সমৃদ্ধ একজীবন কাটিয়ে শ্রদ্ধেয় জাতীয় অধ্যাপক আনিসুজ্জামান চির ঘুমের দেশে পাড়ি জমিয়েছেন গত ১৪ই মে। হাজার মানুষের উপস্হিতিতে শ্রদ্ধা-ভালোবাসায় তাঁকে বিদায় জানানো সম্ভব হয়নি। বর্তমান সময়টা গোটা পৃথিবীর জন্যেই ‘বড় সুখের সময় নয়’। পৃথিবী আজ নিদারুণ এক দুর্যোগের মুখোমুখি। এসময় আত্মার পরম আত্মীয়দের দূর থেকে বিদায় জানানোর নিঠুর এক রীতির ঘেরাটোপে বন্দী আমাদের যাবতীয় মানবিক আবেগ। অধ্যাপক আনিসুজ্জামানকেও তাই প্রায় নীরবে বিদায় জানাতে হয়েছে। শেষবারের মতো চোখের দেখাটা দেখতে না পাওয়ার আফসোস আমাদের ভোগাবে নিশ্চিত। বাংলাদেশের একজন প্রজ্ঞাবান অভিভাবক বিদায় নিয়েছেন- আমাদের জাতীয় জীবনে নিঃসন্দেহে তাঁর চলে যাওয়ার ক্ষতি পূরণযোগ্য নয়। আমাদের আবেগ উদ্বেলিত মনকে এই বাস্তবতা হয়ত শান্ত রাখবে, শারীরিকভাবে তিনি চলে গেছেন ঠিকই; কিন্তু বাংলাদেশের ইতিহাস-ঐতিহ্যের পরতে পরতে যে কর্মযজ্ঞের স্বাক্ষর তিনি রেখে গেছেন, সেগুলোর মধ্যেই আমরা তাঁকে খুঁজে পাবো।
বাংলাদেশের জন্ম ইতিহাসের সাথে প্রায় ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে আছে অধ্যাপক আনিসুজ্জামানের জীবন। তিনি পশ্চিমবঙ্গের চব্বিশ পরগনা জেলার বসিরহাটে জন্মালেও জন্মভূমির মাটি, আলো, বাতাস তাঁর কপালে সয়নি। স্বার্থপর মানুষের ততোধিক স্বার্থান্বেষী রাজনৈতিক কূটকাচালির জেরে হাজারো ঘরছাড়া মানুষের স্রোতে হোমিওপ্যাথি ডাক্তার বাবা, ও মায়ের হাত ধরে তিনিও চলে আসেন পূর্ব বাংলায়। তখন তাঁর বয়স মাত্র দশ কি এগারো। কলকাতার পার্ক সার্কাস স্কুলের সপ্তম শ্রেণীর ছাত্র ছিলেন তখন। শৈশবের স্মৃতি তাঁর বুকের গভীরে কতটুকু আঁচড় বসিয়েছিল, কতটা ক্ষোভ কিংবা হতাশার স্মৃতি তিনি তিনি তাঁর পাঁজর ঘেঁষে জমা রেখেছিলেন সেটি খুব বেশি জানা নেই। নিজ ভূমি ছেড়ে আসা এই মানুষটি প্রথমে পূর্ব বাংলা পরে বাংলাদেশ নামের ভূখণ্ডটিকেই তাঁর আত্মার কাছাকাছি ঠাঁই দিয়েছিলেন। দেশ ভাগের মর্মপীড়া থেকে একদা যে মানুষ তাঁর শিক্ষক, তৎকালীন জাতীয় অধ্যাপক আব্দুর রাজ্জাককে বলতে দ্বিধা করেননি, “স্যার, আপনারা একবার দেশ ভেঙেছেন আরেকবার ভাঙতেও