যাস্টিকে , পেস্টিসাইডে আর পর্ণোতে ভরে গেল দুনিয়া। কত আইন কত নিয়ম। সবকে সব লবডঙ্কা ।

    ও উপুর হয়ে শুলো। দিদুনটা কেমন করে চলে গেল হঠাৎ । আচ্ছা মানুষ মরে গেলেই বডি হয়ে যায়, না! হাজার চুরাশির মা। বডি নং হাজার চুরাশি। একবার দেখতে দিলে কী ক্ষতি হত?মা এটলিস্ট ট্রমাটা থেকে বেঁচে যেত কিছুটা। এখন শুনতে পাচ্ছে ডেডবডি একবার দেখতে দেবার জন্য হসপিটাল, নার্সিংহোম টাকা চার্জ করছে। শুধু ডেডবডি দেখার জন্য চার পাঁচ হাজার টাকা। হাউ ব্রুটালি কমার্শিয়াল পিপল। বাঙালি পেশাদার হল না। ব্যবসাদার হয়ে গেল। অবশ্য এই নার্সিংহোমগুলি অনেকটাই অবাঙালি মালিকানাতে চলে। কিন্তু কোনো প্রতিবাদ নেই।
    ফোন ঢুকল একটা।
    রক্তিম। ও তুলল না। ইদানীং রক্তিমের সঙ্গে ফোনে কথা বলতেও ভালো লাগে না। এত বিশ্রী রকমের ফ্যানাটিক। ইগোইস্ট। প্রথমে বোঝেনি। তখন অনেক ওপর ওপর কথা হত। ভালো ভালো মিষ্টি মিষ্টি কথা। ফর্মাল। এখন আর আবরণ নেই। দ্যাট গাই ইজ গডড্যাম অ্য্রোগ্যান্ট। খুব তাড়াতাড়ি ওকে না বলে দিতে হবে। বাড়িতে ঝামেলা হবে । হোক। বাট টুপুর ক্যাননট টলারেট হিজ ভিউজ অন সার্টেন ইশ্যুজ। রামমন্দির। হনুমানজি। যদি রক্তিম মেচিওরড হত , নিজের বিশ্বাসগুলো নিজের পকেটে রাখতো, তাহলে তবু একটা কথা ছিল। কিন্তু ও ওর সব ফেইথ টুপুরের ওপর চাপাতে চায় ।

    রক্তিমের সঙ্গে কখনো প্রেম হয়নি ওর। এখন বুঝতে পারছে। যেটা হয়েছিল সেটা একটা সামাজিক এগ্রিমেন্ট । চুক্তি। বিবাহ নামক চুক্তির প্রিফেস। দুটি পরিবারের মধ্যে একটি চুক্তি। ভবিষ্যত প্রজন্ম পৃথিবীতে আনার একটি সামাজিক ছাড়পত্র। মুখবন্ধ । প্রথম প্রথম হুড়োহুড়ি । আউটিং । অলি পাব। তন্ত্র। কোলাঘাট। মলটল। টুপুরের জঘন্য লাগে কিন্তু গেছে। দুই বাড়িতেই মত ছিল।
    এখন রক্তিম ফোন করলেও দম আটকে যায় । এটা বাড়তে দেওয়া ঠিক না। হি ইজ ব্লাইন্ডলি ওপিনিয়নেটেড। মেল শভিনিস্ট। গা গুলিয়ে ওঠে। ফোন সুইচ অফফ করলো টুপুর। পরে বলে দেবে কিছু একটা। দিনকে দিন ছেলেটাকে ইনটলারেবল মনে হচ্ছে । ইনক্রেডিবলি সেলফিশ। এবং ভার্চুয়ালি টুপুরকে ডমিনেট করতে চাইছে। ডু দিস। ডোন্ট ডু দ্যাট। কেন সময় নষ্ট করছো। জয়েন আ সার্টিফিকেট কোর্স। এটা পরে এই কাজে লাগবে। ইউ ক্যান জয়েন ভাই মম'স বিজনেস।
    যদি বা টুপুর ফোন ধরে, কোনোমতে কথা সেরেই ফোন নাম রেখেই একটা বড় করে " দুঃশা-লা" বলে। তারপর টেনে একটা সিগারেট ।
    এখন এই সক্কালবেলা সেটার ধৈর্য্য নেই।

    ও দেবী , সমুদূদূরের দেবী,নীল জলের দেবী
    ঘরের মানুষ যাচ্ছে সমুদূদূরে,
    তাকে ফিরিয়ে এসো সময়মতো
    নৌকা ভরে দিয়ো মাছের গন্ধে , ও দেবী অম্বা।

    এটা অম্বা গান। সালমান হিন্দি গান জানে। এই গানটা শিখেছিল কোচিন বন্দরে । সোনারপুরের ছেলে সালমান , আলম, মজহার একসঙ্গে চলে গেছিল প্রথমে উড়িষা। তারপর সেখান থেকে কোচিন। ডিপ সী বোটে মাছ ধরতে যেত ওরা। ওদের চোখে সমুদ্রের নীল রঙের ছায়া। ওদের স্বাভাবিক কালো রঙে সমুদ্রের কন্দর থেকে উঠে আসা ঘন কালচে শ্যাওলার ছায়া। পাঁচ বছর সমুদ্রে ট্রলার নিয়ে ঘুরেছে ওরা। মাথার ওপর আকাশ আর চারপাশে শুধু জল। নোণা জলে শরীর কেঁপে কেঁপে বলিষ্ঠ হয়েছে। কলকাতার রাস্তায় সালমানকে ঠিক মানাচ্ছে না। টুপুর দেখল বাদশা আর বশিরের সঙ্গে নতুন মাছ বিক্রেতা ছেলেটা ভ্রূ কুঁচকে নিজের ঝুড়িতে পড়ে থাকা ল্যাদখোর ট্যাংরামাছগুলো দেখছে। যেন বিক্রিতে মন নেই। চুলগুলো মনে হচ্ছে কোনো এককালে কালার করিয়েছিল। সবুজ টবুজ হবে। এখন সেটা উঠে একটা বিচিত্র রঙ ধারণ করেছে। ওর মন নেই মাছ বেচাতে। বাদশা টাকা গুণছে। টুপুরের বাবা আজ দারুণ দেখেটেখে মাছ কিনল । ছাতে গাছে জল দিতে দিতে হাসল টুপুর। বুগনভোলিয়ার ঝাড় উপচে পড়ে চারদিক উজ্জ্বল । মালবিকা কিছুই দেখছেন না এইসব। এত সমাহার।
    ছেলেটা তখন সমুদ্রে ভাসছিল। থেঙ্গাপত্তনমের মাছশিকারী ও। কোচিন বন্দরেও কাজ করেছে। মালিক ছিল পি। ডিকসন। ভল্লাভলাই থেকে ডিকশনের নৌকাতে যখন সমুদ্রঅন্দরে গেছিল সালমান, তখন নৌকাতে সাড়ে সাতলাখ টাকার সরঞ্জাম ছিল। নীল। হালকা নীল। গাঢ় নীল। সবজে নীল। ক্রমশ ওরা ঢুকে যেত সমুদ্রের অন্তঃপুরে। যখন মাছ নিয়ে ফিরলো, তখন দেখলো লকডাউন হয়ে গেছে। থেঙ্গাপত্তনমে নোঙর ফেলে বসেছিল ওরা। একুশ লাখ টাকা লস হল মালিকের । বরফ নাই। মাছ রাখবে কী করে।
    ডিকসনের নৌকার মত শ ' খানেক নৌকা বন্দরে ফিরে লকডাউনে আটক। ছয় টন মত মাছ প্রতি নৌকাতে। দশ থেকে কুড়ি লাখ টাকার মাছ কম করে, সালমান আল্লার কিরা কেটে বলতে পারে। ও দেখেছে এশিয়ান সী বাস, সিয়ার মাছ। সমুদ্রের গভীরে জাল বিছিয়ে তুলে এনেছে মার্লিন আর সোর্ড ফিশ। ইয়েলো ফিশ টুনা। তাদের গায়ে আঁশটে গন্ধের সঙ্গে মিশে থাকে সমুদ্রের জোলো হাওয়া। টুপুর দেখলো নতুন ছেলেটার মুখে মাস্ক বাঁধা নেই। একটু লম্বাটে চোয়াল। টুপুরের বয়সীই হবে।
    বন্দরে যারা মাছ ধরে, গভীর সমুদ্রে বেরিয়ে যায় ট্রলার নিয়ে,তারা বিশ্বাস করে সমুদ্রের নোণা হাওয়া আর খাদ্যতালিকাতে মাছ, এই দুই হচ্ছে তাদের রক্ষাকবচ। তাই কোচিন বন্দরে আটক থাকার সময় ওরা না পরতো মাস্ক, না বজায় রাখত সোশ্যাল ডিস্ট্যানসিং । ক্যা হ্যায় উও চিজ?নৌকার পর নৌকা বাঁধা বন্দরে। পচা মাছের গন্ধ। কেনার লোক নেই। ওরা নিজেরা যতটুকু খেতে পারে। সে আর কতটুক?
    ওরা কলাপাতায় ভাত আর খরখরে ঝাল মাছের ঝোল খেয়েছে কিছুদিন। সরকার চাল সাপ্লাই দিয়েছে। বন্দর থেকে বেরোতে পারে না।
    টুপুর ওপর থেকে দেখে ছেলেটার খোলা হাতে বিলি কেটে গেছে সমুদ্রের হাওয়া। ও খোলা সমুদ্রে নাচছে। সমুদ্রে কোনো বাধানিষেধ নেই।
    সমুদ্রপারের মাছশিকারীরা নভেল করোনাভাইরাসের কথা কিছুই তেমন জানত না। হাওয়া ভালো ছিল না বলে মার্চের দশের পর সমুদ্রে যায় নি অনেকেই। বন্দরে আটকে থেকে কৈ মাছের মত ছটফট করেছে। তখন ওদের সঙ্গী ছিল এফ এম রেডিও স্টেশন। ভারতবর্ষের প্রথম কম্যুনিটি রেডিও। বিশেষভাবে ধীবর সম্প্রদায়ের জন্য। দিনরাত এফ এম শুনত ওরা। রোজ চাইত অম্বা গান শুনতে। ধীবররা অম্বা গান গায়। বিশাল নৌকা যখন টেনে সমুদ্রে নিয়ে যায় ভাঙা থেকে বা সমুদ্র থেকে নিয়ে আসে ডাঙাতে....হাপরের মত ওঠানামা করে কালো বলিষ্ঠ শরীর। তখন ওরা অম্বা গায়। লকডাউনে বারবার বলেছে এফ এমে। রিকোয়েস্ট । অম্বা গান দাও। সমুদ্রে যাব। সমুদ্র ছেড়ে থাকতে পারি না। এফ এম তখন গানের ফাঁকে নিয়ে এসেছে ডাক্তার। কাউনসেলার। বারবার বলছে মাস্ক পরো। বাইরে যেও না।
    পচা মাছের গন্ধ বেড়ে যাচ্ছিল দিনদিন। মালিক খেতে দেবে কেমন করে। সাতশ টাকার মাছ দুশো টাকাতে বিকেছে। নৌকা দাঁড়িয়ে । লোণা হাওয়ায় বিষ। একটা লকডাউন কাটতেই সলমানরা বাড়ির পথে হাঁটা দিল।
    বাবা, ট্যাংরা মাছক'টা নিয়ে নাও।
    ছাত থেকে চেঁচাল টুপুর। চোখ তুলে তাকালেন ত্রিদিব ।
    - না না। তোর মা ঠিক হোক। তারপর ট্যাংরা ফ্যাংরা হবে। রাতে তো হোমডেলিভারি দেবেই। দুপুরের জন্য ঝামেলা দরকার নেই।
    সালমান তাকাল ওপরের দিকে। কটা চোখ। এখনো সমুদ্রের রঙ যায় নি।
    সমুদ্রে যেতে যেতে মনে সমুদ্রের রঙ ধরে যায় । নীল, হলদেটে নীল, আবছা সবুজ রঙের ঢেউ সব কোষের অন্তর্গত রক্তে খেলা করে। অতিমারী তাকে পুরোপুরি খেয়ে ফেলতে পারেনি।
    টুপুর দেখলো, এ ছেলেটা এখনো সমুদ্রে ভাসছে। এর সঙ্গে পালিয়ে যেতে পারলে বেশ হত। এত একঘেয়ে লাগছে যে এমনিতেই শ্বাসকষ্ট হবার উপক্রম।