আপনাদের বাধা লাগবে না। ওই ভাঙাটাই ঠিক হয়েছে কিনা, স্থির করতে পারছি না; আরো একবার ভাঙার কথা আমরা ভাবতে পারি না।” সেই মানুষ ‘৭০ এর নির্বাচনে আওয়ামীলীগ সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভের পরও ভোটের রায়ের তোয়াক্কা না করে শাসনতন্ত্র স্হগিতপূর্বক সামরিক শাসন জারি করে আইয়ুব খান যখন দেশের সমস্ত ক্ষমতা ইয়াহিয়ার হাতে তুলে দেন তখন-- “এরপর আর (দেশের) দুই অংশের এক থাকার কোনো অর্থ থাকলো না।”র মতো ত্বরিত সিদ্ধান্তে পৌঁছাতে কোনো দ্বিধায় ভোগেননি। কারণ পূর্ব বাংলাই তখন তাঁর আত্মার পরম আত্মীয় হয়ে দাঁড়িয়েছে, যার ভালো মন্দে তিনি নিজেও জড়িয়েছেন স্বার্থচিন্তা বাদ দিয়ে।
এমন বিশাল প্রাজ্ঞ একজন মানুষকে নিয়ে কিছু লিখতে গেলে যে মাত্রার পড়াশোনা লাগে স্বীকার করতে দ্বিধা নেই আমার সেটা একেবারেই নেই। আত্মীয়তার সূত্রে তিনি পরিচিত হলেও তাঁর কর্মযজ্ঞের বিশাল পরিমণ্ডলের সাথে তেমন পরিচয় ঘটেনি বললেই চলে। তাঁর গবেষণা বাংলা ভাষা- সাহিত্যের ভাণ্ডারকে সমৃদ্ধ করেছে, বাংলা ভাষার চেতনাকে তিনি তুলে ধরেছেন অনেক অগ্রগামী চিন্তা চেতনার মাধ্যমে। তাঁর সমসাময়িক অনেক অধ্যাপককে ছাড়িয়ে তিনি উঁচুতে উঠতে পেরেছিলেন যে একনিষ্ঠতার কারণে, সেই একনিষ্ঠ চিন্তাধারাই বাংলাদেশের সাহিত্যিক পরিমণ্ডলকে সমৃদ্ধ করে রেখেছিল এতকাল। তাঁর অভাব পূরণ হবার নয়। এ ছাড়া বাংলা সাহিত্যে অল্প কজন মুক্ত চিন্তার অধিকারী আছেন, তিনি তাঁদের অন্যতম।
স্বাধীনতার পর আনিসুজ্জামান মাতৃভাষায় নতুন রাষ্ট্রের সংবিধান রচনায় যোগ দিয়েছিলেন। দেশে যখনই মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ভূলুণ্ঠিত হয়েছে, তখনই শোনা গেছে তাঁর দৃঢ় কণ্ঠ। জেনারেল হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের সামরিক স্বৈরতন্ত্রের সময়ে নাগরিক–সমাজের হয়ে প্রতিবাদী ভূমিকা রেখেছিলেন। শহীদজননী জাহানারা ইমামের নেতৃত্বে গড়ে ওঠা ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির আন্দোলনে ছিলেন অগ্রণী। গণ–আদালতে অভিযোগ এনেছেন একাত্তরের গণহত্যার পুরোধা গোলাম আযমের বিরুদ্ধে।