    ✨ডিপ্রেশন

    একটা স্বপ্ন জ্বরের ঘোরে কেবলি মাথার মধ্যে প্রজাপতির মত ওড়াউড়ি করছিল। সে টের পাচ্ছিল। মাথাটা অসম্ভব হালকা তখন। একেবারে হাওয়ায় ভাসছে। ঠিক যেন প্যারাশুট নিয়ে শূন্যে উড়ছে । তারপর হঠাৎ দপ করে উঠে যাবে ওপরের দিকে। আর কিছু না। শরীর অসম্ভব হালকা। ভারমুক্ত হবার মধ্যে একটা গভীর ভয় থাকে।
    তারপর অভ্যেস হয়ে যায় সব।
    এক গভীর উপত্যকার পাশে বসে আছে একা। মা। কেমন রুক্ষ পাহাড় চারদিকে। গাছ পালা নেই। একটা সরু ঝর্ণা । তাতে জল নেই তেমন। সে অনেক ওপর থেকে চেঁচিয়ে চেঁচিয়ে বলছে, মা, উঠে এসো। আমি এখানে।
    মা তাকাচ্ছে না। ঘাড় ফেরাচ্ছে না। হাতে একটা ভাঙা গাছের ডাল। সেটা দিয়ে পাথুরে মাটিতে দাগ কাটছে। পিছন থেকে দেখা যাচ্ছে অতটুকুই। সে যেন আবার ছোটোটি হয়ে গেছে। হাফপ্যান্ট । সোয়েটার মায়ের বোনা।
    পরে সে এটা নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করেছে। নিশান্ত এসেছিল চেক আপ করতে। এখন সে কোভিড নেগেটিভ।
    - নিশান্ত, ডু ইউ থিংক ইট নেচারাল?ইজ ইট পসিবল? আই ড্রেমট দিস। আর আমার মা ডিপ্রেশনে চলে গেছে। ইন রিয়ালিটি। অথচ তখন তো আমি জ্বরে অজ্ঞান প্রায় । দিদুন যে নেই জানিই না। দিদুন ইউ নো, মাই গ্র্যান্ড মম। মায়ের মা।
    শী ডায়েড অব কোভিড । হ্যাড কো মর্বিডিটি।

    নিশান্ত খুব স্ট্রিক্ট ডাক্তার । বাড়িতে রেখে দেবরূপকে ট্রিটমেন্ট করেছে। প্রচুর রিস্ক ছিল। নেহাত বয়স অল্প, হার্ট লাংস স্ট্রং এবং কো মরবিডিটি নেই বলে ঝুঁকিটা নিয়ে নেয় সে। অ্যান্ড অব কোর্স অদিতি। সে মেয়ে পাহাড়ের মত সবদিক সামলেছে। নিজের বাড়িতে তার মা এখনো ফিরতে পারেননি। কলকাতায় আটকে আছেন মুমতাজ । মেয়ে বাড়ি এবং অসুস্থ দেবরূপকে দেখাশোনার কাজ করে গেছে চুপচাপ। নিজের অফিশিয়াল কাজ তো আছেই। শুধু ডকুমেন্টারির কাজ বন্ধ রেখেছিল কয়েকদিন। অদিতি সাপোর্ট না দিলে নিশান্ত পারতো না এতটা। হাই ফিভার। বাট হি কুড ম্যানেজ ইট সামহাউ। দেবরূপ হ্যাজ কাম আউট অব কোভিড পজিটিভিটি।
    - হতে পারে। সামটাইমস মাইন্ডস ক্লিক। অ্যান্টিসিপেট করেছে তোমার সাবকনশাস। ইউ ওয়ের ভেরি ক্লোজ।

    ছোট ছোট পায়ে মামাবাড়ির লাল সিঁড়ি বেয়ে নামছে বাবু। বাবা, মা, মামা, মামী সবাই ওপরে। প্রচন্ড গল্প হচ্ছে। হা হা করে হাসছে মামা। বাবু গুটিগুটি পায়ে দিদুনের ঘরে ঢুকছে । উঁচু খাটে ঠিকমত উঠতে পারে না। চাদর ধরে টেনে উঠতে গিয়ে একপাশে রাখা ইস্ত্রি করা জামাকাপড় সব পড়েই গেল। দিদুন বলছে, ছেড়ে দাও দাদান। আমি বলবো আমার কাছে পড়ে গেছে।
    সে গিয়ে দিদুনের কোলের মধ্যে । দিদুন পান খায়। মিষ্টি একটা গন্ধ মুখে। গায়ে বসন্তমালতী। সে বলে,
    আমাকে একটা পান সেজে দাও।
    দিদুন বলছে, না দাদান। পান খেলে দাঁত নষ্ট হয়ে যাবে। তোমার মা বকবে আমাকে। এই নাও। পানের বোঁটা খাও।
    সরু সরু আঙুলে সবুজ পানের বোঁটা ছিঁড়ছে দিদুন। আর সে চিবুচ্ছে। কুচকুচ করে পানের বোঁটা চিবুতে খুব মজা। মামাতো ভাই গোগোল এসে হাত পাতছে। দুই ভাইতে পানের বোঁটা চিবুচ্ছে। টুপুর জন্মায়নি তখনো। দুজনে দাপাচ্ছে দিদুনের কোলে। চশমা খুলে নিচ্ছে। চুল বেঁধে দিচ্ছে। মা এসে দরজা থেকে বলছে, এত জ্বালাচ্ছিস কেন রে আমার মা' টাকে? দু'জনে লুকিয়ে যাচ্ছে দিদুনের পেছনে।
    এইসব পৌষালী দুপুরকে ডিফাইন করবে "হাউ ক্লোজ দে ওয়ের?"
    হবে না। হবে না।
    এখনো শরীর পুরো ফিট নয়। নো ল্যাব। নো ক্লাস। নো স্ট্রে ফিডিং।
    অদিতি একটা কেক টেক জাতীয় কিছু বানাচ্ছে। ব্যাটারটা থেকে ভ্যানিলা টাইপের গন্ধ আসছে। ঘরোয়া ফিলিং হয় স্মেলটাতে। ধূপকাঠিও জ্বেলেছে বোধহয়।
    - অদিতি। দিস ইজ নট গুড ফর আস। ইউ নো।
    নিশান্ত খুব ঠান্ডা গলায় বললো। মৃদুভাষী। খানিকটা শরমান জোশির মত দেখতে।
    - হোয়াট?
    - দিস আগরবাত্তি। ইসকা ফ্রেগরান্স আচ্ছা নহি হ্যায় ইনসান কে লিয়ে। ইন ফ্যাক্ট ইট ইজ ভেরি টক্সিক। শুভ নট ইউজ ইট।
    - ও ইয়েস । আই নো। আজকে জ্বেলেছি। ঘরটা কেমন একটা জ্বর জ্বর গন্ধ করছিল। তারপর এত ফিনাইল আর ডেটল ইউজ করেছি যে আরো হসপিটাল হসপিটাল গন্ধ লাগছিল। সো আই প্রেফারড অ্যান ওকেশনাল আগরবাত্তি। স্যান্ডালউড। গুড ওয়ান।
    ডোন্ট ওরি। ইট ইজ নট আ রেগুলার হ্যাবিট।
    নিশান্ত ঘাড় ঝাঁকিয়ে উঠে পড়লো। কফি শেষ। হসপিটালে দৌড়াবে এবার।
    সন্ধেবেলা আবার আসবে নিশান্ত। কিংবা একটু রাতে। অদ্ভূত ঠান্ডা প্রকৃতির একটি ছেলে। স্টেথো বসায় যখন মনে হয় ধ্যান করছে। সন্ধেবেলা যদি আসে তাহলে ওর সঙ্গে শালিনীর দেখা হয়ে যায় মাঝে মাঝে। শালিনী এবং নিশান্ত পাঁচ বছর স্বামী স্ত্রী ছিল। দে ওয়ের ক্লাসমেটস। বিয়ে করার পর প্রথম তিন বছর কোনো সমস্যা ছিল না। তারপর দুজনেই সাফোকেট করতে শুরু করল। নিশান্ত এত ইনট্রোভার্ট, এত শান্ত, এত পারিবারিক এবং অন্ধভাবে মাতৃভক্ত যে শালিনীর মনে হত যে সে একটি কিশোরকে বিবাহ করেছে। অতএব তারা কোনো সন্তান নেয়নি । শালিনী অরুণাভ আগরওয়াল নামক এক ব্যবসায়ীর প্রেমে পড়ে এবং যেহেতু সে যথেষ্ট সৎ ও বলিষ্ঠ, সে প্রেমটা লুকোয়নি। অ্যান্ড দে গট সেপারেটেড। কোভিড না এসে পড়লে শালিনী আর অরুণাভর বিয়েটা হয়েই যেত।
    নিশান্ত যখন দেবরূপকে চেক আপ করে, শালিনী খুব মন দিয়ে দেখে। সে জানে যে নিশান্ত একজন সিনসিয়ার ডাক্তার। শী রেসপেক্টস হিজ স্কিল। তারপর ওরা পরস্পরের কুশল জিজ্ঞাসা করে। বাড়ির খবর।
    দেবরূপ আগে অবাক হত। এখন হয়না। ওদের মধ্যে প্রকৃতই কোনো বিদ্বেষ নেই। শুধু একত্রে থাকা অসুবিধে জনক। কমপ্যাটিবিলিটি নেই। নিশান্ত আগে উঠে পড়ে।
    কোভিড পজিটিভ কেস বেড়ে চলেছে। অলরেডি থার্টি ফাইভ ডেথ কেসেস ইন পুনে।

    দিদুন অনেক ধূপকাঠি জ্বালত। ঘরটা ধূপের গন্ধে ভরা। এক কোণে মস্ত সিংহাসন। এখন কি সেখানে কেউ নকুলদানা দেয়? মামী? অর হু এলস?
    মালবিকা ফোন করেননি আর। টুপুর জানাচ্ছে যা জানাবার। সে এখনো মা'কে জানাতে পারেনি যে তার কোভিড পজিটিভ ছিল। সে বলতে পারেনি তার হাই টেম্পেরাচার ছিল তিনদিন। প্রায় জ্ঞান ছিল না। শুধু বাবাকে বলেছে।

    সে ভুলে যেতে চায় যে নির্মাল্য সামন্ত সুইসাইড করেছে। সে একদম ভুলে যেতে চায় ।
    এখন শুধু মনে আছে যে দিদুন নেই। মালবিকার কাছে যাওয়া খুব দরকার । কিন্তু কোনো উপায় নেই।
    এই জ্বর থেকে ওঠা দুর্বল শরীরে তেমন সাড় নেই। অদিতি এত কাছে। কিন্তু কোনো উত্তেজনা নেই। এই শহরে তার বেশ কয়েক বছর হয়ে গেলো। কখনো একা লাগে নি। তার কারন গুচ্ছের বন্ধু এবং অদিতি শুধুমাত্র নয়। সেন্স অব সিকিউরিটি গোজ ব্যাক টু হোম। বাড়িতে সবাই ঠিকঠাক। মা তার নিজের কাজ, শখ, বাগান , সংসার । বাবা নিজের কাজে। টুপুর বেশ স্বাবলম্বী । দিদুন মামাবাড়িতে তার কোণের ঘরের রাজত্বে। এইসব হল কর্ণার স্টোন। একটা স্থিতি দেয়। সেগুলো সব নড়ে গেছে। এখন কোনো স্থিতাবস্থা নেই। ঘড়ির কাঁটা তবু নড়ে না।
    অদিতি কাজ শেষ করে ফিরবে। আপাতত ও হসপিটালগুলো সার্ভে করছে। সিম্পটোম্যাটিক আর অ্যাসিম্পটোম্যাটিক কেসেস। অদিতি অতি সিনসিয়ার কর্মী। তার স্বাস্থ্য ভাল। এবং ভয়ডর কম।

    হাতের কাছে খবরের কাগজ আর পত্রিকা ডাঁই করে রাখা। অনেকদিন কাগজ পড়েনি। ল্যাবের কাজে ডুবে থাকা।
    রোদ চড়া হচ্ছে দ্রুত । চোখ জ্বলে। ওর,পূবের ব্যালকনির সমস্ত ঝলসানো রোদ শুষে নিচ্ছে ফ্রিডা কাহলোর চুল।
    কাগজের পাতা ফড়ফড় করে উড়ছে। এসি চালানো যাবে না। যদিও ও ঘামছে। ফ্যান চলছে হাল্কা স্পীডে।
    মার্কেজ মস্ক। মালয়েশিয়া । ফেব্রুয়ারি । গ্লোবাল ইভান্জেলিক্যাল। একটি মুসলিমঅরগানাইজেশন। তখনো ভারতে আন্তর্জাতিক বিমান চলাচল বন্ধ হয়নি। মার্চের তিনে নিউ ইয়র্ক টাইমস বলছে এই জমায়েত দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ার বৃহত্তম ভাইরাল ভেক্টর।
    ও কাগজ উল্টে যাচ্ছে । কই। এগুলো তো ফলো করেনি তখন। মোহম্মদ সাদ কান্দাহারি তাবলিঘী জমায়েত ডাকছেন। নিজামুদ্দিন ওয়েস্টে সাড়ে চার হাজার থেকে নয় হাজার মানুষের জমায়েত ডাকলেন। ছ'শো কুড়ি জন কোভিড পজিটিভ ঐ জমায়েতে। প্রচারকরা এসেছিলেন মালয়েশিয়া আর ইন্দোনেশিয়া থেকে। তখনো ইউনিয়ন হেল্থ মিনিস্ট্রী বলছে যে করোনা ইমার্জেন্সি নয়। প্যানিক করার দরকার নেই। ঠিক সেই সময় দিল্লিতে চব্বিশ । কর্ণাটকে আটাত্তর। তেলেঙ্গানা মহারাষ্ট্র বর্ডারে আটকে দিয়েছে বত্রিশজন প্যাসেঞ্জার ।
    ইয়েস। কুড হ্যাভ বিন মোর কশাস।
    মকরন্দ ঠিক বলে।
    ইন্টারন্যাশনাল ফ্লাইটস বন্ধ করে দরকার ছিল সবার আগে। দ্যাট ওয়জ র্যাশ।
    জ্যাকারান্ডা। ওরেন্জ। সাদা। লাল। মাথা দোলাচলে ওর মাথা ঘোরে। বাথরুমে যাওয়া দরকার। দেওয়াল ধরে ধরে যায় । ঈষৎ টলছে মাথা। মার্চের প্রথম সপ্তাহ পর্যন্ত হেল্থ মিনিস্ট্রী অভয় দিয়ে গিয়েছে। সো হাউ কুড ওয়ান স্টপ এনি গ্যাদারিং?
    জমায়েতে জম্মু ও কাশ্মীরের প্রতিনিধি যিনি ছিলেন তিনি শ্রীনগরের একজন ব্যবসায়ী । এয়ার। রোড। ট্রেইন। তিনটিই ব্যবহার করেছেন। তাঁর মৃত্যুর পর আটশ জন প্রচারককে ব্ল্যাকলিস্টেড করা হল
    সো মেনি থিংগস ওয়ের হ্যাপেনিং অ্যাট দ্যাট টাইম আর তারা কী ক্যালাস ছিল! কী অসম্ভব ইগনোরান্স।

    ভিটামিনের কারণে ইউরিন গাঢ় হলুদবর্ণ। এদেশে সবসময়েই চোর পালালে বুদ্ধি বাড়ে । দেওয়াল ধরে ফিরতে ফিরতে হাঁপ ধরলো।
    না। এখনো সম্পূর্ণ সুস্থ না সে। মা কে কিছু বলা যাবে না এখনো । বাট বাবা হ্যাজ বিন ইনফর্মড। বাবাকে বলা দরকার ছিল। অনেকটাই নিশ্চিন্ত বোধ করছে সে। বাবা বলুক মা'কে। দিদুনের চলে যাওয়া মানে অলমোস্ট উধাও হয়ে যাওয়া, বাবুর কোভিড পজিটিভ হওয়া, মালবিকার ডিপ্রেশনে চলে যাওয়া । সব যেন ঝড়ের বেগে প্যারালাল ন্যারেটিভ। দুর্বলতা সম্ভবত নার্ভের কারনে।
    মায়ের সঙ্গে কথা বলা দরকার। শী ইজ সাফারিং। কষ্ট পাচ্ছে। গুমরে গুমরে মরছে। দ্যাট ইজ ফেটাল। ভয়ানক । কিন্তু কী বলবে? মা, আমার কোভিড পজিটিভ এসেছিল , আমি তাই কথা বলতে পারিনি মা। অদিতি শিবরামণ, ডটার অব মুমতাজ আহমেদ অ্যান্ড মি.শিবরামণ হ্যাজ টেকন অল পসিবল কেয়ার। তোমার মতোই যত্ন করেছে মা। এইসব বলা যাবে একজন ডিপ্রেসড মানুষকে? না। নেভার।
    রোদ এখন অন্য চেহারা নিয়েছে। মেঘ এসেছে নিশ্চয়ই আকাশে। কেমন নবদূর্বাদলঘনশ্যাম হয়েছে ব্যালকনি। কতদিন বাইরে যাওয়া নেই। স্ট্রে ফিডিং নেই।
    নিথর। নিস্তরঙ্গ । বিছানার প্রাণ জীবন।
    কাগজের পাহাড় বেডসাইড টেবলে। তলা থেকে টেনে টেনে একটা রাইটিং প্যাড বের করলো। পেন মাথার কাছেই থাকে হেডবোর্ডে। একটা ফুলদানিতে ফুল রেখেছে অদিতি। গন্ধবিহীন। পেন নিল একটা। স্পিডপোস্ট অ্যাক্টিভ আছে এখনো। অদিতিকে বলবে পোস্ট করে দিতে। জীবনে এই প্রথম।
    জানলার পর্দা উড়ছে। বাইরে বেশ হাওয়া তার মানে।
    ও লিখছে, ডিয়ার, ডিয়ারেস্ট মা....
    তারপর কেটে দিল। বাজে। কী লিখবে? শ্রীচরণেষু? হেসে ফেলল নিজেই
    তারপর লিখলো , .মা.......

    ✨শ্রীচরণেষু

    জন্মিলে মরিতে হবে

    এখানে বেশ গরম মা। কলকাতার মত ভ্যাপসা গরম না। কিন্তু রোদের তাপ খুব। সেই রোদ লেগেই বোধহয়, জ্বর এসেছিল খুব। জ্বর এসেছিল শুনে চিন্তা কোরো না। এখন ভালো আছি। তোমাকে বলেছিলাম আমার বন্ধু নিশান্তের কথা। ও দু' বেলা দেখে যাচ্ছে। অন্য বন্ধুরাও আছে। সবাই আসছে আমি একদম ফিট অ্যান্ড ফাইন। ভালো আছি মা

    তুমি ভালো নেই। আমি জানি। ফোন ধরতে পারিনি। দিদুন চলে গেল। আমরা ছোটবেলায় বলতাম তারা হয়ে গেল। তুমি তো শিখিয়েছিলে মা, কেউ মারা গেলে তারা হয়ে যায় । আমরা বাবার ঠাম্মার তারা দেখতাম। ঠাম্মা যখন চলে গেলেন, তখন আর আমরা তারা দেখতাম না। তখন বোধহয় আমি ক্লাস এইট। জেনে গেছি যে মরে গেলে কেউ তারা হয়ে যায় না। কোথাও চলেও যায় না। অমৃতলোক টোক বলে লোকে শুধু সান্ত্বনা দেয় নিজেদের। আসলে পুড়ে ছাই হয়ে যায় । অথবা কবর দিলে মাটির নিচে শরীর মিশে যায় মাটিতে। আমাদের হিন্দু মতে পুড়িয়ে দিলে ছাই। পঞ্চভূতে মিশে যায় । এই তো ভালো, তাই না মা? এখন ঠাম্মা, দিদুন এরা সবখানে আছে। বাতাসে, মাটিতে, জলে, আগুনে। তোমার চারপাশে দিদুন তোমাকে ঘিরে আছে।

    তুমি তো জানো আমি কেউ মারা গেলে রিপ লিখি না। কোনো শ্রাদ্ধানুষ্ঠানে যাই না। শ্রাদ্ধবাড়িতে খাই না। কতদিন তুমি কত বকাবকি করেছো সেইজন্যে। বাবা পর্যন্ত । তবু যেতাম না। একবার তুমি রাগ করে মেরেছিলে। তখন বেশ বড় আমি । টেন। চড় মেরেছিলে।
    আমি তো কোনোদিন শ্রাদ্ধানুষ্ঠানে বিশ্বাস করতে পারিনি। তুমিই শিখিয়েছিলে মা, শ্রাদ্ধ শব্দটা এসেছে শ্রদ্ধা থেকে। অধিকাংশ শ্রাদ্ধবাড়িতে ইউসুয়ালি শ্রদ্ধাটা থাকে না। আর শ্রদ্ধা যদি থাকে , তবে তার জন্য কোনো রিচুয়ালস দরকার নেই। অন্তত আমি তাই ভাবি।
    তোমরা আমাকে বাড়ির কাছে নামকরা ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলে পড়াতে পারতে মা। কিন্তু সেটা না করে তুমি আমাকে পাঠালে মিশন স্কুলে। ছেলে যাতে সদাচারী হয়। সংস্কারী হয়। তুমি তোমার শান্তিনিকেতনের শিক্ষা দীক্ষা , পরিশীলিত বোধ
    দিয়ে আমাদের বড় করতে চাইতে। মিশনে আমরা প্রার্থনা করতে করতে কোনো ঈশ্বরকে খুঁজিনি মা। ওখানে সবাই কেরিয়ার খুঁজতো। কী করে অ্যামেরিকা যাওয়া যায় । আমার তো মনে হয় একটা ব্লগ তৈরি করা যায় " কী করে এন আর আই হওয়া যাবে? " তাই সবাই কেরিয়ার বানাতে যেতো। যায়। কেউ স্বার্থ ত্যাগ করা শিখতে যায় না। কেউ নিরহঙ্কার হতে যায় না। কেউ ভালোবাসতে শিখতে যায় না।
    যদি হয়, সেটা তার নিজের গুণে। ওখানে না পড়ে বেলিয়াডাঙা হাইস্কুলে অথবা চম্পাহাটিতে পড়লেও একই ব্যাপার হত।