তিনি এক সমৃদ্ধ সৃষ্টিভাণ্ডার রেখে গেছেন আমাদের জন্য। প্রবন্ধ, ভাষা ও সাহিত্য বিষয়ক গবেষণা, আত্মজীবনী, এমনকি গল্পকার না হয়েও গুটি কয়েক ছোটো গল্পও তিনি রচনা করেছেন। মানের বিচারে তাঁর অপরাপর সৃষ্টির তুলনা সেগুলো বেশ দুর্বল। এর মধ্যে তাঁর যে গল্পটি পড়ে ভালো লেগেছে সেটি নিয়ে সামান্য একটু বলবার লোভ হচ্ছে। গল্পটির নাম ‘দৃষ্টি’। অতি সাদামাটা একটি আখ্যান- তার ভেতর যেন লুকিয়ে আছে ‘৭১ পূর্ববর্তী বাঙালির জাতীয় সংকট এবং তা থেকে উত্তরণের ইঙ্গিতময় মুহূর্ত। গল্পের কেন্দ্রিয় চরিত্রটি চশমা ছাড়া দৃষ্টিহীন প্রায়। পাকেচক্রে তাঁর চশমাটি ভেঙে গেছে এবং অর্থনৈতিক সচ্ছলতা না থাকায় তৎক্ষণাত আরেকটি চশমা নেবার সামর্থ তাঁর নেই। এ বর্ণনা যেন পশ্চিম পাকিস্তান কর্তৃক পূর্ব পাকিস্তানকে শোষণের প্রতিভু। ‘আসাদ’ এ গল্পে বৃদ্ধের ছেলে এবং ইতিহাসের সত্য মেনে আবশ্যিক ভাবে সে শাসকের চালানো গুলিতে নিহত হয়। আমার যেটা সবচে’ চিত্তাকর্ষক মনে হয়েছে সেটা হচ্ছে নিহত আসাদ চরিত্রের স্ত্রীর নাম ‘হাসিনা’। চরিত্রটি সন্তান সম্ভবা। যে কিনা ধারণ করে আছে ভবিষ্যতে অপার সম্ভাবনার উৎস। কেন জানিনা পাঠক হিসেবে এমনটা ভাবতে ভালো লেগেছে যে, আলোচ্য গল্পে প্রতীকের মাধ্যমে তিনি বাংলাদেশের ইতিহাসের খণ্ডচিত্রই বুঝি তুলে ধরেছেন। জানিনা পাঠকের এ ভাবনা কতটুকু যৌক্তিক।
যে দেশ শুধুমাত্র একটি ভূখণ্ড মাত্র নয়, তার সাথে জড়িয়ে ছিল তাঁর যাবতীয় আবেগ। সবাই সে আবেগ বুকে ধারণ করেন না হয়ত। আনিসুজ্জামান নিঃসন্দেহে সেইসব ব্যতিক্রমীদের কাতারে পড়েন যাঁরা দেশের যে কোনো ডাকে নিরন্তর যুক্ত থাকেন। বায়ান্ন থেকে শুরু করে আমৃত্যু দেশের প্রতিটি রাজনৈতিক-সামাজিক আন্দোলন কিংবা প্রয়োজনে একজন দেশ-সমাজ সচেতন মানুষ হিসেবে অগ্রণী ভূমিকা রাখতে কখনও পিছিয়ে থাকেননি। কারণ তিনি মনেপ্রাণে বিশ্বাস করতেন “শুধু ধর্ম বা ভাষার বন্ধনে মানুষ এক হয় না; মানুষের ঐক্যের জন্যে দরকার হয় উচ্চতর আদর্শ বোধ।” মুহূর্তকালের জন্যেও তিনি তাঁর আদর্শবোধ এবং সততা থেকে বিচ্যুত হননি। দল বা ব্যক্তি তাঁর কাছে গণ্য ছিল, রাষ্ট্রই ছিল মুখ্য। দেশ ছিল তাঁর অন্তর জুড়ে!