    সেটাও বড় কথা না। বড় কথা এই যে তুমি কষ্ট পাচ্ছো মা। কিছু আচার আচরণ পালন করতে পারোনি। দিদুনকে তো একদিন যেতেই হত। তাই না? তুমি দিদুনের শেষ সময় কাছে থাকতে পারোনি। ঠাম্মা যখন নার্সিংহোমে ছিল, তুমি সেই সকালবেলা স্নান করে নার্সিংহোমে চলে যেতে। দুপুরে বোধহয় একবার আসতে। স্নান করে, আমাদের সব গুছিয়ে, আবার চলে যেতে। রাতে ফিরতে। ক্লান্ত। বিষন্ন। ঠাম্মা বেঁচে থাকতে তোমাদের ভালোই খিটিমিটি ছিল। তোমার সেন্স অব ইন্টিরিয়রের সঙ্গে ঠাম্মার মিলত না। তুমি শখ করে ডিভান বানালে, ঠাম্মা বলল, এর চেয়ে খাট হলে ভাল হত। অতিথ এলে আরাম করে শুতে পারত। তুমি পুরোনো কলসী নামিয়ে তেঁতুল দিয়ে মেজে পিতলের কলসীতে ফুল রাখলে ঠাম্মা বিরক্ত হয়ে বলল, ঢং। তোমার থাই ফুড রান্না হলে ঠাম্মা প্রচন্ড চেঁচামেচি করতো। গন্ধ সহ্য হত না। ইভন তোমার চাকরি করা নিয়ে প্রায় রোজ ঝামেলা। আমাকে ঠাম্মা বলতো, তোদের মা তোদের ভালবাসে না। ঢং করে চাকরি করতে যায় সেজেগুজে। আরো খারাপ সব কথা বলতো। ইচ্ছে করে ভেজা গামছা মেলে রাখতো সামনের বারান্দাতে। বেসিনে জোরে জোরে থুতু ফেলা। কী বিরক্ত হতে তুমি। তোমার শখের আঁকা কুলোতে বড়ি দিয়ে রাখলো , বোধহয় ইচ্ছে করেই তোমার রুচিকে আঘাত করতো । আর তুমিও রাগতে রাগতে ক্লান্ত হয়ে যেতে । রুচিহীনতার বিরুদ্ধে বেশি চেঁচামেচি করাও রুচিহীনতা তো।

    তুমি প্রায় মাসখানেক উইদাউট পে লিভ নিয়েছিলে ঠাম্মা চলে যাবার সময় । রোজ ঠাম্মার নার্সিংহোমে যেতে। ঠাম্মা তখন কোমাতে।

    আসলে এটা তোমার নিজের স্যাটিসফ্যাকশন ছিল মা। এই যাওয়া । গিয়ে বসে থাকা। ক্লান্ত হয়ে ফেরা। যে কোমাতে চলে গেছে, সে এতসব কিছু টের পেত না। ভেন্টিলেশন আর ডাক্তার ছাড়া তার আর বিশেষ কিছু প্রয়োজনও ছিল না।
    দিদুনের শেষ সময় কাছে থাকতে পারলে তোমার ভালো লাগত হয়তো। যে তুমি থাকতে পারছো। সেটা তোমার সেল্ফ স্যাটিসফ্যাকশন । তাতে দিদুনের শরীরের কষ্ট কিছু কম হত না মা। ফ্যাক্ট। আর কে কোথায় পুড়ে গেল এই নিয়ে একদম ভেবো না। প্রাণহীন শরীরের কী হল তা নিয়ে অত,ভাবতে নেই। আমার তো পার্সিদের পথ বেশ লাগে। টাওয়ারে রেখে দেয় । শকুন খেয়ে যাবে। কাক শকুন খেয়ে যাওয়া খুব খারাপ ব্যাপার না মা। কিছু প্রাণীর একদিনের পেট তো ভরে। ঠান্ডা মাথায় ভেবে দেখো। আমি কিন্তু বলছি তুমি দিদুনের জন্য কিছু রিচুয়ালস করো। যা তোমার মন চায় । লকডাউনের মধ্যে যেটুকু সম্ভব । আল্পনামাসিকে ডাকো একদিন । দিদুনের ছবির সামনে গান গাইবে। আর দু একজন থাকল।

    তুমি কি খুব ভয়ংকর রেগে গেলে মা? প্লিজ। রেগে যাও। দিদুন যেভাবে যাবার ছিল সেভাবেই গেছেন। জ্ঞান তো ছিল না, কিছু বুঝতেই পারলেন না। সেটা মন্দের ভালো। তুমি রেগে ওঠো মা । আমার ওপর ভীষণ রাগ করো। রেগে জ্বলে ওঠো।

    আমি এখন ভালো আছি। একদম জ্বর নেই । তোমাকে একটা ভিডিও কল করতেই পারি, না? যদিও ভিডিও কল আমার ঘোর নাপসন্দ, তুমি করলে রেগেও যাই, তবু ঠিক এই মুহূর্তে তোমাকে দেখতে ইচ্ছে করছে। খুব।

    তুমি একটা পাটভাঙা শাড়ি পরো মা। বিকেলে স্কুল থেকে ফিরে গা ধুয়ে যেমন হাল্কা করে সাজো ঐরকম যেন দেখি ভিডিও কলে। দিদুন তোমার চারপাশে মিশে আছে। টুপুরের মধ্যে আছে। তুমি তৈরি হও। আমি আসছি।

    এই পর্যন্ত লিখে থামল। ভাবলো। ভাবলো ছিঁড়ে ফেলবে কিনা। পড়ন্ত বিকেলের রোদের মায়া বড় সাংঘাতিক । ভীষণ ইচ্ছে করলেও এখন মা' কে গিয়ে জড়িয়ে ধরার উপায় নেই। কে জানে। মায়ের হয়তো দিদুনের জন্য একই অনুভূতি হচ্ছে।

    বন্ধ বাড়ির সামনে এসে চুপ করে দাঁড়িয়ে রইলো শ্যামা। চারদিক শুনশান। করে জল এলে লোকজন বেরোবে। তার আগেই ঢুকে পড়া ভালো। পুলিশ ঘুরছে যতক্ষণ ততক্ষণ কেউ বেরোবে না। কিন্তু ঘরে পা দিতে বুক ঢিপঢিপ করে শ্যামার। ঐ তো দুখানি ছোট ঘর। চৌকিতেই সবটা আটক প্রায় । তবু। খালি তো। সুখন। শাশুড়ি । নাই। ছেলে । নাই। ভাবতেই হা হা করে উঠে মন বলল, আছে, আছে, ছেলে আছে। এই ঝুল ময়লার মধ্যে কী তাকে আনা যায় ।
    বুকে জোর এনে তালায় চাবি দিল শ্যামা । ঘরে পা দিতেই পায়ের ওপর দিয়ে সুড়সুড় করে বেরিয়ে গেল ইঁদুর। একবুক দীর্ঘশ্বাস উঠে এল। কেমন যেন দুর্বল । মাথাটা ঘুরে উঠল হঠাৎ । ধুলোমাখা মেঝে। বিছানার চাদর এলোমেলো। শাশুড়ির চৌকিতে মরামানুষের ছোঁয়া যেন খপখপ করে খেতে আসে। শ্যামা হাতপা এলিয়ে বসে পড়ে। হরপ্রীত সঙ্গে থাকলে বড় ভালো হত। কিন্তু এই সময় তার হোমডেলিভারি থাকে। কাজ শেষ করে বাবলুকে নিয়ে আসবে সে।
    জানালা খুলে দিল শ্যামা । টুসিবৌদির জানালা বন্ধ যেন জনমনিষ্যি নেই বাড়িতে । এ কী শ্যামার নিজের ঘর? বুকের ভেতর চিন চিন করে ব্যথা করে উঠল। চাদরটা একটানা তুলে বালতিতে রাখল শ্যামা। কোমরে শাড়ির আঁচল জড়িয়ে তোষক ঝাড়তে শুরু করল । মোটা তোষক। সুখন শখ করে বানিয়েছিল। ঝুল ঝাড়ু দিয়ে ঝুল ঝাড়ল দুই ঘরের। শাশুড়ির চৌকির তোষকটা হ্যাঁচকাটানে তুলে বাইরে রেখে দিল। মরা মানুষের জিনিষ ঘরে না রাখাই ভালো। বড়দিকে দেখেছে। শাশুড়ি মরার পর, খাট, তোষক, বালিশ সব ফেলে দিল। দিয়ে দিল। কেমন আছে বউদি কে জানে! ফোন করেনি কয়েকদিন হল। করোনা হল কী বাড়িতে কারু? শ্যামার ফোনে টাকা ভরা নেই। শাশুড়ির চৌকিতে ঠাকুরের আসনে রাখা গঙ্গাজল নিয়ে ছেটাল শ্যামা। তারপর একটা ভেজা কাপড় দিয়ে মুছতে মুছতে ভাবল যাবে একবার বউদির কাছে। ঐ মানুষটার কাছে যেতে বড় ইচ্ছে করছে।
    মে মাসের আট তারিখ। রোদ চড়চড় করছে। পুলিশ চলে গেছে বোঝা যাচ্ছে। বস্তির সব বেরোচ্ছে এক এক করে। মাতালামি চলছে । বেলির বর বেহেড মাতাল হয়ে গাল দিচ্ছে বেলিকে । বেলির বাচ্চা হবে আবার।
    মদের দোকান খুলে দিয়েছে সরকার। দশটা থেকে ছ'টা। আসার সময় দেখে এসেছে লিকর শপে লাইন । কালুরা সেই ধান্দাতেই বসে আছে। ভাবতেই শপাং শপাং ঝাঁটার বাড়ি মেঝেতে। তাড়াতাড়ি সাফসুতরো করতে হবে। বাবলুর চলে আসা দরকার । কতদিন দেখেনি ছেলেটার মুখ।
    আরশোলা হেগে রেখেছে। ঝাঁট দিয়ে তুললো শ্যামা। বড় ঘেন্নার জিনিস। ঘামে সপসপ করছে ভিজে। শাশুড়ির কাপড়জামা ক'খানা বান্ডিল করলো একটা। পরে কাচলেই হবে। চৌকিটা ফাঁকা পরে থাকলো। থাক। টেবিলের ওপর পাতা কাপড় আর নিজের বিছানার চাদরটা কেচে ফেলবে শ্যামা। সার্ফের পাতা দিয়েছে সেন্টার থেকে আসার সময় ।
    টেবিলে একটা ফোটো ফ্রেম। সদ্য বিয়ের পর তোলা । শ্যামা সুখন পাশাপাশি । একটু হাসি ঠোঁটের কোণে। বাবলুর বইখাতা গোছাতে গোছাতে ঋষি কাপুর দেখা দিলেন।

    মনটা একটু ভালো হল শ্যামার । কী ভালো সোয়েটার পরে লোকটা। হাসিটা কত মিষ্টি। দেখলেই মনে হয় বরফের পাহাড় । তাতে ঋষি কাপুর গড়াগড়ি খেয়ে গান করছেন। বাবলুর বাপ অবশ্য পছন্দ করতো না। বলতো মুখ তো না। বুলবুলি পাখির পাছা। বললে কী হবে। শ্যামার ঋষি কাপুরকে দেখে মন নাচে। ঋষি বললেন, কাম লিপটা লো জলদিসে। বারিষ আ রহা হ্যায় ।
    টিভির পেছনে বাইরের রাস্তার জানালা। এই সিনেমাটা দেখা অনেকবার। দামিনী । পুরনো সিনেমা। ঋষি কাপুর মীনাক্ষীকে বোঝাচ্ছে কিছু। এই সিনেমাতে ঋষি কাপুর ঠিক হিরো না। সানি দেওল বেশি হিরো। ঋষি একটু পিছিয়ে । শ্যামা তাও খানিকক্ষণ দেখল। কাজে প্রাণ এল। ঝটপট ট্যাংক খুলে ধোয়া একটা চাদর পাতল শ্যামা। শাশুড়ির চৌকি খালিই থাক। ঠাকুরদেবতার ছবি রেখে দেবে কিছু। আলনাটা ঝেড়ে ঝুড়ে গুছিয়ে ফেলল আলগা হাতে। কাজ করতে করতে সামনের দিকে হঠাৎ তাকাল শ্যামা ।
    আকাশে গোলাপি একটা মেঘ করেছে তখন।
    ঋষির মিষ্টি মুখের পেছনে জানালা দিয়ে উঁকি মারছে কালুর মুখ। বুলনও আছে। মাস্কগুলো গলাতে নামানো।
    স্পষ্ট দেখা গেল।
    আঁশবটি টেবিলের নিচেই রাখা। মাথার পাশে রগ দপ দপ করে জ্বলছে। শ্যামা প্রস্তুত। মেরেই মরবে।

    ✨ নাগপুর ক্যাম্প । বাইশ নং বেড।

    সুখনলালের ডানপায়ে একটা অদ্ভূত যন্ত্রণা হচ্ছে। হাঁটতে গেলেই পায়ের নীচ থেকে যন্ত্রণা চলে যাচ্ছে একেবারে হাঁটুর শিরা পর্যন্ত। বিদ্যুতের বাড়ি খেলে যেমন যন্ত্রণার ঝলক ওঠে, ঠিক তেমন। অসহ্য ব্যথা। পা ফেলতে পারছে না। কিছু ঢুকেছে কিনা বোঝা যাচ্ছে না কারণ পায়ের তলা এতটাই ফাটা ও ধূলামন্ডিত যে তার মধ্যে দিয়ে সাধারণ চোখে কিছু বোঝা সম্ভব নয়। যারা খাবার দিতে এসেছিল, তাদের একজনকে বলেছিল। সে একটা ব্যথার ওষুধ দিয়েছিল বটে কিন্তু তাতে খুব সুবিধা হল না। অনবরত একটা দপদপানি ব্যথা পায়ে। তাদের একজনও দেখার চেষ্টা করেছে তলায় কিছু ফুটেছে কিনা। এত ফাটা পা , এত ময়লা যে কিছু ঠাহর করতে পারে নি । ওষুধটা খেয়ে চোখ বুজে খানিক বসেছিল সুখনলাল । এই কয়েকদিনে তার এমন হাট্টকাট্টা শরীর যে এত দুবলা হয়ে যাবে তা কেই বা ভেবেছিল।
    হঠাৎ জুহির মুখ মনে পড়ল চোখ বুজে। খুবসুরত ছিল বটে মেয়েটা কিন্তু ঘরে মন ছিল না। ছয়েলছবিলি টিইপ। মুম্বাইতে গিয়ে কয়েকদিনের মধ্যেই বুঝে গেছিল সুখন। সে বেরিয়ে যেতেই ছুঁড়ি এদিক ওদিক ঘুরে বেড়ানো ধরেছিল। শখ করে কটা বাসন এনে দিয়েছিল সুখনলাল। রান্নাবান্না করতোই না জুহি। বায়না ধরতে বাইরে খাবে। কে জানে এখন কোথায় খেয়ে বেড়াচ্ছে। ভেগে গিয়েই তো ফোনের সিম কার্ড পাল্টে নিয়েছিল। সুখন ফোন করে করে হয়রান। তারপর আর চেষ্টা করেনি। কী হবে ভেবে। যে চলে যাবার সে গেছে। ফিরবে বলে তো যায়নি। যাদের সুখন ছেড়ে এসেছে তারা কী করবে সুখন ফিরলে?
    শ্যামার মুখ ইচ্ছে করেই মনে করতে চায় না সুখনলাল। সে কী মূর্তি ধরবে তা বলা ভগবানের বাপেরও অসাধ্যি। ছেলেটার মুখ ভাবে।
    পা দপদপানি আবার বাড়ে।
    সুখন বলিরামকে বলল, আরে দেখ জারা। কুছ জারা দর্দ লাগতা হ্যয়। বলিরাম যাদব বছর চব্বিশের যুবক। মুম্বাইতে দেওয়াল প্লাস্টার করতো। দিনে তিনশ টাকা কামাই ছিল। তাও শেষ মাসের মাইনে পায়নি। বলিরামের হাতে একটা বাটিতে ছাতু। তার মধ্যে মিশিয়েছে ডাল ভেজানো। যব। লঙ্কাকুঁচি। বাটি নিয়ে এসে বসলো সুখনের পাশে।
    পা দেখল। বলিরামের নিজের পাও ফেটে চৌচির। দেখল। সুখনের পা দেখল যতটা দেখা যায় । কিছু ঢুকেছে কি না বোঝা গেল না। সুখনলালের পেট এখনো দুর্বল। মুখ একটু ভাত চায়। যা কিছু দিয়ে হোক। কিন্তু চাল নেই। ফুটিয়ে দুটো মুখে দেবার স্বপ্ন দেখা যাবে না।
    আপাতত ব্যথার তীব্রতা কমলে সুখনলাল একটু শ্বাস নিতে পারে। কোনো মলম লাগানো দরকার। পায়ের নিচের ফাটলগুলোতে ধিকিধিকি বেদনা। সারা শরীর অবশ করে দেয়। তারপর টেরেইন পাওয়া যাবে না শুনে মন আরো ভেঙে গেছে ।
    বীরোত্তমার বডি অনেক কষ্ট করে ডোম দিয়ে তোলা হয়েছে। মুষড়ে পড়ছে ক্রমাগত দলটা। ধুঁকছে । যেন আর কোনো আশা নেই।

    ছাব্বিশে মার্চ দু হাজার কুড়ি । নির্মলা সীতারামণ ঘোষণা করেন যে একশো সাত লাখ কোটি টাকা ব্যয় হবে শ্রমিকদের ঘরে ফেরার জন্য। ইউ পি তে যোগী আদিত্যনাথ বলেন, কেউ যেন হেঁটে ঘরে না ফেরে। চার হাজার দুশো সাতাত্তরটি শ্রমিক ট্রেন চলছে। সুপ্রিম কোর্ট জানিয়েছে কেন্দ্রকে। কেন্দ্র জানাচ্ছে রাজ্যকে। ষাট লাখ শ্রমিক। যারা নিজের জায়গা ছেড়ে অন্য রাজ্যে কাজে গেছে, কাজের অভাবে , তারা ফিরছে। ফিরছে কোনো সাপোর্ট সিস্টেম ছাড়াই। চার হাজার দুশো সাতাত্তরটি শ্রমিক স্পেশাল। ট্রেন বোঝাই হয়ে শ্রমিক ফিরছে ঘরে। ঘোর তর্ক বেঁধেছে কাগজে কলমে। তারা অভিবাসী না পরিযায়ী । সুখন বা বলিরাম । বীরোত্তমা বা শনিচারী। বুধন বা আজহার। শকিলা বা জানকি। কেউই মাইগ্রান্ট বা পরিযায়ী বা অভিবাসী শব্দের অর্থ জানে না। শোনেও নি। ট্রেনে ভিড় । খাবার জল নেই। গু মুতে ভরে গেছে ছোট টয়লেট। দুর্গন্ধ ছড়াচ্ছে ভারত আকাশে। ট্রেন চলছে কিন্তু সুখনলাল যেতে পারল না।
    নাগপুর মিউনিসিপ্যাল কমিশনার তুকারাম মুন্ধে কড়া লকডাউন রেখেছেন বাইশে মে পর্যন্ত। রেড জোন। যদিও তখন পর্যন্ত তিনশো চুয়াত্তর জন কোভিড পজিটিভ এবং তিনজন মৃত, এবং পরিসংখ্যান মতে এটা রেড জোন হতে পারে না। কেন্দ্রের সঙ্গে এই রেড জোন হওয়া না হওয়া নিয়ে একটি চাপান উতোর চলছে, কিন্তু ট্রাক কে ট্রাক পরিযায়ী শ্রমিকদের দল এসে পড়ছে নাগপুরে।

    যন্ত্রণার জ্বালা গিলতে গিলতে সুখন ভাবে, কোনোমতে একটা টিকেট যদি পাওয়া যেত। যদি একবার ট্রেনে চেপে বসা যেত।
    পেটের জ্বালা আর শরীরের যন্ত্রণা যখন একসঙ্গে পেড়ে ফেলে, মানুষ তখন আর দলের কথা ভাবে না। তখন সে একক। দলও তখন তার কথা বিশেষ ভাবে না। গোষ্ঠীবদ্ধতার নিয়মানুসারে দল এগিয়ে যায় । যে পিছনে থাকল তার দিকে তাকাবার সময় নেই কারু। আগে চলনা হ্যায়। বাড়িতে গেলে রুটি মিলবে। এখন বাচ্চারা আটা খাচ্ছে জল দিয়ে গুলে।

    সুখন আপাতত পড়ে থাকে। একা । হাঁটার ক্ষমতা নেই তার।

    স্বচ্ছ সর্বেক্ষণের জন্য দু হাজার ষোলো সালে নাগপুর বিবেচিত হয়েছিল। এমনকি এখানে খোলাজায়গায় মলমূত্রত্যাগও নিষিদ্ধ। পরিযায়ী শ্রমিকরা দলে দলে এসে পড়াতে শহরের পরিচ্ছন্নতা কিছু নষ্ট হয়েছে। ভারতবর্ষের শীত রাজধানী। ওরেন্জ ক্যাপিটল। কিন্তু এই বছর কমলালেবুর ব্যবসাতে তীব্র মন্দা। কেউ নেই। মানে কেনার লোক নেই।
    মুম্বাই থেকে প্রায় আশি হাজার শ্রমিক রওনা দিয়েছিল পায়ে হেঁটে। সুরাটের বেশ কিছু হিরে ব্যবসার শ্রমিকরাও ছিল। এরাও সংখ্যায় খুব কম নয়। এপ্রিল মাসে নাগপুরে কোভিড রোগীর সংখ্যা ছিল একশো আটত্রিশ। মে মাসে সেটা বেড়ে দাঁড়াল চারশো তিন।
    অমরাবতী ডিভিশনে পড়ে আকোলা, ইয়ভতমাল, বুলধানা, ওয়াসিম।
    নাগপুর ডিভিশনের আন্ডারে আছে নাগপুর, ওয়ার্ধা, চন্দ্রপুর,ভান্ডারা, গোন্ডিয়া, গাদচিরোলি।
    মে মাসের দশ তারিখে চব্বিশ ঘন্টার মধ্যে ভারতে তিন হাজার দুশো সাতাত্তরটি নতুন কোভিড কেস আসে। বাষট্টিহাজার নশো ঊনচল্লিশের সঙ্গে যুক্ত হল এরা। মৃত দু হাজার একশো নয়।
    পায়ে হেঁটে চলা শ্রমিকদের অধিকাংশই যাচ্ছিল মধ্যপ্রদেশ বা বিদর্ভর দিকে।
    সুরাট থেকে আসা শ্রমিকদের মধ্যে একশোদশজনকে আটকে দেওয়া হল। তারা কোভিড পজিটিভ। আকোলা ক্যাম্পে রাখা হল তাদের।
    নাগপুর ডিভিশনের কমিশনার সঞ্জীব কুমার প্রায় একই তৎপরতার সঙ্গে কাজ করলেন। কোভিড পজিটিভ রোগীদের ট্রেনে , সাইকেলে বা পয়দল , চলার ছাড়পত্র মিলল না। তাদের জন্য বরাদ্দ হল ক্যাম্প।
    বিশাখাপত্তনম থেকে রাজস্থানের করাউলির দিকে রওনা দিয়েছিল বেশ কিছু কনট্র্যাকচুয়াল লেবার। লকডাউন ঘোষণা হবার সঙ্গে সঙ্গে তাদের মালিক সম্প্রদায় তাদের কর্মচ্যুত করেছে। এরাও এসে আটকে পড়ে নাগপুরে।
    সুখনলাল যখন দলচ্যুত, একা, পায়ের তীব্র যন্ত্রণায় তার গা ভর্তি জ্বর, তখন নাগপুরে স্বেচ্ছাসেবকবাহিনী তাকে তুলে নিয়ে যায়। সুখনলালের পায়ের শিরা ফুলে ঢোল। কিন্তু এই সময় নাগপুরে সমস্ত মিডলেভেল হাসপাতাল বন্ধ । ট্রমা সেন্টার বন্ধ। ওপিডি বন্ধ। নাগপুর মিউনিসিপ্যাল কমিশনারের কড়া শাসন চলছে। কোনো কোভিড পজিটিভ রাজ্যের বাইরে যেতে পারবে না। সুখনলালের না হল পায়ে হাঁটা, না হল ফাঁকতালে ট্রেন ধরা।
    দল এগিয়ে গেল পায়ে হেঁটে। কারু জন্য কারু থামার সময় নাই।
    গোন্ডিয়া থেকে ডাক্তার দেখানোর জন্য এসেছিল অন্তঃসত্ত্বা সুমিরন। সরকারি মেডিক্যাল কলেজে তার চেক আপ ছিল। লকডাউন হয়ে যেতে সে আর ঘরে ফিরতে পারেনি। সেও ঐ রাস্তাতে পড়ছিল আচ্ছন্ন হয়ে। তাকে আর সুখনলালকে একসঙ্গেই তুলে নিয়ে গেল স্বেচ্ছাসেবকরা। সুমিরন। পোয়াতি স্ত্রীলোকটি গেল মেয়েদের ক্যাম্পে। সুখন ছেলেদের