অন্যায় দেখলে রুখে দাঁড়িয়েছেন, সেটা পাকিস্তানী সেনাবাহিনীই হোক কিংবা স্বদেশী স্বৈরাচারী শাসক।
১৯৭১ সালে যখন পূর্ব বাংলায় পাকিস্তান বাহিনী খুব সন্তর্পণে নিজেদের গুটি সাজাচ্ছিল, বাতাসে বৈরি আবহাওয়ার ফিসফাস চললেও যুদ্ধের আলামত তখনও সেভাবে মুখোশ খুলে থাবা বসায়নি। সেরকম এক পরিস্হিতিতে পাক বাহিনীর সাথে মুখোমুখি সংঘর্ষে নামতেও দ্বিধা করেননি। ঘটে যাওয়া অন্যায় দেখে চেপে যাওয়া তাঁর স্বভাবে ছিল না। এ প্রসঙ্গে তাঁর মুখ থেকে শোনা যাক ঘটনা-
“চট্টগ্রামে পাকিস্তানি সেনাদের সঙ্গে প্রথম মুখোমুখি সংঘর্ষ হয় এই অধমের, সেকথা ইতিহাসে লেখে না। সেজন্যেই তো স্মৃতিকথা লেখার দরকার হয়। ১৪ ফেব্রুয়ারি সকালে আমাদের পারিবারিক বন্ধু আজহার সুফিয়ানীর শিশুসন্তানের মৃত্যুসংবাদ পেয়ে স্ত্রী বেবীকে নিয়ে আমার ফোক্সওয়াগেন চালিয়ে চট্টগ্রাম শহরের দিকে রওনা হই। বিশ্ববিদ্যালয়ের এক নম্বর সড়ক বলে যে অপরিসর আঁকাবাঁকা রাস্তা তখন ছিল,তাতে প্রবেশ করে দেখি, সামরিক বাহিনীর একটি গাড়ি লাল পতাকা উড়িয়ে আসছে, তার পেছনে আসছে একটি ট্যাংক। আমার গাড়ি দেখামাত্র লাল পতাকাওয়ালা গাড়ি থেকে একজন ইশারা দিল সরে যেতে। কিন্তু আমার বাম দিকে বড়ো নালা, শুকনো হলেও অগভীর নয় এবং দীর্ঘ। যতোটা পারলাম বায়ে চেপে গাড়ি দাঁড় করালাম । লাল পতাকা চলে গেল, তারপরই ট্যাংকটা আমার গাড়িতে ধাক্কা লাগিয়ে, ডান দিকের ফেন্ডার দুমড়ে দিয়ে, কিছু দূর গিয়ে থামলো। কিংকর্তব্য স্থির করার আগেই দুই সেনানী আমার কাছে এসে কৈফিয়ত চাইলো,তাদের একসারসাইজের সময়ে কেন আমি ওই রাস্তায় ঢুকেছি। আমি বললাম, এই রাস্তায় যান-চলাচল বন্ধের কোনো বিজ্ঞপ্তি নেই, চিহ্ন নেই; আমি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, শহরে যাবার এটাই একমাত্র পথ এবং রাস্তাটাও বিশ্ববিদ্যালয়ের। তারা বলল, দু নম্বর রাস্তায় লাল পতাকা দেওয়া হয়েছে। আমি বললাম, এটা এক নম্বর রাস্তা। তারা বলল, তুমি কি জানো যে, ইচ্ছে করলেই ট্যাংক থামানো যায় না, ট্যাংকের নিচে গাড়িসুদ্ধ তোমাকে পিষে ফেললেও আমাদের কিছু হতো না। আমি বললাম, তোমাদের উচিত ছিল রাস্তায় ঢোকার মুখে বাধা দেওয়া। তারা বললো, ভাগ্যের জোরে তুমি বেঁচে গেছো-একে দোষ করেছ, তার ওপরে আবার তর্ক!”