    সুখনলালের পায়ের চিকিৎসা হবে কী? সমস্ত ডাক্তারের চেম্বার বন্ধ। ক্লিনিক বন্ধ। জ্বর দেখেই লালা পরীক্ষা হল সুখনের। কোভিড পজিটিভ হয়ে সুখনলাল মিস্ত্রি ঢুকল নাগপুর কোভিড ক্যাম্পে।
    জ্ঞান ফিরলো যখন সুখনের , তখন জ্বর কমেছে তার। পায়ের তলায় ব্যান্ডেজ বাঁধা। কড়া ফাটা পা। রক্ত চুঁইয়ে পড়ছিল যে ফাটল দিয়ে সেখানে নিশ্চয়ই কোনো মলমের প্রলেপ পড়েছে। একটু যেন কম ব্যথা। একটু যেন আরাম। সুখন চোখ বুজে একটা ঘোরের মধ্যে পড়ে রইল।
    ক্যাম্প খুব পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন। একটা ওষুধের গন্ধ আর ফিনাইলের গন্ধ ছড়াচ্ছে। কিন্তু সুখন কোনো গন্ধ পায় না। অনেকদিন বাদে একটা বিছানাতে শুয়ে আছে সুখনলাল। কেমন আশ্চর্য আরাম লাগছে তার। শরীর কী জিনিস! এই অবশ মুহূর্তে তার কিছু মনে হচ্ছে না। না জুহি, না শ্যামা, না বাবলু, না তার নিজের মা। এক পা চলার ক্ষমতা, ইচ্ছা কিছুই নাই। বাড়িতে যাবার কথাও মনে নাই এই বেহুঁশ বেদনায়। সুখন চিৎ হয়ে পড়ে রইল। এই চিৎ হয়ে পড়ে থাকা জ্বর গায়ে । হাঁটা নাই। খাবার আছে। খাবার ক্ষমতা নেই। সুখনলাল মিস্ত্রি । ক্যাম্প নাম্বার ছয়। বেড নাম্বার বাইশ। নাগপুর কোভিড ক্যাম্প।
    এই মুহূর্তে এটাই তার শ্রেষ্ঠ প্রাপ্তি।

    ✨আইসোলেশন।

    "আমরা এখন কনটেইনমেন্ট জোনে আছি নিকোল। উই আর কনফাইন্ড অ্যাট হোম। আমাদের নেকস্টডোর নেইবারস আর করোনা অ্যাফেক্টেড। উল্টোদিকেও । আওয়ার্স ইজ আ পশ এরিয়া। এখানে সবাই উচ্চ মধ্যবিত্ত । । ধনীও আছেন কিছু পরিবার। এদের মধ্যে একটি পরিবারের ছেলে হার্ভার্ডে পড়াশুনো করে। হি কেম ব্যাক টু উইকস এগো। এয়ারপোর্টে ওর জ্বর পাওয়া যায় । হি ওয়জ আসক্ড টু গো টু বাঙ্গুর । মাই গ্র্যান্ড মম ওয়জ ওলসো দেয়ার। শী ডায়েড। বাট দ্যাট গাই ডিডন্ট গো টু দ্য হসপিটাল । ও বাড়ি চলে আসে। লকডাউনের মধ্যেও রাতে বন্ধুর বাড়ি গিয়ে পার্টি করেছে। অ্যান্ড ফাইনালি হি ইজ সিক নাউ। কোভিড পজিটিভ। ইন দ্য হসপিটাল, আফটার হ্যাভিং ইনফেকটেড মেনি। হাউ আর ইউ নিকোল? স্টিল কনফাইন্ড অ্যান্ড ওয়ার্কিং ফ্রম হোম? তুমি তোমার নতুন বইটা আমাকে পাঠাবে? আই ওয়ান্ট টু রিড ইট। কে জানে, হয়তো আমাদের হাতে সময় কমে আসছে.....আই ব্যাডলি নিড ইওর বুক। আফটার দ্য ডেমাইস অব মাই গ্র্যান্ড মম, মাই মাদার হ্যাজ গন টু ডিপ্রেশন। মা ডিপ্রেশনে চলে গেছে। মোস্ট প্রবাবলি ইট ইজ আ ক্লিনিক্যাল কেস। আমার এই গ্লুমি কন্ডিশন থেকে বেরোনো দরকার । অন্যরকম পড়াশোনা করা দরকার। আমি অ্যানড্রোজিনাস মডেলটা নিয়ে আরো পড়তে চাই। নারী আর প্রকৃতিকে এক করে দেখার আউটডেটেড কনসেপ্ট এদেশে চলে এখনো । ইট হ্যাজ বিন ডিনায়েড অ্যান্ড রিভাইজড বাই ইউ। দ্যাট ওয়জ ইওর টপিক। আমাকে পাঠিও। আমি একটু দুরের ছোঁয়া চাই। অনেক দুরের। তোমার সমুদ্রের বাতাস পাঠাও নিকোল। তোমাদের অগাধ সবুজ। দূষণহীন কী? পুরোটা?

    মেইল সেন্ট। সেন্ট অপশন খুলে দেখে নিল গেছে কিনা। চমৎকার একটা হাওয়া বইছে। বহুদিন বাদে বৃষ্টি হচ্ছে এত। নিমেষের মধ্যে মেইল পৌঁছে গেল সাগরপারে নিকোল স্মিথের কাছে।
    নিকোল একটা সেমেস্টারে ক্লাস নিতে এসেছিল। পরিবেশ ও প্রতিরোধ বিষয়ক কাজ ওর। ইকোফেমিনিজম নিয়ে কয়েকটা লেকচার শুনেছিল ওর। তারপর থেকে যোগাযোগ । নিকোল জোনাস স্মিথ বঙ্গসংস্কৃতি বিষয়ে বিপুল আগ্রহী।
    খুবই স্বাভাবিকভাবে সহজ মেয়েটি। সোনালি চুল অনেকটা লম্বা। তরল বাদামি চোখ।
    হোয়াই হ্যাভ ইউ পুট ট্যাটুজ লাইক দিজ?
    সাধারণত বিদেশিরা ব্যক্তিগত প্রশ্ন করে না। কিন্তু নিকোল ঠিক গতে বাঁধা মানুষ নয়। তাছাড়া দুজনের মধ্যে তখন আদান প্রদান গডীর। বিজ্ঞানের ছাত্রীকে নিকোল পড়িয়েছে মার্গারেট অ্যাটউড। ও নিকোলকে হাত দিয়ে খেয়ে আঙুল চাটতে শিখিয়েছে।
    - আই লাভ দেম। সিম্পল। আমার ভালো লাগে ওদের। টিকটিকি । গিরগিটি। বেবুন। বাদুড় । সাপ। এই দ্যাখো। এই হাতে । এটা পাইথন। লুক। বিউটিফুল স্কিন। ভালো না?
    নিকোল তার গোল চশমার মধ্যে দিয়ে খুব মন দিয়ে দেখে এই শিল্প কীর্তি। বডি আর্ট।
    - ডাজ ইট পেইন?
    - নট নাউ। ইট পেইন্ড ওয়েন ইট ওয়জ ডান।
    যন্ত্রণা । শারীরিক । মানসিক। সাধ করে শরীরে যন্ত্রণার স্বাদ।
    নিকোলের ট্যাটুতে আগ্রহ নেই। ও পটের গান শুনতে মুর্শিদাবাদ চলে গেছিল। সেখানে মেয়েদের পটের গানে পরিবেশদূষণমুক্তির কথা আছে। শী ইজ ব্যাক টু হার প্লেস ইন ফেব্রুয়ারি ।
    নিকোল একটি বই লিখেছে। অ্যান ইকো ফেমিনিস্ট অ্যাপ্রোচ টু এনভায়রনমেন্ট অ্যান্ড পল্যুশন। কোভিড রিলেটেড কিছু চ্যাপ্টার আছে তাতে। ঠিক কোভিড নাইন্টিন নয়। কিন্তু ভাইরাস জনিত। নিকোলের বই লেখা হয়ে গেছিল উনিশের ডিসেম্বরে।
    কি করে হয়? সেই অনিবার্য হলিউডি ফিল্মগুলো, যেগুলো বহুদিন আগে থেকেই ভাইরাসঘটিত ধ্বংসের কথা বলে আসছে, সেগুলো কিভাবে সম্ভবপর হয়ে ওঠে!
    অ্যান্ড স্টিল সাম পিপল সে দ্যাট দ্য ভ্যাকসিন ইজ গোইং টু টেক এন্ট্রি। গশ!
    তার মা। মা মাঝেমাঝে ডুকরে উঠছে। কবে যে ভ্যাকসিন বেরোবে!
    সে বুঝে পায় না যে কি করে? যাস্ট কি করে কিছু অ্যাডাল্ট এবং শিক্ষিত মানুষ এটা ভাবে যে করোনার ভ্যাকসিন খুব দ্রুত আবিষ্কার হবে এবং ম্যাজিকের মত করোনা হাওয়া হয়ে যাবে। ইট ইজ সিম্পলি নট পসিবল। সম্ভব নয়। খবরের কাগজ আর মিডিয়াও তেমন। রোজ একটা হেডলাইন করছে। আগস্টেই আসতে চলেছে করোনার ভ্যাকসিন । আর লোকে নেচে উঠে বাজারে চলে যাচ্ছে গ্রীষ্মকালে পেঁয়াজকলি কিনবে বলে। ডিসগাস্টিং।

    ইরফান স্বপ্নমেদুর চোখে তাকালেন।
    - ইতনা গুস্সা কিঁউ? শান্ত রহো।
    - আই ফাইন্ড দিজ পিপল এক্সট্রিমলি সিলি। দে থিংক করোনা ভ্যাকসিন উইল অ্যাপিয়ার ম্যাজিক্যালি। অ্যান্ড থিংগস উইল বি দ্য সেইম অ্যাজ বিফোর।
    - উও তো চাহেঙ্গে লোগ। ইসমে ক্যা দোষ হ্যায়?
    - সেটা তো হবে না। ভ্যাকসিন এত দ্রুত মার্কেটে আসবে না। আসতে পারে না।
    - কিঁউ?
    - এক্সপেরিমেন্ট করবে নাকি? আগে পশুদের ওপর। তারপর মানুষের ওপর। ভ্যাকসিন দিয়ে অপেক্ষা । সাইড এফেক্ট হচ্ছে কিনা দেখতে হবে। তারজন্য সময় চাই। আর এরা দিনক্ষণ বলে দিয়ে পাবলিককে ঢপ দিচ্ছে।
    ইরফানের চুল উশকোখুসকো। বেশ খানিকটা রোগা লাগছে তাঁকে। না কামানো দাড়ি। কাঁচা পাকা।
    - মুশকিল ইয়ে হ্যায় কি তুম বহোত জ্যাদা শোচতে হো। ইতনা শোচো মত। লোগোকো আগর ইয়ে ভিশওয়াস রহে কে ভ্যাকসিন আগস্টমে নিকল আয়েগা, তো ক্যা বুরা হ্যায়? ভাবুক না। লেট দেম থিংক দ্যাট আ সলিউশন উইল কাম। দে উইল বি হ্যাপি উইদ ইট। ইট ইজ ইমপরট্যান্ট টু বি হ্যাপি । হ্যায় না?
    - ফলস হ্যাপিনেস।
    - বহোত কড়োয়া শোচতে হো। পিঘল যাও। ঐ যে কী বলে বাংলামে, আশায় বাঁচে চাষা...
    ও হেসে ফেলে। হালকা টোল হাসলে।
    - আচ্ছে লাগতে হো যব হাসতে হো!

    - তুমি মাছ খাও ইরফান?
    - জরুর। ওয়াইফ বেঙ্গলি হ্যায় । ফির আদত সে খাতা হুঁ।
    - লকডাউনে কত কোটি টাকার মাছ নষ্ট হয়ে গেল বলোতো। এই লস ওরা মেক আপ করবে কীভাবে?
    - শোচনা মত। সমন্দরমে যো যাতা হ্যায় উসকা কলিজা তাকতওয়র হোতা হ্যায়। বহোত সক্ত। আপনা ক্যা হ্যায় উসকে পাস! জমিন ভি নহি। বাস উও ট্রলার, মছলি পকড়নেকা চিজ। মছলি।
    ফিরসে বানায়েগা।
    - সাতশো টাকার মাছ পাঁচশো টাকাতে বিক্রি হচ্ছে। আর আমরা খেয়ে মোচ্ছব করছি।
    টিকটিকি বলল, ঠিকঠাক।
    ইরফানের ঈষৎ কোঁকড়ানো চুলে বুগনভোলিয়ার দোল।
    - বানা লেতা হ্যায় আদমি। কিসি না কিসি তরহা কাম বন যাতা হ্যায় ।

    ও। টিকটিকি ও ইরফান। তিনজন বিষন্ন প্রাণী বসে আছে। সম্পর্কহীন সংসর্গে। ভারহীন। এইরকম বসে থাকার মাঝখান দিয়ে বাতাস বয়ে যায় । কিছুক্ষণের জন্যে হলেও অলীক বাতাস ভালো। ওরা কেউ সম্পর্কিত নয়। তাই নিশ্চিন্ত। ভারহীন। দায়হীন।
    টিকটিকি বললে- এটাই ভালো বুঝি? তুমি কিন্তু এসকেপিস্ট।
    ওর মনে হচ্ছে সব কিছু থেমে গেছে। বড় স্ট্যাগন্যান্ট । নিথর। প্রাণহীন। রিলিফ চাই এর থেকে।
    খুব ঝড় উঠুক একটা। ওলোট পালট হয়ে যাক সব। সবকিছু

    পলিজ নেস্ট। যদিও এপ্রিলের শেষে চেঙ্গালা বেশ গরম, বাতাস অতি ভারি, আর্দ্র,মাঝে মাঝেই বৃষ্টি হচ্ছে। পলিজ নেস্ট একেবারে ঝলমল করছে। অনিলের কোয়ারান্টাইন পিরিয়ড শেষ, আউটহাউসের বন্দি, নির্বাসিত জীবন ছেড়ে অনিল পরিবারে ফিরবেন। বাড়িতে খুশির আমেজ। পলির মা ও বোন এসেছেন। ওঁরা চেঙ্গালাতেই থাকেন। আসবেন লোকাল চার্চের পাদ্রি ম্যাথু স্যর। ভেঙ্কটেশ সকাল থেকেই আছে। খাটাখাটনি করে চারদিক দেখেশুনে রাখছে । দুবাইতে গেছিলেন পাঁচমাস আগে। ফিরেই হোম কোয়ারেন্টাইনের এই নিঃসঙ্গ পর্যায়। আজ অনিলের মুক্তির দিন। পুরোপুরি নেগেটিভ রিপোর্ট এসেছে। অচ্ছুতবাসের প্রতিটি দিন ছিল অন্ধকার যাপন । যেন কেউ তাকে ফেলে দিয়েছে পিছলে এক অন্ধকূপে। যার তলা থেকে তিনি বাইরের আলোটুকু কোনোমতে দেখতে পেতেন শুধু।
    কোভিডের নাম শুনলেই যেন আতঙ্ক । কোভিড যেন সেই ভয়ঙ্কর দৈত্য,যে কাউকে ছাড়ে না। গলায় ঢুকে বাসা বাঁধে। তারপর ধীরে ধীরে ফুসফুসের দিকে হাত বাড়ায় । ফাইব্রোসিস নামক সেই অজানা ভয়ের জ্বরে ভুগেছেন কতদিন অনিল। কবে রিপোর্ট আসবে। হা পিত্যেশ করে থাকা। রোগভয় সর্বাপেক্খা ভয়ঙ্কর । প্রতিটি মুহূর্তকে কুরে কুরে খায় কুটিল ছাইরঙা ধোঁয়ার মত। এই কোয়ারেন্টাইন কালে অনিল যে কতদিন মরে মরে বেঁচেছেন, তা তিনিই জানেন।
    সকাল সকাল স্নান সেরেছেন আজ। চুল ব্যাকব্রাশ করে আঁচড়ানো। আউটহাউসের স্নানঘরের জানালা দিয়ে একটা জবাফুলের গাছ দেখা যায় । একটা কলাগাছের পাশেই ফুটে আছে থোকা থোকা জবা। স্নান করতে করতে অনিল দেখলেন অঁজবাফুলের লাল আভা ছড়িয়ে পড়েছে কচি পকলাপাতারঙে। কী আশ্চর্য সুন্দর রঙ ধরেছে! মুহূর্তে তিনি নিজের লাংসের অচেনা স্পটটার কথা ভুলে গেলেন। অথচ তিনসেকেন্ড আগেও গায়ে সাবান মাখতে মাখতে তিনি বিমর্ষভাবে ভাবছিলেন স্পটটার ম্যালিগন্যান্সির কথা। সে কতটা ভয়াবহ রূপ ধারণ করতে পারে ভেবে কেঁপে ওঠেন প্রতিবার স্নানে। ঐ গভীর উৎকন্ঠা ভেতরে চেপে তাঁর গৃহপ্রবেশ। তবু সকালবেলা কচি কলাপাতার গায়ে জবাফুলটি তাঁর মন ভালো করে দিল। এটুকু ভালো লাগা সম্বল করে অনিল টমাস আউটহাউসের বাইরে পা দিলেন।
    চার্চে যাওয়া যাবে না। কনগ্রিগেশন বন্ধ। তাই পলি ম্যাথু স্যরকে ডেকেছেন একটি প্রার্থনার জন্য। স্যানিটাইজেশনের নিয়ম মেনে , হাত ধুয়ে, মুখে মাস্ক পরে প্রার্থনা হচ্ছে দেবদারু গাছটির নিচে। ভেঙ্কটেশ একটু দূরে দাঁড়িয়ে । ও ক্রিশ্চান নয়। তবু থ্রিশুরের ভদ্দকুনাথ্থমের মন্দির থেকে প্রসাদ আনিয়েছে ভেঙ্কটেশ। অনিলকে সে তীব্র ভালবাসে। ভদ্দকুনাথ্থমের শিবমন্দিরের অনেক নামডাক। মে মাসের দ্বিতীয় তারিখে সেখানে বড় সড় পূজা হয়। এবার সব বন্ধ । ভেঙ্কটেশ ক্যুরিয়ার করে প্রসাদ আনিয়েছে।
    পলির ভুবন জুড়ে ছোট বড় খুশি খিলখিল করে হেসে বেড়াচ্ছে । রান্নাঘরের চিমনি থেকে, ওয়াটার কুলার থেকে ঝরে পড়ছে আনন্দ। পলি টুপ করে ধরে তাদের নিজের স্কার্টের লেসে বসিয়ে দিচ্ছেন। মালাবার পরোটার গন্ধে উদ্ভাসিত রান্নাঘর। অনিলের প্রিয় পার্লস্পট মাছ আনিয়েছেন বহুকষ্টে। সঙ্গে রেখেছেন কেরালাস্টাইল প্রণ। দুটোই খুব কষ্ট করে পেতে হয়েছে কারণ লকডাউনে বন্দরে মাছ আটকে আছে। পচে যাচ্ছে। সরকারের পক্ষ থেকে কিছু মাছ বিক্রি করা হচ্ছে মোটামুটি একটা চলনসই দামে। প্রণটা বেশ থকথকে একটা কারি হয়। সবাই পছন্দ করে। পলির মা তৈরি করে নিয়ে এসেছেন বানানা ফ্রিটার্স। এরিসারি। লাঞ্চের জন্য সেজে উঠেছে এতদিন বিষন্ন নিষ্প্রদীপ হয়ে পড়ে থাকা হলঘর। অল্টারে যিশুকে ঘিরে টুনির মালা দুলছে।
    ম্যাথ্যু স্যর কিছুই খাবেন না। পলি জোর করে কফি আর স্যান্ডউইচ নিয়ে আসছে ট্রেতে করে। বাচ্চারা হুড়োহুড়ি করছে পলির বোন মারিসার সঙ্গে । পলির মা কিচেনে। একটা স্যুপ জাতীয় কিছু ফুটছে। বাগানে দাঁড়িয়ে কফিতে চুমুক দিচ্ছেন ম্যাথু স্যর। এপ্রিলের শেষ থেকে মে'র প্রথম হপ্তা পর্যন্ত যে চার্চ ফেস্টিভ্যাল হয়, এবার সেটি বন্ধ ।

    সবমিলিয়ে এক বর্ণময় উদযাপন দীর্ঘদিন পরে। অনিলের মনে বহুদিন এই ছবিটা গেঁথেছিল। সদর দরজার সামনে কাঁচি দিয়ে শিকলি কেটে ওয়েলকাম লিখেছে বাচ্চারা। সাবাইঘাসের বুনোটে নির্মাণ যে ডোরম্যাটের, সেও বলছে ওয়েলকাম। চারদিকে পরম অভ্যর্থনার বাতাবরণ তৈরি করে রেখেছেন পলি। সবকিছু নিখুঁত প্রায় । ঠিকঠাক । এবার কাজে মন দিতে হবে। আইসোলেশনে থাকাকালীন চেষ্টা করেননি তা নয়। কিন্তু পারেননি। কনসেনেট্রশন আসেনি। তীব্র ভয় আর অবসাদ । লিম্বো। অনিল নরকের প্রান্ত থেকে ফিরে এসেছেন।
    মার্কেটিং এর কাজ বড় ঝক্কির। অনেক কিছু একসঙ্গে সামলাতে হয়। কোভিডের ফলে মার্কেট সার্ভে পুরোপুরি বন্ধ। এবার এম ডি' র সঙ্গে মিটে বসতে হবে। আইসোলেশনে থাকাকালীন একদিন দুদিন গুগল মিটে গিয়ে কনসেনট্রেট করতে পারেননি। বসকে মেসেজ করে লিভ করেছেন। এবার কিছুটা কাজের দিকে ফিরতেই হবে।