ঘটনার সেখানেই ইতি ঘটেনি, কারণ দোষ মোটেও তাঁর তরফে ছিল না যার কারণে তিনি মুখে বুঁজে হেনস্তাটা মেনেও নেননি। বিষয়টি ফয়সালার উদ্দেশ্যে তিনি- “ চট্টগ্রাম ক্যান্টনমেন্টে সি.ও. ব্রিগেডিয়ার এম. আর. মজুমদার চট্টগ্রামে নেই জেনে চাইলাম তাঁর দু নম্বরকে। শুনলাম, তিনি কর্নেল এইচ এস শিগরি। নিজের পরিচয় দিয়ে তখনই দেখা করতে চাইলে তিনি তাঁর কোয়ার্টারে যেতে বললেন। গেলাম এবং যথারীতি নালিশ জানালাম। তিনি কাকে যেন ফোন করলেন। তারপর বললেন, সকালে তোমাদের এলাকায় -একসারসাইজ হওয়ার কথা, কিন্তু রাস্তার মুখেই যান-চলাচল নিষেধ করে বোর্ড থাকারও কথা। যারা গেছে, তারা ফেরেনি। আমি তো তোমার গাড়ি চাক্ষুষ করলাম, আমি দুঃখ প্রকাশ করছি, তুমি লিখিতভাবে নালিশ করো, আমরা ব্যবস্থা নেবো।”
“আমার একাত্তর” নামের আত্মজীবনীমূলক বইটিকে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের একটি গুরুত্বপূর্ণ দলিল বলা যায়। বইটিতে তিনি ডায়রির ভঙ্গিতে প্রায় ধারাবাহিকভাবে প্রবাসী সরকারের নানা খুঁটিনাটি বিষয়সহ আগরতলা-ভারতে আশ্রয় নেয়া শরণার্থী জীবনের নির্মোহ বর্ণনা দিয়েছেন। তখন তিনি বয়সে খুব নবীন হলেও সাংগঠনিক দক্ষতার জোরে বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পদে নিযুক্ত হয়েছিলেন।
মুক্তিযুদ্ধের একজন অন্যতম সংগঠক হিসেবে তিনি প্রবাসী সরকারের পরিকল্পনা কমিশনের একজন গুরুত্বপূর্ণ সদস্য ছিলেন। ব্যারিস্টার আমিরুল ইসলামের পাশাপাশি তিনিও প্রবাসী সরকারের প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমেদের বহু ভাষণের লেখক ছিলেন। অধ্যাপক এ. আর. মল্লিকের সাথে তিনিও ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর সাক্ষাতপ্রার্থী বাংলাদেশ প্রতিনিধিদলের অন্যতম সদস্য ছিলেন। সে সময়ে কলকাতায় গঠিত বাংলাদেশ শিক্ষক সমিতির সাধারণ সম্পাদক হিসেবে ভারতীয় বুদ্ধিজীবীদের মধ্যে জনমত গঠনে কাজ করেছেন। এছাড়া অন্যান্য শিক্ষক-বুদ্ধিজীবীদের মতো তিনিও বিশ্বব্যাপী পরিচিতি বুদ্ধিজীবীদের সাথে যোগাযোগের মাধ্যমে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ সম্পর্কে সংশ্লিষ্টদের দৃষ্টি আকর্ষণের জন্য চিঠিপত্র লেখালেখি করেছিলেন। বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতা ঘোষণার ইংরেজি ভার্সনটি তিনি টেলিফোন মারফত শুনে লিপিবদ্ধ করেন। এ বিষয়ে তাঁর বয়ানটি শুনে নেয়া যেতে পারে-