    অনিল বাড়িতে ঢুকবেন আজ। বুকের ভেতরে একটা গভীর আইসোলেশন। শারীরিক আইসোলেশন তবু সহ্য হয়। মানসিক আইসোলেশন বড় যন্ত্রণার । কারু সঙ্গে শেয়ার করতে পারছেন না। পলিকে পর্যন্ত না।
    ত্রিদিব ওয়াইফকে নিয়ে খুব ডিস্টার্বড। শী হ্যাজ গান টু ডিপ্রেশন। দেবরূপের ফোন পাওয়া যাচ্ছে না। সামথিং মাস্ট বি রং উইথ দ্যাট বয়। এখানে সবচেয়ে রিলায়েবল ফাদার ম্যাথ্যু। তাঁকে বলা যায় । কিন্তু আজকে তিনি সারাউন্ডেড। আজ কিছুই বলা যাবে না। আজ আনন্দের দিন। আজ গৃহপ্রবেশের দিন।
    শুধু অনিলের সঙ্গে সঙ্গে গৃহপ্রবেশ হচ্ছে যার , তাকে কেউ দেখতে পাচ্ছে না। তার নাম নাম ভয়।
    যদি ক্যান্সার বাসা বাঁধে। যদি?✨

    কালুর গলাতে কোপ পড়তো সেদিন, যদি না বরের হাতে প্রকান্ড মার খেয়ে চিৎকার করে কাঁদতে কাঁদতে বেরিয়ে এসে শ্যামার দরজার ওপর আছড়ে পড়তো চার মাসের পোয়াতি বেলিরাণী। রঙ ফর্সা। গোলপানা মুখে নাকে নাকছাবি। মুহুর্তে কালু , বুলন যারা জানালা দিয়ে হায়নাসদৃশ হাসছিল তারা সরে যায় । এরা সাধারণত পারিবারিক লফড়ার মধ্যে থাকে না। অল্পবয়সী কুমারী মেয়ে, মাঝবয়সী বিধবা বা স্বামী পরিত্যক্তা এবং সহায়সম্বলহীন নারী এদের টার্গেট। বেলির পিছন পিছন ছুটে আসছে চ্যালাকাঠ হাতে বর। মদ খেয়ে টলছে বিকেলবেলাতেই। বেলি জড়িয়ে ধরেছে শ্যামাকে। আশেপাশের কেউ আসবে না। বরের কাছে মার খাওয়ার ন্যায্য অধিকার বেলিকে পালন করতে দেয় এরা। বেলির গোল মুখে নাকে নাকছাবি। ফর্সা। ডিগডিগে রোগা। কেঁদে মুখ লাল। আর শ্যামা । শ্যামা সুন্দরী । মা মরা রোগাপাতলা যে শ্যামা মাসির কাছে মানুষ পান্তা খেয়ে মানুষ, সুখনলালের সঙ্গে বিয়ে হয়ে যে হাতে স্বর্গ পেয়েছিল, বর ভেগে গেলেও যে আষ্টেপিষ্টে বেঁধে রেখেছিল সংসারের ইঁট কাঠ, তার চুল খোলা। একহাতে ধরে আছে বেলিকে। অন্য হাতে আঁশবটি। চিৎকার করছে। যেন কাকচিল বসতে না পারে। মাসি বলেছিল , ফোঁস করবি শ্যামা । ছোবল দিতে হবে না। কিন্তু ফোঁস করতে ছাড়বি না। নরম মাটিতে বেড়াল আঁচড়ায় বেশি। আর,হরপ্রীত বলে কিসি এককো মারকে তো দেখ। আউরত কে তরফ সেলডিফেন্সকা বহত কানুন হ্যায় । ছোড়না নহি। জমকে রহনা।
    বেলি কালু বুলনকে ঠেলে চলে এসেছে ঘরে। শেয়ালগুলো ভেগেছে। বাইরে ফুঁসছে বেলির বর। শ্যামার মুখ ছুটছে। পাগল হয়ে গেছে যেন।
    - আ যা। আয়। মরদের বাচ্চা হলে আয়। আঁশবটি নাচছে। যেন খাঁড়া।
    ঐ দুবলা বেলি শ্যামার হিম্মত ।
    - দেখা। হিম্মত হ্যায় তো আ। হরপ্রীতের সঙ্গে থেকে হিন্দি বলে শ্যামা । যখন রাগে। আকাশে মেঘ ডাকছে গুড়গুড় । বৃষ্টি নামবে। অথবা নামবে না। যে মেঘ গর্জায় সে মেঘ বর্ষায় না।
    ঋষি কাপুর কখন সানি দেওল হয়ে গেছেন। বলছেন, মার শ্যামা । তু হিম্মতওয়ালি হ্যায়। বহত দম হ্যায় তুঝমে। মার।
    সানির চোখে আশ্বাস। ঢাই কিলোর হাত শ্যামার নেই তো কী হয়েছে, একটাকে মারতে তো পারবে।
    শ্যামা কাকে মারতে চলেছে? বেলির বরকে না কালুদের? শুয়ার। হারামির বাচ্চা। মুখ দিয়ে গ্যাঁজলা। টক জল উঠে আসে।
    খানিকটা দাঁড়িয়ে থেকে বেলির বর চলে যায় । শরীর টলে । মাথা ঘোরে শ্যামার। ধপ করে বসে পড়ে মাটিতে। বটি পড়ে গেছে হাত থেকে । কাঁপছে থরথর করে। তার নিজের গলায়, শরীরে এত জোর ছিল? আগে তো বোঝেনি কখনো!
    বেলি কাঁদতে থাকে। কী হল তোমার দিদি? দিদিগো!আপদে বিপদে শ্যামাই তো ভরসা বেলির।

    ঐ সময়ে লেডিজ সাইকেল থেকে নেমে ঘরে এসেছিল হরপ্রীত কাউর। হলুদ সালোয়ার কুর্তা । ম্যাচিং মাস্ক। হোমডেলিভারি শেষে দেখতে এসেছে শ্যামা ঘরে ঢুকল কিনা। শ্যামার ব্যাটাকে আনেনি এখন।

    মেঝেতে পড়ে শ্যামা । মুখে জলের ছিটে দিতে দিতে হরপ্রীত বলে, উঠ যা। উঠ শামা। কোই নেই উঠায়েগা তুঝে। খুদকো উঠনা পড়েগা। বহোত কাম বাকি। নিউজমে বোলা, সাইক্লোন আ রহা । এক তো করোনা হ্যায় হি। উসকি উপর ইয়ে ক্যা সাইক্লোন আ রহা হ্যায়। কাম লিপটানা হ্যায় ।
    ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়েছিল বেলি। শ্যামার চোখ মুখ ভরা বিস্ময়। যেন একটা ঘোরের মধ্যে । হরপ্রীতের হাত চেপে ধরে বলল, " বাবলু কোথায়, বাবলু? বাবলুকে আনিসনি? "

    বেঁচে থাকার অদম্য তাগিদে শ্যামা হরপ্রীতের হাত ধরে উঠে বসে। বৃষ্টি নেমেছে অঝোরে। শ্যামার দুচোখ জলে ভেসে যাচ্ছে। বাবলুকে আনলি না?
    নতুন করে সংসার পাতবে যেন। বাবলু আর শ্যামা । মা ব্যাটার সংসার। দরকার নেই আর কাউকে। মাঝেমাঝে হরপ্রীত বা বউদির হাত পেলেই হল। কিংবা বেলি। দরকারে দুবলা প্রাণীও কাজে দেয় । শ্যামা বিলক্ষণ বুঝেছে।

    এবার একা লড়বে সে। ভয় নেই আর।
    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।
  • ধারাবাহিক | ২১ জুন ২০২০ | ১২৭৮৭ বার পঠিত
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • পাঠক | 2409:4065:18a:397f:2dfe:54c9:f9e5:***:*** | ২২ জুন ২০২০ ১৫:০৯94533
  • পরের পর্ব ?
  • স্বাতী রায় | 2402:3a80:a87:8492:2f91:95d2:26e6:***:*** | ২৯ জুন ২০২০ ০০:৩৮94697
  • এই লেখাটা খুবই ভালো লাগছে। বাস্তবআশ্রয়ী। নিখুঁত ছবি। পুরোটা একসঙ্গে করে বই হলে ভালো হয়। 

  • | ২৭ আগস্ট ২০২০ ১৫:৩৩96701
  • চমৎকার। করোনার প্রায় সবকটা দিক এসেছে, এসেছে পশ্চিমবঙ্গের বাইরের রাজ্যাগুলোও।
  • এষা সান্যাল | 42.***.*** | ১৪ সেপ্টেম্বর ২০২০ ১৯:৩৫97238
  • এক অভিনব অভূতপূর্ব পরিস্থিতির মধ্যে দিয়ে চলেছে আজকের পৃথিবী। প্রায় রাতারাতি বদলে যাচ্ছে জীবন এবং তার আনুষঙ্গিক নিয়মকানুন অভ্যেস আর তৈরি হয়ে উঠছে এক অন্য জগৎ অন্য পরিবেশ নতুন আচার বিচার। এই অবস্থান্তরের ছবি এঁকেছেন অনুরাধা কুন্ডা তাঁর উপন্যাস 'করোনাকালীন' এ। আজকের বর্তমান কে পরবর্তীর জন্য সঞ্চিত করার এক অসামান্য প্রয়াস এই লেখাটি। সমাজের বিভিন্ন স্তরকে পরতে পরতে খুলে ধরেছেন পাঠকের কাছে এবং বাধ্য করেছেন তাদের সেই বিভিন্ন স্তরের মধ্যে কোথাও নিজেকে খুঁজে পেতে। কখনো কলকাতায় তো কখনো পুনে বা কেরালায়, কখনো উচ্চবিত্তের ফ্ল্যাটে তো কখনো শহরের বস্তিতে, কখনো ত্রিদিব মালবিকার সম্পর্কে তো কখনো শ্যামা সুখনের, রাস্তায় মৃত্যু হওয়া শ্রমিক বা নার্সিং হোমে মালবিকার মায়ের মৃত্যুর মধ্যে অনায়াসে ঘুরেছি আর চমকে উঠেছি কখনো কখনো চেনা চেহারা বা পরিস্থিতি দেখে। অবাক হয়েছি কিভাবে শরীরের অসুখ পৌঁছে গেছে মননে। উপন্যাসটি এই সময়ের এক প্রামাণিক দলিল হয়ে থাকবে। অনুরাধা যে মনোযোগ সহকারে গল্পের মধ্যে সমসাময়িক বিভিন্ন তথ্য মিশিয়েছেন তা যেকোনো প্রশংসার দাবিদার। দেশে অসুখের সূচনা, ঠিক অথবা ভুলভাবে তার মোকাবিলা করা, অন্য প্রদেশে কর্মরত শ্রমিকদের পদব্রজে ঘরে ফেরার চেষ্টা, অসুখটির বৈজ্ঞানিক পরিচয় এবং সেটিকে ঘিরে নানা মুনির নানা মত এই সমস্ত তথ্য লেখক পরিবেশন করেছেন গল্পকথায় মিশিয়ে। আমার কাছে এইটি একটি বড় প্রাপ্তি এই উপন্যাস থেকে। আশা করছি প্রকাশকালে অনুচ্ছেদ ও পরিচ্ছেদের দিকে আরেকটু নজর পড়বে। ধারাবাহিকে একটু অসুবিধা হয়েছিল পড়তে। অনুরাধা কুন্ডা কবি,গল্পকার, নাট্যকার, নাট্য ও চিত্রপরিচালক ও আরও বিভিন্ন পরিচয়ের অধিকারী। এই পরিচয় তালিকায় যোগ হচ্ছে ঔপন্যাসিক। 'করোনাকালীন' শেষে অপেক্ষায় আছি তার উত্তরকথার।

  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : guruchandali@gmail.com ।


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। খারাপ-ভাল মতামত দিন