“বেলা তিনটের দিকে সংগ্রাম পরিষদের সদর দপ্তর থেকে ছাত্রলীগের এককালীন নেতা ও প্রতিরোধ-সংগ্রামের কর্মী রফিকুল আনোয়ার বাসায় আমাকে ফোন করে বলেন একটা জরুরি বার্তা লিখে নিতে । আমি কাগজ-কলম নিয়ে বসি এবং তিনি যেমন যেমন বলেন তেমনটিই লিখে নিই। এটাই ছিলো বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতা-ঘোষণা-ভাষ্যটা ছিল ইংরেজিতে । রফিকুল আনোয়ার অনুরোধ করেছিলেন, আমি যেন এটা ক্যাম্পাসে প্রচার করার ব্যবস্থা করি। তা করতে গিয়ে জানতে পারলাম যে, এরই মধ্যে চট্টগ্রাম বেতারের ফ্রিকোয়েন্সিতে স্বাধীন বাংলা বেতার-কেন্দ্রের অনুষ্ঠান থেমে থেমে শোনা যাচ্ছে এবং সেই বেতার-কেন্দ্র থেকে এম এ হান্নান একই ঘোষণার বাংলা পাঠ পড়ে শুনিয়েছেন। যখন বার্তাটি আমি লিখে নিই তখন গতীর বেদনার মধ্যেও রোমাঞ্চ অনুভব করেছিলাম । স্বাধীন বাংলা বেতার-কেন্দ্রের কথা জেনে আবার রোমাঞ্চ ও আশার সঞ্চার হলো।”
আত্মজীবনীতে নিজেকে আড়াল করে নির্লিপ্ত এক ভঙ্গিতে তিনি তুলে ধরেছেন যুদ্ধ দিনের নানা ঘটনা। যুদ্ধকালীন সময়েও মানুষের স্বার্থপরতা, দলকানাভাব, ঔদ্ধত্য, সামরিক বাহিনীর এক সদস্যের প্রতি অন্য সদস্যের অবজ্ঞা, মুক্তিযুদ্ধে প্রাণপাত করে দেয়া তাজউদ্দীনের বিরুদ্ধ বিদ্বেষ ছড়ানোর মতো ঘটনাবলীর তিনি ছিলেন নীরব সাক্ষী। মুক্তিযোদ্ধাদের ট্রেনিংয়ের ক্ষেত্রে ছাত্রলীগের কর্মীদের অন্তর্ভুক্তি বা সর্বদলীয় জাতীয় মুক্তিসংগ্রামের প্রতি আওয়ামী লীগের উদাসীনতা নিয়েও তিনি বলতে দ্বিধা করেননি। এই পরিস্হিতির গুরুত্ব বুঝে পদক্ষেপ গ্রহণ এবং সততার শিক্ষা তিনি পেয়েছিলেন তাঁর মায়ের কাছে। দেশকে ভালোবাসার পাঠও মা বাবার মাধ্যমেই তাঁর বুকে বাসা বেঁধেছিল তাতে সন্দেহ নাই।
বায়ান্নর প্রথম শহীদ মিনার তৈরির সময় তাঁর মা ছুটে গিয়েছিলেন শহীদদের বেদীতে মৃত কন্যার স্মৃতিচিহ্ন একটি সোনার চেন আন্দোলনের সাহায্য তহবিলে দেবেন বলে। পাকবাহিনী যখন শহীদ মিনার ভেঙে গুড়িয়ে দিয়েছিল সে ঘটনা তাঁর মায়ের বুকেও বেজে ছিল দারুণ ভাবে।
জাতীয় অধ্যাপক, দেশের একজন অগ্রগণ্য অভিভাবক হিসেবে একটা বর্ণাঢ্য জীবন কাটিয়ে চির ঘুমের দেশে পাড়ি জমানোর যাত্রাটি সব কিছু ঠিক থাকলে শহীদ মিনারের বেদীমূলেই উদযাপিত হতো। কিছু মানুষের জীবনই শুধু না মৃত্যুও উদযাপনযোগ্য হয়। আনিসুজ্জামান সেই দলের একজন। মৃত্যু তাঁকে শারীরিক ভাবে আমাদের কাছ থেকে নিয়ে গেল ঠিকই। কিন্তু তিনি থেকে যাবেন তাঁর প্রিয় বাংলাদেশের ছাপ্পান্ন হাজার বর্গমাইল জুড়ে। চলে গিয়েও আরো অধিকভাবে থাকে যাবেন তিনি। কারণ সব ‘চলে যাওয়া মানে প্রস্হান নয়’- তিনি ছিলেন, তিনি থাকবেন।
অবশ্যই এমন ‘চলে যাওয়া মানে প্রস্হান নয়’। সুলিখিত।
শ্রদ্ধা
বিনম্র শ্রদ্ধা। তাঁর মৃত্যু নাই